Categories
2021-Utsob-Story

রিপন হালদার

আশ্চর্য ভ্রমণ

এই মাঠটা মনে হয় কিছু মানুষের অন্তহীন পায়াখানার স্থান। এর আগে যে-কয়বার ও এখানে এসেছিল প্রত্যেকবারই কিছু মানুষকে দেখেছে তাদের দীর্ঘ কালো প্রস্রাবদণ্ড মাটিতে ঠেকিয়ে পায়খানায় রত। প্রত্যেকের সামনে একটা করে ঘটি। আড়চোখে গুনে দেখা গেল আটজন। এবং প্রত্যেকের মাথা মাটির দিকে নোয়ানো। এই লাইনের পর কিছুটা জায়গা ফাঁকা। তারপর আবার একটা লাইন। এখানে যারা বসে আছে তারা আবার পরনের লুঙ্গি বা ধুতির মতো পোশাকটা উলটিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছে। যেন এর ফলে পৃথিবীর আর কেউ তাদের গোপন অঙ্গ দেখতে পারবে না! অন্য দিকে তাকানোর ভান করে গুনে দেখা গেল ছয়জন। আগে যতবার এখানে এসেছিল এদের এভাবেই দেখা গিয়েছিল। আজও অমল দেখতে পেল মানুষগুলোকে একই কাজে ব্যস্ত। প্রত্যেকের বসার ধরন একরকম। মাথার আকৃতি দেহের বিশেষ করে হাত পায়ের গঠন একইরকম দেখতে। সামান্য দূরত্ব রেখে লাইন দিয়ে কী অদ্ভুতভাবে মানুষগুলো উবু হয়ে বসে আছে। এবং প্রত্যেকেরই গায়ের রং কালো। কিন্তু কোনোবারই কাউকে উঠে যেতে দেখা যায়নি। মানুষগুলোকে চিরস্থায়ী ভাস্কর্যের মতো দেখতে লাগছে। মাটির রাস্তাটা পেরোতে পেরোতে অমল মাঝে মাঝে আড়চোখে তাকাচ্ছে ওইদিকে। ব্যাপারটা এমন যে মনে হয় সেই প্রথমবার দেখা মানুষগুলোই এখনও সেখানে বসে আছে। আগেও অমল গুনে দেখেছে আট যোগ ছয়জন বসা ছিল।

বটগাছটা কাছে এসে পড়ায় এতক্ষণে মনে বেশ খুশি জেগে উঠল। ঘন ছায়ায় এবার ও যতক্ষণ ইচ্ছা বসে থাকতে পারবে। প্রতি শনিবার স্কুল চার পিরিয়ডে ছুটি হয়ে গেলে অমল এখানে এসে বসে থাকে। এই মাঠে ওই পায়খানার লোকগুলো ছাড়া অমল আর কাউকে কখনো দেখেনি। লোকালয়ের পিছন দিকে অবস্থিত বলে অথবা আশেপাশে পাকা রাস্তা না থাকার জন্য হয়তো এখানে কারো পা পড়ে না। এই কারণে ওর জন্য এখানে অপার স্বাধীনতা। যতক্ষণ ইচ্ছা থাকা যায়। কেউ বারণ করার নেই। কোনো মানুষই আসে না এখানে, কে বারণ করবে! বটগাছের কোটরের মধ্যে এভাবে বসে থেকে রোদে ছেয়ে থাকা মাঠের তিন দিকের সীমাহীন শূন্যতা দেখতে পাওয়ার মধ্যে যে-হাহাকার মেশানো আনন্দ আছে তা অমল এই বয়সে সবটা বুঝতে না পারলেও হয়তো কিছুটা বুঝতে পারে। না হলে ও এখানে আসে কেন!

আজকের আবহাওয়া অন্যান্য দিনের মতো নয়। হঠাৎ আসা মেঘলা ধূসর আবহাওয়াটা মাঠের রূপ দিয়েছে পালটিয়ে। অথচ একটু আগেই রোদ ওর চামড়া পুড়িয়ে দিচ্ছিল। ঠান্ডা এক আমেজ প্রবাহিত হাওয়াকণার মধ্যে প্রবেশ করে ওর দেহের ত্বকে এখন মুগ্ধতা জাগাচ্ছে। অনেকক্ষণ বসে থাকার পর অমলের ইচ্ছা করল মাঠটাকে একটু ঘুরে দেখার। অন্য দিন ও শুধু এখানে এসে বসে থাকত। যেহেতু অন্যান্য দিনের মতো আজ রোদের তেজ অত জোরালো নয়, তাই ভাবল ঘোরাই যায়! সারা মাঠের উপরে ধূসর কালো মেঘের ছায়া জমছে ধীরে ধীরে। এক সপ্তাহ পর অমল আজ এতটা খোলা জায়াগা দেখতে পাচ্ছে। ওর বাবার ওখানে এতই ঘিঞ্জি বাড়িঘর যে আকাশ দেখা যায় না।

কোন দিকে আগে যাবে বুঝতে না পেরে চোখ বরাবর হাঁটতে শুরু করে দিল। এদিকটা এবড়োখেবড়ো মাটি। উঁচুনীচু ঢিলে ভরতি। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। কিছুক্ষণ হাঁটার পর এবার অমল দাঁড়িয়ে পড়তে বাধ্য হল। এভাবে হাঁটার কোনো মানে হয়! অসাবধানে পা পড়লে মচকে যেতে পারে। কিন্তু মেঘলা আকাশের নীচে উদার মাঠের উপর দিয়ে একা একা এভাবে হাঁটার মধ্যে আনন্দও পাচ্ছে ও। মনের একাকিত্ব বাইরের একাকিত্বের সঙ্গে মিশে গিয়ে একধরনের বেদনা-মিশ্রিত আনন্দ তৈরি করছে।

বিরতির পর আবার শুরু করল হাঁটা। এবার বাঁ-দিক ধরল। যেদিকেই হাঁটে মাঠের অবস্থা একই। দিগন্ত অনেক দূরে! আবছা একটা দাগের মতো আকাশ আর মাটিকে কেটে রেখেছে।

এবার ডান দিকে ফিরল। এখানেও একরকম প্রকৃতি। যেদিকেই যাওয়া যায় কোনো পরিবর্তন নেই। শুধু যেদিক থেকে ও এসেছিল সেই দিকটা বাদে। সেদিকে গাছপালার অস্পষ্ট কালো ছায়া প্রাচীরের মতো আকাশের দিকে কিছুটা উঁচু হয়ে আছে। অমল হাঁটতে থাকল এবার দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে। আনন্দ যেন ওর হাত-পা হয়ে ছুটছে। কোথায় যাচ্ছে তার যদি কোনো গন্তব্য না থাকে তবে যেদিক খুশি চলা যায় এবং চলাটাই তখন মুখ্য হয়ে ওঠে। সেভাবে ক্লান্তিও যখন কাউকে আক্রান্ত করেনি তখন তো আর পিছু হটার কারণ নেই।

এইসময় বাঁ-হাতে ধরে থাকা বইখাতাগুলো নিয়ে অমল একটু অসুবিধায় পড়ল। তাছাড়া হাতের ঘাম লেগে লেগে ওগুলোর ধরে থাকার দিকটা নরম হয়ে যাচ্ছে। অমলের মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল। জামার নীচের দিকের দুটো বোতাম খুলে কোমরের সঙ্গে শক্ত করে বেঁধে নিল বেল্টের মতো করে। তারপর বুকের দিক থেকে বইখাতাগুলো একটা একটা করে সেখানে দিল চালান করে। এবার পেটের সামনে ভারী কিছু থাকার থলথলে অনুভূতি নিয়ে শুরু করল হাঁটা। পদ্ধতিটা তেমন স্বস্তির না হলেও হাতে ধরে রাখার চেয়ে সুবিধাজনক মনে হল।

এই দিকে হাঁটতে গিয়ে অমল একটা বাড়তি সুবিধা পেল তা হল বিপরীত দিক থেকে প্রবাহিত হচ্ছে মাঝারি গতির হাওয়া। ফলে দেহে আরামের সঞ্চার হচ্ছে। কতটা এসেছে কিছু বোঝা গেল না। দাঁড়িয়ে পড়ল। সামনে সোজাসুজি বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। মাঠের উপর ধূসর রঙের এবড়ো-খেবড়ো মাটির চাক ছাড়া কিছু দেখা যাচ্ছে না। দৃষ্টি ক্লান্ত হয়ে আসে বেশিক্ষণ তাকালে। তাও এই মুহূর্তে সামনে ক্ষীণ বৈচিত্র্যের আভাস দেখা যাচ্ছে মনে হল। কেমন যেন একটা অস্পষ্ট ধারণা হল অমলের, যে-জায়গাটায় ও এখন দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে সোজাসুজি একটা উঁচু ঢিবির মতো কিছু দেখা যাচ্ছে। যদিও খুবই আবছা দৃশ্যটা। ওর দৃষ্টিভ্রম কী! এই বৈচিত্র্যটুকুতে অবশ্য ওর মন সতেজ আর কৌতূহলোদ্দীপক হয়ে উঠেছে। নতুন উদ্যমে আবার ধেয়ে চলল গন্তব্যের অভিমুখে। সমস্যা হল যতই ও এগোচ্ছে গন্তব্য আর আসে না। হতোদ্যম না হয়ে এগিয়ে যাওয়াই মনস্থির করল। অদ্ভুত তো! মনে হচ্ছে ওর এগোনোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গন্তব্যও দূরে সরে সরে যাচ্ছে। অমল এবার দাঁড়িয়ে পড়ল। ও কি ভুল পথে যাচ্ছে! কোনো ভুলভুলাইয়ায় আক্রান্ত হল! বেলা এখন কত! মনে হয় মধ্য দুপুর। স্কুলের টিফিনে খাওয়া পাউরুটির টুকরোটা হজম হয়ে গেছে আগেই। এই অবস্থায় আরও এগোনো কি ঠিক হবে! ফিরতে দেরি হলে নতুন মা নিশ্চয় রাগ করবে। সেদিন তো কড়াভাবে বারণ করে দিয়েছিল যে, স্কুলের ছুটির পর যেন অন্য কোথাও না গিয়ে সোজা বাড়ি চলে যায়।

এইসব এলেবেলে ভাবনাগুলোকে গুরুত্ব না দিয়ে অমল এগিয়ে যাওয়াই সিদ্ধান্ত নিল। যেহেতু একটা গন্তব্যের সন্ধান পাওয়া গেছে, এতদূর এসে ফেরা যায় না। তার উপর একধরনের অ্যাডভেঞ্চারের আনন্দ ওকে দখল করে ফেলেছে। দ্রুত পা চালাল। চেষ্টা করল দ্বিগুণ বেগে হাঁটতে। অনেকক্ষণ হাঁটল গন্তব্যকে সামনে রেখে। হাঁটতে হাঁটতে এইবার ক্লান্তি যখন ওকে প্রায় পেড়ে ফেলেছে, চোখের বায়বীয় ধোঁয়াশার পর্দাটা ঘিরে ফেলেছে ওর চারদিকটা। হাঁটা তবু থামাল না।

অবশেষে ঢিবিটা স্পষ্ট হয়ে উঠল ওর চোখের পর্দায়। দাঁড়িয়ে জিরিয়ে নিল কিছুক্ষণ। এবং শ্বাস-প্রশ্বাস যখন স্বাভাবিক পথে যাওয়া-আসা করছে হঠাৎ অনুভব করল পেটের ভারটা আর নেই। জামার গিঁট খোলা। এখন কী হবে! পিছনের দিকে মাথা ঘোরাল। পিছনে বিস্তৃত ধোঁয়া ধোঁয়া মাঠ। তারপর তীব্র অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফেলে আসা পথটাকে ফালা ফালা করে খুঁজতে থাকল বইগুলো। অবশেষে বুঝতে পারল একই জায়গাতেই ও ঘুরেফিরে চলে এসেছে। এবং শূন্য হাতে। ঢিবিটার দিকে আর এগোবে কিনা মনস্থির করতে পারছে না। ক্লান্তি আর হতাশায় বসে পড়ল মাঠের মধ্যে। কান্নার দমক ওঠা বুকটাকে স্বাভাবিক রাখতে চেষ্টা করছে প্রাণপণে। কিন্তু অচেনা অজানার নিমন্ত্রণ কতক্ষণ সে উপেক্ষা করতে পারে, দেখাই যাক!

ততক্ষণে ওর পায়ের চঞ্চলতা মাঠে ঢলে পড়েছে। আবার শুরু করেছে হাঁটা। অবশ্যই সামনের দিকে। কিছুটা পথ এগিয়ে বোঝা গেল ঢিবি বলে এতক্ষণ যা ওর মনে হচ্ছিল আসলে তা বিরাট একটা টেবিলের মতো কিছু। মাটি বা পাথর দিয়ে তৈরি যে নয় তা অস্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে। আরও এগোতে থাকল অমল আবিষ্কারের মোহে। গতি এবার আগের থেকে দ্রুত। প্রায় কাছাকাছি গিয়ে দেখতে পেল পদার্থটা স্বচ্ছমতো কিছু। ভালো করে তাকালে ভিতরের কিছুদূর পর্যন্ত যেন চোখ চলে যাবে। হয়তো চেষ্টা করলে ভিতরে কোনো মানুষও ঢুকে যেতে পারে। আজই ক্লাসে স্যার মালভূমি বিষয়ে পড়াচ্ছিলেন। জায়গাটা একদম সেইরকমই দেখাচ্ছে। তবে এটা স্বচ্ছ পদার্থ দিয়ে তৈরি। বরফ, ধোঁয়া, জল বা মেঘের মতো কোনো কিছু দিয়ে তৈরি হয়ে থাকতে পারে। ঠিক কী উপাদানে এটা তৈরি অমল বুঝে উঠতে পারছে না। ভয় মেশানো মুগ্ধভাব নিয়ে ও অনেকটা সময় ধরে ঐ দিকে তাকিয়ে আছে।

আর কাছে যাওয়া ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছে না। আবার না গিয়েও পারা যাচ্ছে না। অন্য দিকে মনের মধ্যে বই হারানোর কষ্ট ওকে খুব বিব্রত করে রেখেছে। সত্যি বইগুলো কোথায় এমন উধাও হয়ে গেল! বইয়ের ভাবনা ভাবতে আর ওর ভালো লাগছে না। যা হবে দেখা যাবে। খুব ধীরে ধীরে ও এবার এগোচ্ছে এক পা দু-পা করে। ভয় ভয়ও করছে আবার বুকের মধ্যে। তবু সাহস আনার চেষ্টা করল। এভাবে খুব ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল আর একটু। হাত বাড়ালেই দেয়াল বা পর্দাটা ছোঁয়া যাবে এমন দূরত্বে এখন ও আছে।

অমলের চোখে এবার ভেসে উঠল চমৎকার একটা দৃশ্য। সেই স্বচ্ছতা ভেদ করে ফুটে উঠেছে একটা অবয়ব। সিনেমার পর্দায় ছবি ফুটে ওঠার মতো। ঠিক তাও না। কিছুটা আয়নার মতো। আবার অতি স্বচ্ছ আয়নাও না। আয়নায় জল লেগে থাকলে বা অল্প ধোঁয়াভরতি ঘরে দেয়ালজোড়া আয়না থাকলে যেমন দেখায় অনেকটা সেইরকম। অমল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে ছবিটাকে। ছবির মধ্যে আবার মৃদু মৃদু ঢেউও খেলে যাচ্ছে। সমুদ্রের পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকার মতো আরাম এখানে। কেউ যেন একটা বিরাট সমুদ্রকে চারকোনা করে কেটে বসিয়ে রেখেছে মাঠের মধ্যিখানে। ঠান্ডা একটা ভাব চারপাশটায় ছেয়ে আছে। যদিও কোনো শব্দ নেই এখানে। এতক্ষণ আসার সময় মাঠে যে-হাওয়া প্রবাহিত হচ্ছিল তাও এখন বন্ধ। অমল তাকিয়েই আছে মুগ্ধতা নিয়ে। ওর অঙ্গভঙ্গি চেহারা অবিকল ফুটে উঠেছে সেই পর্দায়।

এভাবে কতক্ষণ ও সেখানে দাঁড়িয়ে আছে ও মনে করতে পারছে না। খুবই আরামদায়ক আবহাওয়া। অনন্তকাল এখানে থেকে যেতে ইচ্ছা করছে অমলের। এখন ক-টা বাজে কাছে ঘড়ি না থাকার জন্য তা জানতেও পারছে না। বাড়ি ফেরার বাস কখন তাও ভুলে গেছে। স্বপ্নের কোনো দেশে হয়তো অমল চলে এসেছে। যেখানে বাস্তব জগতের কোনো স্মৃতিই আসে না।

