Categories
2021-July-Essay

তোর্সা বোস

নাচনি নাচ

নাচনি নাচ বিষয়টি মূলত ঝুমুর গানের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে সম্পর্কযুক্ত। এই নাচের ক্ষেত্রে মূলত উপস্থিত মহিলা নৃত্যশিল্পীগণ প্রথমেই রাধাকৃষ্ণের যুগল মূর্তিকে স্মরণ করে বা এক প্রকার আসর বন্দনা দিয়ে নাচ শুরু করেন। এই নাচের বিষয়বস্তু থাকত মূলত রাধাকৃষ্ণকে কেন্দ্র করে, অর্থাৎ, রাধাকৃষ্ণের প্রেম বিরহ লীলা ইত্যাদিকে ভিত্তি করে। প্রাচীনকাল থেকে মূলত পুরুলিয়া অঞ্চলের রাজদরবারে বিশেষত কাশিপুর রাজবাড়িতে এই নাচনি নাচের ব্যাপক প্রচলন ছিল। এই নৃত্যে বাদ্যযন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হত মাদল, ঢোল, সানাই, সিংগা, হারমোনিয়াম প্রভৃতি কখনো কখনো এর সঙ্গে বাজানো হত আড়বাঁশি। সেই প্রাচীনকাল থেকেই নাচনিদলে সাধারণত দশ থেকে কুড়ি জন শিল্পী থাকতেন দলের প্রধান পুরুষকে বলা হত রসিক এবং যে-সকল মহিলারা নর্তকী হিসেবে দলে নাচতেন তাঁদেরকেই বলা হত নাচনি।

নাচনি প্রথার উৎপত্তি:

পুরুলিয়ার মানভূম অঞ্চলে নাচনি প্রথার শুরু হয়েছিল মধ্যযুগীয় শিল্পী বরজুরাম দাসের হাত ধরে। ইতিহাসের সূত্র ধরে যদি আমরা নাচনি নাচ কোথা থেকে এসেছে তা জানবার চেষ্টা করি তবে দেখা যায় যে, মূলত উত্তর ভারতের বাইজি নাচের যে-সংস্কৃতি তাকে অনুকরণ করে এই নাচনি প্রথা বাংলায় আসে। তবে এ-কথা প্রথমেই জানিয়ে রাখি নাচনি নাচে, কিন্তু কোনো সম্ভ্রান্ত ঘরের মহিলারা অংশগ্রহণ করতেন না। এতে অংশগ্রহণ করতেন মূলত নীচু সম্প্রদায়ের গরিব ঘরের মেয়েরা। নাচনিদের ইতিহাসে যিনি সর্বাধিক খ্যাতি লাভ করেছিলেন তিনি ছিলেন শ্রীমতি সিন্ধুবালা দেবী। যদিও উনি কাশীপুরের রাজবাড়িতে নাচনি হিসেবে যে-সমাদর লাভ করেছিলেন তা ওঁর নাগর বা রসিক চেপা মাহাতোর হাত ধরে। যদিও সমাজ এই নাচনিদের শিল্পীদের কখনোই ভালো চোখে দেখত না। কেবলমাত্র রাজ-রাজাদের বা সম্ভ্রান্ত জমিদারদের মনোরঞ্জন করাই ছিল এদের কাজ। নাচনিরা তাদের রসিককে কেন্দ্র করেই বেঁচে থাকত। শিখত নাচ গান, অর্থাৎ, এই রসিকই ছিলেন এদের জীবনসঙ্গী আবার শিক্ষাগুরু। তবে এইসকল রসিকদের কাছে যে-সব মেয়েরাই নাচনি হিসেবে যোগ দিত তারা অনেকেই ছিল পথভ্রষ্ট। এইসকল নাচনিরা কখনো হয়তো বাবা-মায়ের অর্থকষ্টের কারণে বিক্রি হয়ে গেছে শিশুকালেই কোনো-না-কোনো রসিকের কাছে। জীবনে সুখ-স্বাচ্ছন্দ কী তা তারা কখনোই দেখেনি রসিকের সাথে এদের জীবন কাটত নানান সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে। রসিকরা এদের নাচ গান শিখিয়ে অতি দ্রুত নিজেদের মনের মতন করে গড়ে তুলতেন। নাচনি মেয়েদের কাজ হত গ্রামের রাজা কিংবা জমিদারদের মনোরঞ্জন করা কিন্তু তার বিনিময়ে এরা কখনোই যোগ্য মর্যাদা বা ন্যূনতম সম্মানটুকু পেতেন না। সম্ভ্রান্ত সমাজ এদেরকে মানুষ বলি বলেই গণ্য করতেন না। একসময় কোনো নাচনি মারা গেলে তার দেহ সৎকার পর্যন্ত করা হত না। পায়ে দড়ি বেঁধে ধাঙ্গড় দিয়ে টেনে নিয়ে গিয়ে কোনো ভাগাড়ে সেই নাচনির মৃতদেহ ফেলে আসা হত। কী মর্মান্তিক তাদের জীবনের শেষ পরিণতি নাচনিদের জীবনের এই ইতিহাস অনেকটা যেন বাংলার বাউলানি, অর্থাৎ, যারা বাউলদের সঙ্গিনী তাদের সঙ্গে মেলে। যদিও এই বাউলানিরাই বাঁচিয়ে রাখে তাদের বাউলদেরকে কিন্তু শেষ জীবনে তাদেরও অবস্থা হয় এই নাচনিদেরই মতন। বর্তমানকালে একজন উল্লেখযোগ্য এবং স্বনামধন্য নাচনি শিল্পী হলেন শ্রীমতি পস্ত বালা দেবী কর্মকার। ২০১৮ সালে তাঁকে লালন পুরস্কারে পুরস্কৃত করা হয়। যদিও আজ যে আমরা তাঁকে খ্যাতির জায়গায় বসিয়েছি লালন পুরস্কারে ভূষিত করেছি তা কিন্তু তাঁর জীবনে এত সহজে আসেনি। পস্তবালার জীবনের ইতিহাস ভীষণই করুণ। তাঁর মা বিমলা দেবী ছিলেন একজন নাচনি যিনি তৎকালীন জমিদার বাড়িতে নিযুক্ত ছিলেন। পস্ত বালার ক্ষেত্রে তাঁর মা-ই নিজে তাঁকে এই পথে এগিয়ে দেন। পেটের দায়ে সেই ছোট্ট পস্তবালা নানান লোকের বাড়িতে ঘরের ফাইফরমাশের কাজ, ঝিয়ের কাজ এমনকী ভিক্ষা পর্যন্ত করেছেন। মাত্র ১০ বছর বয়সে একজন অতি বৃদ্ধের সঙ্গে তাঁকে বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়। স্বভাবতই এই বিয়ে তাঁর ক্ষেত্রে সুখের হয়নি। নানান অত্যাচার সহ্য করে একসময় তিনি শ্বশুর বাড়ি থেকে পালিয়ে আসেন। এর পর তাঁর জীবনে নাচের হাতে খড়ি হয় শ্রদ্ধেয়া সিন্ধু বালা দেবীর কাছে। এর পর তাঁর জীবনে রসিক হয়ে আসেন বিজয় কর্মকার। ভালোবাসার টানে তিনি ঘর বাঁধেন বিজয় কর্মকারের সঙ্গে যদিও বিজয় ছিলেন বিবাহিত এবং কয়েকজন সন্তানের পিতা। পস্ত বালা নিজেই বলেছেন রসিকের বাড়িতে এসো তাঁর কপালে সুখ জোটেনি বরং রসিক তাঁর নিজের পরিবার বাঁচাতে পস্তর উপার্জন করা পয়সা আত্মসাৎ করে নিতেন। এভাবে দিনের পর দিন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে কাটাতে কাটাতে একসময় শুরু হয়, কিছু শুভ বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের হাত ধরে এই নাচনিদের বাঁচানোর জন্য আন্দোলন। অবশেষে ২০০৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার নাচনিদের স্বীকৃতি দেন তৈরি হয় মানভূম লোকসংস্কৃতি ও নাচনি উন্নয়ন সমিতি। যেখানে এখন সম্পাদিকা আসনে রয়েছেন পস্ত বালা দেবী। যে-রসিক বিজয় কর্মকারের বাড়িতে একসময় তাঁর জায়গাটুকুও জোটেনি আজ নিজের অধিকারে তিনি সেই জায়গা করে নিয়েছেন। যথেষ্ট সমাদর করা হয় তাঁকে। তাঁর নিজস্ব একটি বাসস্থান হয়েছে। বহু জায়গা থেকে ডাক আসে তাঁর, গ্রামে গ্রামে এমনকী শহরেও তিনি নৃত্য পরিবেশন করতে আসেন। যদিও এত কিছু সত্ত্বেও নাচনিদের নৃত্যের যে-ভঙ্গিমা বা শৈলী তা কিন্তু আজও আমাদের বাবু সমাজ বা তথাকথিত সভ্য মানুষরা ভালো চোখে দেখেন না তবে যেহেতু এটি একটি অতি প্রাচীন লোকসংস্কৃতির বা আদিমতম একটি লোকনৃত্যের অঙ্গ বা অংশ তাই তাঁদের সেই মৌলিকত্বকে খণ্ডন করার বা অস্বীকার করার কোনো অধিকারই আমাদের নেই।

বর্তমানকালের নাচনি এবং তাঁদের আর্থসামাজিক অবস্থান:

পূর্বের সিন্ধু বালা দেবী বা বর্তমানের পস্ত বালার মতো এখন আরও যে-সব নাচনি শিল্পীরা রয়েছেন যেমন বিমলা দেবী, সরস্বতী দেবী এঁদের মতো গুটিকয়েক শিল্পীরাই কিন্তু কেবলমাত্র এখন আর এই পেশার সঙ্গে টিঁকে আছেন। এঁদের পরে জানি না আর কে বা কারা এই শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন, কারণ, কী-ই-বা আছে এঁদের? সেই প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত না আছে এই শিল্পীদের জীবনে কোনোরকম কোনো নিশ্চয়তা, সম্মান, যোগ্য মর্যাদা, যোগ্য মজুরি কিংবা দু-বেলা দু-মুঠোভাতের জোগান। যদিও-বা আগেকার দিনে এইসকল নাচনিদেরকে অন্তত কাজ দিয়ে জমিদারবাড়ি কিংবা রাজদরবারের রাখা হত এখন সেই রাজাও নেই রাজদরবারও নেই ফলে নেই নাচনিদের খোঁজ। এখন এইসব নাচনিদের দেখা পাওয়া যায় পুরুলিয়া এবং তাঁর আশেপাশের অঞ্চলে যে-সকল পালা-পার্বণ বা মেলা হয় তাতে, কিন্তু তা আর কতই-বা হয় আর তা দিয়ে তাঁদের কী-ই-বা অর্থ আসে হাতে। ফলে অর্থের এবং উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এই শিল্প আজ ধ্বংসের সম্মুখীন।

নাচনি সম্প্রদায় সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা:

