Categories
2023-Sharodiyo-Golpo

সোহম দাস

টিকটিকি

সকালে বাথরুমে গিয়ে কমোডে বসার পরেই টিকটিকিটাকে দেখতে পেল মণি।

আজ খানিক তাড়াতাড়িই ঘুম ভেঙেছে তার। অন্যদিন আটটার আগে চোখ খুলতেই চায় না। আজ একেবারে এক ঘণ্টা আগেই। অবশ্য কারণও আছে। গতকাল রাত আটটা অবধি ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে থাকতে হয়েছে। না থেকে উপায়ও ছিল না। যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, বা বলা ভালো, তৈরি করা হয়েছে, তার মধ্যে টিকে থাকতে গেলে এ-পথ ছাড়া উপায় নেই।

ক্যাম্পাস থেকে একবার থানায় যেতে হয়েছিল তাকে আর পড়শি বিভাগের অয়নেন্দুদাকে। অয়নেন্দুদা অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর। থানায় যাবতীয় কাজকর্ম সেরে, বয়োজ্যেষ্ঠ সহকর্মীকে ক্যাব বুক করে তুলে দিয়ে মণি নিজে যখন বাড়ি ফিরল, তখন বাজে সাড়ে দশটা। ফিরে এসে চান করে, কোনোরকমে দু-টো রুটি আর একটু আলুভাজা খেয়ে এগারোটায় শুয়ে পড়েছে সে। শরীর আর দিচ্ছিল না।

কৃতি অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করবে বলে উসখুস করছিল। মণি ওর হাত দুটো ধরে বলে দিল – “আজ নয়, বুড়ি, কাল বলব সব। সারাদিন বড্ড ধকল গেছে। আজ শুয়ে পড়ি।”

মণির চোখের ক্লান্তির দিকে তাকিয়ে বুড়ি ওরফে কৃতি আর কিছু বলেনি।

তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ার দরুন ঘুমও ভাঙল নির্ধারিত সময়ের আগে। জানলার সিলে রাখা চশমাটা নিয়ে সে আগেই মোবাইলটা খুলে দেখেছে। নেট পরিষেবা চালু করতেই একগুচ্ছ নোটিফিকেশন। চারটে নিউজ লিঙ্ক, বেশ কয়েকটা হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ, একটা মেইল, ইত্যাদি ইত্যাদি।

হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজের মধ্যে অয়নেন্দুদার মেসেজ দেখে সেইটেই কেবল খুলল সে। গতকাল রাতেই পাঠানো। তিনি লিখেছিলেন – “পৌনে এগারোটা নাগাদ ফিরলাম। তুই ফিরেছিস তো ঠিকঠাক? কাল আমার যেতে দেরি হবে। তোর বৌদির চেক-আপ আছে সকালে। তোরা আমার জন্য ওয়েট করিস না, যেমন শিডিউল আছে, শুরু করে দিস।”

অয়নেন্দুদাকে যথাযোগ্য উত্তর পাঠিয়ে মণি উঠে পড়েছিল। বর্ষার সময়ে সকালবেলায় একটা ঠাণ্ডা হাওয়া বয়, ফলে কৃতি শোওয়ার সময়ে বালিশের পাশে হালকা চাদর রেখে দেয়। ভোরে উঠে গায়ে জড়িয়ে নেয়। আজ মণি আগে উঠেছে, ফলে, দেখতে পেল, চাদরটা কৃতির গা থেকে সরে গিয়েছে। মণি বড়ো যত্নের সঙ্গে আদরের স্ত্রীর গায়ে চাদরটা আবার দিয়ে দেয়। ওর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকায়। কাল রাতে বড়ো দুশ্চিন্তায় ছেয়ে ছিল ওই মুখটা, দরজাটা খুলতেই সেটা লক্ষ করেছিল মণি। কিন্তু, সত্যিই সে কাল বড়ো ক্লান্ত ছিল, সারাদিনের লড়াইয়ের কথা আর বলতে ভালো লাগছিল না। এখনও কি সেই দুশ্চিন্তা লেগে আছে ওই মায়াবী মুখে? না, অন্তত মণি সেরকম কিছু খুঁজে পায়নি।

কৃতির ওঠার সময় ঘড়ি ধরে ঠিক সাড়ে সাতটা। উঠেই সোজা বাথরুমে আসবে, আধঘণ্টার আগে বেরোবে না। এ-সব অন্যদিন মণি জানতে পারে না, তখন সে গভীর ঘুমে। আজকে পরিস্থিতি আলাদা। মণি তাই সময় নষ্ট না করে বাথরুমে এসে ঢুকেছিল। সঙ্গে নিয়ে এসেছিল মোবাইলটা। মোবাইলের স্ক্রিন দেখতে দেখতে দিব্যি কমোডের কাজ সারা হয়ে যায়। অবশ্য এই মোবাইল আনার ব্যাপারটা করতে হয় কৃতিকে লুকিয়ে। জানতে পারলেই চেঁচাবে। আজ ঘুমোচ্ছে যখন, তখন সে-ব্যাপারে নিশ্চিন্তি।

অন্যদিন দেরি করে বাথরুমে আসে, শরীরের নিজস্ব ঘড়িটাও সেই অনুযায়ী তৈরি হয়েছে। ফলে, কমোডে বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকার পরও কোনও নিঃসরণ নেই। মণি সময় কাটাতে মোবাইলটা খোলে।

গতকাল রাতে নেট আর চালু করেনি সে। ফেসবুকে আরও নতুন কী তত্ত্ব প্রকাশিত হল, কে জানে! কমোডে বসে তাই প্রথমেই ফেসবুকটা খুলেছিল সে। একটা চেনা নামের প্রোফাইলের লেখা দেখে সেটাই আগে পড়বে বলে ঠিক করে। দু-লাইন সবে পড়েছে, এমন সময়ে টিকটিকিটা এসে পড়ল তার পায়ের ওপর। বাথরুমের দেওয়ালের গায়ে সাদা টাইলস বসানো। টিকটিকিটা সেই মসৃণ টাইলসের গা বেয়ে ওঠার চেষ্টা করেছিল কোনও কারণে। কোনও কারণে ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলেছিল, ফলে পতন।

আর, পড়বি তো পড়, একেবারে মণির ডানপায়ের পাতার ওপরে।

চমকে উঠল মণি। ডান পা-টা নড়ে উঠল তার। সঙ্গে সঙ্গে তার পা ছেড়ে প্রাণীটা বাঁ-দিকের কোণে ছুটল। ওখানে মেঝেতে ঝাঁঝরির মুখ। ঠিক তার উপরেই কল ফিট করা আছে। কলের সঙ্গে যুক্ত করা আছে একটা হ্যান্ড শাওয়ার। ঝাঁঝরির সামনে গিয়ে থেমে গেল টিকটিকিটা।

মণি বাঁ পা-টা মেঝেতে ঠুকল একবার। টিকটিকি দেখলেই এমন করা তার আশৈশব অভ্যাস। ঝাঁঝরিতে লোহার শিক বসানো। জং ধরে গিয়ে তাদের আসল রং বহুবছরই বিলুপ্ত। একটা শিকের মাঝখান থেকে ভাঙা। সেখানে দিব্যি একখানা ফাঁক তৈরি হয়ে আছে। মণির পা ঠোকায় ভয় পেয়ে সেই ফাঁক গলে ভিতরে ঢুকে গেল মাঝারি আকারের সরীসৃপটা।

তারপর, সোজা নামতে শুরু করল গর্তের নীচের দিকে। ভয়ে বুক কেঁপে উঠল মণির। আর কিছুটা নামলেই যে ঘন অন্ধকার, সে অন্ধকারে তলিয়ে যাবে ওর ছোট্ট শরীর। অজান্তেই মণির মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল – “হে—!”

ভয়ের চোটে খানিক জোরেই চেঁচিয়ে ফেলেছিল মণি। কিন্তু, ‘ই’ শব্দটা বেরিয়ে আসার আগেই সে নিজের মুখ চেপে ধরল। কৃতি এখনও ওঠেনি, এই চিৎকারে যদি তার ঘুম ভেঙে যায়!

যদিও দু-টো ঘটনার কোনোটাই ঘটল না। টিকটিকিটা তলিয়ে গেল না, বরং অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় শরীরকে একশো আশি ডিগ্রি ঘুরিয়ে নিয়ে উর্ধ্বমুখী হয়ে আটকে থাকল গর্তের দেওয়ালে। কৃতিরও ঘুম উঠে পড়ার কোনও লক্ষণ শুনতে পেল না মণি।

ঝাঁঝরির নীচে গাঢ় অন্ধকার। কলের জল, হাত-ধোওয়া জল, সাবানগোলা জল, প্যান-ক্লিনার ভরা জল, সব গিয়ে জমা হয় ওই অন্ধকারে। তারপর, পাইপলাইনের গিরিখাত বেয়ে হারিয়ে যায়। পাইপ কেবল অন্ধকারকে ধরে রাখে, জলকে নয়।

টিকটিকিটা এখন সেই অন্ধকারের একটু উপরে আটকে রয়েছে। গত দশ বছরের জল পড়ে পড়ে গর্তের দেওয়ালে জন্মেছে ঘন শ্যাওলা। ওই শ্যাওলার দেওয়ালে চারহাত আঁকড়ে টিকটিকিটা স্থির হয়ে আছে।

কিন্তু কতক্ষণ ওভাবে থাকবে? জলের মতো ও-ও যদি ওই অন্ধকারে হারিয়ে যায়? সেক্ষেত্রে পাইপের মধ্যে দম আটকে মারা যাবে সরীসৃপটা। তার অভিঘাত কী কী হতে পারে?

