Categories
2021-NOVEMBER-INTERVIEW

বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায়

“রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে কথা বলার মতো প্রজ্ঞা বা চর্চা বাঙালির কমে এসেছে।”

আলাপচারিতায় পার্থজিৎ চন্দ

দ্বিতীয় পর্ব

পার্থজিৎ: আপনি সংগীতের অন্দরমহলের মানুষ। সেদিন রবীন্দ্রনাথের ‘গীতবিতান’ খুলে একটা গান (‘সন্ধ্যা হল মা গো’) পড়তে পড়তে দেখলাম রবীন্দ্রনাথ ‘স্নেহ’-র আগে ‘অতল কালো’ ব্যবহার করেছেন। জীবনানন্দ দাশ যে-কোনো ভাষার যে-কোনো সময়ের মহান কবিদের মধ্যে থাকবেন সে নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু জীবনানন্দের পর রবীন্দ্রনাথের কাব্য-কবিতার বিষয়ে এক বড়ো অংশের শিক্ষিত বাঙালির মধ্যে উদাসীনতা তৈরি হল… জীবনানন্দীয় আধুনিকতাকেই তারা একমাত্র আধুনিকতা বলে মনে করতে শুরু করল।
বিশ্বদেব: এ নিয়ে কী বলব আমি জানি না, তবে আধুনিক হওয়ার জন্য খুব বেশি চেষ্টা করার দরকার আছে কি? যে-কোনো বড়ো কবিই তাঁর সময়ে নতুন এবং সে-জন্যই আধুনিক। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সময়ে আধুনিক ছিলেন, চণ্ডীদাসও তাই-ই ছিলেন।

পার্থজিৎ: আমি আরও স্পেসিফিক করে একটু আপনার থেকে জানতে চাই দু-একটি বিষয়… যেমন ধরুন রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে বাঙালির সমস্যা নেই, ছবি কতটা বাঙালি বোঝে জানি না, কিন্তু ছবি নিয়েও সমস্যা নেই… ছোটোগল্প থেকে শুরু করে প্রবন্ধ উপন্যাস ইত্যাদি নিয়ে সমস্যা নেই; কিন্তু জীবনানন্দ-পরবর্তী সময়ে একদল গবেষক-পণ্ডিত রবীন্দ্রনাথের কবিতার বিষয়ে একধরনের উদাসীনতা তৈরি করতে সমর্থ হলেন।
বিশ্বদেব: আমি তোমার প্রশ্নটি বুঝতে পারছি… তবে তুমি যে বলছ রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে বাঙালির কোনো সমস্যা নেই, আমার কিন্তু কারণ হিসাবে অন্য কথা মনে হয়… আসলে রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে কথা বলার মতো প্রজ্ঞা বা চর্চা বাঙালির কমে এসেছে। প্রবন্ধের ক্ষেত্রেও তাই। আমার ব্যক্তিগত মত, একটা দুটো ব্যতিক্রম বাদ দিলে, রবীন্দ্রনাথের পর ওই উচ্চতার প্রবন্ধও আর লেখা হয়নি। যে-বাঙালি গান শোনেন তাঁদের মধ্যে ক-জন মন্তব্য করবার মতো স্তরে আছেন সেটা নিয়ে ভাবা দরকার। এক সময়ে জীবনমুখী গান নামে একটা প্রবণতা শুরু হয়েছিল (শেষও হয়ে গেছে মনে হয়…), এমনকী ক্লাসিক্যাল মিউজিকের কিছু মানুষ, যাঁদের ধারণা হয়েছিল যে, তাঁরা গান বোঝেন, ঠিক এই কাজটিই করেছিলেন। তাঁরা রবীন্দ্রনাথকে আন্ডারএস্টিমেট করতে শুরু করেন। অনেকের মতো আমিই বিশ্বাস করি রবীন্দ্রনাথের মহত্তম সৃষ্টি হচ্ছে তাঁর গান… আরও একটা জায়গা… তাঁর নাটক।

