Categories
2021-June-Golpo গল্প

চয়ন দাশ

চল্লিশ মেঝে

 ১
বেদকে পাশের রুমে ঘুমোতে দেখে এ-ঘরে এলাম। এ-ঘর আমার আর বেদের নতুন। ঘরটা আমার নতুন হাবির, কিংশুকের। পাঁচতলার উপর। সকালের দিকটা ভালো লাগে, সামনেই একটা বস্তি আছে। সিমেন্টের রাস্তা, খোপ করে টাইম কল। বস্তির মাথাগুলো কমলা আর লাল ত্রিপল মোড়ানো। মাটির কাছাকাছি মানুষের যাবতীয় আয়োজন-প্রয়োজন ছেড়ে আমরা উপরে উপরে এড়িয়ে যাচ্ছি, কেমন যেন মিলিয়ে যাচ্ছি। দুপুরের দিকে ব্যালকোনির গ্রিলে কাক আসে, শালিখ, পায়রা— এতখানি উঠে এসে ক্যামন যেন হাঁপায় মনে হয়। আমায় দ্যাখে, একা ঘরে আমি একা। কিংশুক অফিসে, বেদও স্কুল-কোচিং- এন্ট্রান্সের প্রিপ্যারেসন নিয়ে ব্যস্ত। বাকি থাকল, আমার পরিচয়? আমি আমার নিজের একটা নাম দিয়েছি, ‘ফালতু’।

ডিভোর্সি মহিলা, চল্লিশ হতে চলল অথচ নিজস্ব একটা জীবনের পথ খুঁজে পেলাম না, চেষ্টা করিনি এমন তো নয়, জীবনের চেষ্টার ব্যর্থতার খেসারত অন্যরকম হয়। সময় পেরোয়। স্রেফ সময় পেরোয়। আশপাশের গাছগুলোর ছায়া কমে, বাবা মরে যায় মা মরে যায়, মরে যেতে পারে ভাবতেই পারিনি কোনোদিন, আজও পারি না।

ফাঁকা ঘর, ধু ধু। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকি। খুব সাজি। ভ্রূ আঁকি। লিপগ্লস লাগাই। আস্তে আস্তে পেটের সামনের কাপড় খুলে ফেলি, তুলে দিই। নাভির নীচে স্ট্রেচমার্কগুলো হাত বুলাই। তলপেট যোনি খুব অস্পষ্ট। কেউ কোথাও নেই। আমার নাভি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি ঘণ্টার পর ঘণ্টা। অপরাহ্ণকে দেখতে পাচ্ছি। খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। আবার দেখতে পাচ্ছি কোনো একজন মেয়ের নরম হাত— পেট আর বুক নিয়ে আমার দিকে আসছে। বলছে যেন, ‘কোনোদিন এমন নরম হতে পারবে? হতে পারলে থাকো আমার সাথে…, নয়তো যা বলেছি সেটা করো’। অপরাহ্ণ আমায় থ্রিসামে ইনভল্ভ হতে বলেছিল। অপরাহ্ণর বয়স বাড়ছে, ওর শরীর যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে, ওর মনের ভেতরকার লিঙ্গ জেগে উঠছে, অপরাহ্ণ মনের মুখটা ওর যমজ ভাইয়ের মতো। আমায় যেন আয়নার ভেতর থেকে ডাকতে থাকে… হাত দাও, হাত বাড়াও।

অপরাহ্ণের সাথে সব সম্পর্কই মিটে গেছিল। আমার পক্ষে যতদূর যাওয়া সম্ভব হয়েছিল, গেছিলাম, হাঁপ লাগলে ছেড়ে দিলাম। হল না। বেদ আমাদের ডাইভোর্সের কারণ জানে না। বেদকে জানাবও না কোনোদিন। বেদ ওর পাপাকে খুব ভালোবাসত। ওর সাথে কিংশুকের আলাপ হয়েছে, কিংশুকও চেষ্টা করছে ওর বেস্ট ফ্রেন্ড হতে, পাপার জায়গাটা পাপারই থাকুক।


বেদ ঘুমিয়ে পড়েছে মনে হয়। আমি বিছানা ছেড়ে উঠে এলাম কিংশুকের রুমে, কেন-না কিংশুক আমায় নিঃশব্দে ডেকেছে। আমি জানি ও কেন ডেকেছে। আমার জন্মদিন, ফার্স্ট উইশ করবে। বিছানা থেকে ওঠার আগের মুহূর্তেও একবার অপরাহ্ণকে মনে পড়ল, ভুলতে পারিনি, যতই সে পাপ কিংবা অন্যায় করুক আমার সাথে।

কিংশুককে আমি এভাবে কোনোদিন পাইনি। আশাও করিনি এতটা কাছ থেকে ওকে দ্যাখার। ওর ধীরে ধীরে এক-একটা গিফ্ট আমায় অবশ করে দিচ্ছে। আমার দু-হাত দু’দিকে ছিটকে পড়ে আছে, নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছি। ওর নাক ঠোঁট চোখ আমার নাভির নীচে নামতে থাকলেই মাথা ঝনঝন করতে লাগল। মনে হতে লাগল— আমি পুনরায় একা হয়ে গেছি। বাথরুমের লাল মেঝেতে উলঙ্গ হয়ে বসে আছি, মৈথুন করছি, শিরশির আওয়াজ বেরিয়ে যাচ্ছে মুখে, দরজার ঠিক ওপারে ভাই কান পেতেছে, তবু সামলাতে পারছি না নিজেকে। একসময় দেখছি বাথরুমের বন্ধ ঘরের ভেতর চুপিচুপি কারা এসে দাঁড়িয়েছে। উলঙ্গ পুরুষ, কামার্ত সবজন। অপরাহ্ণ-অপরাহ্ণের সাথে একটা বেঁটে লোক, বস্তির ভ্যানওয়ালাটা, মাছওয়ালির বরটা, কনুই গোঁতানো বাস কন্ডাকটর, বায়োলজির স্যার… সবাই একসাথে দাঁড়িয়ে। সবার লিঙ্গের মাথায় লার্ভার চাক ভেঙে টাটকা মাছি ভ্যান ভ্যান করছে। বুঝতে পারছি— কিংশুক আমার হাঁটু দুটো মুড়ে দিচ্ছে। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে— বেদ দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে আমার নিঃশ্বাস শুনে ফেলছে— বেদ যেন সেই বাথরুমের ভেতর ঢোকার জন্য বাথরুমের দরজায় টোকা দিচ্ছে।


কিংশুককে ঠেলে সরিয়ে আমি এ-ঘরে এসেছি। বেদ ঘুমাচ্ছে। ওর চোখের পাতার নীচে মণিগুলো অস্থির। হয়তো স্বপ্নে ও কোনো ইশকুলবাড়ির ভেতর আটকে গেছে, ওর একাকিত্বের সুযোগ নিতে এগিয়ে আসছে একটা রঙিন উট, ওকে ভালোবাসছে, আদর করতে করতে শূন্যের দিকে গড়িয়ে দিচ্ছে। ও আমার দিকে হাত বাড়াচ্ছে খাদের ভেতর থেকে, আমি হাত বাড়াচ্ছি, হাতড়াচ্ছি… কেউ নেই আমার জন্য। চাই সমস্ত পুরুষ, মানুষ থেকে গাছ হয়ে আমার কাছে আসুক। আমার তলপেটে আঙুল দিক ঠোঁট ছোঁয়াক অ্যান্ড্রোপজ একজন। আঁকড়ে ধরুক

Categories
2021-June-Golpo গল্প

শমীক ষাণ্ণিগ্রাহী

সবাই মিথ্যে বলে

আমার লেখা এটা প্রথম গল্প। গল্পটা লিখে আমার নিজেরই খুব ভালো লেগেছে।

আমার লেখা এটা প্রথম গল্প। তাই অনেক ভাবনাচিন্তা করে, সময় নিয়ে, দু-দিন অফিস কামাই করে লেখাটা শেষ করেছি।

প্রথমে গল্পটা আমি রিয়াকে পড়তে দিলাম।

রিয়া পড়ল। একবার দু-বার তিনবার। শেষে বলল, ভালো লেগেছে।

শুনে আমি খুশি হলাম। কথাটা বলতে রিয়া গতকাল রাত্রের রান্না বন্ধ রেখেছিল। এই কথাটা শুনতে আমাকে গতকাল রাত্রের খাবার রেস্টুরেন্ট থেকে আনতে হয়েছে। যাইহোক গল্পটা রিয়ার ভালো লেগেছে।

গল্পটা বাবাকেও একদিন পড়তে বললাম।

পরদিন বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার কেমন লাগল?

