Categories
2021-Utsob-Prose

সুদীপ্ত মুখোপাধ্যায় ও সোহেল ইসলাম

জেলের ডায়েরি

আপনি হয়তো কারো কাছে তার বয়স জানতে চাইলেন, যা খুবই স্বাভাবিক একটা প্রশ্ন। এবং যে-কেউ খুব সহজেই তার উত্তর দেবে। কিন্তু আপনি যদি কোনো প্যালেস্তানীয়কে তার বয়স জিজ্ঞেস করে বসেন, তার কাছে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়াটা বেশ কঠিন ঠেকবে। সে অবাক হয়ে আপনার দিকে তাকিয়ে থাকবে, ঠিক যেভাবে ঠান্ডায় জমে যাওয়া গাছের দিকে তাকিয়ে থাকে পাখি। তারপর নিজে থেকেই বিড়বিড় করে বলতে থাকবে, “সত্যিই তো আমার বয়স কত? আমি কতদিন এই গ্রহে আছি এবং কতদিন বেঁচে আছি?” কিছুটা থেমে সে অবশ্য আপনার প্রশ্নের উত্তরও দেবে, কেন-না প্যালেস্তানীয়রা জন্মের পর থেকে প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে অভ্যস্ত হয়ে যান। ও আর একটা কথা ওরা কিন্তু আপনাকে স্যার বলে সম্বোধন করবেন। প্রতিটা কথার শেষে একটা করে স্যার যোগ করতে প্যালেস্তানীয়রা বাধ্য। আর এর অন্যথা হলেই ওদের মার খেতে হয় নয়তো যেতে হয় জেলে। ইজরায়েলি দখলদারদের অত্যাচারে নাজেহাল সারা প্যালেস্তাইন এই চিত্রই দেখে আসছে ১৯৪৮-র পর থেকে। আবার ওই বয়সের প্রশ্নে ফিরে আসি। হ্যাঁ, ওরা আপনার প্রশ্নের উত্তরে বলে উঠবে, “আমাদের বয়স তিন যুদ্ধ আর দুই ইন্তিফাদা, স্যার। আমি জানি আপনি আমার কথা কিছুই বুঝতে পারছেন না। বুঝতে পারার কথাও না। কিন্তু যে-প্যালেস্তাইনে আমাদের জন্ম, বেড়ে ওঠা, বেঁচে থাকা… সে-প্যালেস্তাইনে জন্মের পর থেকে যুদ্ধ আর দখলদারিত্বই দেখে আসছি আমরা। আমাদের শৈশব নেই, কৈশোর নেই, আপনাদের বলতে পারার মতো কোনো সুখকর স্মৃতিও নেই। শুধু আছে, ১৯৪৮-এ ‘ইজরায়েল-আরব যুদ্ধ’, ১৯৬৭-তে ‘ছয় দিনের যুদ্ধ’, ২০০৮-এ ‘অপারেশন কাস্ট লিড বা গাজা যুদ্ধ’, প্রথম ইন্তিফাদা যা ইজরায়েলের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ১৯৮৭-১৯৯৩ এবং দ্বিতীয় ইন্তিফাদা বা আল-আকসা বা ইজরায়েলের হিংসার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ২০০০-২০০৫। এই ৭৩ বছরের জীবনে প্যালেস্তাইন এত শহিদ দেখেছে, এত ধ্বংস দেখেছে, এত জবরদখল দেখেছে যে নিজের কথা বলতে গিয়ে তার চোখ কান্নায় ঝাপসা হয়ে আসে। স্যার, আমরা শুধু সংখ্যা নই। আমাদেরও তো বেঁচে থাকার অধিকার আছে, ইশকুলে যাওয়ার অধিকার আছে, বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাড়ি ফেরার অধিকার আছে অথচ ইজরায়েল আমাদের সব অধিকার কেড়ে নিয়ে তাড়িয়ে দিতে চাইছে আমাদের জন্মভূমি থেকে।

