Categories
2021-NOVEMBER-DHARABAHIK

সোমা মুখোপাধ্যায়

প্রতিমা শিল্পী চায়না পাল

কলকাতার কুমোরটুলি অঞ্চল মহানগরীর ঐতিহ্য। একসময় গঙ্গার ধার ঘেঁষা এই অঞ্চলে মৃৎশিল্পের বসবাস শুরু হয়েছিল। গ্ৰাম থেকে রুজির টানে তাঁরা এসেছিলেন এখানে। হয়ে গেলেন ধীরে ধীরে এখানকার বাসিন্দা। আকাশ না দেখা অপরিসর অলিগলির মধ্যে ঘিঞ্জি পরিবেশে থাকা অসংখ্য মৃৎশিল্পী পরিবার হাজারও অসুবিধা সত্ত্বেও সারা বছর ধরে নির্মাণ করেন দেবদেবী-সহ আরও নানা রকম শিল্পকর্ম। পুরুষদের পাশাপাশি এখানে রয়েছেন মহিলা শিল্পীরাও। এমন এক প্রথিতযশা অথচ সম্পূর্ণ অন্যরকম শিল্পী চায়না পাল।

আশির দশকের একেবারে গোড়ার দিকে কুমোরটুলিতে গিয়েছিলাম মহিলা মৃৎশিল্পীদের প্রতিমা নির্মাণের কিছু ছবি তুলতে। ঠিক পুজোর আগেই ছিল সেই সময়। একটি পত্রিকার জন্য প্রবন্ধ-সহ ওই ছবিটি জমা দেওয়া হয় কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সেটি অন্যের নামে প্রকাশিত হয়েছিল।

এরপর অনেক বছর কেটে গেছে। প্রায় তিরিশ বছর পরে আবারও একদিন অন্য একটি কাজের সূত্রে কুমোরটুলিতে গিয়েছিলাম সেই মহিলা শিল্পীদেরই সন্ধানে‌। সেখানে গিয়ে দেখা পেয়েছিলাম চায়না পালের। আমার সেই পুরোনো স্মৃতি থেকে তার বহু আগের চেহারার মিল পেয়ে একটু অন্যভাবেই কথা শুরু করি। যে-সময় আমি প্রথম চায়নাকে দেখি তার বাবা হেমন্ত পালের স্টুডিয়োতে কাজে সহায়তা করতে তখন তার খুবই অল্প বয়স। আমার পুরোনো স্মৃতির সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছিলাম সেই চায়না পালের।

সময়ের জল অনেকদূর গড়িয়ে গিয়েছিল। ছোটো থেকেই চায়নার শিল্প কাজের প্রতি অসম্ভব আগ্রহ ছিল। আর এমনটা হওয়ারই কথা। কেন-না মৃৎশিল্পী পরিবারে জন্মগ্রহণ। তাই মাটির প্রতি টান তো থাকবেই। তাছাড়া সেলাই করতেও চায়না একেবারে সিদ্ধহস্ত ছিল। নিয়ম করে সেলাই স্কুলে সেলাইটাও শিখেছিলেন। সেখানেও নিজের পারদর্শীতা প্রমাণ করেছেন তিনি।

চায়নার প্রতিমা তৈরির গল্পটা অবশ্য একটু অন্যরকম ছিল। বাবাকে ছোটোখাটো কাজে সহায়তা করতেন চায়না। আর পাঁচটা কুমোর পরিবারের মেয়েদের মতোই। চায়না নিজেও জানতেন না একদিন এই পৈতৃক ব্যাবসার দায়ভার তাঁর ওপরেই এসে পড়বে। এক আকস্মিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়েই চায়নাকে ঠাকুর গড়ার কাজ নিজের কাঁধে তুলে নিতে হয়।

এক বিশ্বকর্মা পুজোর দিনে আচমকা ইহলোক ত্যাগ করেছিলেন বাবা। সে-সময় সমস্ত অর্ডারি ঠাকুরে‌ তাদের স্টুডিয়ো ভরতি ছিল। সেই পরিস্থিতিতে একটু বিচলিত না হয়ে পুরোনো কারিগরদের সঙ্গে নিয়ে চায়না শুরু করেছিল ঠাকুর গড়ার কাজ। বাবার অসমাপ্ত কাজের সুন্দরভাবেই সমাপ্ত করেছিলেন তিনি। না, আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। সুন্দর একচালার বাংলা প্রতিমা চায়নাকে নিয়ে গেছে অনেকদূর।

চায়নাদের পরিবারে তার অনেকজন ভাই-বোন আছে। কিন্তু সেদিন বাবারে পৈতৃক ব্যাবসাটি একমাত্র চায়নাই নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। সেদিন এই কাজে আর কেউই এগিয়ে আসেনি। চায়নার কাছে শিল্পই ধ্যান জ্ঞান। তাই সংসার জীবনে না জড়িয়ে এই ঠাকুর গড়ার কাজেই চায়না ব্যস্ত থাকেন সারাটা বছর। শুধু দুর্গাপ্রতিমা নয় লক্ষ্মী-সরস্বতী, কালী অন্নপূর্ণা থেকে আরও নানা ঠাকুর চায়না তৈরি করেন। মাটি, খর, রং, কারিগর আর মাকে নিয়ে চায়নার এক অন্যরকম সংসার। স্টুডিয়োর পেছনেই তার সামান্য আস্তানা।

