Categories
2021-May-Essay প্রবন্ধ

কিংকর দাস

পুরাতনী প্রজ্ঞা অথবা পরম্পরাগত জ্ঞান

১৯৬৯ সালের ২১শে জুলাই ভারতীয় সময় সকাল ৮টা ২৬ মিনিটে মার্কিন চন্দ্রযান অ্যাপোলো ইলেভেন ঈগল যন্ত্রাংশ থেকে বেরিয়ে চঁদের মাটিতে পা রাখলেন প্রথমে নীল আর্মস্ট্রং এবং পরে এডউইন অলড্রিন। আমার বয়স তখন সাত। আমার দাদার সতেরো। তখন অডিয়োভিসুয়াল মিডিয়ার দবদবা শুরু হয়নি। বিশ্ব ও পারিপার্শ্বিক সচেতনতা সম্পর্কে ছাত্রসমাজ ততখানি সবজান্তা সর্বস্ব মানসিকতা সম্পন্ন হয়ে ওঠেনি। তবে চাঁদে মানুষের পদার্পণ ছিল একটা যুগান্তকারী ঘটনা— সে-ঘটনায় সারা বিশ্বজুড়ে তোলপাড় উঠেছিল। আমার দাদাও তার ব্যতিক্রম নয় এবং দাদা কৌতূহলবশত আমার ছোটো দাদুকে ঈষৎ টিপ্পনি কেটে বলেছিল— কই দাদু, তোমার চন্দ্রদেবের দেশে তো মানুষ গিয়ে পৌঁছাল— তো সেখানে তোমার চন্দ্রনাথ তো দূরের কথা প্রাণের টিকিটি পর্যন্ত দেখা মিলল না। দাদার এমনতর প্রশ্ন শুনে অশীতিপর আমার ছোটো দাদু মুচকি হেসে বলেছিল— অর্বাচীন কিশোর, পুরাণে দ্বাদশ চন্দ্রের উল্লেখ আছে, যে-চন্দ্রগৃহে চন্দ্রদেবের বাস সেখানে মানুষের সাধ্য কী পা রাখার। এ-বিষয়ে আমার দাদু একা নয়। এরকম অনেক মানুষের সন্ধান পেয়ে যাবেন যাদের বৌদ্ধিক ধারণায় বিশেষ বিশেষ বিষয় সম্পর্কে পুরাতনী প্রজ্ঞাটি এমনই অটল এবং অনড় যে, সেই সম্পর্কিত ধারণাটি তাঁরা লালন পালন করেন এমন নয়, তাকে অভ্রান্ত বলে মনে করেনও এবং তাকে নির্বিশেষ করে তুলতে চান— বংশপরম্পরাগত বা যুগ যুগ ধরে লালিত সাবেকি বা চিরাচরিত জ্ঞানচর্চার ফলশ্রুতির নিরিখে।

আমার যেখানে বাড়ি— সেই খড়গপুরের মালঞ্চগ্রামের চণ্ডিপুর পাড়ায়। সেই পাড়াতে বাড়ি রহমত মিঞার। রহমত একজন ধর্মপ্রাণ সরল মনের মানুষ। মক্তব পর্যন্ত তার পড়াশোনা। আপনি রহমতকে জিজ্ঞাসা করুন— চাঁদে মানুষ যাওয়ার প্রসঙ্গে, তা হেসে কুটোকুটি হবে সে। কারণ, মৌলবী সাহেবের পুরাতনী প্রজ্ঞা মোতাবেক বিদিত— চাঁদে গিয়েছিল মাকড়শা আর মহম্মদ আকবর। আর রহমতের সাবেকি জ্ঞানে— সে-ধারণা অটুট এবং চিরস্থায়ী। দু-টি ক্ষেত্রে পুরাতনী প্রজ্ঞা ও সাবেকি বা চিরাচরিত জ্ঞান আপ্তবাক্য তুল্য হয়ে গেছে এবং তা অনুশীলিত হয়েছে— পরম্পরাগত বিশ্বাস—বশবর্তী হয়ে। কোনো ক্ষেত্রেই সত্যতার যাচাই, কার্য-কারণের শৃঙ্খলাগত সূত্রে পরীক্ষিত হয়নি এবং তাদের ধারণায় বৌদ্ধিক স্তরে বিষয়টি প্রজ্ঞা বলে বিবেচিত হয়েছে আর সে-প্রজ্ঞা যেহেতু প্রাচীন ও সনাতন বলে মান্যতা পেয়েছে— তাই যুক্তি শৃঙ্খলা খুঁজতে যাওয়া তাদের কাছে অবান্তর বলে মনে হয়েছে। প্রকৃত প্রস্তাবে এদের কাছে যুক্তি শৃঙ্খলাক্রমটি সর্বতোভাবে বীজগণিতীয় আংকিক পদ্ধতির সমস্যা সমাধানের জন্য ধার নেওয়ার মতো কিছু একটা, যেমন x = y কিন্তু x = y কখনো হতে পারে না। x ও y দু-টি ভিন্ন বস্তু বা অবস্থা বা পরিচায়কবাহী সত্তা, সুতরাং x ও y স্বতন্ত্র। কোন মতেই অভিন্ন নয়। একে-অপরের পরিপূরক বা সম্পূরকও নয়, তবুও একটিকে অপরটির কোনো এক অর্থে সর্বতোসমান ধরে সত্যের সমীপবর্তী হওয়ার চেষ্টা করা। কিন্তু সত্য নামক বিষয়টি যে চূড়ান্ত কোন বিষয় বা সিদ্ধান্ত নয়— তা আমার দাদুর বা রহমত মিঞার বোধে ধরা পড়ে না। এ-জন্য নচিকেতা যখন যমকে প্রকৃত সত্য কাকে বলে এমনতর প্রশ্ন করে বসে, তখন যম বাবাজীবনের তো ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি-র মতো অবস্থা; কেন-না সত্যের সেবক-পালক ও ধারক ধর্মরাজ যম ভালোভাবেই জানতেন— ‘সত্য’ নামক বিষয়টা বড়োই গোলমেলে— তা সরল ও একরৈখিক নয় বরং বহুমাত্রিক জটিল ও কূট; তাই আমতা আমতা করে জোড়াতালি গোছের কিছু একটা বলে, ভুজুং ভাজুং করে নচিকেতাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। কেন-না তিনি তো জানেন— তিনি এমন বলতে পারছেন না যে, সত্য মানে যাহা প্রকাশমান, তাহলে সত্যের অপলাপ করা হবে, যেহেতু অপ্রকাশমান সত্য বলেও তো একটা ব্যাপার আছে— যাকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার বা বর্জন করতে হয়; আবার এমনও বলতে পারছেন না যাহা সত্য তাহাই সত্য, তাহলে এক্ষেত্রে কার্যকারণের যুক্তি শৃঙ্খলাকে অস্বীকার করতে হয়। তাই পুরাতনী প্রজ্ঞা আর সাবেকি জ্ঞানের অভ্রান্ততা বিষয়ে আলোচনাক্রমটি সত্যতার যথার্থতা চেয়ে বসে।

পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষণ ও বিশ্লেষণে বিজ্ঞানী দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সত্যের বন্ধনটি যদি সোজা না হয়— তাহলে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা যে কতখানি ভ্রমাত্মক হতে পারে তার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত জার্মান বিজ্ঞানী কখ্‌-এর জীবাণুর জন্ম সংক্রান্ত পরীক্ষাটি, কখ্ একটুকরো খড় ফ্লাস্ক বন্দি করে দেখিয়েছিলেন বাইরের কোনোরূপ সংস্পর্শ ছাড়াই ফ্লাস্কের ভিতরে জীবাণুরা কীভাবে আপনা-আপনি জন্মাতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু কখ্-এর পরীক্ষণে কার্যকারণ সূত্রের সত্যটি যথাযথভাবে অনুশীলিত না হওয়ায়— বিষয়টি যে অভ্রান্ত নয়— তা অচিরেই প্রমাণ করেছিলেন ফরাসি বিজ্ঞানী লুই পাস্তুর। কখ্-এর সিদ্ধান্তরূপ প্রজ্ঞাটি ততদিন অভ্রান্তরূপে বিবেচনা পেয়েছিল, যতদিন পর্যন্ত না পাস্তুর কখ্-এর ঐ সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে দেখিয়েছিলেন— ফ্লাস্কের ভিতরে ঢোকানো খড়ের কুটোটি জীবাণু মুক্ত ছিল না। ফলে ট্রাডিশনাল নলেজ এবং পুরাতনী প্রজ্ঞার বিষয়টি যে সর্বাত্মক নির্বিরোধ— নিঃসংশয়— সন্দেহহীন— অভ্রান্ত এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। বরং এ-দুয়ের মধ্যে যুক্তি প্রতিযুক্তির শৃঙ্খলাক্রমটি যত বেশি বেশি করে সংঘটিত হতে থাকবে— তত বেশি করে সত্যের সমীপবর্তী হওয়া সম্ভবপর হবে। আর তা যদি বেদবাক্য তুল্য আপ্তবাক্যরূপে প্রতীতি লাভ করে, তাহলে বিষয়টি আপাত বিরোধশূন্য বলে পরিগণিত হলেও তা সত্য থেকে (কেন্দ্রাভিগ) সেনট্রিফুগাল হয়ে পড়ে এবং যুগ যুগ ধরে এমন ভ্রমময় প্রজ্ঞাকে সত্য রূপে গ্রহণ করে বসে আর ট্র্যাডিশেনাল থটপ্রসেস তা লালিত হতে হতে ধ্রুবরূপে বিশ্বাস লাভ করে অনুশীলিত হতে থাকে। এ-কথা তো ঠিক যে কোপারনিকাস ও গ্যালিলিও, পূর্ব পৃথিবীতে যারা জন্মেছেন এবং পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন— তারা এটাই জেনে গেছেন সূর্য নামক জ্যোতিষ্কটি পৃথিবী নামক গ্রহের চারপাশ জুড়ে ঘুরে চলেছে। আদপে ‘সত্য’ শব্দটি সম্পর্কে জনমানসে আজন্মলালিত ভ্রান্ত বদ্ধমূল ধারণাটি— সত্য সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞানলাভে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে— ফলে wisdom এবং knowledge এ-দু-টি বিষয় একধরনের চরম ও চূড়ান্ত বা পরম মান্যতা লাভ করে বসে। প্রকৃতপক্ষে বস্তুগত জগৎ থেকে আদিম মানুষ কোনো এক বিশেষ মুহূর্তে আকস্মিক ঘটনাকাণ্ডে জ্ঞান অর্জন করতে সমর্থ হয়েছিল, তারপর সেই অধীত জ্ঞানকে অনুশীলন পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে বিজ্ঞানী প্রজ্ঞায় পরিণত করে— সেই বিশেষ জ্ঞানকে সাধারণ জ্ঞানে পর্যবসিত করেছে। এই বিশেষকে সবিশেষ বা নির্বিশেষ করে তোলাই ছিল primitive society-র সভ্যতার সাথে অগ্রসর হওয়ার প্রাথমিক লক্ষ্যে কিন্তু তা সচেতনকৃতভাবে সংঘটিত হয়েছে এমনটা বলা যাবে না। বরং কিছুটা জ্ঞানে, কিছুটা ব্যবহারিক প্রয়োজনে এবং কিছুটা অজানিতভাবে সাধিত হয়ে থাকলেও— সে-প্রয়াস নিশ্চয় বা অনড় ছিল না— তা মন্থর হলেও গতিশীল ছিল। গতিশীলতার এই প্রেক্ষিতটি গড্ডালিকা প্রবাহ অনুসরণকারী জীবন-যাপনে অভ্যস্ত জনমানসে অনুভূত হয়নি। হয়নি বলেই আজও অধিকাংশ জনমানসে বিজ্ঞান ও সত্য সমার্থকবাচক অভিধার প্রতীতি জন্ম দেয়। আমরা কলকাতার দেওয়ালে বড়ো বড়ো হরফে লিখিত লেখন দেখেছি— মার্কসবাদ সত্য— কারণ, ইহা বিজ্ঞান। যাঁরা এটা লেখেন তাঁরাও ‘সত্য’ সম্পর্কিত বিষয়টির অর্ধসত্যকেই প্রতিষ্ঠা করে। কেন-না সামাজিক সত্য কখনোই পদার্থবিদ্যা বা রসায়ণ বিদ্যার সত্যের ধ্রুবকের মতো সমপদবাচ্য হতে পারে না। তাছাড়া সত্য চির-অব্যাভিচারী বিষয়ও নয়। নিয়ত ব্যাভিচারী বলেই তার স্থিরাঙ্ক নির্ণীত হতে পারে না। আসলে সত্য সম্পর্কিত এই যে স্থাণু ধারণা— তার এইরূপ প্রেক্ষিতটি তৈরি হয়— অন্ধভাবে— হওয়ায় এবং সত্যকে একটি চরম ধ্রুবকরূপে গণ্য করার মধ্য দিয়েই। ফলে অনেক সময় আপাত সত্যকেই চূড়ান্ত সত্য বলে বিবেচনা করে বসে। এর ফলে দৃষ্টিগোচর জগতেও যেমন বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে— তেমনি আপাত দৃষ্টিগ্রাহ্য নয়— এমন ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে। দৃশ্যগ্রাহ্যতার ক্ষেত্রে ভ্রান্তি নিরসনের বিষয়টি আপাত দৃশ্যগ্রাহ্য নয়— এমন ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। বিভ্রান্তির স্থায়িত্ব যত দীর্ঘতাপ্রাপ্ত হবে তার ফলও যে তত মারাত্মক বা বিষময় হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে। শরবতওয়ালা তার কাচের জলভরা গ্লাসে ক্ষুদ্র আকারে শরবতী লেবুটিকে রেখে প্রকৃত আয়তন সম্পর্কে গ্রাহকের মনে যেরূপ ভ্রান্তির সৃষ্টি করে সে-ভ্রান্তি আপতিক; কেন-না লেবুর প্রকৃত অবস্থা ততক্ষণ পর্যন্ত সংগোপন থাকছে যতক্ষণ পর্যন্ত লেবুটি জলভরা পাত্রের মধ্যে নিমজ্জমান। জল থেকে লেবুটি তুলে ফেললেই ভ্রান্তির নিরসন ঘটে। এক্ষেত্রে আপাত দৃশ্যমানজনিত যে-বিভ্রম তা সুদূরপ্রসারী নয়। কিন্তু আজও আমাদের সমাজ জীবনে এমন কিছু বিষয় আছে, যেগুলির জন্ম পুরাতনী প্রজ্ঞার যথার্থ স্বরূপ সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল না থাকার ফলে সামাজিক জীবনে যে-বিভ্রান্তির জন্ম দিয়েছে— তার বিষফল আমরা এখনও ভোগ করে চলেছি। সেইরকম একটি সামাজিক প্রেক্ষিত এই আলোচনার প্রতিপাদ্য।

