Categories
2021-JUNE-KOBITA কবিতা

তনুজ

শবখুন


দীর্ঘ রোজ কিছু (কিছুই) না লেখার পর
আজ, হিজরি সন ১৪৪২-এর গুমশুদা গর্ভ
মহিনা শাওয়ালের উনিশতম রোশনদানের
শ্রেষ্ঠ নূরে আলোকিত সমস্ত জিজ্ঞাসার উদ্দেশ্যে
আল-ফতিহা পড়ার প্রাকে
ইত্তেফাকন ফুনুন-ই-শের মীর আব্দুল হাইয়ের
স্বচ্ছল রেকাবি থেকে একটি স্পষ্ট আখরোট
মুখে ইজহার করতেই

আমার অলিখিত স্বপ্নের দাঁত ভেঙে গেল

এই দেখুন, হাঁ।


কেমন বন্ধু চাও তুমি?

যেমন মনস্থ করেন জালালউদ্দিন রুমি
যখন কাঁদেন তিনি, তবরিজে শমস্-এ সাত রোদন।

এবং কীভাবে খুঁজে পেলে তাকে
ফহেশি মোরগের ঝুঁটি হবে লাল,
বাক্যভুক ছায়া
না-শব্দে হেঁটে চলে যাবে?

এইসব উত্তরে মিঞা, বিষয়ের চোখ পড়ে থাকে।

উন্মার্গসংগীত মেড ইজি


ঐশ্বর্যরহিত
বাজারের থলেতে
একটা মাছের মাথা

প্রতি কিলোমিটার
অন্তর

ঝিমঝিম করছে

তবু আমার হাত সরছে না
গোপনতায়, রোদে

আমি এই মাছের মাথা অর্জন করে খাব

আমি এই মাথার মাছ তর্পণ করে খাব।


জঙ্গলে বেড়াতে গেলে
এমন বৃষ্টির দিনে কোনো

এমনই বৃষ্টির দিনে
কোনো জঙ্গলে বেড়াতে গেলে

সহসা এমনই দুর্বল চাপে পায়ের,
জল ও অতসী টপকালো ব্যাঙ!

প্রায় তরলে সরল করা জল
প্রায় ঘচর-ঘোচর করা
অতসী টপকে গেল ব্যাঙ!

ঘাসের ছিটকিনি খুলে বসে আছ?
এখনও ঘাসের ছিটকিনি বসে আছো খুলে?


বিষণ্ণতার একমাত্র ভাষা আরবি শিখতে চাইলে
নওরোজ মাদ্রাসার পাক মৌলবি জিগাইলেন,
গ্রাম পঞ্চায়েতের তৎকালীন লালপতাকা রঙের চেয়ার জিগাইলেন,
ডুবগাঙের তস্কর জল পায়ে জমিয়ে রাখার বেশরা পদ্ধতি জানা
আশ্চর্য জরায়ুর মালকিন মেহেরুন্নেসা জিগাইলেন,
গাঁজাখেতের সুরঙ্গ আলো করা আশিক ওরাংয়ের
নতুন সাইকেলের ঘণ্টিটি জিগাইলেন,
ভেজা কারেন্টের তারে লটকানো
‘চড়ুই না? হ, হ, চড়ুই’-চেহারার
লোকাল কাউন্সিলার জিগাইলেন

ডাক্তার কি মুসল্লি হইবা?

এবং এই অনধিক প্রশ্নের উত্তরে
না মৌলবি সাহেব, না, ও গ্রাম পঞ্চায়েতের লালপতাকা
রঙের চেয়ার, না, না গো মেহেরুন্নেসা,
না রে ভাই আলো খাওয়া আশিক ওরাং, না,
শ্রীশ্রী ‘চড়ুই না? হ, হ, চড়ুই’ চেহারার লোকাল কাউন্সিলার,
(আপ্নেরেও কইতাসি) না, একে একে সমস্ত অস্তিকে
নিজের পূর্ণনাস্তি দিয়ে ভাগ করার পর
একদিন এক সীমান্তঘেঁষা ডাক্তার

দিনের হালাল হইতে হইতে রাতের ঝটকা হইয়া গেলেন।


যদি গ্যেটের পশ্চিম-উত্তর দিওয়ান
পড়া থাকলে শতাংশের এক
হাফেজ শোনা হয়ে যায়

তবে আমার লেখা পড়েও কেউ
কল্পনাপ্রবণ হতে পারে

ভাবতেই সকালের নিঃসঙ্গ মেদুরতা
পাট ভাঙল রাতের

কিন্তু এত এত অতীত,
এত এত ভবিষ্যতের ভিড়ে
আমাকে সে কোথায় খুঁজে পাবে?

বস্তুত, এত বেশি খরচ না হওয়া অতীত ও
এত বেশি জমতে থাকা ভবিষ্যৎ যে
আমার অনির্দিষ্ট পাঠকের সুবিধের জন্য
ধরে নিচ্ছি
x হচ্ছে সমগ্র অতীত
এবং y কক্ষে
নির্বাচিত প্রবণতার মতো বেজে চলেছে
ভবিষ্যৎ, বারোটা দুই,
বারোটা এক, বারোটা, আমার লেখার সময়।

অতএব পাঠকের কল্পনা, সমগ্র অতীত ও
নির্বাচিত ভবিষ্যতের ফুটেজ খেয়ে
লেখা হল তনুজের আর একটি কবিতা।

বস্তুত, আরও একটি বাংলা কবিতা লেখা হয়ে গেল

তালিয়াঁ!


