Categories
2021-July-Poem

স্বস্তিকা ভট্টাচার্য

জল

যে চলে গেছে
তার প্রতি প্রশ্ন নেই
যে রয়ে গেছে
তার প্রতি আশা নেই।

মানুষ তো জলের মতো
যে-ধারা একবার গেছে,
তা আর ফেরত আসে না।

অথচ টাইম কল
তার জন্য কত অপেক্ষা!

মাছবাজার

বাজারে যাই
মাছের জল পেরিয়ে এগোই।

দাম বেড়ে গেছে
তাই পছন্দমতো মাছ নিতে গিয়েও
না নেওয়ার অজুহাত পেয়ে যাই।

খুব রেগে গেলে বলি,
“মাছের বাজার পেয়েছ বুঝি!”
অথচ জানি
ওই বাজার থেকে কীভাবে মুখ ঢেকে বেরোই।

বাড়ির খুদেরা রোজ এক মাছে বিরক্ত
কিন্তু ওই দুপুরের দিকে পড়ে থাকা
নেতিয়ে যাওয়া মাছ ছাড়া আমার গতি নেই।
পরের মাসের এক তারিখ আসে যায়।
মাছের রকমে বদল আসে না, আনি না তাই।

যা সস্তায় পাওয়া যায়,
তার বেশি কিছু আমি জানি না।

সাধারণ কথা

যারা পাশাপাশি ঘুমায়
সবাই মা-সন্তান, স্বামী-স্ত্রী
পরিচিতও নয়।
ফুটপাথে পিঠ রেখে
আকাশ দেখে একসাথে
রাত্রিবেলা পাশ ফিরে ঘুমায়।

দরকার শব্দটা ভীষণ সীমিত।
ভাত, কাপড়
মাথার ওপরে ছাদ।

মিছিল গেলে তাকিয়ে থাকে
কোলে বাচ্চাকে নিয়ে
যেন ফ্রি-তে সার্কাস!
কেউ ঝান্ডা নিয়ে চলে গেলে
শোনে,
“আমরা আসলে দিন বদলাবে।”

সংসার

মা চিরকাল একটাই সংসার বুনলেন
বাবার যত রাজ্যের গল্প,
সেই সংসারের দাওয়ায় বসেই।
মায়ের সংসারে এদিকে গল্প নেই,
একটা নিয়মে বাঁধা সব।
অথচ বাবার গল্পে,
কোনোদিন সংসার আসেনি।

এ-কারণে কি প্রয়োজনেই শুধু কথা বলতেন,
মা-বাবা?

ঈশ্বর

ঈশ্বর এখনও চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে আছেন।
লন্ঠন খুলে নিয়ে বউ চলে গেছে,
পুকুর ঘাটের অন্ধকারে স্নান সারতে কষ্ট হয়,
ঈশ্বর স্নান সেরে এলে তাকে ‘ বলে ডাকি।

নৈবেদ্য সাজিয়ে রাখে মানুষ,
ঈশ্বর মানুষে উত্তীর্ণ হন খাবারের চাহিদায়।
ছোঁয়াছুঁয়ি খেলতে গিয়ে অস্পৃশ্য হন ভগবান,
এক পাতে ভোগ খায় ভোগী আর দাতা।

আলেয়া জড়িয়ে উপাসক হন সাধু,
গেরুয়ার আড়ালে লালিত লোভ জেগে ওঠে।
“ঈশ্বর আছে, আছে ঈশ্বর”— চিৎকার করে ওঠে উপচার,
প্রণামীতে নেশা করেন ভগবান।

বউ লন্ঠন নিয়ে ফিরে আসে ভোরে।
যেটুকু যা ধুয়ে গেছিল, তাই লেগে যায় গায়ে
মানুষজনম ঘুচে যায় গোপনে।
ধরা-চুরো-নৈবেদ্য, ঈশ্বরজনম আবার প্রচারিত হয়।

ঈশ্বর ফের চাদর মুড়ি দিয়ে জব্বর ঘুমের প্রস্তুতি নেন।

 

Categories
2021-July-Poem

মহিউদ্দিন সাইফ

শুরুর দিনের কথা

সেই হাঁসীর শূন্যতা ভরা মুখ ঈর্ষ্যারতি-র
জেনে কাছে গেলাম।
সাধ হল, এত অপাঠ্য পীত লিপি কার?
চকিতে আকাশের ইঙ্গিতময় সুবাস কষ্টিপাথরের হয়ে এল।
যে-আভাস বহুদিন, বহুকাল থেকে
উঠব উঠব করে রোজ গাঢ় হচ্ছিল
আজ নেহাতই অবলীলায় সরোবর খুলে বেরিয়ে এল
ঝাড়তে ঝাড়তে শত ডানা।

বাতাসের সূক্ষ্ম কণাগুলি,
যেগুলিকে জানতাম ধুলোপিণ্ডের সারাৎসার বলে,
সহসা চৌচির হয়ে
ফোটাতে লাগল একটি করে নিশুত কদম।

আমি আকাশ আর মাটির মাঝখানে
সিঁদুর-হরিতাল খুঁটিটা ধরে ভাবছি,
হাঁস, হব কি হব না…!