বৈদিক সমাজে শ্রেণিবিন্যাসের বর্গ বিভাজন নির্ণয় হয়েছিল শ্রম-চরিত্র অনুসারে। কালক্রমে সেই শ্রেণি বর্গবিন্যাস জাতিসত্তায় সমার্থবাচক হয়ে উঠল। প্রজ্ঞা বলে সেদিনকার সেই বর্গীকরণ হয়েছিল সেবা ও কায়িক শ্রমের নিরিখে-জন্ম সূত্রে নয়। অর্থাৎ, ব্রহ্মবিদ্যা জানা ও বোঝা ও অধী করার বোধ সম্পন্ন মস্তিষ্কই ব্রাহ্মণ পদবাচ্য বলে গণ্য হবেন। আর এই মান্যতা সমাজই তাকে দিয়েছিল— ঈশ্বর নয়। তিনি ঈশ্বর-বিকল্প প্রতিভূরূপে গণ্য হচ্ছেন একটি সামাজিক তথা রাষ্ট্রের সুরক্ষার প্রয়োজনে, ক্ষত্রিয়বর্গের— চাষবাসের তথা খাদ্য উৎপাদনের শ্রমজীবি হিসেবে বৈশ্য বর্গের যেমন প্রয়োজন হয়েছিল— তেমনই দরকার ছিল সমাজের এই তিন বর্গের জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় অন্যান্য কায়িক শ্রমনির্ভর কাজকর্মের জন্য— শূদ্র বর্গের। মনে রাখতে হবে দ্রব্য বিনিময় প্রথার মধ্য দিয়ে সমাজ তথা রাষ্ট্র তখন প্রসারমান তাই তখনও পর্যন্ত বণিক শ্রেণির উদ্ভব ঘটেনি, তাই জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণত্ব— ক্ষত্রিয়ত্ব— বৈশ্যত্ব বা শূদ্রত্ব অর্জন ঘটবে— শ্রেণি বর্গ বিভাজনের সময় এমনতর কোনো ঘোষণাই ছিল না। তাই ব্রাহ্মণের সন্তান ব্রাহ্মণই হবে— এমনতর বিধান বেদেও উল্লেখ নেই। কায়েমী চক্রের নিজ নিজ শ্রেণি-স্বার্থের তাগিদে মেধার বিষয়টি উপেক্ষা করে স্থিতাবস্থা বজায় রেখেছিলেন। ফলে যে-মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে চতুঃবর্গের সৃষ্টি হয়েছিল— তা পর্যবসিত হল জাতপাতের সংকীর্ণ জাতিবাচক শ্রেণিগোত্রে। সে-কারণে ব্রহ্মবিদ্যার লেশটুকু না থাকা সত্ত্বেও ব্রাহ্মণের সন্তান— ব্রাহ্মণের পদবাচ্য হয়ে উঠল— ঠিক তেমনিভাবে ক্ষত্রিয়— বৈশ্য— শূদ্রদের বেলাতেও সেই বাস্তব সমানভাবে সত্য হয়ে উঠল। যুগ যুগ ধরে একটি প্রজ্ঞা (wisdom)-এর বিকৃত ব্যবহারে পরম্পরাগত (Traditional) জ্ঞানে (Knonwledge) প্রকৃত বাস্তবটি আড়ালে থেকে গেল। আমরা পেলাম জাতপাতের বিন্যাসে এক অভিশপ্ত সমাজ। যেখানে জন্মসূত্রে একধরনের মানসিক পঙ্গুত্বের শিকার হল শূদ্র বর্গের নবজাতকেরা। বিশেষ করে— সেবাদাস উপশ্রেণির শূদ্রেরা। আজও তার রকমফের ঘটেনি। রামমোহন রায় পুরোহিতদের বেদকেন্দ্রিক ভণ্ডামির মুখোশটিকে ছিঁড়ে ফেলতে চেয়ে সংস্কৃত না জানা আমজনতার জন্য বেদান্ত সমূহের বাংলাতে অনুবাদ করেছিলেন— সেই ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় অলস বাঙালিকুল সেদিকে মুখ তুলে তাকায়ওনি, ফলে ব্রাত্যজনদের হাহাকার বেড়েছে বৈ কমেনি। গান্ধীজি যতই তাদের হরিজন বলে আখ্যায় বিভূষিত করুক না কেন— সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ‘মেথর’ নামক কবিতাতে তাদের যতই শুচিশুভ্র বলে গৌরবান্বিত করুক না কেন— বর্গীকরণে বিষবৃক্ষের শিকড় এত গভীরে নিমজ্জিত যে, কেবল ব্রাত্যজনের পরিবারের সদস্য হওয়ার কারণে শ্রেণিকক্ষের বাইরের দালানে বসে পড়াশোনা করতে হয়েছে ভারতের সংবিধানের জনককে।

আসলে মূল সমস্যাটিকে বৌদ্ধিক স্তরে বিবেচনা করে তার সঠিক নিরসনের নির্দ্ধারণ না করে বাইরের দিক থেকে গৌরবের প্রলেপ দেওয়ার ব্যাপারটি মারাত্মক রকমের হাস্যকর ও ক্ষতিকারক। হাস্যকর সে-কারণে গান্ধীজির ‘হরিজন’-রা ফিরে গেছে দলিত ঘরে। আর ক্ষতি? আজও আমাদের শিশুপাঠ্যে ‘সমাজবন্ধু’ শীর্ষক একটা চ্যাপ্টার আছে— যেখানে ‘কুমোর-কামার-মুচি-মেথর-ছুতোর-ঝাড়ুদার-ডোম ইত্যাদি’ শ্রেণির কাজকর্ম নিয়ে আলোচনা আছে এবং শিশুমনকে এও জানানো হচ্ছে যে, আপাত নিকৃষ্ট এইসব কাজগুলি ওইসব শ্রেণির লোকেরা করে বলেই তারা মহান। মহানত্ব প্রকাশের নমুনা এর চাইতে আর কি ভালো হতে পারে। অথচ ধরুন, কোনো একটি সরকারি স্কুলে লটারিতে এক ব্রাহ্মণের ছেলে এবং কোনো এক সাফাইকর্মীর ছেলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেলেও শ্রেণিকক্ষে যে-প্রতিস্পর্ধী সাহস নিয়ে মাস্টারমশাইয়ের প্রশ্নের উত্তর ব্রাহ্মণ ছেলেটি যেভাবে মাথা তুলে দিতে পারে— ব্রাত্যজনের পরিবারের সন্তানটি ঠিক সেইভাবে মাথা তুলতে পারে না। পারে না অনেক সময় শিক্ষকদের কারণেও। কেন-না বহুকাল আগেই সমাজ তার মাথা নত করে দিয়েছে। এই নত করার পেছনে এক সচেষ্ট ভ্রান্তি আছে। যে-ভ্রান্তির জন্ম হয়েছিল wisdom-এর হাত ধরে। যে-wisdom আজ পোক্ত ও পুরাতন আর Traditional Knowledge তার ধারক ও বাহক। তাই wisdom মাত্রই চূড়ান্ত অভ্রান্ত এমনটা নাও হতে পারে— আবার সেই wisdom, traditional knowledge দ্বারা যুগ যুগ ধরে অনুশীলিত হলেও তা অভ্রান্ত না-ও হতে পারে। শবকে কাঁধে বহন করা হয় সৎকারের উদ্দেশ্যে, কিন্তু বহু যুগ ধরে আমরা জাতপাতের যে-শবকে কাঁধে বয়ে নিয়ে চলেছি তার সৎকার কবে হবে কে জানে। আর তাই তো আমার দাদু কিংবা রহমত মিঞার traditional knowledge-টি বেশ পাকাপোক্তভাবেই বেঁচে বর্তে থাকে— যুগ যুগ ধরে।

Categories
2021-May-Essay প্রবন্ধ

সোমা মুখোপাধ্যায়

বাংলার পুতুল ও লোকপ্রযুক্তি

বাংলার পুতুল নিয়ে অনেকেই গবেষণালব্ধ সুন্দর কাজ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছেন তারাপদ সাঁতরা, আশিস বশু থেকে সাম্প্রতিক সময়ের বিধান বিশ্বাসের মতো নামিদামি মানুষেরা। পুতুল নিয়ে বই লিখতে গিয়ে আর শিল্পীদের জীবনচর্চা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে লক্ষ করেছি এই পুতুলের মধ্যেই রয়েছে বাংলার লোক প্রযুক্তির এক মূল্যবান দলিল যা অন্তঃসলিলা ফল্গুধারার মতোই এক যুগ থেকে অন্য যুগে প্রবাহিত হয়েছে।

আগুনের ব্যবহার থেকেই মানুষের প্রযুক্তিগত পরিবর্তন শুরু হয়। একসময় অরণ্যচারী যাযাবর মানুষ কৃষি আবিষ্কার করে স্থায়ী বসতি বিস্তার করে। বাংলার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ছিল না। পাণ্ডুরাজার ঢিপি থেকে আবিষ্কৃত খৃপূ আনুমানিক ১২০০ অব্দের মাটির টেপা পুতুল আর একসার জালবন্দি মাছ ও মুখে সাপ ধরা ময়ূরের চিত্রায়িত মাটির তৈজসপত্রের ভাঙা টুকরো থেকেই প্রমাণ হয় যে, সেই সময় এই অঞ্চলে মনুষ্য বসতি গড়ে উঠেছিল।

চাষের সঙ্গে বাসের যে একটা সম্পর্ক তা সমাজবিজ্ঞানীরা গবেষণায় দেখিয়েছেন। অর্থাৎ, মানুষ যাযাবর জীবন থেকে চাষের বা কৃষিকাজের মাধ্যমেই স্থায়ী জীবনে থিতু হয়ে বসে। নিপুণ হাতে গড়ে তার গৃহস্থালী আর সেই গৃহস্থালির নানা কিছু বা চারপাশটাকে সুন্দর করে তোলে তার নান্দনিক ভাবনার দ্বারা। নব্য প্রস্তর যুগ থেকেই মানুষের মনে কৃষি কাজের সঙ্গে সঙ্গে এই নান্দনিক ভাবনার আগমন হয়েছিল এ-কথা জানা যায় ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের মতো বিশিষ্ট গবেষকদের রচনায়। মানুষ তার জীবনের তাগিদে নানা প্রযুক্তিকে নিজের মতো করে আবিষ্কার করতে শুরু করেছিল। ঠিক যেমন অরণ্যচারী মানুষ শিকারের তাগিদে পাথরের হাতিয়ার বানিয়েছিল আর কৃষিকার্যের ফলে মানুষ তার কৃষিকাজের নানা সরঞ্জামের সঙ্গে সঙ্গে ঘর-গৃহস্থলির নানারকম সরঞ্জাম তৈরির জন্য নানা প্রযুক্তির আবিষ্কার করেছিল। তেমনি তার নান্দনিক ভাবনার ক্ষেত্রেও এই প্রযুক্তি অদ্ভুতভাবে ব্যবহৃত হয়েছিল।

