Categories
2021-May-Poem কবিতা

নম্রতা সাঁতরা

বালি

অবাক; স্তম্ভিত আমি!
তোমাকে আদরে তপ্ত করি গোটা দিন,
আলো নিভলে হঠাৎ ঠান্ডা একেবারে।
হাতে নিলে পিছলে যেতে চাও
অথচ, পালাতে চাইলে বুঝতে পারি,
কতটা বিপরীতমুখী বল দিতে হয়।

তাঁবু

জানি, তোমার ভেতর অনেক অনিশ্চয়তা।
অনেকটা সিনথেটিক কাপড় পরে আগুন পোয়ানো।
হিমেল রাতে মাঝে মাঝে ওই কাপড়ই তাঁবু হয়,
নিশ্চিন্ত নিদ্রাযাপন।

বনফায়ার

আগুন জ্বালাতে পারবে যতক্ষণ, সেঁকে নিয়ো যে-কারো মাংসল উপস্থিতি।
তবু সুন্দরী বাঘিনীরা ভয় পাবে সেই আগুন
সব নিভিয়ে ফেলে কাছে টানতে হবে সারমেয়দের।
আগুন না পেলেও পাঁশ মাখতে কাছে আসবে।

জেলেনৌকা

আমাদের কৈশোরপ্রেম মনে আছে তোমার, একটু গুপ্ত—
বালির চরে রাখা নৌকোর মতো তাতে লেখা থাকে—
“বিনা অনুমতিতে নৌকায় ওঠা বারণ”
তবু লুকিয়ে উঠে পড়ি, ক্যামেরার ঝলকানি অনস্বীকার্য।

আঁশটে গন্ধ

অনাদিকালের তুমি আর আমি, আর আমাদের পুরোনো প্রেমটা শুকিয়ে শুঁটকির মতো।
উগ্র আঁশটে গন্ধ ছাড়ে—
তবু বিশ্বাস করি রান্না করলে সুস্বাদু হবে।

সঙ্গম

ডাঙার যত পাখি আছে তাদের নাম অনেক, রং অনেক।
সঙ্গমের অতল জলের তীরে, সকল যাত্রীর অভিন্ন নাম— ‘তীর্থের কাক’।।

Categories
2021-May-Poem কবিতা

রাজীব মৌলিক

রোপণ

আমাকে ছড়িয়ে দাও বীজধান ভেবে
যদি বেড়ে উঠি
মরশুম শেষে

চিতার অনলে নয়
অভাবের রাতে

যেন জ্বলে উঠি…

মূল

মাটি খেয়ে বড়ো হলে গাছ
শাখা, ডাল, পাতা, ফুল, ফল
যতই আকাশচুম্বী হোক

হৃদয় ছড়িয়ে থাকে তার

সানুতলে…

আলপথ

কিছু কথা হোক
অকথা কুকথা
এভাবে হঠাৎ থেমে গেলে
যাতায়াত
ফসলের মাঠে

যত ঘাস চাপা পড়ে আছে
আল ফেটে বেরিয়ে আসবে—

আমাদের পুঁতে রাখা কাঁটা

অস্থায়ী

মনে মনে আমিও পা মেলে
বসি, শ্যামলীর পাশে
লুডু খেলি, খেলি পাশা

ওর দাঁত ঠিক যেন মাগুর চোয়াল
সোহাগের টোপ দিয়ে গিলে নিতে জানে

আমিও চেয়েছি শতবার
গিললে গিলুক দেহখানি

মন না জুটুক তবু
কিছুক্ষণ পচেগলে গেলে থাকি ওর

মায়াবী গজালে

জীবন

পথে রেখে এসেছি তোমায়
আমার জীবন

এখন বিরহ করো
দুঃখ করো

কেউ বলবে না
থামো

কেউ বলবে না
কান্না করলে তোমায় বড়ো বিশ্রী লাগে

Categories
2021-May-Poem কবিতা

উমা মণ্ডল

সৃষ্টিরহস্য

উদাসীন দুপুরের গাছে বসে থাকা কোকিলের চোখে জল পড়ে। হয়তো শীত; ধূসরের শব্দগুচ্ছ পড়ে নিয়েছে সে। এখন কাঙাল হাতে দেনা, পাওনা। আরও নিঃস্ব হয়ে যাওয়া। লাল ধুলা ভেসে যায় দেহ জুড়ে… নদী একটু থাক। এই প্রয়াগের জল মূর্তিমান যমদূত; স্মৃতিচিহ্ন বলে কিছু রেখে দেয় না… বকুল ফুল

ভ্রমরের আদিনৃত্য দেখেছ? যেভাবে জেগে ওঠে শক্তি শবের মধ্যমা থেকে। দারুণ আগুনে ধোঁয়া ওঠে আকাশের দিকে। শেষ থেকে প্রারম্ভের ধারাপাত রিং হয়ে ছুটে যায় পৃথিবীর কোলে; মা ডাকে সন্তান… বুক থেকে খসে পড়ে সুধারস, তার যাপনের ইতিকথা; সেই শূন্য থেকে গড়া চিন্ময়ীর চোখ। জল আসে…

কেঁদো না কোকিল; এই উদাসীন চোখে তানালাপ একতারা নিয়ে বসে আছে একান্তের বোধে…

নিরাময়

পেয়েছি জন্মদিনের চিঠি…
পার হয়ে গেছে কয়েকটা সূর্যওঠা নাম আর ঘন রাত। আমার অসুখে ঢাকা রোদ জলজ গম্ভীর। আঙুলের ফাঁকে যতটুকু আশা, ততটুকু দিন দেখা যায় জানালার শেষে। সেই ঠোঁটে রাখা আহির ভৈরব দেখি পাখিদলে, আকাশের খুব কাছে। একতারা বুকে ভাসে
চিঠি এসে গেছে অবশেষে…
সাদা খামে ভরা এই পাতাগুলি একটি সিন্দুক। আধো বোল, খানিক রহস্য; গাছেদের ডালে ডালে ইচ্ছে বাঁধা সুতোর ঢিলেতে। তাপ দেওয়া অক্ষরের গা-গরম, ছুঁলে পুড়ে যায় চোখ। শিরা বেয়ে বেয়ে জলের আকুতি। বাড়ন্ত জীবন। হয়তো চণ্ডালিকার বংশধর। হাঁটি ডোমপাড়া দিয়ে; সন্ধানে, সন্ধানে।
অক্ষরের গর্ভ বেশ প্রাচীন; আবিষ্কারের দেশে এই অতীতের রেখা সমুদ্রের খুব কাছে। অতল দেখি শুধু অতল; স্রোতে স্রোতে ডাক দিয়ে যায় গাঙচিল। তোমার চিঠি এসে গেছে