মণি ভাবার চেষ্টা করল।

প্রথমত, নিঃসৃত জলের মতো ওর খুদে মৃতদেহ পাইপ দিয়ে বেরিয়ে যাবে না, পাইপের মুখে গিয়ে আটকে যাবে, সঙ্গে হয়তো আটকে দেবে জলের অবাধ প্রবাহকে। তাতে কি গোটা অ্যাপার্টমেন্টের জলের লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হবে? এটা মণির সত্যিই জানা নেই। অনেক বিষয়ের মতো এটাও অজানা রয়ে গিয়েছে! আজকে এই ঘটনার আগে পর্যন্ত গত দশ বছরে এমন কিছু ঘটেওনি যাতে এই ভাবনা তার মনে উদয় হয়। ফ্ল্যাটটা কেনার সময়ে পাইপলাইন সিস্টেমটা নিয়ে আরেকটু বিশদে জেনে নেওয়া দরকার ছিল। মণি কেমন অসহায় বোধ করে।

আজকেই কোনও ইঞ্জিনিয়ার-বন্ধুকে ধরে জেনে নেওয়ার চেষ্টা করবে পাইপলাইনের কার্যপ্রণালীটা।
দ্বিতীয়ত, টিকটিকিটা মরে গেলে কিছুক্ষণের মধ্যেই ওর শরীরে পচন ধরবে। ইংরাজিতে যাকে ‘রাইগর মর্টিস’ বলে। পুরো প্রক্রিয়াটা সেই স্কুলবেলায় জীববিজ্ঞানের বইতে পড়েছিল, এতদিনে ভুলে যাওয়ারই কথা। তবে এটুকু মনে আছে, ব্যাপারটা ধাপে ধাপে হয়। কোনও একটা ধাপে, গন্ধ বেরোনো শুরু হয়। বোধহয়, দ্বিতীয় কি তৃতীয় ধাপেই। টিকটিকি মরলে কতক্ষণ পরে গন্ধ বেরোনো শুরু হবে, সেটা সে জানে না। এদের শরীরে বিষ থাকে বলেও শুনেছে মণি, সেক্ষেত্রে ওই শরীর-পচা গন্ধে জলের লাইনটাই পুরো বিষাক্ত হয়ে যাবে কিনা, সেটাও তার অজানা।

বন্ধুতালিকায় কোনও প্রাণীবিদ নিশ্চয়ই আছে, সে-রকম একজনকে পাকড়ে এই খুদে সরীসৃপদের ফিজিওলজিটাও জেনে নিতে হবে, আজকেই।

এই দুটো ভাবনা ছাড়া আরও একটা চিন্তা আচ্ছন্ন করে ফেলল মণিকে। টিকটিকি মরে যদি গন্ধ ছড়ায় পাইপলাইন জুড়ে, প্লাম্বার ডাকা হবে, সে এসে খুঁজে বার করবে গন্ধের উৎস, অনুসন্ধানে ধরা পড়বে মণির বাথরুমের সঙ্গে সংযুক্ত পাইপলাইনেই টিকটিকি মরেছে, অ্যাপার্টমেন্টের সমস্ত লোক তাকে প্রশ্ন করা শুরু করবে, কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে মণি কোনও ঠিকঠাক জবাব দিতে পারবে না, সমস্যা সমাধানে কমিটির মিটিং ডাকা হবে। পুরো পরিষ্কারের খরচটা মণিকেই দিতে হবে হয়তো, অথবা, অন্য কোনও সমাধানও উঠে আসতে পারে। এই যেমন, পাবলিক নুইসেন্সের অভিযোগ তুলে তাকে ফ্ল্যাট ছাড়ার আইনি নোটিশ ধরানো।

দশবছর আগে তৈরি হওয়া এই ফ্ল্যাটে পাঁচবছর আগে এসেছে সে আর কৃতি। চারিদিক খোলামেলা দেখে পছন্দ হয়েছিল তাদের। কৃতি স্বভাব-মিশুকে, দিনচারেকের মধ্যেই উপরতলা, নিচতলার কয়েকটা পরিবারের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে ফেলার চেষ্টা করল। বাঁধা কিছু প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছিল, বর কী করে, তুমি কী করো, এতবছর বিয়ে হয়েছে, এখনও ওই ব্যাপারে কিছু ভাবোনি কেন, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু, মণির পুরো নামটা তখনও তারা জানতে পারেনি। সেটা জানল দিনকয়েক পরে, যখন কাঠের দরজায় নেমপ্লেট বসল, ফ্ল্যাট – ২সি, তার নীচে পরপর দুজনের নাম – কৃতি চ্যাটার্জি, মণিরুজ্জামান মণ্ডল। সেটার পর থেকেই কৃতি লক্ষ করেছে, লোকজনের হাবেভাবে খানিক পরিবর্তন, আর সেভাবে সহজ হতে পারছে না কেউ। মণিকে সঙ্গে সঙ্গেই জানিয়েছিল। মণি তখন অত পাত্তা দেয়নি, স্বাভাবিক অস্বস্তি, কিছুদিন পরে কেটে যাবে, এমন বলে আশ্বাস দিয়েছিল স্ত্রীকে। কিন্তু আজকে, এই ঘটনার ছুতো পেয়ে তাদের যদি এখন উঠে যেতে বলে, তখন আবার বাসা খোঁজা… মণি আর ভাবতে পারল না, শক্ত হয়ে এল তার শরীর।

কিন্তু আইনি নোটিশ কি এভাবে ধরানো যায়? বন্ধু কিংশুককে একবার জিজ্ঞাসা করতে হবে, কিংশুক এখন বড়ো বড়ো কোম্পানির লিগ্যাল প্রসিডিওর দেখাশোনা করে। কোনও পরামর্শের প্রয়োজন হলেও ও-ই দিতে পারবে।

মণি এতক্ষণ খেয়াল করেনি, হাতে মোবাইলটা ধরাই ছিল। খেয়াল হতেই মনে পড়ল, এতক্ষণ ধরে সে বন্ধুবান্ধবদের জিজ্ঞাসা করার কথা ভেবে চলেছে, অথচ, গুগলের কথাটা একবারও ভাবেনি। এসব অস্বস্তিকর ব্যাপার বন্ধুবান্ধবদের জিজ্ঞাসা করলে হাসির খোরাক হওয়ার সম্ভাবনা আছে, অন্য সন্দেহও ধেয়ে আসতে পারে। আজকাল কিছুই অসম্ভব নয়। তার চেয়ে গুগলে সার্চ করাই তো ভালো বিকল্প। সেক্ষেত্রে জানাজানি হওয়ার কোনও বিপদ নেই। জানলে জানবে কেবল গুগলের সার্ভার।
কিন্তু ব্রাউজার খুলে সার্চ করতে গিয়ে মণি দেখে, তার আঙুল সরছে না। ভয়ে দুশ্চিন্তায় তার হাত বুঝি অসাড় হয়ে গিয়েছে।

মোবাইলে সময় দেখাচ্ছে, সাতটা কুড়ি। মণি বাথরুমে ঢুকেছে সাতটা দশের একটু আগে। মাত্র এগারো-বারো মিনিটেই এত কিছু ঘটে গেল!

কয়েক মিনিট পরে কৃতিও উঠে পড়বে, উঠে পড়ে সোজা বাথরুমে আসবে। বাথরুমে মোবাইল নিয়ে আসার মতো টিকটিকি প্রাণীটিকেও সে চরম অপছন্দ করে। ঘেন্নাই করে, বলা যায়।
সে উঠে পড়ার আগে যা করার করতে হবে।

কোনো একটা কার্যকরী উপায় ভাবা দরকার। কিন্তু, উপায় ভাবতে গেলে আগে মনকে শান্ত করতে হবে। এবং, মন শান্ত করতে হলে এই একগোছা দুশ্চিন্তাকে ঝেড়ে ফেলতে হবে, সকালের পায়খানার মতো।

অতএব, মণি অন্য ভাবনায় মন দেওয়ার চেষ্টা করল।

টিকটিকিটা এখনও ঠায় সেভাবে আটকে আছে। কতক্ষণ ওভাবে… না, ভাবতে গিয়েও মাঝপথে ভাবনা বন্ধ করে দিতে চাইল মণি। কথার মতো ভাবনাকেও যে এভাবে আটকানো যায়, ওই পাইপলাইনের কার্যপ্রণালী বা টিকটিকির শারীরবিদ্যার মতো এটাও এতক্ষণ অবধি মণির অজানা ছিল। অন্যভাবে ভাবলে টিকটিকিটা ওই গর্তে সেঁধিয়ে গিয়ে মণির একপ্রকার উপকারই করছে।
এ-কথাটা মনে উদয় হতেই তার ভালোলাগাটা বাড়ল। বুকের ধুকপুকানিটাও খানিক কমল বোধহয়। শরীরের সার্বিক কাঁপুনি ভাবটাও কমল। এই তো, ভালো দিকগুলো দেখতে পাচ্ছে সে।

টিকটিকিটা প্রথম যখন গর্তে সেঁধোল, সেই মুহূর্তটায় ফিরে গেল মণি। সোজা ঢুকে যাচ্ছিল নীচের দিকে, কিন্তু বিপদ বুঝে নিয়েই কী অসম্ভব গতিতেই না আবার সঠিক দিকে ঘুরিয়ে নিল শরীরটাকে! খুদে জীবের এমন সহজাত ক্ষমতাকে তারিফ না করে কি থাকা যায়?

খালধারের রাস্তার সেই চড়াই পাখিটার কথাই যেমন। মণির নিশ্চয় মনে আছে। তখন সে কলেজে পড়ে। বাড়ি থেকে স্বল্প দূরত্বে কলেজ, সাইকেলেই যাতায়াত। একদিন বিকেলে ফেরার পথে ঘটেছিল ঘটনাটা। খালধারের রাস্তায় একটা কাগজফুলের গাছ ছিল, সে গাছ থেকে চড়াই পাখিগুলো উড়ে উড়ে যেত রাস্তার অন্য পাশে। কী যে উদ্দেশ্য ছিল, তা মণি জানত না। সেদিন, ওদেরই মধ্যে একজন, বেশ নীচ দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময়ে এসে পড়ে মণির সাইকেলের চাকার একদম সামনে। সাইকেলের ধারালো, জং-ধরা স্পোকে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে মোলায়েম পালকশরীর, এই ভেবে সেদিনও মণি ‘হেই’ বলে চেঁচিয়ে ওঠে।

কিন্তু, সেদিনও মণিকে অবাক করে দিয়ে ছোট্ট চড়াইটা দেহটাকে দিব্যি একশো আশি ডিগ্রি ঘুরিয়ে নিয়ে ফিরে গিয়েছিল কাগজফুলের গাছটায়। মণি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে পড়েছিল সাইকেল নিয়ে। ঘোর কাটতে চাইছিল না তার। খালপাড়ের রাস্তা দিয়ে তখন অবিরাম রিক্সা, সাইকেল, বাইক। কেউ বুঝছেই না, এইমাত্র কী অত্যাশ্চর্য এক ঘটনা ঘটে গেল, তার একমাত্র সাক্ষী অন্নদাচরণ কলেজের বি. এ. ইংলিশের ছাত্র মণিরুজ্জামান। দু-একজন কেবল তার ‘হেই’ শুনে এ-দিকে তাকিয়েছিল, তার বেশি কোনও ভাবান্তর ঘটেনি খালপাড়ের নিস্তরঙ্গতায়।

