Categories
2021-NOVEMBER-TRANSLATION

শাকিলা আজিজ্জাদা

ভাষান্তর: পৌষালী চক্রবর্তী

দূর থেকে দেখি

আবার আমি একা পড়ে গেছি
পেছনে কেউই দাঁড়িয়ে নেই
পায়ের তলার থেকে মাটি টেনে নিয়েছে
এমনকী সূর্যের কাঁধও আমার ধরা ছোঁয়ার বাইরে

আমার নাভিরজ্জু বাঁধা ছিল
চলে আসা রীতিনীতির আলখাল্লার গিঁটে
আমার কেশগুচ্ছ প্রথমেই কাটা পড়েছিল
লিপির অনুশাসনের বেসিনের উপর
আমার কানের কাছে প্রার্থনার মতো কেউ ফিসফিস করে
‘তোমার পিছনের ও পদতলের মাটি সারাজীবনের মতো নিঃস্ব হয়ে যাক’

সে যাক গে, একটুখানি উপরেই
একখণ্ড ভূমি থেকে যাবে
যে-পবিত্রতর অন্য কোনো ভূমির থেকে
শয়তান যা যাচ্ঞা করতে পারে আমার থেকে

সূর্য আমার কাঁধে হাত রাখলে
আমি বিচ্ছিন্ন করেছি আমার পদযুগল, সহস্র এক বার,
যা কিছু পিছনে ফেলে এসেছি, সেইসব কিছু, থেকে।

নির্জনতা

তোমার হাতের সব রেখার মধ্যে
তারা লিখে রেখেছে সূর্যের ভাগ্য

ওঠো,
তোমার হাতদুটো তোলো—

দীর্ঘ রাত্রি আমার দম বন্ধ করে দেয়

কাবুল
জুন, ১৯৯৪

আমার কণ্ঠস্বর

এক দূরের দেশ থেকে আমি এসেছিলাম
পিঠে এক ভিনদেশি ন্যাপস্যাক নিয়ে
ঠোঁটে নিয়ে নীরবতার গান

যখন আমি আমার জীবনের নদী বেয়ে ভ্রমণ করেছি
আমি দেখেছিলাম আমার কণ্ঠস্বর
(জোনার মতো)
গিলে নিয়েছিল একটি তিমি
মাছ

আর সেই থেকে আমার জীবনটা বেঁচে ছিল আমার স্বরে

কাবুল
ডিসেম্বর, ১৯৮৯

ইয়ালদা

আমার যন্ত্রণা হয়েছিল
যখন একবাটি মাখা ময়দার তালের মধ্যে
তোমার বাহুযুগল মিলিয়ে যেতে দেখেছিলাম

আর দেখছিলাম তুমি
একফালি লম্বা কাপড় ব্যবহার করছ
পাকা আঙুরের মতো তোমার স্তন বেঁধে নিতে

তোমাকে দেখেছি শিশুকে পরিত্যাগ করতে,
তোমার মুখের কোণ ছিঁড়েখুঁড়ে যাচ্ছে
আমি যন্ত্রণা পেয়েছি।

তোমার ছায়ার দিকে ছুড়ে মারা একটি পাথরও
ঠোঁটে রক্ত বার করে আনার জন্য যথেষ্ট
যে পাথর ছুড়েছিল তার মুখে,
অবশিষ্ট লালা দিয়ে, আমি থুতু ছিটিয়েছি।

কথারা শুকিয়ে গেছে তোমার মুখের মধ্যে
ধীরে ধীরে বয়ে যেতে গিয়ে, বছর
হয়ে গেছে ধুলো আর ধোঁয়া

যাওয়ার সময় তারা পা টেনে টেনে হাঁটছিল
কিন্তু তোমার বাপের বাড়ির রাতগুলিকে
ঝুলন্তই ছেড়ে গিয়েছিল।

এপিটাফ

কার নিভে আসা শ্বাস
ঘুমোচ্ছে
তোমার ওই হ্যাজেল গাছের মতো চোখে?

কীরকমভাবে ছোট্ট শিশুর চাউনি
তোমার ট্রিগারের সামনে শূন্য হয়ে যায়?

কীভাবে তোমার হৃৎস্পন্দন চলে
যখন তরুণী মেয়ের হৃদয় তোমার তালুতে ধরা
আর পা-দুটো রক্তাক্ত?

পাহাড়ের মানুষ!
কোন পরিণতিতে তোমার পদতলের
খাড়াই পাহাড় চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবে?

ধুলোয় ধূসর তোমার কোঁকড়ানো চুলের জন্য,
স্তনবৃন্ত পুড়ে গেলে
কীরকম লাগবে মেয়েদের,
কী ভাববে মা তার ছেলেকে?

বলো,
কার দু-চোখের গভীরে
তোমার নিভন্ত শ্বাস শান্তি খুঁজে পাবে?