বাবা ছোট্ট উত্তর দিয়ে বললেন, পড়ছি। তারপর হাঁটতে বেরিয়ে গেলেন।

তার পরদিন আবার জিজ্ঞেস করতে বাবা, পড়ছি। বলেই হাঁটতে বেরিয়ে গেলেন।

এভাবে একদিন দু-দিন তিনদিন করে করে পুরো সপ্তাহ কেটে গেল।

রোববার সকালের দ্বিতীয় দফা চা খেতে খেতে বাবা জানালেন গল্পটা তিনি পড়েছেন। জিজ্ঞেস করলাম, কেমন লাগল? বাবা সেই আগের মতো ছোট্ট উত্তর দিলেন, ভালো। বলে খবরের কাগজে মন দিলেন।

গল্পটা বউয়ের ভালো লাগল

গল্পটা বাবার ভালো লাগল

গল্পটা লিখে আমার নিজেরই খুব ভালো লেগেছে।

কয়েকদিন পর গল্পটা পত্রিকার সম্পাদকীয় দপ্তরে পাঠালাম।

আমি অপেক্ষা করতে থাকলাম গল্পটা মনোনীত হবার জন্য।

অপেক্ষা করতে করতে একমাস কেটে গেল।

প্রায় ভুলেই গেছিলাম যে, আমি কোনো গল্প লিখেছি। ভুলেই গেছি যে, আমার লেখা প্রথম গল্পটা আমি কোনো পত্রিকার দপ্তরে পাঠিয়েছিলাম।

রিয়া ভুলে গেছে আমার গল্পটা কখনো পড়েছে কিনা।

বাবা ভুলেই গেছেন আমি একটা গল্প লিখেছি বলে।

বাড়িতে একদিন চিঠি এল আমার নামে। আমার নামে চিঠি প্রায় আসে না বললেই চলে। যা আসে সব বাবার নামেই। যাইহোক চিঠিতে পত্রিকার সহকারী সম্পাদক জানিয়েছেন যে, গল্পটা তাদের মনোনীত হয়েছে। এবং সেটা জুলাই সংখ্যায় ছাপা হবে। পত্রিকা প্রকাশিত হলে যথা সময়ে লেখক কপি আমার ঠিকানায় পাঠিয়ে দেওয়া হবে।

গল্পটা ছাপা হবে জেনে আমার খুব আনন্দ হচ্ছে। সঙ্গে আরও একটা নতুন খবর।

গল্পটার জন্য আমাকে সাম্মানিক দেওয়া হবে। সব মিলিয়ে মিশিয়ে আমি খুব খুশি। আমার লেখা প্রথম গল্পটা শহরের সেরা পত্রিকায় প্রকাশিত হবে।

রিয়া হাসি হাসি মুখে বলল, খুব ভালো খবর। টাকাটা পেলে আমাকে একদিন খাওয়াতে নিয়ে যেতে হবে।

বাবা শুনে বললেন, ভালো খবর। সামনের মাস থেকে তুমি তাহলে নতুন গল্প লিখতে শুরু করে দাও।

প্রথম গল্পটা লিখে আমি খুব মজা পেয়েছি।

গল্পটা লিখে আমার নিজেরই খুব ভালো লেগেছে।

আমি অপেক্ষা করছিলাম আমার দ্বিতীয় গল্পটার জন্য।

জুলাই এল। শহরে গরম বাড়ল। লোডশেডিংও বাড়ল। মিউনিসিপ্যালিটির সাপ্লাই জলের টানাটানি বাড়ল। হিসেব করে জল খরচ করার কথা বাবা বার বার মনে করিয়ে দিতে লাগলেন।

পত্রিকা প্রকাশিত হল। অতি উৎসাহে আমি বইয়ের দোকানে গিয়ে এক কপি কিনেই আনলাম।

সূচিপত্রে আমার নামটা জ্বলজ্বল করছে।

সামনের মাস থেকে আমাকে আরও নতুন গল্প লিখতে হবে।

আমি অপেক্ষা করছিলাম আমার দ্বিতীয় গল্পটার জন্য।

 

Categories
2021-June-Golpo গল্প

অনুপম মুখোপাধ্যায়

আন্ডারপাস এবং প্লাস্টিকের চেয়ার

বাড়ির কাছে একটা আন্ডারপাস। সন্ধ্যের পর সেটা একরকম শুনশান থাকে। মাথার উপর দিয়ে বিরাট বিরাট লরি যায়, বাস যায়, টেম্পো, ম্যাটাডোর, পিক আপ ভ্যান, ফিনফিনে মোটরবাইক যায়, রয়্যাল এনফিল্ড যায়। আন্ডারপাসের ভিতরে একঠায় একটা আলো জ্বলে থাকে, খাঁ-খাঁ করে। ওটা তৈরি হয়েছিল স্কুলের ছেলেমেয়েদের সুবিধার জন্য। এক বছরের উপর হয়ে গেল স্কুল বন্ধ।

কিছুদিন আগেও দেখতাম সন্ধ্যেবেলায় চেয়ার পেতে আন্ডারপাসটার মুখে একজন দশাসই পুরুষ বসে আছেন। বাড়ির সামনে। কিন্তু ওঁর বাড়ির লোককে ওঁর পাশে কখনো দেখিনি। একদম একা। বিরাট চেহারা। দৈর্ঘ্যে প্রস্থে প্রায় সমান। ঘাড়টা ঝুঁকে থাকত বুকের উপর। একটা লুঙ্গি কোনোক্রমে কোমরে আটকানো। মাঝেমধ্যে পায়চারি করতেও দেখতাম, মনে হত কষ্ট করে পা ফেলছেন। আজ শুনলাম তিনি কয়েকদিন হল মারা গেছেন।

“স্ট্রোক?”

“না। কোভিড। বডি দ্যায়নি পুলিশ।”

ঠিক বিশ্বাস হল না। পাড়ার আর একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম। সে বলল, “আরে ওর তো বিভিন্নরকমের প্রবলেম ছিল। হার্ট। কিডনি। সে-জন্যই গেছে।”

“পুলিশ বডি দিল না কেন?”

“সে পুলিশ আজকাল অমনই করছে। সন্দেহ হলেই কোভিড পেশেন্ট বলে বডি দিচ্ছে না।”

“সন্দেহ কেন? টেস্ট হয়নি?”

“অত জানি না।”

মৃত্যু এমনই একটা অবাক শূন্যস্থান তৈরি করে। আজ থেকে বছর কুড়ি আগে একটা দোকান থেকে রোজ রাত্তিরে সিগারেট কিনতাম। নিয়মিত অভ্যাস ছিল। একদিন দেখলাম দোকান বন্ধ। পাশের দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করলাম, “কী ব্যাপার? এর কি শরীর খারাপ-টারাপ?”

“মরে গেছে।”

“সে কী! কী হয়েছিল?”

“বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করে বিষ খেয়েছে।”

সেই চমক আমার আজও কাটেনি। দিব্য হাসিখুশি লোক। বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করতে পারে এটাই বিশ্বাস করা মুশকিল। সে ঝগড়া তো করলই, আবার বিষ খেল, মরেও গেল! সেই রাত্তিরে মাথার উপর তারায় ভরা আকাশটার দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিল ওর দোকান থেকে কেনা আমার সব সিগারেটের আগুন যেন সেখানে জ্বলছে, ইয়ার্কি মারছে।

এখন আন্ডারপাসটার কাছে গেলে একটা ফাঁকা প্লাস্টিক চেয়ার চোখে পড়বে।

লোকটার ওজন ঐটুকু একটা চেয়ার কী করে রাখত, তখন অবাক হতাম, এখনও অবাক হয়েই ভাবছি।

সন্ধ্যেবেলায় একটু হাঁটতে না বেরোলে চলে না। লকডাউন চলছে। সব দোকানপাট বন্ধ থাকে। লোকজন রাস্তায় নেই। যারা মহামারিকে ভয় পায় না, তারাও পুলিশকে ভয় পায়। পুলিশের মার পুরোদমে চলছে শহরে। কোনো কিছু না ভেবেই তারা লাঠি চালিয়ে দিচ্ছে শুনছি। আমাকে বেরোতেই হয়। সন্ধ্যেবেলায় একটু বাইরের হাওয়ায় না বেরোলে দম আটকে আসে। যতই অসামাজিক হোক, আত্মবিধ্বংসী হোক, কিছু ক্ষেত্রে তো করার কিছু থাকে না।

আন্ডারপাসটা পেরিয়ে দেখলাম প্লাস্টিকের চেয়ারে আজ ভদ্রলোকের ছেলে বসে আছে। অশৌচের পোশাক পরে আছে। এরও চেহারাটা খুব মোটার দিকে। হয়তো একদিন বাবার মতোই ওবেসিটি ধরবে একেও। অমনই মাথা ঝুঁকিয়ে বসে থাকবে, কষ্টেসৃষ্টে নড়াচড়া করবে।

একবার এই ছেলেটার সঙ্গে আমার রাস্তায় তর্ক হয়েছিল। হঠাৎ করে আমার মোটরবাইকের সামনে এসে হাজির হয়েছিল। আমি ব্রেক কষতে গিয়ে পড়ে যাচ্ছিলাম। ছেলেটা নিজের দোষ স্বীকার করেনি।

সেই থেকে এর সঙ্গে দেখা হলেই মনটা কিছুটা তেতো হয়ে যায়।

আজ তবু দাঁড়ালাম। বেশ কিছুটা দূরত্ব রেখে। ছেলেটা মুখে মাস্ক পরে নেই। বাড়ির সামনে রাস্তা থাকলেও সেখানে কেউ মাস্ক পরতে চায় না। বাড়ি আর নিরাপত্তা যেন দুটো অবিচ্ছেদ্য ধারণা।

বললাম, “খবরটা আমি আজ শুনলাম। উনি কি তাহলে কোভিডেই…”

“না না, বাবার অনেকরকমের অসুস্থতা ছিল। কোত্থেকে কোভিডের গুজবটা রটেছে কে জানে! আসলে এখন কেউ মারা গেলেই কোভিড ভেবে নিচ্ছে লোকজন।”

“তবে যে শুনলাম বডি… ইয়ে… দেহ দ্যায়নি পুলিশ!”

