Categories
2021-NOVEMBER-STORY

কৌশিক মিত্র

ডাউনস্ট্রিম

ফরতাবাদের সুরমা অ্যাপার্টমেন্টের ১২ নং ফ্ল্যাটটা একটি আপাত কলহ অথবা কথা-কাটাকাটির পর স্তব্ধ হয়ে গেছে। এক চিলতে বারান্দা থেকে সিগারেটের ধোঁয়া চারিয়ে যাচ্ছে সামনের রাস্তায়, রাস্তাটা নাকবরাবর গিয়ে মিশে যাবে গড়িয়া স্টেশন রোডে। বাঁ-দিকে এগিয়ে একটু গেলেই হরিমতী গার্লস। ধোঁয়াটা ততদূর যাবে না, যাওয়া সম্ভব নয় বলেই। কিন্তু উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থাকল হরিমতী গার্লস স্কুল। সোনারপুর ব্লকের খাদ্য দপ্তরের পরিদর্শক অনিন্দ্য এখনও ঠিক করে উঠতে পারেনি মেয়ে সোনাইকে কোথায় ভর্তি করবে, কাছাকাছি হরিমতীর প্রাইমারি সেকশনে না কি আইসিএসই-র কোনো স্কুলে! চার বছর হয়ে গেল সোনাইয়ের। শিখার আপত্তি বোর্ড বা মিডিয়াম নিয়ে ততখানি নয়, যতটা অনিন্দ্যর গড়িমসি নিয়ে। অনিন্দ্য এই জায়গাটায় এসে বড়ো কনফিউজ্ড‌।ইংরেজি না বাংলা, আইসিএসই-তে না পড়লে কতখানি ক্ষতি হতে পারে সোনাইয়ের, সবাই কি হাসাহাসি করবে সোনাই বাংলা মিডিয়ামে পড়ছে বলে। মন বিদ্রোহ করে ওঠে মাঝে মাঝে! যদি পড়াতে নিজেকেই হয়, তাহলেও বছরে কম-সে-কম চল্লিশ থেকে ষাট হাজার টাকা স্কুলে দিতে হবে। কেন??? কেরোসিনের ডিলার হরি পালের মুখটা মনে পড়ে যায়, কী খুশিতেই না এসে মিষ্টি খাইয়েছিল নাতনিকে নামজাদা এক আইসিএসই বোর্ডের স্কুলে ঢুকিয়ে। এই সোশাল প্রেসার অনিন্দ্যকে গুটিয়ে রাখে। পাটুলির এক বিখ্যাত স্কুল থেকে ফর্মটা তুলে ফিল-আপ করে জমা দেবে কি দেবে না এটাই সে ভেবে যেতে থাকে। শিখার আপত্তি সংগত, এরপর দেরি করলে তো হরিমতীর শিশু শ্রেণিতে ঢোকাও মুশকিল হয়ে যাবে, ক্লাস ওয়ানে তো আবার লটারি।

অফিস থেকে অটোয় ফেরে অনিন্দ্য। অভ্যাসবশত, স্টেশন রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে সে পৌঁছে যায় বরদাপ্রসাদ হাই স্কুলের উলটো দিকের ইউনিক বুক স্টোর্স-এ। দোকানের মালিক নির্মলবাবুর ফেয়ার প্রাইস শপ আছে। দুই ছেলে এই দোকানটা দেখে, আবার ব্লকে খাতাপত্র সইয়ের জন্যও তারা প্রায়ই অনিন্দ্যর কাছে যায়। স্বভাবতই ছেলেদুটোর সঙ্গে অনিন্দ্যর সখ্যতা জমে যায়, নকাই তো অনিন্দ্যরই বয়সি ফিজিক্সে অনার্স, প্রচুর টিউশনও পড়ায়, মকাই একটু ছোটো। বেশিরভাগ সময়ে ইউনিকে মকাই-ই থাকে। খুব বেশিদিন অনিন্দ্য সোনারপুরে পোস্টিং পায়নি, সুতরাং আবাসনের বাইরে তার পরিচিতি কম, খুব একটা মিশুকে না হওয়ার কারণে সে এ-জায়গায় পিছিয়ে পড়ে, আবার ভেতরের আড্ডাবাজ মানুষটিকে সামলাতে না পারায় ইউনিক স্টোর্স তার গল্প করার একটা ঘাঁটি হয়ে দাঁড়ায়।

একটু আগেই ইউনিকে ঢুকেছে অনিন্দ্য। সন্ধ্যা নামছে। মেট্রোর গতিবিধিতে এই চত্বর এখন সর্বদাই সরগরম। কেন-না ঠিক পেছনেই কবি নজরুল। নির্মলবাবু মাঝে মাঝে দোকানে এসে বসেন। আগে কী ছিল, এখন কী হয়েছে এসব গল্প নির্মলবাবুর কাছ থেকে শুনতে ভালোবাসে অনিন্দ্য। আপাতত দোকানের সামনে ভিড় দেখে তার থমকে যাওয়া— হঠাৎ মকাই তাঁকে দেখতে পেয়ে যায়— ‘স্যার, এদিক দিয়ে আসুন।’ দোকানে ঢুকে একটা টুলে জমাট হয়ে যায় অনিন্দ্য।

এক সুবেশা চড়া মেক আপ নেওয়া ভদ্র মহিলার সঙ্গে মকাইয়ের তর্ক চলতে থাকে—

— ‘ম্যাডাম, আমি তো আগেই বলেছি অক্সফোর্ডের হার্ড বাইন্ড খাতা, একদিকে ছবি, রং পেনসিলের কাজ, অন্য দিকে টাইপড প্রিন্ট আউট নিয়ে সাঁটানো— পাঁচশোর এক পয়সা কমে দিতে পারব না।’

— ‘কিন্তু গাঙ্গুলীবাগানের মডার্ন সাড়ে তিনশো করে নিচ্ছে কী করে?’

— ‘ছবিটা তাহলে বাড়িতে এঁকে নিতে হবে ম্যাডাম।’

ভদ্রমহিলা ব্যাজার। ‘কত অ্যাডভান্স দিতে হবে?’

— ‘তিনশো।’— ভদ্রমহিলা তিনটে কড়কড়ে একশো টাকার নোট বার করেন।

বিলে লেখা শুর হয়।— দান্তে, মাইকেলঅ্যাঞ্জেলো, মোৎজার্ট, নেপোলিয়ন, আমুন্ডসেন… মকাইয়ের বিড়বিড় অথচ নির্লিপ্ত উচ্চারণ চমকে দেবার পক্ষে যথেষ্ঠ।

‘অন্বেষা সেনগুপ্তের নামে বিলটা করুন। ক্লাস ফোর। হ্যাঁ, মোবাইল নাম্বার… না না, স্কুলের নাম লেখার দরকার নেই কিন্তু কবে দেবেন?’ হ্যাঁ, একটা কথা মনে রাখবেন, দু-শোর ওপর ওয়ার্ড যেন না হয়! ম্যাক্স দু-শো দশ। আমি কিন্তু দেখে নেব।

— ‘বেশ। আজ বুধবার! শনিবার বিকেলে পাবেন।’

ভদ্রমহিলা চলে গেছেন। মকাইয়ের সঙ্গে অনিন্দ্যর টুকটাক কথা শুরু হয়।

— ‘কী ব্যাপার মকাই? ফোরের একটা মেয়েকে দান্তের উপর দু-শো শব্দে রচনা লিখতে হবে?’ আহা! রবীন্দ্র সদনে লিট্ল‌ ম্যাগাজিন মেলা থেকে কেনা কমল মুখোপাধ্যায়ের শিলীন্ধ্র-র দান্তে সংখ্যাখানা অনিন্দ্যর মগজে ঝিলিক দিল। এখনও পুরোটা পড়ে ওঠা গেল না।

— ‘না, স্যার রচনা-টচনা নয়। সিম্পল প্রোজেক্ট!’