কৃষিজীবী মানুষ তার ঘর গৃহস্থালীকে সাজাতে প্রথমে এই নান্দনিক ভাবনার রূপায়ণ করেছিল ছবি আঁকার মধ্যে দিয়ে। এরই সঙ্গে সমান্তরালভাবে প্রবাহিত হয়েছিল ধর্মাচরণ যেখানে বিভিন্ন ব্রত কথাতে আলপনা তার মনোভাবকে ফুটিয়ে তুলেছিল। প্রকৃতির চারপাশের বিভিন্ন উপাদান ছিল তার এই ভাবনার মূল বিষয়। এর পর এসেছিল নিজের অবয়বকে ফুটিয়ে তোলার প্রচেষ্টা। মানুষ তার নিজের অবয়বকে ফুটিয়েছে ব্রত আলপনার বিভিন্ন রেখার মাধ্যমে। দশ‌ পুতুল ব্রতের আলপনায় বা সেঁজুতি ব্রতের আলপনায় কয়েকটি রেখার মাধ্যমে মনুষ্য শরীরের একটা অবয়ব আমরা দেখি। এর থেকেই ধীরে ধীরে তা মাটির পুতুলের মাধ্যমে একটা মূর্তির রূপ নিতে পেরেছিল।

একখণ্ড নরম মাটির তাল থেকে হাতের সাহায্যে টিপে টিপে প্রথমে মাতৃকা মূর্তি রচনা করেছিল মানুষ। এই মাতৃকামূর্তিগুলোর শুধু বাংলায় নয় সারা পৃথিবীতেই বহু বছর ধরেই খোঁজ পাওয়া যায়। লক্ষ করলে দেখা যায় প্রথমে এগুলোর কোনো চোখ নাক মুখ ছিল না। প্রকটিত স্ত্রীঅঙ্গ, অর্ধ সমাপ্ত দু-টি হাতের অংশ আর নীচের অংশটা বসানোর জন্য একটু ঘাগড়ার মতন করা। এরপর কাঠি দিয়ে তাতে অলংকরণ করা হয়েছিল। পেছনে থাকত একটা খোঁপার মতো বস্তু আরও পরে দু-টি ছোট্ট মাটির অংশ দিয়ে তৈরি হয়েছিল চোখ। হাতের ওপর জুড়ে দেওয়া হয়েছিল বা কোলে দেওয়া হত ছোটো ছোটো একইরকম প্রতিকৃতি যা তার শিশু বলে মনে করা হত। সারা বাংলার নানা জায়গাতেই এই মাটির টেপা পুতুল তৈরি হতে দেখা যায়।

কিন্তু কাঁচা মাটি তো বেশি দিন স্থায়ী হয় না। তাই মানুষই আবিষ্কার করেছিল তাকে আগুনে পুড়িয়ে শক্ত করতে। প্রথমে এখনকার কুমোরদের যে-ভাটি বা পোন‌ বলি তা ছিল না। একটা ছোটো জায়গায় বিভিন্ন জ্বালানির মধ্যে দিয়ে এই পুতুলগুলো পোড়ানো হত। এখনও পশ্চিম মেদিনীপুরে পটুয়ারা ছোটো মালশায় বিভিন্ন জ্বালানি খরকুটো ও তুষের আগুনে এই পুতুলগুলো পোড়ান। এছাড়াও প্রত্যন্ত গ্ৰামাঞ্চলে অনেক গৃহস্থবাড়িতে নাতি-নাতনিদের জন্য মা ঠাকুরমারা রান্না শেষে পরন্ত উনুনের আঁচে এই মাটির পুতুল পুড়িয়ে থাকেন। মানুষ নিজেই নিজের নান্দনিক ভাবনাকে যথাযথ রূপ দেয়ার জন্য নিজের মতো করে তার প্রযুক্তিগত কৌশল আবিষ্কার করেছিল এ-কথা বলা যেতে পারে।

টেপা পুতুলগুলো হাতে করে করতে অনেক সময় লাগত। তাই একটা সময় পর দেখা যায় যে, কীভাবে একইসঙ্গে অনেকগুলো পুতুল তৈরি করা যেতে পারে। সেই ভাবনার প্রতিফলনে তৈরি হয়েছিল মাটির ছাঁচ। প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননে এমন ছাঁচের সন্ধান মিলেছে। প্রথমে একখোল পরে দু-খোল ছাঁচে এই পুতুল তৈরি এখনও পর্যন্ত দেখতে পাওয়া যায় বিভিন্ন কুমোরপাড়ায় বা কুমোরপরিবারের বাড়িগুলোতে গেলে।

সংখ্যায় যখন অধিক এই পুতুলগুলো তৈরি হতে থাকে তখন কুমোররা আর ছোটোখাটো জায়গায় তাদের পোড়ানোর জন্য রেখে দিত না। মাটির অন্যান্য সরঞ্জাম পোড়ানোর জন্য যে-ভাটি ব্যবহার করা হয় সেখানে এই পুতুলগুলোকে পোড়ানোর প্রচলন হতে থাকে। এতে একসঙ্গে অনেক পুতুল অল্প সময়ের মধ্যে তৈরি করা যায়। পূর্ব মেদিনীপুরের পটুয়াদের মধ্যে এইরকম ছাঁচের পুতুল দেখা যায়। আবার হাওড়ার নরেন্দ্রপুর এর রানী পুতুল বা বিভিন্ন দেবদেবীর যে-পুতুল সেগুলো এই একখোল ছাঁচে তৈরি হয়। অনেক পুতুলে চাকের ব্যবহার দেখা যায়। যেমন এখনও উত্তর দিনাজপুরের কুনুরে রাজবংশী মেয়েরা যে-ষষ্ঠী পুতুল করেন তার নীচের অংশটা তৈরি হয় তাকে বাকিটা হাত দিয়ে।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও অনেক প্রযুক্তির ছাপ পড়ে এই পুতুল নির্মাণে একইসঙ্গে হাত, চাক আর ছাঁচের ব্যবহারে সুন্দর নান্দনিক পুতুল তৈরি দেখা যায় পশ্চিম মেদিনীপুরের মির্জা বাজারে দেওয়ালি পুতুলের ক্ষেত্রে। পুতুলের মুখ আর দেহের নীচের অংশটা তৈরি হয় চাকে, মুখটা ছাঁচে আর বাকি অংশটা এবং চক্রাকারে লাগানো প্রদীপ সবটাই তৈরি হয় হাতে। মুর্শিদাবাদের কাঁঠালিয়ার পুতুল এই একই পদ্ধতিতে তৈরি হয়।

এবার আসা যাক পুতুলের রঙের প্রসঙ্গে। মানুষ দীর্ঘদিন কিন্তু বিবর্ণ পুতুল তার খেলার সামগ্রী হোক বা পুজোর উপকরণ তা দেখতে পছন্দ করেনি। সেই কারণেই ভেষজে রঙে রাঙিয়ে নিতে শুরু করে এই মাটির পুতুল। আতপ চালের গুঁড়ো দিয়ে সাদা রং, শিম পাতা থেকে সবুজ, হাঁড়ির ভুসো থেকে কালো তেলাকুচ ফল থেকে লাল, হলুদ বেটে হলদে এমন সমস্ত রং দিয়ে পুতুলকে রাঙাতে থাকেন শিল্পী। তবে এরও একটা পদ্ধতি আছে। খড়িমাটির সঙ্গে তেতুল বিচির আঠা মিশিয়ে তার একটা প্রলেপ দেওয়া হয় প্রথমে। তারপর তাতে এই রংগুলো ধরানো হয়। বর্তমানে অবশ্য অনেকেই বাজারি রং ব্যবহার করে থাকেন, কারণ, ভেষজ রং দীর্ঘস্থায়ী হয় না।

তবে একেবারে প্রাথমিক দিকে এই পুতুলের রংটা কেমন ছিল তা বোঝা যায় কাঠালিয়ার পুতুলের ক্ষেত্রে। এখানে মূলত তিনটি প্রাথমিক রং লাল সাদা কালো এই দিয়েই পুতুলকে রাঙিয়ে নেন শিল্পী দুধের সঙ্গে মাটি মিশিয়ে তাকে মোলায়েম করা হয় আর সাদা রঙের সঙ্গে অভ্র দিয়ে তার একটা চকচকে ভাব আনা হয়। ডোরাকাটা অলংকরণ যা পৃথিবীর সর্বত্রই একেবারে প্রাথমিক অলংকরণ হিসেবে আমরা জানি তা এই কাঁঠালিয়ার পুতুলেও দেখা যায়। একসময় বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের একেবারে পারদ এর খনিজ হিঙ্গুল নামের এক লাল পদার্থ মেশা মাটি দিয়ে পুতুল তৈরি হত সেই পুতুল পুতুল যদিও এখন তাতে নানা রঙের ব্যবহার হতে দেখা যায়।