ছেলেটা বিরক্ত মুখে বলল, “কে বলল? আমি নিজে মুখাগ্নি করেছি। বাবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল।”

“ওহো…”

আমি আর না দাঁড়িয়ে পা বাড়ালাম। আজ সম্ভবত ছেলেটার সঙ্গে তিক্ততা আরও বাড়ল। এরপর রাস্তাঘাটে দেখা হলে মুখটা আরও বিস্বাদ লাগবে।

ফাঁকা রাস্তায় হাঁটছি। নিজের পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। দু-পাশে বাড়িঘর পড়ছে। ভিতরে আলো জ্বলে আছে। কথাবার্তা আবছা শুনতে পাচ্ছি। রান্নাবান্নার আওয়াজ। টিভির শব্দ। রাস্তায় কুকুরগুলো এখন কেউ গেলেই মুখ তুলে দেখে নিচ্ছে লোকটা কে। এখন সন্ধ্যের পর থেকে সারা শহরের রাস্তায় কুকুরগুলোই প্রভুত্ব করে।

নদীর ধারে এসে পড়ল রাস্তাটা। একদম নির্জন। এখানে কুকুরও নেই। শুনশান হাওয়া দিচ্ছে একটা।

একটু কাশলাম। সেই শব্দ নদীর ওপার থেকে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এল।

কী খেয়াল হল, হাততালি দিলাম।

নদীর ওপার থেকে হাততালিটা ফিরে এল।

জানতাম আসবে।

Categories
2021-June-Golpo গল্প

শুভ্র মৈত্র

একটি নিখোঁজ মেয়ের কাহিনি

ঠিকঠাক বলার জন্য আর একটু কাছে থাকার দরকার ছিল। মাঝে ঐ গাড়াটার জন্য তা সম্ভব নয়। স্থানীয় মুখে গাড়া, আসলে ছিল একটা খাঁড়ি। শোনা যায় একসময় নাকি কালিন্দ্রি নদী এই খাত দিয়েই বইত, তারপর লক গেট করে দেওয়ায় নদী আর নেই, শুধু খাতটা থেকে গেছে। এখন দূর থেকে দেখলে মজা লাগে।মানুষগুলি যেতে যেতে হঠাৎ হাপিশ, তারপর একটু বাদে হুশ করে ভেসে উঠল আবার। মানে ওই গর্তের মধ্যে নেমে আবার উঠে যাওয়া। গ্রামে ঢোকার মুখে এই গাড়া যেন মূল ভূখণ্ড থেকে আলাদা করে রেখেছে ওদের। মানে সবাইকে টাউনে যেতে নামতে হয়, আবার উঠতে হয়। গাঁয়ে ফেরার সময়ও তাই। জলের স্মৃতি শুধু ঝালিয়ে দেয় বর্ষার সময়। জল জমতে জমতে আস্ত একটা নদী হয়ে দাঁড়ায় যেন। সে-সময় রোডে যাওয়া খুব দিকদারি। এই গ্রামের মানুষ তা জানে। প্রথমে কয়েকদিন কাদা জল পার হয়ে, তারপর অঞ্চলের দেওয়া নৌকা। সেও তো আবার রমেশ ঘাটোয়ালের মর্জির ওপর নির্ভর করে। কিন্তু এই খাঁড়ি এ গাঁয়ের সাথে জুড়ে আছে। যে-কারণে মানুষ চট করে বেরোতে পারে না, মানে টাউনে যাওয়ার জন্যও একটা আলস্য ঝাড়তে হয়। আবার ওই গাড়াটার জন্যই সহজে পুলিসও ঢুকতে পারে না। অবশ্য পুলিস এসেছিল সেই কবে, যখন রাসু-র বাবার গলাকাটা শরীরটা সকালে ওর নিজেরই দাওয়ায় দেখেছিল সবাই। পুলিস কে সেই উত্তর দিকের নঘরিয়া গিয়ে তারপর পিছন দিয়ে ঢুকতে হয়েছিল গ্রামে। তাও নেহাৎ ধুলা ছাড়া কিছু ছিল না, নইলে জলের সময় কাদাতেই আটকে যেত গাড়ির টায়ার। ঐ বিরক্তিতেই বুঝি পুলিস আর আসে না, গাঁয়ের বিচার গাঁয়েই করে নেয় মানুষ।

তা ওই গাড়াটার জন্যেই পদ্মর মাকে ঠিকঠাক ঠাহর করা যায়নি। শেষমেষ কতদূর যেতে পেরেছিল পদ্মর মা, তা নিয়ে কেউই তেমন নিশ্চিত নয়। তবে মন্ত্রীর কাছে যাওয়ার জন্য বাসে উঠতে পদ্মর মাকে দেখেছে এ-তল্লাটের বেশ কয়েকজন। “হামি কী কহ্যেছি তবে, পষ্ট দেখনু, পমিস এল, মেলাই ভিড়, তাও বুড়ি ঘুস্যে গেল”। মানে ওই ‘প্রমিস’ বাসের পা-দানিতে পা রাখা পর্যন্ত জামিলের স্বাক্ষ্যই প্রামাণ্য। তারপরে হেল্পার ছোঁড়া ওকে ভিতরে ঢুকিয়েছিল কিনা, বা কন্ডাক্টর বলেছিল কিনা পরের স্টপ নারায়ণপুরে জায়গা হবে, পদ্মর মা ওর ওই কাঁধের ঝাপসা ব্যাগটা নিয়ে দাঁড়িয়েছিল কিনা রড ধরে, না বসতে পেরেছিল সীটে— সেটা কেউ বলতে পারে না।

তবে তপনা, মানে সুধা মাস্টারের ছেলে তপোধন, বলেছিল, “পদ্মর মা বাসে একবার পা ঠেকাতে পারলে, বসার জায়গাও পেয়্যা লিবে।” তা এই ঢিমে আঁচের সাঁঝবেলাতে তপনার কথায় আপত্তি করার মতো কিছু খুঁজে পেল না গণেশের চাটাইয়ে বসা মানুষগুলি। আসলে পদ্মর মাকে যারা চেনে— অবশ্য পাঁচকড়িটোলার কেই-বা ওকে চেনে না—সবাই জানে, রিলিফের ত্রিপল হোক বা চিড়া-গুড়, বা হাজরা বাড়ির কালীপূজার ভোগের মাংস— পদ্মর মা কখনো খালি হাতে ফেরে না। তূণে বুড়ির নানান অস্ত্র। প্রথমে ছেঁড়া শাড়িটা আরও খানিক ছিঁড়ে নিয়ে কান্নাকাটি, চোখের জল এমনিই আসে, কাজ না হলে পদ্মর নামে মানত চড়ানোর অজুহাত এমনকী স্বপ্নে পাওয়া আদেশও আছে পদ্মর মায়ের ব্যাগে। যত সব ঢ্যামনামি! মেয়েমানুষরা গলতে পারে, ব্যাটাছেলেদের জানা আছে এ-সব নাটক। কেউ পাত্তা দেয় না। অবশ্য না দিয়েই-বা উপায় কী? এর পরেই তো রাখা আছে ওদের জন্য শাপশাপান্ত। লাইনে ওর সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে তার বাপ ঠাকুর্দা যৌবনে ঠিক কী কী অনাচার করেছিল, বা কার বউয়ের স্বভাব কতটা খারাপ, ঠিক কতদিনের মধ্যে ওলাওঠা হয়ে মৃত্যু হবে তার— নাহ্, এর পরে আর ফিরে তাকাতে হয় না পদ্মর মাকে।

তা এহেন পদ্মর মা ভিড় বাসে উঠে ঠিকই বসতে পারবে এ নিয়ে খুব সন্দেহ প্রকাশ করার লোক পাওয়া গেল না। কিন্তু সংশয়টা অন্য জায়গায়, ঠিক সংশয় না বরং ভরসা বালা যায়। সদার মুখের বিড়ির ধোঁয়ার সাথে সেটাই বেরিয়ে আসে, “গাঁয়ের মাতব্বরি কী আর সবখানে চলব্যে? মন্ত্রী কি আর গাঁয়ের সুবল মেম্বার যে গেনু আর সরসরিয়ে ঘুঁস্যে গেনু!” এমনিতে সদার কথায় সায় দেওয়ার লোক হাতে গোনা, কিন্তু এই কথাটায় নড়ে উঠল অনেকগুলো মাথাই। আসলে কেউই চায় না সত্যি মন্ত্রীর কাছে যাক পদ্মর মা। নিজের চোখে মন্ত্রী দেখার অভিজ্ঞতা এখানে কারোর নেই ঠিকই, কিন্তু সবজি নিয়ে শহরের রাস্তায় বিক্রি করা তারিকুলকে তো জানাতেই হবে টাউনের হালচাল সে অনেক জানে, “মনতিরির সাথে দেখা করব্যে! হুঁহ, কতটি পুলিস থাকে মনতিরি এল্যে, জানা আছে?” মাথাগুলি আবারও নড়ল খানিক। তাতে অবশ্য জানা আছে না নেই তা ঠিক বোঝা গেল না। এটাও তেমন নিশ্চিত নয় যে, পুলিস দেখে পদ্মর মা খানিক থমকাবে কিনা। “আরে পুলিসের কথা ছেড়্যাই দাও, দুই দিনের জন্য মনতিরি জেলায় পা দেছ্যে, তার কত কাম! এ-সব প্যাঁচাল শুনার সময় আছে? ডাকব্যেই না”, আফতাবের সারুভাই নাকি টাউনের এক নেতার গাড়ি চালিয়েছিল কয় মাস, ফলে আফতাবের মতামতকে ফেলে দেওয়া যায় না। সবাই বেশ ভরসা পেতে চায়।

