Categories
2021-May-Poem কবিতা

সুস্মিতা কৌশিকী

সময়

কোথাও তীব্র বাজছে মুহূর্ত
নদী না, ডোডো পাখির সঙ্গম না, প্রচ্ছন্ন আভাস না
ব্যবহারিক অথবা অপেক্ষাকৃত জান্তব গতির অসঙ্গতি
মর্মান্তিক ভুলের কাছে গুটিয়ে যাচ্ছে চিৎ কণিকারা

মনে হয় হার মানতে নারাজ; এক ডানাভর
ঝুপ করে নেমে আসা মাছরাঙা ঠোঁট
তখনও কিছুই তেমন গুছিয়ে তোলা হয়নি
ছোঁ মেরে নিয়ে গেল

দেখে কাতর লাগে; তৃষ্ণার ছিল কিছু বাকি
আপৎকালীন, প্রিয়তার মুখ, যাপনের যৎকিঞ্চিৎ সঞ্চয়
প্রত্যাশার জন্ম-জড়ুল ছুঁয়ে ছেলেমানুষি জিদ

তবু একরোখা; বর্তুলের ভিতর ঢুকে পড়া ছিপ
তুলে নিল নিখুঁত ব্যবধানে
নিমেষ, শূন্যতা, অনাদী, বিষণ্ণ।

বৃদ্ধ গাছ ও স্বতন্ত্র কুঠার

গাছটার বয়স হয়েছে যথেষ্ট
গায়ে ধরা পোকা খুঁটে খায় রঙিন কাঠঠোকরা
এদিক ওদিক সুযোগসন্ধানী পরগাছা ধরেছে জাপটে
দুটো ডাল দুঃখের স্মৃতির মতো আটকে রয়েছে বেহায়া শরীরে

তবু সামান্য স্নেহগন্ধ বৃষ্টিতে এখনও কেমন মেলে ধরে ডানা
ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে আকাঙ্ক্ষার নবপত্রিকা
ফল মুখে উড়ে আসে বিবিধ গোপন পাখি
ডালে বসে, গান গায়
আহ্লাদের খড়কুটো নীড় গড়ে তোলে
সালতামামির প্রজনন শেষে সুখের উড়াল

এ-সবই ক্ষণকালের জাদুবাস্তবতা— গ্রাহ্য করে না
সারাবেলা সজাগ অতন্দ্র কাঠুরিয়া,
হাতে নিয়ে স্বতন্ত্র কঠিন কুঠার।

অক্ষয় বৃক্ষচরিত

যেটুকু দিয়েছ ভোগ সেটুকুই, এর বেশি যাঞ্চা করিনি
ফিরেয়ে দিতে পেরেছি লাবণ্য আকর, মাটি ও উর্বরতা
অনীহা উদাসীনতপ উপেক্ষার অনুপূর্ব যাতায়াতে
মুখ ঘুরিয়ে চলে যাইনি ইচ্ছামৃত্যুর ললিতসভায়
হাতে ধরানো ফেরারি সুইসাইডনোট নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছি একা—
ত্রিভুবন শয্যার পাশে দৃশ্যহীন বাহুডোরে, যেমন দ্যুতিহীন শ্লীল কঠোরতা আপন হয় অক্লেশে।

মানুষের স্বার্থপরতা দেখেছি, পরশ্রীকাতরতা, উল্লাস
সব ছেড়ে নিজস্ব নির্বান ঘিরে ঐশী বিভার পরন্তপ
দেহপল্লব, সুতনু ঘ্রাণ, চিন্তার মণিকোঠায় জলজ প্রকরণ।

সুদৃশ্য মাইলফলকে অতিক্রমহীন দূরত্ব জ্ঞাপক গেঁথে
পাড়ি দিয়েছি দুরূহ প্রব্রজ্যা, ঋতুপর্ণ মন্থনের কালে
এই দেহ সন্ন্যাসে গোপনে রাখিনি কোনো যৌন-শঙ্খল সাপ।

কেবল হাওয়ার আদলে বদলে গেছি থেকে থেকে, আর
শব্দযোনী খুঁড়ে তুলে এনেছি ওঁ-কার
ব্যথা ভুলবার মন্ত্রে রচিত হয়েছে অক্ষয় বৃক্ষচরিত।

কণ্ঠিবদল

ভেঙে ছিল আবাল্য প্রেম তারুণ্য বিভাজিকায়
দোহাই সৌন্দর্যহীনতা
তারপর একে একে গেছে সব প্রেম, সংসার আবিল
ভেঙেছে যাবতীয় ক্ষোভে ও অভাবে
পথে পথে ঘুরে হাতবদলের ফেরে হয়েছে পতিতা
শরীর ছুঁয়েছে অযুতে, অধরাই থেকে গেছে মন
নেই মান
মানুষের সমাজে ঘৃণ্য সমান।

শেষে এক অন্ধ বাউল
হাত ধরে নিয়ে যায় মাটির কুটিরে
আকাশপ্রদীপ জ্বলে, উদ্ভাসিত একতারা
মন দিয়ে ছুঁয়ে দেয় মন, মাটির নিরালায়
শত শঙ্খ বাজে যে-আঁধারে, অলৌকিক উলু,
তুলসী কাঠের মালা হিরেমোতি আলোর বাহক
যাপন বিন্যাসে গেয়ে ফেরে পথে পথে
বাজে খঞ্জনি দেহতত্ত্ব গানে
সুন্দর হয়েছে সত্য, সত্য‌ অমর্ত্য।