মাটির দুটো সন্ত্রস্ত হাত

যদি ধুয়েও যায়
মুছেও যায়
মিশেও যায়
মাটির দুটো পরিযায়ী স্তনে

ইত্যবসরে

অনল হক
অনল হক

বলতে
বলতে

যদি-বা ক্লান্তি চলে আসে

তবুও
ভুলে যেয়ো না

এই জনমের
মুখ হবে
মুখোশমাত্র।

Categories
2021-JUNE-KOBITA কবিতা

রাজদীপ রায়

প্রাণাধিক দেবতা আমার

কী দুঃখ কী সুখ সবেতেই অবিচল থাকে এই কাঠের শরীর—
ঘর আজ বন্ধ। কেউ আসবে না। রাস্তায় জুতোর শব্দ, তারা কেউ
আসবে না ঘরের ভেতর। এই সময় যদি রক্তখাকি রোদ্দুরের কথা
ভেবে শিরা কেটে রাখি, তবে বেশ হয়! আমি পড়তে বসে যাই আমার
নিজস্ব মৃতদেহ ছড়িয়ে— তার বুকে মাঠ রেখে অনুভব করি
পৃথিবী অনেককাল আগেই মরেছে; এখন শুধুই সেই মরা নিয়ে টানাটানি—
দুর্বল হৃদয় কিছু মানুষের সঙ্গে দেখা হয়েছিল; তারা চলে গেছে পাহাড়ে।
কামুক কিছু মানুষ সমুদ্রের ধারে গিয়ে পোশাক খুলে দিয়েছে।
কালজয়ী হবার কথা এখনো ভুলতে না পেরে
বারবার মাথা পুঁতে দিচ্ছি নরম বালিশে;
এই দুঃখ কে বুকে নেবে?
এই মৃতদেহ কে পুড়িয়ে দেবে?
টবের সামনে সমানে দাঁড়িয়ে আছে বেড়ালটা, যাকে চাইলে সমস্ত মনের কথা
বলে দিতে পারতুম। খুব দেরি নেই পৃথিবীর অন্য এক নামকরণ হবে—
আমরা সেই আনন্দফোয়ারার মুখ রেখে সেলিব্রেট করব পুংজন্ম…
চেনা বারান্দা থেকে রুমাল উড়ে আসবে,
তারও অনেক ওপরে
প্যারাস্যুটে ভাসমান ধ্বংস হয়ে যাওয়া চাঁদের ভগ্নাংশ—
শেষবার বলো, তুমি এই টিপ্পনীর ভাষাকে অন্তত
কবিতা বলে ভুল করোনি।


সহজ-সরল কথা কে আর শোনাবে? আপনার মতো?
জ্বর হলে মাথায় কে পট্টি দিয়ে দেবে…
আহা কুহকের অতিজাল ছিঁড়ে উড়ে যাচ্ছে যে বয়স্ক ঘুড়ি
আমি জানি কোন আকাশের কাছে তার কামভাব সংশ্লিষ্ট আছে!
তার ভিজে যাওয়া মুখে সূর্যাস্তের শর্করা ছড়িয়ে…
মানুষ সহিষ্ণু হবে— কথা ছিল— দুঃখের কথা বলবে গলা জড়িয়ে।
কিন্তু ইতিহাসকে সান্ত্বনা দিয়ে সে এখন কোন পাড়ায় ঝালমুড়ি
বিক্রি করে? বলতে পারেন সে কেন কথা বলে এত জটিল ভাষায়?

স্তাবকের আদিখ্যেতা বুঝে-বুঝে অণ্ডকোষ গাঢ় হয়ে যায়, দেখি
রাত্তিরে পেচ্ছাপ করবার মতো একটি সরল অনুভূতিও আজ
আকাশের কাছে এসে শুকতারা উপহার চাইছে—
অতএব সময় নেই।

আমাকে শেখান ভালোবেসে,
কাকে বলে ভিটামিন-সি, কাকে বলে প্রসন্ন কৌতুক
কাকে বলে অচিন রাগিণী, কাকে বলে তারাপদ রায়…


এমন দুঃখ দেবেন না, যা থেকে মুষড়ে পড়ি, আপনাকে আলবিদা জানাই—
বলি, এতদিন কাছাকাছি ছিলেন বলেই সরলতা জানা হল না…
আজন্ম কূটচিন্তার পাঁক আমাকে পাঠিয়ে দিল স্থাপত্যের দিকে
খিলান, গম্বুজ ঘুরে বুঝলাম এসব পূর্বপুরুষের কীর্তি।
আমরা এদের জিন বয়ে নিয়ে চলেছি সমানে, নারীসঙ্গ বর্জিত এক
সকালের কাছে, দাঁড়িয়ে দেখেছি কীটনাশক আমাদের শরীরে বেমালুম
পরাজিত। অতএব এখন নিশ্চিন্তে পৌরুষ ত্যাগ করা যেতে পারে—
বুঝতে পারেননি আসলে মাথায় শুধুই ঘিলু নয়, কিছু দ্রাবিড় সভ্যতাও ঘুমিয়ে ছিল।
তার ঠাটবাট আর ঠাকুমার গল্পের মতো দুটি মনমরা অথচ ফুর্তিবাজ মেয়ে।
মনে পড়ে, তাদের একজনকে অহিংসার পথ ছেড়ে দেবার সময় ভালোবেসেছিলাম
খুব, তারা বলেছিল, আপনার মূর্তি বসানো হয়েছে তেমাথার মোড়ে—
ওখানে লোকজন বিশেষ যায়-টায় না। দূরপাল্লার বাস দাঁড়ায় না।
শুধু একটা পাগল আকাশের দিকে তাক করে বাটি নাড়ে,
আর বিড়বিড় করে বলে: হে প্রভু, পরমেশ্বর, জুতোর মোলায়েমখানি
খুলে দিন না!
একটু পরাক্রম চাটি…