বুড়িকে পছন্দ করে না কেউ। করবেই-বা কী করে? একা মেয়েছেলে, তবু একটুও সম্ভ্রম আছে কারো প্রতি? সে মেম্বার হোক আর মাস্টার, কাউকে রেয়াত করে না পদ্মর মা। ডিলার যে ডিলার, সবাই এত তোয়াজ করে, পদ্মর মা যেন খড়গহস্ত, “ক্যানে পাব না ডাল? চাল মেপ্যে দিবা, কহ্যে দিনু!” কেউই সাহস করে তর্ক জুড়তে পারে না পদ্ম’র মায়ের সাথে, ফের কী থেকে কী বেরিয়ে আসে! ভয় শুধু সেটাই নয়, আসলে এই নিস্তরঙ্গ গাঁয়ে শেষ যে-ঘটনা ঘটেছিল, সেটাও তো এই বুড়ির সাথেই। আর সেটা নিয়েই এবারে মন্ত্রীর কাছে দরবার করবে পদ্মর মা।

পদ্মর মা নাকি এমন ছিল না কয়েক বছর আগেও। গ্রামের বয়স্করা বলে। তারাও কেউ পদ্মর বাবাকে দেখেনি, তবে পদ্ম হারিয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত, যখন গাঁয়ের ইশকুলে যেত ও, জামাটা অত টাইট হয়নি, তখনও নাকি ওর মা মেয়ের জন্য দুধ চাইতে যেত ঘোষেদের বাড়ি মাথায় ঘোমটা দিয়েই। কেউ কেউ মুখ ঝামটা দিয়েও নাকি পার পেয়ে যেত। যেটুকু গালিগালাজ তা বরাদ্দ থাকত তা ওই পদ্ম আর ওর মরে যাওয়া বাবার জন্য। মেয়েকে নিয়ে কীভাবে চলতো পদ্মর মায়ের তা অবশ্য কেউ হলফ করে বলতে পারে না। চার কুড়ি পার করে দেওয়া হারানের ঠাকুমা বা সুকেশ জ্যাঠাও না— চলে যেত আরকী! দিন তো আর থেমে থাকে না, চলেই! কিন্তু এখন চাটাইয়ে বসা লোকগুলোর এ-সব কথা শুধুই শোনা। ওরা জানে পদ্ম যখন ইশকুল থেকে ফিরত ঠায় দাঁড়িয়ে থাকত পদ্মর মা, কোনো চিল শকুন যেন ভিড়তে না পারে। শুধু কি তাই, ছুটি হতে দেরি হলে সটান ইশকুলে গিয়ে হাজির হয় পদ্মর মা, “মিয়াছেল্যাদের ছেড়্যে দাও মাস্টার!” সব মেয়েদের কথা মুখেই বলা, আসলে পদ্মকে ছেড়ে দিক। সাধন-নিত্যদের স্পষ্ট মনে আছে, মাথায় প্রায় তাদের ছুঁয়ে ফেলা পদ্ম লজ্জা পেত।

সেবারের বৃষ্টিটাই সব ওলটপালট করে দিল মা-মেয়ের জীবনে। মণ্ডলবাড়ির ছাগল নিয়ে চড়াতে গেছিল পদ্মর মা, রোজকার মতোই। ফিরেও আসত ঠিক সময়েই মানে পদ্মর ইশকুল থেকে ফেরার আগেই, কিন্তু বৃষ্টিটাই সব ভণ্ডুল করে দিল। গাঁয়ের মাথায় পাকুড় গাছের তলায় ছাগল নিয়ে দাঁড়ানো পদ্মর মাকে নাকি বাড়ি ফেরতা অনেকেই দেখেছিল। তবে কিছু কথা হয়নি, ওই বৃষ্টির মধ্যে কী কথাই-বা হবে, সবার তো ঘরে ফেরার তাড়া। বৃষ্টি একটু ধরলে, মণ্ডলবাড়ি ছাগল ঢুকিয়ে, কাঁঠাল পাতা বাবুদের মুখের কাছে ধরে ফিরতে ফিরতে প্রায় অন্ধকার। গাঁয়ের সব পথ মুখস্থ, অন্ধকারে যা কিছু নিয়ে গাঁয়ের মানুষ ভয় পায়, তারা অবশ্য তখনও পদ্মর মাকেই ভয় পেত। তাই ঘরে ফিরতে কোনো অসুবিধা হয়নি। কিন্তু ঐ অন্ধকারে চোখে খানিক ঘোলা লেগেছিল বটেই। নইলে দাওয়ায় রাখা ডালের বড়ি যে ঘরে তোলা হয়নি, সে কি আর নজরে পড়ত না? পদ্ম আর তার মরা বাপের পূর্বপুরুষরা কি আর ছাড় পেত সেই সন্ধ্যায়?

ঘরে কুপি জ্বলেনি, সেটা টের পেয়েছিল পদ্মর মা। আর টের পেতেই “ক্যারে পদ্ম, কোন নাগরের জন্য ঘর আন্ধার কর‍্যে…?” বলে সম্ভাষণটা করতেই যাবে, কিন্তু গলাটা যেন তার আগেই চেপে ধরল কেউ। মনের ভিতর কু গাইল কেউ। শুধু ডেকে উঠতে পেরেছিল “পদ্ম…”। স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক নরম ছিল সেই ডাক, পদ্মর শুনতে পাওয়ার কথা নয়, কেউই শুনতে পায়নি। কিন্তু পদ্মর মা নিজের বুকে নিজের ডাক শুনেছিল বার বার। সাড়া পায়নি।

বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পর কাদা রাস্তায় ছপছপ করে পায়ের শব্দ শোনা গেছিল, বাড়ি ফিরেছিল আটকে থাকা মানুষ। বৃষ্টি থেমে গেলে মেঘগুলোর বড়ো গায়ে লাগে, ক্ষোভে গড়গড় করতে থাকে, ওই শব্দেই বোধহয় বড়ো মৌলবীর আজানের আওয়াজ শোনা যায়নি এ-পাড়া থেকে, তবে শাঁখের শব্দ শুনেছিল এই হাজরাপাড়ার মানুষ। শুধু পদ্মর মা যে-আওয়াজটা শুনতে চাইছিল, তা শোনা গেল না কিছুতেই। ঘরের ভিতর থেকে না, পিছনের জঙ্গল থেকে না, পায়ের সাথে লেপ্টে যাওয়া কাদার থেকে, পাকুড় গাছের ভেজা শরীর— পদ্মর গলাটা শোনা গেল না কোথাও।

গাঁয়ের মানুষ অবশ্য সেই জল কাদা ভেঙেও বেরিয়েছিল, খোঁজাখুঁজি করেছিল এদিক সেদিক। আর পদ্মর মায়ের সাথে হ্যারিকেন নিয়ে গেছিল ঠিক ছয়জন। খোঁজাখুঁজির ফাঁকে সবার মুখেই এসেছিল মেয়ের চালচলনের কথা। ঢলানি স্বভাবের কথা বলেছিল। বলেনি আরও অনেক কিছু, পদ্মর ময়লা জামার নীচে এর মধ্যেই উঁচু হয়ে যাওয়া বুকের কথা বলেনি, গায়ের সাথে সেঁটে যাওয়া ভেজা জামার নীচে খাঁজের কথা বলেনি, বেটি বলে ডেকে গায়ে হাত বোলানোর কথা বলেনি, পদ্মর সিঁটিয়ে যাওয়ার কথা— নাহ্, ভেবেছিল শুধু, মুখে বলেনি। জঙ্গলে, ঝোপের আড়ালে খুঁজছিল পদ্মকে, ওর বেমক্কা বেড়ে যাওয়া শরীরটাকে। খুঁজতে খুঁজতে গাড়ার কিনার অবধি এসে থমকে যায় সবাই। তখন অনেক জল। অবশ্য ডিঙিটা বাঁধাই ছিল ঘাটে। রমেশ ঘাটোয়ালকে বললে সে কি আর নফরকে ডিঙি খুলতে দিত না? কিন্তু কেউ আর সাহস করেনি। পদ্মর মা নিজেও কেমন থম্ মেরেছিল, হাঁটছিল খানিক ঘোর লাগা মানুষের মতো। আর মেয়েকে ডাকছে না, ওর হয়ে পদ্মর নাম ধরে ডাকার দায়িত্ব তখন ওই ছয়জনের। ডাকের তেমন জোর ছিল কিনা তা অবশ্য জানা যায়নি। কালকেও নিজের বউয়ের পাশে রাতে শোয়ার সময় কতজন পদ্মর ডবকা শরীরটাকে ভেবেছে, সেটাও যেমন জানা যায়নি।