ঠিক এইসময় অমল দেখল খুব ধীরে ধীরে একটা হাত বেরিয়ে এল সেই স্বচ্ছ আয়নার দেয়াল থেকে। অবিকল ওর হাতের মতো। রোগা শ্যামলা ধরনের। অবশ্যই হাতটা অমলেরই হওয়া উচিত। অমলও তাই ভাবছে। কিন্তু এখানে কিছুটা ব্যতিক্রম আছে। সেই হাতে ধরা একগুচ্ছ বই। বইগুলোর দিকে তাকিয়ে অমল বুঝতে পারল ওগুলো ওরই। রোবটের মতো স্বয়ংক্রিয়ভাবে অমল নিয়েও নিল হাত বাড়িয়ে। ভালোভাবে সেই অস্বচ্ছ আয়নার দিকে তাকিয়ে ও নিজের মুখের ছবি ছাড়া আর কিছুই যদিও দেখতে পেল না। কিন্তু যে-হাতটা বেরিয়ে এসে বইগুলো অমলকে দিল সেটা ওর নিজেরই হাত বলে এখন ও নিশ্চিত হতে পারছে না। আবার ওর এও মনে হল বইসমেত হাতটা যেন ওর পেটের নাড়িভুঁড়ির মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসে আবার ফিরে গেল সেখানেই। এমনভাবেই দৃশ্যটা সেই আয়নায় প্রতিফলিত হয়েছিল।

ফেরার পথটা আর সেরকম কষ্টদায়ক লাগল না অমলের। বাসে উঠে জায়গাও পেয়ে গেল জানলার কাছটাতে। কিন্তু বসতে ইচ্ছা করল না। শুধু মনের মধ্যে একটা জটিল ধাঁধা আরামদায়ক কষ্টের মতো বাসা করে থাকল।

Categories
2021-Utsob-Story

বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায়

মাদল

ছোটো ছোটো টিলা। শালের জঙ্গল। মাঝে মাঝে ফাঁকা মাঠ। জায়গাটা ভালো লেগে গেল গৌতমের। মুখে অবশ্য ও প্রকাশ করল না।

‘একেবারে অজ জঙ্গুলে অঞ্চল। হু! গাড়ি খারাপ হওয়ারও আর জায়গা পেল না।’

বিরক্তি প্রকাশ করলেন পাল সাহেব, ওর চামচিকে-বস্।

অন্য সময় হলে ও পাল সাহেবের কথায় সঙ্গে সঙ্গেই সায় দিত। ও তাই করে থাকে, একটু আগেও গাড়িতে তাই করেছে। কিন্তু এখন কেন যেন, এতদিনের অভ্যাসটাকে ও হঠাৎ কাটিয়ে উঠল। মনে মনে একটা তাচ্ছিল্যের ভাব নিয়ে তাকিয়ে রইল একটা ঝাঁকড়া মতো গাছের দিকে। মউল গাছ। পাকা মউলের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসে। আঃ! জোরে জোরে ফুসফুসভরতি করে হাওয়া টেনে নিল সে। ভুরু কুঁচকে ওর দিকে তাকালেন পাল সাহেব। পরক্ষণেই হাতের ঘড়িটা দেখলেন। ‘দেরি হয়ে যাবে’— ব্যস্তভাবে পায়চারী করলেন কিছুক্ষণ। তারপর হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন— ‘দত্ত সাহেবের চিঠিটা সঙ্গে আছে তো?’

‘হ্যাঁ’— অনিচ্ছা সত্ত্বেও জবাব দিল ও। বোধহয় এই প্রথম ও হ্যাঁ শব্দটার পরে ‘সাহেব’ কথাটা যোগ করল না। এরা সবসময় পরস্পর পরস্পরকে সাহেব বলে সম্বোধন করে কেন কে জানে? পরস্পরকে সম্মান দেখানোর জন্য? কই, সম্মান দেখানোর জন্য তো রবি ঠাকুরকে কেউ রবি সাহেব বলে না! চোখ ফেরাতেই দেখে লোকটা ওর দিকে তাকিয়ে আছে…

পরক্ষণেই, ও দেখল, ঝরনার মতো কল কল করতে করতে বাঁ-দিকের শালের জঙ্গলটার মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসছে তিনটি সাঁওতাল ছেলেমেয়ে। দু-টি মেয়ে একটি ছেলে। যুবকটির গলায় একটা মাদল ঝুলছে। এলোপাথাড়ি তাল দিচ্ছে মাঝে মাঝে। ওর সঙ্গী মেয়েটির হাতে মস্ত বড়ো কাঁসার একটা খঞ্জনীর মতো ঝাঁই। বাজাচ্ছে ঝম ঝম করে। আর সব চাইতে ছোটো মেয়েটি— প্রায় তরুণীই বলা যায়— তার হাতে কিছু নেই। পায়ে মল ঝুম ঝুম করে বাজিয়ে কাছে এসেই হাসি হাসি মুখে হাঁ করে তাকিয়ে রইল গৌতমের দিকে। মানুষটাকে ওর ভালো লেগেছে— এই সহজ কথাটা লুকোনোর কোনো চেষ্টাই নেই। হঠাৎ মেয়েটার খিল খিল হাসিতে গৌতমের চমক ভাঙল।

‘এ্যাই!’ পাল সাহের কর্কশ গলায় বললেন, ‘শহর এখান থেকে কত দূর?

যুবকটি সামনের দিকে আঙুল তুলে জবাব দিল, ‘হুঈ… দশ ক্রোশ হবেক।’

‘আর তোমাদের গ্রাম?’— দ্বিতীয় প্রশ্নটা গৌতমের। মেয়েটির উদ্দেশে।

‘উই তো বটে’ আবার খিল খিল করে হেসে মেয়েটি আঙুল দেখাল সামনের শালকুঞ্জের দিকে। কিন্তু কোনো গ্রাম নজরে পড়ল না গৌতমের।

‘আমাকে নিয়ে যাবে তোমাদের গ্রামে?’, গৌতম জিজ্ঞাসা করে। অমনি খিল খিল করে হাসির ঝরনা গড়িয়ে গেল।

‘চল কেনে? যাবি?’— হেসে জবাব দিল ছেলেটি। তার কথায় স্পষ্ট আমন্ত্রণের সুর।

ঘর র র…

গাড়িটা স্টার্ট নিয়েছে আবার।
‘ঠিক হয়ে গেছে সাব’— ইঞ্জিনের ঢাকনাটা বন্ধ করে হাতের তেল কালি মুছতে মুছতে জানাল ড্রাইভার তেওয়ারি।

‘হয়ে গেছে! যাক।’— হাঁফ ছেড়ে পাল সাহেব বললেন, ‘নাও, চল চল গৌতম। উঠে পড়। অনেক দেরি হয়ে গেছে।’

গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল গৌতম। দরজটা খুলে ওর কীটস ব্যাগটা নামিয়ে আনল। তারপর হেসে বলল, ‘না স্যার খুব একটা দেরি এখনও হয়নি। ভাগ্যকে ধন্যবাদ।’

‘এ কী, তুমি কোথায় চললে?’— পাল সাহেব এবার বুঝি রাগে ফেটে পড়বেন।

‘চললাম জীবনের খোঁজে’— ‘ননসেন্স! একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে যাচ্ছি, এ সময়ে…’

‘আমি তার চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ কাজে যাচ্ছি’— ওঁকে পাত্তা না দিয়ে বলে ওঠে গৌতম। ততক্ষণে রাস্তা ছেড়ে মাঠে নেমেছে সে।

‘তুমি কি পাগল হলে গৌতম!’— রমেশ পাল হাতাশ কণ্ঠে বললেন— ‘এর জন্যে তোমার চাকরি যাবে, তা জানো?’

‘জানি’— গৌতম হাসি হাসি মুখে ঘুরে দাঁড়াল। ‘চাকরিতে আমার আর প্রয়োজন নেই। ছেড়ে দিলাম।’

‘ছেড়ে দিলে!’— পাল সাহেব ফ্যাল ফ্যাল করে তাকালেন। ‘কিন্তু তোমার চাকরি ছাড়া…’

‘প্রয়োজন নেই। বাকি জীবনটা এদের সঙ্গেই কাটিয়ে দেব’—

পা বাড়ালো সে। জ্যোৎস্নার মাঠ পেরিয়ে মউলের ছায়া থেকে সাঁওতালী গাঁয়ের দিকে এগিয়ে গেল গৌতম। যেদিকে জীবন, যেদিকে মুক্তি…

পরদিন একটু বেলায় যখন ঘুম ভাঙল ওর, মাথার মধ্যে তখনও ভারী হয়ে আছে কাল রাতের মহুয়ার নেশার রেশটুকু।

স্নিগ্ধ নিঃশব্দ সকাল। আশে পাশে কেউ নেই। মেয়েটাকেও দেখতে পেলনা সে। বোধ হয় দল বেঁধে কাজে গেছে।

বুকের নীচে ছোট্ট একটা মোচড় অনুভব করল সে, কিন্তু সেটা সুখের না বেদনার তা ঠিক বুঝতে পারল না। মাটির ঘর। তকতকে নিকোনো মেঝে। একটা শেতলপাটির ওপর শুয়ে আছে ও। মাথার কাছে ছোট্ট জানলা দিয়ে আকাশ দেখা যাচ্ছে। জানলার একপাশে জলের সরাই একটা—

ঘরে আর কিছু নেই।

যেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। যেন আরও কিছু থাকলে ভাল হত। আরও কিছু প্রয়োজন ছিল ওর। মাথার নীচে কীটস ব্যাগটার ওপর সস্নেহে হাত বোলালো সে। তারপর হঠাৎ ধড়মড় করে উঠে বসে কবজির ঘড়িটা দেখল। বেলা আটটা দশ। পথ দশ ক্রোশ…

হাইওয়ে থেকে বাস ধরতে পারলে—

‘এখনো সময় আছে’— বিড় বিড় করে কথাগুলো উচ্চারণ করল সে।

তারপর উঠে দাঁড়াল তার কীটস ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে।

বার্নিশ করা একটা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ঘামছিল গৌতম। ধিতাং ধিতাং ধিনতা ধিতাং— ক্রমশই তার বুকের মধ্যে স্পষ্ট হচ্ছে কাল রাতের মাদলের শব্দটা। কাঁপা হাতে হাতলটা ঘুরিয়ে মাথাটা আস্তে আস্তে ঘরের মধ্যে মাথাটা ঢুকিয়ে দিল সে। ধরা গলায় প্রশ্ন করল, ‘আসব স্যার?…’

Categories
2021-Utsob-Story

রাণা রায়চৌধুরী

সীমান্ত এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয়

চীনের সৈন্য আবার ভারতীয় ভূখণ্ডে ঢুকে পড়েছে।

চীনের মেঘ-বাতাস-আলো, ভারতীয় ভূখণ্ডে ঢুকে পড়ে। তাই না? আর সৈন্যগুলোর জন্য সত্যি খারাপ লাগে। বাড়িতে বউ-বাচ্চা-বোন-বউদি এসব আছে, কিন্তু বেটারা ভারতীয় ভূখণ্ডে ঢুকে মুততে আসে, বিড়ি ফুঁকতে আসে। আসলে কৌশিক শ্যামল বিড়ি ওদের ওখানে পাওয়া যায় না। এই নতুন একটা বিড়ি বেরিয়েছে জানিস?

কী বিড়ি?

পদ্মা বিড়ি।

শিবু ‘পদ্মা বিড়ি’ বলতেই— দেবুর পদ্মাদির কথা মনে পড়ল। আর পদ্মাদির কথা মনে পড়তেই কাছেই কোথাও খুব জোরে বাজ পড়ল। বাজ পড়ার আলোয় দু-জনেই বেশ আলোকিত হয়ে উঠল। এই আলোয় ভাসা আসলে ভয়ের আলোয় ভাসা। ভয়! ভয়েরও আলো আছে, কাছেই আছে সে।

চীনের সৈন্য এবার লাল সুতোর বিড়ি খুঁজতে ঢুকে পড়েছে ভারতীয় ভূখণ্ডে। দেবুর দাঁতের ফাঁকে লাল সুতোর বিড়ি। শিবু সুপ্রিম বিড়ি টানছে। দেবু হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, এই শিবু ভূখণ্ড মানে কী? ভারতীয় ভূখণ্ড? শিবু সুপ্রিম টানছে। ভাবখানা এমন যেন, সুপ্রিম কোর্ট টানছে, ধোঁয়া। শিবু দূরের মাঠ, বর্ডার দেখছে। ওপারে বাংলাদেশ। রাজশাহী। দেবু বলল, না না ওপারে চীন! ওপারে উগান্ডা! ভেবে নে। শিবু ভেবে নিল, ওপারে চীন। ওপারে ওপার আছে, এপারে এপার আছে। সুপ্রিম বিড়ির ধোঁয়া আকাশের দিকে যাচ্ছে।

শিবু দেবুকে দেখাল, ঐ দেখ ভূখণ্ড। বাংলাদেশ ভূখণ্ড। ওইরকম তোর মনেও একটা ভূখণ্ড আছে। আমার মনেও একটা দুক্কু দুক্কু ভূখণ্ড। আমার মা-টা অকালে মরে গেল রে! দেবু শিবুর কথা শুনছে, আবার শুনছেও না। দেবু তারকাঁটার ওপারের ভূখণ্ড দেখছে। পায়ের নীচে তাকাল সে। একই ভূখণ্ড। মাটি। মাটিতে দেবু দেশলাই কাঠি দিয়ে একটা লম্বা দাগ দিল। সে দাগের এইপার ওইপার দেখতে লাগল।

***

ইনডিকেটর দেখাচ্ছে স্ট্রংগ সেল। অর্থাৎ, পুট অপশনে খেলতে হবে। স্ট্রংগ বাই দেখালে বাই অপশনে খেলতে হবে। নান্টু নিফটির ওঠা-নামা দেখছে। এই ওঠা-নামা দেখতে তার ভালো লাগে। জীবনের ওঠা-নামা। আজ বাজার হাই ভোলাটাইল। অস্থির। সে নিজের মধ্যেও অস্থিরতা টের পায়। কাল রাতের রাম-এর হ্যাঙ্গওভার এখনও কাটেনি। রাম! হাসে নান্টু। নিজের মনে বলে— কোন রাম? নিজেই উত্তর দেয় থ্রি এক্স! থ্রি এক্স রাম যেমন হয়, তেমন থ্রি এক্স পানু ছবিও হয়। নিফটি নামছে— নিফটি সামান্য ওপরে উঠল— এখন নান্টুর পজিশনে প্রফিট কমে আড়াইশো। ওয়েট করলে নিফটি নামবে, নান্টুর প্রফিট বাড়বে। নান্টু স্টপলস দিল। লসকে স্টপ করার জন্য সাবধানতা। নিফটি স্টপলস ক্রস করে গেল, ঘুড়ি কেটে গেল। নান্টুর সাড়ে সাতশো লস হল। দেবু আর শিবু হাঁপাতে হাঁপাতে নান্টুর ঘরে ঢুকল। দেবু বলল, ওপারের মেঘ এপারে চলে এসেছে।

নিফটি ওপরে উঠে আবার নীচের দিকে নামতে লাগল। নান্টু ভাবল স্টপলস না দিলেই ভালো হত। তাহলে আর তার ঘুড়ি কাটত না। নান্টু হতাশ। দেবু আর শিবু দাঁড়িয়ে আছে হতাশ নান্টুর মোবাইলের দিকে তাকিয়ে। নান্টু মোবাইল থেকে মাথা তুলে বলল, ওপারের মেঘ এপারে এসেছে? এসেছে তো এসেছে, মেঘ তো এদিক ওদিক করবেই। লাল্টুদাকে দেখ, একবার পদ্ম একবার শিউলি আবার পদ্ম আবার শিউলি। আমরা নিজেরাই খেই পাচ্ছি না, কোন ফুলে বসে মধু খাব। লাল্টুদা যেদিকে আমরাও সেদিকে। লাল্টুদা খালি মঞ্চে উঠে পতাকা বদল করে, ফুল বদল করে।

নান্টু আবার মোবাইলের দিকে তাকায়। নিফটি ওঠা-নামা করছে। নান্টুও তার সঙ্গে উঠছে নামছে। ভোলাটিলিটি জীবনজুড়েই।