এর পাশাপাশি শুধু মাটির রংকে মজবুত করে তাকে পুরোপুরি পুতুল তৈরি চল রয়েছে বাঁকুড়া জেলার পাঁচমুড়া-সহ বিবরদা উলিয়ারা আর নানা জায়গায়। এইখানে এক বিশেষ বনক রং তৈরি করেন শিল্পী। জঙ্গল থেকে আনা বিশেষ মাটি থেকে এক পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে এই হলুদ রং তৈরি হয়। পুতুলের অবয়ব কাঁচা মাটিতে তৈরি করে তার ওপরে এই বনক লাগিয়ে রোদে শুকিয়ে ভাটিতে পোড়ালে এক অদ্ভুত চকচকে রং ধারণ করে পুতুলগুলো। শিল্পী নিজেই এক আবিষ্কারে এই ভাটির ধোঁয়া বেরোনোর জায়গাটি বন্ধ করে দিয়ে তৈরি করেন কালো রঙের মাটির পুতুল। পাঁচমুড়ার ঘোড়া ষষ্ঠী পুতুল-সহ বর্তমানে আরও নানারকম পুতুল বিশ্বের বাজারেও বাংলার মুখ উজ্জ্বল করে চলেছে। যদিও আশপাশের পূর্বোল্লিখিত কেন্দ্রগুলোতেও ওই একইরকমভাবে এইসব পুতুল তৈরি হয়। পাঁচমুড়ায় বিশাল বিশাল ভাটিতে যৌথভাবে কুমোররা তাদের সমস্ত মাটির পুতুলগুলো একসঙ্গে পুড়িয়ে থাকেন। অর্থাৎ এটি যে একসময় গ্রামীণ কৌম জীবনের যৌথ প্রযুক্তি ছিল তা বলতে আর দ্বিধা বোধ হয় না।

ডোকরা

মাটির পুতুলের পাশাপাশি শিশুদের মনোরঞ্জনের জন্য ধীরে ধীরে আরও অনেক মাধ্যমে পুতুল তৈরি হয় যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল তালপাতার সেপাই। তালপাতা কেটে তাকে মানুষের আকৃতি বা পশুপাখির আকৃতি দিয়ে সুতা দিয়ে সেলাই করে একটা বাঁশের কঞ্চিতে এমনভাবে আটকে দেয়া হয় যাতে কঞ্চিটি নাড়ালেই সেই পুতুলটির হাত পা ছুঁড়তে থাকে। এছাড়া মাটির মূল অবয়বের ওপর ধাতুর ঢালাই করে তৈরি হয় ডোকরা শিল্প। যদিও তার খুবই জটিল মাধ্যম তবুও একেবারে খাঁটি লোকায়ত প্রযুক্তিতে তা তৈরি হয়। পুরোনো কাপড় দিয়ে তার ভেতরে পুরে সুঁচ সুতো দিয়ে সেলাই করে মা দিদি মায়েরা অবসরে বানাতেন কাপড়ের পুতুল। তোমার নেট তাকেই আধুনিকভাবে রূপ দান করা হয়। তেমনি পূর্ব মেদিনীপুরের দীঘা অঞ্চলে সমুদ্র ধার থেকে কুড়িয়ে পাওয়া ঝিনুককে বাক্যটিকে আঠা দিয়ে জুরে তাতে সামান্য বাজারি রং লাগিয়ে সুন্দর পুতুল তৈরি করেন ওইসব অঞ্চলের শিল্পীরা।

মাটির পরেই নমনীয় মাধ্যম হল কাঠ। এই কাঠ দিয়েও কিন্তু বাংলার নানা অঞ্চলের শিল্পীরা সুন্দর পুতুল তৈরি করে থাকেন বর্ধমানের নতুনগ্রাম কাঠের গৌরনিতাই রাজা-রানি পুতুলের জন্য বিশ্ববিখ্যাত তেমনি হাওড়া তো একসময় থোরের রস পড়ে এইরকম পুতুল হত। পুরুলিয়া বাঁকুড়া প্রতি জেলাতে আঞ্চলিকভাবে বিভিন্ন উৎসবে এই কাঠের পুতুলের সন্ধান মেলে। খুব সামান্য যন্ত্রের মাধ্যমে এই পুতুলগুলো তৈরি করেন শিল্পীরা আর একসময় ভেশজ রং ব্যবহার হত তাকে রাঙানোর জন্য পরে এসেছে বাজারি রং।

পুতুল নির্মাণশৈলীর প্রযুক্তি যদি লক্ষ করা যায় তাহলে সেখানে যুগের ক্রমবিবর্তন আমরা লক্ষ করতে পারি কীভাবে মানুষ নিজের জীবনযাপনের মান উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে তা তার ব্যবহারিক জীবনেও কাজে লাগিয়েছে তা এই পুতুলগুলো বিবর্তনের মধ্য দিয়ে পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে। বিষয়ে বৃষ্টিতেও গবেষণায় ভবিষ্যতে আরও অনেক তথ্যই সামনে নিয়ে আসতে পারবে।

তথ্যসূত্র:
১। তারাপদ সাঁতরা, পশ্চিমবঙ্গের লোকশিল্প ও শিল্পীসমাজ, লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র কলকাতা ২০০২।
২। সোমা মুখোপাধ্যায়, বাংলার পুতুল, প্রতিক্ষণ, কলকাতা, ২০১৮।

Categories
2021-May-Essay প্রবন্ধ

অনিন্দ্য রায়

জাপানি কবিতার কয়েকটি ফর্ম

হাইকু
(Haiku)

ধ্রুপদী জাপানি কবিতা হাইকু।

তিনটি পর্বে রচিত এই কবিতা, পর্বগুলির মাত্রাসংখ্যা যথাক্রমে ৫, ৭ ও ৫ (মোট ১৭) ‘অন’। অন হল জাপানি ধ্বনি-একক, Mora বা ‘কলা’-র সমতুল্য।

জাপানে পরম্পরাগতভাবে একটি উল্লম্ব পঙ্ক্তিতে হাইকু লেখার রীতিই স্বীকৃত। ইংরেজি ও অন্য ভাষায় তিন লাইনের হাইকু লেখার চল দেখা যায়, মাত্রাগণনায় কলা-র বদলে কেউ কেউ ব্যবহার করেন ৫-৭-৫ ‘দল’ (Syllable)।

কোনো দৃশ্য, যা আমাদের চেতনায় মূহূর্তে উদ্ভাসিত করে সত্যকে, প্রণোদিত করে হাইকুকে। হাইকু-মুহূর্তই এই হ্রস্বকবিতার প্রাণ, স্বল্প উচারণে প্রকৃতির দু-টি ছবির কাব্যিক প্রকাশে তা ফুটে ওঠে। ছবিদুটো জোড়া থাকে ‘কিরেজি’ দিয়ে; কিরেজিকে বলা যায় ছেদশব্দ, তা ছবিদুটোর ভেতর সমান্তরাল-ভাব বা জাক্সটাপজিশন তৈরি করে। হাইকুর অপরিহার্য অংশ হল কিরেজি; আর একটি ‘কিগো’। কিগো হল ঋতু-সম্পর্কিত শব্দ, যা নেওয়া হয় ‘সাইজিকি’ বা কিগো-অভিধান থেকে।হাইকুতে একটি কিগো থাকবেই।

হাইকুতে সাধারণত থাকে না কোনো মানুষের কথা, মানবিক ক্রিয়াকর্মের বিষয়। পরম্পরাগত জাপানি হাইকুতে থাকে না কোনো যতিচিহ্ন, অন্ত্যমিল, রূপক, চিত্রকল্প বা অন্য কোনো অলংকার। শুধু প্রকৃতির দু-টি ছবি আর তাদের অন্তর্গত অভিঘাতে জন্ম-নেওয়া বোধ— এই হল হাইকু।

হাইকু তাই ঋতুর কবিতা, প্রকৃতির কবিতা, মুহূর্তের কবিতা, সত্যের কবিতা। জেন ধর্মবিশ্বাস ও যাপনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক এর। গুরুত্বপূর্ণ হাইকুকাররা এই ধর্মাবলম্বী।