শোনা যায় ঠিক তখনই নাকি ওই আশ্চর্য ঘটনাটা ঘটেছিল। ঘোরের মধ্যে চলতে চলতে গাড়ার কিনারে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল পদ্মর মা, আর সবার মতোই। দাঁড়িয়ে ছিল অন্ধকার জলের দিকে তাকিয়ে। হ্যারিকেনের আলোয় কয়েকজন দেখার চেষ্টাও করেছিল জলে কিছু ভাসতে দেখা যাচ্ছে কিনা। মানে পদ্মর ডবকা শরীরটা, উঁচু হয়ে ওঠা প্রাণপণ লুকিয়ে রাখা বুকদুটো, পায়ের উপর থেকে অনেকটা সরে যাওয়া ফ্রক— উঁকি মেরেছিল সবাই। আর ঠিক তখনই ঘুরে দাঁড়িয়েছিল পদ্মর মা। স্থির চোখে তাকিয়েছিল মানুষগুলোর দিকে। কেমন ছিল সেই চোখ, তা কেউ পরে বর্ণনা করেনি, তবে সেই দৃষ্টিতে নাকি এমন কিছু ছিল, যা মুহূর্তে স্থবির করে দেয় সবাইকে। সবার পা আটকে গেছিল মাটিতে, কিছুক্ষণ নড়তে পারেনি কেউ।

সব ঘোরই কেটে যায়। বাড়িও ফিরেছিল সবাই। কিন্তু ফেরার পথে কেউ কোনো কথা বলেনি। পদ্মর মাকে নিয়ে নয়, পদ্মর স্বভাব চরিত্র নিয়েও নয়। এমনকী নিজেদের মধ্যেও কথা বলেনি কেউ। সেদিন গাড়ার পাশে দাঁড়ানো মানুষগুলির স্বাভাবিক হতে সময় লেগেছিল। না, স্বাভাবিক বলতে যা বোঝায়, তা ওরা হতে পারেনি। ঘরের বউরা জানে, তাদের মরদরা সেই রাত থেকেই আর স্বাভাবিক হয়নি। সে-জন্য তারা পদ্মর মাকে দায়ী করে কিনা জানা না গেলেও, ঠিক সেই মুহূর্ত থেকেই পদ্মর মা যে একা হয়ে গেল তা সবাই জানে। গাঁয়ের বাকি লোক যে কেউ পরদিন সকাল থেকে পদ্মকে খুঁজতে যায়নি, সেটার পিছনে ছিল ওই দৃষ্টিটা। সেই আবছা অন্ধকারে চোখ দেখতে পাওয়ার কথা নয়, কিন্তু তবু ছয়জনই নাকি দেখেছিল পদ্মর মায়ের সেই ঘোলাটে চোখদুটো কী এক আশ্চর্য রং নিয়েছিল সেই রাতে!

কেউ আসেনি, কাউকে ডাকেওনি। কিন্তু সেই রাত থেকে যে-খোঁজটা শুরু হয়েছিল, সেটা থামেনি আজও। গ্রামের মানুষ জানে। এত বছর পরেও কোন মুলুকে কোন নতুন গুরুদেব এসেছেন, কে শুধু মায়ের কপাল দেখেই বলে দেবে মেয়ে কোথায়, কোন থানে মানত করলে নির্ঘাৎ ফল— পদ্মর মায়ের বিরাম নেই। থানা পুলিস তো সেই কবেই শেষ, আর যায় না। গ্রামে না আসার নানান অজুহাত দিয়েছিল পুলিস। টাউনের থানায় কোন পুলিস নাকি পদ্মর স্বভাব নিয়ে খারাপ ইঙ্গিত করেছিল, পদ্মর মা থানায় বসেই সেই ‘আবাগির ব্যাটা’-র বাপ মায়ের ঠিকুজি কুষ্ঠি খুলে বসে। পুলিসের আশা ছেড়ে দিতে হল, কিন্তু খোঁজ থামল না বুড়ির। গাঁয়ের মানুষের বাপ-বাপান্ত করা সেই যে শুরু হল, খোঁজ পাওয়ার নামে কত-না মুল্লুক ঘুরে বেড়ায় আজও। কোন কোন থানে যে মানত করেছিল বুড়ি, নিজেরও মনে নেই আর।

বছরের চাকা তো একবার ঘুরে থামে না, ঘুরেই চলে। সেই রাতে পদ্মকে খুঁজতে যাওয়া মানুষগুলির গায়ের চামড়া কুঁচকে আসে, কেউ কেউ মায়া কাটিয়েও ফেলে বউ বাচ্চা সংসার, গ্রাম— সব কিছুর। এত বছরে আর কেউ সেই রাতের কথা তোলেনি। ঝাপসা হয়ে এসেছে স্মৃতি। বগলের কাছে সেপ্টিপিন লাগানো ফ্রকে পদ্মর মুখ-চোখ সব আবছা হয়ে যায় সবার কাছে, উঁচু হয়ে ওঠা বুকদুটোও। শুধু পদ্মর মা এখনও খোঁজে, মাঝে মাঝে গ্রামের বাইরে যায় কাঁধে একটা ব্যাগ নিয়ে, দুই তিনদিন দেখা যায় না। তারপরে একদিন আবার ভুস করে জেগে ওঠে গাড়ার ভিতর থেকে।

সেই বর্ষার পরে অনেকগুলি হা-ঘরে গ্রীষ্ম গেছে, গাড়ার জল শুকিয়ে নীচের ফাটা চামড়া বেরিয়েছে কতবার, সেই শুকনো গর্তে বাচ্চারা খেলার সময় লুকিয়েছেও কত! আবার ভরেও গেছে জলে। থইথই নৌকা। দু-একটা সরপুঁটি ছাড়া ভরা বর্ষাতেও কিছু দেয় না গাড়া। তবু পদ্মর মা ঘুরেফিরেই দোষ দিত এই গাড়াকে। আর মাঝে মাঝে অদ্ভুত চোখে তাকাত গাঁয়ের ব্যাটাছেলেদের দিকে। যেন ভেতরটা পড়ে ফেলতে চায়। দেখে নিতে চায় পদ্মর শরীরের একটুও দেখা যাচ্ছে কিনা কারো বুকের ভিতর।

নাহ্, পদ্মকে কে খেয়েছে তা এখনও বলেনি বুড়ি, কিন্তু পদ্ম হারিয়ে যাওয়ার পরে কথা ফোটা ছেলেরাও মাঝে মাঝে নিজেদের দায়ি ভাবে ওই না দেখা বৃষ্টির রাতটার জন্য।

আধন্যাংটো বাচ্চার দল অবশ্য কোনোদিনই নিয়ম মানেনি, আর তাদের হিংস্রতারও কোনো পরিসীমা নেই। মাঝে মাঝে পিছনে ধাওয়া করে বুড়িকে ক্ষেপাত, ক্ষেপানো খুব সোজা, শুধু পদ্মর নাম বলতে হয়, আর তাতেই বুড়ি শাপশাপান্ত করে বাচ্চাদের বাপ-ঠাকুর্দা-সহ কয়েক প্রজন্মকে। তবে বেশিক্ষণ চলে না এই গালিবর্ষণ। বড়োরা দেখতে পেলে শাসন করে শিশুদের, ধমক দিয়ে নিয়ে যায় ঘরে। নিজের মনেই কথা বলতে বলতে একসময় শান্ত হয় পদ্মর মা।

এ-মুলুক সে-মুলুক ঘুরতে ঘুরতেই সেদিন খবর নিয়ে এল টাউনে মন্ত্রী আসবে। আসছে সোমবারের পরের সোমবার। গাঁয়ের কেউ জানে না। এমনকী সুবল মেম্বারও না। জানার কথাও না। মেম্বার শুধু মাঝে সাজে ঐ নঘরিয়া অঞ্চল অফিসে যায়। কিন্তু পদ্মর মা যাবে। দেখা করবে মন্ত্রীর সাথে। এ-সব কথা কেউ জিজ্ঞেস করে নি, বুড়ি নিজে থেকেই বলেছিল। রেশন দোকানে লাইনে দাঁড়িয়ে বলেছে, পুকুরে চান করতে গিয়ে বলেছে। সবাই জেনেছে। কিন্তু সাহস করে বলতে পারেনি, কী জিজ্ঞেস করবে মন্ত্রীকে। শুধুই কি পদ্মর খোঁজ নেবে না আরও কিছু নালিশ আছে গাঁয়ের লোকের বিরুদ্ধে। আর এত বছর পরে পদ্মকে পাওয়া গেলেও, ওকে চিনতে পারবে কেউ? গ্রামের কেউ প্রশ্ন করেনি, আসলে মন্ত্রী মানে কী ওরা জানে না কেউ। পুরোনো মানুষগুলি নেই, কিন্তু পুরোনো ভয়টা যেন ফিরে এসেছিল মন্ত্রীর নাম শুনে।

সন্ধ্যা আরও জাঁকিয়ে বসছে গ্রামের পশ্চিম কোণের আমগাছটার মাথায়।সাধন-তারিকুল-সদারা নিজেদের মধ্যে যে-কথাগুলো দিনের আলোয় বলাবলি করে—যেমন এ-বছর আমের ফলন, মাটি কাটার কাজ— এখন সেগুলো নেই। এই চাটাইয়ের আলাপ থাকে মেয়েছেলে আর গোপন ইচ্ছেগুলি নিয়ে। নিজেদের ঘরের পানসে বিবিদের কথা তুলতে চায় না কেউ। “মণ্ডলের ছোটোবিবির রস হয়েছ্যে খুব। মরদটা তো বিদেশ, ঝরাব্যি নাকি সদা?”, খ্যাক খ্যাক করে হাসে সবাই। মতিন মিয়াঁর বেওয়া বিটি বাচ্চাটাকে নিয়ে বাপের ঘরেই থাকে। সাধন নাকি নিজে চোখে দেখেছে কার্তিক গয়লার সাথে গুজুরগুজুর করে। “ক্যানে বে, গেরামে কি আমরা নাই? চান্স দিয়্যাই দেখুক না একবার!”, আবার হাসি। ক্রমশ গভীর হয় গলা।