ভীতু আকাশের নীচে তস্য ভীরু চাঁদ, তার নীচে রোঁয়াচঞ্চু রেশনভিমানী
ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখছে একটা আরশোলা ক্রমশ গিলে নেবে বলে
এগিয়ে আসছে— অপদার্থ বাতাস কেমন শান্ত, লঘু
যেন খোলা মুখে আর একটু পরেই কেউ কীটনাশক ঢেলে দিয়ে যাবে
কেউ বলবে সন্ধ্যে হল, মুখ ঢেকে নাও— এখনই মৃতদেহ নিতে আসবে
নিয়ো শ্মশানের ডোম, অবচেতনের দেশে তাদের প্রত্যেকের হাতে
প্লাস্টিকের মেরুদণ্ড কাঁটা-চামচের মতো পরখ করবে— কার কত আয়ু বাকি
কে কত ইন্দ্রিয়পরায়ণ… জিভের অসাড় দিয়ে ছুঁয়ে থাকি সে-সব কাহিনি
শ্মশানযাত্রীরা দেখছে, কিছুটা আড়াল থেকে বিড়ি মুখে, স্নিগ্ধ আততায়ীর মতো।
তাদের প্রশ্নের কোল ঘেঁষে উঠে গেছে ছদ্মবেশী তারা; যার দূরাগত আলো দেখে
বুঝতে পারা যাচ্ছে না, জীবিত না মৃত, ঠিক কীরূপ প্রতিমা দিয়ে গড়া হবে
সত্যের স্বরূপ… এখন ঘুমোতে চলো, ভয়ের উপনিবেশে সবচেয়ে বেশি
শান্ত থাকে আবহাওয়া। প্রতিবেশী মাঠে রক্তদান শিবির বসেছে— মানুষ এসেছে সবে
ফিরে যাবে বলে; নাড়ি টিপে রক্তচাপ বোঝে সুঠাম ডাক্তার: ভয় কিসে?
আমার চোখের জল এখন ধূলার চেয়ে অতি সহজেই ভেঙে ভেঙে যায়!
যেন কোনো মহাপুরুষের পদধ্বনি কথা বলে:
এসেছ এতটা পথ? থেকে যাবে? তাহলে রসিকপ্রাণ হও।


জন্মের অনেক আগে আমরা সব পাথর ছিলাম।
খিলানে খিলানে তার মৃদু রসিকতা ফুটে উঠত নক্ষত্রের মতো—
কারা এই সৃষ্টিকাজ পছন্দ করেনি, কারা একে অশ্লীলতা মনে করে
আলকাতরা লেপে দিয়ে গেছে নাক-বরাবর… স্থির অনুপাতে
বসে দেখেছি সেসব পুড়িয়ে দেওয়া শিলালিপি থেকে
গতিমান অশ্ব, রাজার ধনুক আবার শরীর পাচ্ছে—
এইসব রাতজাগা তারাদের, যারা ভুলেও দেখেনি,
তাদের অসূয়া থেকে জেগে ওঠা আতুপুতু প্রেমের কবিতা
জয়টিকা দেওয়া হয়েছে তাদের মাথায়—
এরপর এইভাবেই লিখতে হবে, পৌরজন কেঁদে ভাসাবেন।
কালজয়ী এ-সব কর্মের সামান্য আগে তোমার প্রভূত জমি
ফাঁকা পড়ে আছে, প্রখর শয়তানি দিয়ে লেখো তো জমিয়ে
বানাও— বানাও নষ্টামি মাখানো কোনো তুমুল উপাখ্যান।
ভণ্ড আস্তিকের দেশে ওই নকল লেখাও কারা ভালোবেসে
মাথায় করবে— কড়া রোদে লণ্ঠন লেলিয়ে বলবে
সাবধানে যেয়ো ওগো প্রাণাধিক দেবতা আমার…


তুমি সত্য বলে দেবে কীভাবে লিখিতে হয়—সত্যিকার উপকথা
মর্ষকামী শোকের উল্লাস। কিংবা বড়োদিন আর ছোটোভাইমেজোভাই
ছিপ ফেলে বসে আছে, কখন নিরন্ন মাছ ধরা দেবে
সরকারি বিজ্ঞপ্তি এড়িয়ে—

ধারাপাত শেষ হয়ে গেছে, গ্রামার মুখস্থ করে উপকণ্ঠের ছেলেরা
সব বাড়িভাড়া বাকি রেখে ফিরে গেছে দেশে,
এখন শীতার্ত বোধ— জীবিকা হারানো
তুমুল অনিশ্চয়তা নিয়ে টোকা মারে, দেখ ঢাউস চাকরির নীচে
মারা গেল তোমার গ্রহিতা। সরলতা আদতে বিজ্ঞান— প্রসন্ন, চতুর
অনাহার প্রসবের কিছু আগে

ভোর হয় হয়… কালপুরুষের ছায়া ঘিরে ধরেছে তালবন
আতঙ্কিত যূথচারীদের রক্তের অভাবে আকাশ শুকিয়ে গেল!
তোমার এ-সমস্তই মনে হল প্রাকৃতিক রসিকতা;
সত্য কী? কীভাবে তা ঘটে, এইসব ভাবিতে ভাবিতে অসহায় আমি
বিড়ি ফুঁকে, ঢোঁক গিলে, খানিক বিষম খেয়ে—
পিণ্ডদান করে এলাম বাংলা কবিতার।