ঈশ্বরের নিদর্শনসমূহ

একটি জানালার হৃদয়ে তুমি ফ্রেমের মতো বাঁধা পড়ে আছ

তার কাঁধের উষ্ণতা
তোমার আঙুলডগে জমাট বাঁধে

স্ট্রিটলাইটের নীচে
বৃষ্টি ধুয়ে নিয়ে যায় তার পদচিহ্নগুলি

তোমার নোটবই বন্ধ
কিন্তু তার চিন্তারাশি পিছলে গিয়ে
পুনরায় যোগ দেয় বিলীয়মান রাতের সঙ্গে।

আর সেখানেই, একটি রাতচরা বিড়ালের ছায়া, হারিয়ে যায়।

প্রথম শ্লোকের মতো কার্যকরী
হাফেজকে তুমি
রেখে দাও পিছনের জানালায়।

তোমার হাতকে দৌড় করাও
রেশমি রুমালের ওপর দিয়ে
কোণায় কোণায় গিঁট বেঁধে
মুড়ে নেওয়া হয় বইরূপ আদি জননীকে

একটি রুপোলি শালের নীচে
তোমার কাঁধ, পাঠ্যের নীরব
ছন্দ হেন, কেঁপে যায়।

প্রাচীন শ্লোকের যত মোড়কের নীচে
পচে ওঠে ঈশ্বরের চিহ্নগুলো।

কনের ঘোমটাটি

আমার বিয়ের সাজ আমি টাঙিয়ে রেখেছি
সাদা রঙের স্মৃতির এক হুকে
তার কাঁধের ওপর আমার রেশমতুল্য দৃষ্টিপাত

তার বুকের থেকে আমি ছিঁড়ে নিয়েছি আমার হৃদয়
সেখানে এখনও দুধের গন্ধ

সে হয়তো জেগে যেত
আমার গ্রীবায় তার স্পন্দমান আঙুলেরা
তার বাহুজুড়ে সেই পুরাতন লাস্যের কলকল।

আমার হৃদয় আমি উপড়ে এনেছি
কিন্তু আমার দু-চোখে শুধু সে
তার চওড়া ও উজ্জ্বল পশ্চাদ্দেশ
বরের শালে জড়ানো

আমি নিজেকে আর মনে করাতে চাই না
পরবর্তী শ্বাসেই
সে উড়িয়ে দেবে ঘোমটার আবরণ

আমি আর গুনব না
তার শ্বাসগুলি

ভূমা

পৃথিবী তার উষ্ণ বাহুদু-টি বাড়িয়ে দেয়
আমাকে জড়িয়ে নিতে
পৃথিবী আমার মা
তিনি আমার এলোমেলো ঘুরে বেড়ানোর
দুঃখ বোঝেন।

আমার এই বিচরণ
এক বুড়ো কাকের মতো
যে জয় করেছে
কম্পমান পপলার গাছের সুউচ্চ শাখা
একদিনে একহাজার বার

হয়তো-বা এ-জীবন কাকেরই মতো
যে প্রতিদিন ঊষাকালে
নিজের কালো চঞ্চু ডুবিয়ে নেয়
সূর্যের পবিত্র কুয়োয়

হয়তো-বা এ-জীবন কাকেরই মতো
যে উড়া দেয় শয়তানের ডানা নিয়ে

অথবা জীবন নিজেই এক শয়তান
ধূর্ত লোককে জাগায় হত্যাকাণ্ড ঘটাতে

জীবন যেন-বা বিষাদগ্রস্ত পৃথিবীর মতো
যে তার রক্তাক্ত হাত বাড়িয়ে দিয়েছে আমাকে

আর তাই আমি ধন্যবাদ দিই
‘বিজয়’-এর প্রান্তসীমায়।

পেশোয়ার শহর
জুলাই, ২০০২

একটি পালক

সেপিদেহ্-র জন্য

যেভাবে আমার স্বপ্ন
তোমার পদক্ষেপের শব্দ শোনে
যখন তুমি প্রবেশ করো
ধীরে, ধীরে, আঙুলের ডগায় ভর দিয়ে

পাতের তলায় তুমি হামাগুড়ি দাও
বিড়ালছানার মতো, তোমার দু-চোখ
আমাকে পান করে।

ঘুমন্ত বা জাগ্রত
আমার স্বপ্নের রেশম তুমি ভাঁজ করো।

যে-মুহূর্তে
তোমার হাত আমার গলা জড়িয়ে ধরে
তুমি দ্রুত বালিশের ওপর ঘুমিয়ে পড়ো।

আর আমি, আধো ঘুমে, আধো জেগে থাকি
যে-মুহূর্তে স্বপ্ন নিঃশেষিত হয়
তুমি আমাকে ভরে তোলো, পুনরায়।

অপেক্ষায় থাকা বিড়ালটি

এই শব্দগুচ্ছ
তারা ভালোভাবে নেয়নি

দয়া করে বোলো না যে, স্বর্গের দরজা
আমার ওষ্ঠাধরের মাঝে খোলে।

আমার দুই বুকের মাঝের ফাটলে
ঈশ্বর স্বয়ং হালকা চালে হেঁটে যান

আমি আসব

এবং আবার
তোমার শ্বাস আমার মধ্যে শ্বাস নেবে
তোমার ফুসফুস ভরে উঠবে
আমার সুগন্ধে
তোমার জিভের থেকে
বৃষ্টি, বৃষ্টি, শুধু বৃষ্টি
আবার ঝরবে আমার গায়ে

আমি দিয়ে দেব

এবং এই সময়ে
যখন তুমি আসো, চকচকে চোখে
আর ঝুঁকে পড়ো, আমাকে দু-ফালা করে দিতে

সংশয়ের ছায়ামাত্র থাকবে না তোমার

সেই কালো বিড়ালের মতো, যে
লুকিয়ে থেকে লাফ দেয়
আর আমার পথ বরাবর চলে যায়
তোমার দুয়ারে এসে চড়াই শিকার করে
যতক্ষণ না সে
নিজেকে হতভম্ব আর ফাঁদে পড়া ভাবছে

