Categories
2021-June-Essay প্রবন্ধ

অভ্রদীপ গঙ্গোপাধ্যায়

শব্দ-কল্প-ঋত্বিক

[‘মেঘে ঢাকা তারা’ ছবির শব্দ ভাবনা ও ধ্বনি মন্তাজ]

সনৎ বলল, কথা আছে। চলো। নীতার অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে। সে ‘না’ বলে পাশ কাটিয়ে বেরোতে চাইতেই, সনৎ তার হাত ধরে ফেলে। বিস্মিত গলায় বলে, নীতা! নীতা সনতের চোখে প্রখর দৃষ্টির দিকে তাকায়। কয়লার ট্রেন ইঞ্জিনের এক সুতীক্ষ্ণ হুইস্‌ল আমাদের বুকে এসে ধাক্কা মারে। সনৎ অপ্রস্তুতের মতো হাত ছেড়ে দেয়। সনতের মতো আমরাও সচকিত ও অপ্রস্তুত হয়ে পড়ি। এই হুইস্‌লের আওয়াজে আমাদের আলাপ শুরু হয়।

এই সুতীক্ষ্ণ হুইস্‌ল কেন ত্রস্ত করে? ছোটো জলার পাশে ঝুঁকে পড়া গাছ ও মাঠকে সঙ্গে রেখে রেললাইন চলে গেছে। মুহুর্মুহু না হলেও, এখানে ট্রেনের অবশ্যম্ভাবী আনাগোনা। এবং ঋত্বিক ইতিমধ্যেই, হুইস্‌ল বাজিয়ে ট্রেনের চলে যাওয়া, দু-বার দেখিয়ে ফেলেছেন। ছবির শুরুতে নীতার দাদা শঙ্করকে আমরা মাঠে বসে গান গাইতে শুনি। নীতা তার দিকে প্রশ্রয়ের চোখে তাকায়। দাদা-বোনের পশ্চাদ্‌পটে ট্রেন চলে যায় একরাশ কালো ধোঁয়া ছেড়ে। ছবি আরও কিছুটা অগ্রসর হলে, নীতা ও সনৎ ওই ঝুঁকে পড়া গাছের নীচে বসে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করে। নীতা উঠে দাঁড়াতে গেলে সনৎ হাত ধরে বলে, নীতা। ট্রেনের হুইস্‌লের আওয়াজ ভেসে আসে। নীতা বসে পড়ে। সন্ধ্যার আনত আলোয় তাদের সামনে রেখে ট্রেন চলে যায়। তারা একে-অপরের সামনে নম্র সুরে বসে থাকে।

তাহলে? তৃতীয় দৃশ্যের সঙ্গে, এই দুই দৃশ্যের মূল পার্থক্য অবস্থানের। তৃতীয় দৃশ্যের অব্যবহিত পূর্বেই নীতা কাশির দমকে রক্ত আবিষ্কার করেছে। সনৎ বিয়ে করেছে নীতার বোন গীতাকে। শঙ্কর গান গেয়ে নাম করার আশায় ঘরছাড়া। তাই ঋত্বিক এই দৃশ্যে ধ্বনি সংযোজন করেন বিশেষ মাত্রায়, যা ধ্বনি মন্তাজের রূপ নেয়। চলচ্চিত্রে মূলত দু-ভাগে ধ্বনিকে ভাগ করা হয়। যে-ধ্বনির উৎস আমরা দৃশ্যে বা শটে দেখতে পাচ্ছি— ডায়াজেটিক এবং যেক্ষেত্রে দেখতে পাচ্ছি না— ননডায়াজেটিক। প্রথমদুটো দৃশ্যে ট্রেনের চলে যাওয়া যে-শটে আমরা দেখতে পাই, সেই শটেই হুইস্‌লের ধ্বনি প্রয়োগ করেন ঋত্বিক। কিন্তু তৃতীয় দৃশ্যে হুইস্‌লের ধ্বনি আসে দু-টি শট আগে, কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই। হুইস্‌লের ধ্বনি শোনার পর আরও একটি শটে, নীতা ও সনৎকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখান ঋত্বিক। যে-শটে সনৎ ত্রস্ত হয়ে নীতার হাত ছেড়ে দেয়। তার পরের শটটিতে নীতা ও সনৎ ঝুঁকে পড়া গাছটির নীচে বসে থাকে। আমরা ট্রেনের চলে যাওয়া দেখতে পাই। এবং ঋত্বিক এই তিনটি শটকে জোড়েন দ্রুত লয়ে চলা ট্রেনের চাকার শব্দে।

অর্থাৎ, এই তৃতীয় দৃশ্যে এসে ট্রেনের হুইস্‌লের শব্দ তিনটি শটে ননডায়াজেটিক থেকে ডায়াজেটিক হয় এবং ঋত্বিক সেই ধ্বনির কম্পাঙ্ক স্বাভাবিকের চেয়ে আরও তীক্ষ্ণ করে তোলেন। যে-সনৎকে নীতা ভালোবেসে নিজের অধিকার দিয়েছিল, সনতের উন্নতির স্বার্থে ত্যাগ করবে ভেবেছিল নিজের আকাঙ্ক্ষা, সনৎ সেই অধিকার হারিয়েছে। সনতের তথা আপামর পুরুষজাতির, সম্পত্তি-মনস্তাত্ত্বিকরণের উপর এই স্বাভাবিকের চেয়ে তীক্ষ্ণ ট্রেনের বাঁশি, নিছক রেলের হুইস্‌ল হয়ে থাকে না, তা অ্যালার্মিং সাউন্ড এফেক্টে আছড়ে পড়ে। অথচ তা নিছক সাউন্ড এফেক্টে সীমাবদ্ধ থাকে না। দৃশ্যটিতে ধ্বনির উৎসকে অপরূপ কম্পোজিশনে দেখিয়ে, আমাদের মননে তা মিশিয়ে দেন এবং তাৎক্ষণিক উত্তেজনাকে প্রশমিত করে শান্ত ও গম্ভীর রসে পূর্ণ সংলাপে কাহিনির খাত বইয়ে দেন ঋত্বিক।

অথচ সাউন্ড এফেক্টের সরাসরি ব্যবহার ‘মেঘে ঢাকা তারা’ ছবিটিতে বিদ্যমান এবং তা বহুলচর্চিত। চাবুকের শব্দকে ঋত্বিক তিনবার তিন চরিত্রের জন্য ব্যবহার করেন, যদিও প্রেক্ষিত বদলে দেন প্রতিবার। এই চাবুকের শব্দ ননডায়াজেটিক ধ্বনি হিসেবেই প্রতিবার থাকে ও এর থেকে ক্লাসিকাল ধ্বনি মন্তাজের একটি উদাহরণ আমরা শিখে নিতে পারি। ঋত্বিক প্রতিবারই এই ধ্বনির সঙ্গে সমাপতন ঘটান দ্রুত লয়ে সেতারের বাজনে। এতে এফেক্টটি আরও তীব্র হয়।

সনতের পালটে যাওয়া বাহির ও অন্তরঙ্গকে দেখে নীতা। একইসঙ্গে সনতের বাড়িতে গীতার উপস্থিতিও সে টের পায়। ঋত্বিক কশাঘাতের ধ্বনি প্রথমবারের জন্য ব্যবহার করেন। দ্বিতীয়বার আমরা এই ধ্বনি শুনতে পাই ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি’ গানের শেষে এসে। শঙ্করের ব্যথিত মুখ পর্দায় ভেসে থাকে ক্লোজ-আপে। পিছনে তিনবার সশব্দে চাবুক পড়ে। তৃতীয় তথা অন্তিম প্রয়োগ, ঋত্বিক করেন ঝুঁকে পড়া গাছের নীচে, যা এই রচনার আধার, সেই দৃশ্যে। এবার নীতার চলে যাওয়ায়, সনতের অপরাধী মুখে অনবরত পড়ে কশাঘাতের আওয়াজ। অর্থাৎ নীতা, শঙ্কর ও সনৎ— কিন্তু প্রত্যেকের ক্ষেত্রে এই সাউন্ড এফেক্টের ব্যবহার, একই ভাবনায় হয় না। ভাবনার অন্তর ঘটে, যা পরিচালকের বক্তব্যকে সরাসরি আমাদের কাছে এনে দেয়।

সনতের প্রত্যাখানে নীতার চরিত্রের ট্র্যাজিকধর্মীতা আর সূক্ষ্ম থাকে না। তা রূঢ় রূপে আমাদের সামনে চলে আসে। তাই সিঁড়ি দিয়ে নামার সময়ে কশাঘাতের ধ্বনিপ্রয়োগ যেন অনেকটাই সাহিত্যধর্মী। যেন ঋত্বিক লিখছেন, ‘সনতের কথাগুলি ও তার শীতল ব্যবহার, নীতার হৃদয়ে কশাঘাতের মতো বাজিতে লাগিল।’ এরকমটি আমরা আগে জানিনি। কাজেই এখানে এক মুখ্য চরিত্র আর এক মুখ্য চরিত্রকে কশাঘাতে আহত করেছে, সেই ভাবই বর্ণিত। তৃতীয় প্রয়োগে, চরিত্রের প্রতি পরিচালকের মনোভাবকে আমরা প্রকাশ পেতে দেখি, এই ধ্বনির বারংবার ব্যবহারে। সনতের যাবতীয় প্রতিশ্রুতির যে আর কোনো মূল্যই নীতার জীবনে নেই, সনৎও যে আদতে একটি চিরন্তন পলায়নমুখী কাপুরুষ, নীতার তা জানা হয়ে গেছে বহুকাল। তাই সনতের মুখে প্রায়শ্চিত্ত ও আদর্শের কথা, নীতার কাছে অতি অবশ্যম্ভাবী খেলো মনে হবেই। টিউবারকিউলোসিস জর্জরিত ফুসফুসের কাছে এ-আলোচনা নিছক অপ্রয়োজনীয়। তাই সনতের শেষ কথাগুলিতে বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ না করে, ছাতা মাথায় তার চলে যাওয়ায়, সনৎ যেমন বুঝতে পারে, তার প্রায়শ্চিত্তের কোনো সুযোগ নেই (অন্তত নীতার কাছে সে-প্রায়শ্চিত্তের প্রয়োজন ফুরিয়েছে), তেমনি উপর্যুপরি কশাঘাতে ঋত্বিক যেন সনতকে শাস্তি দেন এই বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধে।