পাখিঅলা

একদিন এক পাখিঅলা এল, আমাদের খুশবুদার দেশে।
জন্মের পর এই প্রথম।
পাখিদের মুখ এত গাঢ়!
রঙ্কিনীর মনে হল।

সে কত কিসিমের, কত ছাঁদের রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা।
নির্মল কেশগুচ্ছে গরবিনী
পীতধড়ায় ইঙ্গিতময়,
কাঁচা অঙ্গের মখমলে সাত ঘোড়া
চরে বেড়াচ্ছে, প্রগল্ভ মাঠ।

লাল পদ্মের মতো পাখিঅলা,
যেন দীর্ঘ জীবন পার হয়ে এসে শোনাল অভিনব কথা।
ত্রিভুবনের গূঢ় রঙ ছেনে ফোটাল
স্ফূর্তি নামের এক বুদবুদ।

আমরা ছেলেবুড়োরা যাবতীয় চোখ খুলে দেখতে লাগলাম
ভিন্ন ভিন্ন পাখি থেকে উত্থিত হচ্ছে
একএকটি নিরল শব্দ।
সেই ধ্বনি ক্রমে গাঢ় হতে হতে
আমাদেরই মাঝে রুয়ে দিচ্ছে শত শত যুগনদ্ধ তরু।

ঘোড়াজন্ম

পড়ে থাকি
অর্জুন গাছের গোড়ায়
আরও সব দারাসুত
মুখে মুখ গুঁজে, গুফতুগু
বপ্তা মংলার সাথে, খুবধীরে, প্রণয়মেদুর।
সে এক ইশানচাপা, নেশাড়ু অখিল,
ছড়িয়ে রাখে উঁইমেকা, থানে
একগাছি সুতো, কাজল, এয়োতির সিঁদুর।
এন্তেজাম করে, সাঁকরাতে, মাধুকরী
গন্ধে উথাল জুড়িভোগ।

পিতার থেকে মন্ত্র নিয়ে, অঙ্কুরিত নাদ
বেঁধেছে এই কচ্ছপী বীণা।
সেই থেকে তার হাতে ভরণ-পোষণ,
গান শুনি: অর্ধমাগধি দোঁহা।

নির্ভাবুক বসে থাকি, দ্রুতমন্দ ছায়ায়
গোপন টুরুই ডাকে কোনো কোনো দিন।

জ্যোৎস্না রাতে

জ্যোৎস্নায় লহর, উড়ছে চরকার সুতো।
শুক্লা দ্বাদশীর আকাশ, পাহাড়ি নীল ও মন্থর।
তা-ই অধিকার করে বসে আছে বুড়ি
বৃহন্নলা বটের তলায়।

সীতালাউ ফুল টুপাতে রাখা
অপার্থিব দোপাটির আলো, শিশির স্বাগতা।

এদেরই গোপথ দিয়ে নেমে আসে
আরও একটি বুড়ি, অঙ্গুষ্ঠপ্রমাণ।
ত্বকের কুঞ্চনে সৌরভ, গুলঞ্চবাহার।
মহাদানা ঘাটে দূরজন্মের স্মৃতির মতো নেমে
ভাঙে গোল পাথরটির গুমান।
মাখিয়ে দেয় মাথায় চন্দন পায়ে গেরুমাটি।

হাত ধুতে ধুতে
ব্রহ্মানন্দ তালশাঁসের মতো হয়ে আসে পুকুর।
একটি মোহন পাখির দিকে চোখ ঠেরে
হেসে ওঠে,
কে এই মরমিয়া?

জল…

নিরাময়

‘একদিন জলাশয়ের মতো এক যুবতী এসে
আমাদের শৈশবের কাঁথাকানি রাখা
প্যাটরা খুলতেই চারপাশে প্রস্রাবের মহক।’

এটুকু শুনেই মনে হল, কার কাছে যেন
রাখা আছে তামার ঘুনসি।
পিতামহের জালকাঠিগুলি পেলাম না বলে
নামাজ-পাটির থেকেও উঠে এল প্রাণ?
হাঁস আর সাপের খেল দেখতে চেয়ে
সারারাত কাবার হল জ্যোৎস্নার খোঁজে…

কিন্তু এ-ধূলিশয়ান সংসারে দেখলাম
একটি কাবরা ছাগল চরে বেড়াচ্ছে সঞ্চালিত বাতাসে।
আউল করা সবুজে দু-একখানা বংশলোচন।
আর অদূরে মকরধ্বজ আকাশে
কে যেন আমাদের হরিমান রোগ
শুক আর শারিতে স্থাপন করছে,
বুনো হরিদ্রায় ছড়িয়ে দিচ্ছে।

 

Categories
2021-July-Poem

পিন্টু পাল

দৃশ্যের বাগান থেকে


শুয়োপোকার মতো কামনা হু-হু করে ঢুকে পড়ে বুকে। প্রেমবিহ্বল আবেগ। যেন স্থির জলে খোলামকুচি এঁকে দিয়েছে ঢেউয়ের আলপনা। বিকলাঙ্গ অতীত ক্রমশ পাথর করে দেয় সব।শিমুলের ডালে নেমে আসে বছরের প্রথম বসন্ত। প্রচ্ছন্ন আগ্নেয়গিরির মতো উদ্বেগ উসকে দেয় জন্মদাগের উঠোন।

ওগো সর্বগ্রাসী, ভালোবাসায় যে বড়ো ভয়!