এতক্ষণ যা শুনলেন তা কেবলমাত্র কোনো একজন প্যালেস্তানীয়র বক্তব্য নয়। ১৯৪৮-এর পর ইজরায়েলের দখলদারিত্বে থাকা ৫,১০১,৪১৪ সংখ্যক (জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ি, ২০২০) প্যালেস্তানীয় এবং ইজরায়েলি দখলদারদের অত্যাচারে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে শরণার্থীর জীবন কাটানো ৫৬,০০,০০০ সংখ্যক (UNRWA তথ্য অনুযায়ি, ২০১৯) প্যালেস্তানীয়, সকলেই ইজরায়েলের সেনাবাহিনীর অত্যাচারের শিকার। শরণার্থীর কথা যখন উঠলই, তখন চলুন একটু ঘেঁটে দেখা যাক জাতিসংঘ নিয়ন্ত্রিত শরণার্থী তথ্যপুঞ্জি। ১৯৪৮ সাল। আপনারা জানলে শুধু অবাক নয়, চমকে উঠবেন, সে-বছর যুদ্ধশেষে প্যালেস্তাইনে বসবাসকারী ৮৫% মানুষের ঠাঁই হয়েছিল জাতিসংঘের তৈরি করা তাঁবুর ঘরে। ১৯৬৭ সালে ‘ছয় দিনের যুদ্ধ’ শেষে দেখা যায়, জাতিসংঘ শুধুমাত্র প্যালেস্তানীয় শরণার্থী রাখার জন্য ৫৯টি ক্যাম্প বানিয়ে ফেলেছে। কেন-না ১৯৬৭-র যুদ্ধ শেষে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া প্যালেস্তানীয়র সংখ্যা ছিল প্রায় ২৮০,০০০ থেকে ৩২৫,০০০। দীর্ঘদিন ধরে প্যালেস্তানীয়দের শরণার্থী বানানোর খেলায় মত্ত ইজরায়েলকে থামানোর চেষ্টা হিসেবে ১৯৯৩ সালে ইজরায়েল ও প্যালেস্তাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (PLO) আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের উপস্থিতিতে ‘অসলো চুক্তি’ স্বাক্ষর করে। সে-সময়ে ‘অসলো চুক্তি’-কে শান্তি অর্জনের প্রক্রিয়া মনে করা হয়েছিল। কিন্তু ইজরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর দখলদারির লোভ বেশিদিন চাপা থাকেনি। মন্ত্রণালয়ের আপত্তি থাকা সত্ত্বেও নেতানিয়াহু দখলকৃত জায়গা থেকে সেনা প্রত্যাহার অস্বীকার করে। চুক্তিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আগের ফর্মেই ফেরে। শান্তিপ্রক্রিয়া অথই জলে ডুবে যায়। কেউ কেউ ‘অসলো চুক্তি’ ব্যর্থ হওয়ার কারণ হিসেবে ‘দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধান নীতি’-কেই দায়ী করেন। তবে ইজরায়েলের দখলদারিত্বে নেতৃত্ব দেওয়া এবং প্রিয় যুদ্ধনীতির কারণে এতগুলো মানুষ আজও ঘরছাড়া, দেশহারা। ইজরায়েল তো এই নিয়ে কথা তুলতেই চায় না, একইরকমভাবে তাঁর মিত্র দেশ আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, ভারত সবাই চুপ। চুপ থেকে এই দেশগুলো শুধু যে ইজরায়েলকেই সমর্থন করছে এমনটা নয়। আসলে সমর্থন করছে ইজরায়েলের প্যালেস্তানীয়দের শরণার্থী বানানোর প্রক্রিয়াকে।

প্যালেস্তাইনের শরণার্থীদের কথা এত অল্পতে বলে শেষ করা যাবে না। দুঃখ যেভাবে বর্ণনা করে বোঝানো যায় না, অনুভব করতে হয়, ঠিক তেমনই হাল প্যালেস্তানীয় শরণার্থীদের। এবার চলুন জেনে নেওয়া যাক, ইজরায়েলের অত্যাচার, হিংস্রতা, অবিচার সহ্য করেও অধিকৃত প্যালেস্তানীয় অঞ্চলে (OPT— Occupied Palestinian Territories) থেকে যাওয়া মানুষগুলোর কথা। যাদের কোথাও যাওয়ার নেই, তাদের কথা। যারা দেশকে একা রেখে, ইজরায়েলের হাতে তুলে না দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে প্রতিরোধ করে যাচ্ছেন, তাদের কথা। কেমন আছে প্যালেস্তাইন, কেমন আছেন প্যালেস্তানীয়রা― এই প্রশ্নের জবাব এককথায় বললে, “এখানে জন্মের চেয়ে মৃত্যুদিন বেশি”। ক্রমাগত বোমা ফেলে ঘরবাড়ি ধ্বংস, জবরদস্তি দখলদারি, সেনাবাহিনীকে কাজে লাগিয়ে জায়গায় জায়গায় চেকপয়েন্ট (প্যালেস্তাইনের শুধুমাত্র ওয়েস্ট ব্যাঙ্কেই চেকপয়েন্টের সংখ্যা ৫৩৯) বসিয়ে কাগজ দেখার নামে হয়রানি, দিনের পর দিন কোনোরকম চার্জ বা বিচার ছাড়াই ‘প্রশাসনিক বন্দি’ করে রাখার মতো শক্তি প্রদর্শনে ব্যস্ত ইজরায়েল তার ন্যূনতম বিবেককেও বিসর্জন দিয়েছে। ইজরায়েলের বর্তমান কার্যকলাপ দেখলে বা নারীদের উপরে, শিশুদের ওপর অত্যাচার দেখলে আপনার মনে প্রথমেই যে-কথা উঠে আসবে, তা হল ‘ইজরায়েলের কি মন নেই?’ যদিও তাতেও ইজরায়েলের কিছু যায় আসে না। আপনি ভাবতেও পারবেন না, একটা রাষ্ট্র ও তার রাষ্ট্রপ্রধান কী করে এত নীচে নেমে মানবাধিকারের গলা টিপে ধরে কণ্ঠরোধ করতে পারে। না, অবাক হওয়ার কিছু নেই। ইজরায়েলই পারে। তাই তো তারা ৭৩ বছর ধরে একটা দেশকে টুকরো টুকরো করে থালায় সাজিয়ে নিয়ে হাপিস করে দিচ্ছে। ইজরায়েল অধিকৃত প্যালেস্তানীয় অঞ্চলে নাগরিকদের তো বলার অধিকার নেই, একইরকমভাবে বলার অধিকার নেই সাংবাদিকদের, মানবাধিকার কর্মীদের, বলার অধিকার নেই সমাজবিদদের, বিজ্ঞানীদেরও। না, শিশুদেরও বলার অধিকার কেড়ে নিয়েছে ইজরায়েল। একটা তথ্য তুলে ধরলে আপনাদের বুঝতে সুবিধা হবে। ২০২০ সালে ইজরায়েল দেশের জন্য যে-বাজেট পাশ করেছে, তাতে তো দখলকৃত প্যালেস্তানীয় অঞ্চলে বসবাসকারীদেরও অধিকার থাকার কথা। কেন-না, তুমি ওদের জন্মভূমি দখল করেছ, দখল করেছ ওদের বসতভিটে সঙ্গে ওদেরও। তাহলে তো ওদের ভরণ-পোষণেরও দায় তোমাকেই নিতে হবে। অথচ যেখানে ইজরায়েলে বসবাসকারী মোট জনসংখ্যার ২০%-এরও বেশি প্যালেস্তানীয়, প্রায় ১৩৯টি গ্রাম-শহরে এখনও প্যালেস্তানীয়দের বাস। সেখানে তাদের জন্য বাজেটের বরাদ্দ মাত্র ১.৭%। এবার নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, কেমন আছে প্যালেস্তাইন।