হ্যাঁ, আমার চিঠি এসে গেছে। জন্মদিন শেষে অবশেষে; অসুখ সারাতে…

সীমারেখা

মেঝেতে গুটিয়ে থাকা বড়ো অসহায়
পাশ দিয়ে চলে যায় সময়ের চাকা
অথচ কেমন নির্বিকার
এতকাল পার হয়ে গেল, ভয় নেই
তবু এই গণ্ডি এই সীমা…
বেড়া বাঁধা উঠানের ধারে বকুল ফুলের গাছ
গন্ধে সেই নেশা যাযাবর ডাক;
পৃথিবীর তলপেটে যে-মাধ্যাকর্ষণ আছে
জানে গুটিকয় জাতি
ওদের পোশাকে শীত গন্ধ, বরফ আতর
এইসব অভিধানে নেই

ডুব দিলে উঠে আসে লুপ্তপ্রায় ডাকঘর
চিঠিতে প্রাচীন শব্দ হরপ্পার; এইসব
গল্পকথা, উত্তরের পথ
ধূমায়িত গরমের চা ‘ঠিক বুঝবে না’
তবু কথা যুধিষ্ঠির… পাক খেয়ে খেয়ে ঠিক
পায়ে ধরে; মেরুদণ্ড বেয়ে গলা

এরপর ডাক এলে উঠে যাব বাঁকে
রহস্যের কাঁচাঘরে
আলতামিরার গুহাপথ ছেড়ে হয়তো বা
নতুন পথের গন্ধ পাব…

খরা

কতদিন এ-পাড়ায় বৃষ্টি নেই। সেই কবে আকাশের ঘর কালো করে দু-একফোঁটার স্বাদ… চাতকের কান্না শুনে প্রাচীন বটের ঝুরি বলে অভিশপ্ত কাল। সেই থেকে সদ্য জন্ম নেওয়া পাতা হলুদের কোপে ঝরে যায়। গোটা একটা গাছ পোকাদের হাতে চলে গেছে। ছায়ারা হারিয়ে গেছে। তার সাথে পাখিদের বৈঠকী আড্ডাও

ও-দিকে কাঙাল ধানখেত… জ্বলে গেছে হলুদের বেশ। কালো গুঁড়ো ঝুরঝুরে হাওয়া হাতে লেগে; পেটে জ্বালা ধরে। মাতৃদুগ্ধের আস্বাদ অধরা মাধুরী। হাঁড়ি পেতে বিষন্নতা। তার ব্যক্তিগত খাতা থেকে কেউ জল নামক শব্দটি তুলে নিয়ে গেছে। এ-দিক-ও-দিক মুড়ে নৌকা তৈরি করে না খেয়ালি মন। গতি নেই, নেই চলাচল। বড়ো বিষণ্ণতা মাগো। সামনে অন্নপূর্ণার বেদী শূন্য। নীচে ডুবে যাচ্ছে দিনকাল

সেইসব শব্দ

গভীরতা থেকে সৃষ্টি হওয়া শব্দ আসলে ডুবুরি
আতসকাচের চোখে কথা বলে আকারে ইঙ্গিত
দূরদূরান্তর থেকে আগত ইথার
একহাতে লুফে নেয়। তেজ শুধু তেজ
আলো থেকে উদ্ভাসিত পথে বিশ্রামের ছায়া
সকালে ভৈরব
রাতে ছায়ানট…

তীব্র এক আকর্ষের টানে ওঠে ঢেউ
মধুলোভে ছুটে আসে কামুক পৃথিবী
নেশা শুধু নেশা…
সীমান্তের কাঁটাতার ডাকে বেহালার ছড় টেনে
ক্ষত বাঁধা খাদ ভুলে যায় রক্তের প্রচ্ছদ
আসলে ডুবুরি ঐ শব্দ; এক একটি মায়ারোগ
আতসকাচের চোখে কথা বলে আকারে ইঙ্গিতে

খেয়ে নিতে পারে গোটা কৃষ্ণগহ্বরকে

Categories
2021-May-Poem কবিতা

রঘু জাগুলিয়া

তখন দুপুর। গাছের পাতা দিয়ে ঝরে পড়ছে এপ্রিলের রোদ। অবসন্ন পাতার কথা ভাবছি সারাক্ষণ। ভাবি জীবন কি কয়েক ফোঁটা জল। পিপাসার্ত পথিকের মতন অতিক্রান্ত বেলা। পাঁচিলের উপর দিয়ে মাঝে মাঝে একটা-দুটো কালো বিড়াল হেঁটে যায়। আর্দ্রতাহীন একটা বাতাস ধীরে-ধীরে কণ্ঠরোধ করে। আর বাবলাগাছের গুঁড়ি রাস্তা আগলে পড়ে থাকে এমনি
যেন মৃত্যুর পর আরও অবাধ্য হয়ে উঠছে কেউ

তখন দুপুর, চলে যাচ্ছে পরকালে…

গাছের কাছে ছায়া থাকে যেন পুরোনো বন্ধুর মতো। পুরোনো দিনগুলোর মতো। কত পথ চলে যায়, কত অজানা সিঁড়ি দিয়ে চলে যায় আলো। আমার মনের থেকে দ্রুতগামী সেই পাখি, আমি তাকে খুঁজি। সবুজ-হলুদ ধানখেতের উপর দিয়ে একটা হাওয়া চলে যায় নিঃসঙ্গ।

ভাবি, নিঃশ্বাসের কাছাকাছি আসে না কেন আজ, পুরোনো স্মৃতিগুলোর গন্ধ।

জানলার পাশে বসে রোদে ডুবে থাকা লাল বাড়িটাকে দেখি। গৃহবাসীনি পর্দায় হাওয়া লেগে মাঝে মাঝে গায়ের উপর এসে পড়ে— যেন কবেকার তাঁর হারানো স্নেহ, মমত্ব…