দেবু শিবু মেঘের এপারে আসা ভুলে গেছে। ওরা বর্ডারে গাড়ি পাস করাচ্ছিল, কিছু ইনকাম হয়। বিএসএফ ওদের চা বিড়ি সিগারেট দেয়। ওরা লরি ট্রাকের লাইন কন্ট্রোল করে। বিএসএফ মাঝে মাঝে এঁটো ইংলিশও দেয় ওদের, আধখাওয়া। নান্টু নিফটির অনাত্মীয়ের মতো ব্যবহারে খুব দুঃখিত। নান্টু দেবুকে বলে, ‘রাম খাবি! রাম! জয় শিয়া রাম খাবি?’ দেবুর দিনের বেলায় মাল খেতে ভালো লাগে। শিবু মদ খায় না, শিবু গাঁজা, গঞ্জিকা। নান্টু বিল্লাকে ফোন করে। বিল্লা গলির মধ্যে অবৈধ ইংলিশ বিক্রি করে। বিল্লা একটা ছেলেকে দিয়ে আধঘণ্টা বাদে মাল পাঠায়। নান্টুর পাশের ঘরে প্যারালাইসিসে শুয়ে থাকা অসুস্থ মা। ঘুমোচ্ছে।

সীতা ছাড়াই রাম এসে গেছে, এখন বেলা এগারোটা। বাইরে চড়া রোদ। বাইরে চৈত্র মাস। গরম। আকাশে পাখি নেই, পাখিগুলো গরমে ডানা গুটিয়ে কোন কবেকার গাছের পাতার আড়ালে লুকিয়ে আছে। ঘরে ঘ্যারঘ্যার আওয়াজে ফ্যান চলছে, আস্তে। ফ্যানের থেকে একটা মাকড়সা ঝুলসমেত ঝুলে আছে। ফ্যান ঘুরছে, মাকড়সাও ঘুরছে। মাকড়সার দিকে তাকিয়ে ছিল শিবু, মাকড়সা ঘোরার সঙ্গে সঙ্গে শিবুর চোখ মাথাও ঘুরতে থাকে, অল্প মৃদু। গাঁজা না খেলেও, মাকড়সা আর ফ্যানের সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে তার অল্প নেশা নেশা মতন মনে হয়। তার মনে হয় এ-জীবন সুন্দর। এই অল্প পয়সা, এই একই ময়লা চোস্ত প্যান্ট, সান্যাল স্যারের মেয়েকে দেখা, আহা জীবন সুন্দর! মাকড়সাটা ঝুপ করে ফ্যান থেকে শিবুর গায়ে খসে পড়ল। শিবু, নিষ্পাপ শিবু হয়ে গেল।

শিবুর এখন আটটা পা। শিবু এখন লালা দিয়ে জাল বুনতে পারে। শিবুর জালে পোকা পতঙ্গের সঙ্গে সান্যাল স্যারের মেয়েও আটকে যাবে, যেতে পারে কোনোদিন হয়তো, সেদিন হয়তো মাঘের সকাল হতে পারে, সেদিন হয়তো আষাঢ়ের দুপুর হতে পারে। শিবুর জাল স্বপ্ন বোনে…

নান্টু আর দেবুর ভালো ধরেছে। নান্টুর নেশা ধরলে বকবক করে না, ঝিম মেরে থাকে। অনেক পুরোনো হাসিঠাট্টাগুলো স্মৃতিগুলো পুরোনো প্রাচীন গানগুলো নৌকো বেয়ে আকাশের নীল বেয়ে তার মনের কিনারে ঠেকে। ধাক্কা মারে। নান্টু বুঁদ হয়ে সেই পুরোনো প্রাচীন হাসিঠাট্টা প্রাচীন চোখের জলেদের সঙ্গে দাবা খেলে মনে মনে। ওদিকে দেবু গুনগুন গান গায়। পকেট থেকে কুচো পয়সা বের করে গোনে। কড় গুনে গুনে কড় গুনতে গুনতে সে বহুদূর চলে যায়, বর্ডার পার হয়ে অন্য দেশে চলে যায়। ফিরে আসে।

‘কান্দো কেনে মন পাগলা রে কান্দিয়া কান্দিয়া যাইব তোমারও জীবন রে কান্দো কেনে মন পাগলা রে’— নান্টুর ভেতরটা কাঁদছে। কেন ভেতর কান্দে তার, নান্টু জানে না। ভেতরটা কান্নার জলে ভিজে যাচ্ছে। ভেতরের মাঝি ভাটিয়ালি গাইছে, আর বাইছে তাকে— ‘কান্দো কেনে মন পাগলা রে কান্দিয়া কান্দিয়া যাইব তোমারও জীবন রে কান্দো কেনে মন…’ ওদিকে নান্টুর চোখের জল নিয়েই নিফটি ওপর-নীচ করছে…

ওদিকে শিবু-মাকড়সার জাল বাড়তে বাড়তে বিস্তার পাচ্ছে। জালে কীটপতঙ্গের সঙ্গে সান্যাল স্যারের অন্ধ মেয়ে, জালে আস্তে ধীরে— নদী পুকুর আকাশ মাটি, শিবুর বিপত্নীক বাবা— দিদি, জালে বর্ডারের কাঁটাতার— জালে এপার ওপার আটকে যাচ্ছে।

শিবু জাল বুনতে বুনতে এগোচ্ছে। কিন্তু শিবুর জাল নান্টু দেবু কেউ দেখতে পাচ্ছে না। শিবু নিজেও জালে জড়িয়ে যাচ্ছে, জালে তার আট পা আটকে হুমড়ি খেয়ে পড়ল এক অজানা নিরুদ্দেশের মাটিতে, কাদায়। শিবু কোথায় এখন সে জানে না। মাথার ওপরের ঘড়ঘড়ে বিশ্রী শব্দের ফ্যানটা আর নেই। শিবুর মাথার ওপর তার নিজের লালায় বোনা জাল, পায়ের তলায় জাল, তার নিঃশ্বাস প্রশ্বাসে জাল দুলছে, জগৎ দুলছে।

স্যানাল স্যারের অন্ধ মেয়েকে মনে পড়ে তার। মেয়েটি হাতড়ে হাতড়ে এগোয়, হাতড়ে হাতড়ে মা বাবার স্নেহ আদরকে কাছে টেনে আনে, হাতড়ে হাতড়ে ছাদে গিয়ে আকাশকে কল্পনা করে। শিবু দেখেছে মেয়েটির আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা। আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে, কিন্তু আকাশকে দেখতে পাচ্ছে না অন্ধ মেয়েটি। শিবুর মনে হয়েছিল, নিজের চোখদুটো সান্যাল স্যারের মেয়েকে কিছুক্ষণের জন্য দিয়ে দেয়। কিছুক্ষণের জন্য তো মেয়েটি আকাশ দেখতে পারবে! শিবু মনে মনে নীচ থেকে নিজের চোখদুটো খুলে, ছাদে মেয়েটির দিকে ছুড়ে দিয়েছিল, শিবুর চোখদুটো পাখির মতো ডানা মেলে অন্ধ মেয়েটির চোখের পাপড়িতে গিয়ে বসল। আকাশ ধীরে ধীরে অন্ধ মেয়ের কাছে এগিয়ে আসতে লাগল।

নান্টু নিফটির ওঠা-নামা বন্ধ করে, বা নিফটিকে থামিয়ে স্যুইচড অফ মোবাইলকে বিছানার দিকে ছুড়ে দিল। ইউটিউব-নিফটি-হোয়াট্‌সঅ্যাপ এইসব বুকে নিয়ে নান্টুর মোবাইল ড্রপ খেতে খেতে বিছানার কোণের দিকে গিয়ে আটকে গেল। মোবাইলের হার্টবিট এখন বন্ধ। নান্টুই শ্বাসরোধ করে ফোনের হার্টবিট বন্ধ করে দিয়েছে। নেশা দেবু নান্টু দু-জনেরই একেবারে চূড়ায়। চূড়ায় উঠতে সবাই চায়। দেবু নান্টুও চেয়েছিল, দু-জনে উঠেছে চূড়ায়। মোবাইল ফোনটাকে ওইভাবে গায়ের জোরে শ্বাসরোধ করার জন্য নান্টুর নিজেকে এখন খুনি মনে হচ্ছে। মার্ডারার মনে হচ্ছে নিজেকে। খুনের আসামী। নান্টু চোখ মেলতে পারছে না। তার ঘুম পাচ্ছে। পাশের ঘরের স্তব্ধতা হঠাৎ টিকটিক করে ডেকে উঠল। নান্টুর খেয়াল হল, মা ঘুমোচ্ছে অনেকক্ষণ, কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে নান্টু চূড়া থেকে নেমে এল, পাশের ঘরে গিয়ে দেখল, মা তখনও ঘুমোচ্ছে। নান্টু মায়ের ঘর থেকে বেরিয়ে এল। ওপর দিকে তাকাল, ওপর দিকে চূড়ায় দেবুও উঠেছে।

দেবু চূড়া থেকে বর্ডার কন্ট্রোল করছে। এপারের লোক ওপারের লোক, এপারের ভাষা ওপারের ভাষা, এপারের নদী ওপারের নদী— দেবু এই এপার-ওপার কন্ট্রোল করছে। দেবু চূড়ার মাথায় খুব ব্যস্ত। তার মাথার ওপর দিয়ে পাখি এরোপ্লেন উড়ে যাচ্ছে। মেঘ উড়ে যাচ্ছে। দেবুও মাঝে মাঝে চূড়ার সিংহাসন ছেড়ে উড়ে যাচ্ছে এদিক-ওদিক, এধার-সেধার। উড়তে উড়তে দূর থেকে দেবু দেখল ছাদে সান্যাল স্যারের অন্ধ মেয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ঘুড়ির লাট খাওয়া ঘুড়ির প্যাঁচ খেলা দেখছে। কী করে দেখছে? মেয়েটা তো চোখে দেখে না! দেবুর নেশা কেটে আবার জুড়ে গেল। দেবু দেখল সান্যাল স্যারের বাড়ির নীচে শিবু দাঁড়ানো, শিবু আট-পা নিয়ে জাল ছড়াচ্ছে— জালে অন্ধ মেয়েটির চোখ দুটো ভাসছে, সাঁতার কাটছে…

***

নান্টু অনেকক্ষণ বাদে আবার মায়ের ঘরে ঢুকে ‘মা মা’ বলে মাকে ডাকল। মা ঘুমোচ্ছে। অনেকক্ষণ ধরে। নান্টু তার মাকে অনেক দূর থেকে ডাকছে। মা শুনতে পাচ্ছে না। আগের যুগ বা তারও আগের যুগ বা হয়তো তার ঠাকুরদার সময় থেকে কিংবা তারও আগের সময়ে দাঁড়িয়ে নান্টু তার মাকে ডাকছে। মাআআ মাআআআআ।

মায়েরা সারাদিন খাটাখাটনির পর সংসারের সব দায়িত্ব পালনের পর ঘুমোলে কারোর ডাক শুনতে পায় না। নান্টুর মাও নান্টুর মা মা ডাক শুনতে পেল না বা পাচ্ছে না। নান্টু তার ঘুমন্ত মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে কী করবে বুঝতে পারছে না!— এরকম অসহায় অবস্থায় সে দাঁড়িয়ে আছে অনেকক্ষণ। আর ভাবছে যে, এখন তো নিফটি সেনসেক্স মার্কেট বন্ধ! মার্কেটের শব্দ— বাজারের অশ্লীল চিৎকার— লোভের চিৎকার— তো এখন নেই! চারিদিক সব চুপ, শান্ত চারিদিক— মায়াবী! তবু নান্টুর মা নান্টুর ডাক শুনতে পাচ্ছে না!

নান্টুর শ্বাসরোধ করে বন্ধ করা মোবাইল ফোনটা তখনও বিছানায় মৃত অবস্থায় পড়ে আছে অথবা ঘুমিয়ে আছে অথবা লাশের ভূমিকায় অভিনয় করছে। নান্টু একবার মায়ের দিকে একবার মোবাইল ফোনের লাশের দিকে তাকাচ্ছে। মোবাইল ফোন বন্ধ। এখন মার্কেট বন্ধ। নান্টুর নিজেকেও বন্ধ কারখানা বন্ধ ঘড়ি বন্ধ টিকটিকি এইসব মনে হয়।

বর্ডারে অনেকদিন বাদে চীনের কয়েকজন সৈন্য এসেছে এপারে চা খেতে, এপারের ভারতীয় বন্ধু সৈনিকদেরকেও দেখতে, গল্প করতে। একসঙ্গে চা খেতে বেকারি বিস্কুট খেতে কৌশিক-বিড়ি লাল-সুতোর বিড়ি খেতে…

বিষ্ণুদার দোকানে চীন-ভারতের তরুণ সৈনিকরা চা খাচ্ছে, হা হা হাসছে। কাঁটাতারের ওপরে নীল আকাশ। দু-একটা পাখি উড়ছে কাঁটাতারের এপারে ওপারে। কাঁটাতারের কাছের গ্রামেই একমাত্র শ্মশান! সীমান্ত ঘেঁষা এই জায়গাটা বা গ্রামটার নাম সুন্দরপুর। সুন্দরপুরের পাশের গ্রাম গোলাপতলাতেই শ্মশান! চীনের সৈন্যরা ভারতীয় কোনো শ্মশান একবার দেখেছিল। ভারতীয় শ্মশান দেখে স্বভাবতই তাদের মন খুব খারাপ হয়েছিল, তাদের মনে উদাসী এক পাখি বাসা বেঁধেছিল।

এটা চৈত্র মাস। বাইরে ভয়ংকর গরম। রোদ অঝোরধারায় বৃষ্টির মতো ঝরছে। রোদ ঠিক নয়, আগুনের বড়ো বড়ো ফোঁটা পড়ছে, মাটিতে পিচের রাস্তায়, জলে, পুকুরে নদীতে গাছের পাতায়— চৈত্র আগুনের ফোঁটা হয়ে ঝরছে— সেই আগুনের ভিতর দিয়েই নান্টু দেবু আর আট পায়ের দৃষ্টিহীন শিবু চলেছে গোলাপতলার শ্মশানে। শিবুর অক্ষিকোটরে অক্ষি নাই, তার অক্ষি— তার নয়ন— সান্যাল স্যারের অন্ধ মেয়েকে সে দিয়েছে আগেই। সান্যাল স্যারের মেয়ে এখন শিবুর চোখ দিয়ে শোককে দেখতে পায়। শোককে দুঃখকে সে-মেয়ে আগে চাক্ষুষ দেখেনি কখনো। এখন শোক দুঃখকে দেখতে পায় সে।

সান্যাল স্যারের সেই মেয়ে দেবযানী, সেও নান্টু দেবু শিবুদের পিছন পিছন, এই প্রথম শ্মশান দেখতে চলেছে। মানুষের দেহের শেষ পরিণতি কীভাবে অগ্নিতে মিলায় তা দেখতে। সে, দেবযানী, সান্যাল স্যারের মেয়ে ওদের পিছু পিছু যাচ্ছে শ্মশানের দিকে। শিবু অবশ্য দেখতে পাবে না শ্মশান, শ্মশানের দাহ, চিতার আগুন। না দেখে অনুভব করতে পারবে। শিবুর চোখহীন কোটর দিয়ে জল গড়াবে, এতেই শিবুর শান্তি। দেবযানীর গায়ের গন্ধ সে পাচ্ছে বাতাসে পথের ধুলোয়।

চৈত্র ঝরছে। চৈত্র ঝরার কোনো বিরাম নেই। নান্টুর মায়ের শবদেহ ওদের সামনে সামনে বয়ে নিয়ে চলেছে ভারতীয় সৈন্যদের সঙ্গে চীনের সৈন্যরাও। মা! মা মারা গেছে। নান্টুর মা। একজন ভারতীয়র মা। এটা যখন চীনের সৈন্যরা বুঝল তাদের চোখও অল্প ঈষৎ অশ্রুতে ভিজে কি যায়নি! তারা এই প্রথম কোনো ভারতীয় নারীর, ভারতীয় মায়ের দেহ বয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

শব বাহনের কাজে তারাও এগোচ্ছে ভারতীয় সেনাদের সঙ্গে গোলাপতলার শ্মশানের দিকে!