টিনের মগ থেকে খুড়িতে ঢেলে দিচ্ছে গণেশ, “জামিলচাচা তোমার তিন খুড়ির দাম বাকী আছে কিন্তু!”— আব্বে, পেয়ে যাব্যি, হামি কি ভেগ্যে গেনুৈ ঠিকই তো, গনেশ ছাড়া সবাই মাথা নাড়ে। আর গনেশও জানে, এখন বেশি কথা বাড়িয়ে লাভ নেই, বলতে নেই যে, এই এক কথা কতদিন ধরে শোনাচ্ছে জামিল। সকালেই চেয়ে চিনতে নিতে হবে। সবটাই যে পাওয়া যায় তা নয়, তবে খানিক লস ধরেই এ-ব্যাবসায় নামতে হয়। সম্পর্ক ভালো রাখা বেশি জরুরি। এই যেমন জামিলের ভাইই তো রেশনের চালটা জোগাড় করে দেয়!হিসাব কি আর গণেশ জানে না, এতদিন ধরে এ-লাইনে আছে! কাচের গেলাস তো কবেই বাদ দিয়েছে, এখন মাটির খুড়ি। প্রথম প্রথম আপত্তি উঠেছিল, কিন্তু তারপর তো অভ্যাসও হয়ে গেল সবার। “হ্যাঁ রে গণশা, এত ফিকা লাগছে ক্যানে? দুইটা টেনেও নেশাই জমে না”, সাধনের কথায় হাঁ হাঁ করে উঠল সবাই— “ঠিক ঠিক, একবারে ধক নাই। ফিকা!” গণেশ জানে এখন চুপ করে থাকতে হয়, প্রায় রোজই এই সময়টা এমন কথা ওঠে, সোজা হয়ে দাঁড়াতে না পারা সবাই বলবে, “নেশাই হল না” আর পরদিন সন্ধ্যা লাগতেই আবার এসে ভিড় করবে।

এতক্ষণ ধরে কেউ অবশ্য পদ্মর মাকে নিয়ে আর রা করেনি। বুড়ি যে মন্ত্রী পর্যন্ত পৌঁছাবে না, সেই বিশ্বাসটা অনেকটাই ঘন এখন। হেজে যাওয়া শরীরগুলোর উপর পড়ে থাকা ছেঁড়া কাঁথার মতো অন্ধকার নেমে এসেছে।

দূরে বড়ো রাস্তাটা দেখা যায়। ওখানে আলো আছে। মাঝে মাঝে এক-আধটা গাড়ি দাঁড়ায়, কাউকে নামিয়ে দিয়ে যায়। অবশ্য সন্ধ্যার পরে এই স্ট্যান্ডে নামার লোক প্রায় থাকেই না।

— “ক র‍্যে জগা, উঠব্যি না?”— হ্যাঁ রে এই তো এইটা মেরেই উঠি। অবশ্য দু-জনের কারো মধ্যেই ওঠার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। গণেশ জানে, এখন তিন চার বিড়ি ধরে চলবে এই উঠি উঠি খেলা, চাটাই খালি হতে হতে পিছলি বিলে শেয়ালের ডাক।

শেষমেষ ঘরের দিকে রওনা দেয় সবাই। গণেশের চট খালি হল। এদিকে আলো নেই, তাতে অবশ্য বয়েই গেছে ওদের। সদারা সবাই গন্তব্য জানে। ঘরে কুপি জ্বালিয়ে বসে আছে বউ, ভাতের মতো ঠান্ডা। জড়ানো গলায় আফতাব ধরে, “বলম পিচকারি যো তুনে মুঝে মারি…” টাউনের হলে হিন্দি বই দেখার নেশা আছে ওর। পা খুব সোজা পড়ছে না কারো। তাতে অবশ্য অসুবিধা নেই। মুখস্থ এই গাঁয়ের রাস্তা। ঐ সামনের পাকুড় গাছটা থেকে তারিকুলরা উত্তর দিকে চলে যাবে। এদিকে বাড়ি ঘর খুব বেশি নাই। মাঠের মধ্যে দিয়েই আসছিল সবাই এতক্ষণ। শর্টকাট। এবার রাস্তায় উঠবে। রাস্তায় উঠেই কচুর ঝোপের এই জায়গাটায় এসেই সবার একসাথে পেচ্ছাপ পায়… ছড়ছড়…। ছোটোবেলার কাটাকুটি খেলার কথা তোলে সাধন, একসাথে হেসে ওঠে সবাই। “তোর অজগর তো একবারে ঢোঁড়্যা হয়্যে আছে বে, ঝিম ধরা, মুত ছাড়া আর কিছু নাই”, আবার খ্যাকখ্যাক হাসি। ফিকে চাঁদ আকাশে, কোনো শব্দ নেই কোথাও। মুখ দেখা যাচ্ছে না কারো, একটা ছায়া। দূর থেকে রোডে এখনও দু-একটা আলো দেখা যাচ্ছে, আসলে শহরের ঘড়িতে এখনও সন্ধ্যা, গ্রামেই রাত। কেউ আর বাড়ির বাইরে নেই। অনেকের এতক্ষণে একঘুম সারা।

গণশের ঘর থেকে ফেরা ওদের মনে অবশ্য রঙের কমতি নেই। “আফতাবের ঘোড়া পুরা রেডি, বিবিকে নিদ পারতে দিব্যে না”, আবার হাসি। “আব্বে ছাড়, সেই ধক নাই আর বিবির। পদ্মর মতো ডাঁশা মাল কি আর আমাদের নসিবে জুটবে?” সেই পদ্ম চলে এল আবার। কেউ দেখেনি, তবু আসে। ওই বুক, থাই, শরীরের খাঁজ সব আসে ওদের চোখে। অনেকদিন আগে দেখা, বা না দেখা, শরীরটা তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় ওদের। দিনের আলোয় আসে না, আসতে দেয় না, কিন্তু রাতের এই ছমছমে আবছা অন্ধকারে এসে ঘাই মারে বুকের ভিতর। “গেরামে আর তেমন মাগী কোথায়?” আর্তনাদের মতো শোনায় জগার গলা। কী একটা উড়ে গেল পাকুড় গাছটা থেকে। রাতজাগা কোনো বাদুড় হবে বোধহয়। কেমন শিরশির করে ওঠে সবার। এতক্ষণের খুশি ভাবটা হঠাৎ উধাও। চুপ করে গেছে সবাই। মুখে কিছু বলে না কেউ, কিন্তু ঘরের রাস্তাটা আজকে যেন বেশিই লাগছে, কীভাবে যেন পায়ে জোর আনার চেষ্টা করে সবাই। ঝিঁঝির ডাক আরও জোরে বাজছে কানে।

— “আব্বে, সদা… কে ব্যে ওটা?”— সাধনের জড়ানো গলাতেও কী যেন ছিল। শুধু ওর হাত অনুসরণ করেই সবার চোখ আটকে গেল সামনে। গাড়া থেকে উঠে আসছে একটা শাড়ি পড়া শরীর, কাঁধে ব্যাগ। স্পষ্ট দেখা না গেলেও বলতে হবে না ওটা কে। উঠে আসছে, যেমন করে হাঁটে। ঘাড় তেড়িয়ে একবগ্গা। কাছে আসছে ক্রমশ। দাঁড়িয়ে পড়েছে সবাই, কেউ আর এগোতে পারছে না। চোখটায় নজর আটকেছিল সবারই। একটা অদ্ভুত রং, এই দূর থেকেও দেখা যাচ্ছে। সদা’র পা’টা বোধহয় আটকে গেল। সারাদিনের ভ্যাপসা গরম ভাবটা আর নেই। কেমন একটু শীত শীত করছে। আফতাব-তারিকুল কেউ কারো দিকে তাকায়নি, নইলে দেখতে পেত, মাটিতে পা বসে গেছে সবারই। বুকের ভেতরটা গুলিয়ে উঠল। সাধনের জিভে নোনতা স্বাদ, বমি হওয়ার আগে যেমন হয়। এগিয়ে আসছে ওই মূর্তিটা গ্রামের দিকে, ওদের দিকে। সদারা এই রাতে ছয়জন, হাতে লণ্ঠন নেই শুধু…।