— ‘প্রোজেক্ট ব্যাপারটা আগেও শুনেছি। তা একটা ক্লাস ফোরের বাচ্চা দান্তের উপর প্রোজেক্ট করবে?’

— ‘স্যার, ওভাবে ভাবছেন কেন? এখন স্কুল, পেরেন্টস, টিচার সবাই চাচ্ছে ছেলে-মেয়ে অল স্কোয়ার হোক। দান্তে থেকে প্রোগামিং সবকিছুই মগজে লোড করে নিতে হবে’—

— ‘বুঝলুম। তা তোমার ভূমিকাটা কি এখানে, বাচ্চাদের বকলমে তুমি এসব তৈরি করো নাকি?’

— ‘না স্যার, আমার সময় কখন? সব লোক আছে। খাতা-পেনসিল তো পাইকেরি রেটে কেনা। একটা ছেলে আছে, ইরেজিতে এমএ করেছে বিদ্যাসাগর থেকে ডিসট্যান্সে, দু-চারটে সাইট ঘেঁটে এসব তৈরি করে একেবারে স্পেসিফিকেশন মতো টাইপ করে প্রিন্ট-আউট দিয়ে চলে যায়। এক দিদি আছেন, বাচ্চাদের পড়ান, ভালো ছবি আঁকেন তার কাজ খাতায় ছবি, লেখাগুলো পেস্ট করে, ছবির পাশে অলঙ্করণের কাজটা করা— ব্যস প্রোজেক্ট রেডি।’

অনিন্দ্য ফিরে গেল ছোটোবেলায়। সেটা সম্ভবত ১৯৮৮। সে ওয়ানে। মা তখনই বিএড করতে গিয়েছিল, শ্রীমন্ত কাকু মা বিএড-এর প্র্যাকটিস টিচিঙের প্র্যাকটিকাল খাতা অলঙ্করণ করছে। তখন বিএড-কে বিটি বলা হত। যতদূর মনে পড়ছে রুল টানা অংশে প্রথমে লেখা ছিল শিক্ষক ক্লাসে যে-পিসটি পড়াতে চলেছেন সেটি কীভাবে উপস্থাপনা করবেন তারই বিবরণ-নমুনা হিসেবে সম্ভবত: ‘ভোরাই’ কবিতাটা ছিল। হায়, সে-খাতাগুলো যে কোথায় হারিয়ে গেল!

— ‘রেট’ কীরকম দাও?

— ‘কম্পাইলেশন আর প্রিন্ট আঊট একশো পঁচিশ, ছবি আঁকা-সাঁটানো পঁচাত্তর।’

— ‘খাতা, মলাট স্টিকার নিয়ে তাহলে আড়াইশো। বাবা! তোমার তো হান্ড্রেড পার্সেন্ট প্রফিট।’

— ‘খাতা পেন বই বেচে লাভ নেই স্যার। বই/খাতা এখন স্কুল থেকে নেওয়া মাস্ট। দোকান টিকিয়ে রেখেছে প্রোজেক্ট আর ইশকুল।’

— ‘বাঃ, এ তো দেখছি একেবারে ইন্ডাস্ট্রি!’

— ‘ঠিকই স্যার! কোর নয়, তবে ডাউনস্ট্রিম!’

ফিলড আপ ফর্ম নিয়ে আপাতত, সেই বিখ্যাত স্কুলের সামনে অপেক্ষমান অনিন্দ্য। গেটের অদূরে ভুট্টাওয়ালা, পাশে সুদৃশ্য চশমার দোকান। সে জানে, ফর্ম জমা দিলে সোনাইকে অ্যাডমিশন টেস্টে বসতে হবে। সিলেবাস দেওয়া আছে— ‘এ’ থেকে ‘জেড’ বড়ো ও ছোটো হরফে লেখা, ‘অ’ থেকে ‘ন’ পর্যন্ত লেখা এবং ‘ওয়ান’ থেকে ‘ফিফটি’ পর্যন্ত সনাক্ত করতে পারা— মোটের উপর এই হল সিলেবাস। এতে উতরোলে বাবা মা ক্যান্ডিডেট-সহ তিনজনকে ইন্টারভিউ বোর্ডের সামনে হাজির হতে হবে। তাতে কর্তৃপক্ষ খুশি হলে তবে অ্যাডমিশনের পরোয়ানা।

অনিন্দ্য টাইম মেশিনে করে ফিরে যাচ্ছিল ব্লকের স্থায়ী সমিতির মিটিঙে। নারী, শিশু ও সমাজকল্যাণ স্থায়ী সমিতির তরফ থেকে বক্তব্য রাখছিলেন সিডিপিও শুভাশিস গোস্বামী— শুভাশিস অনিন্দ্যদেরই সমসাময়িক— ৩-৬ বছর বয়সের বাচ্চাদের জন্য প্রথাগত শিক্ষা-প্রণালীকে এড়িয়ে ব্যবহারিক এবং বিনোদনমূলক শিক্ষাদান যে কত প্রয়োজনীয় সে-কথাটাই বোঝচ্ছিল শুভাশিস, ব্লকের (প্রোজেক্টের) ২০ খানা শিশুয়ালয়ে (মডেল আইসিডিএস সেন্টার) পূর্ণোদ্যমে কাজ শুরু হয়ে গেছে, দ্বিতীয় ধাপে ২৫টির কাজ শেষের মুখে, ওয়ার্কারদের সিনিতে (চাইল্ড ইন নিড ইনস্টিটিউট) অ্যাডভান্সড ট্রেনিং নেওয়ার পর্ব সমাধা। শুভাশিসের সঙ্গেই নিছক আগ্রহের বশেই হরিনাভীর কাছে একটা শিশুয়ালয়ে তার যাওয়া, বাচ্চাগুলোর জন্যে ট্রফি নিয়ে গিয়েছিল সে। সে এক আজব দেশ। সেই ফ্ল্যাশব্যাক এখন তাকে ছিঁড়েখুঁড়ে দিচ্ছিল।

সমস্যা হচ্ছে সোনাই পারছে না ঙ, ঞ লিখতে, এ-র মাত্রা কেন সে দেবে না এটা তার কাছে খুব দুর্বোধ্য, ওয়ান থেকে ফিফটি সিরিজে চিনলেও র‍্যান্ডম সিলেকশনে অসুবিধেয় পড়ে যাচ্ছে। মেয়েটা কুঁচকে যাচ্ছে দিনদিন! কয়েকদিন আগেও অফিস থেকে ফিরে বাপ মেয়ের সঙ্গে টিনটিন নিয়ে বসত। রোজ তিন পাতা। টানটান হয়ে থাকত মেয়েটা! বাবা থার্কেটা দুষ্টু, কেন ও ক্যাপ্টেন আর টিনটিনকে ছেড়ে দিয়ে চলে এল। ‘তিব্বতে টিনটিন’— শেষের পাতা। চ্যাংকে নিয়ে ফেরার পথে টিনটিন, ক্যাপ্টেন আর কুট্টুস। সোনাইয়ের চোখে জল টলটল— ‘এ কী রে কাঁদছিস কেন’— মেয়ে ছুটে পাশের ঘরে চলে যায়। আবার ফেরে— ‘বাবা, ইয়েতিটা কী করবে এবার? ও যে একা হয়ে গেল!’