তবে দ্বিতীয় প্রয়োগটি এই তিনটির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং তা আত্মসমালোচনাময়। শঙ্কর চরিত্রটি, ‘মেঘে ঢাকা তারা’ ছবিটিতে, ঋত্বিকের আত্মস্বরূপ। সে-শিল্পী, ভ্যাগাবন্ড, ছেলেমানুষীতে ভরা এবং সাফল্য পাওয়ার আগের মূহূর্ত অবধি গোটা ছবিতেই সমাজের চোখে অপাঙ্‌ক্তেয়। এ হেন শঙ্করের কাছে নীতা যখন গান শিখতে চায়, বলে, বাসরে গাইতে হবে না! (গীতা ও সনতের বিয়ে)— শঙ্কর কি গান শেখায়? ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙলো ঝড়ে।’ অর্থাৎ, সে বুঝতে পারে। নীতার একটু একটু করে চলে যাওয়াকে সে প্রতিনিয়ত অনুভব করে। কিন্তু কিছু করতে পারে না। সে বেদনায় নীল হয়ে যায়। পরিচালকের অসহায়তা এভাবেই তার মধ্যে দিয়ে ফুটে বেরোয়। শেষ দৃশ্যে নীতারই মতো আর একটি মেয়ের চটি ছিঁড়ে যাওয়ায়, সে যেন পুনরায় নীতাকে দেখতে পায় ও কেঁদে ফেলে। গানের দৃশ্যে চাবুকের ধ্বনি, তাই ঋত্বিক যেন নিজের উদ্দেশ্যেই ব্যবহার করেন। এই অসহায়তা ও শোষণ তিনি সহ্য করতে পারেন না।

ছবিটিতে ঝিঁঝিপোকার ডাকের প্রয়োগও লক্ষ্যণীয়। আর পাঁচটা গড়পড়তা ছবিতে ঝিঁঝিপোকার ডাক আসে পারিপার্শ্বিকের সাথে, শুধুমাত্র আর একটি ধ্বনি উপাদান হিসেবে। ‘মেঘে ঢাকা তারা’-র প্রথমার্ধেও এভাবেই এই উপাদানটিকে রাখেন ঋত্বিক। এর বদল হয় যখন নীতার ছোটোভাই মন্টুর দুর্ঘটনার খবর আসে চিঠিতে। অনেক বেশি মাত্রার কম্পাঙ্কে ব্যবহৃত হয় ঝিঁঝিপোকার ডাক। ফলে এক আশ্চর্য আধিভৌতিক এফেক্ট তৈরি করে এই ধ্বনি। ঋত্বিক এখানেই থেমে থাকেন না। এরপর যখনই নীতার মাথা ঘুরে ওঠে (যার শুরু মন্টুকে দেখতে গিয়ে হাসপাতালে), যখনই সে কাশিতে রক্ত পায়, যখনই তাকে একের পর এক ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডির সম্মুখীন হতে হয়, ঝিঁঝিপোকারা এক আশ্চর্য অতিরিক্ত মাত্রার কম্পাঙ্কে ডেকে ওঠে। এমনকী, ঝুঁকে পড়া গাছের নীচের দৃশ্যটিতেও, নীতা বলে, এখন ভেবে দেখছি ও-সব ছাড়িয়ে অনেক দূরে চলে গেছি। এখন তো শুধু কাজ। পাখির কলতান ও একটি কোকিলের অনবরত ডেকে যাওয়ার শব্দকে ছাপিয়ে, ঝিঁঝিপোকার সেই আশ্চর্য ডেকে চলা, এক অপার্থিব নৈঃশব্দ্য তৈরি করে।

এ-নৈঃশব্দ্য শেষ হয় ছবির সমাপ্তিতে। ঋত্বিক ‘আয় গো উমা’ গানটির শব্দ পরিকল্পনাতেও স্থান দেন এই আধিভৌতিক ডাককে। ‘আয় গো উমা’ গানটিকে তিনি লেট মোটিফের মতো গোটা ছবিটির সাউন্ডস্কেপে ব্যবহার করেন। কিন্তু কোনো থিম মিউজিক তৈরি হতে দেন না।

নীতাকে আমরা কাশতে দেখি অনবরত। সে কাশি চাপতে রুমাল মুখে চাপবে এবং রক্ত আবিষ্কার করবে রুমালে। এর পূর্বে অমোঘ স্বরে, ধীর লয়ে ‘আয় গো উমা কোলে লই’ গানটি বেজে চলে। গানটি দ্বিতীয়বার শুনি এক ঝড়ের রাতে। বাবা নীতাকে বলেন, তুই জিতে গেছিস। তুই চলে যা। এরা তোকে করুণা করে। নীতা তার আদরের সম্বল ফোটোফ্রেমটি, যে-ফোটোফ্রেমে সে আর দাদা ছোটোবেলায় পাহাড়ের কোলে বসে রয়েছে, নিয়ে ঝড়ের মধ্যেই ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসে। তার মুখে বিদ্যুতের আলো সরে যায়, গাছের ঝুপসি পাতা ঘন ছায়া তৈরি করে। তার মুখে এক অপার্থিব আনন্দ, মুক্তির স্বাদ যেন, খেলা করে। এ-সংসারের যাবতীয় দায়ভার তাকে আর যেন বইতে হবে না। ঝড়ো হাওয়ার শব্দকে ছাপিয়ে জগৎচরাচরে শোনা যায়— ‘আয় গো উমা কোলে লই, গলাতে গাঁথিয়া জুঁই।’ কন্যাকে নিজের পরম আশ্রয়ে স্থান দেওয়ার চিরকালীন মাতৃসংগীত। নীতার শেষ আশ্রয় হয় পাহাড়ের কোলে এক স্যানিটোরিয়ামে। যে-পাহাড়ে সে বার বার যেতে চেয়েছে দাদার সাথে। শেষ দৃশ্যে যখন আর একটি মেয়ের চটির স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে যায় নীতারই মতো, নীতার সংকটকে শঙ্কর বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে দেখতে পায়। গানটিকে লেট মোটিফের মতো পুনরায় ব্যবহার করে ঋত্বিক শুধু দৃশ্যত সংযোগস্থাপন করেন না, ধ্বনিগতভাবেও তৎকালীন মধ্যবিত্ত সংকটকে (যা আজও অনেকাংশে বর্তমান), আমাদের মননে গেঁথে দেন।

লেট মোটিফ হিসেবে ঋত্বিক এক মায়াবী সুরও পুনরাবৃত্তিতে রেখে দেন ছবিটির সাউন্ডস্কেপে। নীতা যখনই ছেলেবেলার পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়ার কথা বলে সনৎকে বা শঙ্করের কাছে আবদার করে পাহাড়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য, এই সুর শোনা যায়। ছবিতে যখন প্রথমবারের জন্য নীতাকে সনতের চিঠি পড়তে দেখি, এই সুরও তখন প্রথমবারের জন্য শোনা যায়। আর আশ্চর্য, চিঠি হাতে নিয়ে নীতা, পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়ার ছেলেবেলার ছবিটি নাড়াচাড়া করে। এ এক বিচিত্র চেতনার স্তরে ধ্বনি ও দৃশ্যের মন্তাজ, যা একলহমায় নীতার অবচেতনকে আমাদের সামনে খুলে দেয়। এই মন কেমন করা নস্টালজিক সুরের উপর্যুপরি ব্যবহারে, সনতের ভালোবাসার চিঠি ও ছেলেবেলায় পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়ার স্মৃতি, দু-টিকে একাসনে বসিয়ে ঋত্বিক নীতার ভিতরের পুকুরটিতে ডুব দেন ও স্বচ্ছ করে তোলেন এই অবগাহন।

অথচ অবশেষে নীতা যখন পাহাড়ে পৌঁছায়, তখন শুধুমাত্র সেই সুর বাজে না। সুরটি এক গম্ভীর করুণ আলাপে বর্ধিত হয়। আর পাহাড়ে খাদে গিরিবর্ত্মে প্রতিধ্বনিত হয় এক চিরন্তন আর্তনাদ। এখানেও ধ্বনি সংযোজনে সাহিত্যধর্মীতা লক্ষ করি আমরা। ঋত্বিক যেন লিখছেন, ‘তাহার পর নীতার ব্যাকুল আর্তনাদ সেই পাহাড়ের প্রতিটি মর্মে ধ্বনিত হইতে লাগিল।’ প্রতিধ্বনি ব্যবহার করে, দৃশ্যটিকে আইকনিক পর্যায়ে পৌঁছে দেন তিনি। অথচ সেই মন কেমন করা সুর আর আগের মতো বাজে না। নীতা সনতের লেখা চিঠি এতদিনে উড়িয়ে দেয় পাহাড়ে। স্মৃতি, প্রেম ও লড়াইকে ছাপিয়ে নির্দ্বিধায় সে ছড়িয়ে দেয় তার অসহায়তা ও বেঁচে থাকার স্পৃহা। মুহূর্তে অপরাজেয় মাতৃমূর্তি ত্যাগ করে সাধারণ মানবীর চাওয়া-পাওয়ায় নিজেকে ব্যক্ত করে সে। তাকে আর উপেক্ষা করা যায় না। তার সামনে দাঁড়িয়ে অপ্রস্তুত হয়ে যেতে হয়।