চায়নার কাছ থেকে শুনেছিলাম ঠাকুরের দু-রকম মুখ হয়। বাংলা মুখ আর সাবেকি। চায়না দ্বিতীয়টাই বেশি করে থাকেন। হলুদ রঙের টানা চোখের ঐ প্রতিমাই বাংলার দুর্গার মূল রূপ। একসময়ে একচালির দুর্গা ঠাকুরের বদলে কুমোরটুলির প্রখ্যাত শিল্পী গোপেশ্বর পাল প্রতিটি ঠাকুরকে পৃথকভাবে তৈরি করা শুরু করেন। একচালার বদলে পাঁচটি পৃথক চালায় গড়লেন দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ আর কার্তিক‌। কিন্তু চায়না মনে করেন ওই এক চালাতেই বাঙালির দুর্গার আসল পরিচয়। একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে টুকরো হওয়া চায়নার পছন্দ নয়। তিনি মনে করেন দুর্গার পরিবার-সহ এই একত্রে থাকাই যেন বাঙালির একান্নবর্তী সংসারের একটি প্রতীক।

সাবেকি দুর্গার নানা রূপকেই চায়না তুলে ধরেন। একসময় গড়েছেন শিবের কোলে বসা দুর্গা। এছাড়া কলকাতার এক প্রখ্যাত ক্লাবের পুজোর রামচন্দ্রের অকাল বোধনের প্রতিমাও একসময় তিনিই করতেন। বর্তমানে অবশ্য করেন না। এর মধ্যেই বছর তিন চার আগে রূপান্তরকামীদের পুজোয় দর্জিপাড়ায় অর্ধনারীশরীর মূর্তি তৈরি করে নজর কাড়েন সবার। একই অঙ্গে দু-টি রূপের এমন মেলবন্ধন পুজোর সময় আগে কখনো দেখেনি এই মহানগরী। আধুনিকতার সঙ্গে ঐতিহ্যের মেলবন্ধন আরও‌ একবার তাকে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসে।

দোহারা চেহারার চায়না পাল সদা হাস্যমুখী। শিল্প নিয়ে আলোচনা শুনলেই তিনি মশগুল হয়ে ওঠেন। এই কারণে প্রখ্যাত শিল্পী প্রবীর গুপ্ত, ভবতোষ‌ সূতারদের সঙ্গে গুরুসদয় সংগ্ৰহশালায় চায়নার প্রতিমাও স্থান পায়। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিশ্ববাংলা স্টোরে চায়নার তৈরি ডাকের সাজের দুর্গার মুখ বিক্রি হয়েছে। অপূর্ব এই ঐতিহ্যমণ্ডিত শিল্প দেশি বিদেশি বহু মানুষের আকর্ষণের বস্তু হয়েছে।

চায়নার এই শিল্পকলা তাকে নানা পুরস্কারে ভূষিত করেছে। এর সঙ্গে চায়না পাড়ি দিয়েছে সুদূর চীন দেশে। আমি জানি না চায়না ওর নিজের নামের অর্থ জানে কিনা। একসময় কন্যাসন্তান বিমুখ অনেকেই নিজের কন্যা হবার পর হেলায় বলতেন আর কন্যা চাই না। সেই নামটি হয়ে দাঁড়ায় চায়না। অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার এই চায়না তার কর্মের জোরেই পাড়ি দিল চায়না, অর্থাৎ, চীন। এমন নারী ক্ষমতায়নের নজির খুব কম আছে।

আজ নারী পুরুষের রেষারেষি শিল্পীদের মধ্যে হয়তো‌ কিছুটা কমেছে। কুমোর পরিবারে পুতুল গড়া, মাটি ছানা, টুকটাক মূর্তি গড়ায় পরিবারের পুরুষ শিল্পীকে সহায়তা করা এমনসব কাজেই বাড়ির মেয়েরা করতেন। কিন্তু পূর্নাঙ্গ দুর্গা বা কালীর মূর্তি গড়া ছিল স্বপ্নের মতো। চায়না সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন করলেন।

একটা মস্ত কাজে অনেক মানুষের সহায়তা লাগে। ঠাকুর গড়াও তেমন। আমি দেখেছি চায়নাকে মূর্তি গড়তে মাটি মেখে। ছাঁচ থেকে দেবীমুখ বানাতে। অথচ নিয়ম কুমোর বাড়ির মেয়েরা চাকে হাত দেবেন না। চায়নার সঙ্গে চাকের যোগ নেই। খড়ের কাঠামোতে মাটি লাগিয়ে স্বপ্ন বোনে চায়না। এর সঙ্গে বৃদ্ধা মায়ের দেখা শোনা থেকে বাজার রান্না সবটাই একা হাতে। ওকে দেখে মনে হয় যে রাঁধে সে চুল বাঁধে এ-প্রবাদের যেন সার্থক রূপায়ণ হয়েছে ওর মধ্যে।

চায়না জানান একসময় তাঁরা ঝুলনে পুতুল গড়তেন। তখন এত বিনোদন ছিল না। তাই ঝুলনের ক-দিন আগেই কুমোরটুলির প্রায় প্রতিটা ঘরেই এই পুতুল মিলত। বাড়ির মেয়েরাই ছিলেন বেশিরভাগ শাল্পী। এখনও এই কাজ তাঁকে টানে। তবে এখন অনেকটাই কমে গেছে ঝুলনের পুতুল। এর পাশাপাশি সুন্দর ছোটো একচালির দুর্গা বানানোর ইচ্ছে তাঁর। তবে প্রতিমা তৈরিতে সারাটা বছর এত ব্যস্ত থাকেন যে, এ-কাজের অবসর পান না। জগদ্ধাত্রী পুজোর পর কয়েক মাস একটু বিশ্রাম মেলে। তারপর আবার সরস্বতী গড়া শুরু।