ইনস্পেকটর সাহেব অনিন্দ্য বসুরায়, এখন বড়ো একা, তার চোখের সামনে একের পর এক বিভীষিকা। হাতের ফাইলটা খুলে সে ফর্মটা একবার দেখে। সামনের পাতায় সোনাইয়ের পাসপোর্ট ছবিখানা বড়ো করুণ ঠেকে। অস্ফুটে তার মুখ থেকে বেরিয়ে গেল— ‘লা ভিতা নুওভা’— সে নিজেকে এখন দান্তে আলিগিয়েরির সঙ্গে তুলনা করল। আপাতত ইনফার্নোর সামনে। একজন ভার্জিলের বড়ো দরকার ছিল এ-মুহূর্তে। পথ প্রদর্শক! পাশের দোকান থেকে একটা ছোটো ফিল্টার উইলস নিয়ে ধরায় সে, হঠাৎই চমক— ‘স্যার কী ভাবছেন এত? মেয়েকে এখানে ভর্তি করবেন নাকি?’

কেরোসিনের এজেন্ট অমিত চক্রবর্তীর ছেলে বাপি।— ‘চলুন স্যার অফিসে দিয়ে আসি।’

— ‘আপনি এখানে?’

— ‘একটু ব্যাঙ্কের কাজে এসেছিলুম আর কী। আমার মেয়েও এখানেই পড়ে স্যার! এখন ক্লাস ফোর, নিশ্চিন্তে ভর্তি করে দিন— খুব ভালো জায়গা। খরচাপাতিও কম। আর কিছু না হোক মেয়ে অন্তত ইংরেজিটা ফড়ফড় করে বলতে শিখবে। ব্যস আর কী চাই?’

— ‘কীরকম খরচাপাতি?’

— ‘বছর দুই আগে একজনকে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলুম, তখন ঐ অ্যাডমিশন চার্জ, টার্মিনাল ফীজ, টিউশন ফিজ, অ্যানুয়াল চার্জ, বইখাতা এসব নিয়ে হাজার বাহান্ন পড়েছিল, এখন আর কত হবে ষাট-পঁয়ষট্টি হবে বড়োজোর! ওসব নিয়ে টেনশন নেবেন না স্যার—ডিসকাউন্ট করিয়ে দোব।’

— ‘না মানে, কি জানেন তার আগে অ্যাডমিশন টেস্ট, ইন্টারভিউ এসব আছে তো, তাতে পাশ করা চাই।’

বাপি হো হো করে হাসতে শুরু করে— ‘স্যার টেনশন লেনে কা নেহি দেনে কা! আপনি আমাদের সাহেব— আর এই স্কুলের সামনে এসে আপনি টেনশন নেবেন, আর আমাকে দেখতে হবে! ম্যায় হুঁ না! ওসব টেনশন পাবলিকের জন্য। ছাড়ুন স্যার! আগে বলুন কী খাবেন লস্যি না স্প্রাইট!’

স্কুলের গেটের মধ্যে দিয়ে একঝলক তাকাল অনিন্দ্য! আলাদা করে একটা টেন্ট খাঁটানো হয়েছে, সামনে বড়ো করে সাইনবোর্ড টাঙানো আছে ‘অ্যাডমিশন কাউন্টার’।

অনিন্দ্য ধীরপায়ে গিলোটিনের দিকে এগিয়ে গেল।

Categories
2021-NOVEMBER-STORY

শুভজিৎ ভাদুড়ী

ঈশ্বর আর মানুষেরা

এক
সবে মাত্র দু-বার গাড়ি চলেছে। দু-বার গাড়ি খালি করে এসে তিন নম্বর বার গাড়ি লোড করার কাজ চলছিল। অর্ধেক ভরা হয়েছে এমন সময় থানা থেকে বড়োবাবু এসে হাজির। আবুল দাঁড়িয়ে ছিল পাশেই। বড়োবাবুকে দেখে খানিকটা এগিয়ে এসেছে। ‘কার গাড়ি?’ বড়োবাবু এগিয়ে আসতে আসতে প্রশ্ন করলেন। এসব প্রশ্ন করার সময় বড়োবাবুর গলার স্বর অস্বাভাবিক রকমের আত্মবিশ্বাসে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। আবুল খানিকটা দ্বিধা আর ভয় মিশ্রিত গলায় উত্তর দিল, “ছ্যার, আমার ছ্যার।”

“বালি তুলছিস কেন? বালি তোলা নিষেধ আছে জানিস না?”

আবুল কিছু বলতে যাবে তার আগেই বড়োবাবুর সঙ্গে থাকা একজন কনস্টেবল বলল, “জানে না আবার! এরা সব জানে।”

বড়োবাবু চোখ নাচিয়ে আবুলের দিকে তাকালেন। যে তিনজন ঠিকা শ্রমিক গাড়িতে বালি ভরার কাজ করছিল তারা কাজ থামিয়ে বড়োবাবুর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। হাতে ধরা বেলচা। সেপ্টেম্বর মাস। মাথার ওপর ঝকঝকে নীল আকাশ। বেলা বারোটার রোদ্দুরে সবারই গায়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। বড়োবাবু ঠিক এখানে আসেননি। একটা কাজ সেরে এই পথেই ফিরছিলেন। পথে দূর থেকে বালির গাড়ি চোখে পড়াতে এখন এসে দাঁড়িয়েছেন। গোটা রাজ্যে এখন বালি মাফিয়া, বালি চোরে ভরে গিয়েছে। এই নিয়ে থেকে থেকে ওপর মহল থেকে চাপ আসে। খবরের কাগজে লেখালেখি হয়।

“এটা তো চরার বালু নয় ছ্যার।” আবুল বলল। সে-কথা অবশ্য ঠিকই। বড়োবাবু চারপাশটা একবার তাকিয়ে দেখলেন। এখান থেকে বুড়িতোর্ষার সেতু দেখা যাচ্ছে বটে, তবে প্রায় আধা কিলোমিটার দূর তো হবে। এসব জমি হয়তো নদীর চর নয়। চাষের জমি। ইতিমধ্যে পুলিশ দেখে এখানে অল্প ভিড় হতে শুরু করেছে। আশেপাশে খাটছিল এমন ছেলে ছোকরা, বৃদ্ধ এমনকী কোলে বাচ্চা নিয়ে শীর্ণ কায়া কয়েকটা মেয়ে বউও এসে হাজির। কোথায় যে সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল এরা, আসলে পুলিশের পোশাকটাই এরকম, বড়োবাবু ভাবলেন। এত চোখে পড়ে আর সবাইকে একেবারে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে।

“চরের বালি না হোক, বালি তো! কার অনুমতি নিয়েছিস গাড়ি লাগানোর আগে? কাগজ দেখা।”

“কাগজ তো, আসলে…” আবুল আমতা আমতা করে,— “…ছ্যার, করা হয়নি ছ্যার।”

“তবে?” বড়োবাবু গলার জোর বাড়িয়ে বলেন, “নিয়ে যাব গাড়ি উঠিয়ে থানায়?”

গাড়ি থানায় উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার অর্থ জানে আবুল। খানিক পয়সা খসবে আর দিনমান ভোগান্তি।

ইতিমধ্যে ভিড়ের মাঝে এসে দাঁড়িয়েছে একজন যুবক। হাতে একটা কোদাল। বেশ আঁটসাঁট তামাদি চেহারা। একগাল দাড়ি। পরনে কেবল নীল চেকচেক লুঙ্গি। খালি গা। বুকে বড়ো বড়ো লোম। এখন ঘামে ভিজে গায়ের সঙ্গে সেঁটে গেছে। এ লালচান। বলল, “নিজের জমি থেকে বালা সরানোও দোষের?”

