Categories
2021-NOVEMBER-PROSE

সম্প্রীতি চক্রবর্তী

ভূত কৌতুক: সাহিত্যে ও চলচিত্রে বাঙালি ভূতের চরিত্রায়ন

একটা বাংলা horror film-এর কথা ভাবুন। হিন্দি মূলস্রোতের মতো সাদা শাড়ি, বিরহ গান আর পাঁচটা অন্তরঙ্গ দৃশ্য মনে পড়ছে কি? একাকিনী বিধবা প্রলোভন দেখায় অমাবস্যার রাতে? নাকি বাংলা ভূত বলতে শ্যাওড়া গাছের মগডালে বসা চিতল মাছের পেটি হাতে শাকচুন্নি? ঘাড় মটকাবে, যদি না সে মাছ পায়, নিদেনপক্ষে একটা মোয়া বা নাড়ু তো লাগবেই! আসলে বাঙালি ভূতের পরতে পরতে একটা ব্যঙ্গকৌতুক রয়েছে, বাংলা সিনেমা বা সাহিত্যে তারই খানিক নাগাল পাওয়ার চেষ্টা এই প্রবন্ধে।

আজকের ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ বা ‘গয়নার বাক্স’ যেখানে ভূতে মোহর জোগায় পরিচালক কে, বা যক্ষের ধনের সন্ধান দেয় আটপৌরে তোতলা গৃহ স্ত্রীকে, তার পূর্বসূরি খুঁজলে পেয়ে যেতে পারেন যমালয় জীবন্ত মানুষ বা চার মূর্তি। মানলাম সেটা যমপুরি, ঠাকুর দেবতাদের সঙ্গে খানিক রঙ্গরসিকতা কিন্তু এখানেও যে পরলোক আর হাস্যরস মিলে মিশে আছে। চার মূর্তিতে আপাতদৃষ্টিতে ভূত নেই, সে যতই টেনিদা বাংলোর কেয়ারটেকারকে দেখে ভিরমি খাক, তবু ভৌতিক আবহাওয়া তৈরি হয় স্বামী ঘুটঘুটানন্দের প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টায়। চারমূর্তি জঙ্গলঘেরা বাসায় অনেকটাই ভীত সন্ত্রস্ত। তবে ক্লাসিক ছবি অবশ্যই ‘ভূতের রাজা’, যার হাসি চিরমলিন। তিনটি গুপি বাঘা ছবিতেই ভূতের রাজাকে হাসি ছাড়া কল্পনা করতে পারেন? ভূতের নাচ একবারেই ভয়াবহ নয়, পেট মোটা পাদ্রী ভূত যখন নাচে তখন পেছনের আবহসংগীত লক্ষ করেছেন? চমক রয়েছে, সঙ্গে অভিনবত্ব, তবে নেই কোনো শীতল শিহরণ। এইসব ভূতই অতি সজ্জন ও পরোপকারী। বাংলা ধারাবাহিকেও তার প্রভাব এসে পড়ল। দু-টি পপুলার বাংলা বিনোদনের চ্যানেলে ‘ভূত ঠাকুমা’ আর ‘ভূত দাদু’ পেশ করা হয়েছিল কয়েক বছর আগে। তারা পুরোনো আমলের পোশাক পরে ধারাবাহিকের মূল চরিত্রকে সাহায্য করে, কখনো হাসির উদ্রেক ঘটায়, কখনো প্রেমে পড়ে, হুকো সেবন, প্রাতঃভ্রমণ কিছুই বাদ নেই। ‘ভূতের ভবিষ্যত’-এ তো অশরীরীর মজলিস, তাও প্রত্যেক সংলাপে হাসি পায়, ক্ষুরধার হিউমার যাকে বলে। ‘গয়নার বাক্স’-তে মৃত পিসিশাশুড়ি নাতবউমাকে আপন করে নেয়। কিছুদিন আগে কৌশিক গাঙ্গুলি ‘খাদ’ নামক একটি সিনেমা বানান, তাতেও আদপে ভূতেদের আনাগোনা, (যদিও মৃত্যু রহস্য উন্মোচন সিনেমার একেবারে শেষে) কিন্তু ভয়ের বদলে সেখানে আলাদা আলাদা জীবন-ছবি অঙ্কিত হয়েছে।

কোথাও গিয়ে বলাই যায়, বাঙালি ভূত আর যা-ই পারুক ভয় দেখাতে পারে না। কারণ, তারা হাসি ফোটায় দর্শকের মুখে, কখনো বুদ্ধিমত্তার জোরে, কখনো নিজেই সং সেজে। সিনেমা থেকে সরে গিয়ে ছোটোবেলার উপকথা হাতরালেও মামদো, ব্রহ্মদৈত্যর কথা মনে পড়ে, যাদের উপস্থিতি রক্তপিপাসু নরখাদক এর চেয়ে ক্ষুধার্ত চেহারার জানান দেয় বেশি। গোপাল ভাঁড়ের গল্প বা অন্য রূপকথায় ভূতের প্রসঙ্গ এসেছে বার বার, কিন্তু ঘাড় মটকাবার বদলে তারা বেছে নিয়েছে বিয়েবাড়ির মিষ্টি চুরির মতো কাজ, বা কোনো বাচ্চার নিত্যসঙ্গী হয়েছে চুপিচুপি। ঠিক এই কারণেই ছেলেবেলায় ভয় বলতে কখনো বাঙালি ভূত মাথায় আসেনি।

ভূত আর হাস্যরসের মধ্যে আদপে সম্পর্কটা কী? সেটাই বোঝার চেষ্টা করছি, বাংলা সাহিত্য কি বলছে?