একটা, দুটো, জোনাকি ঢুকে পড়ে ঘরে…

অথচ আশ্চর্য সেই রাত, ফ্যানের শব্দে কখন যে ঘুম ভেঙে গেল— দেখলাম বাড়ি তো কোথাও নেই, একা একটা বেড়াল আঁচড় কাটছে অন্ধকারে। তারপর অন্ধকার আরও অন্ধকারের ভিতর কারা যেন করাত দিয়ে গাছগুলো কেটে ফেলছে, ঝরে যাচ্ছে ফুল—
অরণ্য কেঁপে উঠছে ভয়ে…

এক-এক সময় শীত করত, জ্বরে তখন ভীষণ গা পুড়ে যেত।

মৃত্যু হয়তো ঘুমের পাহাড়
যার সমস্ত পথই ধুলো—
ছাদের উপর মাংস ঠুকরে খাওয়া কাক যেন একটা আগুন নিয়ে খেলছে…

সূর্যাস্তবেলায় নদীর পাড়ে দেখি কীভাবে আগুন স্পর্শ করছে জল। শুনি ঢেউ-এর আর্তরব। মনে হয় একদিন আমাকেও জলের শিকল দিয়ে বেঁধে ফেলবে জল।

তবু কিছু সুর, কিছু নিজস্ব পথ আছে জেনেই— নক্ষত্রের শুয়ে থাকা দেখি।

পাগলটা অভিমানে শুয়ে থাকত ওখানে
ঝড়বৃষ্টি রাতেও দেখেছি কতবার
তার ছেঁড়া কাঁথাকাপড় থেকে ঠিকরে আসছে আলো
আর আমরা, পাগল বাইরে আছে জেনেও
দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়লাম

তারপর একা আরও একটা বর্ষাকাল চলে গেল…

Categories
2021-May-Poem কবিতা

কৌশিক সেন

চারুলতা

গোবিন্দ মেসো যেদিন সন্ধ্যেয় দ্বিতীয় পক্ষ নিয়ে ঘরে তুলল,
সেদিন দুপুরে চারুমাসির বাড়ি গিয়েছিলাম। মা পাঠিয়েছিল,
একবাটি কুচো মাছের চচ্চড়ি দিয়ে।

চারুমাসি শুয়েছিল বিছানায়। আমায় দেখে মাসি বলেছিল,
আমার কপালে হাত রেখে দ্যাখ না বুধু, বড়ো গা ম্যাজ ম্যাজ করছে।
আমি দেখেছিলাম মাসির সারা শরীরে ডালপালা মেলছে
মস্ত একটা কলকে ফুলের গাছ। ঝুমঝুম করছে ফুলে…

চচ্চড়ির বাটিটা রেখে এসেছিলাম গাছের ছায়ায়। পেছনে ফিরে
দেখেছিলাম কুচো মাছগুলো লকলকে সাপ হয়ে গাছের শরীর বেয়ে
উপরে উঠছে…

উত্তরকাণ্ড

অমিত্রাক্ষর ছন্দে বাবা যখন একটা মহাকাব্য লেখা শেষ করেছে,
মা তখন সবেমাত্র ফোড়ন দিয়েছে ডালে।
বাবা ডাকে, শুনছ একবার এসো না গো, নতুন লেখা কাব্যখানা পড়ে শোনায়!

মা গ্যাস কমাতে ভুলে যায়, বাবা কাব্যখানা পড়ে চলে…

উত্তরকাণ্ড আসতেই পোড়া গন্ধ আসে রান্নাঘর থেকে। মা ছুটে যায়।
দেখে ডালের কড়াইয়ে টগবগ ছুটে চলেছে অশ্বমেধের ঘোড়া

মেয়েমানুষের গল্প

যেদিন জবাকুসুম তেলের শিশিটা হাত থেকে পরে
ভেঙে গিয়েছিল, ও-পাড়ার ডলিবউদি নিখোঁজ হয়ে
গিয়েছিল, বাড়ি থেকে, ভরদুপুরে। শিলনোড়ায়
সর্ষের সাথে কাঁচালঙ্কা বাটতে বাটতে যেদিন কাকের
ডাল শুনেছিল মান্তুর মা, সেদিন মাঝরাতে নিশিতে
ডেকে নিয়ে গিয়েছিল পাশের বাড়ির বিয়ের বয়স
পেড়িয়ে যাওয়া শ্যামলী পিসিকে।

তারপর যেদিন দোল পূর্ণিমার রাতে আমার মাথায়
অনেকদিনের গল্প জমে উঠল, জ্যোৎস্নায় জবাকুসুম
তেলের গন্ধ পেলাম আর চোখে লাগল লঙ্কা সর্ষের
ঝাঁঝ। স্পষ্ট দেখতে পেলাম, সোনালি আলোয়
আমার কলমের দিকে নির্ভার হেঁটে আসছে
ডলিবউদি, শ্যামলী পিসিদের মতো জ্যোৎস্নাময়ী মেয়েমানুষেরা

চাঁপাফুলের কথা

পুরোনো প্রেমিকার বাড়ির সামনে দিয়ে গেলে
আজও ঠাকুরঘরের পাশে মরা চাঁপাগাছে
ফুল ফোটে। লক্ষ্মী আসনে গন্ধ ছড়ায়।

প্রেমিকার ভাইপো ভাইঝিরা কুড়িয়ে নেয় ঝরা ফুল
বলাবলি করে, মালা গাঁথবে এবার। পিসিকে পড়াবে
পুজোর ছুটিতে বেড়াতে এলে।

আঁশ

বাবার জামাকাপড় থরে থরে সাজানো, মায়ের আলমারিতে
মায়ের শাড়ির পাশে।
আগে আলমারি খুললে বাবার গায়ের গন্ধ আসত,
এখন আসে না।

এবার মায়ের আলমারি খুলে দেখেছিলাম,
মা ঝোল-ভাত রেঁধে রেখেছে আলমারির লকারে
বাবার ছেড়ে যাওয়া লুঙ্গিতে মাছের ঝোলের আঁশটে গন্ধ!