বড়োবাবু কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই ভিড়ের মধ্যে থেকে ভেসে আসা কণ্ঠ কানে এল তার, “নেতারা সব নদী থেকে বালা তুলে নিল, তাদের ধরতি পারেনা! হুজ্জুতি করার জন্যি এই গরিবগুলানকেই পায়।”

লালচান কিছু বলছে না। কেবল দেখছে বালি পড়ে সাদা হয়ে থাকা জমিতে মাঝখানে কেবল কিছুটা খাবলা। সবে মাত্র দুই ট্রলি বালি পার করা গিয়েছে। তার মধ্যেই এই বিপত্তি। এই বছর যেন বিপত্তির আর শেষ নেই। প্রথমে বন্যার জল ঢুকে ঘর বাড়ি সব ভাসিয়ে দিল। এত প্রবল বন্যা লালচান বহুদিন পর দেখল। রাজ্য সড়কের ওপর দিয়ে হুহু করে জল বইছে। জমি বাড়ি সব জলের তলায় পড়ে থাকল আধা মাস। সারা বচ্ছর বয়সের গাছপাথর না থাকা বুড়ি ঠাকুমার মতো রোগা হ্যাংলা শরীর যে, বুড়িতোর্ষা নদীর সে কিনা আঠারো বছরের সোমত্থ যুবতীর মতো ফুলে ফেঁপে উঠল। জল নামলে দেখা গেল জায়গায় জায়গায় চাষের জমিতে ঢের নদীর বালি এসে জমা হয়েছে। এখন এই বালি না সরালে চাষ হবে কী করে! আর চাষ না হলে খাবে কী?

লালচানের সম্পত্তি বলতে এই তিন বিঘা চাষের জমি। বছরে কখনো লোকের জমিতে শ্রম দিয়ে আর কখনো নিজের জমিতে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চাষ করে সংসার চলে। ঘর-ভরা সংসার। বাপ, মা, বউ, তিন-তিনটা ছেলেপুলে। সব মিলিয়ে মোট সাতটা উদগ্র হাঁ করে থাকা পেট। সেই পেট ভরার জন্য জমিতে ফসল হওয়াটা জরুরি। ফসল না হলে শুধুমাত্র লোকের জমিতে বাড়িতে গতর ঝড়িয়ে ওই পেট ভরা অসম্ভব। নিজের পেটে খিদের জ্বালা তবু সহ্য করা যায়, কিন্তু যখন ওই একরত্তি বাচ্চাগুলা পেটের জ্বালায় হামলাবে তখন? চুপ করে বসে দেখবে এমন পাষাণ হৃদয় কার আছে!

লালচান তাই তেড়ে ফুঁড়ে এগিয়ে গেল, “এরা কী বলতেছে আবুল?”

আবুল হাত দেখিয়ে লালচানকে শান্ত হতে বলে। আবুল বলেছিল, নিজের থেকেই বলেছিল, যে ও বালুটা সরিয়ে দেবে। ওর নিজের ট্র্যাক্টর আছে। লাফাবাড়িতে একজনের নতুন ঘর উঠছে। ভিটে উঁচু করার জন্য বালু দরকার। আবুল লালচানের জমি থেকে বালু সরিয়ে ওখানে দেবে।

পয়সা যা পাবে সেটা ওর লাভ হবে, আর তাছাড়া লালচানেরও উপকার হবে। এখন এতে দোষের কী আছে সেটা লালচানের মাথায় ঢুকছে না। সে চিৎকার করে এইসব বলছে।

বড়োবাবু সামান্য হলেও দ্বিধাগ্রস্থ। চাইলে গাড়িটাকে তিনি থানায় তুলে নিয়ে যেতেই পারেন। কিন্তু বালি চুরি আটকানো তার একার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। জেলা স্তরের বিভিন্ন সরকারি মিটিং-এ তাকে এই নিয়ে কথা শুনতে হয় তাই তিনি গা ঘামিয়েছেন। তবে নদীর চর থেকে তুললে তিনি ধরতেন অবশ্যই। কিন্তু বন্যার জলের সঙ্গে আসা এবং চাষের জমিতে ফেলে যাওয়া বালুর ক্ষেত্রে নিয়মটা ঠিক কী এ-ব্যাপারে তার সঠিক ধারণা নেই। আবার এতটা সময় নষ্ট করে শুকনো হাতে ফিরে যাবেন এটা ভাবতেও তার ভালো লাগছে না।

দুই
সুরঞ্জন ভাবছিল এবার অফিস থেকে বেরোবে। বেলা দেড়টা বাজতে চলল। আজ সে অফিসে আসতই না। কিন্তু একটা জরুরি কাজ ছিল বলে আসতে হয়েছিল। কাজটা সেরে নিয়েই ফেরার কথা ছিল। আজ সকালের ট্রেনে ওর স্ত্রী এসেছে কলকাতা থেকে। সুরঞ্জন নিজেও কলকাতার ছেলে।

এতদিন চাকরিসূত্রেও কলকাতার আশেপাশেই ছিল, গতবছর বদলি হয়ে পশ্চিমবঙ্গের একপ্রান্তে এই কোচবিহার জেলায় এসে পড়েছে। এখানেই এক ব্লকের ভূমিরাজস্ব আধিকারিক। ঘর ভাড়া নিয়ে একাই থাকে। ফ্যামিলি আসেনি। আসবেই-বা কী করে! ওর বউ তো কলকাতায় চাকরি করে।

সামনের কম্পিউটার বন্ধ করে সবে চেয়ার ছেড়ে উঠেছে এমন সময় ফোন বেজে উঠল। মোবাইল স্ক্রিনে ভেসে উঠল— ওসি।

“বলুন।”

“একবার সাউদের বস-এ আসতে পারবেন? বালির গাড়ি ধরেছি।”

অনিচ্ছে থাকলেও মুখের ওপর একেবারে না করতে পারল না সুরঞ্জন। পদাধিকার বলে সে ওসি-এর থেকে উচ্চ। কিন্তু থানার সঙ্গে তাদের একটা ভালো সম্পর্ক রেখেই চলতে হয়, কতরকম দরকার অদরকারে লাগে। সে বলল, “ক-টা গাড়ি?”

“একটাই।”

“আসছি। একটু থাকুন।”

বালি মাফিয়াদের নিয়ে সারা রাজ্যেই বেশ অস্থিরতা চলছে। উত্তরবঙ্গের এই জেলাও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে দক্ষিণবঙ্গের তুলনায় মাফিয়াদের দাপট এখানে অনেক কম। তবে যেদিকে চলেছে রাজ্য তাতে পরিবেশ অশান্ত হতে সময় লাগবে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তো শাসক দলের নানান মাপের নেতাদের যোগসাজশ পাওয়া যায়। আর এদিকে প্রশাসনিক সভায় নির্বিচারে ভূমিরাজস্ব দফতর চোর অপবাদে গালাগাল খেতে থাকে। তাদের অকর্মণ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। অথচ ব্লকের এত গুরুত্বপূর্ণ একটা অফিসের নিজস্ব একখানা গাড়ি নেই। বাইরের লোকের মোটর সাইকেলই ভরসা।

সত্যি বলতে কী থেকে থেকে বেশ লজ্জা লাগে! সুরঞ্জন যেতে যেতে ভাবছিল। বুড়িতোর্ষার সেতুর ওপর থেকেই জটলাটা চোখে পড়ল। বাইক থেকে নেমে বালির উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সুরঞ্জন জটলাটার কাছে এল। তারপর খানিক হই হট্টগোলের মাঝে সবটুকু শুনে বলল, “বালি বন্যার জলের সঙ্গেই আসুক আর যাই হোক বালি উঠানো বে-আইনি। বালি তোলার কোনও অনুমতি আমরা দেবনা। আর এগুলো জমির শ্রেণি কি? নদী বা সিকস্থি নয়তো?”