লোকসংগীতের একজন ক্ষুদ্র গবেষক হিসেবে একসময় জানতে চেয়েছিলাম পুরুলিয়ার লোকসংস্কৃতিকে আর সেই সুবাদেই পুরুলিয়ায় বা পুরুলিয়ার আশেপাশের বেশ কিছু মেলা কিংবা বা বাধনা, মকর, টুসু ইত্যাদি পালা পার্বণে ছুটে যেতাম। এমনই একবার শীতকালে পুরুলিয়ার একটি জনপ্রিয় বাৎসরিক মেলায় (সৃজন উৎসবে) উপস্থিত হই। সেখানে নানা শিল্পীদের আগমন, নানারকম শিল্পের সম্ভার, বলা যেতে পারে গোটা ভারতবর্ষে যেন সেখানে এসে হাজির হয়েছিল এবং তার পাশাপাশি ছিল এই হারিয়ে যাওয়া নাচনিদের দলও। উৎসুক মনে গিয়ে দাঁড়াই সেই নাচনি দলের কাছে। যদিও যতদূর মনে পড়ে, তাঁরা মেতেছিলেন তাঁদের নিজেদের দলের মানুষদের সঙ্গে। বলতে দ্বিধা নেই, আমাদের মতো শহুরে মানুষদেরকে আশেপাশে দেখলেও এঁরা একটু ভয়ই পান। যাইহোক খানিক ইতস্তত হয়েও এগিয়ে যাই এঁদের সঙ্গে আলাপ জমাতে প্রথমেই মাঝবয়সি যে-মহিলা নাচনি শিল্পীরা সঙ্গে কথা হয় তাঁর নাম ছিল কাজল বালা দেবী। কথায় কথায় জানতে পারি তাঁর বয়স আনুমানিক পঞ্চাশের কাছাকাছি। অনেক ছোটো বয়স থেকেই তিনি এই পেশায় আসেন। তাঁর মাও ছিলেন পেশায় একজন নাচনি। আর তিনিও একটা বয়সের পরে এই পেশায় আসেন। তাঁর জীবনেও আছে রসিক যদিও এই রসিক পরিবর্তন হয়েছে দু-একবার। ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখিয়ে তাঁর জীবনের প্রথম রসিক তাঁকে ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। তারপর আসেন দ্বিতীয় জন, এখন তিনিই তাঁর স্বামী বা রসিক। আলাপ জমতে থাকে ক্রমশ। জানতে চাই তাঁদের এই যে অপূর্ব সাজসজ্জা তার সম্পর্কে। কীভাবে এঁরা তাঁদের কেশবিন্যাস করেন বা কী কী অলংকার পরেন এই নাচনি নাচের সময়। নিজের চোখেই দেখি খুবই রংচঙে সাজগোজ বাহারি শাড়ি হাতের চুরি গলায় মালা ইত্যাদি। উনি ওঁর সাধ্যমতো উত্তর দেন তবে এরই মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উনি দেয় যে, তা হল এঁদের সাজ-পোশাকের ক্ষেত্রে কোমরে একটি কোমরবন্ধ পরা হয়। যেটি কিনা এই নাচের সাজসজ্জার একটি বিশেষ অলংকার। এর পরে শুরু হয় তাঁদের নাচ সঙ্গে ঝুমুর গান দুই মিলে তৈরি হয় স্বর্গীয় পরিবেশ আমিও হারিয়ে যাই সেই আদিরসের সুরে। বেশ রাতের দিকে থামে এঁদের পরিবেশনা। ভেঙে যায় মেলা। আমিও গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চলি আমার ডেরার দিকে। ফেরার পথে ভাবতে থাকি কাজল দেবীর সাথে বলা কথাগুলো সম্পর্কে। আহা, কী আফসোস তাঁর কণ্ঠে ছিল। পরিষ্কার বলেছিলেন, আজকাল আর ক-টা জায়গাতে নাচনি নাচের আসর বসে আর বসলেই-বা আমাদের কী-বা এমন পাই? খুবই কম টাকা দেয়। এমনকী কোথাও কোথাও তো রাতের খাবারটুকুও তাঁদের দেওয়া হয় না। ভাবছিলাম তবে কোথায় উন্নত হল আমাদের সমাজ? আমরা তো আমাদের আদিমতম সংস্কৃতির কথাই ভুলতে বসেছি। তার বদলে জায়গা নিয়ে নিয়েছে সস্তার চটুল সংস্কৃতি। আচ্ছা যাঁরা আজও নাচনিদের সেই আগেকার দিনের মতোই খারাপ চোখে দেখেন, নাচনি মানেই খারাপ পথে যাওয়া মেয়ে মানুষ তাঁরা কি কখনো ভেবে দেখেছেন কেন নাচনিদের নাচে গানে অশ্লীলতা (যদিও কোনটা অশ্লীলতা আর কোনটা শ্লীলতা এটা যার যার ব্যক্তিগত রুচির ব্যাপার) প্রয়োগ রয়েছে? আসলে আমরা ভাবি বড়োই কম আর সেই কম ভাবনার উপর মন্তব্য করি বা নিজেদের ভাবনাকে চাপাই অনেক বেশি তাই হয়তো নাচনিরা আজও সমাজের সেই অন্ধকারেই রয়ে গেছেন। যে-নাচনি নাচের ভঙ্গিমা বা শৈলীকে অশ্লীল বলা হত বা আজও বলা হয় তা কীসের জন্য তার জন্য দায়ী ছিল তৎকালীন উচ্চবিত্ত বাবুসমাজ। উচ্চবিত্তদের অতি স্থুল রুচিবোধেই তো ছিল নাচনিদের নৃত্যের যে-কুরুচিকর ভঙ্গিমা বা শৈলী তার কারণ। বাবুদের মনোরঞ্জনের চাহিদা মেটাতে এই নাচনিরা নাচের সাথে কিছু অশ্লীল দেহ-ভঙ্গিমার আশ্রয় নিয়েছিলেন তাহলে এতে নাচনিদের দোষ কোথায়?

উপসংহার:

পুরুলিয়া তথা মানভূমের লোকসংস্কৃতির ইতিহাসের পাতা থেকে নাচনি নাচের আজ যে-অবলুপ্তি তার জন্য কিন্তু দায়ী আমরাই, কারণ, সিন্ধু বালা, পস্ত বালা কিংবা এঁদের পরে আর সামান্য কয়েকজন যাঁরা আজও খুব কঠিনভাবে এই শিল্পকে বুকে আঁকড়ে বেঁচে রয়েছেন এঁদের পরে এই শিল্পকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার আর কিন্তু কেউ নেই। কারণ, সমাজ উন্নত হওয়ার পাশাপাশি আজকাল আর পুরুলিয়া বা তার আশেপাশের অঞ্চলের মেয়েরা এই নাচনি গানের সঙ্গে যুক্ত হতে রাজি নয়। তাঁরা বরং লেখাপড়া শিখে নিজেদের পায়ে দাঁড়িয়ে চাকরির খোঁজে পাড়ি দেয় দেশের নানা প্রান্তে। যদিও যুগের পরিবর্তন অনুযায়ী অতি স্বাভাবিক ঘটনা কিন্তু তবুও কি এমনভাবে এইরকম একটি সুপ্রাচীন শিল্পকে কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে দেখা যায়? এ কি মারাত্মক যন্ত্রণাদায়ক নয়? আজও যাঁরা লোকসংস্কৃতি লোকসমাজ কিংবা লোকশিল্প নিয়ে বিন্দুমাত্র হলেও চিন্তিত এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে উদ্যোগী সেইসকল শুভ বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষদেরকে উচিত নয় কি সরকারের দরজা অবধি এই নাচনি শিল্পের কথা পৌঁছে দেওয়া? যাতে কেবলমাত্র গুটিকয়েক নাচনি শিল্পীকে কেবলমাত্র বিভিন্ন সম্মানে ভূষিত না করে এই সমগ্র শিল্পটিকে পুরুলিয়ার অন্যান্য যে-সকল সমাদৃত শিল্প যেমন ছৌ নাচ কিংবা ঝুমুরের কাছাকাছি নিয়ে আসা অথবা এর পাশাপাশি সরকারের দৃষ্টিপাত করা উচিত যাতে আজও যাঁরা নাচনি পেশায় নিযুক্ত তাঁরা যাতে পুনর্বাসন কিংবা মাসিক একটি ভাতা বা বার্ধক্যের জন্য সুচিকিৎসার সুযোগ পায়। এর পাশাপাশি সরকার এবং লোকসংস্কৃতির সঙ্গে যাঁরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত আছেন তাঁদের কাছে আমার বিনীত নিবেদন বা আবেদনে বলা চলে যাতে করে একাডেমিক স্তরে এই নাচনি শিল্পকে আবার ফিরিয়ে আনা হয়। যাতে অন্তত কিছু সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী যোগ দেয় এতে। নাচনি গান বা নাচ আসলে কি তা তাঁরা যেন শেখে এবং এর ফলেই একদিন আশা করা যায় হয়তো এঁদের হাত ধরেই বর্তমানকালের কিছু পরিবর্তনকে সঙ্গে রেখেই এই নাচনি শিল্প আবার উঠে আসবে। এতে যেমন করে এই শিল্পটি আবার প্রাণ ফিরে পাবে তেমনি বাঁচবে এই শিল্পের সঙ্গে জুড়ে থাকা প্রান্তিক শিল্পীরা। কারণ, আমরা সকলেই জানি শিল্পী বাঁচলে তবেই শিল্প বাচবে। যে-নাচনিদের পায়ের ঘুঙুরের তালে মেতে ওঠে রসিক দর্শকেরা বা শিল্প অনুরাগীগণ সেই নাচনিদের পায়ে যেন আর কোনোদিনই তাঁদের মৃত্যুর পরে দড়ি বেঁধে টেনে না নিয়ে যাওয়া হয়। যোগ্য মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকার পাশাপাশি, অন্তত মৃত্যুর পরে যেন তাঁরা তাঁদের শেষ কৃত্যের যোগ্য মর্যাদাটুকু পায়।