এই ধরনের ক্ষমতার নিশ্চয়ই কোনও বৈজ্ঞানিক নাম আছে, সে নাম গালভরাও হতে পারে। কিন্তু তখন সে এসব ভাবেনি। তার মাথায় ঘুরছিল অন্য এক ভাবনা।

আব্বার আব্বাকে সে দেখেনি। গল্প শুনেছে মাত্র। সে লোকটা যৌবন বয়সে কংগ্রেস করত, সত্যাগ্রহী হয়েছিল, খদ্দরের ধুতি ছাড়া পরত না। জেলও খাটে কয়েকবার। ’৪৭-এর পর পেট চালাতে একখানা দর্জির দোকান দেয়। চরকা সরে গিয়েছে ততদিনে, সেই জায়গায় বসেছে সস্তার সেলাই মেশিন। মফঃস্বল শহরের একচিলতে পাড়ার একচিলতে দোকানঘরে সকাল-বিকেল খং খং শব্দে সেলাই মেশিন চলত। দুপুরে কিছুক্ষণের জন্য কেবল বিশ্রাম। দোকানঘরের খোলা জানলা দিয়ে প্রায়ই ঢুকে আসত দু-একটা চড়াই, ডিসি পাখার ব্লেডে ঘ্যাচাং-ঘ্যাচ কাটা পড়ত তারা, দাদুর সাদা ধুতিতে লেগে যেত রক্তের দাগ। দাদি নাকি অনেক চেষ্টা করেও সে দাগ তুলতে পারত না!

ওই চড়াইগুলো বুঝি খালধারের চড়াইদের চেয়ে আলাদা হত, তাদের অমন রিফ্লেক্স ছিল না, তাই কাটা পড়ত যখন-তখন, এরকমই একটা কিছু মাথায় এসেছিল সেদিন।

টিকটিকিরাই তো চড়াইদের পূর্বপুরুষ। সেই যে জীববিজ্ঞানের বইতে পড়েছিল একসময়ে, জার্মানির ব্যাভেরিয়া অঞ্চলে প্রথম পাওয়া গিয়েছিল আর্কিওপটেরিক্স নামের এক প্রাণীর ফসিল। সরীসৃপ থেকে পাখিতে রূপান্তরপর্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধি। অনেকেই বলে, ডানাওয়ালা ডাইনোসর। এমন ক্ষিপ্র প্রতিবর্ত ক্ষমতা হয়তো এদের থেকেই পেয়েছে পাখিরা, তেমনটা ভাবতে ক্ষতি কী!

খুদে জীবটা এখনও সেভাবেই আটকে রয়েছে গর্তে। সেই একইরকম স্থির। মণি অনুভব করল, সে আগের থেকে খানিক স্বাভাবিক বোধ করছে। ব্রাউজারে এবার খোঁজ করার চেষ্টা করা যেতে পারে। গুগলটা খুলে সার্চ বারে টাইপ করতে গিয়ে আবারও থেমে গেল। এবার আর আঙুলে অসাড়তা নেই, থেমে যাওয়ার কারণ অন্য। একাধিক ভাবনা সে ভেবে ফেলেছে এই কয়েক মিনিটে। কোনটা আগে খুঁজবে?

এক মুহূর্ত স্থির থেকে টাইপ করল – “can house geckos hold on to mossy surface?”

অজস্র লিঙ্ক খুলেছে। কিন্তু কোনোটাতেই ঠিকঠাক ব্যাখ্যা আছে বলে মনে হল না। একটা লিঙ্কে পাবে ভেবে খুলতে গিয়ে দেখে, ৪০৪ এররের খবর। আপনা থেকেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল – “ধ্যার, বাঁ…”

সময় আরও খানিক এগিয়ে এসেছে। সাতটা ছাব্বিশ। এবার কৃতি উঠে পড়বে। উঠে মণিকে পাশে না পেলে মনখারাপ হবে তার। যেদিন যেদিন মণি আগে উঠে পড়ে, সেদিনগুলোয় কৃতি ভারী খুশি হয়, চট করে বিছানা ছাড়তে চায় না। স্বামীর বুকে মাথা রাখে, দু-জনে মেশামেশি করে থাকে কিছুক্ষণ। তার উপর কাল রাতে শুয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিল মণি, সেই অপরাধও জমা হয়ে আছে।

এবার উঠে পড়তেই হবে। এতক্ষণ ধরে কমোডে বসে থাকা অনুচিত কাজ, এতে পাইলসের সম্ভাবনা বাড়ে। কোনও একটা কাগজে পড়েছিল।

কিন্তু, টিকটিকিটার ওঠার কোনও লক্ষণ নেই। হ্যান্ড শাওয়ারটা হাতে তুলে নিয়ে আরেকটা ব্যাপার লক্ষ করল মণি। জমে থাকা বর্জ্য শরীর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর এক স্বর্গীয় অনুভূতি হয়, সেই অনুভূতিটাই এখন সারা মন-শরীর জুড়ে। ভয়ের আঘাতে কখন যে আপন নিয়মেই সে বর্জ্য খুঁজে নিয়েছে তার নিজস্ব নির্গমনপথ, সেটা মণি বোধহয় বুঝতেও পারেনি। টিকটিকিটা এই উপকারটাও করে দিল।

হ্যান্ড শাওয়ারের কাজ সেরে সেটাকে যথাস্থানে রেখে ছোটো হয়ে আসা গোলাপি টয়লেট সোপটা দিয়ে হাত ধুতে থাকে মণি। কলের হাতলটা অল্পই ঘুরিয়েছে সে, জল পড়ছে অত্যন্ত ধীরে। তাতেই দিব্যি হাত ধোয়া হয়ে যাচ্ছিল। সাবানগোলা ফেনাজলের ফোঁটা গিয়ে পড়ে টিকটিকিটার গায়ের ওপর। চমকে চমকে ওঠে সেটা। দীর্ঘ সময়ের নিস্তব্ধতার পর এই মৃদু স্পন্দন দেখে মণি ভরসা পায়। কিন্তু পরমুহূর্তেই আবারও এক ভয় তাকে ছেঁকে ধরে। আকস্মিক চমকানিতে টিকটিকিটার যদি হাত ফস্কে যায়!

কলটা বন্ধ করে দেয় সে। হাত সরিয়ে নেয় ঝাঁঝরির উপর থেকে। দেওয়ালের আংটায় রাখা তোয়ালেতে হাত মুছে সে এবার উঠে পড়ে।

চান করার কলের নীচে একটা ঝাঁটাকাঠি পড়ে আছে, এটা বাথরুমে ঢুকেই লক্ষ করেছিল সে। বাথরুমে ঝাঁটাকাঠি থাকার কথা নয়, কে ফেলেছে, কেন ফেলেছে, এসব নিয়ে সেই মুহূর্তে মাথা ঘামায়নি মণি, কিন্তু এখন এটা কাজে লাগতে পারে। কাঠিটা ভেতরে ঢুকিয়ে যদি পিছন থেকে টিকটিকিটাকে আলতো খোঁচানো যায়, তাহলে হয়তো উঠে পড়ার চেষ্টা করতে পারে।
কিন্তু তাতে কি সত্যিই কাজ হবে? নাঃ, অত ভাবার সময় নেই এখন। সাড়ে সাতটা ছুঁইছুঁই।
মণি বারমুডাটা পরে নিয়ে, সিস্টার্নের ওপরে রাখা মোবাইলটা পকেটে ঢুকিয়ে, এগিয়ে যায় ঝাঁঝরির দিকে। উবু হয়ে বসে। কাঠি ধরা ডানহাতটা গর্তের কাছে আনে। আর, ঠিক তখনই…

রবি শাস্ত্রীর বিখ্যাত ‘ট্রেসার বুলেট’-এর গতিতে বেরিয়ে এল টিকটিকিটা। তারপর, আরও একটু গতি বাড়িয়ে ছুটে চলে গেল সিঙ্কের আউটলেট পাইপটার নীচে। ওখানে ডাঁই করে রাখা আছে দু-খানা বড়ো আকারের রং রাখার প্লাস্টিকের ডিব্বা, তিনখানা ছোটো রং রাখার টিন, এক জার টয়লেট ক্লিনার, এক জার ডিসইনফেকট্যান্ট সারফেস ক্লিনার, দু-বোতল মিউরিটিক অ্যাসিড, সঙ্গে আরও এটা-সেটা। সেগুলোর আড়ালে লুকিয়ে পড়ল সে।

মণি পিছন ঘুরে আর তাকে দেখতে পেল না।

Categories
2023-Sharodiyo-Golpo

অরুণাভ গঙ্গোপাধ্যায়

যারা অফুরন্তভাবে মৃত

আমি মরে যাবার পর আমার ছেলে একদম কাঁদেনি। এর সঠিক কারণ আমি জানি না। তবে দুটো সম্ভাব্য কারণ আন্দাজ করতে পারি। এক, আমার ছেলে হয়তো কাঁদতেই জানে না। দুই, আমার ছেলেকে আমি ‘পাপ’ বলেছিলাম একবার। এবার যদি এক নম্বর কারণের ব্যাখ্যা দিই তাহলে বলতে হয়, ছোটোবেলা থেকে আমার ছেলে কম মারধর, কম লাথি-ঝ্যাঁটা তো খায়নি আমার কাছে, কিন্তু একবারের জন্যও ওকে চোখের জল ফেলতে দেখিনি। যত মেরেছি, যত অত্যাচার করেছি তত ভাবলেশহীন মুখে, তত যন্ত্রণাহীন মুখে দাঁড়িয়ে থেকেছে। এছাড়া, শুধু আমি নয়, অন্য লোকেও চিরকাল ওকে দেখ-মার করেছে। কিন্তু সেক্ষেত্রেও কাঁদা তো দূরের কথা, এতটুকু শুকনো মুখে কোনোদিন বসে থাকতে দেখিনি আমার ছেলেকে। আর, ওর এই কোনো কিছু তোয়াক্কা না করা মনোভাবটাই আমার ভেতরে ক্রমাগত একটা জ্বালার জন্ম দিত। ফলে অত্যাচারের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিতাম আমি। যাইহোক, এবার আসি দ্বিতীয় কারণের ব্যাখ্যায়। তবে তার আগে একটা ঘটনা বলি।