হাঁ হাঁ করে উঠল লালচান। তার সঙ্গে গলা মেলালো আরও অনেকে। সমবেত কণ্ঠস্বর জানান দিল জমি চাষেরই বটে। শ্রেণি ডাঙ্গা। সে খানিক গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “শোনো বালু তোলা যাবে না। কাজ বন্ধ। যেটুকু কাজ হয়েছে এর জন্য রয়্যালটি লাগবে। ফাইন হিসাবে দিতে হবে।”

লালচান বলল, “ছ্যার, বালি না সরান দিলে চাষ কীভাবে হবে? বিছন মাটি না পেলে ফসল হয়?”

কথাটা যে ন্যায্য তা সুরঞ্জনও জানে। কিন্তু সে কী করবে? তারও তো হাত পা বাঁধা। দিন সময় ভালো না। এখানকারই এক সাংবাদিক সারাক্ষণ খবরের জন্য ছোঁকছোঁক করে। তিলকে তাল বানিয়ে খবর ছাপায়। সে-সব খবর দেখিয়ে উপরমহল কৈফিয়ত চায়। কী দরকার অকারণ নিজের ওপর ঝামেলা ডেকে আনার। তাছাড়া একজনকে দয়া দেখালেই সব একেবারে পেয়ে বসবে। তবে এরা একেবারেই হদ্দ গরিব। কিন্তু এদের থেকে তো আর ফাইন নেবে না, ফাইন দেবে যে-ছেলেটা গাড়ি লাগিয়েছে সে। কী যেন নাম, আবুল শুনল বোধহয়। তবে সেও যে এই কাজটা করে বিশেষ কিছু পয়সা করবে তেমন নয়। নিজের সামান্য কিছু লাভ রেখে এ আসলে একধরনের সামাজিক উপকার। জমির উর্বরতা ফিরিয়ে দেওয়া। তাই এদের থেকে ফাইন নিতে যে ইচ্ছে করছে সেটাও নয়। কিন্তু এখন এই পুলিশের সামনে একেবারে কোনো ফাইন ছাড়া ছেড়ে দিলে ওরা হাসাহাসি করবে। পরে কোনো দরকারে ওদের ডাকলে খোঁটা দিয়ে কথা শোনাবে। তাই পুঞ্জীভূত অসন্তোষের মাঝে দাঁড়িয়ে সুরঞ্জন হাত তুলে বলল, “এই বালির গাড়ি রাস্তা দিয়ে গেলে কাগজে ছবি উঠবে। এলাকার লোকেরাই বালি চুরির অভিযোগ করবে। তখন আমার চাকরি নিয়ে টানাটানি।

কোনো বালি কোথাও সরানো যাবে না। আর যেটুকু কাজ অন্যায়ভাবে হয়েছে তার জন্য ফাইন দিতেই হবে।”

সমবেত ভিড়ের মধ্যে গুঞ্জন উঠলে সে আরও গলার জোর বাড়িয়ে বলল, “টাকা তো আর আমাকে দিচ্ছ না। সরকারি রসিদ পাবে। সরকারকে টাকা দিচ্ছ। আর না হলে থানার লোক আছে গাড়ি উঠিয়ে নিতে বলছি। যা হবে তা আইন মেনেই হবে।”

মুখে আইনের কথা বললেও সুরঞ্জন জানে এসব আসলে আইনের ফাঁক। আইনে ঠিক এরকম কথা বলা নেই। সরকার এক-একটা ভূমিরাজস্ব অফিসে রাজস্ব আদায়ের বড়ো বড়ো লক্ষ্যমাত্রা স্থির করে দেয়। সেই ‘টার্গেট’ পূরণ করতে এইভাবে নরমে গরমে কিছু আদায় করতেই হয়।

যাদের মুখের জোর বেশি, যারা তুলনামূলক অসহিষ্ণু, যাদের নেতা ধরা আছে তাদের সামনে গুটিয়ে থাকে দফতর। কত কত বাংলা ইট ভাটা সরকারকে এক পয়সা রাজস্ব না দিয়ে মুনাফা করে চলে। কত ‘সেয়ম’ জমি ‘দুয়েম’ জমি পুকুর হয়ে যায় রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে। কত ‘পুকুর’ দিনের আলোয় ‘বাস্তু’ হয়ে যায় আইনকে কাঁচকলা দেখিয়ে।

শেষমেষ আরও কিছু কথা কাটাকাটির পর দু-হাজারে রফা হল। সুরঞ্জন রসিদ বই বার করে খসখস করে লিখে দিল ‘আনঅথরাইজড এক্সট্র্যাকসন অফ আর্থ’। হ্যাঁ, “আর্থ”। পাগল নাকি যে “স্যান্ড” লিখবে। অ্যামাউন্ট লেখার সময় থানার বড়োবাবু একটু নাক সিটকালো। নীচু গলায় বলল, “এত কমে ছেড়ে দিলেন! থানায় নিয়ে গেলে মিনিমাম দশ নিতাম।”

সুরঞ্জন অবশ্য সে-কথায় বিশেষ কান করেনি। কারণ, লালচান তখন তাকে জিজ্ঞেস করেছে, “এবার তালে বালাটা পার করতে পারব?”

“একদম না। এটা অন্যায়ভাবে যে কাজটা হয়েছে তার জন্যে ফাইন। কাজ করার পারমিশন না। আর একবারও গাড়ি চলবে না।”

“পারমিশন কে দেবে তাইলে?”

“কেউ দেবে না।” ফাঁপা সরকারি দম্ভের বুটজুতো বালির ওপর মসমস করে সে যখন ফিরে যাচ্ছে তখন পেছন থেকে আবুলের গলা আলতোভাবে তার কানে এল, “বেকার বেকার খানিকটা টাকা খসল, তবে ভাবিয়েন না। ভোর রাতে গাড়ি লাগাব।”

তিন
প্রেম! কী গভীর প্রেম তার! কী গোপন সহবাস! এ-শরীর সে বানায়! এ-মাটি সে বানায়! তাঁর শরীরের ঘাম টুপটুপ করে গিয়ে পড়ে তৃষ্ণার্ত বুকে! ঘামে বুক না ভিজলে সঙ্গম হয় না। নরম হয়! নরম! নরম হতে হতে হাঁ করে থাকে বিছনের জন্য। তখন আর শুধু প্রেম থাকে না। থাকে পূজাও।

হাত জোর করা আকুল আকুতি। হে আমার ফসল ঘরে এসো। হে আমার ঈশ্বর ঘরে এসো। ছড়িয়ে দাও তোমার সুগন্ধ। দাও। দাও। দাও।