জন্মকথা

আমায় যেদিন জন্ম দিয়েছিলে, মাগো
অমৃত পয়স্বিনী গাভীর মতো স্নেহ নামিয়ে এনেছিলে
নিরাভরণ আলপথে, কাশবনে, সাত সকালেই…

যেদিন জন্ম দিয়েছিলে আমায়,
কমণ্ডলু থেকে শান্তিজল ছিটিয়ে ছিলেন কুলগুরু
নিকানো তুলসীমঞ্চ জুড়ে সেদিন রৌদ্রের উৎসব…

রোদ নেয়ে হেসে উঠেছিল শালুক ফুলের মেয়ে
মাগো কবে আবার তেমন জন্ম দেবে আমায়!

Categories
2021-May-Poem কবিতা

দেবাশিস বিশ্বাস

তাস ও রক্তের স্পট: একটি অমেরুদণ্ডী নোট

[মহোদয়, আমি অসমের জঙ্গলে যাইনি। কিন্তু সামনের বাঁশবাগানে দাঁড়িয়ে তর্ক শুনছি গণ্ডারের। অণ্ডকোষের আশায় গণ্ডারকে হত্যা করা হবে। এবং তার মিহি দাঁতের ফুঁ ছড়িয়ে দেওয়া হবে সবুজ কাষ্ঠলে…]

মস্তিষ্কের খোঁজে লণ্ডভণ্ড করেছে বাগান
তরমুজের জেদ ফাটিয়ে ঘুমিয়েও পড়েছে
‘মুক্ত করো জনজাতি মানবসভ্যতা’
জোনাকির মিটি মিটি টাইমের বর্গ
জড়িয়ে থাকে যারা তাদের অস্তিত্ব অজগরের মতন

*
লোম ছুঁয়ে পালিয়ে যাওয়া হাওয়া
‘ভাল্লুক থাবা চাটছে’—
তাকে পাশ কাটিয়ে
ট্রাক
ধাতুকে ধাক্কা দেয়

বরফের উপরে আছড়ে পড়ে OZONE
মস্তিষ্ক,
ও কিছুই না।
দুর্বল পাখি তাড়ানোর মেশিন।

দ্রাঘিমা টেনে রেখে পালিয়ে গিয়েছে ম্যাকাও,
তার জঙ্গলে মুক্ত চুমু
ভাবো, পরশু থেকে, আজ দাবার প্রত্যেক ঘরে কোনো খেলা নেই।
দু-বার না উড়ে একবারেই
মাথার চুলগুলো কমে যাচ্ছে… ডুবে যাচ্ছে যাদের অস্তিত্ব অজগরের মতো

একদল হরিণ,
কখনোই ভাবিনি রাস্তা তার পিতামহের স্মৃতি নিয়ে যাবে

অস্থির সময়ে, টেবিলের অন্ধকারে পাখির ডাক
লালায় অ্যাসিড…! দাঁতের তড়িৎক্ষরণ বিলাসিতার কারণ।
কল্পনায় দোষ নেই, যতবার খুশি গলায় ফাঁস পড়তে পারো
ক্ষেপে উঠছে টলটলে হাত
চাবুক
মাছি
তেলের ব্যাড়েল গড়ানো
এই তোলা হল, সাজিভরতি, জবাফুল। মন্দির।

[তারপর পবিত্র কুসুমের ডাল ছিঁড়ে মায়াহীন বিষুবতলে হলুদ সূর্যমুখী ফুল থেঁতলে তুমি ঠিক পালিয়ে যাচ্ছ অণ্ডকোষ জ্বালিয়ে। একটু বোসো, নিরিবিলি সন্তানের নড়ে ওঠা দাঁতের মিথ্যায় ইঁদুরকে আন্দাজ করো। তুমি কি ভাগ্যবান! জমি বন্ধকের অজুহাতে ড্রিল করছ নাভিতে। সে-নাভি দুর্গন্ধময়।
ভাবছ, এবার রোপওয়ে থেকে ঝাঁপ দেবে?]

তুলতুলে পোঁদ-পাকা বুলবুলি অরাজনৈতিক
বহু পুরোনো প্লাস্টিক জানলায় বাঁধা আছে,
ওখানে ফোন ঝোলানো থাকে
ট্রান্সফরমার ফ্ল্যাশ করে। দু-একটা বাঁদুরের বার্স্ট।
নেমে গেলে শ্রমিকের কালো ধোন, বিশেষরূপে তার যৌনতার কোনো দাম নেই।
লক্ষ লক্ষ যুগের রূপান্তর, মানুষ গাছের শাখাপ্রশাখা খোঁজে।
মনে পড়ছে, হাতকাটা ৫০ হাজার মিলিয়নের থেকেও বেশি রক্তের মুঠি।
চা পাতা চেবাতেও জল ওড়ে, অরোগ্রাফিকভ্রান্তি
বুকে হাঁটা বালি, অর্ধেক আংলি ছাড়া কিছুই নয়

[কটেজের সামনেই বাদামের খোসা। কিছু তাস ও রক্তের স্পট। ইয়া, বিশাল লোহার গেটে ঘাতকের তড়িঘড়ি ছুটে পালানোর রেখা। লতিয়ে সন্ধ্যা নামে বা ভেঙে পড়ে সকালের সূর্য। জন্তু তো, রড কোষ দিয়ে দ্যাখে, কটেজের আকাশ দিয়ে জেট বিমান উড়ে যায়…]

আমি পলাতক হাজার হাজার কচ্ছপের পিঠের শ্যাওলায়
কেউ টিপে দিয়ে স্যুইং খায়
অযথা গভীর সমুদ্রে দাঁড়িয়ে কলোনিবিমুখ হয়ে পড়ি
তারা খসা ও মেরুন কালারের হাতুড়ি-মুখো তিমির পেটে অজস্র মাছ
বলেছিল, শান্তি এক দুর্ভিক্ষের নাম…
ভাবুক অনায়াসে গাছগুলো ছেঁটে দেয়… বাড়তি খনিজ
লম্বা লম্বা পা… এ-সব রূপকথারই গল্প।
সেও একা

জলে জলে ঘোরে
পৃষ্ঠটানের জন্যই সে ক্ষতিগ্রস্ত হয়
গৃহহীন পিছলে যাওয়া সৌরে আচমকা দেখা হয়ে যায় দেয়াল। চুনের রেখায় বুদ্ধি… লা লা লা