জাপানি কবিতা ‘রেঙ্গা’-র প্রারম্ভিক স্তবক ‘হোক্কু’-র থেকে এর জন্ম। মাসাওকা সিকি (১৮৬৭খ্রিস্টাব্দ-১৯০২ খ্রিস্টাব্দ) এই আঙ্গিকের হাইকু নামটি দেন। মাৎসুও বাসো (১৬৪৪ খ্রিস্টাব্দ-১৬৯৪ খ্রিস্টাব্দ), ইয়োসা বুসান (১৭১৬ খ্রিস্টাব্দ-১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দ), কোবায়াসি ইসা (১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দ-১৮২৮ খ্রিস্টাব্দ) ও সিকি-কে শ্রেষ্ঠ হাইকুকার হিসেবে গণ্য করা হয়। হাইকু লিখেছেন অজস্র কবি, লেখা হয়েছে অসংখ্য তিন-পর্বের আলোকিত শব্দসুষমা।

আমাদের সঙ্গে এই আঙ্গিকের পরিচয় করান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১ খ্রিস্টাব্দ-১৯৪১ খ্রিস্টাব্দ)। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে জাপান ভ্রমণকালে তিনি এর সম্পর্কে আগ্রহী হন এবং ‘জাপানযাত্রী’ (১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ) গ্রন্থে এর সম্পর্কে লেখেন, সঙ্গে বাসোর দু-টি হাইকুর অনুবাদ:

পুরোনো পুকুর,
ব্যাঙের লাফ,
জলের শব্দ।

এবং

পচা ডাল,
একটা কাক,
শরৎকাল।

বিশ্বকবি অবশ্য এই লেখাগুলিকে ‘হাইকু’ না, ‘তিন লাইনের কাব্য’ বলে উল্লেখ করেছেন।

বাংলা হাইকুর প্রথম বই সুরেন্দ্রনাথ মৈত্র-এর ‘জাপানী ঝিনুক’ (১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দ)। বাংলা ভাষায় হাইকুচর্চার যথেষ্ট সমৃদ্ধ। নানা কবি লিখেছেন নানা সময়ে। সবক্ষেত্রে যে হাইকুর নিয়মবিধি ঠিকঠাক পালিত হয়েছে এমন নয়।

তবে বাংলাতে নিয়মনিষ্ঠ হাইকুও আমরা পাই:

মাতাল চাঁদ
নিশার দারোয়ান
দাঁতাল শীত
(মুজিব মেহদী)

হাইকুকে বাংলা ভাষার উপযোগী করে মুজিব মেহদী (১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দ- ) ‘বাইকু’ ফর্মটি তৈরি করেছেন। তাঁর লেখা:

বাগানে ভর্তি হলাম পাখিদের ক্লাসে
শিখছি পাতা কাঁপানো ও ফুল ফোটানো
এখনো অনেক দূরে পাতাঝরা দিন
(বাইকুসহায়/৪৯)

বাংলা হাইকু বা বাইকু তিন লাইনের কবিতা, কিন্তু কাঠামোগতভাবে মুক্ত, অর্থাৎ, কলাবৃত্তে ৫-৭-৫ রীতির অনুসারী নয়; এটি মুক্তক হাইকু হিসেবেও বিবেচিত হতে পারে।

সারা পৃথিবীর কবিরাই মেতেছেন হাইকুর সৌব্দর্যে। হাইকু থকে জন্ম নিয়েছে আরও নানা ফর্ম। বিষয়ের দিক থেকেও হাইকু এখন অনেক বেশি প্রসারিত ও মানবিক।

হাইবুন
(Haibun)

সম্মিলিত গদ্য আর কবিতার একটি ফর্ম হাইবুন। এর জন্ম জাপানে। প্রথমে থাকে গদ্যটি, যা হতে পারে ভ্রমণকথা, দিনপঞ্জি, আত্মজীবনী, নিবন্ধ, গদ্যকবিতা— এইরকম কিছু। আর তার পরে থাকে একটি হাইকু।

১৬৯০ খ্রিস্টাব্দে মাৎসুও বাসো (১৬৪৪ খ্রিস্টাব্দ-১৬৮৪ খ্রিস্টাব্দ) তাঁর শিষ্য কোরাই-কে লেখা একটি চিঠিতে হাইবুন শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন। বাসোর ‘গভীর উত্তরের দংকীর্ণ পথ’ (ওকু নো হোসোমচি) বইতে আমরা বেশ কিছু হাইবুন পাই। তা থেকে:

নাতোরি নদী পেরিয়ে আমরা পৌঁছে গিয়েছিলাম সেন্দাই-তে। সেই সময়ে তো লোকজন ঘরের চালের নীচে নীল আইরিশ টাঙিয়ে রাখে। একটা সরাইখানা খুঁজে নিয়ে কাটিয়েছিলাম চারপাঁচটা দিন।
কিমোন নামে এক আঁকিয়ে থাকত শহরটায়। তাঁর নিখাদ শিল্পবোধের ব্যাপারে শুনেছিলাম, আলাপও হল। কবিতায় উল্লেখিত জায়গাগুলোর খোঁজে তিনি অনেকগুলো বছর ঘুরে বেড়িয়েছেন, বলেছিলেন আমাকে। সে সব ঠিকঠাক চিনতে পারা বেশ কঠিন। একদিন আমাদের নিয়ে গেলেন তেমনই কিছু জায়গা দেখাতে। ক্লোভারের ঝোপে ভরা মিয়াগিনো-র মাঠ; ভাবলাম, শরতে দেখতে কেমন হবে। তখন তো তামাদা, ইয়োকোনো, সুৎসুজি-গা-ওকা-র চারপাশে পিয়েরিসের ফুল। আমরা গেলাম এক পাইনবনের ভেতর দিয়ে, এত ঘন যে সূর্যের আলো একদমই ঢুকতে পারে না। নাম জানলাম, কোনোসিতা [গাছের তলা]। শিশির এখানে বহুকাল থেকেই পুরু খুব, একটি কবিতায় ভৃত্য তার মনিবকে বলছে, খড়ের টুপি নেওয়ার কথা। দিন শেষ হওয়ার আগে ইয়াকুসিদো আর তেনজিনের মঠে প্রার্থনা করলাম আমরা।

আসার সময় কিমোন আমদের মাৎসুসিমা, সিওগামা আর স্থানীয় কিছু জায়গার স্কেচ উপহার দিলেন। আর দিলেন ঘন আইরিশ-নীল ফিতেওলা দু-জোড়া খড়ের চটি। এই সব উপহার থেকেই বোঝা যায়, একজন মানুষের রুচি কতটা সমৃদ্ধ।

পায়ে বেঁধেছি
আইরিশের ফুল—
চটির ফিতে

পরবর্তীতে উল্লেখযোগ্য হাইবুন লিখেছেন ইয়োসা বুসোন, কোবায়াশি ইসা, মাসাউকা সিকি প্রমুখেরা।

জাপানের বাইরেও হাইবুনের চর্চা আমরা দেখতে পাই। আমেরিকান কবিজেমস মেরিল (১৯২৬ খ্রিস্টাব্দ-১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দ)-এর ‘অন্তরের স্থান’ (The Inner Room)-এর ‘প্রস্থানের গদ্য’ (Prose to Departure) প্রথম দিকের ইংরেজি হাইবুনের একটি উদাহরণ।

বাংলাতেও সম্প্রতি আমরা হাইবুন নিয়ে উৎসাহ দেখতে পাচ্ছি।

সেনরু
(Senryu)

৫-৭-৫-এর আর একটি জাপানি কবিতার ফর্ম সেনরু। হাইকুর মতো মাত্রাগঠন হলেও সেনরু হাইকু থেকে আলাদা।

হাইকুর মতো কিরেজি (ছেদ-শব্দ) ও কিগো (ঋতুগত শব্দ) থাকে না এতে।

হাইকুর বিষয় প্রকৃতি, মানুষ স্থান পায় না।

সেনরু মানুষের কথা নিয়েই, বলা যায় ‘মানবিক হাইকু’। মনুষ্যচরিত্রের অসংগতি এখানে উপজীব্য।

হাইকুর প্রশান্তি, গাম্ভীর্য থাকে না সেনরুতে। বরং স্থূল রসিকতা লেখা হয় তির্যক ভঙ্গিতে।