আকাশ পরিষ্কার নীল। মেঘ নেই, পাখি দু-একটা নিরুদ্দেশের পথে উড়ে যাচ্ছে। শোক টপকে দুঃখ টপকে তারা ডানা মেলে উড়ে যাচ্ছে… শ্মশান কাছেই… সীমান্তও এখান থেকে খুব দূরে নয়…

হঠাৎই সামনের শববাহকদের কাঁধে কাঁধে যাওয়া ‘মা’-কে নান্টু ‘মাআআআ’ বলে ডেকে উঠল। কিন্তু নান্টুর মা চুপ। নান্টুর মা, ভারত-চীন সৈন্যদের মৃত মাসিমা, নান্টুর ডাকে কোনো সাড়া দিলেন না। তিনি ঘুমোচ্ছেন। পৃথিবীর সব মায়েরা সংসারের সব কাজ সেরে যখন ঘুমোতে যান, তখন কেউ তাঁদের ডাকলে তাঁরা সেই ডাক শুনতে পান না। তাঁরা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে সংসার থেকে কিছুক্ষণের জন্য তখন দূরে চলে যান।

ফলে নান্টুর মা ঘুমোচ্ছেন। ভারত-চীন সৈনিকদের মা ঘুমোচ্ছেন। তাঁর ঘুমের যাতে ব্যাঘাত না হয়, তাই তারা চুপে, নিঃশব্দে শ্মশানের দিকে হেঁটে চলেছে।

সীমান্ত এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয়। শোকে সীমান্তের কাঁটাতারেও দোল লাগছে, একটা দুটো তিনটে স্তব্ধতা, নিঃশব্দ বাতাসের তানপুরা বাজাচ্ছে কেউ, যেন নান্টু দেবু শিবুদের নতুন উদ্যমের শুরু হল এই, এইখান থেকে…

Categories
2021-Utsob-Story

পাপড়ি রহমান

উত্তর শিথানের গাছ

মাটি বড়ো নিষ্ঠুর— গোরস্থানের সমতল ভূমির দিকে তাকিয়ে এমনভাবে সে। যারা চলে গেছে তাদের চিহ্ন কিংবা নাম নিশানাও মাটি ধরে রাখে না। কেউ মরে যাওয়ার পর, দিন কয়েক একটা ছোটো উঁচু ঢিবির মতো দেখা যায়। ক্রমে ঝড়-বিষ্টি-বাদলায়, রোদ্দুরে নাকি লু-হাওয়ায়, নাকি বৃক্ষের পাতা ঝরতে ঝরতে অথবা বাউকুড়ানির খপ্পড়ে পড়ে কিংবা হেঁটে যাওয়া পাখি অথবা মানুষের পায়ের ভরে ওই ঢিবি নীচু হতে থাকে। নীচু হতে হতে একসময় মিলিয়ে যায়। তখন বুঝাই মুশকিল ওইখানে কারো গোর ছিল কি ছিল না? গোর ছিল নাকি ছোটো কোনো টিলা ছিল? নাকি কিছুই ছিল না? কোনো কিছুই আর বোঝার উপায় থাকে না।

মাটির কী এমন ঠেকা? কীসের এত দায় তার— সে কেন প্রতিটা মৃত-মানুষের নামধাম কিংবা কবরের নিশানা মনে রাখবে?— আমিনুল এরকম ভাবে। এইসব দায় মানুষেরই হওয়া উচিত। তারাই নিজ গরজে কবরে কবরে নামফলক লাগিয়ে দিক। কবর বাঁধিয়ে দিক। মন চাইলে শ্বেতপাথর দিয়ে বাঁধিয়ে দিক। নিজেদের সমাধিও তারা আগেভাগেই কারুকার্যমণ্ডিত করে রেখে যেতে পারে। সম্রাট শাহজাহান তো তাই করেছিল। মমতাজের নাম করে বানানো তাজমহলে সে আদতে নিজের শেষ বিশ্রামের জায়গা ঠিক করে রেখেছিল। নিজের নামে আগেভাগেই ওরকম সমাধি বানিয়ে রাখলে একটু কীরকম কীরকম দেখায় না? আদতে মমতাজ মহলকে সামনে ঠেলে দিয়ে শাহজাহানের গুপ্ত-ইচ্ছা ছিল ওই জাঁকের-গোর বানানো।

ইউনিভার্সিটির এক্সকারশনে আগ্রায় গিয়ে স্বচক্ষে এমনই তো দেখেছিল আমিনুল। মমতাজের পাশে সম্রাট শাহজাহান শুয়ে আছেন। দুইজন একে অপরের নিবিড় স্পর্শের দূরত্বে শুয়ে আছেন। যেন-বা কত যুগ ধরে গভীর ঘুমে নিমগ্ন তাঁরা! আর কোনো ছাড়াছাড়ি হওয়ার সম্ভাবনা তাঁদের নাই, আর কোনো বিরহবেদনা নাই! ফলত তাঁদের জন্য শচীন কর্তার সেই গানেরও আর প্রয়োজন নাই—
ভালো লাগে/বিরহ বড়ো ভালো লাগে/বিরহের সোহাগিনী রহে মনের ঘরেতে/

তাজমহলের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া যমুনায় আর নাই আগের সেই ছলাচ্ছল-উচ্ছল ঢেউরাশি। বরং কোনোমতে জলচিহ্ন বুকে ধরে সরু একটা জলধারা সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলে গেছে বহুদূর!

নদী গতিপথ বদল করে, তার জলও একসময় শুকায় আর মানুষও জন্মায়, জন্ম নিয়ে ফের মরেও যায়— এসবের নিদান নাই। আর কেউ জানুক বা না-জানুক, আমিনুল জানে এইসবের নিদান কিছু নাই।

বাড়ির সম্মুখে ঘাস-জংলায় ছাওয়া গোরস্থানের দিকে তাকিয়ে সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বেশ খানিকটা বিস্তৃত জায়গা জুড়ে এই পারিবারিক কবরস্থান। ফল-ফলাদির বড়ো বড়ো বৃক্ষেরা নুয়ে পড়ে কেমন একটা অচেনা ছায়া-ছায়া অদ্ভুতুড়ে পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছে। কিন্তু ওই ছায়ার ভিতর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার উপায় নাই। তীব্র ইচ্ছে হলেও উপায় নাই। কবর পাড়িয়ে গেলে গুনাহ্‌ হয়— ছোটোকাল থেকে শুনে আসা এই জপমন্ত্র এড়ানোর সাধ্য তার নাই। নিজের এরকম অপারগতায় আমিনুলের দীর্ঘশ্বাসেরা গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়, সেইসঙ্গে কেমন একটা বিজ-বিজে রাগ নাকি বিরক্তি এসে তাকে আক্রান্ত করে ফেলে! এই জীবনের সবকিছুতেই খালি অপচয়। ভিতরে অপচয়, বাইরে অপচয়— অপচয় ছাড়া আর কিছুই যেন নাই আর এই ধরায়! নইলে সেই কোনকালে গত হওয়া, কোন জনমে এই পৃথিবীতে আসা তার বংশের লোকজন মেঘের সাথে নাকি বাতাসের সাথে হাডুডু খেলে-টেলে ফের কিনা তাদের এই পিতৃভিটাতেই দখল নিয়েছে। দখল নিয়ে এমন একটা বিস্তৃত জমিনজুড়ে শুয়ে আছে! কী হত অমন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কবর না দিলে? গাদাগাদি ঠাসাঠাসি করে কবর দিলে আরও খানিকটা জায়গা নিজেদের পালানের জন্য পাওয়া যেত।

আমিনুলের ভাবনা কিছু অমূলক নয়— এতটা জায়গাজুড়ে কবরস্থান না থাকলে আরও কিছু আনাজপাতির চারা অনায়াসে লাগিয়ে দিতে পারত সে। নিজের পালানে ফলানো যেত ঝিঙে-কুমড়ার স্তূপ। ঢেঁড়স আর বেগুনের সবুজ-বেগুনির মিশেলে ভারি একটা রংবাহার খেলে যেত আঙিনাজুড়ে। কিন্তু তা তো আর হওয়ার উপায় নাই। খালি চোখে দেখলে মনে হয় বিস্তৃত কোনো খালি জমিন— কিংবা বেখেয়ালে পড়ে থাকা জমিনের উপর কিছু ফিনফিনে দূর্বাঘাস আর ফার্নের ডগা-মাথার দোল-দোলানি। ওইসব এন্তার সবুজের মাঝে কিছু কিছু শেয়ালমুতার হালকা-বেগুনি ফুলের লজ্জিত হেসে থাকা দেখে যে-কেউ বিভ্রমে পতিত হতে পারে— আহারে! এত্ত সুন্দর খালি জায়গাটারে আবাদি করল না কেউ? কিন্তু দুই-একটা কবরের ঢিবি তখনও অসমান বলে খালি জায়গাটা নিয়েও সন্দেহ ঘুরপাক খায়। ঘুরপাক খেতে খেতে সেই সন্দেহ স্থিরও হয়। সন্দেহ বিষয়টা যেন লাটিমের মতো— ঘুরপাক খেতে খেতে একসময় স্থির হয়। কিন্তু স্থির হওয়ার পূর্বে মাটির-বুকে বেশ খানিকটা খোড়ল রেখে যায়। যায়-ই।

সন্দেহের স্বভাব যে লাটিমের মতো তা আমিনুল ভালো করেই জানে। ঘুরতে ঘুরতে স্থির হওয়া। আর স্থির হওয়ার পূর্বে ধারালো লেজে মাটির বুকে গভীর একটা খোড়ল করে দেয়া। ফলত আমিনুলও সকলকে সন্দেহের চক্ষেই দেখে। এরকম না দেখে সে করবেই-বা কী? অন্যকে সন্দেহ করে চোখে চোখে না রাখলে তার নিজের আসল চেহারাটা বেরিয়ে পড়বার সম্ভাবনা থাকে। অন্যের কাছে ধরা পড়ার পূর্বে সে নিজের আসল চেহারাটা লুকিয়ে রাখতে চায়। গোপন রাখতে চায়। এই যেমন সে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনা শেষ করেও কামাই-রোজগারের ধান্ধা তেমন করল না। পড়া শেষ হওয়ার প্রাক্কালে আমিনুল একটা বিয়েও করে ফেলল। আমিনুল যাকে বিয়ে করল তার চেহারা-ছবি তেমন সুবিধার নয়। সুবিধার না হলেও আমিনুলের নিজের যুক্তির কাছে সে কিন্তু দুর্দান্ত রূপসীই বটে! পোলিও রোগে আমিনুলের বউয়ের একটা পা বেঁকে গিয়ে তাকে খানিকটা খোঁড়া করেও রেখে গিয়েছে। আমিনুল এমন মেয়েকে বিয়ে করতে পারে এরকম অন্যেরা কস্মিনকালেও ভাবে নাই। বউ দেখে আমিনুলের মা আঁচলে মুখ ঢেকে কাঁদতে কাঁদতে সেই যে ফিট পড়ল— এর পরে বেচারাকে কিনা ফিটের ব্যামোতেই পেয়ে বসল। এবং এর পর থেকে সংসারে ভজঘট কিছু একটা লাগলেই পারুলবিবির ফিট-পড়া নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়াল। আমিনুল পারুলবিবিকে কিছু বলল না। বরং সে তার সন্দেহের লাটিমের দিকে দৃষ্টি দিল। মা কি বুঝে ফেলেছে আমিনুলের ভেতরের বাসনা? আফরোজা বেগমের বাপের রেখে যাওয়া কয়েক কানি জমি পাওয়ার আশায় বুক বেঁধে আমিনুল যে এই বিয়েটা করেছে, সেটা কিছুতেই পারুলবিবিকে বুঝতে দেয়া যাবে না! মা হলেই কী আর সন্তান হলেই কী! এ-জগতে কাউকে বিশ্বাস করে সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ রাখার মতো বোকা আমিনুল নয়।

আমিনুলের সন্দেহের তালিকা দীর্ঘ, শুধু দীর্ঘ নয়, বেশ দীর্ঘ। সে-তালিকায় পারুলবিবি যেমন আছে, আফরোজা বেগমও আছে। আমিনুল তার তালিকা থেকে এ-পর্যন্ত কাউকেই বাদ রাখে নাই। আমিনুল জানে, কাউকে বাদ রাখলেই বিপদ। উলটা আমিনুলকেই সন্দেহ করে বসতে পারে!

কিন্তু আমিনুল তা কোনোভাবেই চায় না। চায় না তাকেও কেউ সন্দেহ করে চোর-ছ্যাঁচড়ের লিস্টিতে রাখুক। আমিনুল আদতে চোর হতে চায় না। সে চায় পুলিশ হতে। পুলিশ হয়ে অন্যদের গতিবিধিকে কব্জায় রাখতে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশটাস ইত্যাদিকেও আমিনুল তার পুলিশি নজরদারিতে কাজে লাগায়। যেহেতু পড়া-লেখার বেশ ওজনদার একটা সার্টিফিকেট তার ঝুলিতে তোলা আছে, সেহেতু আমিনুলকে নিয়ে অন্যেরা সন্দেহ প্রকাশ করার অবকাশ পায় না।

সার্টিফিকেটের গুণাগুণ আমিনুলও ভালো করেই জানে। আমিনুল যখন পাশটাস দিয়েও গ্রামেই ফিরে এল, তখন অন্যেরা তার মহানুভবতার কথাই প্রাথমিকভাবে ভেবেছে। যখন সকলেই প্রায় উন্নত জীবনযাপনের আশায় শহরমুখী— সেখানে আমিনুলের ফিরে আসা— এটা এক অর্থে চমকই ছিল বটে অন্যদের কাছে। কিছুটা সম্ভ্রমের দৃষ্টিতে দেখেছিল তারা দেখেছিল আমিনুলের এই ফিরে আসাকে। আমিনুলও দিব্যি উপভোগ করে যাচ্ছিল তাদের দেয়া সেই মর্যাদাকর অবস্থানকে।

আমিনুলের পরিশ্রম করতে ভালো লাগে না এটা যেমন সত্য ছিল, পাশাপাশি এটাও সত্য ছিল গ্রামের বাড়িতে নিজের অবস্থানকে পোক্ত করা। আত্মীয়-স্বজনেরা বলতে গেলে আধুনিক-জীবনের মোহে পড়ে প্রায় সকলেই শহরাভিমুখী।

আমিনুল এসেছিল গ্রামের বাড়ির ধূলিকণাটিকেও তুলে নিয়ে নিজের ঝোলাতে পুরে রাখার জন্য। পিতামহের রেখে যাওয়া যা-কিছু— সমস্ত কিছুর অধিকর্তা সে না হলে সে-সব অন্য শরিকদের হাতবন্দি হয়ে আর কতক্ষণ?

এই ভয়-ভাবনা-দুর্ভাবনা আমিনুলকে তাড়িয়ে ফিরছিল বলেই সে পিতামহের রেখে যাওয়া এজমালি বাড়িটাতে ঝটাঝট ফিরে এসেছিল।

আমিনুলের পিতামহীর ছিল গাছগাছালি-পাতালতার বেজায় সখ। বাড়ির চারদিকে ঘুরে ঘুরে গাছ-লতা-পাতা বুনে দেয়া, সেইগুলা যাতে নির্বিঘ্নে বাড়তে পারে সেই তদারকিতে বুড়ির দিনদুনিয়ার অন্য কোনো কিছুর খেয়াল তেমন ছিল না। ষড়ঋতুর যে কয়টা ফল সে মুখে দিত, তার বেশিরভাগের বীজই সে পুতে দিত মাটিতে। অতঃপর বীজ থেকে অঙ্কুর, অঙ্কুর থেকে চারাগাছ হওয়া পর্যন্ত তক্কে তক্কে থাকা। কোনো গাছ গা-ঝাড়া দিল কি দিল না, বুড়ির ব্যস্ততা তখন আর দেখে কে? বুড়ি তখন ছুট লাগাত বাঁশঝাড় অভিমুখে। বামহাতি বুড়ি কিছু কঞ্চি আর বাঁশ কেটে ঘিরে দিত সেই চারাগাছকে। যাতে গোরু-ছাগলের পেটে যেতে না পারে। নিয়ম করে নিড়ানি দেয়া, জল ঢালা সবই অক্লান্ত করে যেত। গাছ বড়ো হলে, ফল দিলে বুড়ির পাহাড়াদারির কাজও শেষ হয়ে যেত। চারাগাছের প্রথম ফল মসজিদের মুয়াজ্জিনের হাতে তুলে দিয়ে তবেই না ক্ষান্ত হত সে। এই করে করে বুড়ি বাড়িটাকে গাছগাছালিতে একেবারে ছেয়ে ফেলল। লতাপাতা, অর্কিড আর গাছের ছায়াতে সমস্ত বাড়িটাই ক্রমে হয়ে উঠল জঙ্গলাকীর্ণ।

বাড়ির উত্তর দিকের সীমানা ঘেঁষে বেড়ে উঠল দুই-তিনটা আম, একটা যজ্ঞ-ডুমুর, একটা খর্বাকৃতি পিপুল আর তিতিজামের গাছ। আমিনুলের পিতামহীর কাছে ওইসব নিছক গাছ ছিল না। বুড়ির হাতে লাগানো সমস্ত গাছপালাই ছিল বুড়ির কাছে নিজের পেটের সন্তানের মতো। কোনো চারাগাছ গা-ঝাড়া দিয়ে আশমানের দিকে বাড়বাড়ন্ত হতে শুরু করলেই বুড়ি তার একটা নাম দিয়ে দিত। যেমন উত্তর দিকের গাট্টাগোট্টা আমগাছটা যখন পাতা-ঢেকে-দেয়া বেশুমার ফলে যুবতী হয়ে উঠল, বুড়ি গাছটার নাম দিল— টিয়াটুটি। আমিনুলও বালক থেকে কৈশোরে খানিকটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার পর এই নামটা নিয়ে ভেবেছে—

দাদিজান এমুন একটা নাম ক্যান থুইল এই আমগাছের?