এই অকপট বাস্তবের চরম উদ্ভাসে, তাই সেই আশ্চর্য নস্টালজিক সুরও মূঢ় হয়ে পড়ে। শব্দ পরিকল্পনায় বলা যেতে পারে, এটি একটি অতুলনীয় মস্তিষ্ক ও মাত্রাবোধের পরিচয়। ঋত্বিক প্রতিধ্বনির সাথে মেঘের গর্জনকে মিলিয়ে দেন সেই লয়ে, যা কশাঘাতের সাউন্ড এফেক্ট তৈরির সময় করেছেন। ফলে মেলোড্রামার প্রকৃত উদ্দেশ্য, যা ঋত্বিকের অভিপ্রেত ছিল চিরকাল, তা-ই হয়। দৃশ্যটির ধ্বনি সংযোজন আমাদের রক্ত ঝরায়।

‘মেঘে ঢাকা তারা’ ছবিটির শব্দ পরিকল্পনাতে অভিনিবেশ করলে তাই আমরা বার বার বিভিন্ন ভার্টিকাল মন্তাজের নিদর্শন পাই। ভার্টিকাল মন্তাজ, অর্থাৎ, দৃশ্যের সাথে ধ্বনির মিলনে জন্ম নেওয়া এক নতুন অর্থ অথবা বোধ। বস্তুত দু-টি শটের পারম্পরিক সহাবস্থানে যে-মন্তাজের সৃষ্টি হয় (যাকে হরাইজন্টাল মন্তাজ বলা হয়ে থাকে), শুধু আমাদের চোখকে পরিশীলিত করে। কিন্তু দৃশ্য ও শব্দের মন্তাজ চোখ, কান তথা মস্তিষ্ককেও পুষ্ট করে প্রখর বুদ্ধিমত্তায়। এ-বস্তু ভারতীয় চলচ্চিত্রে আজও বিরল। দৃশ্যের সাথে ধ্বনির সুপরিকল্পিত মিলনে জন্ম নেয় যে-বোধ, ঋত্বিক আমাদের সেই বোধের সন্ধান দেন। ছবিটির নির্মাণে প্রতিটি সিদ্ধান্ত আমাদের চেতনার নতুন স্তরে উন্নীত করে। শঙ্করের মতো আমরাও বেদনায় নীল হয়ে যাই।

Categories
2021-June-Essay প্রবন্ধ

রূপায়ণ ঘোষ

চৈতন্যদর্শন: এক বৈপ্লবিক সমাজবাদ

“তৃণাদপি সুনীচেন তরোরিব সহিষ্ণুনা।
অমানিনা মানদেন কীর্তনিয়ঃ সদা হরিঃ।।”

নাহ্, এই শ্লোকটির রচয়িতা কোনো প্রাজ্ঞ পক্বকেশ পুঁথিবিদ্যাসর্বস্ব সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত নন। সুললিত এরকম অসংখ্য শ্লোকের রচনাকার হলেন বাংলা তথা ভারতীয় ভক্তি-আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা বিশ্বম্ভর মিশ্র-সমাজ ও ইতিহাস যাঁকে চিনেছে শ্রীচৈতন্য রূপে। শ্লোকটির আক্ষরিক অর্থের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাবে (তৃণাদপি) অর্থাৎ, তৃণের চেয়ে ক্ষুদ্র হও কিন্তু (তরোরিব) বৃক্ষের মতো সহিষ্ণু হওয়া আবশ্যক। যে-মানুষ অন্যকে সম্মানের চোখে, সমানের চোখে দেখেন তারই পক্ষে ঈশ্বরলাভ সম্ভব। পঞ্চদশ শতাব্দীর (১৪৮৬ খ্রিঃ) যে-সময়ে চৈতন্যদেবের জন্ম সেই সময় বাংলা তথা সমগ্র ভারতে সুলতানি শাসনের কর্তৃত্ব মধ্যগগনে। অন্য দিকে বঙ্গদেশ ও নবদ্বীপ ছিল তৎকালীন ভারতের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র এবং বিদ্যাচর্চার পীঠস্থান। সেন শাসনকাল থেকে বিস্তীর্ণ গঙ্গার দু-পাশে জমি ও বিপুল অর্থৈশ্বর্য লাভ করে কুলীন ব্রাহ্মণকুল যথেষ্ট প্রতিপত্তিশালী হয়ে ওঠেন। এই সময়কালে নবদ্বীপ- শান্তিপুর অঞ্চল ছিল ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র, দেশের নানান প্রান্ত থেকে বিদগ্ধ পণ্ডিতেরা এসে এখানে অধ্যয়ন, অধ্যাপনা ও বিদ্যাচর্চা যেমন করতেন তেমনই বিষয়রসে আকৃষ্ট হয়ে গোঁড়ামির প্রবল উন্মত্ততাও লালন করতেন। স্মৃতিশাস্ত্র শাসিত সমাজ ছিল জাতি ও বর্ণভেদ প্রথায় জর্জরিত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই পুরাতন স্মৃতিব্যবস্থাগুলির মধ্যেই রোপিত ছিল প্রাচীন ভারতীয় অপসংস্কৃতির বিষাক্ত বীজ। যে-মনুস্মৃতিতে নারী, শূদ্র ও কুকুরকে এক শ্রেণিতে ফেলে নিন্দা করা হয়েছে, যে-স্মৃতিশাস্ত্রে নারী ভোগবাদের অপার স্বাধীনতা ও পুরুষতান্ত্রিক মদমত্ততাকে সর্বাধিক প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে সেই শাস্ত্র শাসিত সমাজ যে আদতে গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ব্রাহ্মণ শ্রেণির বেলাগাম অত্যাচারে প্রাণান্তকর অবস্থায় নিম্নবর্গের প্রভূত মানুষ দলে দলে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হতে শুরু করেন। আশ্চর্যজনকভাবে একই সময়ে পৃথিবীর অন্য প্রান্তে ক্ষমতাতন্ত্রের সমান নিদর্শন প্রতিফলিত হচ্ছে। পঞ্চদশ শতকের ইতালিতে যে-রাজনৈতিক পট-পরিবর্তন হয়, সেখানে প্রজাতন্ত্রের পরিবর্তে স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের সূত্রপাত ঘটে গেল। তৃতীয় ফ্রেডরিক (১৪৫৩-১৪৯২), তৃতীয় চার্লস (১৪৯৬-১৫২১)-এর মতো শাসকেরা ছিলেন নিঃসন্দেহে জ্ঞানদীপ্ত তথাপি আগ্রাসী স্বৈরাচারী। ইউরোপীয় নবজাগরণের যুগেও সেখানে ক্ষমতা ও চার্চকেন্দ্রিক অন্ধসংস্কারের যে-চিত্র ফুটে ওঠে, পঞ্চদশ শতকের ভারত তার চেয়ে পৃথক কিছু নয়। ঠিক এই সময়কালে চৈতন্যদেবের সমাজ সংস্কারক হিসেবে আত্মপ্রকাশ- মধ্যযুগীয় ভারতের বর্বর প্রথা অবসানের সূচনামুখ।

রূপ গোস্বামী সংকলিত পদ্যাবল্যাং সংখ্যক নয়-এ গৌরাঙ্গ বলছেন,

“নাহং বিপ্রো ন চ নরপতির্নাপি বৈশ্যো ন শূদ্রো।
নাহং বর্ণী ন চ গৃহরপতির্নো বনস্থো যতির্বা।।”

অর্থাৎ, আমি ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য কিংবা শূদ্র নই, নই গৃহস্থ, ব্রহ্মচারী, বনবাসী এমনকী সন্ন্যাসীও নই। তাহলে তিনি কী? তিনি আদ্যোপান্ত মানবেশ্বর প্রেমে মত্ত আর এক মানুষ— যিনি কেবল মানবকে মানবরূপে, সত্যকে পরিপূর্ণ সত্য জেনে সাধনা করেছেন, সেবা করেছেন। কোনো আরোপিত ধর্মমোহের প্রয়োজন তাঁর পড়েনি। সম্মোহন সাধনার ঊর্ধ্বে উঠে তিনি প্রচার করেছেন প্রেমসর্বস্ব, ত্যাগসর্বস্ব ভক্তিবাদের। তাঁর কাছে আচারব্যূহে নিমজ্জিত ধর্মভাবের কোনো গুরুত্ব ছিল না, উপনিষদের ‘আনন্দরূপচেতনা’-ই হল চৈতন্যদর্শনের মূল আধার। বৈষ্ণব গ্রন্থ ‘ভক্তমাল’-এ বর্ণিত গুজরাতের ঘোগা গ্রামে নটী-শ্রেষ্ঠা অসামান্যা রূপবতী বারমুখীর সম্মুখে অশ্রুসজল নয়নে তিনি উচ্চারণ করছেন— হে সখী, হৃদয়ের অভ্যন্তর হইতে ঈশ্বরের নিমিত্ত প্রেম সঞ্চার করো, সে-স্থানে জগতের নাম, রূপ, কর্ম সদা সঞ্চারণশীল, উহাতেই মুক্তি। আশ্চর্যের বিষয় বৃহদারণ্যক উপনিষদের খিলকাণ্ডের পঞ্চম অধ্যায়ে ধ্বনিত হচ্ছে একই স্বর—

“এষ প্রজাপতির্যদ্ধৃদয়মেতদ্ ব্রহ্মৈতৎ সর্বং তদেতৎ ত্র্যক্ষরং হৃদয়মিতি হৃ ইত্যেকমক্ষরমভিহরন্ত্যস্মৈ।।”