এভাবেই দিনাতিপাত করেন আমাদের কুমোরটুলির সরস্বতী। এই কাজে অসম্ভব খুশি তিনি। তাঁর মতে সবকাজেই তো বাধা থাকে। তাকে অতিক্রম করতে হয়। তাঁর কাজের ক্ষেত্রেও তাই। ভালোবাসা দিয়ে যদি কিছু আঁকড়ে থাকা যায় তবে তার সাফল্য আসবেই।

Categories
2021-NOVEMBER-DHARABAHIK

ফা-হিয়েন

ফা-হিয়েনের ভ্রমণ

ষষ্ঠদশ অধ্যায়

আবার চলা শুরু। এবার দক্ষিণ-পূর্ব দিক ধরে। আশি ইউ ইয়েন-এর কিছু কম পথ অতিক্রমকালে তীর্থযাত্রীদল অনেক মঠ, অনেক মন্দির পার করে এলেন। আর পার করে এলেন সে-সব মঠের দশ সহস্র সন্ন্যাসী-সঙ্গ। এই সমস্ত স্থান পেরিয়ে অবশেষে তাঁরা এসে পৌঁছোলেন মথুরা রাজ্যে। এ-স্থানে পৌঁছাতে অতিক্রম করতে হল যমুনা নদী আর তার দুই তীরের কুড়িটি মঠ আর মঠের তিন সহস্র সন্ন্যাসী। বৌদ্ধধর্ম ক্রমেই জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করল। সিন্ধু নদের পশ্চিম তীরবর্তী ভারতীয় উপমহাদেশের ছোটো বড়ো সমস্ত রাজ্যে সকল রাজার রয়েছে বৌদ্ধধর্মে দৃঢ় বিশ্বাস। সন্ন্যাসীদের প্রতি অর্ঘ্য নিবেদনকালে রাজাগণ প্রত্যেকেই খুলে রাখেন রাজমুকুট। এর পর রাজপরিবারের সকল সদস্য আর মন্ত্রীরা নিজেদের হাতে সন্ন্যাসীদের খাইয়ে দেন। আহার পর্ব সমাধা হলে সন্ন্যাসীদের মূল আসনের বিপরীতে মাটিতেই বেছানো হয় কার্পেট আর সেখানেই সকলে উপবেশিত হন। সন্ন্যাসীদের উপস্থিতিতে কেউই বসার জন্য বিশেষ আসন ব্যবহার করেন না। বুদ্ধের জীবদ্দশাতেই এইসকল রাজাদের মধ্যে পূজার আচরণ বিধির চল শুরু হয়। এর দক্ষিণে আছে আর এক দেশ, নাম তার মধ্য রাজ্য। এখানে আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ। বরফবিহীন এ-রাজ্যের মানুষ সচ্ছল, সুখী। নিষেধহীন জীবন। যারা রাজার জমি চাষ করে তারা যথেষ্ট পারিশ্রমিক পায়। এ-রাজ্য ছেড়ে কেউ চলে যেতে চাইলে যেতে পারে, ইচ্ছে হলে থাকতেও পারে। কোনো বিধিনিষেধ নেই। এ-রাজার শাসনব্যবস্থা শোষণহীন। অপরাধের গুরুত্ব অনুযায়ী কেবলমাত্র অপরাধীর জরিমানার বিধান র‍য়েছে। এমনকী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বারংবার বিদ্রোহের শাস্তি, ডান হাত কেটে নেওয়া। রাজার দেহরক্ষীদের জন্য রয়েছে নির্দিষ্ট বেতন। রাজ্যজুড়ে কেউ প্রাণ হত্যা করে না। পেঁয়াজ, রসুন ভক্ষণ বা মদ্যপান কোনোটাই করে না এ-রাজ্যের মানুষ।

এ-সকল আলোর মাঝেও রয়েছে একটি অন্ধকার। চণ্ডাল জাতির মানুষদের এখানে অচ্ছুৎ করে রাখা হয়। জনসমাজ থেকে এরা দূরে বাস করে। মূল নগরে বা বাজারে এলে এরা নিজেদেরকে আলাদা করে চিহ্নিত করতে একটি কাঠের টুকরো দিয়ে নিজেদেরই শরীরে আঘাত করতে থাকে। এতে সবাই চিনে নেয় তাদের আর ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে দূরে দূরে থাকে। এ-দেশে শূকর বা পক্ষী জাতীয় প্রাণী পালন করে না কেউ। গবাদিপশুর বিষয়ে কারো কোনো আগ্রহ নেই। বাজারে না আছে কোনো মাংসের বিপণি, না কোনো ভাটিখানা। কেনাবেচা চলে কড়ির বিনিময়ে। কেবলমাত্র চণ্ডাল জাতির মানুষরাই শিকার করে এবং মাংস কেনাবেচা করে।