ধীরে ধীরে আগাছা শিকড় নামায়। ভুল মন্ত্রোচ্চারণের মতো শঙ্কা চিড় ধরায় হাড়ে। রজনীগন্ধা সুবাস হারিয়ে পড়ে থাকে বিছানায়। দক্ষিণে নলখাগড়া দল পাকাতে পাকাতে ঝাঁক বেঁধে আসে।জ্বরে পুড়ে যায় পিঠ।

কালো বিড়াল আঁচড়ে দেয় দেহজবলয়।


শালগাছের পাশেই রাধাচূড়া। সাদা পায়রার দল সোনালি গমের শীষ নিয়ে বসে। চঞ্চল ঠোঁট। দূরে লাজুক শালুক পুকুরে ফুটতে ফুটতে আড়চোখে দ্যাখে উন্মাদ মাছরাঙা পাখি। গাছে গাছে শ্যামাকোকিল আকাশ ছুঁয়ে গান আনে। গোঁসাইপুর ডিঙিয়ে বেজে ওঠে একতারার সুর।

তবে কি বৃষ্টি এল এই!


অন্ধকারে চকচক করে ওঠে যোনি। যেন অভ্র ছিটিনো জলভেজা বালুতট। পায়ে রাবার গাছের আঠা। বৃষ্টি নামছে দেখে পেখম মেলে এগিয়ে আসে ময়ূর।

অন্ধকারে শরীর এগিয়ে যায় সাপের মতন


এই ঘন আলিঙ্গনের মাঝে রাস্তা বয়ে যায়। মৃত পালকের মতো মায়া ভাসতে ভাসতে আছড়ে পড়ে মাটিতে। কাঠঠোকরার নরম ঠোঁটে লেগে থাকে বুড়ো পলাশের রস। জাদুনগরীর জানালায় শোক চুপটি করে বসে। দু-চোখের দৃশ্য ভেঙে ভেঙে যায়।

প্রতি রাতে জোনাকিপোকা আলো নিয়ে অসুখ সারায়

 

Categories
2021-July-Poem

খুরশিদ আলম

গোলপোস্ট

অন্ধ আয়নার ভিতর মুখ দেখছি
দেখা অ-দেখা মুখের নিজস্ব ব্যাপার। আমাদের
শেষ দেউটি কবে নিভে গিয়েছিল হাতের পাঁচের মতো
তারপরেও গুনে চলেছি ক্রমপর্যায়।
কখনো ব্যর্থ প্রেমিক কখনো দাবা খেলার ছক।
এই যে এত এত ঘুঁটি সাজিয়ে নিরঙ্কুশ আশাবাদ ব্যক্ত করা
একের পর এক তাঁবু সাজিয়ে স্ট্রাইকার না ফরওয়ার্ড
অথচ পাশ ফিরে তাকালেই ফাঁকা গোলপোস্ট

জোড়া দাঁত

জোড়া দাঁত দেখলে আমার ভয় হয়
তীব্র কোনো জ্বরের অনুষঙ্গ
আমাকে ভাবতে শেখায় সাত-পাঁচের যোগফল
মানুষ ও ভাত যেভাবে দেশ, মানচিত্র ফুটিয়ে তোলে
তা আসলে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি
যার পর্দা সরালেই আবহমান কোনো নদী আর নদীর ভিতর কান্না

দেশ

ঝুলন্ত ব্রিজের মতো একটি দেশ চারখানা পায়া
টিনের ছাওনি
যার সমস্ত শরীরজুড়ে অসংখ্য দাগ
ঋণগ্রস্ত কাঁধ নিয়ে তবু সে দাঁড়াতে চায়
স্বপ্ন দ্যাখে
মোহভঙ্গ যুবকের মতো সেও চায় একটু ভাত দুটো রুটি

মাটি

মাটি আলগা হলে বোঝা যায়
শুরু অথবা শেষ
প্রতিটি সম্পর্কের শক্ত ভিতের নাম মাটি
আলগা হলে চিড় ধরে ভেঙে যায়
নির্মাণ বিনির্মাণের ভেতর যে-বেঁচে থাকে তার উৎস হল মাটি

সফল

ক্ষতচিহ্ন মাত্রই অবস্থান বদল করে
ভাবতে শেখায় দোষ গুণের পরিধি
আলো উৎসের সন্ধান
সফলতা মানে এক দৌড়ে আকাশ ছোঁয়া নয়
প্রতিটি সফলতার পূর্বে শিখতে হয়
এক-একটি সিঁড়ি বেয়ে ওঠার কৌশল

 

Categories
2021-July-Poem

বন্ধুসুন্দর পাল

ভিতরে

ভিতরে আলাপ, আর কত কাছে যেতে হবে!
শুকনো পাতার দলে
কাঠকুড়ুনির পায়ের আওয়াজ বেচে
নামিয়ে এনেছে যে আমাকে
তার অবসর কেন শুধু আমি একাই গ্রহণ করব!