অর্থাৎ, হৃদয়ের ভূমিতে নাম, রূপ, কর্মের নিবাস। হৃদয়ই সর্বভূতের অধিষ্ঠান ও সর্বভূতাত্মক প্রজাপতি। অতএব সকল স্তরে, জীবে, শ্রেণিতে হৃদয়ব্রহ্মই এক এবং একমাত্র উপাস্য। যে-বিষয়টি এখানে লক্ষণীয় তা হল, বেদান্ত দর্শনের উপলব্ধিকে কেবলমাত্র ভক্তিরসের মাধ্যমে জনমানসে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। সন্ন্যাসী, শাসক, নগরনটীর মধ্যে কোনো পার্থক্য বিন্যাস তো করছেনই না উপরন্তু যবন হরিদাসের ভক্ষিত খাদ্য গ্রহণ করতে করতে বিশ্বম্ভর পুলক-বেদনার পরমাশ্রয়ে সমাহিত হয়ে পড়ছেন। আবার এই গৌরাঙ্গই স-পার্ষদ গণ-আন্দোলনের পথে অগ্রসর হচ্ছেন! ষোড়শ শতকের সেই বাংলা তখন সর্বাংশেই সুলতানি শাসনাধীন, দিল্লির মসনদে আসীন সিকন্দর লোদি, বাংলার সিংহাসনে হুসেন শাহ। এই পরিস্থিতিতে নবদ্বীপে নাম-সংকীর্তনের দল সংখ্যায় ভারী হয়ে উঠলে সেখানকার মুসলমান কাজী ক্ষমতা হারানোর শঙ্কায় ভীত হয়ে কীর্তন বন্ধের ফরমান জারি করেন। হাওয়ায় খবর রটে যায় নদীপথে নৌকাযোগে সুলতানের সেনাবাহিনী আসছে লুঠতরাজ এবং হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করার উদ্দেশ্য নিয়ে। যদিও তা শেষপর্যন্ত সত্যি হয়নি, কারণ, হুসেন শাহের মতো বিচক্ষণ শাসক বরাবর সাম্প্রদায়িক সহাবস্থানে বিশ্বাসী ছিলেন। তবে এই পরিস্থিতিতেই চৈতন্যদেব সর্বপ্রথম সংঘবদ্ধ গণশক্তির সাহায্যে স্বৈরাচারী শাসননীতির প্রতিবাদ করেন, স-পার্ষদ কাজীর বাড়ি অবরোধ করে দুই রাত্রি অবস্থান বিক্ষোভের পর কাজী নাম-সংকীর্তনের অনুমতি দিতে বাধ্য হন। অবশ্য এ-কথা অস্বীকার করবার নয় যে, নিমাইয়ের জনপ্রিয়তা অনেক ব্রাহ্মণ ও বৈষ্ণব হিন্দুদের ক্ষুব্ধ করেছিল। এক্ষেত্রে কাজীর সঙ্গে তাদের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। আসলে বিশ্বম্ভরের আড়ম্বরহীনতা, সরল সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করছিল। নবদ্বীপ এবং আশেপাশের অঞ্চলের ধনী ব্রাহ্মণরা (মূলত যারা যজমানি জীবিকার সঙ্গে যুক্ত) বুঝতে পেরেছিলেন তাদের সর্বাত্মক প্রতিপত্তির উপর চৈতন্যের প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে। যদিও ‘কাজীদলন’ ঘটনাটি নিয়ে মতভেদ রয়েছে, কবি কর্ণপুরের গ্রন্থে এ-কাহিনির কোনো উল্লেখ নেই আবার মুরারিতে রয়েছে গৌরাঙ্গ কর্তৃক ম্লেচ্ছ উদ্ধারের কথা। কিন্তু এই ঘটনার আত্যন্তিকতা বাদ দিলেও যে-সত্য ধরা পড়ে তা হল, বিশ্বম্ভর তাঁর ধর্মপ্রচারে প্রবল বাধার সম্মুখীন হচ্ছিলেন! রবীন্দ্রনাথের ‘মালিনী’ নাটকে ক্ষেমংকর নবধর্মকে বাধা দেওয়ার জন্য শেষ পর্যন্ত বিদেশ থেকে সৈন্য নিয়ে অভিযান করতে গিয়েছিলেন। অর্থাৎ, রাষ্ট্রশক্তির সাহায্যে নবধর্মের প্রচার ও প্রসার স্তব্ধ করে দিতে ক্ষেমংকরেরা চিরকালই উৎসাহী। অনুরূপ ব্যাপার চৈতন্যের ক্ষেত্রেও ঘটতে পারত কিন্তু সম্ভবত হুসেন শাহের মতো প্রশাসকের সদর্থক উপস্থিতি এখানে যথেষ্ট কার্যকরী প্রতিভাত হয়েছিল।

লক্ষ করার বিষয় হল, কার্ল মার্কস ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত তাঁর ‘Communist Manifesto’-তে শাসকের বিপক্ষে সাধারণ সর্বহারা শ্রেণির যে-গণ-অভ্যুত্থানের কথা বলছেন তার অন্তত সাড়ে তিনশো বছর পূর্বে বঙ্গদেশের মাটিতে চৈতন্যদেব সেই আন্দোলনের সূচনা করে ফেলেছেন। গণ-আন্দোলন সম্পর্কে মার্কসের ধারণা হল, ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নিপীড়িত মানুষের সুবিশাল সমূহকে বিপ্লবের ছাতার তলায় একত্রিত করা। অন্য দিকে বিংশ শতাব্দীর প্রবাদপ্রতিম সাহিত্যিক তথা দার্শনিক আলব্যের কামু বিপ্লব সম্পর্কে বলছেন—

“More and more, revolution has found itself delivered into the hands of its bureaucrats and doctrinaires on the one hand, and to the enfeebled and bewildered masses on the other.”

অথচ তার চার-পাঁচশো বছর পূর্বে মধ্যযুগীয় ভারতের বুকে দাঁড়িয়ে চৈতন্যদেব দু-হাতেই গণ-বিপ্লবকে রূপ দিয়েছেন। কিন্তু রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের কোনো স্থান সেখানে ছিল না, রক্তের যেটুকু ক্ষয়— তার সমস্তটাই নিজের। ক্ষমতাতন্ত্রের কোনোরকম পুজো না করেই অহিংস ভক্তিবাদকে কেন্দ্রাবর্তে রেখে সমাজের একেবারে অন্ত্যজবর্গকেও সঙ্গে করে তিনি পথ হাঁটছেন, উত্তরসূরি সমাজতন্ত্রীদের সঙ্গে তাঁর সবচেয়ে মৌলিক পার্থক্যটি এখানেই। দখলের পরিবর্তে তিনি হৃদয়ের জয়ে অধিক বিশ্বাসী। মনে রাখতে হবে তৎকালীন হিন্দু সমাজের অধিকাংশ ব্যক্তিই ছিলেন পঞ্চোপাসক, স্মার্ত (স্মৃ প্রত্যয় জাত, অর্থে— স্মৃতিশাস্ত্রজ্ঞ)।

অন্ধসংস্কার, লোকবিশ্বাসের মতো ক্ষতিকর ধারণা পূর্ণ মাত্রায় প্রচলিত ছিল। সমাজে ব্রাহ্মণ্য আধিপত্য, রাজসংযোগানুসারে ক্ষমতার হস্তান্তর প্রভৃতির দ্বারা সমাজকে নিজস্ব পদ্ধতিতে চালানোর লোভ ব্রাহ্মণ্য সম্প্রদায়ের মধ্যে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। দোসর ছিল কিছু নির্বাচিত উচ্চবর্গীয় ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য। তাদের একাধিপত্যের ফলে সমাজের বহু নিম্নবর্গীয় জাতি রাতারাতি শূদ্র বলে পরিগণিত হতে থাকেন; উচ্চ-নীচ শ্রেণির ভেদাভেদ বড়ো হয়ে দেখা দেয়— বলা বাহুল্য তা সমাজতান্ত্রিক ঐক্যের পক্ষে খুব একটা সুখকর অবস্থা ছিল না। বিশ্বম্ভরের সংকল্প ছিল এই সমস্ত স্ত্রী-শূদ্র-অন্ত্যজ শ্রেণিকে ভক্তির মাধ্যমে উন্নত এবং মুক্ত জীবনযাপনের দিকে নিয়ে যাওয়া।

সে-কারণেই তিনি নিত্যানন্দকে নীলাচল থেকে বাংলাদেশে প্রেরণ করেন, সন্ন্যাসী না হয়ে তাকে সমাজসেবক হওয়ার পরামর্শ দেন। ফলস্বরূপ নিত্যানন্দের অবাধ সান্নিধ্যে বৈষ্ণব ভক্তিতত্ত্বে আকৃষ্ট হয়ে বাঙালি সমাজের বিবিধ সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ বৈষ্ণব ধর্মের ছত্রছায়ায় আসতে শুরু করেন।

সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল, চৈতন্যদেব সকলকেই সাদরে গ্রহণ করেছিলেন— ব্রাহ্মণ-শূদ্র-মুসলিম, ধনী-দরিদ্র ধীরে ধীরে একীভূত হতে থাকলে সমাজের সর্বাঙ্গীন ঐক্য সাধিত হয়। চৈতন্যভাগবতের ‘কাজীদলন’ অধ্যায়ে দেখা যাচ্ছে নিম্নবর্ণের শ্রীধরের কুটিরে লোহার পাত্র থেকে বিশ্বম্ভর জল পান করছেন, শ্রীধর জন্মগত জাতি সংস্কারের বিধি-নিয়মে তখনও আবদ্ধ— ভয়ে সে শিউরে উঠলেও গৌরাঙ্গ নির্বিকার। পূর্বেও আমরা দেখেছি বিশ্বম্ভর আদতে ঐক্যবিধায়ক শক্তি, সংকীর্ণতার বেড়া ভাঙতেই তাঁর যাবতীয় উৎসাহ এবং উদ্দীপনা। ‘গোরা’ উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ যেন এই ঘটনারই প্রতিফলন ঘটিয়েছেন; গোরায় দেখা যায়, চরের ঘোষপুরের নাপিতের ঘরে জল পান করে এক মুসলমান যুবক, প্রবল নীলকর সাহেব ও গোঁড়া হিন্দুদের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচাতে সেই নাপিত মুসলমান ফরু সর্দারের পুত্র তমিজকে ঘরে এনে রেখেছিল। উপন্যাসে দেখা যাবে গোরা এই তথাকথিত হিন্দু সমাজের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে, অনুরূপভাবে চৈতন্যের আচরণেও সেই একই দ্রোহচিহ্ন; সে-যুগের প্রেক্ষিতে যা এক বিপ্লবের সমতুল্য বলা চলে।