Categories
2021-July-Essay

শুভদীপ ঘোষ

চার্লি ও চ্যাপলিনের কথা

চার্লির কথা ১: বাবা ছিল গায়ক ও অভিনেতা। ভালো গানের গলা ছিল, নামডাক ছিল। আমাদের এখানে বাণিজ্যিক রঙ্গমঞ্চ যেরকম ছিল কতকটা সেরকমই ছিল লন্ডনের মিউজিক হল বা আমেরিকার ভদেভিল। শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীদের গ্রুপ থিয়েটারের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা জাতের। সাধারণ মানুষের আনাগোনা লেগে থাকত, সারা শহর ঘুরে ঘুরে হত নাটক, গান, সার্কাস, মাইম, বক্তৃতা, জিমনাস্টিক এমনকী সন্মোহন জাতীয় ব্যাপার-স্যাপারও। ভীষণ জনপ্রিয় এই প্রদর্শনগুলিতে দর্শকরা নেমে এসে বিপুল উৎসাহে শিল্পীদের সঙ্গে যোগ দিত, চলত দেদার মদ্যপান। বাবা ছিল এইরকমই ঘোর মদ্যপ। নাম চার্লস স্পেন্সার চ্যাপলিন সিনিয়ার। চার্লির যখন বারো বছর বয়স তখন তার বাবা এই মদ্যপান জনিত অসুখের কারণে মারা যায়, মৃত্যুর সময় বাবার বয়স ছিল সাইত্রিশ। সম্পর্ক বলতে যা বোঝায়, বাবার সঙ্গে চার্লি ও তার দাদা সিডনির তা একেবারেই ছিল না। কয়েকবারের কিছু সাক্ষাৎ বাবার স্মৃতি হিসেবে থেকে গিয়েছিল তাদের মনে। তথাপি চ্যাপলিনের ছবিতে তার বাবার প্রভাব আছে নানাভাবে। মা ছিল বাবার মতোই ব্রিটিশ মিউজিক হলের গায়িকা ও অভিনেত্রী। মাত্র ষোলো বছর বয়সে তার শিল্পীজীবন শুরু হয়। নাম হানা পেডলিংহাম চ্যাপলিন। বিজ্ঞাপনে বা হ্যান্ডবিলে ‘লিলি হার্লি’ নাম দেখা যেত। চ্যাপলিন সিনিয়ারের প্রেমে পড়ে ঐ কম বয়সেই। ১৮৮৩ নাগাদ সিডনি হক্‌স বলে একজনের সঙ্গে তার সম্পর্ক হয়, হক্‌স তাকে সোনার-খনিতে সমৃদ্ধ সাউথ আফ্রিকার উইটওয়াটারস্ট্রান্ডে নিয়ে যায়। এখানে তাকে বেশ্যাবৃত্তি করতে বাধ্য করা হয়। এর অল্পকাল পড়েই হানা অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় পুনরায় ব্রিটেন ফিরে আসে। জন্ম হয় সিডনি হক্‌সের ছেলে সিডনি চ্যাপলিনের। উত্তর ফ্রান্সের লে হেভরের রয়াল মিউজিক হলে শুরু হয় পুনরায় গান গাওয়া। ব্রিস্টল, ডাবলিন, গ্লাসগো, বেলফাস্টে তার গান ও অভিনয় শুরু হয় সিনিয়ার চ্যাপলিনকে বিয়ে করার পর। ১৮৮৬ সালের ১৬ই এপ্রিল জন্ম হয় চার্লি চ্যাপলিনের (চার্লস স্পেন্সার চ্যাপলিন জুনিয়ার)। মা বাবার সম্পর্ক কেমন ছিল চার্লির সেটা বোঝার বয়স হওয়ার আগেই মা বাবার মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। চার্লি ও সিডনি মায়ের সঙ্গে আলাদা থাকত লন্ডনের লাম্বেথ অঞ্চলে। হুইলার ডাইড্রেন নামে মায়ের আর এক ছেলের কথা তারা জানতে পারে অনেক পরে! এই গম্ভীর রোগা ডাইড্রেনকে চার্লির শেষের দিকের কিছু ছবিতে অভিনয়ও করতে দেখা গেছে। বাবার মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপান, উত্তর আমেরিকা ভ্রমণের সময়কার অজানা কিছু ঘটনা, অন্য এই ছেলের রহস্য, না কি মায়ের কখনো ঠিক না হওয়া মানসিক অপ্রকৃতিস্থতা, প্রকৃত কারণ কী ছিল ছাড়াছাড়ির! চার্লিদের কাছে রহস্যই থেকে গেছে গোটা ব্যাপারটা। পরবর্তীকালের গবেষণা থেকে জানা যায় হানা চ্যাপলিন সম্ভবত সিফিলিস আক্রান্ত ছিল। অস্বাভাবিক মাথাব্যথা, মাঝে মাঝেই গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোনো বন্ধ হয়ে যাওয়া, দীর্ঘস্থায়ী মানসিক গৈরুষা, সার্বিক স্বাস্থের অবনতি-সহ শেষাবধি ডিমেন্সিয়া এই সিফিলিসের কারণেই হয়েছিল বলে সন্দেহ করা হয়!

ছোটোবেলায় চার্লি

সুন্দরী কতটা ছিল তেমন জানা না গেলেও মায়ের রূপে-গুণে চার্লি ও সিডনি ছিল মুগ্ধ। অনেক রাত করে মা বাড়ি ফিরত, ফিরে দেখত ছেলেরা ঘুমিয়ে পড়েছে, সকালে উঠে ছেলেরা দেখত মা ঘুমোচ্ছে, টেবিলে সাজিয়ে রাখা আছে তাদের খাবার। দাদু দিদারা এসে মাঝে সাঝে থাকত ওদের সাথে, হানার রোজগারে আধপেটা খেয়ে কষ্টেসৃষ্টে চলে যেত। ছুটির দিনে কখনো লাম্বেথের ফুটপাথে কখনো কেনিংটন রোডের ধারে কখনো-বা ওয়েস্টমিনিস্টারের ব্রিজের ধারে, মায়ের সঙ্গে লাইলাক গাছের ডাল ধরে সুন্দর কেটে যেত তাদের বিকেলগুলি। গান গেয়ে, নেচে, কদাচিৎ আইসক্রিম কিনে দিয়ে অভাব অনটন কিছুক্ষণের জন্য ভুলিয়ে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে যেত মা। কিন্তু এরই মধ্যে দুঃস্বপ্নের একটি রাত চার্লি কোনোদিন ভোলেনি।

প্রথম দৃশ্য— লাম্বেথে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। মায়ের সাজপোশাকের প্রিয় পেটিটা খুলে বসেছে দুই ভাই, মা সাজগোজ করে বেরোবে, গন্তব্য অ্যালডারসটের ক্যান্টিন মিউজিক হল। চার্লির কথায়, “ভাড়া বাড়িতে একা রেখে যাওয়ার চাইতে মা সাধারনত আমাকে থিয়েটারে নিয়ে যেতেই বেশি পছন্দ করত”।

দ্বিতীয় দৃশ্য— জমকালো পোশাকে মোহময়ী হানা গান ধরেছে। অ্যালডারসটের ক্যান্টিনে তুমুল হইচই হচ্ছে, দর্শক শ্রোতারা অধিকাংশই সৈনিক, তুমল বিশৃঙ্খলা, চিৎকার চেঁচামেচি চলছে, শিস পড়ছে, উড়ে আসছে অশ্লীল শব্দ ও চুমু ‘চার্মিং লিট্‌ল চান্টার’ হানার প্রতি। দু-একজন মদ্যপ পায়ের কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে বদমায়েশি করে, গান গাইতে গাইতেই হানা হাত দিয়ে বাড়ি মেরে দূর করে দিচ্ছে তাদের। নেপথ্যে দাঁড়িয়ে সব দেখছে শুনছে পাঁচ বছরের চার্লি।

তৃতীয় দৃশ্য— হঠাৎ গানের আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেল, এদিকে মা প্রাণপণ চেষ্টা করছে গলা দিয়ে আওয়াজ বের করতে! অর্কেস্ট্রা বন্ধ হয়ে গেছে। নাঃ! মা লজ্জায় মুখ লুকিয়ে তড়িঘড়ি দৌড়ে বাইরে বেড়িয়ে গেল আর কিছু বোঝার আগেই হিড়হিড় করে টেনে মঞ্চে তুলে দেওয়া হল পাঁচ বছরের চার্লিকে!

চতুর্থ দৃশ্য— চারপাশ ধোঁয়া ধোঁয়া, তার মুখের উপর এসে পড়েছে স্পটলাইটের আলো। আবার শোনা যাচ্ছে যন্ত্রের আওয়াজ! অর্কেস্ট্রা বেজে উঠেছে, আর কিছু করার নেই, গান বেরিয়ে এল মানুষের গলা দিয়ে। স্বভাব কবিদের মতো স্বভাব অভিনেতা-গায়ক চার্লি গান ধরেছে, জ্যাক জোন্সের গান!

পঞ্চম দৃশ্য— শুরু হয়ে গেছে পয়সার বৃষ্টি, পুচকে চার্লি গান গাইতে গাইতে মায়ের ভাঙা গলা নকল করছে মাঝে মাঝে আর অদ্ভুত মুখভঙ্গি করতে করতে তাড়াতাড়ি কুড়িয়ে নিচ্ছে পয়সাগুলো যাতে কতৃপক্ষ ঝেড়ে না দিতে পারে! এই কাণ্ড দেখে দর্শকরা হেসে কুটিপাটি।

ক্যানটারবেরি হল, লাম্বেথ

এই ছিল চার্লির প্রথম রঙ্গমঞ্চের অভিজ্ঞতা। কান্নাহাসির দোলদোলানো এই শৈশব, হাসির অন্তরালের বিষাদের উৎসভূমি ছিল। কৌতুক ও বিষাদের সমমিশ্রণ না ঘটলে মানুষ হাসে না ও হাসির শেষে মানুষের চোখে জল আসে না। এ-সব বোঝা হয়ে গিয়েছিল চার্লির অনেক ছোটোবেলায়। দারিদ্র্য দুর্দশা ঐটুকু ছেলেকে শিখিয়ে দিয়েছিল নিজের প্রাপ্যটুকু বুঝে নিতে। তাই প্রথম রঙ্গমঞ্চের কুড়িয়ে নেওয়া টাকার মতো চার্লি ঐশ্বর্যের শিখরে পৌঁছেও ছিল সমান হিসেবি।

শিল্পীজীবনকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো সুস্থতা মায়ের আর আসেনি। জামাকাপড় সেলাই করে মা কোনোরকমে সংসার চালাত। পাউনিল টেরাসের বস্তিতে উঠে আসে তারা ভাড়া বাড়ি ছেড়ে দিয়ে। দুই ভায়েরই স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায় এবং শুরু হয় রোজগারের নানারকম চেষ্টা। বাড়ির সব জিনিস বেঁচে দিতে হয় একে একে, এমনকী তাদের সবচেয়ে প্রিয় মায়ের সাজগোজের পেটিটা পর্যন্ত! এরপর দেনার দায়ে সেলাইয়ের মেশিনটাও নিয়ে যায় পাওনাদার। লাম্বেথের ওয়ার্কহাউসে গরিব ও অনাথ বাচ্চাদের সাথে দুই ছেলেকে ভর্তি করে দেওয়া ছাড়া হানার আর কোনো উপায় থাকে না। রোজগারের বৈধ ও নিষিদ্ধ বিভিন্ন উপায়ে কাটতে থাকে হানার জীবন।

চ্যাপলিনের কথা ১: মানুষকে দেদার সাহায্য করার সময়ও আমরা আত্মসচেতন এক চ্যাপলিনকে দেখি তার ছোটো বড়ো সমস্ত ছবিতে। পয়সা রোজগার করার কত ফিকির আমরা দেখতে পাই তার ছবিতে। ধনসম্পদের বৈষম্যই যে ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাকে কায়েমি রাখার মূল চাবিকাঠি এই বোধ চ্যাপলিন যেরকম চার্লির জীবন থেকে পেয়েছিল সেইমতো তার প্যান্টোমাইম চলচ্চিত্র যাত্রার শুরুর চলচ্চিত্রটির নামও অদ্ভুতভাবে ‘মেকিং এ লিভিং’ (১৯১৪)। এই ‘মেকিং এ লিভিং’-এর চ্যাপলিন কিন্তু আমাদের চেনা ঢোলা প্যান্ট, ছোটো গোঁফ, ছড়ি টুপির ভবঘুরে আর্কিটাইপ চ্যাপলিন নয়। ঐ চরিত্রটিকে খুঁজে পেতে তাকে পরের ছবি ‘কিড অটো রেসেস অ্যাট ভেনিস’ (১৯১৪) অবধি অপেক্ষা করতে হয়েছিল। এরপর একে একে ‘হিজ নিউ প্রফেশান’ (১৯১৫), ‘হিজ নিউ জব’ (১৯১৫), ‘ওয়ার্ক’ (১৯১৫), ‘দি পন শপ’ (১৯১৬), ‘এ ডগ্‌স লাইফ’ (১৯১৮) জুড়ে শুধু ঢোলা প্যান্ট, ছেঁড়া টাইট কোট, ছড়ি, টুপি, ছোটো গোঁফ আর হাঁস জুতোটুকুও যাতে চলে না যায় সেই জন্য রোজগারের নানান ধান্দা। ‘এ ডগ্‌স লাইফ’-এ এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে লোকভরতি বেঞ্চের একধারে বসে থাকা চ্যাপলিন মাটিতে পড়ে যায় যখন অন্য প্রান্তে একটি মোটা লোক এসে বসে। সমাজের বিস্মৃত মানুষের সর্বোত্তম প্রতিনিধি চ্যাপলিনকে এর পর বিশ্বাসযোগ্যভাবে অভিনয় করতে দেখি এমন এক প্রাহসনিক দৃশ্যে যেখানে বেঞ্চ থেকে উঠে এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে জানালায় তার পৌঁছোনোর আগেই অন্য কেউ-না-কেউ পৌঁচ্ছে যাচ্ছে! সমাজের একেবারে নীচু তলার মানুষের অবস্থা নিয়ে এরকম শ্লেষাত্মক বিবৃতি চলচ্চিত্রের ইতিহাসে বিরল!