সে কি আশ্রয়ের চেনাশোনা কেউ?
অথবা পালতোলা নৌকা, যার শুধু বিরহ দিয়েই মাথা ঢাকা
নিচে, প্রেমিক-প্রেমিকারা পয়সা দিয়ে একঘণ্টা সময় কিনে নিচ্ছে ইচ্ছেমতো…

তা দিয়েই পেট চলে অপূর্ণ নদীর
ভেসে যাই আমি যার নির্দেশে, অতলে
সেও কি ভিতরে ডাকে! আমি সাড়া পাই…

অথবা স্তনহীন বৃদ্ধা, যে, মাছের পেটের ভিতর
আজন্ম যৌনতা চাপা দিয়ে সে পালিয়ে বেরিয়েছে
নদী থেকে সমুদ্রের তলা ভেদ করে

আর তার উপর দিয়ে একটা শকুন কার যেন মরা-চোখ খুবলে নিয়ে উড়ে যাচ্ছে
তাদের কি শুভদৃষ্টি সম্পন্ন হইল…

বাহানা

ফুরিয়েছে গৃহকোণ, ফুরিয়েছে আলো-চাল
ফুরিয়েছে ব্যথা

এসো চিঠি খুলে চিনি, এটা কার হাতের-লেখা

চিনেছি নোলক পড়া নাকের বাগান
চিনেছি ভাতের ফ্যান
গড়িয়েছি বালিমাখা মুখের বেগম

এত যে ঐশ্বর্য, তা কি অশৌচের কেউ নয়?

এসো হে জীবন, আমাকেও ছুঁয়ে দ্যাখো,
কেমন তোমার অতিমারির বাহানা…

পায়রা

সাধনা বিলিয়ে দিচ্ছি, ফিরে তাকিয়ো না, প্রিয় মুখ। অথৈ অবজ্ঞার অনুষ্ঠানে পাতপেরে খেতে এসো আলো। তোমার নাভির নির্মাণকার্য শেষ হলে একটা পায়রা পুষব সেখানে। সারা গায়ে তখন অনুরোধের আসর বসবে। তোমাকে যারা অনুশোচনার মতো দেখতে বলে বিদ্রূপ করত চিলেকোঠার ওপার থেকে, তাদের শরীর বেয়ে আকন্দফুল ঝরে পড়বে। আমার শীতলতা গ্রাস করো, বর্ণা, এই জঙ্গল আমাকে অশৌচ বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছে তোমার কাছে। ব্যাপ্তির তলদেশ ফাঁক করে যে-ক-টা শুকনো কাঠ কুড়িয়ে এনেছি, সেগুলো একান্তই শুধু আমার। সেখানে যে-সব শব্দ জোর করে ভাগ বসাতে আসবে তাদেরকে বৈধব্য আগুনে পুড়ে মরতে হবে। আমার শরীরে কোনো সিঁড়ি নেই, তুমি যেখানেই পা ফেলবে সেখানেই পোড়া কাঠ দেখতে পাবে। এভাবেই এক পা এক পা করে পা ফেলতে ফেলতে, ক্লান্ত হয়ে যখন আমার চিলেকোঠার ছাদে গিয়ে একদিন বসবে, তখন সমস্ত পোড়া কাঠ পায়রা হয়ে পুরো ছাদ সমেত তোমাকে ঘিরে ফেলবে। তোমার আর কোথাও যাওয়ার উপায় নেই…

ক্ষমা

জবরদখলকারী বিদ্বেষের মনোরম আতিথেয়তা আমাকে স্বীকার করবে বলে আলোরা দরজার সামনে হত্যে দিয়ে পড়ে আছে। আমার সারা শরীর তখন ঘুমে ঢাকা। অতল মিশিয়ে দিয়েছে যে, তার কোনো বিকেলের ফেরিওয়ালা নেই। সন্ধ্যেবেলার গুমোগন্ধে যে-কাঁথাটা লাজুক কবিতার নিম্নদেশে এসে বার বার চিৎকার করে বলছে, ‘আমি তাকে চিনি!’ তবুও রাজহাঁসের মনখারাপে পুকুরপাড়ে মেঘ করে আসে না। ঘাসেদের সংগমের শব্দকে কোনো পাগল আর প্রেমিকা বলে ডাকে না। তবুও তোমার পিঠ বরাবর যে-শব্দ গড়িয়ে পড়ছে আমার অতল ভেঙে, ক্রমশ নীচে আরও নীচে, তাকে তুমি ‘ক্ষমা’ বলে ডেকো…

সমঝোতা

আশ্রয়ের দিকে মুখ না ফিরিয়ে যে চলে যাচ্ছে খণ্ড খণ্ড পৃষ্ঠা ভরে, তার দিকে সময় হাঁ করে ঢোঁক গিলে নিচ্ছে। এই যে বিষম খাওয়া জলজ সময়, এই যে আলজিভে কবিতা লুকিয়ে রোদের পিঠে ছুরি মারা অবয়ব, যা তাকে সম্পূর্ণতা দিয়েও হিসেব করতে বসেছে, তার কোনো পটচিত্র নেই আমার এই ঘুমন্ত বিছানায়। আমার পাশ ফেরার আগেই যে-জানালা রোজ উলঙ্গ কাঙালপনায় অক্ষরের সঙ্গে সমঝোতা করে চলেছে, আমাকে দোষী সাব্যস্ত প্রমাণ করে আমার থেকে ভোরবেলা ছিনিয়ে নিয়ে গেছে, তার থেকে আমি কখনো সকাল ভিক্ষে করিনি ।