একটানা শব্দটা সুরঞ্জনের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তবু সে নিজেকে অটুট রেখেছে। আট বছর পেরিয়ে গিয়েছে বিয়ে হওয়া। বোধহয় কলকাতার কোনো গাইনি কোনো ফারটিলিটি ক্লিনিক আর বাকি নেই। সব দেখানো হয়ে গেছে। প্রায় তো মেনেই নিয়েছে ভাগ্য বলে। তবু আজও কেন যে এই প্রক্রিয়াটা দহন করে! কেন কেবল আনন্দ হয় না! আজ কি আরও বেশি করে যন্ত্রণা হচ্ছে? সংগম অসম্পূর্ণ রেখে নিজেকে স্ত্রীর শরীর থেকে পৃথক করল সুরঞ্জন। তারপর ওর পাশেই পা ভাঁজ করে হাঁটুর ওপর মাথা নামিয়ে বসল। ওর পাশে এখন ওর স্ত্রীর নগ্ন নির্জন দেহস্তব্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে। হঠাৎ মনে হল ওরা চলে আসার পর লালচান কি ওর জমির পাশে ঠিক এভাবেই বসে ছিল? ওকে কি তবে লালচানের মতো দেখাচ্ছে! ও নিজেই কি আসলে লালচান? না না, তা কী করে হয়! লালচানের জীবনে ওর ভূমিকাটা তো সেই অদৃশ্য অদেখা ঈশ্বরের মতো! যার অঙ্গুলি হেলনে উর্বরতা নষ্ট হয়ে যায়! অনন্ত সম্ভাবনার ওপর যে বালি ছড়িয়ে দেয়! তবে কি ও নিজেও ঈশ্বর! তাই-বা কীভাবে সম্ভব! ও নিজে তো এই বিরাট সমাজব্যবস্থা আইন ব্যবস্থার এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কীটবৎ অংশ যে শিশুর মুখস্থ করা পড়া আওরানোর মতো সমাজের দুর্বোধ্য নিয়মগুলোর চর্বিতচর্বণ করে। ঈশ্বর তো সে যে অদেখা অলভ্য। যার কেবল আকাঙ্ক্ষা করা যায় ভ্রূণ রূপে, কুঁড়ি রূপে। মনে হতেই, সুরঞ্জন, আবার নেমে গেল স্ত্রীর শরীরে, যেভাবে কুমীর জলে নামে।

প্রেম! কি গভীর তার প্রেম! কি গোপন তার পুজা! যেন নিজের যৌনাঙ্গটাকে বেলচার মতো করে চালাচ্ছে সুরঞ্জন। প্রাণপণ। যেন নিজের সমগ্রটাকেই সে একটা বেলচার মতো করে চালাচ্ছে। সে একা নয়। তার সঙ্গে আরও অনেক স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞ, বন্ধাত্ব বিশেষজ্ঞ। ফারটিলিটি ক্লিনিকের বড়ো বড়ো সাইন বোর্ডের আড়ালে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে ওর শরীর। মাটি খুঁজে বার করতে হবে। ফসল ঘরে এসো। এসো ঈশ্বর।

ক্লান্তি

ক্লান্তি

ক্লান্তি!

শরীরজুড়ে নেমে আসে ঘুম। বালির শরীর। বালির বিছানা। যখন দু-হাত ছড়িয়ে উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছে একটা নিস্তব্ধ দেহ, বাইরে ভোর হচ্ছে।

লাফাবাড়িতে যাদের ভিটায় বালি দেওয়ার কথা ছিল তাদের দিয়েও এক গাড়ি বেঁচেছে বলে আবুল ওটা নিজের বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে। ভোরের কাঁচা আলোয় দেখা গেল ওই যে গাড়িটা বুড়িতোর্ষার সেতু পেরিয়ে গেল।

জমির বুকে হাত রেখেছে লালচান। রং দেখছে। বুকের ওপর জন্মানো আগাছা দেখে ও মাটির মন বোঝে। তবে এখন তো সব খাঁ-খাঁ। যেন ওর সামনে নতজানু হয়ে বসেছে সেই অষ্টাদশী কিশোরী। জড়সড়। আগে আড় ভাঙতে হবে। মুখোমুখি বসেছে লালচান। দু-হাতে ঘাঁটছে। আবার প্রণামও করছে। ওর গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। এসো, এবার ছড়িয়ে দাও তোমার সুগন্ধ…

Categories
2021-NOVEMBER-STORY

শর্মিষ্ঠা বিশ্বাস

গিনিপিগ

এই লোকটা, সেই লোকটাই— যাকে চিনতে রীতিমতো গবেষণা করতে হয়েছে। তবে কি মানুষকেও গবেষণার জন্য গিনিপিগ করা যায়? তাহলে লোকটাকে একটা গিনিপিগই বলি। এই যে ‘বলি’— শব্দটায় একজন বক্তা আছেন। তিনিও লোকটার মতো একজন মানুষ। মানুষই মানুষকে বোঝে। অবিকল হাত পা, মাথা, পেট, বুক, জনন, প্রেম, চুম্বন সবই মানুষের আছে বলে, অন্য মানুষকে বোঝা সহজেই সম্ভব। কিন্তু গিনিপিগ? সে-তো খুদে একটি চঞ্চল প্রাণী! সারা শরীরময় ইট-সাদা, সাদা-কালো গোলাকার দাগ। ওগুলো এক-একটি পৃথিবী। ওইসব পৃথিবীতে বারংবার মহামারি গেছে, এসেছে। ওরা সবকিছুকেই ঝেঁটিয়ে লোকচক্ষুর অন্তরালে আবারও গবেষণাগারের স্বেচ্ছাবন্দিত্ব মেনে নিয়েছে।

এইসবের কোনো বিচার নেই। গিনিপিগকে শুয়োরের বাচ্চা বললে ও কোনো প্রতিবাদ করতে পারে না। চুপচাপ গবেষণাগারের জেলখানার কয়েদি হয়ে মিটিমিটি হাসে। একজন মানুষ গিনিপিগকে বোঝে না বলে, আগের সেই ‘আমি-বক্তা’ এইবার গিনিপিগ হওয়ার চেষ্টা শুরু করল।

বউকে বলল— ও বউ, খেতে দাও। বউ ওমনি তাড়াতাড়ি পাকের ঘর থেকে এক থালা গরম ভাত আর কলমির গন্ধভরা জলের থেকে আবিষ্কৃত শাকের মৃতদেহ নিয়ে স্বামীর ভাতের থালার ওপরটা দেখতে দেখতে উঠোন পেরিয়ে দাওয়াতে উঠে গেল। সাদা ভাতের ওপর সবুজ কলমির শাক ততক্ষণে জলে ভাসা মৃতদেহ হয়ে গেছে। এক হাতে বউটার জলের ঘটি। ওই হাতের বগলে গোঁজা তালপাতার হাতপাখা। পাখার হাওয়ায় ভাত জুড়োবে। জুড়োবে বউয়ের মন।

আহা! স্বামী বলে কথা! জন্মজন্মান্তরের বোঝাপড়া! বউকে কখনো সখনো জড়িয়ে ধরলে লোকটার যৌবন ফিরে আসে।

যৌবন কি সত্যিই ফিরে আসে? এসবও গিনিপিগের মতোই গবেষণার বিষয়। তবে, মহাজনের কাছে হাওলাত বরাত বন্ধ হয়ে গেলে লোকটা বউকে পেটায়। মারতে মারতেই বনবন করে গাছের মগডালে উঠে যায়। আবারও সরসর করে নীচে নেমে আসতে গিয়ে পঞ্চায়েতি বিচারকদের দেখে পাতার আড়ালে চলে যায়। অর্থাৎ, লোকটা তখন একটা গিনিপিগ। ওকে আড়াল করতে সারা শরীরে পেটাইয়ের ব্যথা নিয়ে এবার ওর গিনিপিগ বউ দরজার খুঁটিতে দাঁড়িয়ে ছেঁড়া আঁচলে মুখ চেপে বলে— তিনি বাড়ি নাই।

গিনিপিগ সন্ধ্যাকালে সরসর করে নীচে নেমে আসে। নিজের যৌবনকে আদর করে ডেকে নিজেকেই বলে— আয়…

রাত বাড়লে আকাশ জুড়ে পূর্ণিমার ধবধবে সাদা চাঁদের কামিনী কাঞ্চন। গিনিপিগ তাঁর বউ গিনিপিগকে জড়িয়ে ধরে ফিরে যায় যৌবনের গবেষণা করতে। কেন, কেন তাদেরকে শিকার করে একদল মানুষ?