বুদ্ধের নির্বাণলাভের সময় থেকেই এইসকল দেশগুলির রাজা, বয়োজ্যেষ্ঠগণ, এবং মধ্যবিত্ত ভদ্রজনেরা নিজ নিজ স্থানে বিগ্রহ স্থাপনা করেন। উদ্দেশ্য ছিল সন্ন্যাসীগণের প্রতি অর্ঘ্য নিবেদন, গৃহ, ভূমি, বাগিচা ইত্যাদি দান করা। আর দেওয়া হত কর্মক্ষম ব্যক্তি ও বৃষ, চাষাবাদ করার জন্যে। এসবের স্বত্বাধিকারের দলিল লেখা হত এবং রাজাগণ পুরুষানুক্রমে তাঁর পরবর্তী রাজাকে এই দলিল সঁপে যেতেন। প্রজন্মের পর প্রজন্ম একইভাবে থেকে যেত এগুলি। এই দলিল ধ্বংস করার কথা ভাবে এমন দুঃসাহস হত না কারো। সন্ন্যাসীগণ যেখানেই যাক না কেন বাসগৃহ, শয্যা সামগ্রী, আহার্য, পোশাক কোনো কিছুরই অভাব হত না। তাঁরা ধর্মীয় দান ধ্যানের বদান্যতায়, অথবা ধ্যান-মগ্ন হয়ে এসবের দখল অনায়াসে পেয়ে যেতেন। কোনো আগন্তুক সন্ন্যাসী সহসা এসে উপস্থিত হলে, পুরাতন আবাসিক সন্ন্যাসীগণ তার সঙ্গে এসে সাক্ষাৎ করতেন। ভিতর ঘরে বহন করে নিয়ে যেতেন তাঁর পোশাকআশাক আর ভিক্ষাপাত্র। পা ধোয়ার জল এবং প্রলেপ দেওয়ার জন্য তেল এনে দেওয়া হত এরপর। আর দেওয়া হত সন্ন্যাসীদের জন্য নির্ধারিত পরিমিত আহার্যের চেয়ে কিছু বেশি আহার-পানীয়। অচিরেই অতিথি সন্ন্যাসী যখন বিশ্রাম কক্ষে আসতেন, তাঁরা তাঁর বয়স আর সন্ন্যাস লাভের ক্ষণটি জানতে চান। এরপর কর্তৃপক্ষের নির্দেশমতো সকল শয্যা দ্রব্যাদি-সহ তাঁকে একটি কক্ষ দেওয়া হয়।

এই সন্ন্যাসীদের বাসস্থানগুলির নিকটেই সারিপুত্র, মোগালান আর আনন্দের উদ্দেশে প্যাগোডা স্থাপন করা হয়। অভি ধর্ম, পঞ্চ শীল আর বৌদ্ধ সূত্রাবলীর সম্মানে গড়ে তোলা হত মিনার। মাসাধিক কাল একই স্থানে বসত করলে, ধর্মভুক্ত সকল পরিবারগুলি মিলে ঐ সন্নাসীর স্বীকৃতি দান ও পূজা নিবেদনের আয়োজন করতেন। তাঁরা ভোজনের বন্দোবস্ত করতেন আর সকল সন্ন্যাসীগণ সমবেত হয়ে বুদ্ধের শৃঙখলাগুলি ব্যাখ্যা করতেন। সব সমাধা হলে তাঁরা সারিপুত্রের প্যাগোডায় এসে বিচিত্র সব সুগন্ধি ধূপ আর ফুলের অর্ঘ্য নিবেদন করতেন। নিশিভোর জ্বালিয়ে রাখা হত দ্বীপ। এতে সকলের পূজায় যোগদানের পথ প্রশস্ত হয়। সারিপুত্র আদতে ছিলেন এক ব্রাহ্মণ সন্তান। একদা বুদ্ধের সাক্ষাৎ পেয়ে সন্ন্যাস গ্রহণ করতে চেয়ে কাতর মিনতি জানান। মোগালান আর কাশ্যপ, তাঁরাও একইভাবে বুদ্ধের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। অধিকাংশ মহিলা ভিক্ষুগণ আনন্দের প্যাগোডাতে গিয়ে নিজেদের পূজা নিবেদন করতেন, কারণ, আনন্দই বুদ্ধের কাছে প্রার্থনা জানিয়ে, মহিলাদের সন্ন্যাস গ্রহণের অনুমতি
আদায় করেন। আর নবীন ব্রতী যাঁরা ছিলেন, তাঁরা মূলত আরহতের পূজা করতেন। অভি ধর্মের গুরু যাঁরা ছিলেন তাঁরা অভিধর্মের পূজা করতেন। শৃঙ্খলার গুরু পূজা করতেন শৃঙ্খলাকে। এই পূজা বছরে একবারই করা হত। প্রত্যেকের জন্য নিজস্ব একটি দিন ধার্য্য করা থাকত।

মহাযান মতে প্রজ্ঞাপারমিতা, মঞ্জুশ্রী, অবলোকিতেশ্বরের পূজা করা হত। সন্ন্যাসীরা যখন ফসল ঘরে তুলত, অগ্রজ, মধ্যবিত্ত, ব্রাহ্মণ, সকলেই বিভিন্ন উপচার, যেমন বস্ত্র ইত্যাদি সঙ্গে করে নিয়ে আসতেন। শমনগণ সার দিয়ে দাঁড়িয়ে একে-অন্যের হাতে উপহারগুলি তুলে দিতেন। বুদ্ধের নির্বাণ লাভের সময় থেকেই, পবিত্র ভ্রাতৃত্ব বোধের প্রতি এই মহান শিষ্টাচারগুলি চলতে থাকে অনিবার। সিন তো নদীর অগভীর অংশ থেকে দক্ষিণ সাগর দিয়ে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ হাজার লি পথ অতিক্রম করলে পরে এসে পড়বে দক্ষিণ ভারতের সীমানায়। এ-দেশ একেবারে সমতল। পর্বত গাত্র চিরে বেরিয়ে আসা সুগভীর ধারা স্রোত নেই এখানে, আছে কেবল ক্ষুদ্রকায় কিছু নদী।