আয়োজনে যে-আলো শরীর ঢেকে দেয়, তারও তো বৈশাখী ঝড়ে উড়ে যেতে মন চায়। এই নির্ভরতার উপোসবেলা ভেঙে যে আজও প্রতিটা ঘরের দোরে দোরে সন্ধ্যে দেওয়ার জল পড়ার শব্দ শোনে তার কাছে থেকে একটা অন্ধকার চুরি করে পালিয়ে বেরিয়েছি। তুমি আমকে শাস্তি দেওয়ার ছলে একবার অন্তত জড়িয়ে ধরো, দ্যাখো, আমি কেমন বিচ্ছিন্ন হতে হতে একটা নতুন শব্দের মতো চুপ করে শুয়ে আছি তোমার কোলে। কেউ আমাকে খুঁজে পাচ্ছে না। আর তোমাকে খুঁড়তে যে-সব শব্দকর্মীরা এসেছিল, তারা কেউ পারিশ্রমিক না পেয়ে জেলে হয়ে গেছে…

 

Categories
2021-July-Poem

সৌরভ মন্ডল

সেরে ওঠো সভ্যতা


খটখটে মটির ফাটল দিয়ে দুটো হাত
কচি সবুজ সকাল নিয়ে আসে দু-চোখে;
প্রথম কেঁদে ওঠা বিদ্রোহে
আদম-ইভের কামনা লেগে থাকে;
পরস্পর-বিরুদ্ধ; ভেতর থেকে বাইরে
পাপের সংক্রমণ ভালোবাসার কবচকুণ্ডল
পরিয়ে দেয় কাজলের টিপে।
নাভির অন্তর্লীন যোগ আলগা হলে
প্রথম কঁকিয়ে ওঠা যন্ত্রণায় থাকেন ‘মা’।

গতকাল জন্মদিনের বাসি কষা মাংস
ডাইনিং টেবিলে; আহারান্তে
ইল্বল ডেকে ওঠে: “বাতাপি! বাতাপি!”
খাদ্য ও খাদকের সম্পর্ক নষ্ট করে
প্রতিটি নতুন সম্ভাবনা।
আশ্রয় আশায় ছোটো ছোটো ডাল-পাতা:
কেউ যদি ভালোবেসে বেড়া এঁকে দেয় চারধারে।
বাড়ন্ত বেলায় হাত এগিয়ে যায়
পড়শির নিষিদ্ধ প্রদেশ ছোঁবে তাই;
সব বেড়া ভাঙতে চায়,
ভালোবাসা ঘৃণায় বদলে যায়।

খাবার ডেলিভারি বয় লাঞ্চ-প্যাকেট হাতে
পুরোনো বন্ধুর দরজায়;
উপযোগিতার বাজারে আত্মীয়তা
অপ্রাসঙ্গিক। “রেটিংটা প্লিজ
দিয়ে দিন স্যার।”
সুস্বাদু বিরিয়ানির গন্ধে, উষ্ণতায়
মিয়ানো ঝালমুড়ির স্মৃতি শ্বাসরুদ্ধ;
স্বপ্নরা রোদের সাথে যুদ্ধ করে করে
ক্লান্ত হয়; কত সূর্যমুখী
ভরদুপুরের আশ্রয় খুঁজে চলে
কল-বয়ের রোমশ ক্লিভেজে।

বিকেলের ফ্ল্যাট ছোটো হতে হতে
খাঁচা হয়; খাঁচার পাখি উড়িয়ে দিলে
দেদার আকাশ!
আকাশে মুক্তি আছে, আছে ভয়ও।
সূর্য লুকিয়েছে পাটে। “ইকারাস!
আরও, আরও উঁচুতে উড়ে যাও,
আকাশে আকাশ হয়ে যাও।”
পড়ন্ত বেলা; মোমেরও ক্লান্তি আছে,
ঘসা লেগে লেগে সন্ধি আলগা হয়ে গেলে
ডালে এসে বসে পাখি;
দুপুরে স্খলিত বীর্য জল হয়ে আসে
বিকেলে; আশ্রিত আশ্রয় হয়ে ওঠে।

শেষ বেলায় পাখিরা বাসায় ফেরে;
গাছের ডাল কিংবা খাঁচায় কোনো তফাত নেই
অন্ধকারে; রঙের কোনো ভেদ নেই,
সব ক্ষমতার রংই কালো।
রোদ্দুর-ধোওয়া পালকের আলো নেভে কবে,
কেউ তার হদিশ রাখে না।
যারা কথা ভুলে যায়, গান ভুলে যায়,
তাদের মিছিলের একক স্লোগান রোদের মতো
ফুরিয়ে আসে আপোশের ঘরে
সহবাসে; ভালো থাকার লোভে
হেজে গিয়ে নিঃশেষ হয় খোঁয়াড়ে।