প্যালেস্তানীয়দের দুর্দশার কথা আর বলব না। বলব না স্বাধীনতা নিয়েও কোনো কথা। কোনো কিছুই আর অবশিষ্ট নেই প্যালেস্তাইনে। বরং বলি কী আশ্চর্য দেখুন, এতকিছুর পরও মানুষগুলো কী অদম্য জেদ নিয়ে রোজ ঘুমোতে যায়, ঘুম থেকে ওঠে। রুগ্ন চোখজুড়ে লালন করে স্বাধীনতার স্বপ্ন। দেশ আর নিজের মর্যাদা রক্ষার জন্য অবলীলায় করে চলেছে কারাবাস। জানেন ইজরায়েলিরা যখন প্যালেস্তানীয়দের ধরে ধরে জেলবন্দি করাকে উৎসবে পরিণত করেছে, ঠিক তখন প্যালেস্তানীয়রাও জেলে অনশন করাটাকে উৎসবে পরিণত করেছে। প্রতি মুহূর্তে সন্ত্রাসবাদের অজুহাতে, জিজ্ঞাসাবাদের অজুহাতে, আইন-লঙ্ঘনের অজুহাতে যত প্যালেস্তানীয়কে আটক করা হয়, সেই সংখ্যাটা আপনার-আমার কল্পনাতে অতীত। জেলের কথা যখন উঠলই চলুন একবার ওদিকটায় ঢুঁ মারা যাক।

প্যালেস্তাইনের কিছু NGO সংস্থা, যারা বন্দি প্যালেস্তানীয়দের অধিকার রক্ষা এবং মানবাধিকারের জন্য লড়াই করে তারা প্রতি বছর জেলবন্দিদের নিয়ে একটা করে বাৎসরিক সমীক্ষাপত্র প্রকাশ করে। যেখান থেকে আপনি অনায়াসেই জানতে পারবেন, বছরে কতজন ইজরায়েলের হাতে বন্দি হচ্ছেন, কতজন মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, চিকিৎসা পাচ্ছেন না, শেকল বাধা অবস্থায় সন্তান প্রসব করেছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। আমরা এখানে সেই NGOগুলোর সমীক্ষা থেকেই শেষ তিন বছরের কিছু তথ্য আপনাদের পড়ে শোনাই। ২০১৯-এ রাজনৈতিক বন্দির সংখ্যাটা ছিল ৫৪৫০ জন, প্রশাসনিক বন্দি ৪৯৫, মহিলা বন্দি ৫৩, শিশু বন্দির সংখ্যা ২১৫ এবং প্যালেস্তানীয় আইন পরিষদের বন্দি সংখ্যা ৭। একইরকমভাবে ২০২০-র পাতা ওলটালে দেখা যাবে ২০২০ সালে রাজনৈতিক বন্দি ছিলেন ৫০০০, প্রশাসনিক বন্দি ৪৬১, মহিলা ৪১, শিশুর সংখ্যা ১৮০ এবং প্যালেস্তানীয় আইন পরিষদের বন্দি সংখ্যা ৪। এবার আসা যাক ২০২১ সালে। ২০২১ সালের অগাস্ট অনুযায়ী রাজনৈতিক বন্দি ৪৭৫০ জন, প্রশাসনিক বন্দি ৫৫০, মহিলা বন্দি ৪২, শিশু বন্দি ২০০ এবং প্যালেস্তানীয় আইন পরিষদের বন্দি সদস্য ১২। এবার বুঝতে পারছেন তো কেন ‘জেলের ডায়েরি’ শিরোনামে এই লেখা লিখতে বসা। আসলে পুরো প্যালেস্তাইনকেই বড়ো বড়ো কংক্রিটের দেওয়ালে মুড়ে বৃহৎ এক জেলখানায় বদলে ফেলেছে ইজরায়েল।