টিয়াটুটি— এই নামের অর্থ কী?

কালচে-সবুজে ছেয়ে থাকা ছোটো-ছোটো আম! আমের বোঁটা ছাড়িয়ে ক্রমান্বয়ে নীচের দিকে নামতে নামতে টিয়াপাখির ঠোঁটের মতো বাঁকিয়ে গেছে! আম নয় যেন কোনো টিয়াপাখির বাঁকানো সবুজ ঠোঁট। আহারে! বুড়ির মনে যে কত কী ছিল? কত দিকে নজর রাখার পরই না আমগাছের এমন কোনো নাম দেয়া যায়?

বুড়ির গাছপালার এইরকম কারিশমা কবরখানাতেও কম দেখা যায় না।

চারটা গাছ একেবারে শঙ্খলাগা সাপের মতো জড়িয়ে-পেঁচিয়ে আন্ধার-করা-সবুজে নুয়ে পড়েছে গোরের দিকে। জ্যৈষ্ঠের হাঁসফাঁস করা গরমে যখন পাকনা-আমের সুবাস নিয়ে হাওয়া থম ধরে থাকে, কাঁঠালের নাকি কাঁঠালিচাঁপার খুশবু নিয়ে উত্তাপ আরও ঝেঁপে নামে মাটিতে— তখন তাকিতাকি করে খুঁজতে হয়— গাছটা কি আমের না কাঁঠালের? নাকি কাঁঠালিচাঁপার? বাদলার দুই-চারটা ফোঁটা ওই আন্ধার-করা-সবুজে পড়া মাত্রই বাতাবিনেবুগুলার হলদেটে আভাও যখন উঁকিঝুঁকি মেরে বসে, তখন ব্যপারটা হয়ে দাঁড়ায়— লও ঠ্যালা! এইবার আন্ধার-করা-সবুজের লগে তুমিও খানিকটা বেসামাল হও। গাছবাকলের ভুলভুলাইয়ায় ঘুরপাক খেতে খেতে তুমার চক্ষেও আন্ধার নামুক।

আমিনুলের বালক ও কিশোরকালজুড়ে এই ভুলভুলাইয়া কম কিছু ছিল না। আজও ওই শঙ্খলাগা গাছগুলির কোনো সুরাহা আমিনুল করতে পারে না। শুধু আমিনুল কেন, ওই বুড়ি ছাড়া আর কারো পক্ষেই বোঝা সম্ভবপর ছিল না কোনটা আমগাছ আর কোনটা কাঁঠালের? কোনটা বাতাবিনেবু আর কোনটা কাঁঠালিচাঁপার?

এরকম আজব-কিসিমের কায়কারবার ওই বুড়ি ছাড়া আর কারো পক্ষেই করা সহজ ছিল না— ফলফলাদির বৃক্ষের সাথে কীভাবেই কাঁঠালচাঁপার ফুলগাছকে কেউ জড়িয়ে যেতে দেয়? তার উপর যখন সকলেই জানে যে, কাঁঠালিচাঁপা ফুলের গন্ধে মাতাল হয়ে সাপেরা কিলবিলাতে থাকে গাছের তলায়। গাছ আর সাপের সহাবস্থানে থাকা— ওই বুড়ি ছাড়া আর কারো মাথা থেকে বেরুনো প্রায় অসম্ভব!

কবরখানার গাছগুলি বুড়ির বিশেষ যত্নে বেড়ে উঠেছিল। ঝেঁকে-আম-ধরা গাছটার নাম বুড়িই রেখেছিল— ঝুনকি। হয়তো ঝোঁপা-ঝোঁপা ঝুলন্ত আমের সৌষ্ঠব দেখেই বুড়ি এই গাছটার নাম দিয়েছিল— ঝুনকি! আহা! নামের কী বাহার! আমিনুলের মাথায় বিজবিজে রাগটা এসে ফের যেন ছুরি চালাতে থাকে। আরেকটা আমগাছ বিশাল হতে হতে সাঁঝ-প্রভাতের সমস্ত আলোকেই শাখাপত্রে গিলে নিতে পারে— দলকচড়া! পাকা আমের খোসার ভেতর গুঁটি বাঁধা মাংসপিণ্ড! বুড়ি কী অকাতরেই না বলত—

দাদাভাই, আরেকটু উপরের ডাইলে যাইতে হইব। সাবধানে ডাইল ধইরা যাইও। ওই যে দ্যাহো, পাতার ভিত্রে লুকাইয়া রইছে সিন্দুইরা-লাল-ধরা-আম।

কথা সত্য! দলকচড়া গাছের আম পেকে গেলে সিন্দুরের মতো টুকটুকে লালবর্ণ ধারণ করত। সামান্য টকের মিশেল হলেও ওই গাছের আমের সোয়াদ অসাধারণ!

আমিনুলের শূন্য-চোখ দাদিজানকে খুঁজে ফেরে। কই তার দাদিজান? কই সেই গোলাপি-আভা-ঠিকরানো দাদিজানের পানপাতার মতো মুখের-ডৌল? গাছলতার জননী— বনবাদাড়ের পেলবতাকে নিজদেহে ধারণ করে রাখা সেই সদা-কর্মঠ-নারী— কই হারিয়ে গেল সে? আমিনুল মাথা খুঁড়লেও তো খুঁজে বের করতে পারবে না দাদিজানের গোর কিংবা গোরের কোনো চিহ্ন! কই আছে তার দাদিজান? কোন বৃক্ষের ছায়াতলে সে নির্ভার শুয়ে আছে? এই কবরস্থানে সবই কেমন সমান! সবই কেমন অকাতরে সবুজ ঘাসের তলায় দীর্ঘ ঘুমে মরে আছে! দাদিজানের গোরের সামান্য ঢিবি হয়ে থাকা মাটির চিহ্নও আজ আর কোথাও অবশিষ্ট নাই।

আমিনুল এমন দেখে বা ভাবেও। কিন্তু পরক্ষণেই কি তার চমক ভাঙে না? দাদিজান রাবেয়া খাতুনের হাড়গোড়ও আজ হয়তো মাটির সাথেই মিশে গেছে। কিন্তু এই যে আন্ধার-করা-ছায়া, এই যে নুয়ে-থাকা-বৃক্ষেরা, এই যে অমোঘ-সবুজ এসবের ভেতরে কি দাদিজানের রুহ্‌ এসে ভর করে না?

অকারণেই আমিনুলের গায়ে কাঁটা দেয়, লোমগুলি জারিয়ে ওঠে—

আমিনুল তো প্রায়ই রাবেয়া খাতুনকে দেখতে পায়। আদুল গায়ে, এক প্যাঁচ দিয়ে ডুরে-শাড়ি পরা দাদিজান— কবরস্থানের ফনফনানো-ঘাস-জংলা না-মাড়িয়ে দিব্যি শূন্যে ভাসতে ভাসতে কোনো গাছের কোটরে ঢুকে পড়ছে! সেই কোটরে হয়তো কোনো টিয়াপক্ষীর বাসা! কোটরের ভেতর সদ্য ফুটানো বাচ্চারা চিঁউচিঁউ করে ডাকছে। আর দাদিজান তাদের আঁচলের কোমল ওমে তুলে নিতে নিতে বলছে—

আহারে! বাচ্চারা কাইন্দো না। কাইন্দো না। মায়ে এক্ষুনি আইয়া পড়ব খাওন নিয়া।

বৈশাখের গা-জ্বালানো-দুপুরে আমিনুল দাদিজানের অপেক্ষায় থেকে থেকে ক্লান্ত হয়ে উঠেছে। কিন্তু গাছের খোড়ল থেকে দাদিজান কিছুতেই বের হয়ে আসে নাই। আমিনুল তো জানেই, দাদিজানের স্বভাবই ওমন। ওমনই। যতক্ষণ মা-পাখি নীড়ে না ফিরবে দাদিজান কিছুতেই ছানাদের ফেলে বের হয়ে আসবে না।

আমিনুল ভেবেছে দাদিজানকে খুঁজে বের করে বলবে—

আইচ্ছা, এত্ত গরমে তো তুমি মইরা যাইবা। চল চল ঘরে চল।

পরক্ষণেই সে হতাশ বোধ করেছে!

ধুর! এতসব গাছপালার ভিড়ে, জলাজংলার আবেষ্টনে আর এতসব পাখপাখালির ডাকে দাদিজানকে খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব!

কোন গাছ থেকে কোন গাছে খুঁজে বেড়াবে সে? কোন কোটর থেকে কোন কোটরে? আমিনুলের জন্য এটা একেবারেই এক অসম্ভব ব্যাপার!

পিতামহী রাবেয়া খাতুনের বড়ো সাধের টিয়াটুটি আমগাছটার দিকেই কিনা প্রথম নজর পড়ল আমিনুলের! এ-দিকটা বাড়ির পেছনের দিক— এতদিনে ঝোঁপ-জংলা তাদের বংশবিস্তার করে ঘন-অরণ্য বানিয়ে ফেলেছে। যগডুমুরের গাছটাও বয়সের ভারে শরীর নেতিয়ে প্রায় পড়ো-পড়ো হয়ে উঠেছে! সামনের কালবৈশাখীতে হয়তো সে ধরাশায়ী হয়ে যাবে। এখন এই জঙ্গল— পড়ো-পড়ো ডুমুরগাছের আড়াল— এখান থেকে কিছু একটা কেটে ফেললে বা সরিয়ে ফেললে সহসা ধরা যাবে না। গাছ ছাড়া শূন্য-ময়দান বড়ো বেশি চোখে লাগে। আমিনুল তাই আগেভাগেই সতর্ক। সে নিজের কোনো কাজের জন্য কাউকে জবাবদিহি করতে চায় না। ফলত গাছ কাটা নিয়ে আমিনুল কথাবার্তাও বলে নাই কারো সাথে।

একদিন ভোরের সূর্য নিস্প্রভ থাকতে থাকতেই করাতিরা এসে হাজির হল। তাদের পিঠে লটকে থাকা কাপড়ের ঝোলায় খাঁজকাটা করাতের অস্তিত্ব জানান দিয়ে যাচ্ছে। করাতের ধারালো খাঁজ বারংবার কুমিরের দাঁতের মতো ঝলসে উঠছে সকালের উত্তাপহীন-রোদ্দুরে। একজন ধাইধাই করে উঠে পড়ল টিয়াটুটির মোটা ডালে। আর দুইজন করাতের দুই দিকের হাতল ধরে মাটির ওপর দাঁড়াল। এই দুইজন নীচে থেকেই করাত টানবে। অন্যজন গাছের ওপর দাঁড়িয়ে। আমিনুল এদিকসেদিক তাকাতাকি করে দেখে নিল কে কে ঘুম থেকে জেগে গেছে, আর কার কার এখনও সকাল ফুটে ওঠে নাই।

করাতিরা টিয়াটুটির ডালে ঘ্যাঁচর ঘ্যাঁচর শব্দে করাতের ছোবল বসাতে শুরু করল। খাঁটি সোনার সাথে খাদ মেশানোর পর যে ম্যাটম্যাটে-হলদে রং ধরে, আমগাছটা থেকে তেমনি রঙের গুঁড়ো-গুঁড়ো কাঠ ঝরে পড়তে শুরু করল। যেন-বা কোনো বিশাল আকাশমনি বৃক্ষ থেকে অবিশ্রাম-ধারায় ঝরে পড়ছে পুস্পরেণু! আমিনুল সেদিকে তাকিয়ে খানিকটা যেন চমকে গেল!

দাদিজান কখন তার পাশে এসে দাঁড়াল? হায় হায়! দাদিজানের পিন্ধনে দেখি কাপড়জামা কিচ্ছু নাই! আমিনুল কী চোখে কুনু ধান্ধা দেখতেছে? আমিনুল চোখ ডলে ফের ভালো করে তাকাল। নাহ্‌! কুনু ভুল নাই, দাদিজান। দাদিজানই। দাদিজানের পরনে একপ্যাঁচের ঘিয়েরঙা-শাড়ি। মলিন হতে হতে ঘিয়েরংটা আর বোঝার উপায় নাই! ওই শাদা আর ঘিয়ের মাঝামাঝি কিছু একটা থুবড়েটুবড়ে উঠে গেছে দাদিজানের আদুল হাতের ওপর দিয়ে।

কাঁচাপাকা, কিরিকিরি-কোঁকড়া চুলের বোঝা উদোম পিঠ ছাপিয়ে কোমরের দিকে নেমে গেছে। যেন-বা পুকুরের থুম-ধরা-জলে বেদিশা হাওয়ার টানে ছোটো-ছোটো ঢেউ উঠেছে। জলের দুলুনিতে ঢেউগুলি একটার পিঠে একটা পলকে হেলে পড়ছে। আমিনুলের কেমন যেন ভয় ভয় করতে লাগল। এক্ষুণি হয়তো দাদিজান তেড়েফুঁড়ে আসবে টিয়াটুটি গাছটার এরকম সর্বনাশ করার জন্য। আমিনুলের একবার মনে হল করাতিদের গাছ কাটতে নিষেধ করে দেয় সে। কিন্তু দাদিজানের কাণ্ডকারখানা দেখে সে নড়তে পর্যন্ত পারল না। আমিনুল দেখল আকাশমনির পুস্পরেণুর তলায় দাদিজান অকাতরে মাথা পেতে দিল। অবিশ্রাম ফুলরেণু ঝরে পড়তে লাগল দাদিজানের কিরিকিরি-কোঁকড়া চুলের গুচ্ছতে। কিন্তু দাদিজান নির্বিকার। ক্রমে দাদিজানকেই আড়াল করে ফেলল ওই রেণুর-ঝরনাধারা। আমিনুল দেখল— পলকেই কেমন নাই হয়ে গেল দাদিজানের আদল! আজব তামশা বটে!

এই বাড়িতে আসা-অব্দি আমিনুলকে নানান চক্করই দেখিয়ে চলেছে রাবেয়া খাতুন। আমিনুল যেদিন দাদাজানের আমলের তামার বড়োসড়ো ডেগটা বিক্রি করে দিল, রাবেয়া খাতুনও যেন সেদিন থেকেই তার পিছু নিল। আমিনুল একলা হলেই সে যেন পেত্নীর মতো কাঁধে চেপে বসে। ব্যাপারটা আমিনুল কাউকে বলতেও পারে না। এরকম কথা অন্যদের বলে-টলে সে জলজ্যান্ত মিথ্যাবাদী হতে চায় না।

এমনকী মা পারুলবিবিকে এ-কথা বললেও সে উলটা উপদেশের ঝুড়ি ঢেলে দিবে—

কী কও এইগুলা বাজান? আয়-রোজগারে নজর নাই বইল্যাই হয়তো এমুন খোয়াব দেহো তুমি।

এরকম কথাবার্তা শুনলেই আমিনুলের মাথার ভেতরটা রাগে বিজবিজ করে। কিন্তু আমিনুল রাগলেই কী আর কাঁদলেই কী? রাবেয়া খাতুন তো তাকে ছেড়ে যাচ্ছে না কিছুতেই।

এই যে খানিক আগেই আকাশমনির পুস্পরেণু গায়ে মেখে কই না কই ডুব দিল সে! এখন রাবেয়া খাতুনের তালাশে আমিনুল যদি সমস্ত বনবাদাড় চষে ফেলে তাও কি তাকে খুঁজে পাবে? না, পাবে না। রাবেয়া খাতুন নিজে এসে ধরা না দিলে আমিনুল তাকে কিছুতেই খুঁজে পাবে না।

দাদিজানের এরকম মতিচ্ছন্নতায় আমিনুল আরও বিরক্ত বোধ করে। বুড়ি মরেও দেখি মরে নাই! দিব্যি এসে সংসারের চাবিকাঠি নাড়তে শুরু করেছে!