একদিন অনেক রাতে আমার ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভাঙে আমার ছেলের আমাকে ধাক্কা দেওয়ার জন্য। রোগা প্যাংলা আট বছরের একটা বাচ্চা, কিন্তু বেশ জোরে জোরে ধাক্কা দিচ্ছিল! আমার ঘুম ভেঙে যায়। আমি পাশ ফিরি। দেখি, আমার মাথার শিয়রে বসে আছে। মারওয়াড়িবাবুর বাড়ি ওভারটাইম করে, রাত বারোটায় বাড়ি ফিরে, স্নান সেরে, নাকেমুখে দুটো ভাত তরকারি গুঁজে, বোধহয় ঘণ্টাখানেক হয়েছে কি হয়নি আমি শুয়েছি, আর মরেছি। কিন্তু ওর ধাক্কা দেওয়াতে আমার কাঁচা ঘুমটা গেল চটকে, ফলে খুব স্বতঃস্ফুর্তভাবেই মুখ দিয়ে— “ধ্যার ল্যাওড়া, কী হয়েছে কী?”— বেরিয়ে এল। তখন দেখি ও আঙুল তুলে ওপর দিকে দেখাচ্ছে। ওপর দিকে মানে সিলিঙের দিকে। চোখে তখন ঘুমে শেকল পরিয়ে রেখেছে, পিচুটি ভ্যাদভ্যাদ করছে, তার ওপর ঘরে একটা জিরো পাওয়ারের নীল রঙের নাইট ল্যাম্প জ্বলছে। ফলে ওই প্রায় আধিভৌতিক পরিবেশে প্রথম চোটে কিছুই বুঝতে পারলাম না ও কী বলতে চাইছে, কিংবা কী দেখাতে চাইছে। তাই বাধ্য হয়ে বিছানায় উঠেই বসলাম। ভালো করে কচলে কচলে চোখ পরিষ্কার করলাম। তারপর হাতড়ে হাতড়ে বেড সুইচ টিপে ঘরের বড়ো আলোটা জ্বালালাম। আর দেখলাম, ঘরের অ্যাসবেস্টসের সিলিং ধরে রাখা লোহার খাঁচার একটা রডের সাথে, গতবছর পুরী থেকে কিনে আনা সুতির কটকি চাদরটা বেঁধে ফাঁস তৈরি করে, সেই ফাঁস গলায় পরে আমার বউ ঝুলছে। মুহূর্তের আপাদমস্তক চমকে ওঠায় আমি আমার ছেলেকে জড়িয়ে ধরলাম তখন। তবে ওই প্রথম। ওইই শেষ। কিন্তু ওই জড়িয়ে ধরাটা এখনও আমার শরীরে, যে-শরীর আর নেই সেই শরীরেই, যেন লেগে রয়েছে! তবে ওর ওপর আমার যা আক্রোশ, তাতে তো ওই স্পর্শ লেগে থাকার কথা নয়! যাইহোক, মুহূর্তের জড়িয়ে ধরা, মুহূর্তেই ছেড়ে দেওয়া। তারপর, একটি আত্মহত্যা পরবর্তী ঝুটঝামেলা সামলানো। চলতে থাকল। বেশ কয়েকদিন ধরে। পুলিশ তো প্রথমে আমাকে আটক করেও নিয়ে গেল! মেরে ঝুলিয়ে দিয়েছি এই সন্দেহে। পরে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট যখন বেরোল, মর্গের ডাক্তার যখন নিশ্চিত করল, যে শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই, হত্যা নয়, এটা আত্মহত্যাই, তখন হাজত থেকে ছাড়া পেলাম। কিন্তু আমার বউ কেন গলায় দড়ি দিল তা জানতে পারলাম না। আমার বউয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কেমন ছিল? সেই নিয়ে আমি আদৌ কোনোদিন ভাবিত ছিলাম না। কিন্তু আত্মহত্যা করতে পারে, এরকম জায়গায় চলে গিয়েছিল কি ব্যাপারটা? কে জানে! দু-চারদিন ভাবার পর আমি ভাবা বন্ধ করে দিলাম। ওদিকে পুলিশও দু-চারদিন পরেই হাত তুলে নিল।

এর পর বেশ কিছু মাস কেটে গেল। দুর্গাপুজো এল। আমি যে-মারওয়াড়ি ব্যবসাদারের বাড়ি বাজার সরকারের চাকরি করতাম তিনি লোক ভালো। বউ আত্মহত্যা করা স্বত্তেও, তিন দিন হাজতবাস করা স্বত্ত্বেও উনি আমাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেননি, উলটে পুজোর সময় ডবল বোনাস দিলেন। বললেন— “মা তো নেহি রহি যো পূজাকে ওয়াক্ত বচ্চে কো সাজায়েগি, তুমহি উসে অচ্ছে সে কপড়ে খরিদকে দেনা”— এই বলে, খুব সুন্দর একটা খামে পুরে ক্যাশটা আমার হাতে দিলেন। ক্যাশ মাইনে, ক্যাশ বোনাস, এছাড়াও উপরি বোনাস। সেটাও ক্যাশ। চল্লিশ হাজার টাকা ক্যাশ তখন আমার পকেটে। পা আর মাটিতে পড়ছে না। কী করি? কী করা উচিত এখন এতগুলো টাকার সাথে? ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মাথায় এল বউ মরে যাওয়ার পর থেকে আর কারও সাথে শোয়া হয়নি আমার। তাই যেমন ভাবা, তেমন কাজ। রেড লাইট থেকে একটা বেশ্যা তুললাম। বাড়ি নিয়ে এলাম। শুলাম। যেদিন প্রথম শুলাম সেদিনও বহু জায়গায় মণ্ডপে পেরেক পোঁতা শেষ হয়নি। সেদিন ছিল পঞ্চমী। আর সেদিন থেকে শুরু করে টানা নবমী পর্যন্ত আমি শুলাম। গোটা দুর্গাপুজোটা আমি ওই এক্সট্রা বোনাসের দশ হাজার টাকা খরচ করে একটা মেয়েছেলের শরীর ভাড়া করে আনলাম ভোগের জন্য। তারপর, সারারাত কাটানোর পর বিজয়া দশমীর দিন সকালে যখন ওই বেশ্যা ফিরে যাচ্ছে তখন হঠাৎ মনে পড়ল ছেলেটাকে এবার পুজোয় কোনো নতুন জামা-প্যান্ট কিনে দেওয়া হয়নি। তাই দুপুরে চান খাওয়া সেরে, বিকেল বিকেল বাড়ি থেকে বেরোলাম। রাস্তায় তখন সারি সারি নতুন জামা। নতুন প্যান্ট। নতুন জুতো। আনন্দ-বিসর্জনের পথে। তখন সেই সমস্ত নতুন জামা-নতুন প্যান্ট-নতুন জুতোদের পেরোতে লাগলাম আমি। ঢাকের বাদ্যি পেরোতে লাগলাম। তাসা পার্টির বাজনা পেরোতে লাগলাম। ঝকমকে আলো পেরোতে লাগলাম। আলোর তলার ছায়া পেরোতে লাগলাম। পেরোতে পেরোতে একসময় দেখতে পেলাম খুব ছোট্ট একটা জামাকাপড়ের দোকান তখনও খোলা। ফাঁকা। কোনো খদ্দের নেই। ভেতরে একজন বৃদ্ধ কর্মচারী বসে আছে কেবল। প্রতিমা নিয়ে ম্যাটাডোর বেরিয়ে যাবার পর যেভাবে প্যান্ডেলে একটা নিঃসঙ্গ প্রদীপ জ্বলে; ঠিক সেইভাবে। যাইহোক, গিয়ে উপস্থিত হলাম সেই দোকানে। তারপর বেছে বেছে খুব সস্তা দামের একজোড়া জামা-প্যান্ট কিনতে গিয়েও কিনতে না পেরে, বেশ দাম দিয়েই একটা পাজামা-পাঞ্জাবীর সেট কিনে ফেললাম। তারপর ফিরতে লাগলাম; আবার সেই ঢাকের বাদ্যি-তাসা পার্টি-আলো-ছায়া পেরোতে পেরোতে। আর ফিরতে ফিরতে হঠাৎ, ওই বেশ্যা আর আমার, একদিনের বেশ লম্বা একটা সংলাপ আমার মাথার মধ্যে ফিরে এল।

“শেষপর্যন্ত আর জানতে পারোনি না?”

সপ্তমীর দিন। রাত্রিবেলা। শোয়া পর্ব মিটলে বিরিয়ানি আর থাম্বস্‌ আপ নিয়ে খেতে বসেছি আমি আর ওই বেশ্যা। পাশের ঘরে ছেলেটাকেও এক প্যাকেট বিরিয়ানি আর এক বোতল কোল্ড ড্রিংক দিয়ে এসেছি। তবে খেয়েছে কি না দেখিনি। আমার পাড়ার রতনের দোকানে মটন বিরিয়ানিটা রাঁধে ভালো। আয়েশ করে খাচ্ছিলাম। হঠাৎ আমার ভাড়া করা মেয়েছেলের প্রশ্নে খাওয়ায় ছেদ পড়ল। মুখ তুলে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম—

“কী জানতে পারার কথা বলছ?”

“তোমার বউ কেন গলায় দড়ি দিয়েছিল?”

মেজাজটা গেল খিঁচড়ে। খাওয়ার সময় এসব কথা কেন যে বলে এইসব আহাম্মক মেয়েছেলেগুলো! বললাম—

“তোমার কি খেয়ে দেয়ে কোনো কাজ নেই যে এখন এসব কথা তুলছ?”

আমার বলার মধ্যে যথেষ্ট তিক্ততা ছিল, কিন্তু দেখলাম ভবি ভোলার নয়। পাঁঠার টেংরি চিবোতে চিবোতে প্রশ্ন করেই চলল—

“জানতে ইচ্ছে হয়নি?”

“নাহ্‌”।

“কেন?”

“এমনিই”।

জোরের সাথে বললাম। কিন্তু তারপরেও সেই বেশ্যা বলে—

“আচ্ছা তুমি কি তোমার বউকে সন্দেহ করতে?”

“সন্দেহ করতে যাব কোন দুঃখে?”

“করতেই পারতে! হতেই তো পারত যে অন্য কারও সাথে ওর লটরপটর ছিল। সেখান থেকে হয়তো ব্ল্যাকমেল করছিল। তাই ভয় পেয়ে সুইসাইড করে ফেলেছে!”

“একদম ফালতু কথা বলবে না। আমার বউ মোটেও ঐরকম ছিল না!”

“বাবা! এখনও এত টান!”