ইজরায়েলি আইন অনুযায়ী প্যালেস্তানীয়দের গ্রেফতার করতে কোনো ওয়ারেন্ট লাগে না, তেমনি জেলবন্দি করে রাখতেও লাগে না কোনো চার্জশিট। ইজরায়েল প্যালেস্তাইনের সাধারণ মানুষের অধিকার নিয়ে একটুও চিন্তিত নয় এবং তারা চায়ও না প্যালেস্তানীয়রা অধিকার নিয়ে কথা বলুক। তারা বন্দিদের সঙ্গে আইনজীবী কিংবা পরিবারের লোকজনকে দেখা করতে দিতে চায় না। ইজরায়েলের জেলে প্যালেস্তানীয় বন্দিদের জন্য সূর্যের আলোর বরাদ্দ নেই, বিছানার বরাদ্দ নেই, বরাদ্দ নেই কাগজ, কলম, পেন্সিল এমনকী বইয়েরও। ইজরায়েলের জেলে এমনও হাজার হাজার বন্দি রয়েছেন, যাঁরা ২০ বছর জেলে কাটানোর পরও জানেন না, কেন তাকে বন্দি করে রাখা হয়েছে। তাহলে বুঝতেই পারছেন ইজরায়েলের জেল থেকে কোনো চিঠি বা ডায়েরির বাইরে আসাটা কতটা কষ্টকর এবং একইসঙ্গে অসম্ভবও বটে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আইনজীবীর হাত ধরেই জেলের বাইরের আলো দেখে চিঠি বা ডায়েরির পাতা। আজ আমরা তেমনি চারটে পাতা, চার বন্দির জেল যাপন আপনাদের সামনে রাখলাম।

ইব্রাহিম মিস আল

১৯৯০-এর ২৮ মার্চ আমি ধরা পড়েছিলাম। ইজরায়েলি সেনারা বিস্ফোরক এবং কুকুর নিয়ে আমার বাড়িতে ঢুকেছিল। বাড়িতে যে ছোটো বাচ্চারা ছিল তা নিয়ে তাদের কোনো ভ্রূক্ষেপই ছিল না। আমার ছেলের বয়স তখন মাত্র ২ বছর আর মেয়ের ১ বছর। এবং আমার স্ত্রী তিন মাসের অন্তঃস্বত্ত্বা। সেদিন যা ঘটেছিল সেটা সত্যিই ওদের জন্য ভয়াবহ ছিল; শুধু তাই নয়, সেই ঘটনার এক বছর পরও আমার মেয়ে কথা বলতে পারেনি।

সেই মুহূর্তগুলো, আমার পরিবারের মুখগুলো― আমি কখনো ভুলতে পারব না, ঠিক যখন আমার বাড়ির সমস্ত দেওয়াল, পুরো বাড়িটা, বাড়ির সবকিছু ওরা ভেঙে তছনছ করে দিচ্ছিল। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ওরা আমাকে অন্য একটা জেলে নিয়ে গিয়েছিল, আর পথে রাইফেল-সহ যা কিছু ওদের হাতে ছিল তা দিয়ে লাগাতার আমাকে মারার কাজটা চালিয়ে গিয়েছিল।

জিজ্ঞাসাবাদের নামে টানা ৫০ দিন ধরে আমার ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছিল। ওরা আমাকে ঘুমোতে দিত না, পিছমোড়া করে হ্যান্ডক্যাপ পড়িয়ে আমাকে অদ্ভুতভাবে বসিয়ে রাখত। প্রচণ্ড গরম এবং ঠান্ডা দুই পরিস্থিতির মুখোমুখিই আমাকে হতে হয়েছে। এর ফলে আমার ঠিক কতটা ক্ষতি হয়েছি তা হয়তো সঠিক বলতে পারব না। পরে জেনেছিলাম আমার স্ত্রীকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হলে আমাকে জেলে পাঠানো হয়। সেখানে প্রতিটি বন্দির মতোই আমারও হাতে পায়ে শেকল পড়িয়ে একটা ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল, যে-ঘরে দেওয়াল ছাড়া কিছুই ছিল না। আমি লাগাতার কষ্ট পাচ্ছিলাম। জেলে আমাদের অবস্থার উন্নতির জন্য জেল কর্তৃপক্ষকে দীর্ঘ সময় ধরে আবেদন-নিবেদন চালিয়ে গেছি। ওরা আমাদের অবস্থার কিছুটা উন্নতি করেছিল বটে তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় অতি সামান্য। যখন আমাকে আদালতে পাঠানোর বিষয়টি এসেছিল ততদিনে আমার জীবন নরকে পরিণত হয়েছিল। সাধারণত ওরা খুব ভোরে দু-জন বন্দিকে হাতকড়া পরিয়ে বাসে করে রামাল্লায় একটা ডিটেনশন ক্যাম্পে নিয়ে যেত। ওখানে আমরা টানা কয়েকদিন মাটির নীচের একটা ঘরে থাকতাম, আর সে-ঘরটা একেবারে ভিড়ে ঠাসাঠাসি থাকত। জল নিকাশের পাইপগুলো ছিল সিলিঙের ওপরে আর সারাক্ষণ সেগুলো থেকে জল চুইয়ে পড়ত। সেখানে ইঁদুর, আরশোলার উৎপাতের পাশাপাশি ছিল দম বন্ধ করা দুর্গন্ধ, একেবারে নাড়িভুড়ি বেরিয়ে আসার জোগাড়।