Categories
2021-NOVEMBER-TRANSLATION

মার্সেল প্রুস্ত

স্মৃতি
[Memory]

ভাষান্তর: সঞ্চয়িতা পাল চক্রবর্তী

খয়েরি উর্দি ও সোনালি বোতামে সজ্জিত একজন চাকর বেশ শীঘ্রই দরজাটি খুলে দিল এবং আমাকে একটি ছোটো বসার ঘরের দিকে এগিয়ে দিল— যে-ঘরে ছিল পাইন কাঠের প্যানেলের কাজ, দেওয়ালে ঝোলানো ছিল ছাপা সুতির কাপড় এবং যে-ঘর থেকে সমুদ্র দেখা যেত। আমি সেই ঘরে ঢুকতেই এক বেশ সুপুরুষ তরুণ উঠে দাঁড়ালেন, আমাকে শীতলভাবে অভ্যর্থনা জানালেন এবং আবার নিজের আরামকেদারায় বসে, ধূমপান করতে করতে খবরের কাগজ পড়তে লাগলেন। আমি একটু অস্বস্তির মধ্যে দাঁড়িয়েই রইলাম, বলা যায় আমি এখানে কী অভ্যর্থনা পেতে চলেছি সেটাই ভাবতে লাগলাম। এতগুলো বছর পরে, এই বাড়িতে এসে আমি কি ঠিক কাজ করলাম, যেখানে তাঁরা হয়তো অনেক আগেই আমাকে ভুলে গেছেন? এই আতিথ্যময় বাড়িটি যেখানে আমি আমার জীবনের সবচেয়ে সুখের, গভীর, কোমল মুহূর্তগুলি কাটিয়েছি?

বাড়ির চারপাশের যে-বাগানটি এবং একদিকে তৈরি হওয়া সেই অলিন্দটি, চিত্র-বিচিত্র চিনামাটির পাত্রে সজ্জিত ও খোদাই করা লাল ইটের দুই মুরুজ, লম্বা আয়তাকার জানালাগুলো যেখানে আমাদের বর্ষার দিনগুলি কাটিয়েছিলাম এবং এমনকী এই ছোট্ট বসার ঘরের সাজসজ্জাও— যেখানে আমাকে এখুনি নিয়ে আসা হল— কিছুই পালটায়নি। কতক্ষণ পরে এক সাদা দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ লোক অবিন্যস্তভাবে ঢুকলেন। তিনি বেঁটে এবং কুঁজো। তাঁর অনিবিষ্ট দৃষ্টি তার মধ্যে এক নির্মোহ অভিব্যক্তি এনেছিল, আমি তখনই মসিয়ে দে এন-কে চিনতে পেরেছিলাম। কিন্তু তিনি আমাকে চিনতে পারলেন না। আমি অনেকবার আমার নাম বললাম: কিন্তু তাঁর কোনো স্মৃতি উঠে এল না। আমার আরও বেশি অস্বস্তি হতে শুরু করল। আমাদের দৃষ্টি যেন আটকে গেল, আমরা কী বলব কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আমি বৃথাই তাঁকে কিছু সূত্র দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম: তিনি আমাকে সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়েছেন। আমি তাঁর কাছে একজন অচেনা মানুষ।যেই আমি চলে যাচ্ছিলাম, দরজাটি খুলে গেল: “আমার বোন ওডেট”, একটি দশ-বারো বছরের মিষ্টি মেয়ে তার নরম সুরেলা ভাষায় বলে উঠল, “আমার বোনের এক্ষুণি মনে পড়ল যে, আপনি এখানে ছিলেন। আপনি কি এখানে এসে ওঁর সঙ্গে দেখা করতে চান? তাতে তিনি খুব খুশি হবেন!” আমি ছোট্ট মেয়েটিকে অনুসরণ করলাম এবং আমরা বাগানের দিকে এগিয়ে গেলাম। সেখানে আমি সত্যি ওডেটকে পেলাম। একটি বড়ো মোটা কম্বল ঢাকা দিয়ে একটি অনাচ্ছাদিত সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছেন। তাঁর এতই পরিবর্তন হয়েছে যে, আমি তাঁকে চেনা দুষ্কর হয়ে পড়ত! তাঁর মুখাবয়ব প্রলম্বিত হয়েছে এবং তাঁর অন্ধকার চোখ যেন তাঁর নিস্তেজ মুখকে বিদ্ধ করেছে। একসময় সে বেশ সুন্দরী ছিলেন এখন আর তা নয়। একটু যেন দ্বিধাগ্রস্তভাবেই তিনি আমাকে পাশে বসতে বললেন। আমরা একাই ছিলাম। “আমাকে এই অবস্থায় দেখে তুমি নিশ্চয়ই বেশ অবাক হয়েছ”, অনেকক্ষণ পরে তিনি বললেন। “আসলে আমার ভয়ংকর অসুস্থতার পর থেকে, এই যেমন তুমি দেখছ, এরকমভাবে কোনো ছটফট না করে শুয়ে থাকতে হয়। আমি অনুভূতি আর দুঃখ নিয়েই বেঁচে আছি। আমি গভীরভাবে ওই নীল সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকি, যে-সমুদ্রের এই অসীম শৌর্য আমার কাছে মনোমুগ্ধকর। এই ঢেউগুলো যেন আমার মনে আসা কত মন খারাপের চিন্তা, কত আশা যা আমাকে ছেড়ে দিতে হয়েছে। আমি পড়ি, আসলে আমি অনেক পড়ি। কবিতার সুর আমার মধুর স্মৃতি জাগিয়ে তোলে, আমার সম্পূর্ণ অস্তিত্ব সজীব হয়ে ওঠে। সত্যি তুমি কত ভালো যে, এত বছর পরেও আমাকে ভোলোনি এবং আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছ! আমার সত্যি খুব ভালো লাগছে! আমি আগের থেকে অনেক ভালো অনুভব করছি। আমি এটা বলতেই পারি— পারি না কি?— যখন আমরা এত ভালো বন্ধু ছিলাম, তোমার কি মনে পড়ে এই জায়গাতেই আমরা টেনিস খেলতাম? আমি তখন বেশ সমর্থ ছিলাম; আমি সুখী ছিলাম। আজ আমার সেই সামর্থ্যও নেই; আমি আর সুখীও হতে পারব না। আমি যখন দেখি ভাঁটার টানে সমুদ্র সরে সরে যায়, অনেক দূরে, আমার তখন ভাঁটার স্রোতে আমাদের একা হাঁটার কথা মনে পড়ে। আমি যদি খুব দুষ্ট, খুব স্বার্থপর না হতাম, তবে আমার সেই মুগ্ধ মুহূর্তগুলির স্মৃতি আমাকে সুখী রাখার জন্য যথেষ্ট হত। কিন্তু, তুমি জানো, আমি যেন নিজেকে ছাড়তেই পারি না, এবং কোনো কোনো সময় আমার নিজের চেষ্টা সত্ত্বেও, আমার ভাগ্যের বিরুদ্ধে গর্জে উঠি। এই একাকিত্ব আমাকে উদাস করে তোলে, কারণ, সেই মা মারা যাওয়ার পর থেকেই আমি একা। আর বাবা, আমার কথা ভাবার জন্য বাবা বড়োই বৃদ্ধ ও অসুস্থ। আমার ভাই এক নারীর কাছে ভয়ংকরভাবে প্রতারিত হয়ে চরম আঘাত পেয়েছিল। সেই থেকে সে একাই থাকে। কোনো কিছুই তাকে ভোলাতে ও সান্ত্বনা দিতে পারে না। আমার ছোটো বোনটি এতটাই তরুণ, তাছাড়া আমাদের তাকে নিজের মতো সুখে বাঁচতে দিতে হবে।”

আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে তাঁর চোখ উজ্বল হয়ে উঠল। তাঁর বিশীর্ণ পাণ্ডুবর্ণ অদৃশ্য হয়ে গেল। তাঁর সেই বহুকাল পুরোনো মিষ্টি অভিব্যক্তি তিনি আবার ফিরে পেলেন। আবার তিনি সুন্দরী হয়ে উঠলেন। তিনি কী সুন্দরী ছিলেন! আমি তাঁকে জড়িয়ে ধরতে চাইতাম: তাঁকে বলতে চাইতাম, আমি তাঁকে কতটা ভালোবাসি… আমরা অনেকক্ষণ একসঙ্গে ছিলাম। সন্ধ্যার ঠান্ডা বাড়ছিল, তাই তাঁকে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হল। এবার তাঁকে বিদায় জানাতেই হবে, চোখের জলে আমার গলা রুদ্ধ হয়ে এল। সেই লম্বা অলিন্দ দিয়ে আমি হেঁটে গেলাম। সেই সুন্দর বাগানের নুড়িপথ আর আমি পেরোব না। আমি সমুদ্রতীরে নেমে পড়লাম; সেখানে কেউ ছিল না। শান্ত, নির্মোহ ভাঁটার জলের ধারে বিষণ্ণ আমি বেড়াতে লাগলাম। সূর্য অদৃশ্য হয়েছে; কিন্তু তার বেগুনি আকাশে ছড়িয়ে পড়েছে।

 

 

 

 

Categories
2021-NOVEMBER-TRANSLATION

চার্লস বুকাওস্কি

বারবিকিউ সস দিয়ে যিশু

ভাষান্তর: শুভঙ্কর দাশ

পেট্রল পাম্পের কাছেই হিচহাইকারটা দাঁড়িয়েছিল যখন ওরা তাকে গাড়িতে তুলে নিল। তাকে বসানো হল পিছনের সিটে ক্যারোলিনের সাথে।

গাড়ি চালাচ্ছিল মাররি। ফ্র্যাঙ্ক তার হাতটা সিটের পেছনে রেখে ঘাড় ঘুরিয়ে হিচহাইকারের দিকে ফিরে তাকাল।

‘তুমি কি হিপি?’

‘আমি জানি না। কেন?’ জিজ্ঞেস করল অল্পবয়সি তরুণটি।

‘আসলে হিপিদের ব্যাপারে আমরা বিশেষজ্ঞ। ওদের ব্যাপারে আমরা অভস্থ।’

‘তাহলে আমাদের আপনার অপছন্দ নয়?’

‘আরে না না, আমরা হিপিদের ভালোইবাসি! তা তোমার নাম কী?’