পুরীতে অবস্থানকালে জগন্নাথ মন্দিরের পুরোহিত জনৈক সার্বভৌম আচার্য ভগ্নিপতি গোপীনাথ ভট্টাচার্যের কাছে চৈতন্য সম্পর্কে জানতে চাইলে গোপীনাথ উত্তর দেন—

“ইঁহার নাহি বাহ্যাপেক্ষা/ অতি বড় সম্প্রদায়েতে উপেক্ষা।।”

বিশ্বম্ভর যে আদ্যোপান্ত অসাম্প্রদায়িক একজন মানুষ ছিলেন, সমাজের সমস্ত ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে যে তার অবস্থান- বৃন্দাবন দাস স্থানে স্থানে তার ইঙ্গিত দিয়েছেন। খাণ্ডবা গ্রামের সেবাদাসী ইন্দিরা বাঈ, কিংবা নারোজি দস্যু, ভিল পান্থদের মতো ভিন্ন ভিন্ন বর্গের মানুষকে অবনমনের পথ থেকে সরিয়ে সমাজের মূলস্রোতে ফিরিয়ে এনেছেন। আবার পুরীতেই মন্দিরের পাণ্ডারা তাঁর বিরোধিতা এমনকী ষড়যন্ত্র পর্যন্ত করেছেন। কলিঙ্গ সেই মুহূর্তে বহিরাক্রমণ এবং অভ্যন্তরীণ কলহে পর্যুদস্ত, তদসত্ত্বেও দু-টি শক্তিতে তারা বিভক্ত হয়ে গেল। একদিকে চৈতন্য ও মহারাজ প্রতাপরুদ্র অপর দিকে গোবিন্দ বিদ্যাধর, জগন্নাথ দাশের মতো মন্দিরের পাণ্ডাবৃন্দ। সে-সময় প্রতাপরুদ্র দক্ষিণাঞ্চলের রাজা কৃষ্ণদেবের কাছে একের পর এক যুদ্ধে পরাজিত হচ্ছেন, তাঁর ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি সংকোচিত হয়ে আসছে। মন্দিরের সেবায়েতবৃন্দ ধীরে ধীরে নীলাচলের নিয়ামক হয়ে উঠতে শুরু করলে গৌরাঙ্গকে নিয়মতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই আরম্ভ করতে হয়। অর্থাৎ সমাজের অভ্যন্তরে ‘প্রাধান্য ও আধিপত্যবাদ’ যেখানে শাসকের চরিত্রকে সর্বকালীন দোর্দণ্ডতা প্রদান করছিল সেখানে গৌরাঙ্গ সমাজের দুর্বল শ্রেণিদের একত্রিত করছেন, ঈশ্বরের ভক্তিবাদকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছেন শাসক ও ক্ষমতাতন্ত্রের বিরুদ্ধে! কারণ, তিনি জানতেন প্রভুত্ব অধিকার করে, প্রতিপত্তি অর্জন করে রাষ্ট্রশক্তি ক্ষান্ত হয় না। তার মূল লক্ষ্য থাকে সংস্কৃতি ও সামাজিক ভাবাদর্শের আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে দেওয়া।

কী অদ্ভুত! চৈতন্যের এই কার্যকলাপের পরবর্তীতে আধুনিক ইতালীয় দার্শনিক আন্তোনিও গ্রামশি আনছেন (Hegemony and Dominance) তত্ত্ব! আশ্চর্যজনকভাবে সেখানে চৈতন্যের কথার প্রতিধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়— “The bourgeoisie acquires all the authority of Society through the establishment of Hegemony.” (Prison Notebooks)

দু-জন পৃথক ব্যক্তি, দু-টি আলাদা মহাদেশ— মধ্যবর্তী সময়ের ব্যবধান প্রায় চারশো বছর। একজন ঘোষিত সমাজবাদী দার্শনিক অন্যজন সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী; অথচ প্রায় হুবহু একই চিন্তন উদ্ভাসিত হচ্ছে দু-জনের মননে, কার্যক্রমে! একে সমাজতান্ত্রিক আদর্শের সময়োপযোগী উত্তরণ ছাড়া অন্য কিছু বলা সম্ভবই নয়। আবার এই প্রবল সাম্যবাদী সন্ন্যাসী সমাজ-সংস্কারক বিশ্বম্ভর কর্ম ও ভক্তি দ্বারা দুঃখের সাগর পাড়ি দিতে চান। এখানে উল্লেখ্য, বর্তমান সময়পর্বে ভক্ত ও ভক্তির যে-আতিশয্য চতুর্দিকে দেখা যাচ্ছে গৌরাঙ্গের ‘ভক্তি’ তার চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা এক জগতের কথা বলে। তাতে স্নেহ, প্রেম, বাৎসল্য, মধুরতা, শান্ত, দাস্য, শখ্য উপস্থিত— এ হল চৈতন্যতত্ত্ব। এখানে হিংস্র অন্ধভক্তির কোথাও কোনো স্থান নেই।

“নয়নং গলদশ্রুধারয়া বদনং গদ্গদরুদ্ধয়া গিরা।
পুলকৈর্নিচিতং বপুঃ কদা তব নামগ্রহণে ভবিষ্যতি।।”

রূপ গোস্বামী সংকলিত চৈতন্যের এই ছয় সংখ্যক পদাবলীটিতে সেই ভক্তি এবং ভক্তি দ্বারা মুক্তির কথা ধ্বনিত হয়। এই মুক্তি কি দেহাবসানের কথা বলে?

না, এই স্বর প্রকৃত অর্থে জাগতিক লালসা ও স্বার্থান্বেষী জীবনচর্যার ঊর্ধ্বে উঠে সমাজ-সাম্যের কথা বলে। এমন অশ্রুধারা যা সংবরণ করা যায় না, কথা বা বাক্ অর্থাৎ ইন্দ্রিয় তার ক্রিয়া স্তব্ধ করে (এখানে ইন্দ্রিয় নিঃসন্দেহেই পঞ্চেন্দ্রিয়) সুতরাং ইন্দ্রিয় সুখের লোভ পরিত্যাগ করে সারা শরীর রোমাঞ্চিত হয়। তবে কি বিশ্বম্ভর আরাধ্যের প্রাপ্তিকে সমাজ-সংস্কারের মধ্যে দিয়েই অনুভব করতে চান? না হলে কৃষ্ণনাম ব্যতীত সমাজ-সাম্যের এত বিপুল প্রচেষ্টা তাঁর জীবনের ছত্রে ছত্রে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকবে কেন? তবে কি সাম্যবাদের উত্তরাধিকার তিনি পেয়েছেন পূর্বসূরির সূত্রে? ভুললে চলবে না ভারত তথা সমগ্র বিশ্বে মানব-সাম্যের সর্বপ্রথম পাঠ গৌতমবুদ্ধের মহাবৈপ্লবিক চিন্তা-চেতনার ফসল। ‘ধম্মপদ’-এর বুদ্ধবর্গে তিনি বলছেন—

“বহুং বে সরণং যন্তি পরবতানি বনানি চ।
আরামরুকখচেত্যানি মনুসসা ভয়তজ্জিতা।।

দুকখং দুকখসমুপপাদং দুকখসস্ চ অতিককমং।
অরিয়ঞ্চটঠঙ্গিকং মগগং দুকখূপসমগমনং।
এতং সরণামাগমম্ সব্বদুকখা পমুচ্চতি।।”
(শ্লোক: ১৮৮, ১৮৯)

(মনুসসা ভয়তজ্জিতা) ‌মনুষ্যগণ ভয়বিহ্বল হয়ে বনে, পর্বতে, উদ্যানে আশ্রয় নেয়। কারণ দুঃখ থেকে, লোভ এবং হিংস্রতা থেকে উৎপত্তি হয় ভয়ের। কিন্তু এই বহির্জগতের আড়াল উত্তম আশ্রয় কখনোই নয়। তার জন্য প্রয়োজন আকাঙ্ক্ষা ও দুঃখের মুক্তি। দুঃখ (দুকখং) ও দুঃখের মায়াকে অতিক্রম করে (দুকখসমুপপাদং) অষ্টাঙ্গিক মার্গের পথে সম্যক সত্য প্রজ্ঞার দর্শনে (সম্মপঞ্ঞায় পসসতি) মুক্তি সম্ভব। গৌতমবুদ্ধ এই সর্ব-দুঃখের পরিত্রাণকে বলেছেন (সব্বদুকখা পমুচ্চতি) আর চৈতন্য বলছেন (প্রোদ্যন্নিখিলপরমান্দপূর্ণামৃতান্ধে) সংসারের সর্বপ্রকার মায়া থেকে স্বতঃস্ফূর্ত মুক্তি, কর্ম-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র মানবজাতির এই সত্যের ক্রমানুসন্ধানই অহিংসা ও প্রেমের সামাজিক সাম্যাবস্থার একমাত্র প্রতিষ্ঠা পথ।

“বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহার’/সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারো।” অথবা “নীরব রাত্রি হারাইয়া বাক্/বাহির আমার বাহিরে মিশাক/দেখা দিক মম অন্তরতম/অখণ্ড আকারে।”

‘গীতাঞ্জলি’-র মর্মে মর্মে এক ও অখণ্ডতার কথা কি রবীন্দ্রনাথও বলছেন না? ‘বিহার’ শব্দের ব্যবহারে রবীন্দ্রনাথ একইসঙ্গে স্পর্শ করছেন বুদ্ধ ও চৈতন্যকে। এক অর্থে ‘বিহার’ বৌদ্ধ শ্রমণদের বাসস্থান— মুক্তি, শান্তি ও কল্যাণকারী সাম্যের নিরন্তর চর্চার প্রাণকেন্দ্র অন্য দিকে চৈতন্যের বিহার হল ‘প্রেমবিহার’। কীর্তনের মহাভাবে প্রতিনিয়ত শান্তি, মুক্তি এবং সাম্যের বাণীকে দিকে দিকে ছড়িয়ে দিয়েছেন তিনি।