পার্থজিৎ: হ্যাঁ, এগুলো তো আছেই, তবে রবীন্দ্রনাথের কবিতা নিয়ে সচেতন উদাসীনতা মাঝে মাঝে অবাক করে দেয়…
বিশ্বদেব: আসলে রবীন্দ্রনাথের কবিতায় যে-কাহিনিধর্মিতা তাকে এ সময়ের কবিতার ক্ষেত্রে একটা বড়ো ডিসকোয়ালিফিকেশন বলে ধরা হয়। কিন্তু আমি নিজেও বুঝতে পারি না মানুষ কেন এমন এক ভার্ডিক্ট বা ডিকটামকেই অ্যবসলিউট মনে করে! কাহিনি মানেই আর সব উপাদান ছেড়ে তাকে বাতিল করে দেওয়া হয়, অথচ ‘কিনু গোয়ালার গলি’ তো এখনও আমার কাছে অদ্ভুত হৃদয়স্পর্শী কবিতা। কিন্তু ইউরোপ তো টেনিসন বা কোলরিজের কাহিনিধর্মী কবিতা সম্পর্কে এ-কথা বলে না… তারা জানে কবিতার বিবর্তনের ইতিহাসে ওই বিষয়টা কত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমরা আজকে যাকে আধুনিক কবিতা বলছি তার সেই ফর্মকে ধীরে ধীরে আবিষ্কার করতে হয়েছে। অথচ তুমি একবার ভাবো সেই যে কবিতা… রবীন্দ্রনাথ লিখছেন ‘আজিকে হয়েছে শান্তি জীবনের ভুলভ্রান্তি…’ (‘মৃত্যুর পর’)… কল্পনা করা যায় এই লেখা! এ যেন হঠাৎ কোথা থেকে মৃত্যুর স্তব্ধতা নেমে এল, অথচ কী গভীর রহস্যময়… কী গভীর বেদনা। আসলে কি জানো, বীণা যে বাজবে তার আগে তাকে বেঁধে রাখতে হবে তো… রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বেজে ওঠা কি সোজা কথা?

পার্থজিৎ: মানে পাঠককেও তৈরি হয়ে উঠতে হবে অবিরত…
বিশ্বদেব: হ্যাঁ, এটাই… এটাই। না বাঁধলে রেসোনেট করবে কী করে? এ-প্রসঙ্গে একটা কথা মনে পড়ল, আব্দুল করিম খাঁ সাহেবের কথা… কিরানার বাড়িতে রয়েছেন আব্দুল করিম খাঁ সাহেব। বাংলার একজন সংগীতসাধক গেছেন তাঁর কাছে গানের আরও পাঠ নিতে। তো হল কী বাড়ি খুঁজতে খুঁজতে তিনি দেখলেন মাথায় পাগড়ি পরা একজন লোক গাছের নীচে বসে ‘সা…সা’ সেধে চলেছেন। সামনে একটা তানপুরা রাখা রয়েছে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করবার পর সংগীতসাধক জিজ্ঞেস করলেন, ‘আব্দুল করিম খাঁ সাহেবের বাড়িটা কোথায় বলতে পারেন?’ …যে-লোকটি গাছের নীচে বসে সুরসাধনা করছিলেন তিনি বললেন, ‘বোসো… আমিই আব্দুল করিম খাঁ…’। সংগীতসাধকের ভিরমি খাওয়ার অবস্থা, তিনি কোনো রকমে বললেন, ‘আপনি যদি আমার গুস্তাকি মাফ করেন তো একটা কথা জিজ্ঞেস করব? এটা কী করছিলেন আপনি? আপনার মতো একজন শিল্পী এতক্ষণ ধরে ‘সা…সা’ করে চলেছেন…!’ আব্দুল করিম বললেন, ‘আমি সুরচর্চা করছি, সা-কে খুঁজছি… এই দেখ…’। বাংলা থেকে করিম সাহবের খোঁজে যাওয়া সংগীতসাধক দেখলেন, তানপুরার উপর ছোট্ট একটা কাগজ ভাঁজ করে রাখলেন আব্দুল করিম খাঁ… তারপর ‘সা…’ ধরলেন আর সঙ্গে সঙ্গে তানপুরার তার থেকে লাফিয়ে পড়ে গেল কাগজটা। এই হচ্ছে পারফেকশন, এই হচ্ছে আব্দুল করিম খাঁ-র সঙ্গে বেজে ওঠা… কিন্তু তার জন্য তো বাঁধতে হয়েছে তানপুরার তার। যে-বাঙালির বাংলার সংস্কৃতির প্রতি কোনো ভালোবাসা নেই সে রবীন্দ্রনাথকে বুঝবে কী করে? একটু অন্যরকমভাবে বললে বলতে হয়, আমাদের বোধের টেস্টবাড্‌সগুলিই নষ্ট হয়ে গেছে। আমি নিজে খুব সামান্য লেখক, কিন্তু সারাজীবন এর বাইরে যেতে পারলাম না; যাবার প্রয়োজনই হয়নি আমার। আমি বাংলার যে-কোনো প্রান্তে বসে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রান্তসীমা পর্যন্ত দেখতে পাই। আমার বাংলা এত সুন্দর, এত মহৎ। বাংলার প্রতি এই ভালোবাসা কোথায় এখন? রবীন্দ্রনাথের গানের মধ্যে যে-অপূর্ব লালিত্য রয়েছে, তার সুরের মধ্যে যে-বিস্তার রয়েছে তাকে ঠিকঠাক আবিষ্কার করতে না-পারলে ওই জীবনমুখী গানই হবে। আবার শুনলাম কোনো এক শাস্ত্রীয় সংগীতের পণ্ডিত নাকি মন্তব্য করেছেন, ওঁর সবই ভালো, শুধু সুরগুলি ভালো নয়। তাঁর এতই স্পর্ধা যে, রবীন্দ্রনাথের গানের সুর বদলে তিনি গাইতে চেষ্টা করবেন।