এবারের মতো প্রথম আবিষ্কারের খাতা থেকে তোমায় বাদ দেওয়া হল

ঐরাবতের কাহিনি


মোচড়ানো বৃক্ষের জাহাজ, উড়ে গেছে কি — কবিতার
ফাঁকা অনিঃশেষে দাঁড়ানো ঐরাবত, চুলগুলো বারুদ
কোথায় ছিল সে, অনুমানে তিনটে খুন হয়
যতই রটানো হোক তিলখেতে বাঙালার পাখি ধরা হয়—
বদমেজাজি লোক সে, সীসার হৃদয় থেকে ভার নিয়ে নেয়
ধরা যাক, শ্বাসরুদ্ধ
অপর পাশে কবিতার খেত

উচ্ছে কবিতার কাছে, ঘেঁষে আছে খুনি নিবারণ—


যথাসম্ভব টান দিলেই পুকুরের নলি ছিঁড়ে যাবে, শান্ত মৌরলার চঞ্চল
মাথাদের বিশ্রাম চাই… এই অজুহাতে আঁশ তোলা হয়
কঠোরের দিক ওইদিকে, একটু কান ঘেঁষে গেলেই বাড়ি ঘর জঙ্গলে, মাতৃ হাঁ শ্বাসের আওয়াজ
শোনো, অবিকল জিতে যাওয়া ট্রফির চিক্কন—
ছুঁড়ে কেউ জমেছে এমন… মা-মরা সন্ধ্যার একায়?
আবহাওয়া মাছেদেরই থাকে
তবু কোনো চোর আসে, যথাসম্ভব টান দিয়ে মৌরলার ঠোঁট ছিঁড়ে নেয়


যতটা ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি, মাফলার জমে যাওয়া বরফ
আমি তা কুকুর চোদার মতো দেখি
এই গরল, তামার পাত্র উপচে ওঠে দোকানের ঘরে
বিধিসম্মত কফিনের পেরেকে খুঁচিয়ে তুলছে সে কবেকার জমে থাকা ফ্লেশ!
কালো জাদুতে বিশ্বাসী, ঐরাবত
গন্ধের অভাব বোঝে, নাসারন্ধ্র থেকেও দূরে, সূর্যের প্রজ্জ্বলন
এ কেমন মহামায়া রুপোর জলের কাছে আবেদন যেন
মৃত পশুদের দল স্টিল হয়ে আছে, ধীর হয়ে আছে
ঘাসের ক্রমশ হাত মানুষ তুচ্ছ করে
যেন সে পশু নয়
কফিন বানানো তার কাজ, অদৃশ্য জাতক!

Categories
2021-May-Poem কবিতা

রাজদীপ পুরী

অদৃষ্ট

হাওয়ায় পুড়ে গেল ঈশ্বরের ছায়া, এখন নীল রঙের রোদ হাতে নিয়ে
ঈশ্বর ঘুরে বেড়ান মাঠে ঘাটে, ধুলোর আলপনা জমে তাঁর গায়ে,
নব্য প্রেমিক প্রেমিকারা তাঁকে পাথর মনে করে নিজেদের নাম
যত্ন করে লিখে রাখে— ঈশ্বর সব দেখেন আর মুচকি হাসেন,
নতুন অলংকার পেয়ে, আহ্লাদে আটখানা হয়ে পুড়ে যান ঈশ্বর…

বধূবরণ

সেদিন চৌকাঠ ডিঙিয়ে রোদ্দুর এল, এল আলো বাতাস জল—
একটা আস্ত সমুদ্র এসে ভাসিয়ে দিল খাট, আলমারি, ঘরের সমস্ত আসবাব…
এখন খোলা জানলার পাশে ভ্যান গখের হলুদ গমখেত,
আর রাতের বেলায় ছাদ জুড়ে মুনলাইট সোনাটা!
তোমার অর্ধেক আকাশ ‘এই শুনছ…’ বলে আলতো টোকা দিল আমার অর্ধেককে…
দু-চারটে তারা খসে পড়ার পর— সেদিন তোমার সঙ্গে চৌকাঠ ডিঙিয়ে
গোটা পৃথিবী এল আমার ঘরে আর আস্ত একটা সূর্য এসে
আটকে রইল আমাদের বাড়ির আশমানে

একটি বিধিসম্মত সতর্কীকরণ

পিরীত দিও গো কন্যে, দিও মন, মেলে দিও ডানা এক আশমান—
বাতাসে উড়েছে রঞ্জক, কদমের বনে দ্যাখো একা বিষণ্ণ কানহাইয়া…
সুর নেই তাঁর, লয় কেটে গেছে, বাঁশিতে ফিসফাস, কিসব গুঞ্জন!

ডানা থেকে খসে পড়ে ময়ূরকন্ঠী আলো, সেই আলো গায়ে মেখে
আর পোড়াইও না শ্রীঅঙ্গ

কোজাগরী

বিপদের ছায়ার মতো স্নিগ্ধ আর উদাসীন আমাদের বেঁচে থাকা,
মৃত্যুর চেয়েও রূঢ় চোখে আমরা তাকিয়ে থাকি অমরত্বের দিকে,
বাঘনখ দিয়ে প্রতিপক্ষকে ফালা ফালা করে ফেলার ভেতর
যে অদম্য উল্লাস কাজ করে… খুচরো পয়সার মতো তা জমিয়ে রাখি
লক্ষ্মীর ভাঁড়ে, জীবনকে মোচ্ছব বানাতে দেওয়ালে দেওয়ালে
টাঙিয়ে রাখি কাঁচা মেয়ের ছবি…

রূপোর থালার মতো চাঁদ উঠেছে, লক্ষ্মী ঠাকরুনের লাল আলতা পা ছাপে
গাঢ় চুমু এঁকে দিয়ে ফেরার হয়ে যান এক কবি

দাম্পত্য

আমাদের সারারাত খুনসুটি আর তুমুল ঝগড়াঝাটির পর
এই যে সূর্য ওঠে আর রোদ এসে ঝিলমিল করে
আমাদের ছোট ঘরে… আমাদের ছোট ছোট সুখ, ছোট ছোট রাগ অভিমান—
এই যে আমরা ভাগাভাগি করে নিই, কি নিই না বল?
আমাদের চারহাত দুহাত হয়ে যাওয়ার পরও এই যে
আমরা প্রেমিক প্রেমিকা সাজি, আর তালি বাজাতে বাজাতে
পার হয়ে যাই দিন মাস বছর, আস্ত ট্রাম লাইন…

হট প্যান্ট আর স্ট্রবেরী কন্ডোমে টগবগ করে আমাদের
খেজুর রঙের দাম্পত্য!