‘ব্রুস।’

‘ব্রুস। বাহ সুন্দর নাম। আমি ফ্র্যাঙ্ক। যে গাড়ি চালাচ্ছে ও হল মাররি। আর তোমার পাশের ওই সুন্দরী মাগিটার নাম ক্যারোলিন।‘

ব্রুস মাথা নাড়িয়ে হাসল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনারা কতদূর যাচ্ছেন?’

‘পুরোটাই যাব আমরা, তোমাকে নিয়ে পুরোটাই যাব আমরা বাচ্চে।’

মাররি হেসে উঠল হা হা করে।

ব্রুস জিজ্ঞাসা করল, ‘উনি হঠাৎ হাসছেন কেন?’

‘মাররি ওরকম সবসময় ভুল সময়ে হাসে। কিন্তু ও আমাদের গাড়ির চালক। আর ও খুব ভালো চালক। ও আমাদের নিয়ে যায় উপকূলের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত। অ্যারিজোনা, টেক্সাস, লুসিয়ানার বুক চিরে। আর ও কখনোই ক্লান্ত হয় না। আর ও ঠিকই আছে তাই না সোনা?’ সে ক্যারোলিনকে জিজ্ঞাসা করে।

‘একদম তাই আর ব্রুসও বিন্দাস।’ সে ব্রুসের হাঁটুতে হাত রেখে অল্প চাপ দেয়। তারপর ঝুঁকে এসে তার গালে একটা চুমু খায়।

‘কিছু কী খেয়েছ তুমি বাচ্চে?’

‘না, আমার বেশ খিদে পেয়েছে।’

‘ঘাবড়ো না। আমরা শিগ্গির গাড়ি থামিয়ে কিছু খাব।’

ক্যারোলিন সমানে হেসে চলেছে ব্রুসের দিকে তাকিয়ে। ‘ও সত্যি খুব ভালো। খুব ভালো।’ ব্রুস টের পেল ক্যারোলিনের হাতটা আস্তে আস্তে তার পা বেয়ে নেমে আসছে তার লিঙ্গের দিকে। ফ্র্যাঙ্ক ব্যাপারটায় গা লাগাচ্ছে না আর মাররি গাড়ি চালিয়ে চলেছে। তারপর ক্যারোলিন ব্রুসের লিঙ্গ ঘঁষতে শুরু করল আর হাসতে লাগল।

‘গত রাতে কোথায় ঘুমিয়েছিলে তুমি বাচ্চা?’ ফ্র্যাঙ্ক জিজ্ঞাসা করল।

‘গাছের নীচে। খুব ঠান্ডা ছিল। আর তাই মন ভালো হয়ে গেল যখন সূর্য উঠল।’

‘তুমি ভাগ্যবান। রাতে কোনো জন্তু তোমাকে গিলে ফেলেনি ভাগ্যিস।’

মাররি আবার হেসে উঠল।

‘আপনি কী বলতে চাইছেন?’ বাচ্চাটা জিজ্ঞাসা করল।

‘আমি বলতে চাইছি তোমার ওই অত চুলের ভেতরে তোমাকে একটা সরস বাচ্চার মতো লাগছে।’

‘একদম তাই’ ক্যারোলিন জবাব দেয়। সে সমানে ব্রুসের লিঙ্গ ধরে উপর নিচ করতে থাকে। সেটা শক্ত হতে থাকে ক্রমে।

‘তোমার কত বয়স ব্রুস?’

‘১৯।’

‘তুমি গিন্সবার্গ, কেরুয়াক পড়েছ?’

‘হ্যাঁ, কিন্তু ওঁরা বিট জমানার। আমরা ভালোবাসি রক এবং লোকসংগীত, আমার জনি ক্যাশকেও ভালো লাগে। আর ববি ডিলান, অবশ্যই…’

ক্যারোলিন ব্রুসের জিপার খুলে ফেলে ওটা বার করে ফেলেছে। তারপর সে তার জিভ ছোঁয়ায়, আর জিভটা ওপর নিচ করে লিঙ্গ বরাবর। ফ্র্যাঙ্ক এমন ভাব দেখায় যেন কিছুই ঘটছে না।

‘তুমি বার্কিলি অবধি এসেছ?’

‘এসেছি তো। বার্কিলি, ডেনভার, সান্টা বারবারা, ফ্রিস্কো…’

‘তুমি কি মনে করো একটা বিপ্লব ঘটবে?’

‘হ্যাঁ, হতেই হবে। এছাড়া কোনো উপায় নেই আর। বুঝতে পারছেন…’

ক্যারোলিন ব্রুসের লিঙ্গটা তার মুখে পুরে নিয়েছে। বাচ্চাটা আর কোনো কথা বলতে পারে না।

মাররি অবশেষে পিছন ফিরে তাকায়, তারপর হা হা করে হেসে ওঠে। ফ্র্যাঙ্ক একটা সিগারেট ধরিয়ে দেখতে থাকে।

‘হে যিশু’, বাচ্চাটা বলে ওঠে, ‘হে ভগবান, যিশু!’

ক্যারোলিন ঝাঁকাচ্ছিল। তারপর সে পুরোটাই মুখের ভেতর পেল। শেষ হল ব্যাপারটা। ব্রুস সিটে গা এলিয়ে দিয়েছে। জিপারটা টেনে বন্ধ করেছে।

‘কীরকম লাগল, বাচ্চা?’