কথাটা বলে, একটা বাঁকা হেসে, ঢকঢক করে গলায় খানিকটা কোল্ডড্রিংক ঢেলে দিল বেশ্যাটা। তবে এর পরেই, থাম্বস্‌ আপের বোতলটা নামিয়ে রেখে অদ্ভুত গম্ভীর গলায় বলল—

“তাহলে দায় তো তোমারই। অস্বীকার করো কোন সাহসে? মারধোর করতে না তো?”

কেন জানি না, এই কথাটা শোনার পর আমার খাওয়া থেমে গেল। মনে হল, পুলিশের পর আমি যেন দ্বিতীয়বার আটক হলাম এই মহিলার কাছে। খুব ধীরে ধীরে বললাম—
“তুমি খোঁজ নিয়ে দেখতে পারো পাড়ায়, কোনোদিন আমি আমার বউয়ের গায়ে হাত তুলেছি কি না! কোনো খারাপ ব্যবহার করেছি কি না!”

“কিন্তু ভালোবাসতে কি?”

“নাহ্‌… তা আর বাসতাম না।”

এই কথাটা এত সহজে এই বেশ্যাটাকে বলে দিলাম, অথচ কোনোদিন নিজের কাছেই বলার ধক ছিল না! এই অতি সাধারণ, শরীর বিক্রি করা মহিলা ঠিক যেন মনের ডাক্তার! কালো জল, যার বাইরে থেকে তল বোঝা যায় না, তার ভেতরে হাত চুবিয়ে পোড়খাওয়া মনোবিদের ভূমিকাতেই যেন ঘুলিয়ে দিল সে সবকিছু, আর মারল শেষে মোক্ষম ঘা—

“কিন্তু ছেলেটাকে এরকম দূরছাই করো কেন? ওর কী দোষ?”

“দোষ নেই?”

“আছে! ওর জন্মের ওপর ওর হাত ছিল বুঝি?”

এই প্রশ্নে আমি চুপ। আবার ওই মহিলা—

“আর অস্বীকার করতে পারবে যে ওর এইরকম জন্মের জন্যে তুমি তোমার বউকেই দুষতে?”

নাহ্‌! আমার বিরিয়ানি খাওয়া ঘুচল। মেয়েটা মুখ পড়তে পারে। ওর সামনে আর বেশিক্ষণ বসে থাকা যাবে না। পাঁঠার মাংসের সাথে সাথে এবার আমার ছাল চামড়া ছাড়িয়ে খেতে শুরু করবে। আমি তাই খাওয়া ছেড়ে উঠে পড়লাম। তারপর আরও একটু বেশি রাতের দিকে চুক্তি অনুযায়ী যখন আমরা আর-এক প্রস্থ সংগমরত, তখন আমার বুভুক্ষু পুরুষাঙ্গ নিজের ভেতরে নিতে নিতে বেশ্যা বলে উঠল—

“তোমার ছেলে দুর্ভাগ্য জড়িয়ে জন্মেছে। ওকে পাপ বলে দাগিয়ে আর ওকে বাঁচিয়ে মেরে রেখো না।”

আমার তক্ষুনি মনে পড়ল একদিন আমার বউয়ের সঙ্গে কথা কাটাকাটির সময় আমি আমার ছেলের মুখের ওপরেই বলেছিলাম—

“সালা ঢ্যামনা কোথাকার! কোত্থেকে একটা পাপ এসে জুটেছে কপালে!”

এই বলে ওর পায়ের কাছে এক দলা থুতু ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। তারপর অনেক রাতে যখন নিজেই গেটের চাবি খুলে বাড়ি ঢুকলাম, শুনতে পেলাম বাথরুমে বসে আমার বউ গুঙিয়ে গুঙিয়ে কাঁদছে আর বলছে— “আমি আর তোকে আগলে রাখতে পারব না বাবা, কিন্তু এবার আমি নিজেকে বাঁচাব।”

প্রথমে বুঝিনি, কিন্তু পরে যখন আরও রাত্তিরে আমার ছেলের ধাক্কা খেয়ে ঘুম ভেঙে, গতবছর পুরী থেকে কিনে আনা সুতির কটকি চাদরের ফাঁসের সঙ্গে আমি আমার বউকে ঝুলতে দেখলাম, বুঝতে পারলাম আমার বউ আসলে কত ভীতু ছিল! নিজের সন্তানকে সে আর অপমানের হাত থেকে বাঁচাতে পারছে না বলে নিজেই পিঠটান দিয়ে পালাল! অবশ্য আমার বউ যে ভীতু এটা আমার, হাসপাতালে ছেলের জন্মের পর পরই নিশ্চিত হয়ে বুঝে যাওয়া উচিত ছিল। ডাক্তার যখন বলেছিল—

“আপনাদের ছেলের সেক্স ডিটেক্ট করা যাচ্ছে না।”

“তার মানে ডাক্তারবাবু?”

“ওর যৌনাঙ্গের জায়গায় ভ্যাজাইনা আর পেনিস দুটোরই হিন্ট আছে।”

কথাটা শুনে আমার বউ সাদা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ও তো ছেলের গর্ভধারিণী! ওর কি কলিজায় আরও জোর নিয়ে আসা উচিত ছিল না? উচিত কি ছিল না পক্ষীমাতার মতো তার সন্তানকে সব বিষ থেকে আগলে রাখা? আর সে মা হয়ে এ-কাজ পারল না বলেই না আমার মনে ধীরে-ধীরে ধীরে-ধীরে বিষের পাহাড় জমতে লাগল আমার ছেলের জন্য।

কিন্তু আমারও কি উচিত ছিল না এই আগলে রাখার শ্রমে আমার বউকে সাহায্য করা! কিন্তু এখন আর এসব ভেবে লাভ কী? মরে গিয়ে আত্মোপলব্ধি খুব সহজ কাজ। করতাম যদি বেঁচে থাকতে! তাই আমার মতন এরকম বাপ মরে গেলে ছেলেই বা কেন কাঁদবে! তবে ঠিক আমার ওপর ঘৃণা থেকেও নয়, ছেলে আমার এমনিতেই কোনোদিন কাঁদবে না। ছোটো থেকেই আমি, আমরা ওকে বুঝিয়ে দিয়েছি ওর পক্ষে কান্নাকাটি করা আসলে বিলাসিতা। আমার ছেলে অত বিলাসী নয়।

আর শেষে বলি কীভাবে মরে গেলাম। ঢাকের বাদ্যি-তাসা পার্টি-আলো-ছায়া পেরোতে পেরোতে খেয়াল নেই কখন একটা তুমুল উত্তেজনার মধ্যে ঢুকে পড়েছি। হঠাৎ শুনি চারিদিক থেকে অনেকের মিলিত ভয়ার্ত কণ্ঠস্বর। “এই ধর ধর সামলে… মাগো রক্ষা করো… এ কী সর্বনাশ হয়ে গেল মা…” এইরকম সব কথার টুকরো কানে ভেসে আসছে। ঠাহর করে দেখি বাঁশের মাচায় করে প্রতিমা নিরঞ্জনের জন্য নিয়ে যাচ্ছিল একদল বেহারা। পথে কোনোভাবে কারও পা বেসামাল হয়ে পড়ায় গোটা মাচাটাই মাঝখান থেকে ভেঙে বেসামাল হয়ে গেছে, এবং প্রায় একতলা বাড়ির সমান উঁচু প্রতিমা তখন মুখ থুবড়ে রাস্তায় পড়ার উপক্রম হয়েছে। কাঠামোর পিছনে দড়ি বেঁধেও স্থির রাখা যাচ্ছে না, মাচাও রাস্তায় নামানো যাচ্ছে না। এদিকে অত টানাটানিতে প্রতিমার দেহে তখন চিড় ধরতে শুরু করে দিয়েছে। ওদিকে উত্তেজনা, হাহাকার বেড়েই চলেছে। আর আমি তখন নিজের অজান্তেই এক অমোঘ টানে এগিয়ে চলতে শুরু করে দিয়েছি প্রতিমার পায়ের কাছে। চিড় ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে, আর আমার চোখের সামনে অন্য একটা পুরোনো ছবি স্পষ্টতর হয়ে উঠছে। আমি দেখতে পাচ্ছি আমার ছেলে স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা থেকে ফিরে এসেছে। সেই বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার ‘যেমন খুশি সাজো’ বিভাগে আমার ছেলে নাম দিয়েছিল। বাড়ি ফিরে এসেছে সেই পোশাকেই। পরনে সস্তার জরির শাড়ি। লাল রঙের। সস্তার গয়না। ইমিটেশনের। আর পিঠের সঙ্গে বাঁধা, পিচবোর্ড দিয়ে তৈরি দশটা হাত। হাতে অস্ত্র নেই। সেদিন আর আমার মাথার ঠিক থাকেনি। মেরে মেরে বুকে, গলায় দাগ ফেলে দিয়েছিলাম। ঠিক এই ভঙ্গুর মৃৎপ্রতিমার মতো। আমার বউ চুপ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার ওই চণ্ডাল মূর্তি দেখেছিল। এই মুহূর্তে রাস্তায় দাঁড়ানো এই অসহায় গণর মতো।… আবার একপ্রস্থ হই হই রব উঠল চারিদিকে। সেই রবে ভয়ের মাত্রা আগের চতুর্গুণ। আমি দেখলাম কাঠামোর পিছনে দড়ি ধরে দাঁড়িয়েছিল যারা তারা একে একে দড়ি ছেড়ে দিচ্ছে। আর পারছে না। মানুষ তো, কত আর সহ্য করবে? দেবীই ভেঙে যাচ্ছেন!…

একসময় দেবীমূর্তি পুরোপুরি ভেঙে পড়ল। সামনে দাঁড়ানো বেশ কয়েকজন মানুষের ওপর। সামনে দাঁড়ানো সেই বেশ কয়েকজন মানুষের মধ্যে আমিও ছিলাম।

Categories
2023-Sharodiyo-Golpo

অলোকপর্ণা

মেহিকো

সবই ঠিক ছিল, কিন্তু কুন্তলা অদিতিকে মরে যেতে দেখল ভোরবেলা। সম্ভবত অতিরিক্ত মাদকসেবনের ফলে চোখের সামনে মুখে গ্যাজলা তুলে সে নিথর হয়ে গেল, অথচ কুন্তলার ঘুম ভাঙল না। বেলা ন-টা নাগাদ চোখ খুলে সে তার পায়ের পাতার দিকে তাকিয়ে থাকল চুপ করে। মনে হল, পাতাগুলো দেহের আন্দাজে একটু বেশিই বড়ো। তবে কি আরেকটু লম্বা হওয়ার কথা ছিল তার? সময়ের আগে মাসিক হয়ে না গেলে কি আরও ইঞ্চি তিন-চার লম্বা হতে পারত সে? তখনই মনে পড়ল আজকে তার ঘুমের মধ্যে অদিতি মরে গেছে।