Categories
2021-June-Golpo গল্প

দেবকুমার সোম

প্রতিটা খুনই আসলে রাজনৈতিক

হোম মিনিস্টারের মোবাইল ফোনটা কাকে ডাকাতি করেছে। রোববার সকাল। শীতরোদের আমেজ নিতে ব্যালকনিতে নিউজপেপার আর গরম চা নিয়ে মন্ত্রীমশাই বসেছিলেন। পাশেই ছিল অ্যান্ড্রয়েড ফোন। ব্যালকনির গ্রিল ছিল খোলা। তিনতলার ফ্ল্যাট। ফ্ল্যাটের ব্যালকনি ঘোঁষে দাঁড়িয়ে আছে পাশের আবাসনের নধর নারকোলগাছ। মন্ত্রীর মন ছিল কাগজ আর চায়ে। এর মধ্যে সুযোগ বুঝে ধাঁ করে নারকোলগাছ থেকে উড়ে এসে কাকটা মোবাইল ফোনটা তুলে নিয়ে গেল। গেল, গেল, গেল। ধর, ধর। হোম মিনিস্টার চিৎকার করে উঠলেন। তাঁর তীব্র চিংকারে ভয় পেয়ে রান্নাঘর থেকে ছুটে এলেন তাঁর গিন্নি। ছেলেটা তখনও বিছানায় ল্যাদ খাচ্ছিল। সেও তড়াক লাফিয়ে এক ছুটে ব্যালকনিতে। মন্ত্রীর বউমা মনযোগ দিয়ে হাতে নেলপলিশ লাগাচ্ছিল। শ্বশুরের আর্তস্বরে তার হাত থেকে নেলপলিশের শিশিখানা পড়ে গেল। সে সোফা থেকে ঘাড়টা জিরাফের মতো দীর্ঘ করে একবার বোঝার চেষ্টা করল। মন্ত্রীর পাঁচ বছর বয়সের নাতি,— সেও ছুটে এল বাথরুম থেকে হেগো পোঁদে।

সকলেরই চোখ গোল গোল। মাগো! এও কি কেউ কখনো শুনেছে? কাকে চামচ চুরি করে, ছুরি চুরি করে, তা বলে মোবাইল! তুমি এত বেখেয়ালে থাকো কী করে? তোমার চোখের সামনে থেকে কাকটা মোবাইলটা তুলে নিয়ে গেল। মন্ত্রীর বউ আর পাঁচজন বাঙালি বউ থেকে পৃথক নন।

আর নিল তো নিল, একেবারে ধাঁ। বাবা, ইউ আর নো মোর আ সাধারণ পারসেন। তুমি এখন হোম মিনিস্টার।

তাহলে বল এখন লোকের কাছে মুখ দেখানো যাবে? ছেলের কথায় মা জনসমর্থন পান।

মন্ত্রীমশাইয়ের বিরক্ত বোধ হয়। মালটা চুরি হয়ে গেল, আর তোমরা দাঁত ক্যালাচ্ছ! তাঁর মাথা ঠিক থাকে না। আর থাকবেই-বা কী করে? ফোনের মধ্যে কত কী যে রয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী থেকে রাজ্যের সব নেতা-নেত্রীদের গোপন হোয়াট্সঅ্যাপ। শিঞ্জিনির কিছু হট ছবি। পানু ভিডিয়ো। অনেকগুলো গোপন ব্যাংক অ্যাকাউন্টের ডিটেইল্স। সবচেয়ে বড়ো কথা ডকুমেন্ট। প্রচুর ডকুমেন্ট। হায় হায় কারো হাতে পড়লে কী হবে। দাদু, তুমি তো পুলিশ মন্ত্রী। গুলি ছুড়তে পারলে না: নাতিটা মন্ত্রীমশাইয়ের হাত ধরে টান দেয়। বউমা, ও বউমা, দেখছ না তাতান হেগো পৌঁদে দাঁড়িয়ে আছে। ওকে ছুচিয়ে দাও। মন্ত্রীগিন্নি চিল্লে ওঠেন।

কাকটাকে আর দেখা যাচ্ছে না। নারকোলগাছের লম্বা লম্বা পাতার মধ্যে ওর বাসা। সেখানে সেঁদিয়ে গেছে। মন্ত্রীমশাইয়ের ছেলে তার ফোন থেকে ফোন করে। মন্ত্রীর ফোনটা বেজে যায়। ওঁ জয় জগদীশো হরে। সোয়ামি জয় জগদীশো হরে। ওঁ জয় জগদীশো হরে। ব্যালকনি থেকে স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। ফোনের চিৎকারে কাকটা তার পাতাঘেরা বাসার বাইরে আসে।

ওই তো। ওই তো হারামজাদাটা। নামা মালটাকে। হোম মিনিস্টার খেঁকিয়ে ওঠেন।

কিন্তু কে নামাবে? কাকে নামাবে?

তখনই চাঁদুদাকে বলেছিলাম, ও-সব নারকোলগাছ-টাছ হাটাও। তুমি তখন শুনলে না আমার কথা। এবার বোঝো। ছেলে সুযোগ পেয়ে পুরোনো ঝাল ঝাড়ে।

হ্যাঁরে হারামজাদা। তোর চাঁদুদা ফ্ল্যাট তৈরি করতে গিয়ে পাশের বাড়ির নারকোলগাছটা কাটত আর গাছ খুন করার দায়ে আমার পোলিটিক্যাল কেরিয়ারটা মায়ের ভোগে যেত। এই যে ঘরে বসে বেকার ফুটুনি ঝাড়িস, তখন পারতিস ম্যাও সামলাতে। শালা, ছেলে না অপজিশন পার্টির লোক। দাদু, ওই কাকটাকে চিনতে পেরেছ? তাতানের ফের মঞ্চে প্রবেশ। গত মাসে ওর বাসাটাতেই আমরা গুলতি মেরেছিলাম।

কাকপরিবারের সঙ্গে হোম মিনিস্টারের ঝামেলা নতুন নয়। এখন যেখানে আবাসনটা দাঁড়িয়ে আছে একসময় সেখানে পুকুর ছিল। পুকুর পাড়েই অন্য গাছেদের মধ্যে ছিল এই নারকোলগাছটা। প্রমোটার চাঁদুদা রাজনৈতিক সুবিধা নিয়ে ক্রমে পুকুর ভরাট করে বিল্ডিং তোলেন। হোম মিনিস্টার প্রায় জলের দামে বারোশো স্কোয়ার ফুটের একটা ফ্ল্যাট পেয়ে যান। কিন্তু তাঁর পড়শি থেকে যায় নারকোলগাছসমেত কাক পরিবার। অনুমান এই কাক পরিবারটা উদ্বাস্তু নয়। আর তারা উদ্বাস্তু হতেও চায় না। ফলে প্রথম থেকেই দু-তরফেই আকচা-আকচি শুরু হয়। মানুষগুলো উড়ে এসে জুড়ে বসায় শুরু হয় অন্তর্ঘাত। মন্ত্রীমশাইয়ের স্ত্রী ব্যালকনিতে ফুলের টব রাখলে কাকগুলো বিনা প্ররোচনায় উড়ে এসে ফুল ছিঁড়ে নষ্ট করে। রোদে বাসন শুকাতে দিলে চামচ-ছুরি উধাও করে দেয়। কাকের জ্বালাতন থেকে বাঁচতে ব্যালকনিতে লোহার গ্রিল লাগানো হল। ফলে কাকেরা সপরিবারে চিৎকার আর লাফান-ঝাপান শুরু করে দিল। সুযোগ পেলেই চোরাগোপ্তা গেরিলা ফাইট চলতেই থাকল। ফলে দাদু আর নাতি শঠ করে একদিন একটা গুলতি জোগাড় করলেন। ছাদে উঠে এলোপাথাড়ি গুলতি চালিয়ে কাকের কিছু ডিমও ভাঙলেন। এমন রাষ্ট্রবাদী প্রতিঘাতে কাকেরা মুষড়ে পড়েছিল। আজ আবার বেশ কিছুদিন পরে চরম আঘাত।

হোম মিনিস্টারের চিৎকার-চেঁচামিচিতে তাঁর দেহরক্ষীরা ফ্ল্যাটে চলে এল। মন্ত্রী নির্দেশ দিলেন, একটা লোক জোগাড় করতে যে কিনা ভালো গাছি। সে নারকোলগাছে উঠে মোবাইলটা কাকের বাসা থেকে উদ্ধার করে আনবে। কিন্তু শহরে হুট বলতে গাছি পাওয়া যাবে কোথায়? খবর ছুটল ওলা-উবেরের বেগে। শেষে লোকাল থানার বড়োবাবু একটা ক্ষীণজীবী লোককে ধরে নিয়ে এলেন। একে কোথ থেকে পাকড়াও করলেন। মন্ত্রী বেশ অবাক।

আর বলবেন না ছ্যার। থানার লক্-আপে ছিল। ছিঁচকে মাল। তবে ভালো গাছি। বড়োবাবু বুক ফুলিয়ে জবাব দেন। এই কেষ্টা এই নারকোলগাছটার মগডালে উঠে ছ্যারের মোবাইলটা ফিরিয়ে আন।

দেখিস বাবা, সাবধান। কাকগুলো বড়ো খচ্চর। হোম মিনিস্টারের সাবধান বাণী। তবে গাছি লোকটা যতই করিৎকর্মা হোক, কাকের সঙ্গে পেরে ওঠে না। তাকে গাছে উঠতে দেখে প্রথমেই তারা পিরিচ-পিরিচ করে ও ছড়াতে লাগল। লোকটার খালি গায়ে সাদা সাদাটে-হলদে গুয়ে ভরতি হয়ে গেল। লোকটা তবুও অদম্য। তাকে কাছাকাছি উঠে আসতে দেখে কাক পরিবার সাঁ করে নীচে নেমে লোকটার চোখ খুবলে নিতে চাইল। পিঠে নখের আঁচড়ে রক্ত বইয়ে দিল। লোকটা দক্ষ। কিন্তু এমন গেরিলা ফাইটে সে দিশেহারা হয়ে ওপর থেকে ঝুনো নারকোলের মতো ধপ্ করে মাটিতে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেল। ফলে ফের আর একটা কেলেঙ্কারি। মিডিয়া জানলেই চিত্তির!