আবারও সকাল হয়। গতকালকের রাতের অভিজ্ঞতাকে নোটপ্যাডে মনে মনে লিখে রেখে গিনিপিগ জনমজুরি খাটতে যায়।

বউ চুলাতে রান্না বসায়। কাঁচা-পাকা পাতা পোড়ার গন্ধে বউয়ের হাতের কারসাজিতে জলে ভাসতে ভাসতে আসা রান্না করা ঢোলকলমির শাক করোনাতে মৃত্যু হওয়া লাশ হয়ে যায়।

এই লাশটাও কেউ ছিল। একদিন ওর ঘর ছিল। বউ ছিল। জলে ভাসা কলমির দামের মতো সংসার ছিল। বউ শাকভাত রান্না করে লোকটাকে খেতে দিত। রাত হলে আদর করত! আরও কত কিছু করত বউটা, ওই মৃতদেহর জন্য!

চিন্তায় ছেদ পড়ে। সারাদিন খেটেখুটে স্বামী স্ত্রী খেতে বসেছে। বেলাবেলি খেলে গরিবের একবেলার খাবারেই দু-বেলার স্বাদ মেটে। এসব সরকার জানে না। সরকারের ঘর থেকে আসা ফ্রী রেশনের চালের ওপর গিনিপিগেরা তিড়িংবিড়িং করে লাফায়। আটা কিম্বা ফ্রি গম দশ টাকা কেজিতে বিক্রি করলে বিনা পুঁজির ব্যাবসাতে লক্ষ ঘরে আসে। বিদ্যুতের ব্যবহার শিখে গেছে ওরা। আর সেখানেও বিপিএল -দের টিকিয়ে রাখার ভোটব্যাংকের শুভকামনায় দুটো বাল্ব আর একটা পাখার মিটার রিডিঙের কাঁটা শূন্যতেই দাঁড়িয়ে থাকে। গিনিপিগদের বরাদ্দকৃত জমানো কেরোসিন তেল শহর থেকে আগত তেল ক্রেতাদের কুড়ি টাকা লিটারে বিক্রি করে দেয়। ওই তেল দিয়ে করোনাকালে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বাস মালিকেরা মোবিলের সঙ্গে মিশিয়ে বাস চালায়। পরিবেশে দূষণ বাড়িয়ে তোলে সেই তেল পোড়া কার্বনমনোক্সাইড গ্যাস। গ্যাসের ধাক্কায় গিনিপিগের শরীরের গোল গোল চাকা চাকা সাদাকালো পৃথিবীতে ধস নামে।

তাতে কিছুই এসে যায় না গিনিপিগদের। বাঁচা মানে বর্তমান। কার কী ভবিষ্যৎ হবে, কে বলতে পারে?

বিনা পুঁজির ব্যাবসা সম্প্রসারণ করতে করতে এভাবেই চঞ্চল প্রাণীগুলো সামনের দিকে এগোয়।

এতক্ষণে বউ গিনিপিগ এঁটো থালাগুলো জড়ো করে বয়ে নিয়ে যায় সেই জলের কাছে। মাজাঘষা সারতে সারতে রাত বাড়ে। জলে ভাসা কলমির গন্ধভরা মৃতদেহকে সনাক্তকরণ হয়ে গেছে ততক্ষণে। এটা করোনা বডি। দৌড়ে এসে স্বামীকে জানায় সে। এতে স্বামী গিনিপিগের কোনো হেলদোল নেই। কেন-না, এই সময়টাতে সে নিশ্চিন্তমনে ভাবতে বসে। এঁটো হাত শুকিয়ে কাঠ! চোখে নেশা ধরানো জলে ভাসা কলমির গন্ধভরা মৃতদেহকে এখন চিতায় তোলা হবে। পাশাপাশি আরও চিতা। চিতাতে শায়িত প্রতিটি বডিই গিনিপিগের। গণচিতার আগুনের ধোঁয়ায় চারদিক ছেয়ে গেছে।

এতক্ষণে গিনিপিগ বউ গিনিপিগকে বলল— জোরে নয়। এটা আমাদের দু-জনের মৃতদেহগুলোর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন। আস্তে আস্তে আমার সঙ্গে শেষের কথা বলো— “বলো হরি, হরি বোল! রাম নাম সাথ হ্যায়…”

Categories
2021-NOVEMBER-STORY

সুরঞ্জন প্রামাণিক

গল্প নেই শহরের মানুষ

ইদানীং সমীরণ যে-কোনো চরিত্রকে শর্ট-ফিল্মের ছোটো ছোটো ফ্রেমের মধ্যে ধরতে চাইছে বা বলা যায় চিত্রনাট্যের ফ্রেমে আটকে দেখতে চাইছে বা বলা ভালো দেখছে। যেমন এখন, ওই দেখুন তার দু-হাতে ফ্রেমমুদ্রা। আনুভূমিক বুড়ো আঙুলদু-টি পরস্পরের দিকে আস্তে আস্তে দূরে সরে সরে যাচ্ছে। আর সমীরণের দৃষ্টি অনুসরণ করলে আপনি দেখতে পাবেন একজন বয়স্ক মানুষ মাথা নীচু করে ধীরে হাঁটছেন।

মানুষটা ফ্রেমের বাইরে চলে গেলে সমীরণ আপনাকে বা আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারে, আমরা লোকটাকে দেখলাম কি না, ‘যেন কী এক ভার বইছেন, না?’

আপনি ভাবতেই পারেন সমীরণ বুঝি তার দেখাটা আপনার উপর চাপিয়ে দিচ্ছে। অথবা আপনার সেরকম মনেও হতে পারে। আপনি সায় দিলেন।
এবার সমীরণ তার বসার ভঙ্গি বদলে আপনার মুখোমুখি, ‘আচ্ছা বলুন তো, এই মনে হওয়া কীভাবে ভিস্যুয়ালাইজ করা যায়!’ এটা সমীরণের গুণ। সে দর্শক-পাঠকের কাছ থেকে নিয়ে তাঁদেরই ফিরিয়ে দেয়। তার কথায় এ একধরনের ‘মাধুকরী’। সৃষ্টির জন্য। ভোগের জন্য নয়। মাঝে মধ্যে মনে হয়, সমীরণ যত না শিল্পী তার চে’ অনেক বেশি দার্শনিক। আর এ-কারণে আমি তার ভক্ত। তাকে বোঝার চেষ্টা করি। তার সহযোগী হতে চাই।

ফ্রেমমুদ্রায় সমীরণ ও পাশে বসা তার বন্ধুকে দেখে এসব আমার মনে ঘটল এবং একটা গাধা ঢুকে বেরিয়ে গেল ওই ফ্রেম থেকে। আমার মনে হল সমীরণকে কিছু বলা দরকার।

তার আগে ফ্রেমবন্দি বয়স্ক মানুষটার গল্প বলে নিতে হবে। মানুষটার গল্প মানে আমাদেরও গল্প। মানুষটার নাম বিধু, বিধুভূষণ। একসময় বিধুদা আমাদের সঙ্গে মেলামেশা করতেন। এই চায়ের দোকানে বসেই তিনি আড্ডা দিতেন। বিধুদাকে গল্পবাজ বলা যাবে কিনা জানি না। তিনি অবশ্য গল্পের টানেই এখানে আসতেন। গল্পের ম্যানুস্ক্রিপ্ট পড়া ছিল তাঁর নেশা। নেশাটা কোথায় বলুন তো! গল্প আবিষ্কার করা। বুঝলেন না তো! মানে গল্পের মধ্যে নানা গল্প তিনি দেখতে পেতেন। আমরা চমৎকৃত হতাম। বিশেষ করে লেখক। একবার সমীরণই তিন-তিনটে নতুন গল্পের সম্ভাবনা দেখে ভীষণ আপ্লুত হয়েছিল, কী এক আবেগে বিধুদাকে প্রণাম করে বসে। একবার হল-কী— কারো একটা গল্প পড়ার পর বিধুদার মুখ কেমন বে-বোধার মতো হয়ে গেল সেদিন। ম্যানুস্ক্রিপ্টে আরও একবার চোখ বুলিয়ে যেন নিজের মনেই নীচের ঠোঁট উলটে মাথা নাড়লেন। তাঁকে হতাশ দেখাচ্ছিল। বললেন, কথাটা এখনও মনে আছে, ‘খবরের কাগজের ঘটনা নিয়ে গল্প— ঘটনার বাইরে নতুন কোনো গল্প পাওয়া গেল না ভাই!’