সে ভেবে রাখল দুপুরে অদিতিকে জিজ্ঞেস করতে হবে সে কখনো মাদক সেবন করেছে কি না।

অদিতি আর কুন্তলা এখনও একে-অপরকে প্রিয় পাখি, ফুল, ফল, প্রিয় ঋতু ইত্যাদি ইত্যাদি মারফত চিনছে।

এ বড়োই পেলব পর্যায়।

হাওয়াশহর ছেড়ে কলকাতা ফেরার বছর দুয়েক পর কুন্তলার উপরের বারান্দায় এলে বাড়ির সামনের উঠোন বাঁধানোর কাজ চোখে পড়ে। জনা তিনেক মিস্ত্রি এটা সেটায় ব্যস্ত। মেঝে পিটিয়ে সমান করছে যে-জন তাঁর গলায় তুলসির মালা। চকিতে দীপাকে মনে পড়ে যায় তার। কেবল তুলসির মালা বলে নয়, আজকাল সমস্ত অলংকার, সমস্ত রঙিন ফুলে তার দীপাকে মনে পড়ে। লোকটা মেঝে পেটাতে পেটাতে মাঝে মাঝে চুপ করে আকাশের দিকে তাকাচ্ছে। কী ভাবছে তা আন্দাজ করার চেষ্টা করে কুন্তলা। যে-দৃষ্টি সে রচনা করেছে, তাতে নিকট নয় বরং সুদূরের আঁচ আছে। বিগত সময়ের কথা সে ভাবছে হয়তো শারদীয় রোদে মাটি পেটানোর কাজের অবকাশে। লোকটাকে তার ভালো লেগে যায়। সে তার নাম দেয় কৃষ্ণ।

আজ আকাশ বাতাস চমৎকার। শুধু অদিতির মরে যাওয়াটুকু বাদ দিতে পারলে সবকিছু খাসা।

এইসব রোদের কথা, আলোর কথা, হাওয়ার কথা তার দীপাকে জানাতে ইচ্ছে করে, অথবা সুমনকে, অথবা তুলিকেও। এইসব রোদ, আলো, আকাশ ছবিতে মুড়ে পাঠিয়ে দিতে চায় সে ওদের নাগালে।

প্রাতঃরাশ সেরে বারান্দায় এসে কুন্তলা দেখতে পেল কৃষ্ণ হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে আছে ফলবতী শীর্ণ পেঁপে গাছের সামনে। উঁকি দিলে শিশুপেঁপেকে ঝুলন্ত দেখা যাবে। আজ পেঁপে গাছ কাটা পড়বে এমনটাই নির্ধারিত হয়েছে। গোটা উঠোন বাঁধাতে গেলে তা অনিবার্য। দূর থেকে পেঁপে গাছের কাছে করজোড়ে ক্ষমা চাওয়া কৃষ্ণকে দেখে সে চুপ করে। একটু পরে কৃষ্ণ দাঁ তুলে নিলে অকুস্থল থেকে সরে আসে কুন্তলা। পালিয়ে আসে। তার আর ক্ষমা চাওয়া হয় না। নিজেকে ক্ষমার অযোগ্য বলে মনে করে সে আর দিনের আলো অল্প নিভে যায়।

অদিতির সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার যাবতীয় উদ্যমও উবে যায় কীভাবে যেন। ভয় করে, যদি ফের একঘেয়ে হয়ে ওঠে শহরটা? তার তো আর পালাবার পথ নেই!

তবু জোর করে তৈরি কুন্তলা হয়। নিজেকে সাজায় কাজলে। মেট্রোয় উঠে কানে গান ভরে দেয়। গানে গানে চোখে আলো জ্বালাতে চেষ্টা করে, মনে আলো জ্বালাতে চেষ্টা করে। লড়াই করে বিস্মৃতির সঙ্গে, লড়াই করে অন্ধকার সোঁদা কালো পাথরের সহিত যা সে সিসিফাস হয়ে ঠেকিয়ে রেখেছে কোনোমতে।

বেলগাছিয়া যায় আর তার দীপাকে মনে পড়ে। আজকাল যত্রতত্র শব্দে শব্দে দীপা। কুন্তলা সংযত হয়।

অদিতির মন আজ আগের থেকে ভালো আছে। সে অনেক কিছু বলছে ব্যক্তিগত সপ্তাহ সম্পর্কে। কুন্তলা শুনছে মন দিয়ে, ভুলেও যাচ্ছে কিছু কিছু। খেয়ালবশত অদিতির হাত সে নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে।

কুন্তলা কিছু অনুভব করে না। মনে মনে সতর্ক হয়। অদিতির আঙুলের ফাঁক দিয়ে নিজের আঙুল গলিয়ে দেয়। একফোঁটা আঠা নেই তাদের ছোঁয়ায়। হাত আলগোছে ছেড়ে দেয় সে। আলো আরও নিভে আসে।

অদিতি বলে চলে শামুক আর ব্যাঙের মাংসের কথা। হরিণ, কচ্ছপ ইত্যাদির কথাও প্রসঙ্গে এসে পড়ে। সে চুপ করে অদিতিকে দেখে, মনে পড়ে গত সপ্তাহে তারা একে-অপরকে একটি চুম্বন উপহার দিয়েছিল। অথচ আজ কোথাও কোনো আঠা নেই। অদিতির সঙ্গে মিউজিয়ামে যায় কুন্তলা। অদিতির পাশে মাথা নীচু করে হাঁটে। মনে পড়ে, তারা একদিন একটা মাঠে গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়েছিল পাশাপাশি। “এই তো সেদিন অদিতি…” তার ইচ্ছে হয় বলে ওঠে, “এই তো সকালেও আলো ছিল!”

“কী বলবি বলছিলি?”

“আজ সকালে একটা খারাপ স্বপ্ন দেখেছি”

“কী স্বপ্ন?”

“দেখলাম তুই মরে গেলি চোখের সামনে”

“ও আচ্ছা…”

“তুই কখনো ড্রাগ নিয়েছিস?”

“Never, I hate it”

“অদিতি,”

“বল!”

“I am not feeling anything”

“মানে?”

“মানে, স্বপ্নটা দেখার পরেও আমার ঘুম ভাঙেনি, এমনকী ঘুম থেকে উঠেও যখন কথাটা মনে পড়ল আমি চুপ করে বসে রইলাম, দুঃখ না, ভয় না, কিছুই হল না ভিতরে, am I getting bored again?”

অদিতি আর কুন্তলা চুপ করে দক্ষিণ কলকাতার উপকণ্ঠে থমকে থাকে।

“কী হবে তুই বোর হয়ে গেলে?”

“আমি জানি না। আমার হাতে তো আর কোনো অপশন নেই, আমি সব ছেড়ে কলকাতা ফিরে এসেছি। এখানেও যদি এমন হয়, আমার যাওয়ার জায়গা থাকবে না। আমি কোণঠাসা হয়ে যাচ্ছি অদিতি। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।”

“বোর হয়ে গেলে অন্য কোথাও যাবি, তোর তো সেই সুযোগ আছে!”

অদিতি সব সমস্যার সহজ সমাধান করে দেয়। কুন্তলা অদিতির হাত ধরে উঠতে পারে না আর।

উঁচু থেকে সে শহরটাকে দেখে, দূর থেকে দেখে। কখনো কারও বেশি কাছে আসতে নেই, এ-কথা শহরের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আলো আরও কিছুটা নিভে যায়।

আলগোছে অদিতির গাল টিপে দেয় কুন্তলা, তার কাঁধে মাসাজ করে, গাড়ি প্রায় তার বাড়ির সামনে এসে পড়েছে।

অদিতিকে নামিয়ে দিয়ে ফেরার সময় বৃষ্টি নামে বেশ জোরে। গাড়ি থেকে নেমে হাঁটতে থাকে সে। ছাতা খোলে না। মনে পড়ে দীপার বাড়ির ছাদের গাছগুলির কথা। তারাও এখন ভিজছে।

“What if I were a tree?”

গাছের কোথাও যাওয়ার যন্ত্রণা নেই, কোথাও পালানোর অভীপ্সা নেই। কুন্তলাদের দু-খানি পা আছে। আর আছে একটা অসহ্য মস্তিষ্ক।

সুমনের সঙ্গে কাল দেখা করার কথা তার আজ এই মুহূর্তে অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে।

কুন্তলার মাথার উপর দিয়ে উড়ে একটা ছোটো এরোপ্লেন উড়ে মেঘের ভিতর আত্মগোপন করল। অন্তরাল থেকেও সে তার ডাক শুনতে পেল। তার মনে পড়ল, পাসপোর্টে মেহিকোর ছারপত্র ঘুমিয়ে আছে দু-মাস হল। সেইভাবে চেষ্টা করলে কি যাওয়া যেত মেহিকোয়? গিয়েই বা লাভ কী? কিছুদিন পর তো আবার কালো বল পাথর ঠেলে ঠেলে পাহাড়ের উপরে তুলতে থাকা।

কুন্তলা তুলিকে ফোন করে, জিজ্ঞেস করে, সবাই যদি এত যন্ত্রণায়, তবে মানুষ বেঁচে আছে কেন?