ঘণ্টা খানেক ভালো মতো শুশ্রূষা করার পরে লোকটাকে ফের লক্-আপে চালান দেওয়া গেল। পার্টির ছেলেরা এর মধ্যে খবর পেয়ে গেছে। তারা দল বেঁধে এসে নারকোলগাছটাকে গোড়া থেকে বাঁকাতে লাগল। উদ্দেশ্য ঝাঁকুনির চোটে যদি ফোনটা নীচে পড়ে।

শালা, গান্ডু আর কাকে বলে। রাগে ফেটে পড়েন হোম মিনিস্টার। ওরে শুয়োরগুলোকে কেউ বোঝাও অত ওপর থেকে পড়লে আমার ফোনটার আর কিছু থাকবে না।

দাদা, ফায়ার বিগ্রেড ডাকব? পার্টির তরুণ-তুর্কি নেতা কানের কাছে ফিশফিশ করে।

কেন ভাই! হোম মিনিস্টার ঘাবড়ে যান। আমার পোঁদে কি আগুন লেগেছে? না, ছোটোবেলায় টিনটিন কমিক্সে পড়েছিলাম, কুট্টুস এমন তিনতলায় আটকে যেতে ফায়ার বিগ্রেড এসে তাকে উদ্ধার করে। আমাদের কুটুস নেই, মোবাইল আছে।

এই কে আছিস, এই আঁতেলটাকে হাটা তো এখান থেকে।

দেখতে দেখতে সূর্য মাথার ওপরে উঠতে থাকে। নারকোলগাছের ছায়াও ক্রমে ছোটো, আরও ছোটো। কাকগুলো মোবাইল পাহারা দিচ্ছে। বাসা ছেড়ে নড়ার নাম নেই।

স্যার, আমি একটা ডিভাইস ইনভেন্ট করেছি। মন্ত্রীর সেক্রেটারি আই.এ.এস. বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকস ছাত্র ছিলেন। হোম মিনিস্টারের পড়াশুনো খুব বেশি দূর নয়। ফলে লোকটাকে এড়িয়ে চলতেই তিনি পছন্দ করেন। তবুও সেক্রেটারির কথায় তাঁর চোখ চিক্ চিক্ করে ওঠে।

ডিভাইসটা আর কিছুই নয়, দুটো লম্বা বাঁশকে পরপর দড়ি দিয়ে বাঁধা হয়েছে। তার এক মাথায় বেশ বড়ো একটা মেটালের আঁকশি। অনেকটা মানুষের পাঁচ আঙুলের থাবার মতো। কৌশল হল, বাঁশটা নারকোলগাছে কাকেদের বাসা বরাবর নিয়ে যাওয়া হবে। তারপর আঁকশি দিয়ে সম্পূর্ণ বাসাটা তুলে আনা হবে।

পরিকল্পনা দেখে সকলেই ফের উৎসাহী হয়ে ওঠে। প্রথমে ছাদ থেকে। তারপর বারান্দা থেকে অনেকবার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু দেখা যায় দুটো বাঁশ জোড় দিয়েও কাকের বাসার কাছে পৌঁছানো যাচ্ছে না। ফলে অনুমানের ওপর ভিত্তি করে সাকুল্যে পাঁচটা পূর্ণ দৈর্ঘ্যের বাঁশ বাঁধা হয়। তারপর কাকের বাসা অবধি যখন আঁকশি পৌঁছাল, ততক্ষণে মড় মড় শব্দ উঠেছে। বাঁশের বাঁধন পলকা হয়ে গেছে। সেক্রেটারি আই.এ.এস. ফলে ফের তিনি ত্রুটিগুলো ঠিক করলেন। আবার আঁকশি ওঠানো গেল। কিন্তু এতদূর থেকে আঁকশিতে বাসা তুলে আনা গেল না।

শালা বিজ্ঞানের ব জানে না বালের সেক্রেটারি হয়েছে। ছাত্র ইউনিয়নের এক নেতা পেছন থেকে ফুট কাটে। ডাইনামিক্স পড়েছে! পলিটিক্যাল সায়েন্স আর ফিজিক্স এক হল!

মরার আগেই যার মড়ার খবর করে দেয়, সেই মিডিয়াকূল এর মধ্যে এসে হাজির। আজ বিকেলে হোম মিনিস্টারের একটা প্রেস কনফারেন্স রয়েছে। গত পরশু পুরুলিয়ায় ফসলের দাম না পাওয়া চাষিরা হাই-ওয়ে আটকালে পুলিশের গুলিতে তিনজন মারা যায়। বিরোধীরা হোম মিনিস্টারের রেজিগনেশন দাবি করেছে। আজকে বিকেলে সেই নিয়ে প্রেস কনফারেন্স। তারপর সন্ধ্যেবেলায় টিভি চ্যানেলে প্যানেল ডিসকাশন। আবাসনের ভেতরে দু-চারটে ওবি ভ্যান আর বুম হাতে ছেলেমি মেয়েগুলো হামলে পড়েছে। চলছে লাইভ টেলিকাস্ট। সঙ্গে রানিং কমেন্ট্রি। এরই মধ্যে একটা চ্যানেল আবার স্টুডিয়োতে কিছু আঁতেল জোগাড় করে ঘটনার রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, মানবিক, মানসিক এবং যৌবিক বিশ্লেষণ শুরু করেছে। পায়ে পায়ে পার্টির নেতারাও এসে হাজির। এত লোকের জন্য চা-বিস্কুটের ব্যবস্থা করতে প্রমোটার চাদু আর তাঁর সিন্ডিকেটের লোকজনের হাঁপ ধরে গেল।

এভাবে দেখতে দেখতে সূর্য ঢলে পড়ল পশ্চিমে। কিন্তু বিজ্ঞান, ঝাড়-ফুঁক, তন্ত্রমন্ত্রপতঞ্জলিতেও না উদ্ধার হল হোম মিনিস্টারের মোবাইল ফোন। না পারা গেল কাকেদের অবস্থান ধর্মঘট থেকে সরাতে। ফলে, একে একে উদ্দেশ্য ও বিধেয়ও নিয়ে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁরা ক্রমে কেটে পড়লেন। হোম মিনিস্টার আজ সকাল থেকেই গৃহবন্দি। মাঝে একবার মুখ্যমন্ত্রীর ফোন এসেছিল। তিনি খিস্তি করে মা-বোন এক করে দিয়েছেন।

ফলে সকলে চলে গেলে মন্ত্রীমশাইয়ের আবাসন ফের স্বাভাবিক হয়ে আসে। সারাদিনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার পরে হোম মিনিস্টার ক্লান্ত, হতাশ, রিক্ত তাঁর বারোশো স্কোয়ার ফুটের ভূগোলে ফিরে আসেন।

সারাদিন এ তাকে, সে একে বিস্তর দোষারোপ করে পরিবারের সকলেই এত ক্লাস্ত আর নতুন কোনো প্রসঙ্গ উঠে আসে না। সারাদিন প্রায় খাওয়া-দাওয়া হয়নি। ছেলে হোটেল থেকে রাতের খাবার নিয়ে আসে। সকলেই আজ তাড়াতাড়ি খেয়ে নেয়। সারাদিন নারকোলগাছ-নারকোলগাছ করে হোম মিনিস্টারের মাথা এখন ঘুরছে।

রাত তখন ঠিক কত জানা নেই। হঠাৎ কাকের চিৎকারে হোম মিনিস্টারের ঘুম ভেঙে যায়। ধড়মড় করে বিছানায় জেগে ওঠেন। নাইট ল্যাম্পের আলোয় দেখেন তাঁর স্ত্রী খুব কুৎসিংভাবে ঘুমিয়ে। কাকটা ব্যালকনি থেকে ডাকছে। তিনি উঠে যান। এ কি সকালে যেখান ফোনটা তুলে নিয়েছিল কাকে, সেটা সেখানেই! কাকটা তাহলে এত কাণ্ড করে শেষমেষ ফেরত দিয়ে গেল। তিনি খুব দ্রুত হাতে তুলে নেন মোবাইল ফোনটা। সুইচ্ড অফ। অন করার জন্য সুইচ টিপতেই অন্ধকার ব্যালকনি আলো ঝলমল করে ওঠে। সেই ঝলমলে আলোর ছিটে লাগে হোম মিনিস্টারের দু-চোখে। কিন্তু এ কী! ফোনটাকে রি-সেট করে দিয়েছে। না আছে মুখ্যমন্ত্রী থেকে রাজ্যের সব নেতা-নেত্রীদের গোপন হোয়াট্সঅ্যাপ। শিঞ্জিনির হট ছবিগুলো। পানু ভিডিয়ো। গোপন ব্যাংক অ্যাকাউন্টের ডিটেইলস। কিংবা ডকুমেন্ট। মন্ত্রীমশাইয়ের ফোন ফ্যাকটরি রি-সেট হয়ে গেছে। কেবল স্ক্রিন সেভার হিসেবে স্ক্রল হচ্ছে গোটা গোটা বাংলায় লেখা একটা বাক্য— প্রতিটা খুনই আসলে রাজনৈতিক।