পার্থজিৎ: এই মূঢ়তার দিকে তাকিয়ে শুধু ক্ষমা করে দেওয়া ছাড়া আর কিছু করার আছে বলে তো মনে হয় না…
বিশ্বদেব: একজন মানুষ তার অস্তিত্বের বিন্দুটিকে অস্বীকার করে কবি কেন, কিচ্ছু হতে পারেন না। আমার সমস্ত শরীরের ভেতর দিয়ে এই বাংলার অনুভবই তো বয়ে চলেছে। ধরো একটা কোকিল যেভাবে গায় একটা কাক সেভাবে গাইতে চেষ্টা করলে কিছুতেই পারবে না। কিন্তু এটিই কি একমাত্র সত্যি? একটা কোকিলও কি কাকের মতো গাইতে পারবে? যে-মানুষ প্রকৃত সৌন্দর্যপিপাসু সে জানে কাকের ডাকও কত মধুর।

পার্থজিৎ: আপনার ‘গাছের মতো গল্প’ বইটি পড়তে গিয়ে বার বার দেখছিলাম, আমি নরনারীর প্রেমের কথাই বলছি, টলটলে এক প্রেম… সে-প্রেম ছায়া ফেলে যাচ্ছে আপনার জীবনে… কিন্তু সেখানে যৌনতার প্রকাশ্য উদ্‌যাপন উল্লেখ্যভাবে কম। আপনার কবিতায় যৌনতা এসেছে জলের ভেতর মিশে থাকা জলরং আলোর মতো। এতক্ষণ রবীন্দ্রনাথ নিয়ে কথা হচ্ছিল, তিনি প্রেম ও পূজার মধ্যে অভিন্নতা দেখতে পেয়েছিলেন… আপনিও কি প্রেম ও পূজার মধ্যে এই অভিন্নতা দেখতে পেয়েছিলেন?
বিশ্বদেব: একদম… শুধু একটা কথা বলি, আমার মনে হয় যা সত্য সে-সম্পর্কে লজ্জিত হবার কিছু নেই। কারণ, কোনো সত্যই আমি ঘটাইনি। দ্বিতীয়ত, যা গভীর শ্রদ্ধার ও আনন্দের তা নিশ্চিতভাবে ঐশ্বরিক। অনাদি অনন্ত সৃষ্টির যে-রহস্য… এই সৃষ্টিকে যে বহন করে নিয়ে যাচ্ছে… সে-যৌনতা কখনো নিন্দনীয় হতে পারে? আমি নিন্দনীয় হতে পারি… আমার মনকে নিন্দনীয় করে তুলতে পারি; কিন্তু ওই সত্য কখনো নিন্দনীয় হতে পারে না।