সে-কারণেই আমরা অবস্থার উন্নতি করতে চেয়েছিলাম, আর আমাদের একমাত্র পদক্ষেপ ছিল অনশন ধর্মঘটে যাওয়া। অনশনের পথটা কঠিন হলেও ওটাই ছিল আমাদের একমাত্র পথ। যদিও এই পথটাকে অনেকেই নেতিবাচক মনে করেন। ওরা আমাদের সেলের বাইরে যে-সমস্ত খাবার দেওয়ার চেষ্টা করত, আমরা সেগুলোকে ছুড়ে দিতাম। এতে আমাদের যে শুধু খিদের মুখোমুখি হতে হয়েছে তাই নয়, ইজরায়েলিরা ধরে ধরে আমাদের মেরেছে পর্যন্ত। কিছু বন্দিকে অন্য জেলে পাঠানো হয়েছিল, আর অন্যদের নির্জন সেলে রাখা হয়েছিল। অনশন ধর্মঘট আর মৃত্যুর মধ্যে কোনো তফাত নেই জানা সত্ত্বেও আমাদের অধিকার আদায়ের জন্য অনশনকেই আমরা ব্যবহার করতাম, যখন আমাদের সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যেত। অনশন ধর্মঘটের সময় অনেক বন্দিই মারা গিয়েছিলেন।

অনশন ধর্মঘটের ফলে আমরা যে-অধিকারগুলো অর্জন করতাম কিছুদিনের মধ্যে আবার সেগুলো ওরা কেড়ে নিত ফলে বছরে এক-দু-বার আমাদের অনশন করতেই হত কারণ জেলের পরিস্থিতি ছিল দুর্বিষহ। প্রতিটি বন্দির জন্য বরাদ্দ জায়গার পরিমাণ ছিল মাত্র ১ বর্গমি যেখানে তাকে সবকিছু করতে হত।

আমি প্যালেস্তানীয় জনগণের প্রতিরোধের বিষয়ে কথা বলতে চাই। আমরা হত্যা করতে পছন্দ করি না৷ ইজরায়েলি দখলদারি আমরা প্রতিহত করেছি, কারণ, আমরা স্বাধীনতা চেয়েছিলাম, আমরা আমাদের সন্তানের ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত করতে চেয়েছিলাম। ইজরায়েলিরা বলে আমাদের হাত রক্তে রাঙানো, আমরা সন্ত্রাসী। কিন্তু মজার বিষয়টা হল তাদের নেতারা প্যালেস্তানীয়দের রক্তে ডুবে গেছে, বিশেষত শ্যারন এবং নেতানিয়াহু। প্যালেস্তানীয় জনগণের বিরুদ্ধে অপরাধ সংগঠিত করার ক্ষেত্রে সমস্ত ইজরায়েলি নেতারাই যুক্ত। ২৩ বছর ধরে যে-যন্ত্রণাদগ্ধ জীবন আমি কাটিয়েছি তা এই অল্প সময়ের মধ্যে ব্যক্ত করা সত্যিই অসম্ভব।

ইবতিসাম ইসাবী

আমি ৪ মেয়ে ও ২ ছেলের মা। আমার ১৫ বছরের সাজা হয়েছিল, আমি ১০ বছর জেলে কাটিয়েছি। জেল যদি একজন পুরুষের পক্ষেই এতটা অসহনীয় হয়, তবে ভাবুন একজন মেয়ের পক্ষে জেল কতটা বিভীষিকার। ইজরায়েল সর্বদা দাবি করে মধ্যপ্রাচ্যের তারাই একমাত্র দেশ যেখানে নারী ও পুরুষদের সমান অধিকার রয়েছে, তবে এটা আমরা শুধুই শুনেছি কিন্তু প্রত্যক্ষ করতে পারিনি।

জেল থেকে জেলে বা আদালত থেকে জেলে স্থানান্তরের সময় আমি যে একজন নারী, বা একজন পুরুষ আর একজন নারী প্রয়োজনের মধ্যে যে পার্থক্য থাকে সে-বিষয়ে তারা কখনো কোনো আমলই দেয়নি। কখনো কখনো এই স্থানান্তরের কাজটা করতে একদিনের বেশি সময় লাগত। জেলে আমাদের কোনো গোপনীয়তা ছিল না। তল্লাশির নামে ওরা যখন তখন সেলে ঢুকত এবং কখনো কখনো আমাদের উলঙ্গ করে তল্লাশি চালাত।

শুরুতে আমি রামালের জেলে ছিলাম। সেখানে একজন বন্দি হিসেবে নয়, একজন অপরাধী হিসেবে আমাকে দেখা হত। ঠিক একজন হত্যাকারীকে যেভাবে দেখা হয় বা ডাকাতি বা বেশ্যাবৃত্তির দায়ে কাউকে যেভাবে দেখা হয়। ওরা সর্বক্ষণ আমাদের তল্লাশি চালাত, ওদের দাবি ছিল আমরা নাকি জেলে মাদক পাচারের কাজের সঙ্গে যুক্ত রয়েছি। সে-জন্য আমাদের অধিকার আদায়ের জন্য অনশন ধর্মঘটে যেতে হয়েছিল। আর সে-কারণেই আমাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহারের পাশাপাশি অনশন ধর্মঘট ভাঙার জন্য কখনো কখনো জোর করে গ্লুকোজ ইঞ্জেকশন দিত।