গাছ আর পাখির রসায়ন বাঁচিয়ে রাখে
জন্ম-চক্র; ছানার জন্য নিয়ে আসা বীজ
খসে পড়ে মাটিতে, উর্বর মাটি
গাছের জন্ম দ্যায়; সেই গাছই তো একদিন
বাড়ি হয়ে ওঠে, বাড়িতে বাড়ে ছানা।
বাড়ি আসলে ঘটনাচক্র;
এক অসংগঠিত বিদ্রোহ।
কত ঘর ভেঙে যায়, ভেসে যায়,
পুড়ে ছারখার হয়; তবু সভ্যতা
গড়ে তোলে বাড়ি, শূন্যে;
তঞ্চক সভ্যতা কি হিসেব রেখেছে
কত পাখি চলে গেছে বনে, অন্তরীক্ষে, সমুদ্রে
মিথ্যে নিয়মের পিছনে লাথি মেরে;
অভিশাপ ছুড়ে গেছে কত!
সেরে ওঠো সভ্যতা; বেঁচে থাক
মানুষ।

Categories
2021-July-Poem

উজ্জ্বল ঘোষ

শস্যময়ূর

ক্রন্দসী, তাঁতের কণ্ঠদাগ ধরে ধরে গিয়ে দেখি
নীল মাঠে শস্যময়ূর ফোটাচ্ছ তুমি।
অক্ষরের মাঠ বরাবর হেঁটে হেঁটে
এসে পড়লাম এ কোন শস্যের মাঠে!
গর্ভস্থ ভ্রূণের মতো বাঁধা পড়লাম তাঁতের নাড়ির ডাকে।
ধ্বনিময় মাতৃগর্ভে, আশ্চর্য ছন্দের ঘরে, শুনি
মাতুলকুলের হাতে বোনা হয় গায়েহলুদের হলদে শাড়ি।

দূর নও, শান্তিপুর, মায়ের যমজ দেশ তুমি;
আমাকে ফসল করো, শস্যে ভরে দাও।

ঘুঁটে পোড়ে গোবর হাসে

ঘুঁটে পোড়ে, তবু কেন গোবর হাসে, মা?
দহনে তৃপ্তির স্বাদ কেন খোঁজে আর এক দহন?

গোবরের গোল থেকে নাড়ি ছেঁড়া দুটো ঘুঁটে
ভীষণ আলাদা কেন পোড়ে;
হৃদিপদ্ম ছাই হলে মিশে যায় উনুনের বুকে!

অন্ধকার সুতো বাড়ে তোমাতে আমাতে।
অনক্ষ রুমালে বাঁধা থেকে যাব তুমি আর আমি?

সংখ্যার জননী তুমি সৃজনের গোল;
যদি চোখ মেলে দাও, যদি সেই শিশুর ঘুমোনো
বাবা আর মা-কে মলে দাও কান, তবে
পুড়ে ছাই ধুকপুক থেকে হৃদয় নিঃসৃত হবে।

প্যারাসুট

ধ্বনির প্রহরী আমি, পদাঙ্কের কান;
মনোমোনিয়ামে দেখো বেলো করে কারা—
বেলো করে পৃথিবীর পাঁচটি আঙুল

পাখিরা শুদ্ধ ‘নি’ জানে, কোমল ‘রে’ তাও জানে;
আমি মনোমোনিয়াম, বাজি
ভীষণ গোপনে, শোনো,
সারেগামা প্যারাসুট বোনে

ঠেলে নিয়ে যাও যদি খাদের কিনারে
প্রজাপতি প্যারাসুটে উড়ে যাব দূরে

আবার প্রসূত হব মাটি আর জলে

লবণ সত্যাগ্রহ

দিগম্বর ফকিরের বেশে হেঁটে যাই চলো দু-শো একচল্লিশ মাইল।
এসো ডাক পাড়ি, সাড়া দিই, শুনি সমুদ্রকথন।
শব্দেরা ঢেউয়ের মতো ছুঁয়ে দিক এসে;
স্বরের ভেতর ছবি, ছবির ভেতর স্বরলিপি
রেখে দিয়ে, ফিরে যাক নিজেদের দেশে।
দিগম্বর ফকিরের বেশে তৈরি করি চলো প্রাণের লবণ।

বলো বীর

(গৌতম বসু-র শ্রীচরণে নিবেদিত)

“জয়লোভে যশোলোভে রাজ্যলাভে, অয়ি,
বীরের সদ্‌গতি হতে ভ্রষ্ট নাহি হই।”
— কর্ণ-কুন্তী-সংবাদ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

অঘোর পল্লব নিয়ে ধরাশায়ী শাল
ভাগীরথী বুকে বেঁধে দাঁড়িয়ে মশাল
ঠান্ডা পর্ণে লেগে আছে বীরের গঠন
তোমার চিন্ময় জল তোমার বাহন

পরাস্ত বাতাসে বয় জয়ী ইতিহাস
যাপন চিন্তিত মেঘ, জীবন আকাশ
আকাশ ভ্রমণপথ, আকাশই পথিক
পাতালে অর্ধেক বৃত্ত— অদেখা অনীক

শ্মশানে শুধোয় এসে রাজার সন্তাপ :
বীরের সদ্‌গতি থেকে ভ্রষ্ট হওয়া পাপ?