Categories
2021-JUNE-KOBITA কবিতা

পার্থজিৎ চন্দ

রক্তবীজমাতা

যুদ্ধে যাচ্ছি, তার আগে মায়ের মন্দিরে একবার প্রণাম করে যাই। ছোটো ছোটো যুদ্ধ, গেরিলাযুদ্ধ… অস্ত্রের হাতে বন্দি আমরা নিছক সৈনিক। মন্দিরের সামনে রক্তমাখানো জবাফুল-হাতে লম্বালাইন, শত্রুমিত্র সবার একই মাতৃ-আরাধনা; ইনি ঈশ্বরেরও মা অসুরেরও মা…রক্তবীজমাতা। যুদ্ধক্ষেত্রের এক ধারে দেবীকে সাময়িক প্রতিষ্ঠিত করা হয়। সৈন্য নিধনের দিনে ইনি শত্রু-মিত্রে সৈন্য সাপ্লাই দেন। যুদ্ধে যাচ্ছি, মায়ের মন্দির থেকে সোনার পালকি করে, মাথায় রাজছত্র, দেবীকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আবার কোনো যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে। মিলেমিশে আছে তার পালকিবাহক, সহাবস্থানে আছে সেবাইত। হুম হুম করে তারা মন্ত্র পড়ছে, একই মন্ত্র, ‘সুখদুঃখে সমে কৃত্বা লাভালাভৌ জয়াজয়ৌ…’, মাঝ-রাস্তায় তারা শুনতে পাবে গর্ভযন্ত্রণা তীব্র হচ্ছে, মোচন জরুরি। শিবিকা নামিয়ে তারা মুণ্ড কাটাকাটি যুদ্ধ করবে আর রক্তবীজমাতা কয়েকটি প্রসব করে কিছুটা তৃপ্তি পাবেন। তারপর দীর্ঘ যুদ্ধ, রক্তবীজমাতার যোনী থেকে পিলপিল করে বেরিয়ে আসবে ঈশ্বর-অসুর। আমি তালবনে একা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবি, এখানে সবাই তাঁর অবোধ অথবা সুবোধ সন্তান, কে তবে দেবীর কাছে প্রতিদিন দিয়ে আসে এত জন্মবীজ!

শরীর

‘উভৌ তৌ ন বিজানীতো নায়ং হন্তি ন হন্যতে’, আত্মা হননও করে না, হতও হয় না… দুপুরে মেঘ করলেই এই শ্লোকটির কাছে বাজে পুরানো রেডিয়ো। বাজতে বাজতে একদিন তার লাল-শাদা এভারেডি গলে যায়… রেডিয়ো চুইয়ে বিছানায় পড়ে ব্যাটারির রস, ঠিক যেন শয্যাগতর মূত্রপ্রবাহ। একদিন মানুষের শরীর থেকে আত্মাকে বের করে এনে ভরে ফেলা হবে ছোটো ছোটো ক্যাপসুলে; টানা করিডর, হাসপাতালের আলো, ট্রলির ওপর শুয়ে আত্মার গলিত ক্যাপসুল। কোটি কোটি ক্যাপসুল, লাল আর শাদা এভারেডি বেরিয়ে পড়েছে। মাঝে মাঝে তারা শরীরের ভেতর ঢুকবে, একটি শরীরে ভুলক্রমে দু-টি ক্যাপসুল ঢুকে অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটাবে। লাল ও শাদা এভারেডির মধ্যে ঘনিয়ে উঠবে দ্বন্দ্বমূলক সহাবস্থান। ধীরে ধীরে গলে যাবে আত্মার ক্যাপসুল, কিন্তু শরীর থাকবে। নতুন নতুন আত্মার কাছে তখন সুযোগ থাকবে শরীর বাছার। মোট কথা, সেদিনই যথার্থ প্রমাণ হবে, শরীর অবিনশ্বর— সে হননও করে না, হতও হয় না।

খাদ্য

এই সেই নিষাদীর গ্রাম, রুক্ষপথের ধুলোঝড় পার করে আমাদের গাড়ি থেমেছিল বিকেলবেলায়। বনজঙ্গলভরা টিলা, শরপঞ্চ ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছিলেন, নিষাদী ও তার পাঁচ পুত্রসন্তান এ-রাস্তা ধরেই মদ আর মাংসের লোভে ঢুকে পড়েছিল জতুগৃহের কালো গহ্বরে, তাদের সঙ্গে ছিল পোষ্য রাজহাঁস। ক্রূর অভিসন্ধিময় হত্যার পাশে, নিষাদী ও তার পাঁচ পুত্রের দগ্ধ শরীরের পাশে পড়েছিল সেই রাজহাঁস। সন্ধ্যে নামছে, বিরাট দিঘির জলে উড়ে যাওয়া পাখিদের ছায়া, জলের ভেতর সেই ছায়া যেন ঝলসানো হাঁসের শরীর। আমাদের সমস্ত অক্ষরের গায়ে ছায়া-ফেলা ঝলসানো হাঁস, তার ঠোঁট থেকে গড়িয়ে নামছে শ্লোক— অস্ত্র ধরো, অস্ত্র ধরো, এ-বনের ভেতর কোথাও ঝলসে উঠছে হাঁসের মাংস ঝলসে উঠছে তোমার খাদ্য