চার পয়সা ধার দিয়ে ফাঁকতালে এক পয়সা নিজের জন্য সরিয়ে রাখে সে, কিংবা ‘সিটি লাইট’ (১৯৩১)-এ জলে ডুবন্ত সেই উন্মাদ ধনকুবেরকে বাঁচাতে গিয়ে সে নিজে আগে জল থেকে ওঠার চেষ্টা করে! ‘Be brave! Face life!’, স্বগতোক্তির মতো শোনায়, বুক চাপড়ে এ-কথা বলতে গিয়ে চ্যাপলিনের আত্মপ্রবঞ্চনাময় কাশির দমক আমাদের হাসিতে ভরিয়ে দেয়। ‘Tomorrow the bird will sing’, আত্মহত্যা করতে যাওয়া যে-মানুষকে চ্যাপলিন এ-কথা বলছে সে একজন ধনকুবের! উদ্বৃত্ত অর্থের স্রোত, সমস্ত ভোগ করে ফেলার পর মানুষের বুঝি এই অবস্থা হয়! অথচ উলটোটাই তো কথা ছিল, কিন্তু ভবঘুরে আধপেটা খাওয়া চ্যাপলিন ভাবেনি সে-কথা, এখানেই ব্যক্তি চার্লির দুর্মর আশাবাদ চলচ্চিত্রের চ্যাপলিনের প্রতিভায় প্রকাশিত হয়েছে। এই ধনকুবের চরিত্রটির মধ্যে নিহিত আছে চার্লির বাবার ছায়া। মদ্যপ ধনকুবেরটি যেন চ্যাপলিনের বাবার ইগো আর নেশা ছুটে যাওয়া দাম্ভিক ধনকুবেরটি যেন তার বাবার অলটার ইগো।

মাত্র পাঁচ বছর বয়সে অপ্রস্তুত চার্লিকে একদা ঘাড় ধরে তুলে দেওয়া হয়েছিল মঞ্চে, এই অভিজ্ঞতা বিভিন্ন রূপ নিয়ে ফিরে ফিরে এসেছে চ্যাপলিনের ছবিতে। ‘দি সার্কাস’ (১৯২৭) ছবিটিতে পুলিশের তাড়া খেয়ে চ্যাপলিনকে আমরা ঢুকে পড়তে দেখি সার্কাসের মঞ্চে, তারপর পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে শুরু হয় ট্রাপিজের হাজার কসরত! ছবিতে সার্কাসের দর্শকরা সে-সব দেখে হেসে অস্থির তাদের কাছে প্রকৃত সত্য জানা নেই, আর আমরা ছবির দর্শকরাও হেসে অস্থির কিন্তু আমাদের অবস্থান চ্যাপলিনের সঙ্গে। ছবির এক জায়গায় সার্কাসের ম্যানেজারের মন্তব্য ভেসে উঠতে দেখি ইন্টারটাইটেলে, “He’s a sensation but he doesn’t know it…”। এতকাল বাদে এই স্বতঃস্ফুর্ত স্ল্যাপ্সটিকগুলির দিকে ফিরে তাকালে ঐ সময়ের প্রেক্ষিতে এ-কথা কৌতুকপূর্ণভাবে সর্বৈব সত্য বলে মনে হয়। আবার প্রথম দিকের ‘এ নাইট ইন দ্য শো’ (১৯১৫)-তে আমরা দেখা পাই ব্রিটিশ মিউজিক হল বা আমেরিকার ভদেভিল জাতীয় রঙ্গমঞ্চের! ছবির এক জায়গায় মদের নেশায় চ্যাপলিন আচমকা গিয়ে রঙ্গমঞ্চের উপর উঠে পরে, তারপর শুরু হয় তার চিরাচরিত স্ল্যাপস্টিক মারপিট! অনেকে বলে থাকেন চ্যাপলিনের ছবি আসলে মানুষের আজীবন লালিত সুপ্ত শৈশবকে প্রাণিত করে তাই তার ছবির বয়সে ছোটো দর্শকের থেকে বয়সে বড়ো দর্শকের সংখ্যাই বেশি। মদ্যপ চ্যাপলিন আরও বেশি করে যেন ঐ শৈশবে প্রণত, তাই ভদেভিল রঙ্গমঞ্চে মদ্যপ চ্যাপলিন যেন স্বতঃপ্রণোদিতভাবে উঠে পড়ে, যেন এ তার অনেক ছোটোবেলার অভ্যাস! এখানে ছবির ভদেভিলের দর্শকদের থেকে ছবির দর্শক হিসেবে আমাদের অবস্থান অনেক বেশি ব্যক্তি-চ্যাপলিন নিষ্ঠ। ‘হিজ ফেভারিট পাস্টাইম’ (১৯১৪), ‘দ্য রাউন্ডার্স’ (১৯১৪) থেকে ‘সিটি লাইট’ মাতাল চ্যাপলিনের মগ্নচৈতন্যের শৈশবযাপন। যুক্তিবুদ্ধির ধারণা থেকে মুক্ত বিহঙ্গের মতো শরীরটাকে ছেড়ে দিয়ে যা খুশি করা, কিছুক্ষণের জন্য শিশুসুলভ দুষ্টুমি করে চলা। স্ল্যাপস্টিক প্রদর্শনের এরকম সুযোগ চ্যাপলিন কখনো ছাড়েনি।

চিরাচরিত স্ল্যাপস্টিক, ‘এ নাইট ইন দ্য শো’ (১৯১৫)

চার্লির কথা ২: বন্দিত্ব ও একাকিত্ব বস্তিবাসীদের নিত্যদিনের সঙ্গী। লাম্বেথের ওয়ার্কহাউসে একদিন তার মাথা মুড়িয়ে দেওয়া হয়। জেরিমি বেন্থাম রাষ্ট্রের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বকে বলেছিলেন প্যান-অপটিকনিয়ান। বলা নেই কওয়া নেই, সমাজসেবী পাদ্রির দল কোথা থেকে এসে নিয়ম নামক কবচ ঝুলিয়ে তার সাধের চুল কেটে দিয়ে চলে গেল! গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক সমস্তরকম সমাজব্যবস্থায় মানুষ যে একটা সংখ্যার বেশি কিছু নয় চার্লি সেটা ঐ কম বয়সেই টের পেয়েছিল যখন সে দেখল আসলে নিজের শরীরটাও নিজের নয়। যে-শরীরকে সে চিরকাল ব্যবহার করেছে মানুষকে আনন্দ দিতে যে-শরীর তার শিল্পের যাপনভূমি সেইখানেই ঘটে গেল অতর্কিত হামলা। তার এই অভিজ্ঞতার কথা জানা থাকা দর্শক হিসেবে তার ছবি সমাদর করার প্রাক্-শর্ত।

মায়ের মধ্যে পাগলামির লক্ষণ দেখা দিলে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় মানসিক চিকিৎসাকেন্দ্রে। হানার পরিবারে মানসিক অসুস্থতার বেশ কিছু নজির আছে। হানার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা উত্তরাধিকার সুত্রে পাওয়া না কি সিফিলিস ঘটিত তা আজও পরিষ্কার নয়। মা হাসপাতালে চলে গেলে সরকারি নিয়মে চার্লি ও সিডনি কেনিংটনে তার বাবার বাড়িতে গিয়ে ওঠে। বলা বাহুল্য গৃহকত্রী বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী লুইস ব্যপারটা একেবারেই মেনে নিতে পারেনি। খাদ্য জুটত কিন্তু তার থেকেও বেশি জুটত অবহেলা ও তুচ্ছতাচ্ছিল্য। পরে মা সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে বেরোলে তারা মায়ের সঙ্গে পাউনাল টেরাসের বাড়িতে গিয়ে ওঠে। এখানে থাকা কালিন দারিদ্র্য চরমে পৌঁছোয়। আগের মতোই উপার্জনের নানা পন্থা এবং উপায় না থাকলে রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষে করে বেড়ানো এইভাবেই কাটত মায়ের নিত্যদিন। এই সময়েরই একটি ঘটনার কথা চার্লি অনেক জায়গায় বলে গেছে।

প্রথম দৃশ্য— মা বেরিয়েছে উপার্জনের জন্য। সিডনি কোথায় সে জানে না। ছাদের কড়িকাঠে শেষ বিকেলের আলো এসে পড়েছে, সেই দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘুমে চোখ জড়িয়ে এসেছে চার্লির।

দ্বিতীয় দৃশ্য— বাইরে হঠাৎ হইচই-এর শব্দ। চার্লির তন্দ্রা ছুটে গেছে, সে এক দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছে।

তৃতীয় দৃশ্য— একটা আধপাগল ধরনের লোক মুখে অদ্ভুত আওয়াজ করতে করতে একটা ভেড়াকে তাড়া করে রাস্তার সামনে দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। রাস্তার ধারের লোকজন বিশেষত চার্লির বয়সি ছোটোরা দারুণ উপভোগ করছে ব্যাপারটা আর হাততালি দিচ্ছে। চার্লিও দারুণ মজা পেয়েছে, সে অন্যদের সঙ্গে হাততালি দিতে দিতে দৌড়চ্ছে লোকটার পিছন পিছন।

দৃশ্য চার— রাস্তার শেষ মাথায় পৌঁচ্ছে গেছে সবাই, লোকটা ভেড়াটাকে টেনে ঢুকিয়ে দিল একটা বাড়িতে। চার্লি চোখ তুলে দেখে সেটা একটা কসাইখানা! এই অনভিপ্রেত ঘটনার অভিঘাতে চার্লি ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে, মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে, “ওরা একে মারতে নিয়ে যাচ্ছে!!”