 

Categories
2021-July-Poem

রূপক চট্টোপাধ্যায়

একগুচ্ছ গোলাপের প্রলাপ


প্রলাপের তীর ঘেঁষে আমার
জ্বরের সংসার!
রোজ থালাবাটি ছোঁড়া। গালাগালি। অরন্ধন। তবু
বনের কোনে ধাতব চাঁদ এলে
গার্হস্থ নিয়মের পদাবলী ফেলে, কালো
কলজে ধুতে যাই, জোৎস্না গোলা জলে।


তির ছুড়ে দাও।
বুক পেতে আছি! আমি ইচ্ছামৃত্যু চাই না।
বরং মৃত্যুর কাঁধে ভর দিয়ে, তোমার দুপুর
দেখব। দেখব বিকেলের বিনুনি তুমি কত
সহজ করে বাঁধো!
কত সহজ হয়ে যায়
বসন্তকাল! শীতের পিছু পিছু
সাদা রাজহাঁস ছুটে যায়। আমার
মৃত্যুর পিছু পিছু ছুটে আসুক
আদিম বর্ষাকাল!


সৌভাগ্যের শৈলশিরায় একদিন
সূর্যোদয় হোক। আমরা সবান্ধব দেখতে
যাব। আমরা ধাতব যন্ত্রণাকে বুকের ভেতরই
কবর দিয়েছি! সেখানে এখন বনতুলসীর ঝোপ,
বিষণ্ণ ডাহুক। আর ছিটকে পড়া ভ্রম!


একদিন ঠিক ধর্মের বাকল খুলে,
সূর্যোদয়ের সামনে,
উলঙ্গ মানুষ হয়ে দাঁড়াব।
সেই হবে শ্রেষ্ঠ পরিচিতি। নাগরিক মানপত্র
ছিঁড়ে ফেলে, ভাসাব আড়বাঁশিতে
ভীমপলশ্রী। চন্দনবনের রাধাকে দেখে
ডেকে উঠবে ডাহুক পুরুষ!


শরীর জুড়ে ক্যাকটাস হিংস্রতা নিয়ে
জেগে আছি জগদ্দল ভ্রমে। মৃতনদীর
তৃষ্ণারা জোনাকি সেজেছে। এই দায়ভার
বইতে পারি না আর। তীব্র আকাঙ্ক্ষায়
জ্বলে উঠে কালপুরুষ হই মাঝরাতে।
মাঝে মাঝে মনে হয়, পৃথিবীর অন্তঃস্থলে বসে
আমিই গর্ভসঞ্চারের শেষ মানবশিশু হব!

 

Categories
2021-July-Poem

শীর্ষেন্দু পাল

দেয়াল

দেয়াল ভাঙা হলে
ইটেরা সবচেয়ে খুশি হয়
জমাট বাঁধা বিভাজনরেখা থেকে
খসে পড়ে মাটির অনিচ্ছা…
পুড়ে ইট হয়ে গেলেও
মাটি কোনোদিনই বিভাজন চায় না।

বাসনকোসন

যত সাবধানেই রাখা হোক
শব্দ একটু হবেই
গড়িয়ে পড়ে গায়ে লেগে থাকা জল
আসলে… কান্নার সময়
প্রত্যেকেই একটু আনত হয়।

জুতোর র‍্যাক

জুতোর র‍্যাক আসলে নির্বাক বেড়াল
থাবাতে লুকিয়ে রাখে
পথের দুঃখরেণু
ছাতা এক প্রকার আনন্দ
যা হারালে দুঃখের চেয়েও
শোক হয় বেশি।

আয়না

শুধু কি আয়নাই জানে
তোমার শরীরে ক-টা তিল
ফুটন্ত চায়ের জল দেখলে মনে হয়
তোমার তিলগুলো চোখ রাঙাচ্ছে
উষ্ণতায় জেগে উঠবে বলে

বিছানা

কুঁকড়ে গেছে মাঝখানের সুতো
সংগমের পর বিছানা চাদর যেন
সকাল বিকেল নির্বাক ছলছুতো
জানি— সহজ কথা
বলা হল না এখনও।

কুকার

আবহে শিবরঞ্জনী নয়
বিদ্রূপ করে কুকারের সিটি
চমকে ওঠা ধরা পড়ার ভয়ে
ভিতর প্রদেশ আলগা করে মুঠি।

 