এই পর্বে এসে আশ্চর্য প্রবহমানতায় আমরা লক্ষ করছি, প্রাচীন ও আধুনিক দুই কালচক্রের সমাজকে, তার বিবর্তনকে সাম্যের পারম্পর্যে জুড়ে দিচ্ছেন মধ্যযুগের আর এক লোকতান্ত্রিক দার্শনিক তথা সন্ন্যাসী। মানুষের দুঃখের উত্তর খোঁজার প্রচেষ্টায়, মধ্যযুগীয় সামাজিক অব্যবস্থার বিপক্ষে সরাসরি লড়াইয়ের চেষ্টায় তিনি আমৃত্যু সংগ্রাম করেছেন। সেই সংগ্রামই যে চৈতন্যদেবকে আজ মহত্ত্বের সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছে দিয়েছে সে-কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

Categories
2021-June-Essay প্রবন্ধ

গৌতম অধিকারী

চৌগাছার নীলবিদ্রোহ: ইতিহাসের অকথিত অধ্যায়

বাংলাদেশের সংগঠিত নীলবিদ্রোহের ইতিহাসে চৌগাছার বিদ্রোহ গুরুত্ব পেয়েছে সবচেয়ে বেশি। ১৮৫৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এই বিদ্রোহের প্রথম বিস্ফোরণ ঘটে। কিন্তু এই বিদ্রোহের অন্যতম প্রধান নেতা বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস বর্তমানে চৌগাছা নামে একটি গ্রামের মানুষ ছিলেন। ফলে চৌগাছার বিদ্রোহরূপেই এর পরিচিতি। কিন্তু ইতিহাসের তথ্য এই যে চৌগাছার কৃষকরা বিদ্রোহে অংশ নিলেও প্রতিরোধটি শুরু হয় গোবিন্দপুরে, বর্তমানে নদিয়া জেলার চূর্ণী-তীরবর্তী র্হাঁসখালি ব্লকে যার অবস্থান। বিদ্রোহের প্রায় কুড়ি বছর পরে ১৮৮০ সালের ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’-য় এই বিদ্রোহের প্রথম পরিচিতি প্রকাশিত হয়। রচনাটির শিরোনাম ছিল ‘A Story of Patriotism in Bengal’। লিখেছিলেন নীলবিদ্রোহের অন্যতম সুহৃদ ও অগ্রণী মানুষ শিশিরকুমার ঘোষ। পরবর্তীতে রচনাটি তাঁর ‘Pictures of Indian Life’ গ্রন্থে জায়গা পেয়েছে। সত্যিকারের কথা হল, এই লেখাটির সূত্রেই বাঙালি গবেষক সমাজ প্রথম চৌগাছার ঐতিহাসিক বিদ্রোহ সম্পর্কে জানতে পারে। কিন্তু আমার মনে এই বিষয়ে অন্তত দু-টি ছোট্ট প্রশ্ন বার বার উত্থাপিত হয়েছে, নীলবিদ্রোহের এত বড়ো লড়াইটা শেষপর্যন্ত প্রচারের আলোয় আসতে কুড়ি বছরেরও বেশি সময় লেগে গেল কেন? দ্বিতীয়ত, বিদ্রোহের স্থান হিসেবে কোন জায়গাটিকে ধরা হবে? তাহলে কি ধরে নেওয়া হবে, এই বিদ্রোহের যে-বিশেষ গুরুত্বের কথা বার বার উচ্চারিত হয়েছে, সমসময় সে-বিষয়ে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিল না!

‘যশোর খুলনার ইতিহাস’ প্রণেতা সতীশচন্দ্র মিত্র বলেছেন, চৌগাছার অবস্থান যশোরের জেলার ঝিকরগাছা থানাধীন। পক্ষান্তরে ‘নদীয়া কাহিনী’-র লেখক কুমুদনাথ মল্লিক সিদ্ধান্ত করেছেন নদিয়া জেলার চূর্ণী তীরবর্তী গ্রাম চৌগাছা, যার আজকের অবস্থান কৃষ্ণগঞ্জ ব্লকে। কোনো সোজাসাপ্টা সিদ্ধান্তে আপাতত আমি যাচ্ছি না। শুধু জানিয়ে রাখি পরবর্তীতে এই বিষয়ে যে-সমস্ত লেখালেখি হয়েছে, তার কোনোটাই শিশিরকুমারের বর্ণিত ঘটনার বাইরে নয়। এবং এইসব লেখাপত্রে চৌগাছার স্থানিক পরিচয় থেকে শুরু করে বিদ্রোহের আসল চরিত্র ও ঘটনা সম্পর্কে গবেষকমহল নিজেদের পছন্দমতো ব্যাখ্যা দিতেই আগ্রহী হয়েছেন। ফলে চৌগাছার নীল বিদ্রোহ বলে কথিত বিদ্রোহের আসল ঘটনা ইতিহাসের আড়ালে গেছে হারিয়ে। হারানো সেই ইতিহাস-অনুসন্ধানে প্রথমে আমরা শিশিরকুমারের রচনাটির সঙ্গে পরিচিত হতে পারি।

শিশিরকুমার জানাচ্ছেন, চৌগাছা গ্রামের বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও পোড়াগাছা গ্রামের দিগম্বর বিশ্বাস দু-জনেই ছিলেন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নীলকুঠিতে কর্মরত দেওয়ান। বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ছিলেন ছোটো জমিদার (a small Zeminder) এবং দিগম্বর বিশ্বাস সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘মহাজন’, যিনি টাকা ও ধান খাটাতেন সুদের বিনিময়ে (lent money and paddy on interest)। অর্থাৎ, প্রাথমিক পর্যায়ে তাঁরা নীলচাষের অংশভাগ, এবং এই সূত্রে উপার্জিত অর্থে সমৃদ্ধ গৃহস্থও বটে। নীলকুঠিতে দেওয়ান হিসেবে চাকরি করতে করতেই তাঁদের মধ্যে নীলকর সাহেবদের অত্যাচার সম্পর্কে বিরূপ মানসিকতার জন্ম হয়। কারণ, শিশিরকুমারের মতে— “they were men of indomitable perseverance and courage.” সবচেয়ে বড়ো কথা— “They were, besides, men of heart, and has large share of the intelligence which generally characteristics a Bengali gentleman.” এবং এ-জন্য তাঁরা দেওয়ানের চাকরি ছাড়েন। আর শিশিরকুমার মনে করেছেন— “they were obliged to leave service in disguist, as Dewans of indigo factories, who hearts, had to do in those days.” খুব স্পষ্ট যে সময় ও কালের আহবানে বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাস দেওয়ানের চাকরি ছেড়ে দিয়ে নীলচাষিদের পাশে দাঁড়িয়ে লড়াই করেন এবং নেতৃত্ব দেন। নেতৃত্ব দেন শুধু নয়, “সম্ভব হলে তাদের একেবারে দেশ-ছাড়া করবার শপথ নিয়েছিলেন।”

কিন্তু নিছক নীলচাষিদের প্রতি দরদ ও দায়বদ্ধতা থেকে দিগম্বর বা বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস নীলবিদ্রোহের পথে হেঁটেছিলেন, এমন কথা বিশ্বাস করা কঠিন। পুলক চন্দ তাঁর ‘নীল বিদ্রোহ’ গ্রন্থটিতে লিখেছেন— “বাঁশবেড়িয়া নীলকুঠির নীলকর হোয়াইটের সঙ্গে মহাজনি কারবারকে কেন্দ্র করে বিশ্বাসের ছিল এক তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা। মহাজনিতে তখন তাঁদের প্রবাহী পুঁজি (floating capital) ছিল কম করেও লাখ টাকা। সুতরাং ঐ অঞ্চলে ধানচালের ব্যবসার একচেটিয়া কারবার করার পথে বিশ্বাসেরাই ছিলেন বড়ো বাঁধা।” আবার নীলকর হোয়াইটও নীলচাষের পাশাপাশি ধানের কারবারে অর্থ লগ্নি করতেন। তিনি চাইলেন বিশ্বাসদের মজুদ ধান কিনে নিতে। বিরোধ বাঁধল চুক্তির শর্তাবলীতে। তখন হোয়াইট শক্তি প্রয়োগ করে ধান লুঠ করার চেষ্টা করে এবং বিশ্বাসদের কাছে যে সব চাষী ধার-কর্জ নিয়েছিল, তাদের উপর প্রভাব খাটাতে শুরু করেন কর্জ শোধ না করতে। বোঝা যায়, প্রথম দিকে নিজেদের অস্তিত্ব টিঁকিয়ে রাখার কারণেই বিশ্বাসেরা নীলকরদের সঙ্গে বিরোধে লিপ্ত হয়। পুলক চন্দের এই বক্তব্যে ‘অন্য সূত্র’ কথাদুটো থাকলেও সূত্রটি স্পষ্ট নয়। যদিও স্বয়ং শিশিরকুমার তাঁর লেখাটিতেও বিশ্বাসদের পরিচয় দিতে গিয়ে লিখেছেন— “In the village Chougatcha, district Nadia, lived two gentlemen babus Vishnu Charan Biswas and Digambar Biswas. They were both men of some property: Babu Vishnu Charan Biswas was a small zamindar, and Babu Digambar Biswas, a Mahajan, that is lent money and paddy with the interest.” ফলে এইসব কারবারকে কেন্দ্র করে সেকালে নীলকর ও স্থানীয় জমিদার ও ভূমধ্যকারীদের মধ্যে হামেশাই বিরোধ লেগে থাকত। এক্ষেত্রেও সেটা সম্ভব। তবুও এ-কথা স্বীকার করতেই হবে, টিঁকে থাকার প্রয়োজন এবং আহত মর্যাদা রক্ষার তাগিদ থেকে বিষ্ণুচরণ ও দিগম্বর বিশ্বাস কোমর বেঁধে নীলবিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। বীরত্ব ও আত্মত্যাগের নিষ্ঠায় তাঁরা রেখে যান বিরল দৃষ্টান্ত এবং তাঁদের নেতৃত্বে প্রবল গণজাগরণের প্রেক্ষাপটে নিজেদের স্বার্থপর কথা ভেবে পিছিয়ে আসেননি, হারিয়েছেন সর্বস্ব।