Categories
2021-May-Poem কবিতা

বাপি গাইন

 

ভেঙে পড়বার মতো এক কাঠের চেয়ার কেবল, মানুষ নই
সারাদিন বারান্দায় জানালার সামনে বসে থাকি
যেন জন্মের আগে থেকে এই চোখের অপূর্ব এক খিদে
যেন মৃত্যুর পরেও এই চোখের কোনো বিরাম নেই

সুখী ও সফল মানুষের পৃথিবীতে
ঋতু পরিবর্তন হয় তবু
কেবল প্রার্থনায় বসার এই ভঙ্গিমার
কোনো পরিবর্তন হয় না

অশ্রু হারানোর পর, চোখ নয় জেগে থাকে পাথুরে দৃষ্টির চর

আমার ভেতরে যত মেঘ, আমি ততটাই শুষ্ক মাটি চাইছি ঝরে পড়ার, তোমার কাছে। যতটা আগুন আমাকে ঘিরেছে পা থেকে মাথা পর্যন্ত ততটা জলীয় ত্রান চেয়েছি, তোমাকে হত্যা করতে আসিনি। অথচ তুমি আমার শোবার ঘর তুলে নিয়ে গেছ, তোমার বরদির কাছে। যে-আঘাতে আঘাতে পাথর তাকে তুমি এনেছ আমার শোবার ঘরে। ফলে আমার অসহ্য রাতদিন, আমার কুয়াশায় কুঁকড়ে যাওয়া ভাষা তারও সহজপাঠ হবে না স্বাভাবিক। এ-সমস্তই হালকাভাবে নিতে হবে। আমার ভেতরে যত মেঘ, হালকাভাবে নিতে হবে আমাকেই। আমার ভেতরে যে-আগুন, শেষপর্যন্ত আমাকেই নিতে হবে তার ছাইয়ের অধিকার।

কতদিন লিখি না কিছুই
পর্ণমোচী বৃক্ষের মতো যেন সব কথা ঝরে গেছে, সব ব্যথা
জল থেকে উড়ে যাওয়া পাখি
জলে সামান্য ঢেউ এই মাটিতে আছড়ে পড়েছে।
হতভম্ব পাথরের মতো শুধু দেখে যাওয়া, এই চোখ
আর কোনো প্রশ্ন করে না।
এক্ষুনি অথবা একটু পরে মরে যাব
এই চেতনা আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে এখনও।

নিভৃত প্রশ্নের আলোয়
মৃত্যু নিয়ে অহেতুক কষ্ট পাচ্ছ তুমি
জীবন যেভাবে সম্ভব যায় নিজেকে অতিক্রম করে
প্রকৃতির গর্ভে সেভাবে কিছুই অপচয় হয় না।

প্রতিটা উত্তরের পর তাই
যে-প্রশ্নটির মৃত্যু ঘনিয়ে আসে
অজ্ঞানতাবশত তার জীবনপ্রণালী লক্ষ করি
দেখি জন্ম ও মৃত্যুকেই একমাত্র খিদে দিয়ে প্রশ্ন করা যাচ্ছে
অর্থাৎ এই প্রশ্নমুখর খিদের অজ্ঞানতাই জীবন
জীবন আমাকে ভুলতে বসেছে পথেঘাটে।

একমাত্র উৎসবের দিন এলে বোঝা যায়
উৎসবের মানুষ আমি না
আলো ও অন্ধকারের ভেতর— বেড়ালের গলায় আটকে থাকা ঘড়ির কাঁটা।

দিনের শেষে মানুষের তবু একটাই গল্প থাকে, উল্লেখ করার মতো।
গল্পের খাতিরে মানুষ ফুলপ্যান্ট পরা শেখে
দু-আঙুলে সিগারেট ধরার কৌশলও, অভ্যেস হয়ে যায় ঠিক একদিন।

গল্প এতটাই গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক
উঠতে বসতে তাকে নিয়ে ট্রেনে-বাসে-নেটে
এমনকী মন্দির আর বিধানসভায়ও মানুষের নিস্তার নেই।

ধর্মযুদ্ধ আর অজ্ঞাতবাসেও গল্পের মহিমা বহু প্রাচীন।

নেই নেই করেও অতিচর্চিত এক গল্পের আওতায়
প্রতি মুহূর্তে আমি মুদ্রিত হচ্ছি
যার স্বত্ব এখনও অরক্ষিত পৃথিবীর কাছে।

Categories
2021-May-Poem কবিতা

গৌতম সরকার

হরেশ কাকার স্যান্ডো আর শরীরে লবণ দিয়ে ভারতবর্ষ আঁকা।
সে-ম্যাপে আছে পাকিস্তান, চীন, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ।
সে যখন হাল দেয় তখন মাটির গন্ধ গায়ে মাখতে ঘুটকুরি আসে, দুধ সাদা বক, টেকেনাই…। এরা
কোন এক প্রাচীন কাল থেকে স্নান করে না। শরীরে তাদের শামুক খোলের মতো মেঠো গন্ধের আস্তরণ।
প্রতীক্ষা নিয়ে বসে থাকে… এক আড়াই আঙুলের লোভে।
আর সেই ডানপিটে আড়াই অন্ধকারকে দড়ি বানিয়ে বানিয়ে ভাগ করে— নুন, ভাত, ফ্যানা।

তোমাকে পেতে চেয়ে শরীর পেতেছি।
আর পেতেছি দুধ সাদা বুক…
তোমাকে চেয়ে উল্লেখযোগ্য উলঙ্গ হয়েছি। অথবা দৃষ্টান্ত হব বলে।
উপরে দিয়েছি ভেজা খড়। ছেঁড়া ধকর। ছোটো ছোটো টেকা দেখব বলে ভোরের আঁচল সরিয়েছি।
ছেনিতে ছুয়েছি জল। মুস দিয়েছি মাখিয়ে…
এত কাণ্ডের পর জুহুরি এসে যখন বল— ও তো খাস্তান!!
তবে পরাগও মিছামিছি মিলন করে। শরীর চেপে থাকে রস।