Categories
2021-July-Poem

অনিকেশ দাশগুপ্ত

চাঁদের ডিঙা

জঙ্গল-রমণীর মতন জোয়ার-চাঁদটি
মুছে ফেলল সমস্ত পশ্চিম, নীল তাঁতের সীমানায়—
দু-খানি আদুর উৎস থেকে ঝরে পড়ল চাঁদনি গাঙ,
পার্বত্য মেষের বিতান ছিল এমন এক; নতুন পাতার—
ঘ্রাণে ভরে ওঠা মাঝরাতের অরণ্য কীভাবে যে
শালের মদে পোয়াতি হয়ে উঠত ধীরে-ধীরে, নীল ঠোঙার
খাঁজ, নুনে-ঠেকানো-জিহ্বা আর বিষের কালো খনি—
একাকার হয়ে কুমকুমের গাঢ়-কিশোরী-ছোঁয়া বয়ে বেড়াত,
মৃণালে তার চাঁদের কত পঙ্‌ক্তি, কাজলের বেড়ি—
নিরন্ন বোবা আঙিনায় আইবুড়ো বৃক্ষ-দুহিতাটির চারপাশে
সাদা মাড়ের ঘ্রাণ ছড়িয়ে ভাসিয়ে দিত আকাশী ডিঙা

সমাধি

যেদিন ফিরে এলাম প্রাচীন এ-সমাধিপ্রাঙ্গনে
ঘাসের শতসহস্র মণির অন্তরে লুটিয়ে পড়ে শরীর ভরে যেন
মুগ্ধ সবুজ সর, আকাশ-নীল কাঁটার মতো সুউচ্চ বৃক্ষকামে
মেনে নিলাম তীব্র বসতি, সোপানের আশ্চর্য শ্লথ ফাটলে
আঙুল রেখে একটি স্ফুরণে পরিপূর্ণ হল নিঃসীম
বাগিচা, রঙিন বাস্কেট থেকে সরীসৃপ চক্ষুর মতো মনে হল
ঘাস-লতা, বাবুই-আঁশ; নখের ডগায় এই এক কণা অভ্রের বাতি
পুরোনো জানলার পারে ছড়িয়ে পড়ল, তালপাতার হাওয়ায়
জ্যোৎস্না-হৃদয়গুলির এপার-ওপার ভেদ করে সহস্র
বছর ধরে উড়ে এল ঘাসের আত্মা

আষাঢ়

হলুদ শিখাটিকে লক্ষ করে ছুটে চলেছে
নিদ্রাতুর পাতার ওপরে ময়ূরবর্ণের মেঘ-পুঞ্জ
রানির অন্তিম জরি থেকে নানান ছল ও কৌশলের
নাতিদীর্ঘ স্বচ্ছতা, অন্তহীন জলছাপ রেখে পাখির শ্যামলিমে
হারায়, হারায় আলোকোজ্জ্বল সাইকেলে প্রথম নিষ্ক্রমণ
একে-একে, জ্যোতিষ্কপারে রুধিরে চন্দ্র-হংসের দীঘলতায়,
অরব মর্ষকামী ওষ্ঠে লেগে থাকে মীন-চাঞ্চল্য
পাখোয়াজ-নীল তরঙ্গে বিবশ কাঁচুলি ও-ঘাটে—
শ্রী-অঙ্গে ভিজেছে কোন দূরের জলতিলক-নারী-ঘাস
সারসের নিবিড় রক্তিমতা ছুঁয়ে নেমে আসে অলক্ষ্যের আকাশ

চৌকাঠ

কখনো-বা মোড় ঘুরেই আবিষ্কৃত হত বিবশ নদীর প্রিয়তমা,
নীল অরণ্য-চাদরে মাথা পেতে দেখতাম শীর্ণ সৌর-পথ
তিরের অন্তিম আবেগ আর একটু পরেই যেন থিতিয়ে পড়বে
শতসহস্র বৃক্ষশাবকে; বঙ্কিম সমুদ্রধারে এমনই এক সান্ধ্য
লাইটহাউসে আমরা, জন্তুদের কর্কশ দেহতল
উপড়ে ফেলেছিলাম

সাদা ধাতব মার্জনার ঠোঁটে লেগে থাকত মদ, চূর্ণ চন্দ্রদ্বয়,
মগ্ন পিপুলের নীচে বিষাক্ত দাঁড় টেনে-টেনে কখন যেন
ক্ষয়ে যেত সে-বিশুদ্ধ বজ্রসুখ, নীরক্ত অটল সমৃদ্ধির

ট্রামডিপোর অন্য প্রান্তে

ডিপোর বিজ্ঞাপনগুলি এমন মেঘলা দিনে
নীল সীমন্তের বঙ্কিম ট্রামসারিতে কাঁপা-কাঁপা তর্জমায়
উঠে আসে, তেঁতুলবীজের চুরমার ধ্বনিতে
বাদামি টেলিগ্রাফ তার থেকে
নিঃসীমে সরোবর কোণে উড়ে গেলে তুমি
যেন কোনো পতঙ্গবিদের
গাঢ় অসীম বীক্ষণ, নরম আরক্তিম এই পাদানিতে তখন
ঝড় বয়ে এসেছিল অন্য আর এক শতাব্দীর

বাজখাঁই খামের হাঁ থেকে সারি-সারি অশ্বখুরাকৃতি মঞ্চ
নেমে এলে নিমেষেই ধরে ফেলা হচ্ছিল অনন্ত সপ্তক
মন্দ্রে জোনাকিদের ঢেউ—

ইস্কাপনের সোনালি রিম থেকে তোমায় দেখেছি এলোমেলো
কানামাছির মতো কাদার মণ্ডে চমকপ্রদ ছুরি গেঁথে ফেলতে