কারাই হাচিমন (১৭১৮ খ্রিস্টাব্দ-১৭৯০ খ্রিস্টাব্দ, ছদ্মনাম সেনরু, কারাই সেনরু নামেও পরিচিত) এইরকম হাস্যরস আর বিদ্রুপাত্মক ছোটো কবিতাগুলির সংকলন ‘হাইফুইয়ানাগিদারু’ প্রকাশ করেন যা সে সময়ে দারুণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে সেনরু ও অন্য সম্পাদকেরা বুঝতে পেরেছিলেন যে, ধ্রুপদী হাইকু আর পাঠকের মন ভোলাতে পারছে না, মানবিক ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে একটু মজার কবিতা হিসেবে সেনরু পাঠকের কাছে সমাদৃত হয়।

কারাই সেনরু-র সংকলন থেকে একটি সেনরু:

ধরেছি যাকে
ডাকাত ভেবে এ কী
খোকা আমার

হাইকুর মতো বিষয় ও উপস্থনা নিয়ে নিয়মের নিগড় নেই এতে, ছন্দকাঠামো মেনে অনেকটা উন্মুক্ত মনে এই ধারায় পৃথিবীর নানা ভাষার কবিরা লিখে চলেছেন। এবং এই ধারাটি আজ যথেষ্টই জনপ্রিয়।

বাংলাতেও সেনরু লেখা হয়েছে এবং হচ্ছে। স্বল্প কথায় শাণিত বিদ্রূপে এই ফর্ম বাংলা কাব্যজগতে বেশ মানিয়ে যায়।

নাটক শেষ
মৃত সৈনিকটি
শুয়েই আছে

বা

ভাজা মাছটি
উলটে খেয়ে নেয়
ভেজা বেড়াল

কাতাউতা
(Katauta)

জাপানি কবিতার আর একটি ফর্ম কাতাউতা, তিন পর্বে রচিত, পর্বগুলির মাত্রাবিন্যাস ৫-৭-৫ অন; কখনো ৫-৭-৭ অনেও লেখা হয়েছে এই কবিতা।

কাতাউতা প্রেমের কবিতা, প্রিয়জনের উদ্দেশে লেখা, অন্ত্যমিলহীন।

ওঠো, ও প্রেম
ঘৃণার ঢেউ থেকে
না রবে বিছানাতে?

অষ্টম শতাব্দীর পর থেকে এই ফর্মের ব্যবহার বিরল। সম্প্রতি নানা ভাষায় নতুন করে এর চর্চা লক্ষ করা যাচ্ছে।

বাংলাতেও প্রেমের অনুকবিতা হিসেবে এই ফর্ম গৃহীত হতে পারে:

চোখের জলে
শেষ হয় না নুন
সাগর তোমার কে?

কাতাউতাকে বলা হয় ‘অর্ধেক কবিতা’, পরপর দু-টি কাতাউতা মিলে তৈরি হয় সেদোকা।

সেদোকা
(Sedoka)

সেদোকা দু-টি কাতাউতার সমষ্টি। মাত্রাবিন্যাস ৫-৭-৭-৫-৭-৭। সাধারণত অন্ত্যমিল থাকে না। প্রথম তিন লাইনে একটি দৃশ্য বর্ণিত হয় আর পরের তিন লাইনে অন্য প্রেক্ষিত থেকে দেখা হয় দৃশ্যটিকে। দু-টি অংশের মধ্যে একটি শাণিত ছেদ থাকে আর অংশদুটো স্বতন্ত্র কবিতা হিসেবে পড়া যায়। কখনো তা সংলাপধর্মী, প্রথম অংশে প্রশ্ন, উত্তর পরে।

একে ‘শীর্ষ-পুনরাবৃত্তির কবিতা’ও বলা হয়।

জাপানি কবি কাকিনোমোতো নো হিতোমারো (৬৬২ খ্রিস্টাব্দ-৭০৮ বা ৭১০ খ্রিস্টাব্দ) তাঁর সেদোকাগুলির জন্য খ্যাত।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘ছন্দ’ বইয়ের ‘সম্পূরণ’ অংশে বলেছেন সেদোকার বিষয়ে, আছে একটি উদাহরণও:

সাগরতীরে
শোণিত-মেঘে হল
নিশীথ অবসান
পুবের পাখি
পূরব মহিমারে
শুনায় জয়গান

অন্ত্যমিল আছে। আর সে-বিষয়ে কবিগুরুর মন্তব্য, “বাঙালি পাঠকের অভ্যাসের প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া নিজের অনুকৃতিগুলির মধ্যে একটু মিলের আভাস রাখা গেছে।”

অষ্টম শতাব্দীর জাপানি কাব্যসঞ্চয়ন ‘মানিওশু’-তে কাতাউতা-র দেখা মেলে। পরবর্তীতে এর চর্চা প্রায় বিলোপ পায়। ছয় লাইনে, তিন-তিন দুই স্তবকে, মোট ৩৮ মাত্রায় (৫-৭-৭-৫-৭-৭) সেদোকা লেখার প্রয়াস ইদানীং দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন ভাষায়।

এর সৌন্দর্য বাংলা ভাষাতেও ফুটে উঠতে পারে:

এক শেয়াল
গোধূলির উঠোন
পেরিয়ে গেল ছুটে

বোঝা গেল না
সেইদিকে খাবার
না পেছনে খাদক

মনদো
(Mondo)

আর একটি জাপানি ফর্ম মনদো।

জেন ধর্মানুশীলন থেকে এর উৎপত্তি। লেখা হয় দু-টি তিন লাইনের স্তবকে।

প্রথম স্তবকে প্রশ্ন, উত্তর পরেরটিতে। মত্রাবিন্যাস ৫-৭-৭-৫-৭-৭ অন, বা কখনো ৫-৭-৫-৫৭-৫ অন।

সাধারণত দু-জন কবি লেখেন একটি একটি করে স্তবক।

সংলাপমূলক কবিতা হিসেবে বাংলায় এর ব্যবহার আমরা আশা করতে পারি।

মেঘ তো কালো
বৃষ্টিফোঁটা কেন
এমন ধবধবে?

মাটির দিকে
যা কিছু নেমে আসে
বাড়তি ঝেড়ে ফেলে

তনকা
(Tanka)

পরম্পরাগত জাপানি কবিতা আর একটি ফর্ম ‘তনকা’-র পাঁচটি পর্ব লেখা হয় যথাক্রমে ৫-৭-৫-৭-৭ অন মাত্রাবিন্যাসে। অনুবাদে, জাপানি ছাড়া অন্য ভাষায় পাঁচটি লাইনে প্রকাশিত হয় তনকা। ওপরের ৫-৭-৫-এর অংশটিকে বলা হয় ‘কামি-নো-কু’ আর নীচের ৭-৭-এর অংশটিকে ‘সিমো-নো-কু’।

মনিওশু-তে দীর্ঘ কবিতাকে চোকা আর হ্রস্ব কবিতাকে তনকা বলা হত। পরবর্তীতে সাধারণভাবে হ্রস্ব কবিতাকে ‘ওয়াকা’ বলা শুরু হয়।

বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে জাপানি কবি মাসাওকা সিকি (১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দ-১৯০২ খ্রিস্টাব্দ) তনকা সম্পর্কিত ধারণার পুনর্মূল্যায়ণ করেন।

সিকির লেখা:

সেই লোকটি
মুকুরে হত দেখা
আর সে নেই
নষ্ট মুখ দেখি
অশ্রু ঝরে যায়

তাকুবোকু ইসিকায়া (১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দ-১৯১২ খ্রিস্টাব্দ)-র লেখা একটি তনকা:

পুব সাগরে
ছোট্ট এক দ্বীপে
সাদা বালিতে
অশ্রুভেজা মুখে
খেলি কাঁকড়া নিয়ে

বাংলা তনকাচর্চাও আমরা লক্ষ করছি বেশ কিছুদিন। তা লেখা হয় পাঁচ পঙ্‌ক্তিতে, পর্বের চরিত্র বজায় রেখে।

হাসির মাঝে
একটু করে থামি
আর দম নি’
নীরবতার ফাঁকে
কান্নাকে লুকোই

সমনকা
(Somonka)

জাপানি কবিতার আরেকটি ফর্ম সমনকা। দু-টি তনকা নিয়ে রচিত হয় সমনকা।

সমনকায় তনকাদুটোর কেন্দ্রীয় ভাবনা প্রেম আর তা লেখা হয় প্রেমিক-প্রেমিকাদের কথোপকথনের চালে, প্রথমটির যে-বক্তব্য তার প্রতক্রিয়া থাকে দ্বিতিয়টিতে। নরনারীর প্রেম ছাড়াও অন্য সম্পর্কভাবনায় এই শৈলীর কবিতা পাওয়া যায়।

এতে শিরোনাম থাকে, অন্ত্যমিল থাকে না। দু-জন কবি মিলে একটি সমনকা লেখেন।

ফর্মটি বেশ পুরোনো, খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে রচিত সমনকার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।

৭০০ খিস্টাব্দের আশেপাশে মিকাতো নো সামি ও তাঁর স্ত্রীর রচিত একটি সমনকা:

বাঁধো, শিথিল
না বাঁধলে দীর্ঘ
প্রিয়ার চুল
দেখি না আজকাল
বেঁধে রেখেছে সে কি?