পাগলা গোরুটাকে অনেক কষ্টে বাগাতে পেরেছি।
সে এখন ডান বাম বোঝে। উঠস বইস বোঝে।
হাই তোলে না আর আগের মতো। লাঙল তুলে দিই ঘারে। তাল তাল সন্তান পাবার আশায় বীজ পুঁতে দিই জমির শরীরটাতে…
জানো নন্দ— এতে কতবার শরীর ভাঙে।
আমার, জমির, গোরুর।
আর তুমি শুধু উল্লেখযোগ্য ভাম ধরো। বাজে খেলো। নীতি করো। আমি কতটুকু তোমার নিয়েছি? আর তুমি কতটা পেয়েছ নন্দ?
চলো খেরোর খাতা খোলো…

মা বলে— বাসন একখানে থাকলে ওমন শব্দ হবেই।
রোজই রেগে ওঠে বড়ো মুখ ওয়ালা ডেকচি। ঝনাঝন শব্দ হয়। কেটলির কারি আর আগুন মোতা গরম সইতে পারি না বলে একা চলে যাই দূরে।
কেকারুদের বাগানে বড়ো গাছে গিয়ে লুকোচুরি হই। মা হয় হয়রান। বাবা হয় আগুন
মা বলল— একদিন দেখিস
সেই যে টুকুনটা ছিল। আমি তাকে বলতাম চিকনঠোঁটি। সে গতকাল হাতবদল হয়েছে। তার কান্না দেখে আমি ভান করেছি।

মা আর কিছু বলে না।
এখন শুধু ভাত হতে ইচ্ছে করে…

পিতা হওয়ার চিন্তা আঁকি। কিংবা আদরের কোল।
দুই থেকে বারো ঘরের নামতা মুখস্থ হয়নি কোনো কালেই। তাই, যোগ আর ভাগের সময় অনেক দাঁড়ি কেটেছি খাতায়।
বলে আপাত এই শ্বাশত বুক ছিঁড়ি। হাতের রেখায় মৃত্যু যোগ খুঁজে একের পর এক গুণ কষতে থাকি। ইনফিনিটি চিহ্ন ছেড়ে হাল কষি ততক্ষণ, যতক্ষণ না বুদ্ধের চরণ অবধি পৌঁছাতে পারি…

পুতুলনাচ এখন নতুন করে ভাবি…
কেমন এক অদৃশ্য সুতোয় ঝুলে আছে মেঘ।
যেমন থাকে জন্ম ও মৃত্যুর সম্পর্কের মাঝামাঝি। উলম্ব… কোনো মোহযুক্ত টান নেই অযথা ঝড়ে যাওয়ার। নেহাতই নিয়ম মেনে চলা ক্লাস সেভেনের ছাত্র সে…
ঘণ্টা-রুটিন-পোশাক…

সে যখন লাবণ্য খায়। বিয়ে হয়…।
খিদে বাড়ে আরও।
মনে হয় আর নয়। নয় আর…
তারপর আবার চরম হতে চায়। শক্ত হয় আটি… তুলতুলে হয় দানব। সে তো এক ভয়াবহ চক্রব্যূহে লড়াই!! লড়তে থাকা ক্লান্ত ভক্ষক চেটেপুটে খেতে থাকে রস।
এরপর না-থাকার এক দশর্ন পাঠ করে। আর না। না আর… সাধু হয়।
না-বাচকের পাঠক হয়।

Categories
2021-May-Poem কবিতা

অর্ণব রায়

ধ্বংসশহর: একটি অনুবাদ কবিতা

একবার আমাদের পুরোনো পিক আপ ভ্যান আর চার ক্রেট বিয়ার নিয়ে অসীমের প্রান্ত দেখব বলে বেরিয়ে পড়েছিলাম। সে-প্রান্তটি, দেখা গেল, এক অচেনা মহিলার বাড়ির সামনে দুম করে থেমে গেল। ইতিমধ্যে ক্রেটের সব বরফ গলে জল হয়ে গেছে। অছিলা নয়, সত্যি সত্যি বরফ চাইতেই সেই বাড়ির সামনে থেমেছিলাম। আদিগন্ত গমের খেতের মধ্যে সেই একখানা একক কাঠের বাড়ি। ফিকে হলুদ আর কালচে রং করা।

আমি কোনোদিনও ভুলব না সেই সামনের কাঠের বারান্দা। ঝোলানো হ্যামক। আইসড টি। ভাই লুসি, অতদূর তুই কোনোদিন যাসনি। অতক্ষণ গাড়ি চালানোর পরে অমন একজোড়া চোখ, চোয়ালের ধার, নরম গ্রীবা আর কখনো কেউ দেখেনি। আর কেউ কখনো অমনভাবে কারোর বলা কথার দিকে হৃদয় পেতে রাখেনি।

এইসব আগুনঝড় ভূমিকম্প পাতালের আগ্রাসন মিটে গেলে একদিন আমরা ওই বাড়িটার খোঁজে বেরিয়ে পড়ব। দড়জায় টোকা মেরে বলব, একটু বরফ পাওয়া যাবে আপনার কাছে? এক আধটা পিক আপ ভ্যান আর কয়েক ক্রেট বিয়ারও জোগাড় হয়ে যাবে নিশ্চই।

ভাই লুসি, ওই বুঝি শুরু হল। আগুনের হলকার মতো এক একটা বাতাসের ঝাপটা বুঝি আসতে শুরু করল। রাত থাকতে চক্রাকার লাল মেঘ বাবায়ারামের মাথার ওপর জমতে শুরু করেছিল। যেন আমরা জানতাম, শেষের শুরু এরকমটাই হবে।

আমরা এ-সব পাশে নিয়েই রাস্তায় হেঁটে বেরিয়েছি। কিছু যে হবে, তা আমরা জানতাম। কিন্তু বিশ্বাস করতাম, কিছুই হবে না। আমাদের জানা আর বিশ্বাসের মাঝে এখন গরম হাওয়া বইছে। গা যেন পুড়ে যাচ্ছে।

এখন কবরস্থানের পাশে গিয়ে প্রার্থনা করার সময়। যে যার পাপের জন্য নিজ নিজ মাপে শাস্তি চেয়ে নেওয়ার সময়।