বেঁচে থাক আত্মার বাঙ্ময় আলো, দেহকাঁচা, ফকিরাত।

ব্যক্তিগত জার্নাল

জানাও— কতটুকু আঁধার, কতটুকু অনালোক। আঁধারে বাজুক সেতার সর্বভুক, অনালোক ছুঁয়ে ফেলো সন্ন্যাস জোছনায়। তলিয়ে যেতে যেতে তোমার সিংহকেশর পৌরুষ শাসন করুক আমার ভূলোক দ্যুর্লোক। অমার্জিত প্রেমে বনেচর জীবন ডায়নার খরস্রোত। আমাকে বখে যেতে দাও।

পূর্বজন্মের কথা মনে পড়ে। আহা! জলজ মীন জীবন। পলকহীন চোখে দর্পণের পিপাসা। ইন্দ্রিয়গুলো একে একে মরে যেতে থাকে। স্পর্শ পাখনা ক্ষতিগ্রস্থ হলে জলতল ভুল হয়ে যায়, যেভাবে গন্ধ মরে গেলে বাঁচেনা প্রেম। প্রতিকূল নয় কিছুই, কেবল ধর্মের শিঙা বাজাতে শিখিনি বলে…

আমাকে থামিয়ে দিয়েছ বিনাশরেখা থেকে সংকটপূর্ণ দুরত্বে। রোজ একটু একটু পরখ করে নিই, কতটা অবলম্বনহীন বেড়ে ওঠে বিরুৎজীবন। মুখ লুকোবার পরিসরে পাথর খাদান। তবু ব্যভিচারী আঙুলগুলো সেজে ওঠে অভয়মুদ্রায়।

Categories
2021-May-Poem কবিতা

মণিশংকর বিশ্বাস

ফল

রোদের জটা থেকে ছিটকে ওঠে কয়েকটি শালিখ
‘একি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ’ কিশোরীর মতো ধানখেত একা শিস দেয়
গোলাপ ফুলটি আসলে ততটা বড়ো, যতদূর তার সুগন্ধ
বহুদূর হতে আকাশে জীবন্ত কোনো গ্রহ তাকে প্রেম নিবেদন করে।
এইসব মিলেমিশে থাকে আমার ভিতর—
বাইরে থেকে বোঝাই যায় না এই মিলমিশ—
একটি বৃহৎ সংখ্যা যেরকম দুই বা দুইয়ের অধিক ক্ষুদ্রতর সংখ্যার যোগফল।

অশোকনগর

ভালোবাসি— এই ব্যক্তিগত বোধগম্যতার আঁধারে
একটি জোনাকি ক্রমাগত জ্বলে বা নেভে।
বরষাঘন চোখের মতো পুকুরের ধারে
দাঁড়িয়ে রয়েছি, ভিজে কুকুরের আনুগত্য নিয়ে।
সাইকেলে বাঁধা বেলুনগুচ্ছের মতো
কী যেন একটা
ছটফট করে, উলটো দিকে ছুটে যেতে চায়।

তোমার চোখের বিন্দুবিসর্গ আমার ভালো লাগে

আমি চাই ও-দু-খানি চোখ জানালা দিয়ে এসে
আমাকে তুলে নিয়ে যাক

…নিয়ে যাক তোমার নিজ্‌ঝুমে, অশোকনগর।

কলাবউ

তোমাকেই পেতে চেয়ে বাকি সব আগডুম বাগডুম
এই শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকও চলে গেল
তুমি সেই দেহতত্ত্ব গান।
সুন্দরের জলে ডুবে যেতে ইচ্ছে করে—

দুপুরের নির্জন খয়েরিনীল কচুরিপানায়
যেরকম ডুবে থাকে রাজহাঁস।
মনে পড়ে গত শতকের আশির দশক—
মানুষের যা যা দরকার, সব আবিষ্কার হয়ে গেছে
দুপুরবেলা আমিও আবিষ্কার করেছি কখন
প্রতিদিন তুমি শাড়ি খুলে উড়াও পাখির ঝাঁক
পুকুরের জলে মেশে বৃত্তাকার হলুদ
ওই উদ্বৃত্ত নাভিদেশ পরক্ষণেই অন্য মহাদেশ
বৃষ্টিবন…
পঁচিশ বছর দেখা হোক বা না হোক

আজও তোমার মুখের ’পরে
আমার সকল যৌনইচ্ছা খেলা করে।

প্রাক্তন

পুরোনো দিনগুলিকে দুর্বোধ্য সংকেত মনে হয়।

কী যেন ভুলতে হবে—
সারাক্ষণ মনে পড়ে।
রক্তের গভীরে ফোটা এই রক্তজবার মালা
অতর্কিতে দেবতার পায়ের দিকে চেয়ে
হাড়িকাঠের মান্যতা চায়
অন্ধের চোখের সাদা অংশের মতো ভয়
ও কালো অংশের মতো উদ্দেশ্যহীনতা
ছাগশিশুটির ’পরে ভর করে।

আমাদের সম্পর্ককে, অতঃপর, জলে ধুয়ে ফেলা রক্তের দাগ মনে হয়।

নিজের পুরোনো কবিতার মুখোমুখি

যখন পিছন ফিরি তোমাকে দেখতে
মনে করি এ কোন সময়?
তুমি কি গভীর নও তত
তবে কেন এত জল, এত কান্না উপচে পড়ছে?
ফার্নপাতা, শ্যাওলায় ঢেকে গেছে প্রেমিকার চুল
পাথরের শ্বেতাভ হাসির দাগ লেগে আছে
ওই মর্মরজটিল বেদেনির ঠোঁটে…
লতানো ফুলের গাছ থেকে
ঝরে পড়ে ফুল, আরও শাদা ফুল।
একটি গোখরো হিলহিলে, সহসা উঁকি মারে
সবুজ পিচ্ছিল অক্ষরের ফাঁকে

অধীর প্রশ্নবোধক চিহ্নের মতন।