‘সত্যি বলতে, ভালোই লেগেছে।’

‘সবসময় এমন একটা গাড়ি চড়ার অভিজ্ঞতা ঘটে না আর তাছাড়া ব্যাপারটা এখনও শেষ হয়নি। এটা স্রেফ একটা শুরু। দাঁড়াও এবার আমরা খাবার জন্য থামব।’

মাররি আবার হেসে উঠল।

‘ওনার ওভাবে হাসাটা আমার ভালো লাগছে না’, বলল ব্রুস।

‘সব কিছু তো আর ঠিকঠাক হয় না। এই তো সুন্দর একটা চোষণ পেলে।’

তারা আরও কিছুক্ষণ এগিয়ে চলল।

‘খিদে পাচ্ছে মাররি?’

মাররি এই প্রথম কথা বলল, ‘হ্যাঁ’।

‘বেশ বেশ, একটা ভালো জায়গা পেলেই আমরা গাড়ি থামাব।’

‘আশা করি দ্রুত ওটা পাওয়া যাবে’, বলল মাররি।

‘আমার মনে হয় ক্যারোলিনের খিদে পায়নি। ও তো সবে লাঞ্চ খেলো।’

‘আমি কিছুটা ডেসার্ট খেতে পারি যদিও’, ক্যারোলিন হেসে উঠল।

‘আমরা শেষ কখন খেয়েছি যেন?’ ফ্র্যাঙ্ক জিজ্ঞাসা করে।

‘গত পরশু’, উত্তর দেয় ক্যারোলিন।

‘সে কী?’ জিজ্ঞাসা করে ব্রুস, ‘গত পরশু?’

‘হ্যাঁ, বাচ্চা, কিন্তু যখন আমরা খাই, সত্যি আমরা খাই— আরে এই তো। এই জায়গাটা তো ভালোই মনে হচ্ছে। প্রচুর গাছগাছালি, একদম ফাঁকা। গাড়িটা রাস্তা থেকে নীচে নামাও মাররি।’

মাররি রাস্তার ধারে গাড়িটা থামায় আর ওরা সবাই বেরিয়ে আসে গাড়ি থেকে, আড়মোড়া ভাঙে।

‘তোমার দাঁড়িটা খুব সুন্দর বাচ্চা। আর ওই একমাথা চুল। নাপিতেরা তোমার থেকে খুব বেশি কিছু নিতে পারেনি, তাই না?’

‘আমার মনে হয় কেউই পারেনি নিতে’।

‘কেয়াবাৎ বাচ্চে। বেশ, মাররি একটা গর্ত খুঁড়ে ফেলো রোস্ট করার জন্য। একটা শিক তৈরি রাখো। দু-দিন কেটে গেছে এবার তো আমার পেটের অবস্থা করুণ’।

মাররি ট্রাঙ্কটা খোলে। ভেতরে ছিল একটা বেলচা। কাঠ এমনকী কয়লাও। সব কিছুই ছিল যা ওদের দরকার। ও সেগুলো বয়ে নিয়ে চলল গাছগাছালির ভেতর। অন্যান্যরা গাড়িতে গিয়ে উঠল। ফ্র্যাঙ্ক-এর দেওয়া জ্বলন্ত তামাক ঘুরতে লাগল হাতে হাতে আর একটা স্কচের বোতল। মদটা স্মুথ কিন্তু বাচ্চাটার বার দুয়েক জলের বোতলের প্রয়োজন হল।

‘আমার সত্যি ব্রুসকে পছন্দ’, বলল ক্যারোলিন।

‘আমারও ওকে পছন্দ’, বলল ফ্র্যাঙ্ক। ‘তাতে কী, আমরা কি ওকে ভাগ করে নিতে পারি না?’

‘নিশ্চয়ই’।

ওরা সবাই কথা না বলে মদ খেয়ে চলল। তারপর ফ্র্যাঙ্ক বলে উঠল, ‘চলো সব এতক্ষণে মাররি নির্ঘাত সব রেডি করে ফেলেছে।’

ওরা বাইরে বেরিয়ে ফ্র্যাঙ্কের পিছু পিছু চলল গাছগাছালির দিকে। ক্যারোলিন আর ব্রুস হাত ধরাধরি করে। ওরা যখন সেখানে পৌঁছোল দেখল মাররির কাজ প্রায় শেষ।

‘ওই জিনিসটা কী?’ বাচ্চাটা জিজ্ঞাসা করল।

‘ওটা একটা ক্রুশ। মাররি নিজে বানিয়েছে। দারুণ হয়েছে তাই না?’

‘মানে আমি বলতে চাইছি ওটা কী জন্য?’

‘মাররি বিশাস করে ধর্মীয় আচারপদ্ধতিতে। ও একটু ওরকম আমরা এটা মজা করে মেনে নি।’

‘শুনুন’, বাচ্চাটা বলে, ‘আমার খিদে পায়নি। আমার মনে হয় আমি রাস্তা ধরে কিছুটা এগোই হাঁটতে হাঁটতে’।

‘কিন্তু আমাদের খিদে পেয়েছে বাচ্চা’।

‘বেশ, কিন্তু আমার…’