প্রথম পর্ব

দ্বিতীয় পর্ব

তৃতীয় পর্ব

চতুর্থ পর্ব

Categories
2021-NOVEMBER-DHARABAHIK

শতদল মিত্র

মস্তানের বউ

নার্সিং হোমে কৃষ্ণ ঢুকতেই তার হাতে সদ্যজাতকে তুলে দিয়ে, যেমন দস্তুর নার্স বলেছিল— দাদা, মিষ্টি খাওয়াতে হবে কিন্তু। কৃষ্ণ লজ্জা মাখানো হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে দু-হাত বাড়িয়ে তার প্রথম সন্তানকে কোলে তুলে নিয়েছিল। দেখতে দেখতে সে-হাসি যেন গর্বিত পিতার হাসিতে ঝলমলিয়ে উঠেছিল, কেন-না সদ্যজাত প্রাণটি সে-আশ্রয়ে বন্ধ চোখেই ঠোঁটে হাসি এঁকেছিল, অন্তত অবাক রূপার চোখে তেমনতরই প্রতিভাত হয়েছিল তা। নার্সের হাতে সন্তানকে ফিরিয়ে দিয়ে পকেট থেকে এক খাবলা একশো টাকার নোট বার করে পাশে টতস্থ আয়ার হাতে গুঁজে দিয়েছিল। নার্সটি আবারও ফুটে উঠেছিল— দাদার দিল্‌ই আলাদা! কম কথার মানুষ কৃষ্ণ হাতের ইশারা করেছিল, সে-ইঙ্গিতে নার্স ও আয়া তত্ক্ষণাৎ কেবিনের বাইরে বেরিয়ে গেলে কৃষ্ণ রূপার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল— কী, আমারই জিত হল তো! পরক্ষণেই শিশুটির বদ্ধমুঠিতে হাত রেখে স্বগতোক্তি করেছিল— আমার উদিতা, আমার দি-তা!

হ্যাঁ, লোকটা পাগলের মতো মেয়ে চেয়েছিল প্রতিটা আদরের মুহূর্তে। ভাবে রূপা। আর, আর যেদিন ছোট্ট উদিতা দা-দা, ডা-ডা বলতে বলতে বা-বা বলে প্রথম যেদিন বুলি এঁকেছিল তার পাতলা নরম ঠোঁটে, লোকটা পাগল হয়ে উঠেছিল যেন। মেয়েকে নিয়ে এমন লোফালুফি করতে শুরু করে যে, রূপা ভয় পেয়ে ধমকেই উঠেছিল— থামো, পড়ে গেলে…! দেখছ না কেমন ভয়ে সিঁটিয়ে রয়েছে!

— হাঃ হাঃ! আমার মেয়ে কিনা ভয় পাবে! কৃষ্ণের মেয়ে ভয় পাবে!

প্রথম থেকেই অল্প আওয়াজে বা জোরে দোলালেও ছোট্ট প্রাণটি ভয়ে সিঁটিয়ে যেত। তখন তো কিছু বুঝতে পারেনি রূপা বা কৃষ্ণ কেউই…। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে রূপা, সে-টানেই যেন চেতনে ফেরে রূপা। খেয়াল করে কখন যেন সন্ধ্যের আঁধার গুঁড়ি মেরে ক্রমে গ্রাস করার তালে আছে তার দোকান ঘরটিকে। সে উঠে আলো জ্বালে সুইচ টিপে। কালিপরা টিউব লাইটটা বার কয়েক দপ দপ করে জ্বলে উঠলে, ম্লান আলো তবুও ঝলকে ওঠে কৃষ্ণের ফোটোর কাচে। সে-ঝলকানি তাকে ডাকলে, রূপা উঠে গিয়ে ফোটোটা আঁচল দিয়ে আলতো মুছে দেয়, মায়ামাখা হাতে। সে-মায়ায় কৃষ্ণের হাসি ফুটে উঠলে সে তার মুখের ছায়া ভেসে উঠতে দেখে যেন! নাঃ, সামনের অনেকগুলো চুলেই পাক ধরেছে যেন। পরক্ষণেই তার নিজের ছায়াকে মুছে সেখানে ফুটে ওঠে অন্য নবীনার মুখ— সুদীপ্তা, ছোটো মেয়ে তার।

— একটু কলপ তো করতে পার, নাকি? কী এমন বয়স হয়েছে তোমার? একটু থামে, তারপর আবার বলে ওঠে সুদীপ্তা, যা ইদানীংকার বাঁধা লব্জ তার— আমি তো আছি।

সবসময় শাসনে রাখে ছোটো মেয়েটি তাকে। পুরো বাপের স্বভাব পেয়েছে সে, অল্প কথা, কাটা কাটা, ওজনদার—তেমনই লম্বা দোহারা চেহারা। ছোটোমেয়েই তার ভরসা, আবার ভয়ও।

রূপা ফিরে নিজের জায়গায় আসতেই সামনের রাস্তা চোখ টেনে নেয় তার, যে-চোখে ভেসে ওঠে গোরার মুখ, আড়চোখে তার দোকানের দিকে একবার তাকিয়েই মুখ ঘুরিয়ে হনহানিয়ে হেঁটে যায় সে। রূপার মুখে চিলতে হাসি ফুটে ওঠে।

— কাপুরুষ! কোন লজ্জায়ই-বা সে তার চোখে চোখ রাখে ?

ভাবে রূপা। আর অমনি দড়াম করে আছড়ে পড়ে কৃষ্ণের চেলা গোরার সে দিনের আধখানা বাক্য—বৌদি, দা-দা… । যা সে দিনের আঁধারকে চিরে আরো ঘনবদ্ধ করে তুলেছিল, যা আজকের ঘনায়মান অন্ধকারকে টলিয়ে ভাসিয়ে তুলেছিল আলো ঝলমল সে-আওয়াজ— দশ কা বিশ… দশ কা বিশ…!