আমার পরিবার জর্ডনে বাস করে। আর বাবা বয়স্ক হওয়ার কারণে আমাকে দেখতে আসতে পারেননি। আমি বাবার সঙ্গে কমপক্ষে একবার ফোনে কথা বলার জন্য অনেক অনুরোধ করেছি, কিন্তু ওরা অস্বীকার করেছে এবং বলেছে পরিবারের কেউ মারা গেলেই নাকি একমাত্র ফোন কলের অনুমোদন রয়েছে।

জেলে আমরা ছুটির দিনগুলো নিজেদের মতো করে উদযাপন করতাম, তবে ইদ উদযাপনের দিনেও ওরা কোনো অনুমতি দিত না। ওরা সবসময় বলত ভুলে যেয়ো না এটা হোটেল নয়, তোমরা জেলে আছ।

প্যালেস্তানীয় বন্দিরা সুশিক্ষিত হিসেবে পরিচিত। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি, আর সে-কারণেই জেলটাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করার ব্যবস্থা করেছিলাম। এমনকী আমরা যখন পড়াশুনো করতাম সেটা যাতে করতে না পারি তারও চেষ্টা চলত। আমাদের অনশন ধর্মঘট করার পেছনে সেটাও একটা কারণ। আমাকে দু-সপ্তাহের জন্য মুক্তি দেওয়া হয়েছিল এবং তারা আমার ওপর একগুচ্ছ বিধিনিষেধ চাপিয়ে দিয়েছিল। যেমন আমাদের ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে প্রবেশের অনুমতি নেই। আর আমার ক্ষেত্রে সমস্যা হল আমার পরিবার এবং ভাইয়েরা বেশিরভাগজনই সেখানে বাস করে। তারা জেরুজালেমে আসতে পরে না এবং আমি তাদের সঙ্গে দেখা করতে যেতেও পারিনি… পারি না।

নাসের আবেদ রাব্বো

১৯৮৮-র ৯ ফেব্রুয়ারি, ২৩ বছর আগে আমি গ্রেফতার হয়েছিলাম। আমি এখনও জিজ্ঞেস করি… কেন আমাকে আমার শহর জেরুজালেম থেকে এবং আমার প্রিয়জনের থেকে আমাকে দূরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল? আমি এর উত্তর চাই, কারণ, আমি এখনও জেলবন্দি, কোনো নির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই।

আমাকে আমার বাড়ি থেকেই গ্রেফতার করা হয়েছিল এবং আমাকে গ্রেফতার করার সময় ওরা আমার বাড়ির সবকিছু ভেঙে তছনছ করে দিয়েছিল। সে-সময় আমাকে হাতকড়া আর চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আমার গ্রেফতার মোটেই স্বাভাবিক ছিল না, আমাকে সোজাসুজি আমার বাড়ি থেকে পুলিশ ভ্যানে তোলা হয়নি। তারা আমাকে প্রায় ২ কিমি দূরে গ্রামের বিভিন্ন প্রতিবেশীদের দেখাতে দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। আমি আঘাত পেয়েছিলাম, বিশেষত মাথায়। প্রত্যেকেই মাথা থেকে রক্তপাত হতে দেখেও চুপ ছিল। আমি মনে করি আমার সঙ্গে এইসব ঘটনা ঘটানোর পেছনের মূল উদ্দেশ্য হল দখলদারির বিরুদ্ধে কেউ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে গেলে তার পরিণাম কী হতে পারে সেই সংক্রান্ত একটা উদাহরণ তৈরি করা।

জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আমাকে জেলে পাঠানো হয়। ওই সময়টা জেল কর্তৃপক্ষ এবং গোয়েন্দাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ওরা সকলেই জেল থেকে আদালতে পাঠানোর সময় আমাদের ওপর মানসিক চাপ তৈরি করত। আসলে বিচারপর্ব দ্রুততার সঙ্গে শেষ করা এবং চার্জগুলো যাতে আমরা অস্বীকার করতে না পারি সেটাই ছিল ওদের মূল লক্ষ্য। ওরা আমাদের বোঝাত, তুমি যদি এসব মেনে নাও তবে অত্যাচার এবং আমাদের সঙ্গে যে খারাপ ব্যবহার করা হত সেটা বন্ধ হয়ে যাবে।

ইজরায়েলিরা সবসময় মিডিয়ায় বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলে যে, তারা একটি সন্ত্রাসবাদী দলকে গ্রেফতার করেছে যারা বিশাল সংখ্যক ইজরায়েলিদের হত্যার জন্য দায়ী। আমাদের চার দেওয়ালের মধ্যে আটকে রাখাটা কেবল আমাদের শরীরকে আটকে রাখা নয়, মনকে আটকে রাখা। এবং আমাদের সমাজে যে-সক্রিয় অংশ রয়েছে তা থেকে আমাদের দূরে নিয়ে যাওয়া। আসলে ওরা আমাদেরকে সবসময় একটা সামাজিক ঘেরাটোপের মধ্যেই রাখতে চায়। এবং ওরা আমাদের পরিবারের সদস্যদের আমাদের সঙ্গে দেখা করতে পর্যন্ত বাধা দেয়। বিশেষত পরিবারের বাবা-মা, ভাইবোন, সন্তান, অর্থাৎ, পরিবারের নিকট আত্মীয় সদস্য ছাড়া কারোরই সাক্ষাতের অনুমতি মেলে না।