তুলি জানায়, আর কোনো অপশন নেই তাই। মৃত্যুটা কোনো অপশন নয়। ফোন কেটে যায়।

সিঁড়ি ভরে আছে মদের গন্ধে। অর্থাৎ সহোদরটি ঘরে ফিরেছেন। তাকে মদ্যপান সম্পর্কে সাবধান করতে কুন্তলা তার ঘরে ঢোকে।

দেখে, চোখ বুজে একটা দাঁড়ির মতো লম্বা হয়ে সে বিছানায় পড়ে আছে, তার এক হাত তার হাফপ্যান্টের ভিতর, নিশ্চুপে স্বমেহন চলছে। চুপিসারে দরজা বন্ধ করে কুন্তলা নিজের ঘরে এসে পড়ে।

কোথাও কোনো মেহিকো নেই তার জীবনে। এ-সত্য সে টের পায়।

একদিন সে সবেতেই ক্লান্ত হয়ে পড়বে। নিজেতেও। এ-কথা সে অনুভব করে সে অদিতিকে মেসেজ করে, “আমার মনে হয় না আমি আর কোনোদিন কাউকে ভালোবেসে উঠতে পারবো অদিতি। আমি ভিতরে ভিতরে বড়ো ক্লান্ত। আমার দ্বারা নতুন করে কাউকে ভালোবাসা সম্ভব নয়। আমার এক্সপায়ারি ডেট পেরিয়ে গেছে কবে আমি নিজেও টের পাইনি। আজকাল বড়ো ক্লান্ত লাগে সবকিছু। কোথাও আলো জ্বলে ওঠে না। কোথাও বিস্মিত হই না। আমার কাউকে মনে পড়ে না আর।”

কুন্তলা বুঝতে পারে অদিতি মেসেজটা দেখেছে। কিন্তু সে কোনো জবাব দেয় না।

আকাশ ভেদ করে একটা উড়োজাহাজ চলে যায়। কুন্তলা চুপ করে তার ডাক শোনে। কলকাতা থেকে সমস্ত প্লেন এখন মেহিকোতে চলে যায়। সব নদী যায় মেহিকোতে বয়ে। সমস্ত ডাক এখন মেহিকো থেকে আসে আর কুন্তলা জানে মেহিকো বলে আসলে কোথাও কোনো দেশ নেই, পৃথিবীর সকল দেশ কুন্তলা এবং সকল দেশ শ্বাসরোধকারী, সকল শহর সমান অন্ধকার।

ফোনে আলো জ্বলে উঠলে সে বোঝে অদিতি উত্তর দিয়েছে। ফোন খুলে দেখে অদিতি লিখেছে, “আমারও। আমারও।”

Categories
2023-Sharodiyo-Golpo

শরদিন্দু সাহা

একটি সম্ভাবনার সূত্র

এমনটা হওয়ার কথা ছিল কি! না বা হ্যাঁ কোনো উত্তরই তেমন দেওয়ার কথা ছিল না। কেউ তো নেই এমন উত্তরটা সুবোধের ঘাড়ে এসে চাপিয়ে দেবে। এই মুহূর্তটা এমন একটা ভাবনার দোলনায় ও দুলছে, বোঝা দুষ্কর হয়ে যাচ্ছে কোথায় গিয়ে থামবে কিংবা থামতে চাইবে। কোনো প্রশ্নের উত্তর হয়, আবার হওয়ার জন্য অপেক্ষাও করে। অপ্রত্যাশিতভাবেই দরজাটা খুলে যায়, সুবোধ নিজে চেয়েছে কি চায়নি, সেটা নিজেও জানে না। এসে গেল হুট করে। বড়ো আজব লাগে, তাজ্জব বনে যেতে ক্ষণেক সময় নেয় না। ভাবনার সমুদ্রটা মনের দরজায় এমন করে আছড়ে পড়ে, জানে না কী জমা ছিল, বোধ, সুখ, অসুখ, জমা অন্ধকার, টুকরো আলো ঢেউয়ের তোড়ে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। পড়ে থাকে তো তারপরেও অনেক কিছু – দৃশ্যমান ও অদৃশ্য। ও বুঝতে পারল সবটাই সত্যি। দূরে দাঁড়িয়ে যে-লোকটা সুবোধের উপুড় হওয়া প্রত্যক্ষ করছিল, ভেবেই বসল, লোকটা এমন কিছু একটা হারিয়েছে যা জরুরি ভোগ্যবস্তু বলে তো মনে হচ্ছে না, কল্পনার ইতিউতি, রেখায় কিংবা জলরঙে।

সুবোধ কিছুতেই নিজেকে এখনও সামলে উঠতে পারেনি, তবে কারা যেন জন্ম নিতে চাইছে, উপকরণগুলো আপনা-আপনি হাজির হয়ে মূর্ত হবে বলে গোল পাকাচ্ছে। নিজেদের ইচ্ছেটা তো জন্মায়নি, আকারের কথা উঠবেই বা কেন।

সুবোধ কিছু কি দেখতে চাইছিল! এই মায়াময় পৃথিবীর বুকে দাঁড়িয়ে কেন ও ভাবতে পারবে না ওই যে ছাদটা কবে থেকে এক ফাটল ধরা চতুর্ভুজ হয়ে পড়েছিল হঠাৎই চারটে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে যাবে। জং ধরা টুকরো টিনগুলো দেয়ালের ছাদ হয়ে যাবে। দেয়ালের গায়ে কত তাড়াতাড়ি শ্যাঁতলা জমে সবুজ না হয়ে ঘন লাল রঙে লেপ্টে যাবে। সুবোধের চোখের সামনেই কেউ যেন ছিটিয়ে দিয়ে গেল। রমেশকে দেখল হাঁ হয়ে খুঁজছে এমন কিছু যা ওর নিজের দেখার কথা ছিল। কী আশ্চর্য! রমেশের এমন অসময়ে আগমন! ওর কি আসার কথা ছিল? এমন একটা পথের সাক্ষী হয়ে কবেই তো আর একটা পথ কেটে কেটে চলে গেছে অনেক দূরে। ফেরত যদি আসতেই হয়, এমন অনেক বস্তুর সঙ্গে সংঘাত ঘটবে, ওর অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলে দেবে। প্রমাণ করা এত সহজ হবে না, ও সামনাসামনি দাঁড়িয়ে প্রত্যুত্তর দিচ্ছে। সুবোধ কেন দেখল অনেকগুলো জানালা ওর দিকে ছুটে আসছে। ছোট্ট শিশুটি সেগুলো জাপটে ধরবে বলে কত আকুলিবিকুলি। রমেশ এক নরম মিষ্টি চাহনিতে ওর লাফালাফি সতৃষ্ণ হয়ে দেখছে। ওর হয়তো গ্ৰহণ বর্জনের পালার সুযোগ এসে হাজির হয়েছে যা ও অনেককাল আগে হাতের মুঠোয় পেয়েও হাতছাড়া করেছে। রমেশ ভাবতে পারে এই পাওয়া আর এক পাওয়া, এই জীবন অন্য আর এক জীবন। না, না সুবোধ রমেশের এই ভাবনাকে প্রশ্রয় দিতে যাবে কেন? রমেশের পুনরাবির্ভাব যে অনস্বীকার্য এর প্রমাণের জন্য ওর দৃষ্টিই কি যথেষ্ট নয়? তাই যদি হবে, রমেশ যে ভূমির উপর এতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল, তা এমন করে আলগা হয়ে যাচ্ছে, তার তো না-দেখার কিছু নেই। আচ্ছা, রমেশের উপস্থিতি অদৃশ্য হচ্ছে দেখে, ও কি সমুদ্রের কথা ভাবতে পারে না, পারবে নাই-বা কেন! সেই জলস্রোত কি এক জায়গায় থেমে থাকে, চলে গিয়েও তো ফিরে ফিরে আসে। রমেশের বাসনা তো ফেলনার নয়, সময়কে বন্ধু করে কত রকমের অবয়ব নিয়ে ফিরে আসে, কত বৃক্ষ, কত শাখা-প্রশাখা, কত ছায়া, কত মানুষের প্রতিধ্বনি হয়ে সে হয়তো অন্য কায়া কিন্তু ও তো রমেশই ষোলো আনা নিশ্চিত। ছাদটা ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে দেখতে পেল তো সুবোধ আর দেয়ালটা ছাদ হয়ে আশ্রয়ের ঠিকানা হল। রমেশ আর রমেশ রইল না, পরেশ হয়ে প্রদক্ষিণ করল দুই ছাদের চারপাশে। রমেশ তারস্বরে ডাকল বলেই না, অনেক কথা চালাচালি করল বলেই না, না-হয় কোনো জন্মে দেখেছে, তখন তো সুবোধের হাঁটি হাঁটি পা পা। পাড়ায় পাড়ায় অনুরোধে উপরোধে খালি গলায় গান গাইত, গাইতে গাইতে এক সময় কোথায় যে হারিয়ে যেতে চাইল, সে গল্পই তো শোনাল রমেশকে। রমেশ ওর কথায় এতই মজল, ভাবল পরেশ যদি হতে পারত, এই জীবনই তো চেয়েছিল ও। তারপর তো পরেশের বঞ্চনা, মুখ থুবড়ে পড়া, দোরে দোরে যে-জীবন চেয়ে চেয়ে বেড়িয়েছিল, সকলে থুথু ছিটিয়েছিল। এত কিছুর পরেও রমেশ পরেশ হতে চেয়েছিল। এমনকি যেটুকুনি হামবড়াই ভাব রমেশের ছিল, সেটুকুনি বিসর্জন দিয়েও সুরে সুর মেলাতে দ্বিধা করল না, যদি প্রয়োজন হয় সময়কে চুরি করতে এতটুকু দ্বিধা দ্বন্দ্ব দূর করে দেবে তুড়ি মেরে। সব চাওয়া-পাওয়ার কথাই তো সুবোধ নিজের কানেই শুনল।