পার্থজিৎ: এর মধ্যে পাখোয়াজ ও সেতার বেজে যাবার আনন্দ রয়েছে তাহলে…
বিশ্বদেব: একদম, বললেন যখন একটা কথা বলি… ধরুন বেহাগ… তার মধ্যে কি শুধু অন্য রসগুলিই এল? শৃঙ্গার এল না? আমাদের শাস্ত্রে যে-নবরসের কথা বলা হয়েছে তার মধ্যে রস-শ্রেষ্ঠ হল শৃঙ্গার… ফলত আমি নিজে একে অপবিত্র মনে করি না। বসন্তে যখন সারা প্রকৃতি নেচে ওঠে, মাতোয়ারা হয়ে ওঠে, কোকিলের কুহুতান শুনি তখন কি তার মধ্যে শৃঙ্গার রস থাকে না? শৃঙ্গার বাদ দিয়ে একে কল্পনা করলে তো তা অপূর্ণ হতে বাধ্য। আমি নিজে কখনো এর থেকে দূরে থাকতে চাইনি; আবার এর মধ্যে মানুষের আরোপিত যা কিছু কদর্যতা তার থেকে নিজেকে দূরে রেখেছি। সত্যি কথা বলতে, আমার ভাবনাতেও এই কদর্যতা আসে না। এটা যে আমি খুব মহৎ মানুষ বলে হয়ে থাকে তা নয়; আসলে আমি জানি যে একবার ওই কদর্যতা প্রবেশ করলে আনন্দটা হারিয়ে যাবে। বেহাগ আমার প্রিয়তম রাগ; কিন্তু বেহাগের মধ্যে তো কোনো কদর্যতা নেই। আমি আরও বলতে চাই, প্রশ্ন করতে চাই, যে-কোনো নারীর নগ্ন মূর্তি কি কদর্য? সে-সৌন্দর্য ঐশ্বরিক। শৃঙ্গারকে যারা নিন্দনীয় বলে মনে করেন তারাই একে কদর্য করে তোলেন।

পার্থজিৎ: শাস্ত্রীয় সংগীতে আপনার সুগভীর দখল, আপনি কি কোনো গুরুর কাছে শিষ্যত্ব নিয়ে সংগীতশিক্ষা করেছিলেন?
বিশ্বদেব: সেটা খুব অল্প সময়ের জন্য, আমি কলেজ থেকে পাস করে বেরোবার ঠিক আগে অল্প সময়ের জন্য শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রাথমিক শিক্ষা নিয়েছিলাম পণ্ডিত সুভাষ রায়চৌধুরীর কাছে। তিনি আগ্রা ঘরাণার ওস্তাদ আতা হোসেন খাঁ-র শিষ্য ছিলেন। যদিও আমি তার আগে থেকেই রাগ ইত্যাদি চিনতে পারতাম।