কৃষ্ণর পর, বাবলু, তারপর গোরা… নাঃ, রূপশ্রী হলের দখলদারিত্ব ধরে রাখতে পারেনি সে। নির্লজ্জ, কাপুরুষ! যদিও কালের নিয়ম, ভিডিয়োর যুগ, হল্‌ চলছে না তেমন আর তবুও!

রূপা বাইরে এসে পাশের হল চত্বরের কালো অন্ধকারে চোখ চাড়ে, একবুক দীর্ঘশ্বাসকে চেপে ধরে।

— বৌদি, তিনটে চা।

সে-ডাকে রূপা দোকানে ফেরে, বর্তমানেও।

হ্যাঁ, কৃষ্ণের পর বাবলু, সে-ই কিছুদিন কৃষ্ণের তাজ ধরে রেখেছিল, দাপটে— তবে ওই কিছুদিনই। বাবলুর পর গোরা… গলির ছিঁচকে গুণ্ডা শুধুই, পাড়ার লোকের ওপর যত জুলুম! প্রদীপ রায়ের পা চাটা ভেড়ুয়া… ভোটের জন্য অমন কত কুত্তা, ভেড়ুয়া প্রদীপ রায় পোষে! কৃষ্ণের নাম ডুবিয়ে ছেড়েছে একেবারে! রোজ কৃষ্ণের গলিতে সন্ধ্যে লাগলেই মদ গেলা কতকগুলো চামচা জুটিয়ে আর মেয়ে দেখলেই টিটকারি দেওয়া। বিশ্বাসঘাতক, গদ্দার! অথচ সাবানকলে ওর চাকরি কৃষ্ণই করে দেয়! লোকে ঠিকই বলে— চুহা এক নম্বরের! কোর্টে গিয়ে বেমালুম বলে কিনা, ও কিছুই দেখেনি! বেশ করেছে আখতারের ছেলেরা কপাল ফাটিয়ে দিয়েছে ওর! সে-দাগ আজও মোছেনি। তবুও দাগীবাজ হয়েও ছুটকো গুণ্ডামি গেল না! সবই ওই কালো লোকটার আশকারায়। ভোটে জেতে না, তবুও তাবড় নেতা নাকি প্রদীপ রায়, এলাকা ছাড়িয়ে গোটা কলকাতার জেলা কমিটির নেতা নাকি লোকটা! রাগে গনগনে হয়ে ওঠে রূপার মুখটা, গ্যাসের আগুনেরও উসকানি হয়তো কিছুটা, তবুও।

ভিডিয়োর যুগ এলেও তখনও সিনেমা হলের রমরমা ফিকে হয়নি। তবে রূপশ্রীতে আর বাংলা ছবি লাগে না। পরি হলে তো কবেই বাংলা বই দেখানো বন্ধ। পি-সন, কমল, খাতুনমহলে তো, যেহেতু খাস উর্দু এলাকার তাই বরাবরই হিন্দি ছবি। রূপশ্রীই একমাত্র বাঙালি হিন্দু পাড়ার হল। হিন্দি সিনেমার টানেই হোক, আর কৃষ্ণের পর তেমন দাপুটে নেতা না থাকার কারণেই হোক, বা পার্টির প্রশ্রয়েই হোক উর্দুভাষী মুসলমানদের ভিড় বাড়তে থাকে ক্রমে, এ-তল্লাটে আখতারের ক্রমশ দখলদারি জারির শুরুয়াতই যেন তা। যা বাঙালি দর্শকদের হল থেকে দূরেই রাখে তখন। তেমনই এক সাঁঝকালে হলের তত্কালীন বকলমা মালিক গোরা কিছু উর্দুভাষীকে সবক শেখাতেই, যেহেতু তারা হলের গায়ে খৈনির পিক ফেলেছিল, যেন-বা বহুকাল আগের রিপিট শো— তবে এবার উলটপুরাণ, সবক শেখানেঅলা নিজেই সবক শিখে যায়! গোরা হাত তোলা মাত্র ত্বরিতে ওদের একজন লুঙ্গির গেঁজে লুকানো পিস্তলের বাঁট দিয়ে গোরার কপালে দাগা বুলিয়ে দেয়। হিসহিসিয়ে বলে ওঠে—শুন বে! অবসে ই ইলাকা হামরিস। আখতার ভাই কা। ইয়ে ভাই কা সির্ফ ওয়ার্মিং সমঝিস। কাল সে ইধার তুঝকো দেখিস তো… । এই চেতাবনি দিয়ে গোরাকে এক ধাক্কা। যা ছিটকে ফেলে দেয় গোরাকে তার তাজ সমেত। কে যেন এক কলি গেয়ে ওঠে দেওয়ালে গুটখার পিক ফেলে—চুম্মা, চুম্মা ! দে দে মুঝে চুম্মা! গোরা ডানে, বাঁয়ে তাকায়, নিজের সঙ্গী কাউকে দেখতে পায় না। শুধু তার চারপাশে দুদ্দাড়িয়ে ভীত, সন্ত্রস্ত মানুষের ছুটে যাওয়া দেখে। দিবালোকে না হলেও, গোরার এ পতন প্রকাশ্যই, নিশালোকের মায়াবী আলোয় যা আরো পল্লবিত হয়। ফলে লজ্জায় বেশ কিছুদিন এ মুখো হয় না সে আর। শান গেলে যে কোনো ক্ষমতাবানই পঙ্গু। বস্তুত বাবুলের পরে কৃষ্ণের নারায়ণী সেনা যখন ছত্রকার!