তার পর অদ্ভুত সব বদলে যেতে থাকল। আমি গল্প লিখতে পারছিলাম না। সমীরণের গল্পেও বিধুদা আর নতুন গল্প পাচ্ছিলেন না। তাঁরও আসা কমে গেল। এর মধ্যে আমাদের অনেকেই কম্পুটারে লিখতে শুরু করেছি। মানে হাতে লেখা ম্যানুস্ক্রিপ্টের দিন শেষ। এসব জেনে বুঝেই হয়তো তিনি আর আসেন না। জানি না তিনি ফেসবুক সাহিত্যের কথা জানেন কি না। মাঝে একদিন পথে দেখা। কেমন আছেন জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ‘ভালো নেই!’

‘কেন কী হয়েছে?’

আমার মুখের দিকে, বলা ভালো চোখের দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন, ‘গল্প লিখছ?’

আমি বললাম, ‘না।’

‘তুমি ভালো আছ?’

আমার কথা না শুনেই তিনি বললেন, ‘কী করে ভালো থাকবে! গল্প না থাকলে কি ভালো থাকা যায়? আচ্ছা ভাই আসি!’

সেদিন তাঁকে বেশ ঋজুই মনে হয়েছিল। এটা মনে হতেই সমীরণকে আর গাধার কথা না বলে বললাম, ‘তুই বরং বিধুদার সঙ্গে কথা বল! ক্যারেক্টারকে তো ভিতর থেকে জানতে হবে। সবচে’ বড়ো কথা, বিধুদাকে তুই প্রজেক্ট করতে চাইছিস কেন, এটা ভালো করে বুঝতে গেলে তো বিধুদাকে স্টাডি করা দরকার।’

সমীরণ কী ভেবে বলল, ‘আমার মনে হচ্ছে, বিধুদা এই সমাজে বেঁচে থাকার বৈধতা হারাচ্ছেন!’

‘কেন, এরকম মনে হচ্ছে কেন তোর?’

‘একদিন বিধুদাকে বলতে শুনলাম, একদা ডাকসাইটে নেতাকে বলছেন, তোমরাই তো এই পরিবেশ তৈরি করেছ কমরেড! আর আমাকে কয়েকদিন আগে বললেন, শুনেছ আদালত চত্বরে এক পাগলিকে ধর্ষণ করা হয়েছে? এই ক-দিন আগে এক পাগলকে কী যেন বলে, পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ কপালে— খুন করা হয়েছে— এর মধ্যে কি কোনো গল্প আছে? দেখো তো লিখতে পারো কিনা! তিনি একটা ক্লু দিলেন— একটা মানুষ এই শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে, সে কিন্তু বলতে পারছে না— এই দুষ্কৃত নগর আমার দেশ না!’ এই ব্যাপার দুটো মিলে সমীরণের মনে হচ্ছে বিধুদার বেঁচে থাকার বৈধতা আর থাকছে না।

একটু ভেবে আমি বললাম, ‘মানে তুই আশংকা করছিস!’

‘আশংকার কথা ভাবিনি, তুই কী মনে করে বললি?’

‘কথাদুটো তো বিগত-বর্তমান উভয় সরকারের সমালোচনা হয়ে যাচ্ছে!’

‘ঠিক!’

‘আর সরকারের সমালোচনা মানেই দেশদ্রোহ— এক ওয়ান ফাইন মর্নিং আমরা শুনব, মাঝরাতে পুলিশ বিধুদাকে তুলে নিয়ে গেছে…’

সমীরণ অন্যমনস্ক। আমার মনে হল আমি তাঁকে ভাবাতে পেরেছি। সে কোনো নতুন দৃশ্য ভাবছে।
কথামতো বিধুদাকে চায়ের দোকানে ডেকে নিলাম। বললাম, ‘একটা অণুগল্প লিখেছি!’ বিধুদা কোনো উৎসাহ দেখালেন না। সমীরণ বলল, ‘একটা কথা খুব জানতে ইচ্ছে করে―’

‘বলো!’

‘আপনি কী এত চিন্তা নিয়ে হাঁটেন?’

‘কী দেখে তোমার মনে হল, আমি খুব চিন্তা নিয়ে হাঁটি!’

‘আপনার পথহাঁটা দেখে…’

বিধুদা একটু হাসলেন। তাচ্ছিল্যের না কি ব্যঙ্গের ঠিক বোঝা গেল না।

‘…যেন পৃথিবীর ভার আপনার কাঁধে, হারকিউলিস উপমা হয়ে আসে।’

নিজের মনেই আমি সমীরণকে তারিফ করলাম। গাধা নয়, হারকিউলিস তার মনে হওয়ার যথার্থ চিত্ররূপ।

‘আসলে হয়েছে কি, আমার চোখ ভালো নেই— সামনের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে অসুবিধে হয় তাই মাথা নীচু করে পথ চলতে হয়—’ একটু দম নিয়ে বললেন, ‘তবে চিন্তা আছে, ছেলের চিন্তা ছেলে-বউয়ের চিন্তা— ঘরে নিত্য অভাব। খবরের কাগজের খারাপ খবর যেন ঘটে যাবে ওদের জীবনে— চিন্তা হয়, তোমাকে তো বলেছি… চিন্তা হয় কোথাও গল্প নেই দেখে।’ তারপর আমাকে বললেন, ‘দাও দেখি গল্পটা!’

গল্পটা পড়ে বললেন, ‘তুমি ঠিকই লিখেছ, শহরের বিত্তবানের চিন্তায় আমরা ভাবনা প্র্যাকটিস করছি। ধরে নেওয়া গেল, একটিও ভালো মানুষ নেই আমাদের শহরে। ভালো মানুষ করোনা আক্রান্ত রোগীর মতো, সে-কারণে ভালো মানুষ সাসপেক্টে পুলিশ একজনকে তুলে নিয়ে গেছে যাতে অন্য মানুষ আক্রান্ত না হয়। ভালো! কিন্তু এসবই তো নেগেটিভ বাস্তবের প্রসারণ— ‘একটিও ভালো মানুষ নেই’ এই অবাস্তব ব্যাপারটাকে কেউ গল্প ভাবতেই পারে, আমি ভাবতে পারছি না। আচ্ছা, ভালো মানুষের পক্ষে বাস্তব তৈরি হতে পারত নাকি?’ বলে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালেন।

সমীরণের হাতে ফ্রেমমুদ্রা, সে পায়ের ছবি ধরতে চাইছে। বিধুদা ফিরে এলেন। আমাকে বললেন, ‘শহর হোক-কি গ্রাম— তুমি কি মনে করো গরিব মানুষেরা চিন্তা করতে পারেন না?’

উত্তরের কোনো প্রত্যাশা ছিল না। তিনি চলে যাচ্ছেন। সমীরণের চোখ যেন দৃশ্যশূন্য। আর আমি উত্তর খুঁজছি…