কিন্তু যদি কেউই না দেখছে, প্রার্থনা করে কী করব? ঈশ্বর এ-শহর ছেড়ে স্মিথদের ওয়াগনে চেপে চলে গেছেন।

যেন এক বিষণ্ণ মেলায় মাঝরাতে এসে উপস্থিত হয়েছি। এখানে লোকের মুখ নিথর। নাগরদোলা থেকে বিষণ্ণতা উপচে পড়ছে। খেলনার দোকান থেকে দুঃখের ফেনা ভসভস করে বেরিয়ে আসছে। আলোগুলি উজ্জ্বল কিন্তু ফিনফিনে কালো চাদরে ঢাকা। ডাঁই করে রাখা খাবারগুলি পাথর হয়ে গেছে। ছুঁয়ে দিলে ভেঙে যাবে।

আমরা, মানে আমি মার্থা আর বাচ্চারা একবার এই মেলায় এসেছিলাম। প্রচুর জিনিস দু-হাত ভরে কেনার পর, এখানেই আমাদের মধ্যে কিছু একটা বিষয় নিয়ে তীব্র ঝাঁঝালো ঝগড়া শুরু হয়। সেই ঝগড়া শুরুর মুহূর্ত থেকে মেলাটি সেই অবস্থায় স্থির হয়ে আছে। আর ধীরে ধীরে ভঙ্গুর পাথর হয়ে যাচ্ছে।

ভাই লুসি, সেই থেকে একটি ঘামে চটচটে মেলায় আমি পথ হারিয়ে ফেলি। সম্পূর্ণ ফাঁকা মাঠে অসংখ্য গলিপথ সৃষ্টি হয়। অগুন্তি ফেরিওয়ালা তাদের বেলুন, বুদবুদ, খেলনা বাঁদর নিয়ে আমার মুখের ওপর ‘পিকাবু’ বলে উঁকি দিয়ে যায়। অচেনা মুখের পাথর আমি রোজ দেখি।
আজ তোর সাথে মেলায় এসেছি। আজ আবার মেলা চালু হবে। এ-পর্যন্ত সরল আজ আমরা হব।

প্রবীণ বয়সে এসে হোমার অন্ধত্বের গুরূত্ব বুঝলেন। সারাজীবন আলোর জন্য হাহাকার করেছেন। সারাজীবন তার কল্পিত জগৎকে একবার দেখার জন্য আকুলি বিকুলি করেছেন। শেষ জীবনে এসে বুঝলেন, আলো নয়, আলোয় উদ্ভাসিত প্রিয়মুখ, ঘরবাড়ি বস্তুপুঞ্জ— কিছু নয়। অন্ধকারই আসল রূপ। নিকষ সীমাহীন অবয়বহীন কালো। এখন তিনি সেই অন্ধকারের ওপর অন্ধকার দিয়ে আঙুল নেড়ে নেড়ে আলপনা আঁকেন।

ভাই লুসি, আমরাও কি সেরকমই কোনো অন্ধত্বে ডুবে গেছি? দেখতে পাচ্ছি কি পাচ্ছি না তা-ই বুঝতে পারছি না। আলো আঁধার গোধূলি সকাল সাদা কালো ধোঁয়া ধূসর— কিচ্ছুটি এখানে নেই। এখান বলতে ঠিক কোথায় তা-ও স্পষ্ট নয়। পৃথিবীর বুক থেকে আমাদের শহর স্বেচ্ছায় গুটিয়ে নেই হয়ে গেছে। শহরের স্মৃতিও আর আমাদের মধ্যে নেই।

লুসি, আমি তোকে ডাকছি, কথা বলছি বটে, তুই আদৌ আমার সাথে শোনার দূরত্বে আছিস কি না জানি না। গাধাটি কোথায় গেল? আমিই-বা কই?

এ-সবের মাঝে হোমারই-বা কী করছেন? কী লিখছেন?

প্রথম ক-দিন ওরা খুব ঈশ্বর ডেকেছিল। ওরা, যে যেরকম, মাটিপূজারী, পাখিবাদী, ব্যথাসঞ্চয়ী, অবিশ্বাসী— যে যার মতন করে প্রাণ থেকে আবেদন পৌঁছোনোর চেষ্টায় ব্যস্ত ছিল। একদিনও কোনো গাছতলা, গুহা, পাতালঘর, যাদুর মাধ্যমে রোগ সারানো— একটি দরবারের একটি সিটও খালি যায়নি। লোকে রাস্তায় হাঁটু ভেঙে ভেঙে বসে পড়েছে যখন তখন।

প্রথম যেদিন বাবায়ারামের মাথা নড়ে উঠল, তার প্রায় একমাস আগে থেকে চৌকো টেলিভিশনের ভেতরে থাকা মেয়েটি হাত পা নেড়ে আমাদের নীচে, মাটির তলায় সান্দ্র আগুনের চলাচলের কথা বলে আসছিল। শহরের কেউ শুনতে পায়নি। শহরের সকলে সকাল হলে গাড়ি নিয়ে ট্রাফিকের মধ্যে লাফিয়ে পড়তে, বিকেল হলে সেই ট্রাফিক ভেঙে ভেঙে বাড়ি ফিরতে, সপ্তাহ শেষে আবার সেই গাড়ি নিয়ে সমুদ্রের জলে পা ডোবাতে বেরিয়ে পড়তে ব্যস্ত ছিল। রেস্তোঁরাগুলি প্রতি সন্ধ্যায় মানুষের সমবেত গুনগুনানিতে গুনগুন করছিল। প্রথম যেদিন বাবায়ারামের মাথা নড়ে উঠল, টেলিভিশনের ভেতরে থাকা মেয়েটি সেদিন আর হাত পা নেড়ে কিছু বলার চেষ্টা করল না। সেদিন তার ঠোঁটের একপাশে এক নীরব আধখানা হাসি ফুটে উঠল। সেদিনও গোটা শহরে তাকে দেখার কেউ ছিল না। সকলে, যে যেখানে ছিল, স্তব্ধ বিস্ময়ে বাবায়ারামের মাথার দিকে তাকিয়ে ছিল।
ঈশ্বর ডাকার পর্ব একদিন শেষ হলে সকলে শুঁড়িখানায় গিয়ে ভিড় জমাতে শুরু করে।