রূপার মুখে আনমনে একটা মশা ঢুকেছে যেন। বাইরে এসে নীরবে থুথু ফেলে ড্রেনে– ওয়াক থু! সাঁঝ পেরোলে তার দোকান একটু জমজমাট থাকে সকালের মতোই, বুড়োদের কল্যাণে। ঘরে বসে কাঁহাতক সময় কাটে? তাই সকাল, সাঁঝে রূপার দোকানে তাদের আড্ডা। রূপার বেশ ভালোই লাগে। বাইরে মুসলিম ছেলেদের দঙ্গল—যত দিন যাচ্ছে তত বাড়ছেই।

— হবে নাই বা কেন? ওদের মহল্লায় সবই তো বোরখা ঢাকা! এক বুড়ো ক্ষ্যা-ক্ষ্যা করে হেসে কথাগুলো ছিটকে দেয়।

— হ্যাঁ, তবে থাকত যদি কৃষ্ণ আজ! আমাদের পাড়ার মেয়ে-বউদের তো…

তবে তার কথা মাঝখানেই আটকে যায়, যেহেতু বাইরে বাইকের আওয়াজ থামিয়ে বেজে ওঠে ভারিক্কি গলা—ভাবিজি, দো চায়ে।

আচ্ছা আখতারকে কী করে তোল্লাই দিচ্ছে প্রদীপ রায়, আব্বাসের জামাই জেনেও, যতই লাল পার্টির হোক না কেন আখতার? আর আব্বাসেরই বা কী চাল? মাটির দুর্গের উর্দু মহল্লায় তো আব্বাসের ইশারা ছাড়া গাছের একটা পাতাও নড়ে না। রাজনীতির চাল বোঝে না রূপা। কৃষ্ণও কি বুঝতো?

দীর্ঘশ্বাস চেপে গেলাস দুটো এগিয়ে ধরে রূপা দুই খদ্দেরের দিকে।

৯ 

–নেতা! ঝাঁটের নেতা!

দুপুরবেলা ঘরে এসে হিসহিসিয়ে বলে ওঠে কৃষ্ণ। গায়ের ভিজে জামাটা খাটের ওপর ছুঁড়ে দেয় সে। এ সময়ে রূপা চুপ করে থাকে। ওকে শান্ত হওয়ার সময় দেয়। তবে আজ বড় রকমের কোনও গণ্ডগোল সেটা বুঝতে পারে রূপা, কেননা ঘরে কৃষ্ণ কখনো মুখ খারাপ করে না। আর আজ মানুষটা ঘরে আসতে স্বস্তিও পেয়েছে ও। নইলে সাত সকালেই ঘটনাটার খবর পেয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল কৃষ্ণ এক রকম ছুটেই প্রায়। বাবলুই খবরটা নিয়ে এসেছিল। ফাতেপুর ভিলেজ রোডে দাঙ্গা লেগেছে নাকি! তারপর থেকে লোকের মুখে , টিভির খবর শুনে রূপার মনটা আনচান করছিল। ঘর-বার করছিল সে। পথঘাট নিমেষে শুনশান হয়ে পড়েছিল। দোকানে ঝটাপট শাটার নেমেছিল। হিন্দু পাড়ার ভিলেজ রোড যেখানে বাত্তিকল-ধানখেতির মুসলমান বস্তির ভুলভুলাইয়ায় গোত খেয়েছে, সেখানে নাকি ডি॰সি॰ পোর্টকে খুন করা হয়েছে। মনটা তাই অস্থিরই ছিল সকাল থেকে রূপার। এখন ঘরের মানুষ ঘরে ফেরায় আপাত স্বস্তি পায় সে। ঠান্ডা সরবতের গেলাস নিঃশব্দে বাড়িয়ে ধরে রূপা।

মেজাজ একটু ঠান্ডা হলে স্নান করে ভাত খেতে খেতে বৃত্তান্তে ফেরে কৃষ্ণ।

— জানো, খবর পেয়েই তো ছুটলাম প্রথমে পার্টি অফিসে। দলবল নিয়ে যেতে চাইলাম স্পটে। প্রদীপদা বলে কিনা যেতে হবে না, ওটা সেটিং কেস। শরিকি অন্য দলের মামলা! দাঙ্গার নাম করে সামান্য ডাবপাড়া নিয়ে ফালতু ঝগড়া বাঁধিয়ে একটা হিন্দুর ঝুপড়িতে আগুন ধারায় আনিস। ডকের ছিঁচকে চোর কাঁহিকা! সব সাজানো নাটক! খবর পেয়ে পুলিশ ছুটে আসে—হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বলে কথা! ডি॰সি॰ পোর্টও ছুটে আসে। পুলিশও সে যোগসাজসে ছিল। বাত্তিকলের গলির ভুলভুলাইয়ায় ঢুকিয়ে দিয়ে পুলিশ ফোর্স পেছনে সরে আসে, ততক্ষণে ডি॰সি॰ অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছে একা, কেবলমাত্র বডিগার্ড সঙ্গী।

থামে কৃষ্ণ। এক গ্রাস ভাত ঢোকায় মুখে, কিছুটা চিবিয়ে, ঢোক গিলে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,— ঢ্যামনা করিমের চাল সব। ডি॰সি॰টা সৎ ছিল কিনা! ডকের সব চুরি বন্ধ করে দিয়েছিল কড়া হাতে। তাই প্লান করে ডি॰সি॰কে ফাঁদে ফেলে কুপিয়ে কুপিয়ে মেরেছে আনিসের দল, সঙ্গে নিরীহ বডিগার্ডকেও। শালা, করিম আবার মন্ত্রী! ওই তো একটা দু-গাছা লোকের দল! আমরা না জেতালে ভোটে জিতবার মুরোদও নেই! ডকের ডাকাত তো ও! সুভাষ বোসের নাম ডুবিয়ে ছাড়ল! ছিঃ! মাঝখান থেকে কয়েকটা নিরীহ হিন্দুর ঘর পুড়ল।

কৃষ্ণ জল খায়। ভাত মাখতে মাখতে বলে আবার,— তেমনি আমাদের প্রদীপদা! বললাম, আমাদের এলাকা। হিন্দুরা পড়ে পড়ে মার খাবে আর আমরা দেখব? তো, লোকটা বলে কিনা, ‘রাজনীতিতে মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়। রাজনীতি অন্য জিনিস, সবাই পারে না’।

ভাত নাড়াচাড়া করে কৃষ্ণ। রূপা বোঝে, লোকটা মনে মনে আঘাত পেয়েছে খুব। নইলে কম কথার মানুষটাকে এত কথায় পায়!