পার্থজিৎ: অনেকেই জানেন, আবার অনেকেই জানেন না যে, আপনি কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের দৌহিত্র। শৈশব যৌবনের অনেকটা সময় তাঁর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে আপনার কেটেছে। যে-গুটিকয়েক বাঙালি লেখক চৌকাঠ ডিঙিয়ে বাঙালির অন্দরমহল পর্যন্ত প্রবেশ করতে পেরেছিলেন তার মধ্যে তারাশঙ্কর অন্যতম। তাঁর লেখার গান ও সুরের ব্যবহার উল্লেখ্য। আপনার কি কোথাও মনে হয় যে, এটা আপনার ক্ষেত্রে প্রাথমিক উৎসাহ ও ভিত তৈরি করতে সাহায্য করেছে?
বিশ্বদেব: আমার গানের প্রতি ভালো লাগা শুরু হয় রবীন্দ্রসংগীত, জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামীর মাধ্যমে… তারপর ওস্তাদ বড়ে গুলাম আলি-র গান… রাধিকামোহন মৈত্রর সরোদে মজে ছিলাম খুব। তারাশঙ্করের যে-গান, সে-সম্পর্কে আমার একটু অন্য ধরনের অনুভূতি আছে। ওঁর লিরিক্স অসামান্য, ওই জীবন যে উঁনি শুধু দেখেছেন তাই নয়, সমস্ত রস গ্রহণ করেছেন। ওই গানটির কথা বার বার মনে পড়ে, রবীন মজুমদারের গাওয়া ‘তোমার আয়না বসান চুড়িতে…’।

পার্থজিৎ: এই গান তো বাংলার কোণে কোণে বাজত রেডিয়োতে। মানুষ কান পেতে থাকত…
বিশ্বদেব: আর একটা গান… ‘ভালোবেসে মিটিল না সাধ… জীবন এত ছোট ক্যানে…’।

পার্থজিৎ: আমি বহু বহু মানুষকে এর উৎস না-জেনে ব্যবহার করতে শুনেছি… এটা একটা লবজ হয়ে গেছে বাংলায়…
বিশ্বদেব: মানুষের জীবনে এর থেকে বড়ো প্রশ্ন আর কী আছে! এবং দেখ কী সরলভাবে বললেন… আমি তারাশঙ্করের ক্ষেত্রে বলব, কী জটিল বিষয় নিয়ে তিনি লিখলেন, কিন্তু প্রকাশের মধ্যে কোনো জটিলতা নেই।

পার্থজিৎ: সেই সুদূর বীরভূমের গ্রাম থেকে উঠে এসে বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক হয়ে ওঠা… এই জার্নি তো আপনি দেখেছিলেন…
বিশ্বদেব: আমি খুব কাছ থেকে দাদুকে দেখেছি। আমরা কাছেই থাকতাম, পাইকপাড়া আর টালার দূরত্ব। তারপর বাষট্টি সালে আমার বাবা মারা যেতে আমরা দাদুর টালার বাড়িতে এসে উঠলাম। আমি জীবনে খুব বেশি বড়ো সাহিত্যিককে কাছে থেকে দেখার সুযোগ পাইনি; কিন্তু এই একটি মানুষকে কাছ থেকে দেখে বুঝেছিলাম একজন সাহিত্যিকের সব থেকে বড়ো মূলধন হল তার বিশ্বাসের ভূমি। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকাটাই তাঁর সততার লক্ষণ। তারাশঙ্কর অনেক কিছুই জানতেন না; হ্যাঁ, জানতেন না… বিজ্ঞানে তাঁর সামান্য ধারণা ছিল, বিশ্বের বড়ো বড়ো সাহিত্যিকদের বই পড়ে ফেলবার মতো পণ্ডিতি তাঁর ছিল না… তা হলে তিনি কীসের উপর দাঁড়িয়ে ছিলেন? একটা মাত্র গ্রন্থ যার থেকে সমস্ত জ্ঞান গ্রহণ করতে হয়— সে-গ্রন্থের নাম জীবন। তারাশঙ্কর ঠিক ওই গ্রন্থ থেকেই তাঁর পাঠ গ্রহণ করেছিলেন। আমার সামনেও একটি মাত্র গ্রন্থই খোলা থাকে— সেটি জীবন। আমি নিজেও বহু গ্রন্থ পাঠ করি এমন নয়, ভাবি বেশি। তার অনুষঙ্গে কিছু বই পড়ি। তাতে আমার অভিযাত্রা অনেক বেশি আনন্দের হয়।