আমরা যে-টিভি চ্যানেলগুলো দেখতাম তার সংখ্যাও ওদের ইচ্ছের ওপর নির্ভর করত, এমনকী রেডিয়োগুলো পর্যন্ত অ্যান্টেনা ছাড়া কাজ করত না। যদিও আমাদের টিভি দেখার অনুমতি ছিল কিন্তু কোন চ্যানেলগুলো আমরা দেখব তার ওপর আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। প্যালেস্তাইনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াশুনো করার ক্ষেত্রেও ওরা আমাদের বাধা দিত। এই সবকিছুই করা হত আসলে আমাদের সমাজের থেকে বিচ্ছিন্ন করার উদ্দেশ্যে।

প্যালেস্তানীয় বন্দিদের মধ্যে প্যালেস্তাইনের সকল অংশের মানুষ রয়েছে। এছাড়াও জেলে এমন কিছু বন্দিও রয়েছে যারা আরবের অন্য দেশ থেকে আসা, অন্য রাজনৈতিক দল থেকে আসা। দখলদারিত্বের শুরু থেকেই বন্দিরা রাজনৈতিক দলের সংস্পর্শে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল, কারণ, তারা জানত, ন্যায়সংগত উদ্দেশ্যের জন্যই তাদের লড়াই। প্রত্যেকের মধ্যেই এই অনুভূতি ছিল যে, আমাদের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে, এমনকী সেটা জেলের ভেতরেও। আর এটাই প্যালেস্তানীয় বন্দি আন্দোলন হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। ইজরায়েলিরা অবশ্য এই আন্দোলনকে একেবারেই পছন্দ করেনি এবং যথেষ্ট কঠোরভাবে দমন করেছিল।

১৯৭০-এর দশকে বেশ কয়েকটি জেলকে ট্যাঙ্কের শক্ত আবরণ, অর্থাৎ, শিল্ড তৈরির কারখানা হিসেবে ব্যবহার করা হত। যে-ট্যাঙ্কগুলো আবার আমাদের প্যালেস্তানীয়দের মারার জন্য ব্যবহৃত হত। তারা আমাদের আন্দোলনকে ধ্বংস করতে এবং তাদের রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে বন্দিদের কারখানায় কাজ করতে বাধ্য করেছিল। তবে জেলের ভেতর বন্দিদের দৃঢ়তার কারণেই সকলকে নিয়ে এক বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছিল। আমাদের সেই আন্দোলন যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। যদিও ইজরায়েল জেল কর্তৃপক্ষ সবসময় সেটাকে দুর্বল করার চেষ্টা চালিয়ে গেছে।

অনশন ধর্মঘটের মধ্যে দিয়ে আমরা বেশ কিছু অধিকার অর্জন করি, কিন্তু যারা বলে জেল কর্তৃপক্ষ আমাদের সেই অধিকার দিয়েছে তারা মিথ্যা বলে। আমরা লড়াই করে এবং নিজেকে অভুক্ত রেখে কিছু অধিকার পেয়েছি। আসলে অনশনই আমাদের কৌশলগত অস্ত্র যা আমরা আমাদের অধিকার পেতে জেল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারি।

আলি মাসলামানি

৩০ বছর… ৩০ বছর জেলে কাটিয়েছি আমি। আর সেই ৩০ বছর নিত্যদিন সার্চলাইটের নজরদারির ভেতর নিজের সঙ্গে নিজের লড়াই করতে হয়েছে। দেশ হিসেবে প্যালেস্তাইনের জাতীয় সম্মান ও অধিকার পুনঃস্থাপনের জন্য আমাদের লড়াই জারি রয়েছে। জেলে থাকা সত্ত্বেও আমরা আশাবাদী, কারণ, এই ভূখণ্ডের ধারক আমরা। আমরা আশাবাদী কিন্তু তাই বলে আমরা পারফেকশনিস্ট নই, কারণ, বাস্তব সত্যটা আমরা জানি।

আমরা শারীরিকভাবে অনেক কিছুই জয় করেছি কিন্তু তার থেকেও আমাদের গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য হল নৈতিকতার সাফল্য। কারাগারের জীবন এক অন্য জীবন, সেখানে প্রত্যেকে একে-অপরকে সম্মান করে। আমাকে বলতেই হবে আমি এখন সত্যিই সুখী। আমার মনের অবস্থা সত্যিই ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়, আমি এখন মুক্ত, আমি এখন আমার পরিবার, আমার বন্ধুদের মধ্যে রয়েছি।

মুক্তি পাওয়ার পর থেকে আমি আবার সময় বিষয়টা অনুভব করতে শুরু করেছি। জেলের সমস্যা হল আপনি সেখানে সময়ের হিসেব কষতে পারবেন না। জেলে সময় যেন থমকে যায় সে কিছুতেই এগোতে চায় না, কারণ, সেখানে নতুন কোনো ঘটনা ঘটে না, প্রতিটা দিন সকাল থেকে সন্ধ্যা সেই একই আবর্ত। কিন্তু মুক্তি পাওয়ার পর আমি সারাদিনে কী কী করব, কোথায় কোথায় যাব সব মাকে বলি, আসলে স্বাধীনতার এটাই তো মজা।