ফ্র্যাঙ্ক বাচ্চাটার পেটে ঘুসি মারল একটা আর সে ঝুঁকে গেল সামনের দিকে, মাররি তার কানের পেছনে একটা গদা দিয়ে মারল। ক্যারোলিন পাতা দিয়ে একটা বালিশ বানাল আর বসে রইল আর তখন ফ্র্যাঙ্ক আর মাররি বাচ্চাটাকে হেঁচড়ে নিয়ে চলল ক্রুশের দিকে। ফ্র্যাঙ্ক ব্রুসকে ক্রুশে ঠেসে ধরে রাখল আর মাররি বাচ্চাটার বাঁ-হাতের পাতায় একটা বড়ো পেরেক গেঁথে দিল। তারপর তারা তার ডান হাতের পাতায় গাঁথল।

‘তুমি কি পায়ের পাতায়ও পেরেক লাগাবে?’ জিজ্ঞাসা করল ফ্র্যাঙ্ক।

‘না, আমি ওতে ক্লান্ত হয়ে পড়ি। বড্ড বেশি কাজ।’

ওরা বসে পড়ল ক্যারোলিনের পাশে আর মদের বোতল দেওয়া নেওয়া শুরু হল।

‘এখানে ওদের সূর্যাস্তটা বড়ো সুন্দর, তাই না?’ জিজ্ঞাসা করল ক্যারোলিন।

‘হ্যাঁ। ওদিকে তাকাও। গোলাপী আর আস্তে আস্তে যা লাল হচ্ছে। তোমার সূর্যাস্ত ভালো লাগে মাররি’।

‘হ্যাঁ তো। আমার সূর্যাস্ত ভালো লাগে। তোমার কী মনে হয়?’

‘আমি স্রেফ জিজ্ঞাসা করছিলাম। রাগ কোরো না আবার’।

‘তোমরা সারাক্ষণ আমাকে একটা বোকাগাধা বলে মনে করো। সত্যিই আমার সূর্যাস্ত ভালো লাগে’।

‘বেশ। তর্ক করব না আমরা। বা হয়তো আমাদের তর্ক করার দরকার আছে। কারণ, আমার মাথায় একটা প্ল্যান এসেছে।’

‘তাই?’ বলল মাররি।

‘হ্যাঁ। আমি বারবিকিউ সস খেয়ে খেয়ে ক্লান্ত হয়ে গেছি। আমি ওই স্বাদে ক্লান্ত একেবারে। আর তাছাড়া কোথাও একটা পড়েছিলাম ওটা বেশি খেলে ক্যান্সার হতে পারে।’

‘কিন্তু কথা হল, আমার বারবিকিউ সস ভালো লাগে। আর আমি সারাক্ষণ গাড়ি চালাই, সমস্ত কাজ আমি করি, তাই আমাদের বারবিকিউ সস খাওয়া উচিত’।

‘তোমার কী মনে হয় ক্যারোলিন?’

‘আমার কিছু আসে যায় না, সস দিয়ে বা সস ছাড়া। এখন খাবার খেতে পেলেই হল’।

বাচ্চাটা ক্রুশে নড়াচড়া করা শুরু করেছে। সে পা ছড়ায় দাঁড়াবে বলে, সে উপর দিকে তাকায়। তারপর নিজের হাতটা দেখতে পায়।

‘হে ভগবান। এ আমার কী করেছেন?’

তারপর ব্রুস চিৎকার করে উঠল। সেটা ছিল একটা লম্বা তীক্ষ্ণ আর্তনাদের কাকুতি। তারপর সে চুপ করে গেল।

‘মাথা ঠানৃডা রাখো বাচ্চা’, বলল ফ্র্যাঙ্ক।

‘হ্যাঁ ঠিক’, বলল মাররি।

‘মনে হয় না এখন ও আরেকটা চোষণ চাইবে, তাই না ক্যারোলিন?’

ক্যারোলিন হেসে উঠল।

‘শুনুন’, বাচ্চাটা বলল, ‘আমাকে দয়া করে ক্রুশ থেকে খুলে নামিয়ে দিন। আমি কিছু বুঝতে পারছি না। এই যন্ত্রণা— খুব যন্ত্রণা হচ্ছে। আমি দুঃখিত যে, আমি চিৎকার করেছি। দয়া করে আমাকে নামান। দয়া করুন, দয়া করুন, হে পরমেশ্বর, আমাকে নামান!’

‘বেশ, মাররি ওকে নামাও।’

‘হে ঈশ্বর, ধন্যবাদ!’

মাররি ক্রুশের দিকে এগিয়ে গেল, তারপর বাচ্চাটার মাথা ঠেলে দিলো পেছন দিকে তারপর তার ঘাড়ের শিরা একটা মাংস কাটার ছুরি দিয়ে কেটে দিল। তারপর সে একটা পেরেক-তোলা হাতুড়ি দিয়ে বাঁ-হাতের পাতার পেরেকটা ধরে টানতে লাগল। সে খিস্তি দিল বিড়বিড় করে।

‘এই অংশটা সবসময় খুব কঠিন।’

তারপর মাররি বাচ্চাটাকে নামিয়ে তার জামাকাপড় খুলছিল। সে জামাকাপড় ছুড়ে ফেলে দিল একপাশে। তারপর ছুরি দিয়ে কাটতে লাগল বাচ্চাটাকে। পাঁজরের নিচ থেকে টেনে পেট বরাবর কেটে ফেলল।

‘চলে এসো’, বলল ফ্র্যাঙ্ক। ‘এই অংশটা আমি দেখতে পছন্দ করি না।’

ক্যারোলিন আর ফ্র্যাঙ্ক উঠে চলে গেল জঙ্গলের ভেতর। যখন ওরা ফিরে এল তখন মাররি বাচ্চাটাকে শিকে গেঁথে রোস্ট করছে।

‘শোনো মাররি।’

‘হ্যাঁ বলো।’

‘বারবিকিউ সস-এর কী হল?’