১৯০১ সালে বাবা মারা যায়। দাদা সিডনি জাহাজে কাজ নিয়ে দূরে। চার্লি এই সময় মুদিদোকান থেকে মুচিগিরি সমস্তরকম কাজে নিজেকে যুক্ত করেছে, রঙ্গমঞ্চে গান অভিনয়ও চলেছে পাশাপাশি, বিদ্যালয়েও গেছে মাঝে মাঝে, আর শ্যেন দৃষ্টিতে দেখছে উপলব্ধি করছে মানুষের স্বভাব ও মানুষের সমাজ। একদিন জানতে পারে মা সম্পূর্ণ পাগল হয়ে গেছে, তাকে আবার মানসিক চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। এই অসুখ তার আর কোনোদিনও সারেনি।

১৯১০ সাল নাগাদ চার্লি ব্রিটিশ মিউজিক হলের বিখ্যাত অভিনেতা ও স্ল্যাপস্টিক কৌতুকাভিনেতা ফ্রেড কার্নোর দলে যোগ দেয়। পরবর্তীকালে চ্যাপলিনের ছবিতে এর ওর মুখে বড়ো কেক বা পেস্ট্রি ছুড়ে মারার যে-দৃশ্যগুলি দেখতে পাওয়া যায় সেই স্ল্যাপস্টিক প্রকরণটি এই ফ্রেড কার্নোর মস্তিষ্কপ্রসূত, একে custard-pie-in-the-face gag বলে। ইনি ছিলেন স্ল্যাপস্টিক কমেডি এবং সাইলেন্ট কমেডির প্রবর্তকদের অন্যতম। এর হাত ধরেই চার্লির আমেরিকা যাত্রা ও ‘কমেডির রাজা’ ম্যাক সেনেটের ‘কিস্টোন স্টুডিয়ো’-তে যোগদান। এই বছরগুলিতেই স্ল্যাপস্টিক কমেডির উপযোগী শারীরিক দক্ষতা সে রপ্ত করে ফেলে, প্রায় স্প্রিঙের মতো বানিয়ে ফেলে শরীরটাকে। সঙ্গে লন্ডনের ‘ককনি’ বাচনভঙ্গিরও পরিবর্তন ঘটতে থাকে যা মার্কিন রঙ্গমঞ্চের জন্য একেবারেই উপযোগী ছিল না। পরে ‘এসানে স্টুডিয়ো’, ‘মিউচুয়াল ফিল্ম কর্পোরেশন’ হয়ে সব শেষে নিজে ‘ইউনাইটেড আর্টিস্ট’ তৈরি করে খ্যাতি ও সমৃদ্ধির শিখর ছোঁয়। মা তার সঙ্গেই ছিল আমেরিকাতে। ছেলের সাফল্য ও খ্যাতিতে যদিও সে নিস্তেজই থাকত। অবশেষে ১৯২৮ সালে তার মৃত্যু হয়।

চ্যাপলিনের কথা ২: বিশুদ্ধ চলচ্চিত্রের কাহিনি বলার কোনো দায় নেই বলেছিলেন বেলা বালাজ, জিভা ভের্তভের মতো চলচ্চিত্র তাত্ত্বিকেরা। সেক্ষেত্রে মানতেই হবে চ্যাপলিনের সাইলেন্ট কমেডিগুলি বিশুদ্ধ চলচ্চিত্রের আদর্শ নিদর্শন। আর চ্যাপলিন সেখানে অবাঞ্ছিত অনুপ্রবেশকারী, একটা দাগ একটা ক্ষত। ‘কিড অটো রেসেস অ্যাট ভেনিস’-এর কথা ভাবুন, অভিজাতদের বাচ্চাদের গাড়ির রেসের ভিডিয়ো তোলা হচ্ছে সেখানে চ্যাপলিন ঢুকে পড়ছে বার বার! লাথি, গলা ধাক্কা যাই দেওয়া হোক সে নাছোড় বান্দা। একদম শেষে তাকে ভেংচি কাটতে দেখা যায় ক্যামেরার সামনে এসে। কতৃপক্ষ ও বড়োলোকেদের যাবতীয় ব্যাবস্থাকে সে যে সারাজীবন বুড়ো আঙুল দেখাবে এখানেই তার সূচনা হয়ে যায়। অবাঞ্ছিত অনুপ্রবেশের পর নানান অশান্তি করে ছবির মূল বিষয়বস্তুতে পরিণত হওয়া চ্যাপলিনের অনেক ছবিরই নিত্যদিনের ব্যাপার। এই ছবি থেকেই ভবঘুরে ঢোলা প্যান্ট টুপি ছড়ি ছোটো গোঁফের আর্কিটাইপ চ্যাপলিনের দেখা পাই আমরা। শোনা যায় ম্যাক সেনেটের নির্দেশে সে নিজেই তার এই রূপকল্প তৈরি করেছিল, অনেকে আবার বলে ঝড়জলের সন্ধ্যায় এইরকম দেখতে একটি মানুষের সন্ধান পেয়েছিল সে।

সেই বিখ্যাত ভেংচি, ‘কিড অটো রেসেস অ্যাট ভেনিস’ (১৯১৪)

‘ইজি স্ট্রিট’ (১৯১৭)-র একটি দৃশ্য আছে যেখানে চ্যাপলিন বাক্স থেকে খাবার বের করে বাচ্চাদের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছে এমনভাবে যেন তারা মানবশিশু নয় তারা মুরগির ছানা! সের্গেই আইজেনস্টাইনকে এই দৃশ্যের কথা মনে করিয়ে দিয়ে চার্লি বলেছিল, “জানেন তো— আমি এটা কেন করেছিলাম কেন-না শিশুদের আমি অপছন্দ করি। তাদের আমার ভালো লাগে না।” আপাত নির্মম এই কথার পিছনে লুকিয়ে আছে চার্লির বিপর্যস্ত শৈশব। প্রকৃতপক্ষে শিশু নয়, চার্লি অপছন্দ করত শৈশবকে। শিশুরা ছিল সেই অপছন্দের শৈশবের প্রতিমূর্তি।

‘শান্তি ও সমৃদ্ধির’ প্রতীক শ্বেত শুভ্র স্তম্ভের উদ্বোধন হবে। শহরের গণ্যমান্যরা উপস্থিত দলবল সমেত। পাইক-বরকন্দাজ পাদ্রি কেউ বাকি নেই। ঢাকা সরতেই দেখা যায় শ্বেত শুভ্র স্তম্ভের গায়ে কালো আঁচরের মতো কী একটা লেগে আছে যেন! ওহ্‌ ঐ শালা ভিখিরি ভবঘুরেটা! ঘুম ভেঙে উঠে হতভম্ভ চ্যাপলিন, তাকে যত নেমে আসার হুমকি দেওয়া হয় তত একবার তার প্যান্ট আটকে যায় মার্বেলের তলোয়ারে, একবার সে বসে পড়ে একটি মূর্তির মুখের উপর নিতম্ব রেখে! এদিকে বিউগল বেজে উঠতেই বাকিদের সঙ্গে সেও ঐ অবস্থাতেই স্যালুটের ভঙ্গি নেয়। বোঝা যায় ব্যাপারটা সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত নয়। সমাজ যাদের ভুলে থাকতে চায় তাদের এরকম অবাঞ্ছিত উপস্থিতি দিয়েই শুরু হয় ‘সিটি লাইট’। ঝাঁ চকচকে শহরের অভ্যস্ত আলো নয়, যে-সব মানুষ বা যে-সব অঞ্চল ইচ্ছাকৃতভাবে ব্রাত্যই থেকে গেছে, এই আলো সেই বাইরের নগরের। বস্তুত ‘সিটি লাইট’-এর সময় হলিউডে বাক্-চিত্র এসে গেছে। কিন্তু নৃত্যগীতবাদ্য মুখর কর্ণভেদী বাক্-চিত্রের বিপরীতে মাঝে মাঝে কিছু আওয়াজ ও নেপথ্যসংগীত ছাড়া ‘সিটি লাইট’-এর নির্বাক্‌ চলমান চিত্রমালায় এমন একটা সুখ ছিল যা এই ছবিটিকে শেষপর্যন্ত প্রায় মন্ত্রে-শান্তিতে উন্নীত করে দেয়!

সে এখানে স্বয়ং পাদ্রি এবং অবশ্যই অবধারিতভাবে জালি পাদ্রি, আদতে জেল পালানো আসামী। এদিকে শহরের শেরিফ চ্যাপলিন-আসামীকে চিনতে পারে ও তাকে বন্দি করে। কিন্তু তার উদারতায় ততক্ষণে সবাই মুগ্ধ তাই শেরিফ তাকে আমেরিকা থেকে পালিয়ে মেক্সিকোতে চলে যেতে সাহায্য করতে চায়। আমেরিকার সীমানায় নিয়ে গিয়ে যতবার তাকে মেক্সিকোতে পাঠানো হয় ততবার সে ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে (নাকি বুঝতে না চেয়ে!) সীমানা টোপকে ফের আমেরিকা চলে আসে! শেষে বিরক্ত শেরিফ পশ্চাদদেশে লাথি মেরে তাকে মেক্সিকো পাঠিয়ে নিজে পালিয়ে চলে যায়। চ্যাপলিন তখন দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থায়, এক পা আমেরিকার দিকে আর এক পা মেক্সিকোর দিকে দিয়ে লাইনের উপর দাঁড়িয়ে থাকে। এদিকে কী একটা গণ্ডগোল শুরু হয়েছে খুব গোলাগুলি চলছে। সে কি করবে কিছু বুঝতে না পেরে ঐ লাইন ধরে দু-দিকে দুই পা রেখে দিগন্তের দিকে হাঁটা দেয় তার বিখ্যাত পাতিহাঁসের মতো হাঁটার ভঙ্গিতে! ‘দ্য পিলগ্রিম’ (১৯২৩) ছবির পরিসমাপ্তি ঘটে এখানেই। এই তার চলচ্চিত্রের আন্তর্জাতিক ভাষা। প্রান্তবাসী অন্তেবাসী মানুষের প্রতিনিধি সে, তাই যেখানে দু-দেশের সীমারেখা সেখানেই তার বসবাস।

আমেরিকার স্টুডিয়ো সিস্টেম থুড়ি আমেরিকার রাষ্ট্রব্যবস্থা তার এই ‘আঁতলামো’ ভালোভাবে নেয়নি। ‘মডার্ন টাইম্স’ (১৯৩৬) ছবিতে যন্ত্রপাতির ভিতরে ঘুরতে থাকা চ্যাপলিন তাই যতটা বোধ-বুদ্ধি রহিত প্রযুক্তির ব্যবহারকে ব্যঙ্গ করে ততটাই স্টার-ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেমের জাঁতাকলে তার কী অবস্থা হয়েছে সেটাও প্রকাশ করে। ব্যাপারটা ‘গোল্ড রাশ’ (১৯২৫)-এর সময় থেকেই শুরু হয়। চার্লির জবানবন্দি থেকে জানা যায় ক্লন্ডিক গোল্ড রাশের গল্পটা তার মাথায় আসে চিলকূট গিরি পথে যাবার সময়। নিজেকে নধর মুরগি হিসেবে ভাবার দৃশ্য পরিকল্পনাটি তার মাথায় আসে আমেরিকার পথিকৃৎ একজনের নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া ক্যানিবালিজ্‌ম-এর ঘটনা থেকে! চ্যাপলিন তাই মনে করত হাস্যরস আপাতবিরোধী কারণ তা উত্থিত হয় বিষাদ বা দুঃখ থেকে। উপহাসের ভিতর দিয়ে যে-হাস্যরস নির্গত হয় তা মানুষের অনেক অসহায়তাতে প্রলেপ দেয়, না হলে সে পাগল হয়ে যেত। নরভুকবৃত্তির এ হেন ব্যাঞ্জনা আমাদের হাসতে হাসতে স্তব্ধ করে দেয়। এই মুরগি অনুষঙ্গ রাষ্ট্রের চোখে আসলে ছিল প্রান্তিক মানুষের প্রতিমূর্তি!