করাতিদের ঘ্যাচরঘ্যাচর গাছকাটার শব্দে সকালের রোদ্দুর তার ম্যান্দামারা ভাব কাটিয়ে বেশ চনমনে হয়ে উঠেছে। সূর্যের কিরণ তেরছা ভঙ্গিতে লুটিয়ে পড়েছে কাঠের গুঁড়োর স্তূপের ওপর। বাতাস আমোদিত করে ভেসে বেড়াচ্ছে আমগাছের ভেষজ-মৌতাত। আমিনুলের বড়ো চেনা এই গন্ধ! আমিনুল জানে, আমপাতা হাতের চেটোয় চটকে নিলে এই গন্ধ গাঢ় থেকে আরও গাঢ় হয়ে উঠবে। শুধু কি পাতার? গাছেদের কাণ্ডেরও আলাদা আলাদা গন্ধ রয়েছে। সে-সব গন্ধ ঘাস নাকি ঘাসফুলের মতো, খড় নাকি বিচালির মতো— আমিনুল তা সঠিক নির্ণয় করতে পারে না।

এই যেমন এখন করাতের ধারালো দাঁতের নীচে পড়ে দাদিজানের টিয়াটুটি আমগাছটা লুটিয়ে পড়েছে মাটিতে। আমের পাতাগুলি কেটেছেটে আলাদা করে রেখেছে করাতিরা। শাখা-ডালের একটা স্তূপ যগডুমুরের গাছটাকে প্রায় আড়াল করে রেখেছে— এখান থেকে আমিনুল কী করেই বা আলাদা করবে ঘেসো-গন্ধ কিংবা খড়বিচালির স্যাঁৎসেঁতে গন্ধ-কে?

আমিনুলের তো অত বোধবুদ্ধি নাই! আমিনুল নিজের ওপরই বিরক্ত হয়— এতসব উদ্ভট চিন্তা তার মাথাতেই খালি চক্কর খায় কেন? জঙ্গলের গন্ধ কেমন তা খুঁজতে খুঁজতেই তার মাথা অন্ধকার হওয়ার যো। ওদিকে দাদিজান যে কাঠের-গুড়ো নাকি আকাশমনির ফুলরেণুর তলায় অদৃশ্য হয়ে গেল তা নিয়েও তো সে গোলকধাঁধাতেই আছে। সূর্যের চড়তা-আলোর উত্তাপে করাতিরা বিনবিনিয়ে ঘামছে— দুই-একবার তারা জল খেতে চেয়েছিল কিনা আমিনুল এখন কিছুতেই মনে করতে পারছে না।

আকাশমনির রেণুর স্তূপ ফুঁড়ে দাদিজান হঠাৎ উদয় হলে আমিনুলের ধন্দ আরও বাড়ে। দাদিজান তার সাথে বেশ একটা রহস্য রহস্য খেলায় মেতে উঠেছে। খানিক আগেই না সে বেপাত্তা হয়ে গেল, এখুনি কী করে সে বজ্রপাতের মতো নাজিল হল ফের?

দাদিজানের পরনে এখন লাল-কালোর ডোরাকাটা-শাড়ি। অথচ তাকে তো শেষবার দেখা গিয়েছিল শাদা-অফহোয়াইট রঙের মাঝামাঝি কোনো অবস্থানে!

দাদিজান বলে ওঠে—

এই গাছডা কাইট্যা ফেলাইলি? আমগুলি বড়োই সোয়াদের আছিল।

আমিনুল দেখে দাদিজান ফাদিজানের ছায়াটাও কোথাও নাই— তার সম্মুখে মা পারুলবিবি দাঁড়িয়ে আছে। পারুলবিবির গা-ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে আমিনুলের পনেরো বছরের পুত্র মালেকুল! আমিনুল খানিকটা বিব্রত বোধ করে। সে ভেবেছিল পারুলবিবি ঠাওর করার পূর্বেই মজুরি চুকিয়ে করাতিদের বিদায় করে দেবে। কিন্তু সেটা তো আর হল না।

পারুলবিবি আমিনুলকে ঠান্ডা গলায় বলে—

মুরুব্বিগো হাতের জিনিস এমুন কইরা কাটন নাই, বাজান।

বলেই টিয়াটুটির কাটা ডালপালার স্তূপের দিকে একপলক তাকায় সে। অতঃপর ঘরের দিকে হাঁটা দেয়।

আমিনুল দেখে দাদির পাশপাশি মালেকুলও ঘরে ফিরে যাচ্ছে। ছেলেটাকে আজ এমন বড়োসড়ো দেখাচ্ছে কেন? লম্বা হতে হতে আমিনুলকেও সে হয়তো মাথায় ছাড়িয়ে গিয়েছে।

মধ্যাহ্নের রোদ পড়ে আলোর মেজাজ নরম হয়ে এলে প্রায় বিকেলেই পায়চারি করে আমিনুল। মৃদু-পায়ে হাঁটতে হাঁটতে চারপাশে কী যেন খুঁজে বেড়ায়! খুঁজতে খুঁজতে তার চোখদুটো একসময় সরু হয়ে ওঠে। সরু হয়ে প্রায় বুজে আসতে চায়। কিন্তু না, চোখ বুজলে চলবে কী করে? ফলত আমিনুলের দৃষ্টি কবরখানার সবুজ থই-থই করা বৃক্ষরাজির ওপর স্থির হয়। আমিনুল অবাক হয়ে ভাবে— শাখাপত্রে জড়াজড়ি করে কেমন নিশ্চিন্ত জীবন এই গাছেদের! খাওয়া-পরার চিন্তা নাই। বিছানা-ঘরের চিন্তা নাই। পাতা ছড়িয়ে ঘন-ছায়া বিস্তার করে পাশের ঢালু-জমিনটাকেও নিজেদের আয়ত্বের মাঝে নিয়ে নিয়েছে! আর ওই ছায়াচ্ছন্নতার তলায় যারা চিরঘুমে শুয়ে আছে, তারাও এক অর্থে নিশ্চিন্তই। অবশ্য আমিনুল সঠিক জানে না, তারা সত্যিই নিশ্চিন্ত কিনা? এই একটা বিষয় আমিনুলকে বরাবরই ধাঁধায় ফেলে দেয়— এই যে কত কত আপনজন ওই মাটির তলায় নিজেদের স্থায়ী ঠিকানায় চলে গেল, তারা আদতে কেমন আছে? কেউ তো কোনোদিন ফিরে এসে জানিয়ে গেল না যে মাটির তলায় কেমন মরণে তারা থাকে? বা ওইখানের সুখসুবিধা মাটির ওপরের চাইতেও উত্তম কিনা? অথবা ওইখানেও কী এরকমই চলমান সবকিছু কিনা? আর কিছু না হোক মাটির ওপরে যারা আছে, তাদের খাওয়ার চিন্তাটা তো চলমান। যে যা-ই করুক না কেন খেতে তাকে হয়ই। খেতে হবেই। এই একটা জিনিস থেকে দূরে থাকার কোনোই উপায় নাই। এরকম আজগুবি ভাবনাচিন্তার মাঝেই কবরখানার গাছগুলিকেও কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয় আমিনুল।

কবরখানার গাছ বিক্রি করার ব্যাপারটাকে আমিনুল এবার আর গোপন করতে চাইল না। কী দরকার আর এতসব রাখঢাকের? সে তো এসেছেই পিতামহের ওয়ারিশান হিসেবে এই বাড়ির সমস্ত কিছুই ভোগদখল করতে। আমিনুল ভেবে দেখেছে, খামোখাই পারুলবিবিকে পেরেশানির মাঝে ফেলার দরকার কী? কিংবা পারুলবিবি বাধা দিলেই কী? আমিনুল কোন জন্মেই বা মায়ের কোন নিষেধের তোয়াক্কা করেছে?

কিন্তু আমিনুল যা ভেবেছিল সে-সবের কিছুই ঘটল না। অর্থাৎ, পারুলবিবি সব শুনেটুনেও কিছুই বলল না। এমনকী একবার সে ফিটও পড়ল না। ভাবলেশহীন চেহারা করে চুপচাপ শুনে গেল। আমিনুল যা কস্মিনকালেও ভাবে নাই, সেটাই ঘটল! গাছ বিক্রিতে বাধ সেধে বসল কিনা আফরোজা বেগম! এক-পা খোঁড়া আফরোজা বেগমের আপত্তি দেখে আমিনুল খানিকক্ষণ তবদা মেরে বসে রইল। নিজের স্ত্রীর এমন রুদ্রমূর্তি ইতোপূর্বে আমিনুল দেখে নাই।

আফরোজা বেগমের সাফ-কথা—

দেখো, কব্বরখানার গাছগুলান কাটা উচিত হইব না। কত শত বছর আগে কত মুরুব্বিগো গোর এইখানে। গাছ কাটলে হেগো নিদ্রার ব্যাঘাত ঘইট্যা যাইব। হেগো নিদ্রা টুইট্যা যাইতে পারে।

আফরোজা বেগমের এসব কথাবার্তায় একটা অচেনা-ক্রোধ আমিনুলকে গ্রাস করে ফেলতে লাগল। আফরোজা বেগম কি জানে না এইসব কথার নামমাত্র মূল্যও আমিনুলের কাছে নাই? তাহলে কেন সে এসব বলতে শুরু করেছে?

এসব আমিনুলকে বলা আর ফুটো পাত্রে জল ঢালা একই ব্যাপার। আফরোজা বেগম তবু যেন মরিয়া! ফলত সে বলতেই লাগল—

কব্বরখানার গাছের ফলফলাদি কত পক্ষীরাই না খাইয়া যায়। কত জাতের পক্ষীই না আহে এইহানে! এমুন ঘন-ছায়ার তলায় বেবাকতেই কিমুন নিশ্চিন্ত ঘুমাইয়া রইছে। কত পশুপক্ষীই না এইহানে আইস্যা জিরায়। গাছে কুড়ালের কোপ পড়লেই কিন্তুক বেবাকতেই জাইগা উঠব। বেবাকরে জাগাইয়া দেওন কি ঠিক হইব, কইন?

আফরোজা বেগমের এসব আবেগাক্রান্ত কথাবার্তাও আমিনুলের মাঝে কোনো ক্রিয়া-বিক্রিয়া ঘটালো কিনা বুঝা গেল না।

দিন-দুয়েক পরে ভোর-ভোর গাছ কাটার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল আফরোজা বেগমের। ঘুম চোখেই সে প্রায় থালুথালু বেশে দৌড়ে গেল কবরখানার দিকে। ততক্ষণে প্রচণ্ড কোলাহলে পূর্ণ হয়ে উঠেছে চারদিক। পাখপাখালির কিচিরমিচিরে ভোরের নির্জনতা গুঁড়িয়ে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। কাটা গাছের ডালে বসে এক দঙ্গল কাক তারস্বরে চিৎকার করছে। অদূরেই কাকের ভাঙাবাসা থেকে দুইটা ছানা মুখ বাড়িয়ে চিঁ-চিঁ স্বরে অনর্গল ডেকে চলেছে!

আফরোজা বেগমের চোখ থেকেও ঘুমভাব দ্রুত সরতে শুরু করল। চোখ ডলে তাকিয়ে সে দেখতে পেল পারুলবিবি লম্বা ঘোমটা টেনে শঙ্খলাগা গাছগুলির তলায় দাঁড়িয়ে আছে। পারুলবিবির পাশেই মালেকুল দাঁড়ানো। কবরখানার সমস্ত নিস্তব্ধতা উঠে এসে তাদের দুইজনের অবয়বে যেন ভর করে আছে।

বৃক্ষদের শরীরে করাত টানার সঙ্গে সঙ্গে আকাশমণির পুস্পরেণু স্তূপ হয়ে উঠছে। আর হলুদ আবরণের স্রোতে ডুবে যাচ্ছে সবুজ-ঘাসের-গালিচা। আমিনুল ইতিউতি তাকায়। সে আদতে দাদিজানকে তালাশ করে। গাছ কাটার এত শব্দ পেয়ে রাবেয়া খাতুন একবারও উঁকি দেবে না, তা তো হয় না। নিশ্চয়ই সে এসেছে। এসে হয়তো কোনো গাছের কাটা ডালের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে।

দাদিজানের দেখা না পেলেও, দাদিজানের লাগানো আম, কাঁঠাল আর কাঁঠালিচাঁপার ঝোঁপ একইসঙ্গে কাটতে হল। এতটাই আষ্টে-পৃষ্টে বাঁধা ছিল তারা যে, আলাদা করে কাটার কোনো উপায়ই আর রইল না।

গোরস্থানের সমস্ত গাছ কাটা হয়ে গেছে দীর্ঘ সময় পূর্বে। এক্ষণে কবরের ওপর আর কোনো ছায়া নাই। দুপুরের তপ্ত সূর্য অসমতল মাটি ফুঁড়ে চলে যাচ্ছে আরও গভীরে। যেন সে কোনো পাতালপুরীর খোঁজ পেয়েছে। নিশ্চুপ জমিনকে উত্তাপে উত্তাপে সরব না করা পযর্ন্ত সূর্যের যেন শান্তি নাই। মাথার ওপর তাপদাহকে অগ্রাহ্য করে মালেকুলও দাঁড়িয়ে ছিল। পাশে পারুলবিবি। মালেকুল উফ্‌ শব্দ করে বসে পড়লে পারুলবিবির আর্ত-চিৎকারে কবরখানা পুনরায় কোলাহলে ভরে উঠল।

পারুলবিবি দেখল, কালো দড়ির মতো একটা সাপ এঁকেবেঁকে, ঘাসের বুকে ঘসঘস শব্দ তুলে চলে যাচ্ছে দ্রুত। সে চলে যাচ্ছে গোরস্থান লাগোয়া ঢালু জমিনের দিকে।

আর ঠিক ওই মুহূর্তে আমিনুলও কিনা দাদিজানকে দেখল— আদুল গায়ে, এক প্যাঁচ দিয়ে শাদাটে-শাড়ি পরা রাবেয়া খাতুন— হাওয়ায় ভর করে উড়ে চলেছে। কিরি-কিরি-কোঁকড়া চুলের রাবেয়া খাতুনের পিঠে কোনো ডানা নাই। কিন্তু তবুও সে মসৃণ গতিতে উড়ে চলেছে। আমিনুল ধন্ধে পড়ে— পাখনা ছাড়া একডা মানুষ উইড়া যায় কেমনে?

প্রগাঢ়-নির্জনতা এখন ঝেঁপে নেমেছে গোরস্থানে। হাওয়া দ্রুত বইয়ে গেলেও পাতাদের দুলে ওঠার সামান্যতম শব্দও আর শোনা যায় না। বুকের ভেতর ভয় ধরিয়ে দিয়ে কোনো রাতজাগা পাখিও আর অকারণে ডেকে ওঠে না। কবরের উপরের ফনফনানো সবুজ-ঘাস, ফার্ন আর শেয়ালমুতার বেগুনিফুলেরা মরো-মরো দশাপ্রাপ্ত হয়ে আছে।

আমিনুল মুখ আন্ধার করে বসে থাকে। বৃক্ষশূন্য এক বিস্তীর্ণ জমিন তার চোখের সামনে ক্রমশ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে।

বাদামি রঙে ছাওয়া জমিনের এক-কোনায় মাটির ছোট্ট একটা ঢিবি— একরত্তি চরের মতো জেগে আছে। খেজুরগাছের দুই-চারটা কাটা ডাল ওই ঢিবির এক পার্শ্বে গাঁথা। মালেকুলের কবরের উত্তর শিথানে এই কাঁচা-ডাল আমিনুলকেই পুঁতে দিতে হয়েছিল…।

Categories
2021-Utsob-Story

মধুময় পাল

কলোনি ডায়েরি

[এই লেখা একটি ডায়েরির কয়েক পৃষ্ঠা৷ ডায়েরির লেখক অতুলকথা বাঙাল৷ কারো কৌতূহল হতে পারে এমন অদ্ভুত নাম কেন? পূর্ববঙ্গের কিশোরগঞ্জে তিনপুরুষের ভিটে থেকে উচ্ছেদ হবার পর নলিনীকুমার বসু ভারতে আশ্রয় নেন৷ বিখ্যাত কোনো নেতা বা গুরুর আশ্রয় নেওয়ার মতো নয় একেবারেই৷ প্রাণ হাতে নিয়ে পালিয়ে শেয়ালদা স্টেশনে লক্ষ দেশভিখারির ল্যাপটালেপটি ভিড়ে নিজেদের কোনোরকমে গুঁজে দেওয়া৷ ‘নিজেদের’ মানে নলিনীকুমার, তাঁর স্ত্রী, কন্যা ও নাতি৷ পালানোর সময় নাতির বয়স ছিল চারমাস৷ এই স্টেশনেই দীনভিখারি-অনুষ্ঠানে নামকরণ হয় তার৷ কোটালিপাড়ার ডাকসাইটে ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান অব্যয়ানন্দ শিশুর নাম রাখেন ‘অতুলকথা’৷ আর নলিনীকুমার নতুন পদবি দেন ‘বাঙাল’৷ ছিলেন ‘বসু’৷ যার দেশ যায়, তার সব যায়৷ পুরোনো পদবি থাকে কীভাবে? তাছাড়া, এরপর তো সবাই ‘বাঙাল’ ডাকবে, শোনার অভ্যাস হয়ে যাক শিশু থাকতেই৷ অব্যয়ানন্দও খেদা-খাওয়া৷ তিনি ১৯৫২ সালে নলিনীকুমারের কাছ থেকে দু-টাকার পুরোহিত-প্রণাম আদায় করেন এই নামকরণের জন্য৷ ডায়েরিতেই এ-কথা লিখিত আছে৷ অতুলকথার ডায়েরি তিরিশ পরিচ্ছেদের৷ এখানে তার একটি দেওয়া গেল৷ নামকরণ স্বয়ং অতুলকথার৷]