‘আমি ওটা দিতে যাচ্ছিলাম। ওটা দিতে হয় মাংস রাঁধার সময় যাতে করে সঠিক স্বাদটা পাওয়া যায়, তুমি তো সেটা জানো।’

‘একটা কথা বলি। এই ব্যাপারটা নিয়ে টস করা যাক। তুমি রাজি আছ মাররি?’

‘বেশ। ক্যারোলিন তুমি এদিকে এসো। তুমি মাংসটা উলটেপালটে রোস্ট কর, আমরা ততক্ষণ টস করে নি।’

‘ঠিক আছে।’

‘একবারই কল করবে’, বলল ফ্র্যাঙ্ক। ‘কল করবে যখন কয়েনটা বাতাসে ঘুরছে।’

ফ্র্যাঙ্ক কয়েনটাকে অনেক উঁচুতে টোকা মেরে পাঠাল।

‘হেডস!’ চেঁচিয়ে উঠল মাররি।

কয়েনটা এসে পড়ল। ওরা এগিয়ে গেল দেখতে।

হেডস ছিল।

‘ধোর বাঁড়া’, বলল ফ্র্যাঙ্ক।

‘তুমি যদি খেতে না চাও তাহলে খাবার দরকার নেই তোমার’, বলল মাররি।

‘আমি খাব,’ উত্তর দিল ফ্র্যাঙ্ক।

পরের দিন সকালে তারা চলেছে গাড়ি চালিয়ে। গাড়ির সামনে বসে আছে ফ্র্যাঙ্ক আর মাররি, আর পেছনের সিটে ক্যারোলিন। সূর্য উঠে গেছে অনেকটা। ক্যারোলিন পেছনের সিটে বসে আছে একটা হাত নিয়ে। হাতের আঙুলের মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে।

‘এই মেয়েছেলে খেতে পারে বটে, আমি এমন দেখিনি’, বলে ওঠে মাররি।

‘হ্যাঁ, আর প্রথম চাখাটা তো ওই চেখেছে। ছেলেটা গাড়িতে ওঠার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে’।

ফ্র্যাঙ্ক আর মাররি দু-জনেই হা হা করে হেসে ওঠে।

‘এইসব বাজে কথা কিন্তু, এক্কেবারে বাজে কথা!’

ক্যারোলিন গাড়ির কাচ নামিয়ে হাতটাকে বাইরে ছুড়ে ফেলে।

‘আমার পেটটা বড্ড ভরে গেছে’, মাররি বলে, ‘আমি আর একটাও হিপি দেখতে চাই না।’

‘তুমি একই কথা বলেছিলে ২ বা ৩ দিন আগে’ ফ্র্যাঙ্ক বলে ওঠে।

‘আমি জানি, আমি জানি…’

‘ওই দেখো! আস্তে চালাও! আমার মনে হয় আমি আর একজনকে দেখছি! হ্যাঁ, দেখো, দাঁড়ি, চটি, সাজগোজ’।

‘এটাকে বাদ দাও ফ্র্যাঙ্ক’।

হিপি তাদের দিকে বুড়ো আঙুল নাড়িয়ে লিফট চায়।

‘গাড়িটা থামাও মাররি। দেখা যাক না ও কতদূর যেতে চায়।’

ওরা গাড়ি থামায়।

‘কতদূর যাবে বাচ্চে?’

‘নিউ অরলিয়ন্স।’

‘নিউ অরলিয়ন্স? ওতে আমাদের কম করে যেতে ৩ বা ৪ দিন লেগে যাবে। বেশ উঠে পড়ো, বাচ্চা। যাও পিছনে গিয়ে বোসো আমাদের সুন্দরী ভদ্রমহিলার সাথে।’

হিপি গাড়িতে উঠে পড়ে আর মাররি গাড়ি চালাতে শুরু করে।

‘তোমার নাম কী, বাচ্চা?’

‘ডেভ।’

‘ডেভ। বাহ্‌ সুন্দর নাম। আমি ফ্র্যাঙ্ক। যে গাড়ি চালাচ্ছে ও হল মাররি। আর তোমার পাশের ওই সুন্দরী মাগিটার নাম ক্যারোলিন।’

‘আপনাদের সবার সাথে দেখা হয়ে ভালো লাগছে’, বলল ডেভ আর তারপর ক্যারোলিনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল।

‘তোমার সাথে দেখা হয়ে আমরাও খুশি হয়েছি’, হাসল ক্যারোলিন।

মাররি ঢেকুর তুলল আর তখনই ক্যারোলিন তার হাতটা রাখল ডেভের হাঁটুর উপর।

[এই লেখাটা নিয়ে বলতে গিয়ে বুকাওস্কি বলেছিলেন, এই গল্পটার মূল ভিত্তি আমেরিকার টেক্সাসে ঘটা একটা ঘটনার নিউজ রিপোর্ট। পরে পুলিশ যখন ওদের ধরে তখনও মেয়েটার হাতে ছিল একটা মাংসের টুকরো। সে-মাংস কীসের তা নিশ্চয়ই আর বলে দিতে হবে না।]