গ্রামে গ্রামে চাষিদের কারণে নীলচাষ বন্ধ করবার আহ্বান জানিয়েছেন বিশ্বাসেরা সরাসরি। জানতেন নীলকর সাহেবরা সহজে ছাড়বে না। হিংস্র আক্রমণ নেমে আসবে নিশ্চিত জেনে শক্তি সঞ্চয় করেছিলেন, সশস্ত্র চাষিবাহিনীর পাশাপাশি বরিশাল থেকে দক্ষ লাঠিয়াল আনিয়ে রেখেছিলেন। প্রথম পর্যায়ে বিষ্ণুচরণের গ্রাম চৌগাছা ছাড়া সাড়া মিলল আর মাত্রা একটি গ্রাম থেকে। শিশিরকুমার লিখেছেন— “All the villages declined to join them except one, and to that village they sent eight spearsmen for its protection. The planter, who was thus defied, resolved to nip the rebellion in the bud, and collect about a thousand men, about one hundred of whom were regulars. Mind All this preparation were being made within eight to ten miles of the sadar. station, the town of Nadia.” নদিয়ার সদর শহর কৃষ্ণনগর থেকে আট-দশ মাইল দূরের এই গ্রামটির নাম অবশ্য শিশিরকুমার উল্লেখ করেননি।

চাষিদের এই প্রস্তুতির খবর নীলকর হোয়াইটের অগোচরে থাকার কথা নয়। অঙ্কুরেই বিদ্রোহকে দমন করতে তার শিবিরেও সাজো-সাজো রব। বিভিন্ন জায়গা থেকে এক হাজার পেশাদার লাঠিয়াল সংগ্রহ করে তৈরি হলেও বাহিনী। ধুরন্ধর হোয়াইট রটিয়ে দিল এক নির্দিষ্ট দিনে আক্রমণ করা হবে চৌগাছা গ্রাম। শিশিরকুমারের বর্ণনা— “The planters spread a rumour to the effect that they would attack the village Chougatcha on a certain day,…” বাস্তবে হোয়াইট তাঁর লাঠিয়াল বাহিনী পাঠালেন ঐ গ্রামটির দিকে, যেখানেই নেওয়া হয়েছিল যুদ্ধের শক্তিশালী প্রস্তুতি। কিন্তু গুজবের শিকার হয়ে গাঁয়ের চাষিরা আটজন শড়কিওয়ালার মধ্যে চারজনকে আগেই চৌগাছা আক্রমণ প্রতিহত করতে পাঠিয়েছিল। ফলে কম শক্তিতে কিছুটা হলেও তারা প্রাণপণ লড়াই করেছিল। পরাজিত হবার পর বিধ্বংসী অত্যাচার নেমে আসে গ্রামে, চলে অবাধ লুঠপাট, অগ্নিসংযোগ, সংঘর্ষে আহত হয়ে মারা যায় একজন লাঠিয়াল।

প্রথম পরাজয়ের আঘাতে কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন হয়তো ভেঙে পড়ত, কিন্তু ভাঙেনি, “এক অশেষ সৌভাগ্যপূর্ণ পরিস্থিতি”-র কারণে, শিশিরকুমারের ভাষায়— “So the first battle was lost, and the combination might have collapsed, but for an extremely lucky circumstances.” সেটি হল, এই সময় নদিয়ার ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে এসেছিলেন আর. এল. টোটেনহাম নামে এক উৎসাহী যুবক। এই ঘটনার বিচারের ভার পড়ে তাঁর হাতে। তিনি হোয়াইটকে দোষি সাব্যস্ত করে তিনশো টাকা জরিমানা আদায় করেন। যে-সময়ে নীলকর সাহেবদের সমস্ত অপরাধ সহজেই মাফ করে দেওয়াটাই ছিল রেওয়াজ, সেই সময়ে সামান্য হলেও এই শাস্তিবিধান কৃষকদের মনোবল বাড়িয়ে তোলে। গ্রামে গ্রামে নীলকরদের বিরুদ্ধে প্রচার তুঙ্গে ওঠে, তৈরি হয় সশস্ত্র বাহিনী। প্রতিরোধের একটা স্তরে নীলকর সাহেবরা মিথ্যে মামলায় চাষীদের সর্বস্বান্ত করতে উদ্যোগী হয়েছে, এদের মামলার খরচ, বিপন্ন সংসারের দায়িত্ব বহন করতে গিয়ে দিগম্বর বিশ্বাস নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিলেন এই সময় রানাঘাটের জমিদার শ্রীগোপাল পালচৌধুরী খানিকটা হলেও দিগম্বর বিশ্বাসের পাশে দাঁড়ান।

কিন্তু যে-আত্মমর্যাদা রক্ষা এবং চাষিদের জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপত্তার জন্য এতটা আত্মত্যাগের পথে হেঁটেছিলেন বিষ্ণুচরণ ও দিগম্বর বিশ্বাস, তা অবশ্য অচিরেই সফল হয়। শিশিরকুমার লিখেছেন— “Another village joined them, and another. Within the course of a year and-a-half they found the factory tottering. The ryots had become then the stronger party. The tidings spread far and wide that the indigo ryots had fought and won against planter.” কাঠগড়া থেকে লোকনাথপুর সব কুঠির অধীন বিরানব্বইটি গ্রামের চাষী-প্রজারা ঘোষণা করে দিল, “বুনব না নীল”। শিশিরকুমারের অভিমত, ১৮৬০-এর নীলচাষ-বিরোধী আন্দোলনের গোড়াপত্তন হয়েছিল এই চৌগাছা থেকেই। শিশিরকুমারের আক্ষেপ উচ্চারিত হয়েছিল প্রবন্ধের একদম শেষে। তিনি লিখেছেন— “Their [Vishnu Charan and Digambar Biswas] names are not even known, and this is the first time that we are induced to give publicity to their doing.”

শিশিরকুমারের এই বক্তব্য প্রমাণ করে, এই আন্দোলনের সমকালে বাংলাদেশের বিদ্বৎসমাজ চৌগাছার নীলবিদ্রোহ সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানতেন না। এমনকী নীলচাষিদের একান্ত সুহৃদ শিশিরকুমারও হয়তো সবিস্তার অবগত ছিলেন না। কিন্তু আমরা জানি, এই ১৮৮০ সালের কাছাকাছি সময়ে কর্মবীর শিশিরকুমার তাঁর বড়দার প্রয়াণে কিঞ্চিৎ মানসিক অসহাতার শিকার হয়ে এসেছিলেন নদিয়া জেলার হাঁসখালিতে, বাস করতেন চূর্ণীপাড়ের কালীপাড়ার এক পরিত্যক্ত নীলকুঠিতে। এখানে বসেই ‘শ্রীঅমিয়নিমাই চরিত’ লেখার প্রেরণা তাঁর মধ্যে সঞ্চারিত হয়। এখানে এসেই সবিস্তারে হয়তো শুনে থাকবেন চূর্ণীপাড়ের নীলবিদ্রোহের কাহিনি, যা লিপিবদ্ধ করলেন ‘A story of patriotism of Bengal’ প্রবন্ধে। চৌগাছার নীলবিদ্রোহ সম্পর্কে পরবর্তীতে যা কিছু লিপিবদ্ধ হয়েছে, সেগুলোর একমাত্র আকর এই প্রবন্ধটি। কিন্তু শিশিরকুমারের প্রবন্ধটি খুঁটিয়ে না পড়ে অনেকেই চৌগাছার বিদ্রোহের স্থান সম্পর্কে নিজের নিজের বক্তব্য হাজির করেছেন, তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা। আমরা চেষ্টা করব আর কিছু পার্শ্ব উপাত্ত ও শিশিরকুমারের প্রবন্ধের ভিত্তিতে গভীরতর সত্যে পৌঁছুতে। তার আগে অবশ্যই বিভ্রান্তির জায়গাগুলো একটু সামনে আনা দরকার।