ভাষাশাবক

তারপর দূর কোনো স্ট্যাডেল— গুহার দিকে জেগে ওঠে মাছ-জীবনের ভোর। গলিত নৌকো ও নোহার হাড়গোড়… দীর্ঘ জড়ানো স্নায়ু মাংসপিণ্ড সমুদ্রগাছের ছায়া গুহামুখে। বিগত প্লাবন শিকড় উপড়ে এক কালো হাঁ-মুখের শূন্য রেখে গেছে। তার কাছে হাঁটু মুড়ে বসে গুহার ভিতর নির্মিত হতে দেখি কিমাকার জান্তব আদিম শরীর। সে মৎসশিকারে নেমে যায় নদীর গভীরে। নোহা ও নদীর কাছে শুয়ে থাকা মারমেড তার গর্ভে ধরে রেখেছিল এক ভাষাশাবকের ভ্রূণ। স্ট্যাডেল-গুহার গূঢ় অন্ধকারে ভাষাশাবকের গায়ে ফুটে ওঠে টোটেম ও ট্যাটুর গান। মূর্ত টোটেম ও বিমূর্ত গানের দ্বৈরথে যজ্ঞসম্ভূত তমসার জন্ম হয়েছিল। ফলে তমসার ডলফিনগুলি বিমূর্ত লাল বল নিয়ে সারারাত পাক খায়। ঘুম-সারেঙের ছিন্ন নৌকাটিকে ঘিরে পাক দিয়ে ঘোরে। জলের ভেতর মাছ-জীবনের দিকে হেঁটে আসে সিংহপুরুষ। তার অস্ফূট গান সারেঙের শ্রবণমাত্রার ঠিক নীচে ভেসে থাকে স্থির; লুব্ধক। অনিবার্য, অথচ সুদূর। সারেঙের গান ও আর্তনাদে তমসার সচকিত ডলফিন। যেন মাথাটুকু তুলে, নাসিকারন্ধ্রটুকু তুলে মহাপ্লাবনের দিনে ভেসে যাওয়া প্রাণীদের জগৎ-সংসার। তাদের মাথার কোটরে ঢুকে যাচ্ছে সারেঙ-শব্দ আর ভাষা-তমসার নীচে তার দেহটিকে কামড়ে ধরেছে সিংহপুরুষ। এই মূর্ত টোটেম ও বিমূর্ত গানের মাঝখানে রক্তলাঞ্ছিত দু-টি শুশুকের মুখ; যারা ভাষাশাবকের খাবার খুঁজতে এতটা এসেছে

হত্যা

সচেতন চর্যাপদে তোমাকে শপিং-মলের কাছে রেখে দিয়ে যাই। তুমি ঘুরে ঘুরে দেখো থাই-ফাটা জিন্স ম্যানিকুইনের ঠেলে ওঠা বুক (যদিও ইউনিসেক্স), কিছু বিনিময় ছাড়া কী-আশ্চর্য, তুমিও শপিং-মলের অমোঘ অংশ হয়ে ওঠো। লক্ষ বছরের ইতিহা্সে, শুধু দর্শনে এ প্রথম বাণিজ্য সম্পন্ন হল। যৌনতাও। কাহ্ন-ভুসু্কু ভাষানদীতীরে মূর্ছা গেলেন। রক্তমাংসমেদ ছাড়া নগরীতে বিবাহের বাদ্যি বাজল। ভুসুকুর খুলি থেকে নিয়ো-লিবার‌্যাল মদ চেটে খেতে খেতে ফেরার প্রহর ঘনিয়ে এসেছে। সচকিত ছেলেমেয়ে, ও.বি-ভ্যানে চেপে যারা বনভোজনের দিকে এসেছিল তার ফিরে যায়। তার আগে তছনছ করে যায় বাস্তুতন্ত্র। নৌকার সন্ত্রাসে নদী থরথর করে কাঁপে সচেতন চর্যাপদে তোমাকে শপিং-মলের কাছে এক অচলায়তনে রেখে দিয়ে আসি

Categories
2021-JUNE-KOBITA কবিতা

পঙ্কজ চক্রবর্তী

ধুলোবালি

মেঝেতে ধুলোয় প্রতিদিন ভাঙছে সংসার। আমি টের পাই অন্যমনস্ক বাতাস দু-একটি বাসনপত্র নাড়াচাড়া করে। জীবন প্রস্তুত নয়। শূন্যতা ভরা বেলুন উঠে যাচ্ছে আকাশের দিকে। লেখা নেই, শুধু এক চতুরতা এতদিনে লায়েক হয়েছে। ঐ তো ভাসছে মেঘফুলের তরী। দৃশ্যমানতায়। তোমার সিঁড়ি বেয়ে এসেছে খ্যাতি, স্বল্পবাক্ মানুষের ভাঙাচোরা যেটুকু দিগন্ত।

ধুলোবালি, কতদিন রাতে আমি মাথায় বুলিয়ে দিয়েছি এই হাত। তবু ভোরবেলা মানুষের সংসারে নষ্ট হয়ে যাচ্ছ প্রতিদিন।

পিতামহ

শতাব্দী প্রাচীন একটা জানলা বুকের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলেন আমার পিতামহ। আর লোকজন এলে গল্প করতেন বাসি বোয়াল মাছের ঝোলের। আস্তে আস্তে তার চশমা ডুবে যেত জলের গভীরে। মাঝরাতে জ্যোৎস্নার উঠোনে ঘুরে বেড়াত নেত্রকোনা সাবডিভিশন। ধানখেতের মাথায় মরা জামগাছ নিয়ে চিন্তিত ছিলেন অনেকদিন। কথায় কথায় চালের হাঁড়ির ভিতরে দেখতে চাইতেন এই স্মৃতি কতদিন পর্যাপ্ত। আমার সমস্ত বই তার বানান থেকে দূরে উদাসীন দুপুরের চিৎকার।

সমৃদ্ধ ভারতবর্ষের এক নাবালককে তিনি শাসন করতেন একফালি বারান্দায় বসে।

সীমানা

একটি কাঠবেড়ালি মৃত্যু বসে আছে নিমগাছের ডালে। আমি ভেবেছিলাম তোমার রেলপথ এমনই বিস্তৃত। জামগাছের আড়ালে ঐ তো স্টেশন, টিকিটঘর। জনহীন দুপুর। শুধু ঘাসের জঙ্গলে বসে একজন বুড়ো মানুষ দিবাস্বপ্নের ভিতর হাসছে। এইসব জীবন বিপ্লব থেকে বহুদূরে। এমনকী শ্মশানের কাঠ তত মধুময় নয়। শতাব্দী প্রাচীন কাঠবেড়ালি তোমাকে আদেশ করি স্পর্শটুকু নাও।