উত্তরের জানালা খোলা৷ আশ্বিনের আকাশে মেঘের জমায়েত আলো শুষে নিচ্ছে৷ বৃষ্টি নামবে কোনো সময়৷ শোবার আগে পর্দা আধাআধি টেনে দিয়েছে শিশির৷ বালিশে মাথা রেখে নাটকের বইটা পড়তে পড়তে চোখের পাতা ভারী হবে, হাই উঠবে, পাশ ফিরে আরামের কোল নেবে শরীর, ভাতঘুমে ডুবে যাবে— এরকম ভেবেছিল সে পর্দা টানতে টানতে৷ বিছানায় বসে বইয়ের সতেরো নম্বর পৃষ্ঠা খোঁজে৷ সতেরো পায়৷ কিন্তু সেই দৃশ্য ও সংলাপ নেই৷ তবে কি পনেরো, নাকি উনিশ? ডান দিকের পৃষ্ঠায় আছে ভুবনপ্রসাদের সংলাপ: তোমাকে আমি সম্মান দিয়েছি, মর্যাদা দিয়েছি, অধিকার দিয়েছি, ভাষা দিয়েছি৷ ভুলে যেয়ো না তুমি ভাষাহীন ছিলে৷ তোমাদের কখনো ভাষা ছিল না, থাকে না৷ আমি, এই ভুবন সিংহ দিয়েছি৷ কথা ফুটিয়েছি করতলে রেখে যত্নে আদরে৷

ডান দিক ধরে খুঁজতে খুঁজতে সংলাপটা পায় শিশির আরও ছ-পৃষ্ঠা পর৷ একবার ভুবনপ্রসাদ হওয়ার চেষ্টার মধ্যে দু-বার হাই ওঠে৷ ভুবনপ্রসাদের ভারী আওয়াজে হাইয়ের হাওয়া ঢুকে পড়ে৷ বই সরিয়ে রাখে সে৷ দূর থেকে ভেসে আসে আকাশের গুমগুম৷

আধোঘুমে সে শুনতে পায় নীলিমার সংলাপ: ভাষা যখন দিয়েছ, কথা যখন ফুটিয়েছ, শুনতে তো হবেই৷ শুনবে না কেন? আমি অন্য কাউকে শোনাব? তোমার ভাষা, তোমার কথা, মালিক তুমি৷ তোমারই হাতে তুলে দেব তোমার দান৷ যদি আর কাউকে শোনাই, যদি আর কারো সামনে বেজে উঠি, সইতে পারবে কি? পারবে না৷ গর্জন করে উঠবে৷ বলবে, তুমি আমার৷ শুধু আমার৷ তোমার দখলের কথা মনে করিয়ে দেবে৷ মনে করিয়ে দেবে আমি তোমার একার সম্পত্তি৷ হে প্রিয়, হে অন্তরতম, তুমি অধিকার দিয়েছ, ভাষা দিয়েছ, সে-সবই তোমার ভোগের জন্য৷

শিশির একটা ছবিতে দাঁড়ায়৷ সে নিলীমাকে দেখতে পায়৷ তার খুব কাছে৷ পরিপাটি শরীরের ওপর রচিত মুখশ্রী৷ চোখ তুলে বলে, আমার সবই তোমার জন্য৷

ঘুমটা সরে সরে যায়৷ নিলীমার রোল-টা লাভলি পেতে পারে৷ লাভলিকে পেতে পারে শিশির৷ ক্লাবে দু-বার এসেছে লাভলি৷ এক কর্মকর্তার পছন্দের নারী৷ পরিচয়ে বলে, অমুকের বোন, আমারও বোনের মতো৷ মধ্যবিত্ত বাঙালির ঢ্যামনামি৷ কর্মকর্তা লাভলিকে খাবে৷ জানা কথা৷ এরকম হয়ই৷ এরকমই হয়৷ শিশিরও খাবে৷ সে সিলেক্ট করেছে৷ ডিরেক্টররা পেয়ে থাকে৷ শিশির ডিরেক্টর৷ উচ্চারণ পরিষ্কার৷ রিফিউজি মেয়ে হলেও পূর্ববঙ্গের টান নেই৷ গলার জোর আছে৷ কলেজে পড়ার বয়স৷ পড়ে কিনা জানা নেই৷ পড়বার কথা নয়৷ গরিবের ঘরে বই বড়ো আপদ৷ মেয়েটি হয়তো শেখেনি অনেককিছুই, আড়ষ্টতা নেই চলাফেরায়৷ প্রথম দিনের রিহার্সালেই বুঝিয়ে দিয়েছে৷ হে প্রিয়, হে অন্তরতম, তুমি অধিকার দিয়েছ, ভাষা দিয়েছ, সে-সবই তোমার জন্য৷ পরিপাটি শরীরের ওপর রচিত মুখশ্রী৷ এরকম শরীর শিশিরের খুব লাগে৷ হাসি হতে পারেনি৷ রূপ থাকাটাই যথেষ্ট নয়, রূপকে দাঁড়াতে হয়৷

গুমগুম আরও ভারী হয়ে কাছাকাছি৷ উত্তরের জানালা দিয়ে অন্ধকার ঢুকছে ঘরে৷ ভর দুপুরে ঘনিয়ে এল সন্ধ্যে৷ আকাশ তোলপাড় করে মেঘ ডাকল৷ বৃষ্টি হবে৷ খুব বৃষ্টি হতে পারে যদি হাওয়ার টানে কেটে না যায়৷ ভোর থেকে আকাশ মেঘের হাট হয়ে ছিল৷ বেলায় বেলায় বেড়েছে ভিড়৷ ভাতঘুমের হাই মিলিয়ে গেছে৷ বেশ চনমনে লাগছে৷ বাদলদিনের একটা অন্যরকম এফেক্ট তো আছেই৷ হাসি আসতে পারে এখন৷ এখনও কি ঠাকুরঘরে? বয়স যত বাড়ছে, ঠাকুরবাতিকও বাড়ছে৷ হয়তো এখনও খাওয়া হয়নি৷ তারপর বাসন মাজতে বসবে৷ কাজের লোকের বাসনমাজা পছন্দ হয় না৷

মেঘের জমায়েত এ-মাথা ও-মাথা তখনই, সবেদুপুরে শিশির যখন মান্নার চায়ের দোকানে, অন্যদিনের মতো কাগজে ছোটো খবর খুঁজছিল৷ যেমন আইন-আদালত, মধুচক্র, অবৈধ সম্পর্ক৷ কুচো কুচো খবরে মুঠো মুঠো প্রাণ৷ চায়ের দোকান একটু হালকা হলে শিশির কুচোতে ঢুকে যায়৷

মান্না এটা জানে৷ সে পাখা বন্ধ করে দেয়, জোরে ঝাঁটা চালিয়ে ধুলো ওড়ায়, ঝুল ওড়ায়৷ উনুনে কাঁচা কয়লা গুঁজে দেয়৷ চোখ-জ্বালানো নাক-জ্বালানো ধোঁয়া ওঠে৷ তারই মধ্যে বসে শিশির রস খোঁজে৷ আজ মান্না বলেছে, শিশিরবাবু, আকাশ ভাইঙা পড়তে চায়৷ নামলে ছাড়া অনিশ্চিত৷ আমারে ঘরে যাইতে হবে হাইট্যা৷ পড়লেন তো আধাঘণ্টা৷ পাইছেন নিশ্চয় কিছু৷ ঘরে গিয়া ভাবেন৷ বউদির লগে গল্প করেন৷ শিশির মান্নার দিকে তাকিয়ে হেসে বলেছে৷ বলেছে, সাহস বাড়ছে তোমার৷ আজকের কাগজ সাদা৷ কোনাখামচিতেও কিছু নেই৷

নীল আলো ঝলসে উঠল জানালায়৷ চড়চড় শব্দে আছড়ে পড়ল বাজ কাছেপিঠে৷ শিশির কুঁকড়ে যায়৷ সন্ন্যাসীর মা ঝলসে দাঁড়িয়ে আছে নিমগাছে৷ প্রায় ছ-ফুট, চওড়া কাঠামোর শরীর বিদ্যুতের আলোয় আংশিক দেখে নাথুরামের কাঠের দোকানের পাল্লায় ছিটকে পড়েছিল শিশির৷ সেদিনও দুপুরে রাত্রি নেমেছিল৷ জানালাটা বন্ধ করা দরকার৷ বিছানা থেকে হাত বাড়িয়ে আপাতত পর্দা টেনে দেয়৷ আকাশে মেঘের কুরুক্ষেত্র৷ বালিশে মুখ গুঁজে পড়ে থাকে শিশির৷

‘খুট’ শব্দটা কানে এল৷ হাসি এল তবে৷ সদ্য বিয়ের পর এভাবেই শুতে আসত রাতে৷ শ্বশুর-শাশুড়ি কয়েকদিন ছিল তখন এখানে৷ ননদ ছিল৷ এখন তারা নেই৷ শ্বশুর-শাশুড়ি তো সপ্তাহখানেক বাদেই পাকিস্তানে৷ শেরপুরে বিরাট ব্যাবসা৷ বারোপাল্লার দোকান৷ অবিনাশের ওপর ছেড়ে দিয়ে আসা৷ খুবই বিশ্বস্ত অবিনাশ৷ তবু৷ দেশভাগের পর দেশটা আর আগের মতো নেই৷ ছেলের বিয়ে দিয়ে তারা চলে গেছে৷ ননদ চলে গেছে নিজের বাছাই-করা যুবকের সঙ্গে৷ শিশিরের এখন দুই মেয়ে৷ ওরা স্কুলে থাকলেও হাসি এমনভাবে ঘরে ঢোকে যেন এতটুকু শব্দ না হয়৷ সদ্য বিয়ের সহবাসের সেই লজ্জা আজও ডিঙোতে পারেনি৷ স্বামীর বিছানায় শব্দহীন এই আসার চেষ্টার একটা ‘খুট’ শব্দ কী ভীষণ রমণীয় ও কামনাতুর৷ হাসির স্তন দুই সন্তানের ধকলের পরও তেমনই সুডোল, পাণিগ্রাহী৷ শিশিরের বড়ো প্রিয় খেলার জিনিস৷ বড়ো প্রিয় হাসির ঠোঁট, সুগঠিত পা, কম্পনময় যৌনযাপনভঙ্গি৷ স্তনের ভাঁজে শিশিরের মাথা সে টেনে নেয়৷ ঝুঁকে পড়ে সবটুকু আদর নিয়ে৷ লাভলিরা কিছুক্ষণের৷ ঘরের বাইরের৷ সব সম্পর্ক ঘরের হয় না৷ শিশির মুখ গুঁজে চুপ করে পড়ে থাকে হাসি ছোঁবে বলে৷

বৃষ্টি নেমেছে৷ মেঘের যুদ্ধ কিছুটা স্তিমিত৷ পাশের বাড়িতে বিরুদের টিনের চালে ঝমঝম হচ্ছে৷ কুকুরের কুঁইকুঁই শোনা গেল৷ কারো বারান্দায় বা রান্নাঘরের দাওয়ায় উঠেছে ভেজা এড়াতে৷ তাড়ানো হচ্ছে তাকে৷ শিবরামদের বাড়ি থেকে কাঁসরের আওয়াজ এল৷ ধনাদের গোয়ালে গোরু ডাকল৷ নিমুখুড়ো কাশছে আর বউকে ডাকছে চেঁচিয়ে৷ দ্বিতীয় পক্ষ, বয়স কম, সাড়া দিতে চায় না৷ খুড়ো এরপর খিস্তি ছোটাবে৷ হাসি তবে কি আসেনি? ‘খুট’ শব্দটা মনের ভুল? শিশিরের চাওয়ার মধ্যে বেজে উঠেছিল? হয়তো এখনও ঠাকুরঘরে৷ কিংবা খেতে বসেছে৷ নিজের হাতে বেড়ে একা একা খাওয়া৷ কিংবা খাওয়ার পর বাসন মাজতে বসেছে৷ এমনও হতে পারে শুকনো কাপড় তুলে গুছিয়ে রাখছে আর ভেজাগুলো মেলে দিচ্ছে বারান্দায়৷ কোনো ভাড়াটে হয়তো বলল, বউদি, ঘরে জল পড়ছে৷ কোনো ভাড়াটে হয়তো বলল, বউদি, ভাঙা পাল্লা দিয়ে ঘরে জল ঢুকছে৷ কেউ বলল, দিদি, দেয়াল চুঁইয়ে জলে মেঝে ভাসছে৷ টালি ভেঙেছে কয়েকটা৷ জানালার পাল্লাও ভেঙেছে৷ সারাবে কীভাবে শিশির? ভাড়াটেরা বকেয়া ভাড়া “আজ দেব কাল দেব” করে৷ পাকিস্তান থেকে টাকা আর আগের মতো নিয়ম করে আসে না৷ পিচচট দিয়ে সাময়িক মেরামতের চেষ্টা হয়েছে৷ টেকেনি৷ দেওয়ালে জল চোঁয়ানো ঠেকাতে খানিকটা জায়গা প্লাস্টার করা হয়েছে৷ কাজে লাগেনি৷ জানালার নতুন পাল্লা বানাতে অনেক খরচ৷ টাকা আসবে কোথা থেকে? ছয় ভাড়া-ঘরের মালিক হলেও শিশির গরিব৷ যেটুকু আছে তা বাড়িওলার ঠাট রাখতে খরচ হয়ে যাচ্ছে৷ মেয়েদের স্কুলের খরচ যোগানো এরপর সমস্যা হয়ে পড়বে৷ এসব ভাবতে শিশিরের একদম ভালো লাগে না৷ একটা দুশ্চিন্তা তাকে অস্থির করে, একটা অসহায়তা তাকে স্থবির করে৷

মেঘের ডাক আর শোনা যাচ্ছে না৷ শিশির বালিশ থেকে মুখ তোলে৷ বৃষ্টির ছাঁটে জানালার পর্দা খানিক ভিজেছে৷ হাসি আসেনি৷ নাকি এসেছিল? শিশিরকে মুখ গুঁজে শুয়ে থাকতে দেখে হয়তো ভেবেছে ঘুমিয়ে আছে৷ ডাকেনি৷ না, সেরকম হতে পারে না৷ হাসির অত সাহস নেই৷ থাকলে অনেক কিছুই ঘটে যেতে পারত এতদিনে৷ যে-ঘর থেকে হাসিকে আনা হয়েছে, সেখানে সাহস থাকে না৷ ছোটোবেলা থেকে মেয়েদের বাধ্যতার শিক্ষা দেওয়া হয়, মুখ বুজে মেনে চলার শিক্ষা দেওয়া হয়, ভয়ের শিক্ষা দেওয়া হয়৷ গোড়ার দিকে কখনো কখনো অন্যরকম কথা বলতে চেয়েছে হাসি, প্রতিবাদ করতে চেয়েছে৷ শিশির শাসন জানে৷ সুশাসন৷ শেরপুরের ব্যাবসা থেকে তখন প্রয়োজনের অনেক বেশি টাকা আসে৷ শিশিরের জন্মদিনে উঠোনে মেহবুব ব্যান্ড বাজে৷ ঝুলন পূর্ণিমায় রাধা-কৃষ্ণের পুতুল সোনার গয়না পরে দোল খায়৷ কালীপুজোয় বসনতুবড়ি ভুস করে জ্বলে উঠে আলোয় ভরে দেয় মুহুর্মুহু৷ রানাঘাটের রিফিউজি ঘরের বাবা-হারা মেয়ে কোনোদিন ভেবেছিল তার গায়ে এত সোনা উঠবে? শিশির শাসন জানে৷ সুশাসন৷ এখন আর সেই জাঁক নেই৷ কিন্তু শাসন পোক্ত হয়ে আছে প্রতি ধাপে৷ তোমার যে-ভাষা, সে আমার দান৷ তোমার যে-অধিকার, সে আমারই দেওয়া৷ নাটক জমে যাবে৷ লক্ষ্মীবিলাস রিক্রিয়েশান ক্লাব শিশিরকে ডিরেক্টর হিসেবে চেয়েছে৷ লাভলিকে নিলীমার পার্টটা দিতেই হবে৷ হাসি তবে আসেনি৷ বৃষ্টিভেজা হাওয়া আসছে ঘরে৷ বিছানা থেকে আকাশ যতটুকু দেখা যায় এখনও মেঘলা৷