নধর মুরগিরূপী চ্যাপলিন, ‘গোল্ড রাশ’ (১৯২৫)

এখান থেকে শুরু, ১৯৪০-এর ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’-এ হাঁস জুতো টুপি ছড়ির ভবঘুরে চ্যাপলিন অন্তর্হিত, পড়ে আছে শুধু তার গোঁফটা! আসলে ১৯৩৮ সাল নাগাদ চার্লির বন্ধু ভেনডারবিল্ট জার্মানি থেকে তাকে পাঠাতে থাকে কিছু পোস্টকার্ড। সেখানেই প্রথম চোখে পরে গোঁফ চুরির ব্যাপারটা! চার্লি লিখেছে সে-কথা, “ও আমার গোঁফ চুরি করেছে! ঐ গোঁফ আমি আবিষ্কার করেছিলাম! অবশ্য এই গোঁফ-সহ ওর মুখ আমার মুখের বাজে নকল— পুচকে ঠোঁট ও এলোমেলো চুল নিয়ে ঐ মুখে ফুটে উঠেছে অশ্লীল ভাঁড়ামো। হিটলারকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা আমি ভাবিওনি। কিন্তু যখন আইনস্টাইন ও টমাস মানকে জার্মানি ছেড়ে চলে যেতে হল, তখন হিটলারের ঐ মুখ আর কমিক না থেকে হয়ে উঠল ভয়ংকর।” ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’ শুরুর সময়ে খবর আসতে থাকে জার্মানি রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। আমেরিকা-ইংল্যান্ড জল মাপতে শুরু করে, নাৎসি জার্মানিকে আপাতত চটানো যাবে না। ছবিটার বিরোধিতা শুরু হয়। বলা হয় ছবিটার মুক্তি এই দু-টি দেশে চিরকালের মতো নিষিদ্ধ করতে হবে। এদিকে ফ্রান্সের অঁদ্রে ম্যাজিনোর নামে নামাঙ্কিত ‘ম্যাজিনো লাইন’ নামক যুদ্ধের জন্য তৈরি দুর্গ ধূলিসাৎ হয়, ফ্রান্স অধীনস্থ হয় হিটলারের, অতঃপর ডানকার্কের দিকে এগিয়ে চলে রণতরী যুদ্ধ-বিমান। আমেরিকা প্রমাদ গোনে ও ডাক পড়ে ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’-এর! বলা হয় “তোমার ছবি তাড়াতাড়ি কর, সবাই অপেক্ষা করছে এটার জন্য।” কিন্তু ডিক্টেটর হ্যানকেল (হিটলারের নকল)-রূপী ইহুদি নাপিতের শেষ সম্ভাষণ মনঃপূত হয় না প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট-সহ গোটা মার্কিন সাংবাদিককুলের, বিশেষত, “in the name of the democracy— let us use that power— let us all unite…”। রাষ্ট্রশক্তি বুঝতে শুরু করে যা আগে কেবল সন্দেহ ছিল আজ তা প্রমাণিত হচ্ছে, এ-লোক খুবই বিপজ্জনক। ১৯৪৭-এ ‘মঁসিয়ে ভের্দু’ ঝড় বইয়ে দেয় আমেরিকা জুড়ে, বন্ধ করে দেওয়া হয় ছবির মুক্তি! নিজে বিবাহিত হয়েও, বড়োলোক মহিলাদের বিয়ে করা ও তারপর তাদের হত্যা করা এই এখন চ্যাপলিনের কাজ! সরাসরি পুঁজিরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এই ফতোয়া ম্যাকার্থি যুগে চ্যাপলিনকে দেগে দেয় আমেরিকাবিরোধী হিসেবে, দেশদ্রোহী হিসেবে, কমিউনিস্ট হিসেবে! যদিও তিনি এইচ. জি. ওয়েল্‌সকে বলেছিলেন, “আপনি যদি সমাজতন্ত্রী হন তাহলে বিশ্বাস করুন, পুঁজিবাদ বিনষ্ট, পৃথিবীর জন্য আর কী আশা থাকবে যদি রাশিয়ায় সমাজতন্ত্র ব্যার্থ হয়?” ১৯৫২ সালে তাকে স্থায়ীভাবে মার্কিন দেশ ছাড়া করা হয়।

ডিক্টেটর হ্যানকেল (হিটলারের নকল), ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’ (১৯৪০)

প্রকৃতপক্ষে চলচ্চিত্রের আদি যুগে যে ক-জন বিরল প্রতিভাধর স্রষ্টার সৃষ্টি চলচ্চিত্রকে নাটক ও সাহিত্যের মধ্যবর্তী স্থানে উপনীত করেছিল চ্যাপলিন তাদের মধ্যে প্রধান বললেও অত্যুক্তি হয় না। ভঙ্গি, বেশভূষা, চরিত্রচিত্রণ সব কিছুর মধ্যে শুরু থেকেই তার স্রষ্টাসুলভ সাক্ষর বিদ্যমান, রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, “বানিয়ে তোলা জিনিশ নয়, হয়ে ওঠা পদার্থ’। শিল্পের এই আদন্ত মৌলিক রূপ তার চলচ্চিত্রগুলিকে যেমন দিয়েছে বিশুদ্ধতার স্বীকৃতি তেমনই তার প্রতিভাকে করে তুলেছে শেক্সপিয়ারের সমতুল্য! কারণ, সেও শেক্সপিয়ারে মতোই বাণিজ্যের চলতি সবগুলি প্রথা মেনে নিয়েও স্তর-বহুল শিল্পী হতে পেরেছিল। অর্থাৎ, ভোক্তার তারতম্য অনুযায়ী তার আবেদনের স্তরও আলাদা-আলাদা, কিন্তু নিম্নতম স্তরেও বঞ্চিত হতে হয় না যেহেতু নিছক বিনোদন-উপভোগের সমান অংশীদার সবাই।

উপলব্ধি কী? চার্লির জবানবন্দি থেকে পাওয়া যায়, “‘লাইম লাইট’ (১৯৫২)-এর ছবির চূড়ান্ত পর্যায়ে কমেডিয়ান ক্যালভেরোর উপলব্ধিই আমার উপলব্ধি: জীবন গতিশীল এবং তাই প্রগতি।” ‘লাইম লাইট’ ছবির শেষে পিয়ানো বাদকের ভুমিকায় যে-অভিনেতার দেখা পাই আমরা তার নাম ‘বাস্টার কিটন’। চ্যাপলিনের সমতুল্য প্রতিভার এই স্ল্যাপস্টিক কমেডিয়ানের সুদিন তখন পড়ে আসছে কিন্তু ক্যালভেরোর ভালোবাসা থেকে যায় তার প্রতি। চার্লি ও চ্যাপলিন সত্যিই কোনোদিন জীবন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি। কি ‘মঁসিয়ে ভের্দু’-তে কি ‘সিটি লাইট’-এ, কি প্রতিবাদে কি প্রেমে, সদা প্রাণবন্ত এই ভাঁড় এই ভবঘুরে তাই আজও আমাদের এত প্রিয়। ক্যালভেরো মারা যায় টেরিকে প্রাদ প্রদীপের আলোর নীচে রেখে, কিন্তু আমরা জানি আর একজন চার্লি চ্যাপলিন (মৃত্যু— ২৫শে ডিসেম্বর, ১৯৭৭) আর কোনোদিনও আসবে না এই পৃথিবীতে!

Categories
2021-July-Essay

মানস শেঠ

মিথ্রিডাটিয়ম: নীল রঙে মিশে গেছে ইতিহাস

“এ বিষের নাই রে শেষ!
শুরু শুধু আছে?—
কখনো থাকে এ বিষ দূরে
কখনো বা কাছে।”
— মাজু ইব্রাহিম

বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হয়েছে রাজার। খবরটা ছড়িয়ে পড়া মাত্রই রাজ্য জুড়ে শুরু হয়ে যায় চাপা গুঞ্জন— রানিই বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করেছেন রাজাকে। কারণ, অন্য কোথাও তো নয়, নিজের বিলাসবহুল ভোজনকক্ষেই মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে রাজাকে। রানি ছাড়া আর অন্য কারো পক্ষেই সেই ভোজনকক্ষে ঢোকা অসম্ভব। এমনই তর্ক বিতর্কতে উত্তাল রাজ্য। তবে রাজ্যের সবাই যে রানিকে খুনি ভাবছেন তা অবশ্য নয়। অনেকেই মনে করছেন, কোনো অজ্ঞাত আততায়ীর কাজও হতে পারে এটা।

কৃষ্ণ সাগরের দক্ষিণ তীর জুড়ে গড়ে উঠা পন্টাস রাজ্যের রাজা পঞ্চম মিথ্রিডাটিসের মৃত্যু রহস্যকে কেন্দ্র করে দেশ তখন সরগরম। কে হত্যা করলেন রাজাকে— সেই প্রশ্নে বিভক্ত রাজ্যবাসী। সেই রহস্য উদ্‌ঘাটন না হওয়ায়, তখন থেকেই আজও দ্বিধাবিভক্ত ইতিহাস।

খ্রিস্টপূর্ব ১২০ অব্দে বিষক্রিয়ায় যখন মৃত্যু ঘটে রাজা পঞ্চম মিথ্রিডাটিসের, তাঁর দুই পুত্র তখন নিতান্তই নাবালক ছিলেন। জ্যেষ্ঠ পুত্র মিথ্রিডাটিস্‌ ইউপাটরের বয়স তখন বারো। আর কনিষ্ঠ পুত্র মিথ্রিডাটিস্‌ ক্রেস্টাস্ তখন আরও ছোটো। রাজার মৃত্যুর পর, জ্যেষ্ঠ পুত্র মিথ্রিডাটিস্‌ ইউপাটরকে সামনে রেখে রানি লেয়ডাইসই হয়ে উঠলেন সাম্রাজ্যের সর্বময় কর্ত্রী। রানি লেয়ডাইস ছিলেন অত্যন্ত চতুর। রাজ্যের শাসন ভার হাতে পাওয়ার পর রানি বুঝতে পারেন, কয়েক বছর বাদে বড়োছেলে মিথ্রিডাটিস্‌ ইউপাটরই এই সিংহাসনের প্রকৃত দাবিদার হয়ে উঠে আসবে। রীতি মেনে, তাঁকে তখন ছাড়তে হবে এই গদি। প্রমাদ গুনলেন রানি। ক্ষমতায় টিঁকে থাকতে গেলে কত কিছুই না করতে হয় মানুষকে! জ্যেষ্ঠ পুত্র মিথ্রিডাটিস্‌ ইউপাটরকে হত্যার নকশা তৈরি করলেন রানি লেয়ডাইস। একদিন, কিশোর রাজকুমারের অজান্তে, পিছন থেকে বর্শা নিক্ষেপ করেন কেউ। বর্শা লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায় সে-যাত্রায় বেঁচে যান কুমার। কিছু দিন পর, একপ্রকার জোর করেই, একটা পাগলা ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে, যাতে ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে মৃত্যু হয় তাঁর। কিন্তু, সে-যাত্রায়ও বেঁচে যান তিনি। ঘোড়ার পিঠ থেকে তাঁকে পড়ে যেতে দেখেননি কেউই। তবে ঘোড়ার পিঠে চেপে সেই যে লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গেলেন কুমার, তারপর থেকে আর কোনো খোঁজই পাওয়া গেল না। এই সম্পর্কে দুটো মত পাওয়া যায়। প্রথম মতানুসারে, নিজের বিপদ বুঝে কুমার নিজেই রাজপ্রসাদ ত্যাগ করেন এবং আত্মগোপন করে থাকেন। দ্বিতীয় মত, জ্ঞাতি শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করতে, কুমারকে অজ্ঞাতবাসে পাঠান স্বয়ং রানি।

“কতটা বিষ গিলেছ নিজে?
তারপর সব কিছু করলে বিষাক্ত।
কতটা বিষ ছড়িয়েছ সুখে?
তারপর করলে আমাকে এত ক্ষতবিক্ষত।।”
— দীপেশ সরকার