— আমাদের ঘাড়ে চেপে উনি নেতাগিরি করবেন, আর আমরাই রাজনীতি জানি না!… মানুষের বিপদে যদি মানুষের পাশে না-ই দাঁড়াতে পারলাম, তবে কীসের…। একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় কৃষ্ণ। ফলে সিলিং ফ্যানের ঘূর্ণি বাতাসটা আরও একটু লু টেনে আনে যেন বাইরে থেকে।

রূপা মৃদুস্বরে শুধু এটুকুই বলতে পারে,— ও কী? অর্ধেক ভাত যে পড়ে রইল!

— নাঃ, খিদে নেই আজ আর। বাথরুমে গিয়ে হাত ধোয়। ফিরে এসে খাটে হেলান দিয়ে আয়েশ করে সিগারেট ধরায়।

— ওরা দু-জন ঘুমোচ্ছে নাকি? দিদি খেয়েছে?

— হ্যাঁ, দিদি ওদেরকে ওপরে নিয়ে শুয়েছে।

— তুমি খাবে কখন? বেলা তো হয়েছে।

— এবার খাব। একটু থামে রূপা, আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মোছে। তারপর রান্না ঘরে যেতে যেতে বলে,

— পুলিশের অত বড়ো অফিসারকে খুন করেছে… পুলিশ ছাড়বে না নিশ্চয়!

সিগারেটের ধোঁয়ার সঙ্গে কথা ক-টা উড়িয়ে দেয় কৃষ্ণ,— ধু-স-স! বললাম না মন্ত্রী লেভেলে সেটিং আছে। তাছাড়া এই ডি॰সি॰-র জন্য পুলিশেরও হিস্যায় টান পড়েছে কিনা!

সত্যিই তাই হয়, অর্থাৎ, কিছুই হয় না। যদিও সেদিন সন্ধ্যে থেকেই কার্ফু জারি হয়, লালবাজার পুরো উঠে আসে ভিলেজ রোড আর ধানখেতির বস্তিতে। আনিসকে ও তার দলবলকে গ্রেপ্তার করা হয়, মানে করানো হয় এবং আগে থেকে ছকা ছক অনুযায়ীই, নইলে ধানখেতি-বাত্তিকলের ভুলভুলাইয়া থেকে কাউকে বের করে আনা পুলিশের কম্ম নয়! যেমন ক-বছর পরে পারেনি শেরুকেও। বোকা আনিস রাজনীতির বোড়ে হয়ে গড়াগড়ি যায়, সেই সঙ্গে কিছু নিরীহ হিন্দু ছেলেও। না হলে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বলে চক্রান্তটা সাজাবে কেমন করে মন্ত্রী-পুলিশের ঘোঁট!

আহা! কী অল্পবয়সি ডি॰সি॰র বউটা! আর বাচ্চাটাও কী ফুটফুটে! খবরের কাগজে ছবি দেখেছিল সে। দুপুরের খদ্দেরহীন দোকানে বসে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে পৌঢা রূপা। অভ্যাসবশে আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মোছে। এইবার দোকান বন্ধ করবে সে। আর বেচারা আনিস! সে বোধহয় মুখ খুলেছিল নেতার গদ্দারি ধরতে পেরে। পুলিশ তার পেটে এমন লাথি কষায় যে পায়খানার দ্বার দিয়ে পেটের নাড়িভুঁড়ি নাকি বেরিয়ে গিয়েছিল! সে-মামলা আজও চলছে এত বছর পরও— সাক্ষী পাওয়া যায়নি নাকি কোনও! একটা করুণ হাসি আবছা ফুটে ওঠে রূপার ঠোঁটে। সেদিন রাত্রে মানুষটার গলায় আফসোস ঝরে পড়েছিল— আমাদের কাঁধে ভর দিয়েই নেতাগিরি… অথচ আমরাই রাজনীতির বোড়ে শুধু। মন্ত্রী-রাজারা দরকারে আমাদের খেয়ে নেয় আমাদের অজান্তেই! বেচারা আনিস… বোকা, বোকাচো-!

আচ্ছা কৃষ্ণের সঙ্গে প্রদীপ রায়ের কি কোনো দূরত্ব তৈরি হচ্ছিল? নইলে…! সামান্য ঘরোয়া নারী জানেনি সে কিছুই! কেন-না কম কথা বলা লোকটা কখনো এ নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেনি। ঘর আর বার তার কাছে আলাদাই ছিল। কোনো হতাশায়, নিরুপায়তায় যেটুকু ধরা দিত স্বেচ্ছায় তার কাছে সেটুকুই কেবল!

একটু জোরেই যেন দোকানের দরজা বন্ধ করে রূপা।

প্রথম পর্ব

দ্বিতীয় পর্ব

তৃতীয় পর্ব

চতুর্থ পর্ব