নাটক নিয়ে মজে থাকার মধ্যে হাসি এল কীভাবে? হাসির আসবার কথা নয়৷ শিশির ভাবে৷ নাটকের সংলাপ পড়ছিল সে৷ হাই উঠছিল৷ ঘুমোবে ভাবছিল৷ মেঘ জমছিল৷ জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকছিল অন্ধকার৷ ঘুমটা ছোঁয়া দিয়ে চলে গেল৷ মেঘ ডাকল৷ বিদ্যুৎ চমকাল৷ কাছেপিঠে বাজ পড়ল৷ ভেসে উঠল সন্ন্যাসীর মায়ের দীর্ঘকায় ঝলসানো মূর্তি৷ সে ভয় পেল৷ বালিশে মুখ চাপা দিল৷ একটু পরে দরজায় খুট শব্দ হল৷ হাসিকে চাইল শিশির৷

আবার বৃষ্টি ঝরছে৷ দাপট তুলনায় কম৷ আবহাওয়া দপ্তর বলেছে, দফায় দফায় মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টি হবে৷ বজ্রপাতের সম্ভাবনা৷ ঝোড়ো হাওয়া বইতে পারে৷ বিছানা থেকে উঠে শিশির জানালার পর্দা সরায়৷ আলো জ্বালে৷ চোখে পড়ে টেবিলের ওপর একটা খাম৷ চিঠি এল? শেরপুর থেকে? পোস্টাফিসের স্ট্যাম্প নেই৷ হাতে এল কি? খামের ওপর ইংরেজি হরফে শিশির চৌধুরীর নাম৷ খামের একপ্রান্ত সন্তর্পণে ছেঁড়ে৷

বউদি, মেঝে ভেসে গেল৷ এসো দেখে যাও কী অবস্থা ঘরের৷ সারারাত জেগে বসে থাকতে হবে৷

দিদি, আমাদের ঘরটাও দেখে যাও৷ ভাঙা জানালা দিয়ে জলের ছাঁট এসে তক্তপোষ ভিজিয়ে দিয়েছে৷ সরাব কোথায়? শাশুড়িকে রাখি কোথায়? দিদি, আমরা মাসের ভাড়া মাসে মাসে দিই তো! তবু এত ছিদ্দৎ কেন কপালে৷

শিশিরবাবু কই? একমাস ভাড়া দিতে দেরি হইলে কী চোটপাটই না করেন৷ এখন কই তিনি? দরজার সামনে দিয়া বাথরুমের জল যায়৷ আসেন, শুইঙ্গা যান কেমন গন্ধ ছাড়তাছে৷ কী কমু আপনেগো, বড়োলোক মানুষ, পাকিস্তান থেইকা আপনেগো ট্রাংকভরতি টাকা আসে, সোনাগয়না আসে৷ আমরা খেদাখাওয়া পোড়াকপাল, ইচামাছ টুকাইয়া খাই আর বিছার লগে শয়ন যাই, মানুষ ছিলাম পার্টিশনের আগে, পরে আর নাই৷ নেহরু-জিন্নার লালসা আমাগো সব খাইছে৷ ওই শয়তানগুলা না জন্মাইলে দেশের মানুষ দেশেই থাকতে পারতাম৷ এই নরকে উঠতে হইত না৷ শিশিরবাবু, আপনেরা বড়োমানুষ নিজেগো জায়গা কী সুন্দর গুছাইয়া নিছেন৷ আপনেগো ঘরে জল পড়ে? পড়ে না৷ আপনেগো দরজায় গু ভাসে? ভাসে না৷

বাবা থামো৷ কাশি উঠবে৷ ও-সব বলে লাভ কী?

শিশিরের কানে আসে৷ চেয়ারে বসে সে খাম থেকে চিঠি বের করে৷ মায়ের হাতের লেখা৷

মা লিখেছে: আদরের খোকা, প্রথমে তোমরা আমাদের প্রীতি ও শুভকামনা জানিবে৷ আশা করি তোমরা সকলে সর্বকুশলে আছ৷ এইখানকার পরিস্থিতি বিশেষ সুবিধার নহে৷ দিনে দিনে খারাপ হইতেছে৷ পরিস্থিতি অবগত করাইবার জন্য তোমার পিতাঠাকুরের নির্দেশে চিঠি লিখিতেছি৷ কিছুদিন পূর্বে আমাদের দোকানের সম্মুখে বড়োরকমের গোলমাল হয়৷ রাজিবুল মণ্ডলের বড়োছেলে দোকানে আসিয়া বলে যে, তাহার ভাইয়ের জামা ও প্যান্টের অধিক মূল্য লওয়া হইয়াছে৷ তাহারা দল বাঁধিয়া আসে৷ অবিনাশ তাহাদের বুঝানোর চেষ্টা করে৷ তাহারা অবিনাশকে চড়চাপড় মারে৷ ইতিপূর্বে এইরূপ ঘটনা কখনো ঘটে নাই৷ রাজিবুল মণ্ডল আমাদের পুরানা খরিদ্দার৷ তাহার নিকট বহু টাকা পাওনা আছে৷ তোমার পিতাঠাকুর রাজিবুল মণ্ডলকে দেখা করিতে বলিয়াছে৷ সে আসে নাই৷ মাসুদুর রহমান বলিয়াছে, এইরূপ আরও ঘটিবে৷ লোকঠকানো ব্যাবসা আর চলিবে না৷ দরকার হইলে দোকান উঠাইয়া দিবে৷ মারধরও হইতে পারে৷ মাসুদুর প্রকাশ্যে এইসব বলিতেছে৷ তোমার পিতাঠাকুর থানায় গিয়াছিলেন৷ বড়োবাবু ভরসা দিতে পারেন নাই৷ বলিয়াছেন, সাধারণ মানুষ আপনাদের উপর ভীষণ চটিয়া আছে৷ আমাদের দোকান হইতে একমাইল উত্তরে করিমসাহেবের মোকাম৷ শুনা যায়, করিমসাহেব এই গণ্ডগোলের পিছনে৷ তিনি অবশ্য স্বীকার যান নাই৷

খোকা, দেশটা আর আমাদের নাই৷ খাতায় কলমে আমরা নাগরিক৷ কিন্তু এই দেশের মানুষ আমাদের স্বীকার করে না৷ বহুকালের চেনাজানা মানুষদের মুখের ভাষা পালটাইয়া গিয়াছে৷ উহারা চায় আমরা যেন এখনই চলিয়া যাই৷ কেন যাইব সে-উত্তর নাই৷

বেশি দূরে নয় বাজ পড়ল৷ শিশির দেখতে পেল সন্ন্যাসীর মায়ের ঝলসানো দীর্ঘ দেহ নিমগাছের হেলানে খাড়া৷

মা লিখেছে: মহাজনের ঘর হইতে আমাদের দোকানে মাল আনিতে বাধা দেওয়া হইতেছে৷ পথে মালের গাড়ি আটকানো হইতেছে৷ পুরাতন খরিদ্দারদের ভয় দেখানো হইতেছে৷ ধারের টাকা আদায়ের আশা আর নাই৷ ধারের টাকা মিটাইতে নিষেধ করিতেছে পাড়ার গউণ্ডাপ্রকৃতির ছেলেরা৷ বারোপাল্লার দোকানের চারিপাল্লা পূর্বেই বন্ধ হইয়াছে৷ এরপর কী হয় ঈশ্বরই জানেন৷ অবিনাশ ভারতে চলিয়া যাইবে বলিয়া মনস্থ করিয়াছে৷ তাহার মেয়ে বড়ো হইয়াছে৷ সেদিনের ঘটনায় সে মর্মাহত৷ সন্তানের মতো ছেলেপুলেদের হাতে চড়চাপড় খাইতে হইবে ইহা সে কোনোকালে ভাবে নাই৷ সেলিম ভাইরা ভরসা দিতে পারিতেছেন না৷ প্রতিবেশীদের মতিগতি ভালো নহে৷ বিভিন্ন জায়গা হইতে খবর পাই হিন্দুরা দেশত্যাগ করিতেছে৷ কোনো কোনো পাড়া হিন্দুশূন্য হইয়াছে৷ আমাদের দেশ আর আমাদের জন্য নিরাপদ নহে৷

শিশিরবাবু, ব্যবস্থা কিছু তো করবেন৷ নাকি এই অবস্থা চলবে৷ শোবার জায়গায় জল, রান্নার জায়গায় জল৷ থাকি কীভাবে? তুলে দিতে চান? আমাদের তুলে দিয়ে বেশি ভাড়ার ভাড়াটে বসাবেন? ঘর মেরামত না হলে আমি আর ভাড়া দেব না, স্পষ্ট বলে দিলাম৷ ক্লাবের কিছু ছেলে আমাকেও চেনে৷

মা লিখেছে: পাড়ায় একটা দমবন্ধ ভাব৷ আমরা প্রায় নিঃসঙ্গ৷ হিন্দুঘর যাহারা আছে তাহারা আমাদের এড়াইয়া চলে৷ বুঝিতে পারি, তাহারা বাঁচিতে চায়৷ কিন্তু বাঁচিতে পারিবে কি? তোমার পিতাঠাকুর উমেশবাবুদের সঙ্গে কথা বলিয়াছিলেন৷ তাঁহারা হুঁ হাঁ করিয়া কাটিয়া পড়েন৷ বুঝা যাইতেছে আমাদের কোনো অপ্রীতিকর অবস্থায় পড়িতে হইলে কেহ আসিবে না৷ মোহনবাবু পরিষ্কার বলিয়া দিলেন, আমাদের ঘরের মেয়েরা বড়ো হইয়াছে৷ তাহাদের বিপদে ফেলিতে পারি না৷ আপনি তো আপনার পুত্রকন্যাকে ইন্ডিয়ায় আগেভাগে সুব্যবস্থা করিয়া রাখিয়াছেন৷ তখন তো আমাদের ঘরের কথা ভাবেন নাই৷ এইপ্রকার ভয়প্রদ অবস্থার মধ্যে আছি৷ তোমার পিতাঠাকুরের মতো শক্ত মনের মানুষও ভাঙিয়া পড়িতেছেন৷ তাঁরই নির্দেশে এই পত্র লিখিলাম৷ তোমাদের দুশ্চিন্তা বাড়িবে, জানি৷ তোমার পিতাঠাকুর কহিলেন, দেশ ছাড়িলে উপার্জন বন্ধ হইবে৷ ঘরবাড়ি বেচিয়া ন্যায্য দাম পাইবার সম্ভাবনা নাই৷ বারোপাল্লার দোকানও জলের দরে বেচিতে হইবে৷ নানারকম পাকেচক্রে ফেলিয়া উহারা ন্যায়সংগত দাম দিবে না৷ এইরকম অবস্থায় পড়িতে হইবে কখনো ভাবি নাই৷ জীবনের শেষভাগে আসিয়া এইরূপ হইল৷ ঠাকুর কপালে আরো কী লিখিয়াছেন কে জানে! আমরা ইন্ডিয়ায় গেলে কী অবস্থায় পড়িতে হইবে তাহাও তোমার পিতাঠাকুর ভাবিয়াছেন৷

শিশিরবাবু কি ঘরে আছেন? থাকলে একটু বাইরে আসেন৷ নিজের চোখে দেখে যান৷ বউদিমণিকে বলে কী লাভ! উনি তো আমাদের সুরাহা দিতে পারবেন না৷ দেখে যান জল পড়ে উনুনের মাটি গলে গেছে৷ দুটো ভাত-ডাল ফুটিয়ে নেবার উপায় নেই৷ কিছু মনে করবেন না আপনি নাটক ভালো করেন৷ আমরা নাটক করি না৷ ভাড়া দিই থাকি৷ আমাদের নাটকে নামালেন কেন? ভাড়া কম দিই এই অপরাধে? কত নাটক করেন৷ হাততালি পান৷ দশ-বিশটা টালি বদলে দিতে পারেন না৷

সন্ন্যাসীর মায়ের ঝলসানো দেহটা ভেসে ওঠে৷ শিশির ভাবে, ভাড়াটেরা যদি একসঙ্গে তার ঘরের দরজায় জড়ো হয়, সে কী করবে?

মা লিখেছে: তুমি রোজগারের ব্যবস্থা করিতে পারো নাই৷ চাকরির বয়স আর নাই৷ ব্যাবসা করিয়াছিলে৷ লোকসানে ডুবিয়াছ৷ তোমার স্ত্রী ও দুই কন্যা আছে৷ তাহাদের খরচ ভাড়ার টাকায় কোনোক্রমে এখন চলিয়া যায়৷ কন্যাদের লেখাপড়ার খরচ বাড়িলে চালাইবে কোন উপায়ে? তোমার স্বভাবের দরুন খুকুর ভালো বিবাহ হইতে পারে নাই৷ সে নিজে পাত্র বাছিয়া পালাইয়াছে৷ জামাইয়ের এখন চাকরি নাই৷ তাহাদের কীভাবে চলিতেছে ভগবানই জানেন৷ দোকানের অনেক টাকা তোমাকে দেওয়া হইয়াছে৷ সে-সবই কি নষ্ট করিয়াছ? তোমার পিতাঠাকুর আবার কিছু টাকা পাঠাইবেন৷ আশরফ সাহেবের হাতে৷ একমাত্র তিনিই আমাদের শুভানুধ্যায়ী৷ তিনি কথা দিয়াছেন দোকানের ভালো দাম মিলিবে৷ সম্ভবত তিনিই কিনিবেন৷ এই পত্রও তাঁহার হাতেই পাঠানো হইল৷ তুমি শীঘ্র একটা উপার্জনের ব্যবস্থা করো৷ মনে রাখিবে, গহনায় হাত দিবে না৷ কোনো কারণেই না৷

হাসিকে ও দুই নাতনিকে আমাদের শুভাশিস জানাইবে৷ পত্র দীর্ঘ হইল৷ তোমার পিতাঠাকুরের নির্দেশমত লিখিলাম৷
ইতি— আশীর্বাদিকা মা৷

তার মানে, হাসি ঘরে এসেছিল৷ চিঠি রেখে গেছে৷ শিশিরকে ডাকেনি৷ সাহস বেড়েছে৷ এরকম চিঠি আগেও এসেছে৷ তার কোনো একটি বা দু-টি কি পড়েছে হাসি? শিশিরই হাসিকে পড়তে শিখিয়েছিল। সে তখন বালিকা বধূ৷ সাহসটা তবে শিশিরই দিয়েছে?

আমি অতুলকথা বলছি:
বাজবাদলের দুপুরে শিশির চৌধুরীর ঘরের ভেতরকার ঘটনা শুনেছি কানুদার মুখে৷ গোলামালিকের ছেলে কানু দাশের সঙ্গে বিশেষ সখ্য ছিল শিশির চৌধুরীর৷ দু-জনে অস্থানে কুস্থানে যেত৷ টাকা জোগাত কানুদা৷ বাজবাদলের দুপুরের ঘটনার বিবরণে কিছু প্রক্ষেপ থাকতে পারে৷ যেমন, কানুদা নিজের মতো করে কিছু অংশ ঢুকিয়ে দিয়েছে৷ আমিও হয়তো কিছু মিশিয়েছি৷ শিশির চৌধুরীর স্ত্রী হাসিকে আমি বহুবার দেখেছি৷ খুবই সুন্দরী৷ মুখে সবসময় হাসি৷ কথা বলতে শুনেছি কমই৷ আর পাঁচজনের থেকে আলাদা৷ সন্ন্যাসীর মা-র দীর্ঘ ঝলসানো শরীর আমি দেখেছি৷ ভয়ংকর৷ চিঠিটাও হয়তো দেখেছি৷ কারণ, একটা প্রশ্ন আমার মাথার ভেতর মাঝে মাঝেই গুঁতো মারে, হিন্দু আর মুসলমানদের সম্পর্কটা হঠাৎই এতটা বিষিয়ে গেল? এতদিনের মানুষ পরিচয়টা মুছে গেল? এরকমটা হতে পারল কেন? শুধুই রাজনীতির প্রতিক্রিয়া? নাকি এতদিনের সম্প্রীতির ন্যারেটিভটা নিছক মনভোলানো?