সরে দাঁড়াও ঈষৎ ট্রেনের ঐ বাঁশি। আরও বেশি গাছপালা, কয়েকটি স্টেশন পাওয়া যাবে। তোমার কাঁসার থালায় বরিশালের রোদ্দুর। জলের নাভি থেকে উঠে আসছে রামকৃষ্ণ উদ্বাস্তু কলোনি।

দূরদেশি

ওগো ছোটোখাটো দুঃখ ভালো মানুষের উপেক্ষার ভিতর দীর্ঘ শীতকাল ঘুমিয়ে পড়েছে। তোমার অলীক দরজা পেরিয়ে যেটুকু ফসলের ছায়া, প্রস্তুত হই। একজন লিপিকর জলের ছায়ায় মুখ রেখে চলে গেছে দীর্ঘকবিতার দেশে। আমি কি ভোরের পায়চারি থেকে তুলে নেব সফল জীবন? মহৎ শিল্পের পাশে বসে ঐ যে কুকুর তুলে নেয় বাসি বিস্কুটের ছায়া। আমি শুধু মাঝখানে দাঁড়িয়ে দেখেছি খড়কুটো, মাছেদের অসুখী জীবন।

এমন তো হতেই পারে বড়ো দুঃখ প্রতিবেশীর ঘরে আসন পেতেছে। আমি যাচ্ছি যাই করে করে আজীবন পেয়ারা গাছের নীচে রাত কাটালাম।

দেবোত্তর

১৮৫৫, তোমার সোনার ছটা আমাদেরও গায়ে এসে লাগে। ছোটোখাটো ঘরের কাজ আর বাসন ধোয়ার জলটুকু ছাড়া এই জীবন অপরাধী, উচ্ছিষ্ট আহারের মতো প্রতারক। মন্দিরের গায়ে, মানতের ঢিলে শুধু তো প্রার্থনা নয়, কামনাও থাকে। থাকে অভিশাপ। কয়েক পুরুষের ভিজে গামছার নীচে রক্তের শ্রাবণ। জামগাছের নীচে জামাকাপড় ইস্তিরি করছে একজন দেহাতি মানুষ‌। তুমি তার কেউ নও। শুধু এক দালানের সিঁড়ি বুকে চেপে হাঁটে চতুষ্পদ।

আজ দেবোত্তর সম্পত্তির দিকে বাড়ানো সমস্ত হাত খসে গেছে। ওগো চরাচর, ১৮৫৫, আজও মানুষ তেমনই পাথর, শুধু এক ভ্রমণকারীর খাতা স্থাপত্য টুকে রাখে খুচরো অভিমানে।

শ্রমিক

টের পায়, ব্যক্তিত্বহীন মানুষ টের পায় শহর তাকে গ্রহণ করেনি। বন্ধ কারখানার বাতিল যন্ত্রপাতির ঘরে এখনও দু-একটি গেঞ্জি আছে তার নামে। প্রতিটি সূর্যাস্তের চুম্বন। দেখে মনে হয় খালি পায়ের ভ্রমণ। শুধু এক চায়ের দোকানদার মধ্যস্বত্বভোগী। দিনের পর দিন যায়। আগাছার পাশে বুনোফুল বেড়ে ওঠে রোজ। একদিন ফিরে যেতে হবে ঘনিষ্ঠ অন্ধকারে উটের মালিকের দেশে।

তবুও জলের কাছে ছায়ার মানুষটিকে দেখে তার আশ মেটে না। দেশান্তরের জল। তার নাভির ভেতরে রাখা আছে তালাচাবি বন্ধ কারখানার।

রাতের শহরে

নিজের ছায়া বিক্রি করে এই শহরে পড়তে এসেছি। অন্ধকারে মানিব্যাগে অবশ্যপাঠ্য বইয়ের চিরকুট। গম্ভীর এক লাইব্রেরিয়ান চুলের মুঠি ধরে দেখে নেয় ছদ্মবেশী পাঠকের ঘুম। তারপর খাঁচা ভর্তি এক ঝাঁক পাখি রেখে যায় টেবিলের ওপর। ফোর্থ ক্লাস স্টাফের সঙ্গে রফা হয়। দুস্প্রাপ্য বইয়ের পোকার জীবনের পিছুপিছু হেঁটে দেখি সামনে পথ নেই। শুধু এক তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের নির্বাচিত দেহটুকু নিয়ে হাসির ফোয়ারা। ফুটপাতে অলৌকিক জেরক্সের দোকানে আলো জ্বলছে এই মধ্যরাতে।

আমি দেখি দুপুরের ঘাম, অবশিষ্ট ভাতের নীচে আতসকাচের এক গ্রাম। বহুদূর থেকে পড়তে এসেছে রাতের শহরে।

স্বর্ণযুগ

অর্থহীন শব্দের কুয়াশা, আমি রাজপথ ছেড়ে নেমেছি তোমার গলিপথে। দেখছি মানুষের ভিতর এক উট চলেছে আলোকবর্ষ সুদূরে। কামরাঙা গাছের মদিরা। ভাঙাচোরা মানুষ মাটির দাওয়ায় বসে পাঁউরুটি ভিজিয়ে নিচ্ছে চায়ের গেলাসে। আমার সমস্ত ধারবাকি তার বুকের পাঁজরে লিখে রাখি। মহৎ শিল্পের পাশে এই ধুলোমাটির জীবন বলছে তোমার মুখর ছায়ার কোনো বিকল্প নেই।