আমার পরিবার এবং বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর আমি জেলের দুর্বিষহ দিনগুলোর কথা ভুলেই গিয়েছিলাম, আমার কাছে সবকিছুই অপ্রয়োজনীয় হয়ে গিয়েছে। আমি মনে করি প্যালেস্তানীয়দের সহায়তা করতে প্রয়োজনে আমি একজন যোদ্ধাও হব। আসলে প্যালেস্তানীয়রা মনে করে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াই এমন এক ধারাবাহিক অনুষ্ঠান যেখানে তারা তাদের সন্তানদের উৎসর্গ করে স্বাধীনতা আনার জন্য। আমরা প্রত্যেকেই এক বৃহত্তর মানবিক ঘটনার অংশীদার। আমি জীবনে অনেক সংবেদশীল ঘটনার মুখোমুখি হয়েছি কিন্তু আমাদের জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার দৃশ্যটি ছিল সবচেয়ে আশ্চর্যময় এবং অনবদ্য। আমাদের পরিবার এবং বন্ধুরা আমাদের যেভাবে অভিনন্দন জানিয়েছিল তাতে আমরা অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম। আমাদের অনুভূতি কেমন ছিল সেটা ব্যাখ্যা করার জন্য সত্যিই বোধহয় একজন কবির প্রয়োজন।

জেলে প্রত্যেকেই কোনো-না-কোনো মামলায় জড়িত, কেউ পাথর ছোড়ার জন্য তো কেউ কোনো বড়ো অপারেশনের সঙ্গে যুক্ত, আবার কেউ-বা ইজরায়েলিদের হত্যার কারণে। কিন্তু সেই বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে আমাদের কেউই কখনো বড়াই করে না। আমরা সবসময় বলি স্বাধীনতার জন্য, সম্মানের সঙ্গে বাঁচার জন্য, আমাদের দেশকে ফিরে পাওয়ার জন্য আমরা প্রতিনিয়ত ইজরায়েলের দখলদারিত্বকে প্রতিহত করে চলেছি। আমাদের অপরাধ আমরা সর্বদা আমাদের জনগণের জন্য শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধের আহ্বান জানিয়েছিলাম, কারণ, আমরা মনে করি রক্তপাত বন্ধ হওয়া উচিত এবং প্যালেস্তাইনের রাজধানী হিসেবে পবিত্র জেরুজালেমে প্যালেস্তানীয়দের বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে। ইউনেস্কো যেদিন থেকে প্যালেস্তাইনকে সদস্য দেশ হিসেবে গ্রহণ করেছে, সেদিন আমাদের আশা আকাশ ছুঁয়েছে, আমরা এতটাই আশাবাদী।

আমি তিন প্রজন্মের একজন
যে গত ৪০ বছর ধরে
কত না উপায়ে শুধু স্মৃতি মুছে গেছি
অনেক স্মৃতি অবশ্য কেড়ে নিয়েছে বুলেটেরাও

ভুলভাল ধর্মের সব ভুলভাল লোক এসে
একচেটিয়াভাবে
আমাদের দেশটাকে সাজানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে

আমরা তিন প্রজন্ম ধরে
একইরকম তাঁবুর বাড়িতে রয়েছি
তৈরি থেকেছি
এক সুটকেস আর চাবি সঙ্গে নিয়ে
আমরা জানতাম―
যে-কোনো সময় নেমে আসতে পারে আক্রমণ
রাত কাটাতে হতে পারে বিমানবন্দরের মেঝেতে
আমরা তৈরি অভিবাসনের প্রশ্ন-উত্তরের জন্য
মানচিত্রও মুখস্থ আমাদের

ভালোবাসতে গিয়ে পুরুষ নয়
আমরা বিপ্লবের প্রেমে পড়ে গেছি
বিবাহ দিনের ডাবকা নাচ
আমরা নেচে ফেলেছি শেষকৃত্যের দিনে

আমাদের আকাশ চুরি গেছে
চুরি গেছে তিন প্রজন্মের আনন্দ, ভালোবাসা
দখল হয়েছে শ্বাস-প্রশ্বাস
আমাদের দিন কেটেছে জানালার সামনে বসে
কেটেছে খাঁচায় ঘেরা ওয়েটিং রুমে
আমাদের আলিঙ্গনের মাঝে এসে দাঁড়িয়েছে সৈনিকের ছায়া
আমাদের হাত আজীবন ধ্বংসস্তূপ খুঁজে চলেছে
খুঁজে চলেছে মোমবাতি আর নোটবুক

আমাদের প্রতিটা রাগী চোখ চেকপয়েন্টের দিকে তাকিয়ে
আমাদের প্রতিটা গান ওদের বিরুদ্ধে গাওয়া
আমাদের প্রতিটা নিঃশ্বাস তৈরি হয়েছে
বিরোধিতা করবে বলে
আমরা ওদের তৈরি করেছি
তোমাদের বিরোধিতা করব বলে