সেখানেও কিন্তু অলৌকিকতা আর হাসি এক ভাবে মিলে মিশে আছে। তিন জনের লেখা উল্লেখ করি, troilokyanatherডমরু চরিত, সুকুমার রায়ের ভুতুড়ে খেলা এবং আরও অনেক পরের হলেও শীর্ষেন্দুর ‘গোঁসাইবাগান’।

ত্রৈলোক্যনাথের ডমরু ধর এক আশ্চর্য চরিত্র। অবাস্তব ঘটনা তার নিত্য সঙ্গী, যার জেরে সে এক সামান্য দর্জি থেকে জমিদার হয়ে উঠতে পেরেছে, বিবিধ অলৌকিক, বিদঘুটে কাহিনী সে শোনায় তার বন্ধু মহলে, সকলে তাঁকে সমিহ করে এবং আমরা পাঠকরাও সেই গল্পে মজি বার বার। ‘ডমরু চরিত’-এর একটি গল্পের শিরোনাম ‘ছোটখাটো ভালো মানুষ ভূত’, এই পর্বে ডমরুর সাক্ষাৎ হয় এক ভীতু ভূতের সঙ্গে। সে আশেপাশে কোনো মানুষ হাচলে কাশলে ভয় পায়, কুকুর ডাকলে পলায়ন করে, ডমরুর হাতে ভেটকি মাছ দেখেও সম্ভ্রমে তা চাইতে পারে না। ইংরেজিতে একটা বিখ্যাত সিনেমা ছিল, ‘ক্যাস্পার’, এক ছোটো সাদা ভূতের গল্প। ত্রৈলোক্যনাথের ছোটো ভূত তাকে মনে করিয়ে দেয়। ডমরুর ভীতু ভূত তারই সঙ্গে গ্রামের পথে হাঁটা চলা করে, রান্নাঘরে উঁকিঝুঁকি মারে আর ঘুলঘুলি দিয়ে হাত বাড়িয়ে মাছ ভাঁজা নেয়, তবে যদি রাঁধুনে নিজে থেকে হাতে তুলে দেয়। ভদ্র, শিষ্ঠ ভূত, নিজে কাড়াকাড়ি করতে পছন্দ করে না। এবারে চলে আসুন মা ভূত আর ছানা ভূতের গপ্পে। সুকুমার রায়ের ভূতুড়ে খেলায়, পান্ত ভূতের ছানা তার মায়ের কোলে খেলা করে। মা তাঁকে কত নামে ডাকে, ‘নোংরা মুখো সুটকো’, ‘বাদলা রোদে জষ্টি মাসের বৃষ্টি ‘গণেশ ঠাকুর ময়দা ঠাসা নাদুস’’। ভূত তো কী হয়েছে, সেও গরমিকালে বৃষ্টির স্বস্তি বোঝে, গণেশ ঠাকুরের মতো নাদুসনুদুস বাচ্চার স্বপ্ন দেখে আবার ময়দার কোমল ডেলা ভেবে শিশুকে কোলে তোলে যত্নে। দেবতার মানবায়ন বলে একটি কথা আছে, বাংলা হিন্দু পৌরাণিক গল্পে তার নজির মেলে বার বার। এখানে শিবদুর্গা যেন আর পাঁচটা দম্পতির মতো নিত্য কলহে জড়ায়, রাধাকৃষ্ণের প্রেম হয়ে ওঠে অতি মানবিক। আমার তো মনে হয় এই বাংলায় ভূতেদের ও মানবায়ন ঘটেছে। এর সব থেকে উৎকৃষ্ট নজির কিন্তু শীর্ষেন্দুর ‘গোঁসাইবাগান’।

বুরুন অঙ্কে তেরো পেয়ে ফেল করেছে, বাড়িতে সে এক ঘরে, কেউ তার সঙ্গে ভালো করে কথা বলে না। মনের দুঃখে গোঁসাই ডাকাতের বাগানে গিয়ে তার সাক্ষাৎ হয় নিধিরাম ভূতের সঙ্গে। নিধিরাম দু-শো বছর ধরে সেই জঙ্গলে রয়েছে, হাত পা ইয়া লম্বা করে, অদৃশ্য হয়ে, একেবারে ছোট্ট হয়ে হোমিওপ্যাথির শিশির মধ্যে ঢুকেও সে বুরুনকে ভয় দেখাতে ব্যর্থ হয়। হতাশ হয়ে ভূত বাবাজি তার অসীম সাহসী বন্ধুকে সাহায্য করতে উদ্যত এবার। করালি স্যারের টিউশনে ভূত বুরুনের হয়ে অঙ্ক কষে দেয়, স্কুলে ক্রিকেটে বুরুনের হাতে ব্যাট দিয়ে অদৃশ্য ছক্কা মারে, এমনকী তার বাড়িঘর ঝাড়পোঁছ পর্যন্ত করে দেয়।

এইসব বাঙালি ভূতের গল্পে কেউ স্নেহশীলা মা, কেউ-বা পরোপকারি বন্ধু আবার কেউ ভূতের একমাত্র স্বধর্ম বর্জন করে নিজেই ভয় পেয়ে বসে আছে। কেউ কেউ আবার মানুষের আদলে তৈরি ম্যাজিক জানা এক প্রজাতি, সিনেমা হোক বা গল্প এই ধারা চলছে শতকের পর শতক।

বাংলার ভয়, অশ্রু, কষ্ট মিলে মিশে যায় রঙ্গব্যঙ্গে, কৌতুকে। আমরা হাসি খিলখিলিয়ে, ভূত চতুর্দশী হোক বা নিশিদিন কোনো অমাবস্যা।