উটের ছায়ায় চলেছে বেঁটে মানুষের বউ। তাকে কিছু বলার আগেই বুঝি কথা শেষ— শুরু হল তোমাদের স্বর্ণযুগের সব গান।

Categories
2021-JUNE-KOBITA কবিতা

রাণা রায়চৌধুরী

বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে


ঐ লাভ চিহ্ন উড়ে যাচ্ছে
ধরো ধরো, ও যে বিষাদের প্রতীক
ও যে অভ্রান্ত অভাবের বাড়ি

ওকে আটকে রাখো। ওকে ভয়ংকর তালাচাবির নিভৃত
আগুনে সাজাও।

এই লাভ চিহ্ন
মায়া ও বাসনা ঘেরা উদ্ভ্রান্ত এক
পাখির পালক, অপলক আকাশের নীল দিকরেখা

ধাক্কা ও আকাঙ্ক্ষা মাখা এক
বৈদ্যুতিক দূরবীণ, ওই শরীরে শরীর মেখে
কাঁদছে ও

ওকে রুমাল দাও, আর দাও সন্দেহের হ্যারিকেন

ওই উড়ে যাচ্ছে ও
গায়ে তার বাতাস আর, আর গান লেগে আছে –
বিরহের ব্যস্ততায় ওই বাথরুমে ঢুকল, হিসি ও সন্ধ্যার
সন্ত্রাস ওকে শান্ত করুক…

গদ্যের কারিগর ওকে দিক ঘাস
আর এফএম রেডিয়ো
তেহরানের বাতাসে ভেসে যাক সে


যারা বাইক চালিয়ে যায়, তাদের আমার
ভালো লাগে। তাদের গায়ে ও মনে
অজগরের চামড়া, বনজ সহজ গুল্মলতা,
আধুনিক আসবাবের মতো গতি আর
তীব্র আকাশ কাঁধে উহাদের চলে যাওয়া…

দেখি আমি

দেখার চোখ দিয়েছিল যে সেও চলে যায়
গানের গা থেকে পাতা খসে পড়ে
ছোটো পিশি পাস্‌ড অ্যাওয়ে বলে ট্রান্সমিটারে আগুন
জ্বলে ওঠে, গানের গা থেকে ছোটোপিশি খসে পড়ে

দেখি আমি

ছালবাকল ওঠা একটা জীবন
যাকে ট্রেন থেকে দেখা অচেনা গ্রামের
মতো মনে হয়, ওইখানে মেজদা সরোজিনীকে
জড়িয়ে শুয়ে ছিল, মেজদার বিছানায়
বাইকের চাকার দাগ
সরোজিনী ঘষটে ঘষটে মৃতদেহ হয়ে ওঠে

মেজদার লিঙ্গ যেন
ভয়ংকর লেপার্ডের মতো
অদৃষ্টের দিকে চেয়ে থাকা

হে বাইক, বিড়াল কাটা রাস্তায়
এত মেজদা ও সরোজিনী কেন আজও?
হে বাইক, তোমার গর্জনে কেন এত
আত্মত্যাগ লেগে আছে?


মোমবাতির একটা দীর্ঘ কালো ছায়া
দেখা যাচ্ছে।
একজন ঝুলে থাকা মানুষ যেমন
ভাল্লুকে রূপান্তরিত হয়।

একটা বিপরীতমুখীরেখা তোমার
আমার সবার জীবনে আসুক।
একটা রিভার্শাল টার্ন।
ষাঁড়কে দেখা যাচ্ছে ওই প্রস্ফুটিত
ফুলের মতো, আলোর মতো।

জিলিপির বিয়ে ঠিক হয়ে গেল।
পাত্র ময়রার দোকানের এক নম্বর
কারিগর, ঈষৎ চুতিয়াও সে, সে একদিন
মিষ্টিকে তেতো বানাবেই।

বুল ভার্সেস বিয়ার ফাইট ইজ
কন্টিনিউড।

আরও নীচে থেকে, খাদের গভীর থেকে
একদিন হঠাৎ আমাদের লালায়িত ষাঁড়
উঠে আসবেই, সঙ্গে চাঁদের ক্ষতবিক্ষত
মায়া ও ভালোবাসা।

জিলিপির বিয়েতে একটু বেশি খাওয়া
হয়েছিল, আমাদের সবার।

আমরা বেশি বেশি খাব বলে ষাঁড়কেই
ভাইজান ভেবেছি চিরকাল…


ভাইমাডা পঞ্চাশ
ইস্টামেট পঞ্চাশ/পাঁচশো
অ্যাটোরভা দশ
কঙ্কর কর দুই দশমিক পাঁচ
ডক্সোলিন চারশো
ডুওলিন দুইশো
বুদামেট দুইশো

জাপিজ দশমিক পাঁচ
Telekast L
কোয়াশ
পটল
ঝিঙে
লঙ্কা এঁচোড়ে পাকা কদুলি

আটান্ন প্লাস
দিবানিদ্রা
ভোরের দুঃস্বপ্ন
মনখারাপ
মা নেই
বাবা নেই
আজ শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তি লাভ
আজ মাতুলালয়ের শোকলাভ

একটা সাইকেল
কেরিয়ারে চৈতালি হাওয়া
চাকায় পাম্প কম
সামনে বাম্পার

মেয়েটি সুন্দরী
কিন্তু তিতিরের বয়সি
যাক গে যাক
মুখে মাস্ক
রুমালে কফ ও সিকনি
আধার ও প্যান নম্বর মুখস্থ