‘যশোর খুলনার ইতিহাস’ গ্রন্থে সতীশচন্দ্র মিত্র মজুমদার লিখেছেন— “যশোরের অন্তর্গত চৌগাছা গ্রামে বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাস বাস করিতেন।… চৌগাছা কাঠগড়া কুঠির অন্তর্গত।” ‘যশোর জেলার নীলচাষ: নীলকর ও নীলচাষী সম্পর্ক’ নামের অতীব তথ্যপূর্ণ একটি গ্রন্থে সতীশচন্দ্র মিত্র মজুমদারের কথাকেই অনুসরণ করেছেন লেখক মোঃ রেজাউল করিম। যশোরের ইতিহাস-সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ ‘যশোরাদ্য দেশ’-এর রচয়িতা হোসেন উদ্দিন হোসেনও বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাসের বাসস্থান ও বিদ্রোহ-স্থান হিসেবে ‘ঝিকরগাছা থানার অন্তর্গত চৌগাছা গ্রামে’-র কথাই বলতে চেয়েছেন। কোনো সন্দেহ নেই যে, যশোরের কাঠগড়া কানসার্ণের অন্তর্ভুক্ত একটি নীলকুঠি চৌগাছা এবং তার অবস্থান কপোতাক্ষ তীরে। কিছু শিশিরকুমারের বক্তব্য থেকে পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় যে, বিষ্ণুচরণ ও দিগম্বর বিশ্বাসের লড়াইটা শুরু হয়েছিল বাঁশবেড়িয়া কুঠিবাড়ি নীলকর হোয়াইট সাহেবের বিরুদ্ধে প্রথম। আর নিশ্চিতভাবেই বাঁশবেড়িয়া কুঠির অবস্থান নদীয়ার জেলার মধ্যে। চাকরিসূত্রে বিষ্ণুচরণ ও দিগম্বর বিশ্বাসের সম্পর্ক কাঠগড়া কুঠিবাড়ি সঙ্গী ছিল, কেন-না তাঁরা একাধিক কুঠির দেওয়ান হিসেবে কাজ করেছেন। কিন্তু তাতে বিশ্বাসদের বিদ্রোহের কেন্দ্রস্থল পালটে যেতে পারে না। সব চেয়ে বড়ো কথা স্বয়ং শিশিরকুমারের লেখাতেই বিদ্রোহের প্রস্তুতি-অঞ্চল হিসেবে মনে করিয়ে দিয়েছেন— “Mind All this preparation were being made within eight to ten miles of the sadar. station, the town of Nadia.” নদিয়ার সদর শহর কৃষ্ণনগর থেকে আট-দশ মাইল দূরের এই গ্রামটির নাম আমরা প্রথম জানতে পারছি মার্কিন ঐতিহাসিক ব্লেয়ার. বি. ক্লিং-এর গবেষণাগ্রন্থ ‘The Blue Mutiny: The Indigo Dusturbances of Bengal’ থেকে। ব্লেয়ার তাঁর গ্রন্থের চতুর্থ অধ্যায়ে ‘The Conspirators’ শিরোনামে মহেশচন্দ্র দত্ত, লালচাঁদ সাহা, রতন মণ্ডল প্রমুখের পরপরই লিখেছেন— “Two other minor landlords and moneylenders who became leaders of the peasants had become legendary heroes in Bengal. They were Digambar Biswas and Bishnu charan Biswas, leading Indian employees of the Bansbaria concern in Nadia District.” (pp. 95) অর্থাৎ, ব্লেয়ার আমাদের নিশ্চিত করে দিলেন আরও একবার বাঁশবেড়িয়া কানসার্ণের বিরুদ্ধেই বিষ্ণুচরণ ও দিগম্বর বিশ্বাসের বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল, কপোতাক্ষ-তীরের কাঠগড়া কানসার্ণের বিরুদ্ধে নয়। এর পর ব্লেয়ার আবার লিখছেন— “On September 13, 1859, white sent more than hundred Lathials, some mounted on elephants to attack Govindapur.” শিশিরকুমার কথিত— “Mind All this preparation were being made within eight to ten miles of the sadar. station, the town of Nadia.”-ই যে গোবিন্দপুর তাতে বোধ করি কোনো সন্দেহ থাকে না। আর গোবিন্দপুরের নীলবিদ্রোহের সঙ্গে ইচ্ছে থাকলেও কপোতাক্ষ তীরের ঝিকরগাছা থানার চৌগাছায় বসে যুদ্ধ হওয়া অসম্ভব। দ্বিতীয় কথা এই, স্বয়ং শিশিরকুমার ছিলেন ঝিকরগাছা থানার পলুয়া-মাগুরার মানুষ, তাঁর অঞ্চলের নীলবিদ্রোহে শুধু নয় গোটা বাংলাদেশের নীলবিদ্রোহের সঙ্গে তাঁর নাড়ির যোগ। নিজের বাড়ির পাশের বিদ্রোহ সম্পর্কে ঐ ১৮৫৮-১৮৫৯-এ সংঘটিত বিদ্রোহ সম্পর্কে কুড়ি বৎসর তাঁর অন্ধকারে থাকার কথা নয়।

কৃষ্ণনগর সদর শহর থেকে আট-দশ মাইল দূরের গোবিন্দপুর বাংলাদেশের সগংঠিত নীল বিদ্রোহের প্রথম রণক্ষেত্র, সংঘাত শুরু হয়েছিল ১৮৫৮ সালে বগুলা নীলকুঠির অত্যাচারকে কেন্দ্র করে শ্যামনগরের কাল্লু মণ্ডল, আমীর মণ্ডলের নেতৃত্বে। তার বিকশিত রূপের হাল ধরলেন বিষ্ণুচরণ ও দিগম্বর বিশ্বাস। আর রণক্ষেত্র-কুরুক্ষেত্র তীর্থের নাম হাঁসখালি-গোবিন্দপুর। যে-সংঘাতের কয়েকদিন পরে আহতাবস্থায় শহিদ হন একজন সড়কিওয়ালা‌। সংগঠিত নীলবিদ্রোহের প্রথম শহিদের নামে আজও বাঙালি জানে না। কিন্তু ঐ বিদ্রোহকে কেন্দ্র করেই শহিদ হয়েছিলেন আর একজন ছোটো ভূমধ্যকারী-গোপাল তরফদার। ইতিহাসে তাঁর কথাও রয়ে গেল উপেক্ষিত।

হাঁসখালির ভূমধ্যকারী ছোটো জমিদার গোপাল তরফদার গোবিন্দপুর আক্রান্ত হওয়ার সময়ে লড়াইয়ের প্রথম সারিতেই ছিলেন। এই সময় কৃষ্ণনগর থানার দারোগা হিসেবে কর্মরত ছিলেন গিরিশচন্দ্র বসু। নীল কমিশনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্যদাতা এই পুলিশ আধিকারিক চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর অক্ষয়চন্দ্র সরকার সম্পাদিত ‘নবজীবন’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে লিখতে থাকেন তাঁর স্মৃতিগ্রন্থ ‘সেকালের দারোগার কাহিনি’ (শ্রাবণ ১২৯৩-শ্রাবণ ১২৯৪)। পরের বছর বাংলা ১২৯৫, অর্থাৎ, ইংরেজি ১৮৮৮ সালের ৭ নভেম্বর তারিখে ঢাকা থেকে এটি গ্রন্থের আকারে প্রকাশিত হয়। সেখানেই, একমাত্র সেখানেই রয়েছে গোপাল তরফদারের শহিদ হবার কাহিনি। গিরিশচন্দ্র লিখেছেন— “… হাঁসখালির গোবিন্দপুরের গোপাল তরফদার। সেই ব্যক্তি তাহার গ্রামের প্রজাবর্গের সাহায্যে কুঠির বিরূদ্ধাচরণ করাতে একদিবস রাত্রে একটি হস্তীসমেত কয়েকজন অস্ত্রধারী লোক গোবিন্দপুর গ্রাম আক্রমণ করিয়া দীন দরিদ্র চাষী প্রজাদিগের যথাসর্ব্বস্ব লুঠপাট এবং অপচয় করে এবং অবশেষে তরফদারকে যৎপরোনাস্তি বে-ইজ্জত করিয়া ধরিয়া লইয়া যায়।” এই সময় নদিয়ার ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন আর. এস. টটেনহাম (পরে কলকাতা সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি)। তাঁর সাহায্যে নানান চেষ্টা করেও গোপাল তরফদারের খোঁজ পাওয়া যায়নি। গিরিশচন্দ্র গোপাল তরফদারের পরিণতি সম্পর্কে লিখেছেন— “অবশেষে শুনিলাম, যে ধরিবার সময় গোপাল তরফদারকে আঘাত করিয়া ধরা হইয়াছিল এবং সেই অবস্থায় তাহাকে নানা স্থানে চালান করাতে, সেই ক্লেশে তাহার মৃত্যু হয় এবং তাহার মৃতদেহ তাহার বন্ধুবান্ধবের হস্তে পড়িতে না পারে, সেই জন্য তাহা নীলের গিঠির দ্বারা জ্বালাইয়া ভস্মসাৎ করিয়া ফেলা হয়।”

খুব সংগতভাবেই শিশিরকুমার তাঁর রচনায় চৌগাছা নীল বিদ্রোহের ব্যাপক প্রভাব এবং সেক্ষেত্রে বিষ্ণুচরণ ও দিগম্বর বিশ্বাসের ভূমিকার মূল্যায়ন করেছেন। কিন্তু যে-কোনোভাবেই হোক না কেন এই বিদ্রোহের ব্যাপকতায় গোপাল তরফদারের শহিদ হবার ঘটনা ইতাহাসের উপেক্ষিতই রয়ে গেছে। গোপাল তরফদারের গুম-মৃত্যুর ঘটনায় যে চাষিসমাজে ব্যাপক আলোড়ন তোলে, তার প্রতক্ষ্যদর্শী গিরিশচন্দ্র বসু লিখেছেন— “কিন্তু গোপাল তরফদারের মৃত্যুই নীলকরের কাল হইল‌… গোপাল মরিয়া যেন কৃষ্ণনগর এবং যশোহর জেলার সমুদয় প্রজাকে খেপাইয়া তুলিল। নীলকরের বিরুদ্ধে বিদ্বেষভাব দাবানলের ন্যায় হুহু করিয়া জ্বলিয়া উঠিল। ‘মোরা আর নীল করবো না’ বলিয়া প্রজারা যে সুর ধরিল, তাহা আর কেহ নিরস্ত করিতে পারিল না।” অবস্থা এমন হয়েছিল যে, যে-সাহেবদের ইঙ্গিতে শত শত লাঠিওয়ালা-সড়কিওয়ালা‌ দাঁড়িয়ে পড়ত, তারাই ভয়ে “স্বীয় স্বীয় প্রাণরক্ষার নিমিত্ত গবর্ণমেন্টকে কৃষ্ণনগর ও যশোহর জেলার স্থানে স্থানে অশ্বারোহী সেনা আনিয়া স্থাপিত করিতে বাধ্য করিয়াছিল।”

ফলাফল এ-কথা বোধহয় নিশ্চিতভাবে বলা যায়, এই নীলবিদ্রোহের মগজ যদি হয় চৌগাছা, প্রতিরোধের নাম হাঁসখালি-গোবিন্দপুর।