অগত্যাই ছোটোছেলে মিথ্রিডাটিস্‌ ক্রেস্টাস্‌কে সামনে রেখে রাজকার্য পরিচালনার যাবতীয় দায়ভার নিজ হাতে তুলে নেন রানি লেয়ডাইস। এদিকে সময়ের সাথে সাথে, অজ্ঞাত কোনো এক স্থানে বেড়ে উঠতে থাকেন কিশোর মিথ্রিডাটিস্‌ ইউপাটর। তিনি বুঝতে পারেন তিনিই দেশের রাজা। রাজসিংহাসনের প্রকৃত দাবিদার। সেই দাবির জন্য এবার নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকেন তিনি। তিনি নিজেই বিপদসংকুল ভবিষ্যতের কথা বিলক্ষণ বুঝতে পারছেন। তিনি জানেন, কে বা কারা খাদ্যে বিষ মিশিয়ে হত্যা করেছেন তাঁর বাবাকে। বিষক্রিয়ায় বাবার মৃত্যু ভাবিয়ে তোলে কুমারকে। অস্ত্র নিয়ে সামনাসামনি মোকাবিলায় ভীত নন তিনি। কারণ, এখন তিনি একজন বীর যোদ্ধা হিসেবেই পরিচিত। তিনি চিন্তিত গুপ্তহত্যায়। কিশোর ইউপাটরের মনে সবচেয়ে আতঙ্ক তৈরি করেছে— গুপ্তহত্যা তথা বিষক্রিয়ায় মৃত্যু। সম্ভাব্য বিষক্রিয়া থেকে মুক্তির উপায় নিয়ে সারাক্ষণই ভাবতে থাকেন তিনি। বিষ প্রতিরোধ করতে পারে এমন কিছুর খোঁজ করতে শুরু করলেন তিনি। এই অজ্ঞাতবাসের দিনগুলোতেই বিভিন্ন ভেষজবিদের সাহায্য নিয়ে বিষ প্রতিষেধক প্রস্তুত করতে সচেষ্ট হলেন ইউপাটর। বিভিন্ন গাছের ছাল, মূল, পাতা, ফল, ফুল প্রভৃতি সংগ্রহ করতে থাকেন তিনি। সেই সমস্ত ভেষজকে কখনো বেটে, কখনো শুকিয়ে, কখনো গরম জলে ফুটিয়ে নানান মিশ্রন প্রস্তুত করতে শুরু করলেন। এই ধরনের নানান পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে এক সময়ে প্রস্তুত করেই ফেললেন এক বিষ প্রতিষেধক। এবার নিয়মিত সেই বিষ প্রতিষেধক ব্যবহার করতে শুরু করলেন তিনি। এই সমস্ত বিষ গ্রহণের ফলে প্রথম প্রথম ভীষণ রকমের অসুস্থ হয়ে পড়তেন তিনি। কিন্তু স্বল্পমাত্রায় নিয়মিত বিষ প্রতিষেধক নিতে নিতে ক্রমেই বিষ প্রতিরোধী হয়ে উঠেতে থাকেন। তিনি জানতে পারেন, তাঁর রাজ্যে ‘পন্টিক ডাক’ নামে এক ধরনের হাঁস আছে, যারা বুনো ও বিষাক্ত গাছপালা খেয়ে বেঁচে থাকে। বিষ প্রতিরোধের আশায় বিষাক্ত গাছপালার সাথে পন্টিক ডাকের রক্ত মিশিয়ে নিয়মিত গ্রহণ করতে শুরু করেন মিথ্রিডাটিস্‌ ইউপাটর। এছাড়াও এক জাতের বিষাক্ত মৌমাছির মধুও সেবন করতেন তিনি। এই সমস্ত বিষ গ্রহণ করে সর্ব অর্থেই বিষ প্রতিরোধী হয়ে উঠলেন তিনি।

খ্রিস্টপূর্ব ১১৩ অব্দ। সাত বছরের অজ্ঞাতবাস কাটিয়ে অবশেষে প্রকাশ্যে আসেন মিথ্রিডাটিস্‌ ইউপাটর। সোজা হাজির হলেন রাজধানী সিনোপ শহরে। দখল করলেন সিংহাসন। সিংহাসনে বসলেন রাজা ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিস্‌ হিসেবে। সিংহাসনে বসেই প্রতিশোধ নেন মায়ের উপর। বন্দি করেন রাজমাতা লেয়ডাইস এবং ভাই মিথ্রিডাটিস্ ক্রেস্টাস্‌কে। দেওয়া হয় কারাদণ্ড। হত্যা করতে থাকেন সিংহাসনের সম্ভাব্য সমস্ত দাবিদারদের। ১১৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দেই কারাগারে মৃত্যু ঘটে মা ও ভাইয়ের। কথিত, রাজার নির্দেশেই হত্যা করা হয় তাঁর মা ও ভাইকে। নিজের বংশে সিংহাসনের আর কোনো দাবিদার না রাখার লক্ষ্যে, নিজের বোন লেয়ডাইসকে (মায়ের মতো একই নাম) বিবাহ করেন তিনি।

“উগ্র বিষ শরীরে প্রবেশ করিলে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই তাহার চরম ফল ফলিয়া শেষ হইতে পারে, কিন্তু বিষ মনে প্রবেশ করিলে মৃত্যুযন্ত্রণা আনে— মৃত্যু আনে না।”
— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

এত কাণ্ডের পরও কিন্তু বিষ প্রয়োগে গুপ্তহত্যার ভয় থেকে নিষ্কৃতি পাননি রাজা ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিস্‌। নিজের রান্নাঘরে কড়া প্রহরার ব্যবস্থা করেন তিনি। নিয়োগ করেন রয়্যাল টেস্টার। খাবার চেখে দেখার জন্য। তাছাড়া আগের মতোই এখনও নিয়মিত সেবন করে চলেছেন বিষ প্রতিষেধক। কিন্তু তাতেও যেন নিজেকে বিপন্মুক্ত ভাবতে পারছেন না তিনি। নিজের নিরাপত্তা নিয়ে অনেক চিন্তাভাবনা করার পর, অবশেষে এক সর্ববিষ প্রতিষেধক প্রস্তুত করার কথা ভাবলেন তিনি। এই সর্ববিষ প্রতিষেধক হবে এমন এক মিশ্র ভেষজ, যা সমস্ত ধরনের বিষক্রিয়াকে প্রশম করতে সক্ষম হবে। সেই সর্ববিষ প্রতিষেধক প্রস্তুত করার জন্য তলব করলেন রাজবৈদ্য ক্রেটুয়াসকে। ক্রেটুয়াসকে জানালেন, সর্ববিষ প্রতিষেধক তৈরি করতে চান তিনি, আর এই বিষ প্রতিষেধক প্রস্তুতির দায়িত্ব নিতে হবে তাঁকে। রাজার ইচ্ছায়, সর্ববিষ প্রতিষেধক তৈরিতে ব্রতী হলেন ক্রেটুয়াস। ক্রেটুয়াস নিমগ্ন হলেন সর্ববিষ হরার প্রস্তুতিতে। নিরবিচ্ছিন্ন গবেষণা চালিয়ে অবশেষে তিনি সক্ষমও হলেন এক সর্ববিষহরা প্রস্তুত করতে। অচিরেই সেই সর্ববিষ প্রতিষেধক তুলে দিলেন তিনি রাজার হাতে। ক্রেটুয়াসের প্রস্তুত করা সেই সর্ববিষ প্রতিষেধক বা ইউনিভার্সাল অ্যান্টিডোট্‌স নিয়মিত গ্রহণ করতে শুরু করলেন রাজা ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিস্।

এক পরাক্রমশালী রাজা হিসেবেই ইতিহাসে বিধৃত হয়েছেন ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিস্‌। যুদ্ধক্ষেত্রে ও রণকৌশলে রাজা ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিস্ ভয়ংকর ছিলেন। রাজ্যভার গ্রহণ করার পরই রাজ্য বিস্তারে বিশেষ মনোযোগী হন ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিস্‌। প্রথমে আক্রমণ শানাতে থাকেন পার্শ্ববর্তী রাজ্য সমূহে। একে একে ছোটো বড়ো বিভিন্ন রাজ্য দখল করতে শুরু করেন তিনি। আনাতোলিয়া (তুরস্ক) অঞ্চলের রোমান মিত্র রাজ্যগুলো জয় করে ইজিয়ান সাগর তীরে রোমান রাজ্যের সীমানায় উপস্থিত হন ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিস্। এই সময়ে গোটা আনাতোলিয়া অঞ্চল নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করে ফেলেন তিনি। ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিসের হাতে রোমান মিত্রদের পরাজয় এবং পন্টাস রাজ্যের বিস্তারে চিন্তিত হয়ে পড়েন রোমানরা। ফলস্বরূপ খ্রিস্টপূর্ব ৮৯-৬৩ অব্দের মধ্যে তিনবার মিথ্রিডাটিসের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন রোমান সেনাদল, ইতিহাসে যা ‘মিথ্রিডাটীয় যুদ্ধ’ নামে খ্যাত। রোম সাম্রাজ্যের সীমা থেকে মিথ্রিডাটিসকে হঠাতে রোমান সেনাধ্যক্ষ লুসাস কর্নিলিয়স সুলার নেতৃত্বে বিশাল এক বাহিনী হাজির হয় পন্টাস রাজ্যের পশ্চিম সীমান্তে। শুরু হয় ‘প্রথম মিথ্রিডাটীয় যুদ্ধ’ (খ্রিস্টপূর্ব ৮৯-৮৫ অব্দ)। প্রাথমিকভাবে কিছুটা পিছু হঠেন মিথ্রিডাটিস্‌। পরে পালটা আঘাতও হানেন তিনি। ফলে, দীর্ঘস্থায়ী হল যুদ্ধ। বছর চারেক পর, খ্রিস্টপূর্ব ৮৫ অব্দ নাগাদ রোমান রাজ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে সেনাধ্যক্ষ সুলার রোম অভিমুখে যাত্রা করেন। একই সময়ে মিথ্রিডাটিসের বিজিত রাজ্যেও শুরু হয় বিদ্রোহ। ফলে উভয়পক্ষই যুদ্ধ বিরতিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। পরিণতিতে সমাপ্তি ঘটে প্রথম মিথ্রিডাটীয় যুদ্ধের। ঘরোয়া অবস্থা কিছুটা সামলানোর অনতিকাল পরেই আবার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন দু-পক্ষ। শুরু হয় ‘দ্বিতীয় মিথ্রিডাটীয় যুদ্ধ’ (খ্রিস্টপূর্ব ৮৩-৮২ অব্দ)। এই যুদ্ধে রোমানরা পিছু হঠতে থাকে এবং শেষপর্যন্ত পরাজিত হয় ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিসের কাছে। এরপর বেশ কিছুটা সময় শান্তই ছিল উভয়পক্ষ। খ্রিস্টপূর্ব ৭৩ অব্দে, পার্শ্ববর্তী বেথিনিয়া রাজ্যে নিজেদের পছন্দের উত্তরাধিকারকে মসনদে বসাতে গিয়ে ফের যুদ্ধে জড়িয়ে পরেন এই দুই রাজ্য। শুরু হয় ‘তৃতীয় মিথ্রিডাটীয় যুদ্ধ’ (খ্রিস্টপূর্ব ৭৩-৬৩ অব্দ)। দশ বছর ধরে চলল এই তৃতীয় মিথ্রিডাটীয় যুদ্ধ। এই যুদ্ধে রোমান সেনাদের নেতৃত্ব দেন সেনাধ্যক্ষ নিয়াস পম্পিয়স ম্যাগনাস, যিনি ‘পম্পি’ নামে অধিক পরিচিত। দীর্ঘ দশ বছর ধরে যুদ্ধ করার পর, মিথ্রিডাটিসের রণক্লান্ত সেনাবাহিনীর একাংশ বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। রাজ্যলাভের আশায়, পন্টাস রাজ্যের এই সেনা বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন মিথ্রিডাটিসেরই দুই পুত্র। মিথ্রিডাটিসের সেনারা আর যুদ্ধ করতে নারাজ। বরং এই যুদ্ধবাজ রাজার বিরুদ্ধে রোমানদের সাহায্য করতেই বেশি আগ্রহী তাঁরা। পরিণতিতে তৃতীয় মিথ্রিডাটীয় যুদ্ধে পরাজিত হন মিথ্রিডাটিস্‌। নিজের স্ত্রী-কন্যা ও নিকটজনদের নিয়ে রাজধানী সিনোপ ত্যাগ করে কৃষ্ণসাগরের উত্তর দিকে ক্রিমিয়া উপদ্বীপের প্যান্টিকাপিয়ম শহরের দুর্গে আত্মগোপন করেন তিনি। এদিকে মিথ্রিডাটিসের পালানোর সংবাদ পেয়ে তাঁর সন্ধানে নেমে পড়েন রোমান বাহিনী। তাঁকে বন্দি করতে প্যান্টিকাপিয়মে সেনা পাঠান পম্পি। প্যান্টিকাপিয়ম অভিমুখে রোমান সেনা অভিযানের খবর জানতে পারেন মিথ্রিডাটিস্‌। কিন্তু না, রোমানদের হাতে কিছুতেই ধরা দেবেন না তিনি। রোমানদের গ্রেপ্তারি এড়াতে সপরিবারে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেন মিথ্রিডাটিস্‌। নিজের সঙ্গে সবসময়েই কিছু পরিমাণে বিষ বহন করতেন মিথ্রিডাটিস্‌। সেই বিষ তিনি তুলে দিলেন তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের হাতে। রাজা ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিসের দুই মেয়ে— মিথ্রিডাটিস্‌ (পিতার মতো একই নাম) ও নাইসা, বিষ পান করে মৃত্যু বরণ করেন। তাঁর স্ত্রীও বিষপান করা মাত্রই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। অবশিষ্ট বিষের সবটাই পান করেন মিথ্রিডাটিস্‌ নিজে। সেই মারাত্মক বিষপান করেও মৃত্যু হল না তাঁর, দিব্যি বেঁচে রইলেন তিনি। নিয়মিত বিষ প্রতিষেধক গ্রহণ করে, এখন তিনি নীলকণ্ঠ। কোনো বিষই আজ আর বিষ বলে প্রতীয়মান হয় না তাঁর কাছে। সকল প্রকার বিষের প্রতিরোধী হয়ে গেছেন তখন তিনি। তাই মারাত্মক এই বিষ সেবন করার পরও দিব্যি বেঁচে রইলেন মিথ্রিডাটিস্‌। তবে বিষক্রিয়ার ফলে তাঁর শরীর তখন অবসন্ন, ক্লান্ত। দেহে আর শক্তি যেন নেই তাঁর। নির্জীব হয়ে নিজ শয়নকক্ষে পড়ে আছেন তিনি। কিন্তু বেঁচে আছেন। এদিকে রোমান সেনারাও শহরে ঢুকে পড়ল বলে। কিন্তু না, জীবন থাকতে রোমান সেনাদের হাতে ধরা দেবেন না তিনি। অগত্যাই তাঁর বিশ্বস্ত এক সেনাকে ডেকে মিথ্রিডাটিস্ নিজেকে হত্যা করার আদেশ দিলেন। অনুরোধেই হোক বা নির্দেশে, তাঁর অনুগত সেনার হাতেই শেষপর্যন্ত মৃত্যু বরণ করলেন রাজা ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিস্।

ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিসের মৃত্যুর পরই রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করেন রোমান সেনারা। রাজার ঘরে ঢুকে, মৃত রাজাকে উদ্ধার করেন তাঁরা। রাজার পাশে একটা পুঁথি উদ্ধার করেন রোমান সেনাদল, তাতে বেশ কয়েকটা বিষ প্রতিষেধক প্রস্তুতির উপায় লিপিবদ্ধ করা ছিল। সেনাধ্যক্ষ পম্পির হাতে সেই পুঁথি তুলে দেন রোমান সেনারা। পুঁথির গুরুত্ব বুঝে তা সযত্নে রক্ষা করেন সেনাধ্যক্ষ পম্পি। কিছুকাল পরে, তাঁর উদ্যোগেই এই পুঁথির রোমান অনুবাদ প্রকাশিত হয়।

“আমার ফণার মণি করিলাম উল্কাপিণ্ড তুলি
মহাকাল-করে জ্বালাময় বিষ-কেতন উঠিনু দুলি।
সেদিন আমারে প্রণতি জানাতে এলো কত নর-নারী,
বন্দিয়াছিল আমারে ভাবিয়া সাগ্নিক নভোচারি।”
— কাজী নজরুল ইসলাম

মিথ্রিডাটিসের মৃত্যুর পর, সাময়িকভাবে ইতিহাসের অন্তরালে চলে যায় এই সর্ববিষ প্রতিষেধকের ঘটনাটা। মিথ্রিডাটিসের মৃত্যুর প্রায় ১০০ বছর পর রোমান মেডিক্যাল এনসাইক্লোপেডিয়ার রচয়িতা অলাস কর্নিলিয়স সেলসাস (খ্রিস্টপূর্ব ২৬-৫০ খ্রিস্টাব্দ) তাঁর বিখ্যাত ‘দি মেডিসিনা’ গ্রন্থে ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিস্‌ ব্যবহৃত এই সর্ববিষহরার প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। এই গ্রন্থে এই সর্ববিষহরার উপকরণের বিশদ বিবরণও পেশ করেন তিনি। সেই সময়ে, মিথ্রিডাটিস্‌ ব্যবহৃত সর্ববিষহরার নাম হয়তো অনেকেই শুনেছিলেন, কিন্তু সেই বিষহরার উপাদান সম্পর্কে একেবারেই অন্ধকারে ছিলেন সবাই। সেলসাসের বই প্রকাশের পর থেকেই দ্রুত জনপ্রিয়তা তথা পরিচিতি লাভ করতে থাকে এই সর্ববিষহরা। অচিরেই, মিথ্রিডাটিসের নাম থেকেই এই সর্ববিষহরা ‘মিথ্রিডাটিয়ম’ নামে পরিচিতি লাভ করে। কোনো কোনো গ্রন্থকার আবার এই সর্ববিষহরাকে মিথ্রিডাটাম নামেও উল্লেখ করেছেন। মিথ্রিডাটিয়মে মোট ৩৬টা উপাদান আছে বলে উল্লেখ করেছেন সেলসাস। এই ৩৬টা উপাদানই ভেষজ তথা উদ্ভিজ। এর উপাদান হিসেবে এমন কিছু ভেষজের ব্যবহার দেখা যাচ্ছে, যা কেবলমাত্র মধ্যপ্রাচ্য বা ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলেই পাওয়া যায়। সেলসাসের বই প্রকাশের পর থেকেই মিথ্রিডাটিয়ম নিয়ে আগ্রহ বাড়তে থাকে আমজনতার। খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে রোমান সাম্রাজ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে মিথ্রিডাটিয়ম। অনেকেই ভাবতে থাকেন এই প্রতিষেধক সেবন করলে বুঝি সমস্তরকমের অসুখ থেকেও নিস্তার পাওয়া যাবে। দীর্ঘ ও সুস্থ জীবনের আশায় রাজা প্রজা নির্বিশেষে এই মহৌষধ সেবনের আগ্রহ প্রকাশ করতে থাকেন। কিন্তু কে বানাবে সেই মিথ্রিডাটিয়ম? ক্রেটুয়াসের মতো সেই কুশলী ওষুধ নির্মাতা কোথায়? তবু হাল ছাড়তে নারাজ অনেকেই। ফলে নতুন করে প্রস্তুত হতে লাগল মিথ্রিডাটিয়ম। অনেকেই সেই প্রস্তুত প্রণালিতে বড়োসড়ো পরিবর্তন আনলেন। বিষের তীব্রতা বাড়াতে অনেকেই আরও নতুন নতুন উপাদান যুক্ত করলেন। খ্রিস্টীয় প্রথম শতকেই মিথ্রিডাটিয়মের ৫৪ খানা উপাদানের কথা উল্লেখ করেছেন প্রখ্যাত রোমান ইতিহাসবিদ প্লিনি (২৩-৭৯ খ্রিঃ)। এই তথ্য থেকে এটা স্পষ্ট, ইতিহাসের একটা পর্যায়ে মিথ্রিডাটিয়ম প্রস্তুতিতে অত্যন্ত সক্রিয় ছিলেন বেশ কিছু মানুষ। তবে মিথ্রিডাটিয়ম প্রস্তুতিতে কেউ সফল হয়েছেন বলে শোনা যায়নি। কারণ, শুধু উপাদানের বর্ণনা থেকে তো আর কোনো ওষুধ বা রাসায়নিক পদার্থ তৈরি করা সম্ভব নয়। সেইসমস্ত ওষুধ বানাতে গেলে নির্দিষ্ট তাপ, চাপ, কতক্ষণ ধরে তা ফোটাতে হবে, কোনটা গুঁড়ো করে ব্যবহার করতে হবে, কোনটা গোটা ব্যবহার করতে হবে, সেইসমস্ত তথ্যও তো জানা প্রয়োজন। সব দিক বিবেচনা করে, আধুনিক মিথ্রিডাটিয়ম বিশেষজ্ঞরা তাই স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, মিথ্রিডাটিয়ম বানানো সম্ভব নয়। তাছাড়া মিথ্রিডাটিয়মের উপাদানগুলোর পরিমাপ লক্ষ করলে দেখা যাবে, কোনোটা ২৯ গ্রাম নেওয়া হয়েছে, তো কোনোটা ২৬.৬৬ গ্রাম, আবার কোনোটা ১.৬৬ গ্রাম নেওয়া হয়েছে। আজ থেকে অত হাজার বছর আগে, এত সূক্ষ্ম পরিমাপ করা যে, কীভাবে সম্ভব হল, তা অনুমান করা কিন্তু বেশ কষ্টকর।

চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক প্রাচীন এবং চিত্তাকর্ষক বিষয় বিষবিদ্যা বা টক্সিকোলজি। সাপের বিষ, মাকড়সার রস, আর্সেনিকাদি খনিজ বিষ, হেমলক জাতীয় ভেষজের সাথে দীর্ঘদিনের পরিচয় মানুষের। ইতিহাস বলছে, মিথ্রিডাটিসের সমসময়ে রোম, গ্রিস, এশিয়া মাইনর অঞ্চলে বিষপ্রয়োগে গুপ্তহত্যা ছিল বহু রাজপরিবারের ইতিহাসের অঙ্গ। কোনো সন্দেহ নেই যে, সেইসমস্ত রোমহর্ষক মৃত্যুগুলোর সাথে একসঙ্গে ঠাঁই পাবে ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিসের মৃত্যুও। ইতিহাসের গর্ভে থেকে যায় কত বিষাক্ত ইতিহাস।

গ্রন্থঋণ:
1. ‘The Poison King: The Life and Legend of Mithradates, Rome’s Deadliest Enemy’, Adrienne Mayor, Princeton University Press, 27 March 2011.
2. ‘Mithridates the Great: Rome’s Indomitable Enemy’, Philip Matyszak, Pen & Sword Military, Reprint Edition, 1st March, 2016.