তবু রাত আর শেষ হয় না
ভোরের ফার্স্ট ট্রেন ক-টায়?
শিয়ালদা থেকে মেডিকেল কলেজ

ক্লাস ফোরের দিনগুলো
মনে পড়ে


আচ্ছা ভালো কথা, বেগম আখতার তুমি
শুনেছ? আচ্ছা গীতা দত্ত? সায়গল? আসলে
ভ্রূণাবস্থায় আমরা ছিলাম সুরে ভেসে মায়ের
পেটে। আমরা সুর পান করতাম। গর্ভাবস্থায়
মা-ও খেত গীতা দত্ত মা খেত সায়গল—
ঝাল-মশলা ডক্টরের বারণ ছিল— মা
সে-বারণ শুনে শুধু সুর খেত, গলাগলা সুর। বাবা
নামিয়ে দিত তার খুশি খুশি শরীর থেকে— এই
যে শিক্ষিত জঙ্গল আমাদের; এই যে
উচ্চ-শিক্ষিত বন্যরা গীতা দত্ত-র সুর দাঁতে
ছিঁড়ে নিয়ে পালাল ভক্তিভরা জঙ্গলের ভিতর,
ঐ জঙ্গলেও সায়গলের সুর আছে প্রাচীন
দেবদারু গাছে।

তো এই সুর এই পথ— নাউন আর
অ্যাডজেক্টিভ আর ভার্ব আর প্রোনাউন দিয়ে তৈরি।
এখানে সাঁতার এখানে নিষ্কাম কর্ম, নিরাসক্তি।
এইসব সুরের ভিতর ঝমঝম করে ফার্নিচার
ঝরে-ঝরে সংসার, ঝরে ন্যাতানো ইউটিউব—
এইসব সংবাদ শুধু তোমার জন্য, এই বেসুরো গান শুধু
তোমার জন্য রইল।

আমাকে একটু চা দাও, আর দাও একটি পথ,
দীর্ঘ একটা পথ দাও, অনেক দিন পথের দেখা
পাইনি, পাইনিকে পেতে পেতে না-পাওয়ার
দিকে যেতে চাই…

Categories
2021-JUNE-KOBITA কবিতা

অমিতাভ মৈত্র

শর্টকাট

যদি ক্রাচ সঙ্গে থাকে
অস্তিত্ব স্রেফ দু-মিনিটের হাঁটা পথ

যে ভাবে মিথের জন্ম হয়

রাতে তারা দু-জন কবরখানার প্রধান ফটক থেকে
নেমে আসে নিঃশব্দে
আর অন্ধকার রাস্তায়
নরম থাবা ফেলে ঘুরে বেড়ায়।

লোকে বলাবলি করে
ধুলোমাখা শিরীষ গাছের আড়ালে
মাঝে মাঝে তারা পেচ্ছাপ করার জন্য থামে।

বুড়ো আর সূর্য

মাটির পাত্রে জ্বলন্ত কাঠকয়লা জুটত না বলে
শীতে অসাড় বুড়োটা চাইত
সূর্য যেন না ডুবে যায় কখনো।

সূর্যই জানে আসলে এক অবাস্তব ধর্মযাজক সে
মৃত্যুদণ্ডের আগে যে দণ্ডিতের সামনে
অনুভূতিশূন্য কিছু কথা
কাগজ দেখে অন্যমনস্কভাবে পড়ে যায়।

নিরাপত্তা

দেয়ালে শক্তভাবে জুড়ে থাকা প্রতিটি ইট
তৃপ্ত থাকে তাদের নিরাপদ সুসংবদ্ধ জীবনের জন্য।

বাতাস মাঝে মাঝে বিদ্রূপ করে তাদের জীবনকে

তারা কানে তোলে না।

আউটডোর টেবিল

উপুড় হয়ে শুয়ে আছে নিঃসাড় আকাশ
আর তার পিঠের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে
আস্তে আস্তে, সারাদিন ধরে এগিয়ে যাচ্ছে লাল স্টেথোস্কোপ

সম্ভবত অসুখ খুঁজছে।

সিদ্ধি

একজন মানুষকে হত্যা করার পর
কয়েকদিনই শুধু হাত কেঁপেছিল আমার
কিন্তু তারপর আবার যখন ছবি আঁকায় ফিরলাম
আমার কল্পনা আর রং
অনেক বেশি গভীর ও সাহসী হয়ে উঠেছিল

আমার মনঃসংযোগ আর তুলি ধরার ক্ষমতাও বেড়ে যায়

অনুতাপের ঘরের দেয়ালে যা লেখা ছিল

এমন জীবাণুশূন্য করে নিয়ো না নিজেকে, যাতে মনে হয়
সাদা সাবানের ওপর কালো ফিনাইল দিয়ে
                        লেখা হয়েছে তোমাকে

ঈশ্বরের হাতে, ঈশ্বরের লেখার খাতায়

শপিং মল-এ একজন আধ্যাত্মিক

ট্রায়াল রুমের ভেতর থেকে লাল কর্সেট পরা মহিলাটি
চাপা গলায় বললেন— গাধা কোথাকার!

আর ব্লেজার বাড়িয়ে ধরে একজন ঝকঝকে বিক্রেতা
                                            তখন বলছেন—
নিন এই দুর্দান্তকে! শুধু আপনার আগের জীবন আমাকে
                                            দিন।

মনে হয় এই শহরে সবাই
ঘরের আলো নিভিয়ে
স্ট্যাচু হয়ে থাকার খেলা পছন্দ করে
আর কোনোভাবে সেই খেলা আমাকেও টেনে নিচ্ছে হয়তো।

ঘষা কাচের ওপাশ থেকে আর একজন লাল কর্সেট
          খসখসে গলায় বলে উঠলেন— গাধা কোথাকার!