পার্থজিৎ: সৃষ্টির সময়ে, মানে ধরুন একটা লেখার জন্য প্রাণপাত করে চলেছেন বা ভয়ংকর রকম ডুবে রয়েছেন… সে-সময়ে ঠিক কেমন দেখেছেন তারাশঙ্করকে?
বিশ্বদেব: আমরা তখন খুব ছোটো, আমরা বাগবাজারের একের এক আনন্দ চ্যাটার্জ্জী লেনের ভাড়াবাড়িতে… মানে দাদুর ভাড়াবাড়ি… দাদুর বাড়ি তৈরি হচ্ছে টালায়… আমার মনে আছে বাগবাজারের ভাড়াবাড়ির দোতলায়, একটা সাবেককালের ডেস্ক নিয়ে এক চিলতে বারান্দায় লিখে চলেছেন তারাশঙ্কর। আমি, আমার দিদি শকুন্তলা ও আমার এক মামাতো ভাই— তিনজনে লাফালাফি তুলকালাম কাণ্ড করছি। কোনো দিনের জন্য সেই ঋষি বিন্দুমাত্র বিরক্ত হয়েছেন বলে আমার মনে পড়ে না। সাবেককালের খাটের বাজু ধরে ঝুলোঝুলি করছি আর সেই খাটে বসেই উঁনি লিখছেন; বিরক্ত হতে দেখিনি। বাংলা সাহিত্যের মণিমুক্ত তখন সেখানে তৈরি হচ্ছে। পরে যখন ওঁর আরও নামডাক হল, মনে পড়ে সকালবেলা একটু লেবু-চা-বিস্কুট খেয়ে বসতেন। একটা বাঘছাল ছিল দাদুর, সম্ভবত তাঁকে ওটি দিয়েছিলেন ধীরেন্দ্রনারায়ন রায়… সে-সময়ে দেখতাম তাঁর চোখে এক অদ্ভুত উদাস দৃষ্টি। বেসিক্যালি গ্রামের মানুষ, ফলে লোকদেখানো ভড়ং ছিল না।

পার্থজিৎ: এটিই কি তাঁর সব থেকে বড়ো কবজকুণ্ডল হয়ে উঠল? এই নাগরিক ভড়ং থেকে দূরে থাকার ফলে অক্ষরের মাধ্যমে তাঁর প্রকাশ আরও যথাযথ হল এবং মানুষ তাঁকে গ্রহণ করল দু-হাত ভরে?
বিশ্বদেব: একজন নাগরিক মানুষও বড়ো সাহিত্যিক হতে পারেন অবশ্যই; আমার মনে হয় একজন মানুষ যতক্ষণ পর্যন্ত-না স্বাধীন হচ্ছেন ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি নিজের কাজের প্রতি অনুরক্ত থাকতে পারেন না। সাধনার শেষতম কথা আপন মনে থাকা। এই আপন মনে কেউ থাকে না, সব পরের মনে থাকে।

পার্থজিৎ: উনিশশো অষ্টআশি সালের সতেরোই মে— এটি আপনার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা দিন। সেদিন আপনার চেতনার অনন্ত বসন্তোৎসব শুরু হয়ে গেল। তার কিছু আগে স্বামী ধ্রুবানন্দজির সঙ্গে আপনার সাক্ষাৎ, আজ কি কোথাও মনে হয় যে, এগুলি সবই পূর্ব-নির্ধারিত?
বিশ্বদেব: আসলে পূর্ব-নির্ধারিত কথাটির মানে আমার কাছে আজও পরিষ্কার হল না। ধরুন আপনি হেঁটে যাচ্ছেন, যেতে যেতে একটা জায়গায় দেখলেন একটি থাম রয়েছে। আপনি কি থামটিকে পূর্ব-নির্ধারিত বলবেন? আপনি যদি ওই জায়গাটি দিয়ে অতিক্রম না-করতেন তা হলে থামটিকে দেখতেই পেতেন না। এমনভাবে ভেবে দেখি, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অতীত থেকে অনাদি অনন্ত ভবিষ্যৎ— সবই চিরন্তন। এর পরিবর্তন নেই, ফলে নির্ধারণেরও কোনো প্রশ্ন নেই। ঈশ্বরই সব করেন, তাঁর পূর্ব-পর বলে কিছু নেই… তিনি তো আর সময়ের অধীন নন। আমি শুধু বলতে পারি, এই জীবনকে আমি দেখলাম, বুঝলাম… বুঝলাম, দেহের ভেতর যে আছে বাইরেও সে আছে। আসলে বাইরে-ভেতর বলেও কিছু নেই… জগতে কিছু হয়নি, কিছু হবেও না… অনাদিকাল থেকে জগতের একটি স্থির ছবি আছে। সেই স্থির ছবির আভাস আমরা থিয়োরি অফ রিলেটিভিটিতে পাই।