বলে সবাই
এমন লম্বা যে
বাঁধাই ভালো
যেটুকু দেখো তুমি
খোঁপায় জড়িয়েছি

সমকালীন বাংলা প্রেমের কবিতায় এই কবিতার আবেদন হয়ে উঠতে পারে চিত্তাকর্ষক। আর দুই কবি, প্রেমিক-প্রেমিকা যদি লেখেন একটি একটি করে স্তবক, তাহলে তো কথাই নেই:

মেঘের গায়ে
কার সে স্বাক্ষর
ফুটে উঠল
এমন আঁকাবাঁকা
চিনতে পারছ কি?

তা আমারই তো
তোমার ছোঁয়া লেগে
জ্বলেছে হাত
আর সে বিদ্যুতে
আঙুল গেছে কেঁপে

চোকা
(Choka)

পরম্পরাগত জাপানি কবিতার ফর্ম চোকা। লেখা হয় পর্যায়ক্রমে ৫-৭-৫-৭ অনে। শেষে থাকে ৫-৫-৭-এর একটি পর্ব। ‘মানিওশু’তে সংকলিত এই চোকাটির রচয়িতা কবি ইয়ামানোউ নো অকুরা (৬৬০? খ্রিস্টাব্দ-৭৭৩? খ্রিস্টাব্দ):

তরমুজ তো
খেলেই মনে পড়ে
বাচ্চাদের,
আরও মনখারাপ
বাদাম খেলে,
ভাবনাগুলো আসে
কোত্থেকে যে?
রাতের পরে রাত
ঘুম আসে না চোখে।

এই চোকাটির পরে আছে অকুরারই লেখা একটি তনকা যাকে হানকা বা অনুকথন বলতে পারি:

দাম কত হে
কণক, রূপা, হীরে?
অমূল্য না,
সন্তানের সাথে
তুলনীয় তো নয়

রবীন্দ্রনথ ঠাকুরের ‘ছন্দ’ বইয়ের ‘সম্পূরণ’ আমরা একটি চোকা পাই:

সাহসী বীর
দেখেছি কত অরি
করেছে জয়।
দেখিনি তমাসম
এমন ধীর—
জয়ের ধ্বজা ধরি
স্তবধ হয়ে রয় ।।

দোদোইৎসু
(Dodoitsu)

৭-৭-৭-৫ মাত্রাবিন্যাসের জাপানি কবিতা দোদোইসু। বিষয় প্রেম বা মানবিক ব্যাপার-স্যাপার। ভাবনার একটি মোচড় থাকে সাধারণত।

অনুবাদে একটি:

যখন রেগে যাই
নাড়াই পেয়ালাটি
নড়ে চোখের জল
দীর্ঘশ্বাস?

এদো (১৬০৩ খ্রিস্টাব্দ-১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দ) কালখণ্ডের শেষ দিকে এর উদ্ভব। মনে করা হয় জাপানি লোকসংগীত থেকে বিকশিত এই ফর্মটি।

জাপানি ছাড়াও অন্য ভাষার কবিরা এই আঙ্গিক নিয়ে উৎসাহী হয়ে উঠছেন। বাংলাতেও এর সম্ভাবনা নিয়ে আমরা সচেষ্ট হতে পারি:

তোমার প্রতিটি না
সম্মতির কাছে
চোখ বন্ধ করে
দাঁড়িয়ে থাকে

বুসোকুসেকিকা
(Bussokuseki)

জাপানের নারা শহরের ইয়াকুসি মন্দিরে সুপরিচিত স্তম্ভ বুসোকুসেকি-কাহি। সেখানে রয়েছে একুশটি কবিতা খোদিত ‘বুদ্ধের পদচ্ছাপ’। কবিতাগুলি ৫-৭-৫-৭-৭-৭ মাত্রার, বুদ্ধের গুণগান, জীবনের অনিত্যতা ও বৌদ্ধমতের প্রচার সংক্রান্ত।

২০ সংখ্যক রচনাটি:

ঝোড়ো আকাশে
ক্ষণিক বিদ্যুৎ
এই শরীরে
মৃত্যুমহারাজ
দাঁড়িয়ে চিরকাল
কাঁপব না কি ভয়ে?

ইয়াকুসি মন্দির স্থাপিত হয় ৭৫৩ খ্রিস্টাব্দে, কবিতাগুলি রচনাকাল তার আশেপাশে। এই মন্দির ছাড়া কয়েকটি সংকলনে আমরা এই জাতীয় কবিতা দেখতে পাই। একে বলা যায় ওয়াকার আদিরূপ।

জাপ্পাই
(Zappai)

হাইকুর কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম আছে আমরা জানি, কিন্তু তার বাইরে, সতেরো অন-মাত্রার অন্য কবিতাও আমরা দেখলাম। সতেরো অনের যে-সব কবিতা হাইকুর প্রকৃত নিয়মনিষ্ঠ ও কারুকৃতির চরিত্রের সাথে মানায় না তারাই হল জাপ্পাই। জাপ্পাইয়ের ঐতিহ্যও সমৃদ্ধ, এটি একটি স্বতন্ত্র আঙ্গিক; হাইকু লেখার ব্যর্থ প্রয়াস থেকে যে জাপ্পাই নয়, বুঝতে পারা যায়। আবার তা সবসময় সেনরুর মতো বিদ্রূপাত্মক হয় না।

৫-৭-৫ মাত্রার সঙ্গে ৭-৭-এও লেখা হয় জাপ্পাই।

অলসভাবে
শুনি ভোরবৃষ্টি
সেই মাঝির
(মিসাতোকেন)

চোখ-মু-কান নাই
বউ সৎমা বেশ
(ইসায়িতা ইয়ুমিকো)

বাংলায় হাইকু হিসেবে লেখা অনেক কবিতাই এই শ্রেণির। আবার সতেরো মাত্রার বিন্যাস অক্ষুণ্ণ রেখে তিন লাইনে লেখা কবিতা হিসেবে জাপ্পাই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

মন ও মন
আয়নার দুপাশে
ছুঁতে পারে না

সিনতাইসি
(Shintaishi)

জাপানি ভাষায় ‘সিনতাইসি’ শব্দটির অর্থ ‘নব আঙ্গিকের কবিতা’; হাইকু, তনকার মতো পরম্পরাগত জাপানি কবিতার মাত্রাবিন্যাস ও আঙ্গিকের বাইরে লেখা এই কবিতাকে, বলা যেতে পারে মুক্ত কবিতা। উদীয়মান সূর্যের দেশে ‘মেজি’ (১৮৬৮ খৃস্টাব্দ-১৯৮২ খ্রিস্টাব্দ) যুগে ‘আধুনিক’ অনুভূতিকে প্রকাশের তাগিদে এর উদ্ভব।

সিনতাইসি ধ্রুপদী জাপানি ভাষায় লিখিত। ওচিয়াই নাওবুমি ( ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দ-১৯০৩ খ্রিস্টাব্দ) এই রীতির উল্লেখযোগ্য কবি। তাঁর লেখা ‘কোজো সিরাগিকু নো উতা’ (সাদা তারাফুল/White Aster) কাব্যকে এর প্রারম্ভিক উদাহরণ ধরা হয়।

শুরুর লাইনগুলি:

আসো পর্বতের এক জনমানবশূন্য দূর গ্রামে সূর্য অস্ত যাচ্ছে
আর ক্রন্দনরত পাখিরা পড়ছে ঘুমিয়ে
বৃষ্টির জলে-ভেজা কয়েকটি নীচু গাছ; শোনা যাচ্ছে দূরের মন্দিরের ঘণ্টা
একটি বাড়ির দুয়ারে বছর চোদ্দর এক মেয়ে বাবার জন্য অপেক্ষা করছে
বাবা গেছেন পশুশিকারে
সে খুবই ছোট্ট, কিন্তু তার মুখ দেখে মনে পড়ে সুন্দর এক ফুলের কথা
হাওয়ায় এলোমেলো তার চুল, বাবার চিন্তায় বেশ কয়েকদিন ঘুম হয়নি তার

এই মেয়েটির কাহিনিই এই ‘সাদা তারাফুল’-এর বিষয়।