পার্থজিৎ: আপনার সঙ্গে কথা শুরু করলে অসংখ্য জিজ্ঞাসা মনে আসে, প্রশ্নের পর প্রশ্ন। ঠিক এখন যেমন মনে হচ্ছে, মৃত্যুবোধ বা মৃত্যুচেতনা যে-কোনো শিল্পের খুব গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। হয়তো সব শিল্পের শুরুও এখান থেকে। আপনি মৃত্যুকে খুব কাছে থেকে কখনো দেখেছেন?
বিশ্বদেব: আসলে মানুষ যতদিন বেঁচে থাকে মৃত্যু যে কত কাছে আছে এটা সে বুঝতে পারে না। আমার নিজের জীবনে সাংঘাতিক বিপদ ঘটেছে বেশ কয়েকবার, মোটর-অ্যক্সিডেন্ট হয়েছে দু-বার, তাছাড়া ক্যানসার পর্যন্ত হয়েছিল। কিন্তু এই কোভিড অতিমারির সময়ে আমার এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়। সেটা মনে হয় সবার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যায়; যদিও একটা কথা প্রচলিত হয়ে আছে খুব গূঢ় অনুভবের কথা মানুষকে বলতে নেই। তা হলে কি আমি মানুষের সঙ্গে শুধু অগভীর অনুভব ভাগ-বাটোয়ারা করব? আমি মৃত্যুকে দর্শন করলাম কিছুদিন আগে… আমি কোভিড আক্রান্ত হয়েছিলাম, দীর্ঘদিন খুব কষ্টের ভেতর ছিলাম। আমি এ-বাড়ির একদম শেষ ঘরে শুতাম, আমার স্ত্রী দূরত্ব বজায় রেখেও যথাসম্ভব দেখাশোনা করতেন পরম যত্নে। একদিন রাত্রে আমি ঘুম থেকে উঠে বাথরুমে যাচ্ছি; হঠাৎ হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম, অসম্ভব আঘাত অনুভব করলাম। সব অন্ধকার হয়ে গেল; পরক্ষণে বুঝলাম আমার স্ত্রী খুব কাছে থেকে বার বার বলছেন, ‘তুমি পড়ে গেছ… তুমি পড়ে গেছ’। আমি দেখছি আমার দেহ-টা পড়ে আছে ওই জায়গায় আর আমি বারান্দা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি… আমি আমার থেকে দূরে সরে যাচ্ছি… আমার থেকে পাঁচ-সাত হাত দূরে বড়ো প্রদীপের শিখা এগিয়ে যাচ্ছে। প্রদীপ নেই; শুধু শিখা। অদ্ভুত সোনালি-লাল এক আলোর আভা আর অন্ধকার। আমি তাকে অনুসরণ করছি, করিডোর যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকে দেওয়াল ভেদ করে বাঁ-দিকে চলে গেলাম; অনুভব করলাম এক আশ্চর্য ঠান্ডা ও শান্ত প্রকৃতির মধ্যে এসে পড়েছি। ওপরে নক্ষত্রখচিত আকাশ; ডান দিকে একটি পাহাড়। কিছু কালো কালো মানুষ মাথায় ভাঁড়ের মতো জিনিস নিয়ে অন্ধকারে হেঁটে চলেছে। তাদের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে দেখলাম ডান দিকের পাহাড়ের গা-বেয়ে নেমে আসছেন শ্রীকৃষ্ণ। নীলাভ গাত্রবর্ণ, হাতে বাঁশি… আমি কৃষ্ণকে চিনি। আমার দেখতে অসুবিধা হচ্ছিল, আমার চশমাটা পাচ্ছিলাম না। চশমা হারিয়ে গেছে ভাবতে ভাবতে হঠাৎ দেখি পাহাড়ের ঢাল বেয়ে কৃষ্ণ নামছেন আর তাঁর চোখে আমার সোনালি চশমা। আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, ‘প্রভু, এই জিনিস কি তোমাকে মানায়?’
তিনি বললেন, ‘তুমি যে বললে তোমার চশমা হারিয়ে গেছে? তাই আনলাম… এই নাও। কিন্তু তুমি এখানে কেন? ফিরে যাও…’
তাঁর কথা কোনো অনুরোধ নয়, স্টেটমেন্ট নয়… এক সত্য রয়েছে তার ভেতর। অনুভব করলাম ঘুরে আমি বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ছি, দেহের ভেতর ঢুকে গেলাম আবার।
এখন এটা শুনে একজন আমায় বলেছিলেন, ‘এটা আপনার মনে হয়েছে…’। তিনি সব থেকে সত্যি কথাটাই বলেছেন; কারণ, আমি এমন কিছু বলিনি যা আমার মনে হয়নি। যা মনে হয়নি তা বলাটাই মিথ্যাভাষণ। কিন্তু অনেকে যে-অর্থে এটাকে ‘বাস্তব নয়’ বলেন আমি জানি না এর থেকে বেশি বাস্তব আর কী। বাস্তবকে চিনতে গেলে তো তাকে মনে হতেই হবে। আমি নেই অথচ জগৎ আছে এটা ভাবা যায় না; জগৎ ও আমি একসঙ্গে আছি এটাই চিরন্তন অনুভূতি।

পার্থজিৎ: একদম শেষে এসে আপনি আর একটি মারাত্মক প্রসঙ্গের ইঙ্গিত দিয়ে গেলেন, ‘মনে হওয়া’ ও ‘ফলসহুড’কে এক করে দেখার যে-চেষ্টা তার দিকে আমাদের অন্যভাবে তাকাতে বাধ্য করলেন…
বিশ্বদেব: এই অবিশ্বাসের যুগে বিশ্বাসকেই অনুসরণ করেছি সারাজীবন। জ্ঞানের প্রধান তিনটি লক্ষণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়— বিশ্বাস, বিশ্বাসের কারণ ও তার বাস্তবিক সত্যতা। এই তিনটিকে পৃথক করে দেখা হয়। তৃতীয়টি হচ্ছে অবজেক্টিভ কন্ডিশন, এই সাবজেক্টিভ কন্ডিশনকে অবজেক্টিভ কন্ডিশন থেকে আলাদা করে দেখার প্রবণতা এখন সাংঘাতিকভাবে বেড়ে গেছে, সন্দেহের চেহারা নিয়েছে। এটা কোনো দার্শনিক-সন্দেহ নয়, হিংসা থেকে উৎপন্ন হওয়া সন্দেহ।

পার্থজিৎ: আপনি যে-অনন্ত আনন্দ ও আলোকিত জগতের মধ্যে রয়েছেন, যার স্পর্শ আমরা পাচ্ছি তা আরও অনেক অনেক দিন ধরে যেন পাই— এই চাওয়া। আপনার সঙ্গে কথা ফুরায় না…
বিশ্বদেব: ‘আমি যদি না থাকি’— এ-বেদনার কোনো অর্থ হয় না; এই আনন্দের ভেতর আমি খুব সুন্দর বেঁচে আছি। জীবনের অপূর্ণতা যা মনে হত একদিন, এখন আর তা মনে হয় না… জীবন খুব পূর্ণ।

প্রথম পর্ব