সংসার বড়ো মধুময় নয়, সুবোধ কি জানত না, জানত। না না, একেবারেই কোনো চাপা অভিমান ছিল না। ঘরনি পুত্র-কন্যা থাকবে না, সে আবার হয় নাকি, অদ্ভুত এক জগৎ। সকাল সন্ধ্যা যে-কথাগুলি চলত, সবই কিন্তু মিলিয়ে মিলিয়ে। শান্তি এ-ঘর থেকে ও-ঘরে যেত, কী জানি মনে হত এ-ঘর পালটি খেয়ে ও-ঘরে চলে যাচ্ছে। মনে হতে লাগল রমেশের ইচ্ছেগুলোই পাক খেয়ে ওর মনের কোণে কোথাও বাসা বেঁধেছে। পাখির বাসা নয় যে খড়কুটোগুলো দূর ছাই করে উড়ে উড়ে চলে যাবে, শক্তপোক্ত ইঁট বালি সিমেন্ট গাঁথা, ঝড়ের সাধ্য কি তেড়েফুঁড়ে এসে তুবড়ে দেবে। কথাগুলো চলনসই, মিষ্টি তেতো ঝাল। তাতে কার কী আসে যায়। যেমন করে আসতে চায়, তেমন করে আসে। সুবোধই বলছে, শান্তিও শুনছে, যেমন করে শুনতে চায়। কেন শান্তির মনে হয় শেলফের উপরে কোথাও বসে কোকিলটা কুহু কুহু রবে ডাকছে। এমন সংসার হওয়া কি এত সহজ, দুজনেরই সহজ যোগদান এ-কথা মেনে নেওয়ার মধ্যে কোনও বাহাদুরি নেই। শান্তি কি টের পায় ওর প্রতিটি উচ্চারণ থেকে থেকে কেমন উঁচু-নীচু হয়। শান্তি গ্যাসের নব বন্ধ করতে করতে, ছেলের দুষ্টুমির জন্য কানমলা দিতে দিতে সুবোধ বোধ হয় কোকিলের ডানা ঝাপটানোর শব্দ পায় নিশ্চয়ই, না হলে এমন করে নড়েচড়ে বসে কেন। ওর গলার স্বরটা কিন্তু খাপে খাপে মিলে যায়। সবটাই কি সত্যি? কোনটা অসত্যি টের পাওয়া যে সোজা নয়, বিলক্ষণ জানে শান্তি। কোকিলটা আড়াল টপকে সোফার মাঝখানে কাচের টেবিলটার উপর বসে লেজ নাড়িয়ে শান্তির নজর কাড়ে, কথার পরে কথা সাজিয়ে এমন এমন কথা বলে, কোথায় যেন শুনেছে ও। অমনি সময় কথার ফাঁকে চলে আসে, মা, বাবা, দিদি। ওদের চোখেমুখে উৎকণ্ঠা। কবে কোথায় চোখ বুজেছিল। যাওয়ার মুহূর্তগুলোকে চিনে নেবে এমন সাধ্য কার। ওরা অনর্গল বলে চলেছে। কোনো দৃশ্যই আর একটা দৃশ্যকে ছুঁতে চাইছে না। কেউ কারও দিকে তাকিয়েও দেখছে না, অথচ দূরত্ব যে কোনোকালে ছিল না, সেটাও ঘুণাক্ষরেও টের পাচ্ছে না। শান্তি কি মাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করবে, তোমার বিদায়বেলার অনুভূতিটা একবার বলো না মা। অসাড় দৃষ্টি শান্তির দু-চোখের আলোকে নিষ্প্রভ করে দিয়ে নির্বাক করে দিচ্ছে। বাবার মুখটা বেদনায় কেমন আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে, সময়ের কথা বলবে এমন প্রবৃত্তি কোথায়। কোকিলের স্বর বড়ো ম্রিয়মাণ হয়ে শান্তির দু-পাশে ঘুরঘুর করে কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। এত চোখের জল দু-চোখে, সবই কী অশ্রুত, কেঁদে ভাসিয়েছিল না, বলেছিল না আমায় শক্ত করে ধরে রাখ, যেতে দিস না বোন। সুবোধকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কি দেখতে পাচ্ছ?’ ‘তোমার ইচ্ছেগুলো আমার কল্পনায় এসে জোড়া লাগছে।’ শান্তি এই প্রথম সুবোধের কথায় কোথায় যেন স্বস্তি পেল। তবে প্রপঞ্চময় এতগুলো বছর কেমন করে ডুব দিয়ে তলদেশে তলিয়ে গেল। মা শান্তির চুলে বিলি কেটে বলল, ওই দেখ কত আলো। সূর্য নয় তো। ‘আমি কি বলেছি তাই!’

এত আলোর বন্যা। তীব্র গতি তার। কেমন অদ্ভুত রঙের ছাউনি নিয়ে ঘর বেঁধেছে। ওরাও এসেছে সেই ঘরে। অবন্তীর খেলার মাঠের গোল বৃত্তটার উপর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সকল সঙ্গীসাথী। ওরা এত জোরে দৌড়ল, আলোগুলো ছিটকে গেল এপাশ-ওপাশ। এই রং তার অচেনা। কথার আগুনে পুড়ে মরবে বলে বসন্ত কোন পথ দিয়ে এসেছে কে জানে। ও তো দাঁড়িয়ে ছিল বোধিবৃক্ষের নীচে, জলময় কুণ্ডলীকে ঘিরে ছিল ওর যাত্রাপথ। এমন প্রতিকূলতার যে মুখোমুখি হবে একদিন কে-ই বা জানত। সময় যে এমনভাবে পাক খাবে, দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে চলে এসে এমন সাধনায় যে সিদ্ধিলাভ করবে কিংবা অবন্তী যে দাঁড়িয়ে থাকবে পথের মাঝে যে-পথের চিহ্নে লেগে থাকবে মাকড়সার জাল, বসন্তের অনুভূতি গোল পাকিয়ে তাই না হয়েছে আকাশচুম্বী। রমণীও এনেছিল ভাবনার প্রতিধ্বনি হয়ে, সে তো কমদিন নয়, উল্টোপথের ইশারা পেয়েছিল বলেই না মাথা চুলকাতে চুলকাতে ভেবে নিয়েছিল ও-পথে যাব না। এই বৃত্তে আসবে বলে গোপন আকাঙ্ক্ষা ছিল বলেই না গুটি গুটি পায়ে ঢুকে পড়া। হাতড়ে বেড়িয়েছিল অনেকটা সময়, বুঝেই বলেছিল, ‘এসব আমার নয়।’ কী জানি কোনো আসবাবপত্রের দিকে ইঙ্গিত করেছিল নাকি অন্য কোনও পাওনাগণ্ডা! কত মানুষই তো কত কিছুর পেছনে ছোটে, কে কার খবর রাখে। হৃদয়ের পরিধি মাপে, এমন দুঃসাধ্য কার! রমণীর অসময়ে আগমনীবার্তা অবন্তীকে নাড়িয়ে দেবে, বোঝাই যায়নি। জলের বৃত্তটা খেলা করছে আগুনের গোলা হয়ে, হতে পারে তো এমনটা? ভয় হয় কখন নিঃশেষ হয়ে যাবে, রমণীর চেতনা ডুবসাঁতার কাটতে কাটতে কোন মাঝ সমুদ্রে যে মুখ বাড়াবে, জানবে না তো। কত তো জলজ প্রাণীদের উৎপাত, ওদের ভয়ঙ্কর দাঁত-মুখ খিঁচুনি, চিনতে পারলে তো। কপাৎ করে গিলে নেবে না চিবিয়ে চিবিয়ে, বোঝা তো মুখের কথা নয়। অবন্তী আবিষ্কার করে কতগুলো খুঁটি পোঁতা রয়েছে। কে পুঁতেছে, কখন পুঁতেছে, কেনই-বা পুঁতেছে, মুখে কুলুপ এঁটেছে। কখন আবার কথার খই ফুটবে, কেউ জানে না। অবন্তী স্তব্ধ। হাঁ করে চেয়ে আছে। জানা-বোঝার ঊর্ধ্বে, রমণী কেমন করে এত কাছাকাছি এল, বসন্তই-বা চলে গেল কেন ধরাছোঁয়ার বাইরে! অবন্তী শুধু বৃত্তাকারে ঘুরপাক খায়। আগুনের গোলা ছুটে চলে আসে সুযোগ বুঝে অবন্তীকে গ্ৰাস করবে বলে। কার কোন কারসাজি কে বলবে! দেখতে তো পাচ্ছে কতগুলো মানুষ উলঙ্গ হয়ে ধেই ধেই করে নাচছে। ওদের মুখনিঃসৃত কোনও শব্দই অবন্তীর কানে পৌঁছচ্ছে না।

বাড়িগুলো অনেক উঁচু। কত নালিশ বোঝাই করে এনেছে ঝোলায়। কোথায় কোন নালিশ জানালে কোন জানালার কাচ টপকে সঠিক টেবিলটাকে নাড়িয়ে দিয়ে বলবে, ‘আমায় একটু দেখুন প্লিজ।’ অম্বালিকা ততক্ষণে মানুষের দঙ্গল থেকে নিজেকে আলাদা করে নিয়েছে। ক্ষণে ক্ষণে ছবিটাকে পাল্টে নিয়েছে নিজের মতো করে। দ্রুত পা চালিয়ে যারা সিঁড়ি টপকাতে এগিয়ে গেছে, হঠাৎই তারা মুখ থুবড়ে পড়ল। যা হবার নয় তা হল। যাদের চলন নিম্নগামী ছিল তারা কী এমন কথা ওদের কানে কানে বলল, ওরা নড়েচড়ে বসল। ঘেমে নেয়ে একশা হলে ভাবল একটু ছায়া হলে মন্দ হয় না। এত চড়া আলো হয়তো এই সময়ে বিপজ্জনক। ওদের কর্মচারী প্রফুল্ল ছাতা মাথায় বৃষ্টির ঝাপটা ভুলে গিয়ে কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে, হাতে পতপত করে দুলছে ঝাণ্ডা। কবেকার কথা, বলেছিল, ‘মাহিনাটা পাঁচ টাকা বাড়িয়ে দিন না বাবু।’ মাথা নত করে চোখ দুটো নীচে নামিয়ে কাকুতিমিনতি করে কথাগুলো বললেও কেউ কর্ণপাত করেনি। সেই যে গেল আর ফিরে আসেনি। অম্বালিকার বাপ ঠাকুরদার ভিটে থেকে উচ্ছেদ করেছিল যে-মানুষটি, ওই তো, স্বপন বাঁড়ুজ্জেই হবে, লোকটা গটগট করে হেঁটে এসে প্রফুল্লর চুলের মুঠি ধরে কষিয়ে এমন জোরে থাপ্পড় মারল চক্বর খেতে খেতে এসে ও লুটিয়ে পড়ল ওর পায়ের কাছে। স্বপন যেমনটি দাঁড়িয়েছিল, তেমনি দাঁড়িয়ে রইল। বলার কথা তো অনেকই ছিল। অম্বালিকার সখী ছিল অনুত্তমা, মনের কোণে বিতৃষ্ণা নিয়ে ও বেড়ে উঠেছিল, বুঝতেও চায়নি, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির ভাণ্ডারটার ফারাক, ভেবেছিল এক ঝটকায় সব নিংড়ে নেবে, তাই বলে কি এত দিনের খেলায়, ঘুমের ঘোরে এত চোখের জলে বুক ভাসানো, সান্ত্বনার বাক্যগুলো ফুড়ুৎ করে উড়ে যেত, শেষ পেরেকটা পুঁতে দিয়েছিল ওই স্বপন বাঁড়ুজ্জে। এই সময় অনুত্তমাই একরাশ অভিযোগ নিয়ে রাগে ফুঁসছিল কালভার্টটার উল্টোদিকে মুখ ঘুরিয়ে। শুকনো চোখে বিদ্রূপের হাসি। কী আশ্চর্য! ওই প্রাচীরের কোল ঘেঁষে লোকটা দাঁড়িয়ে কেন? এমন অশোভন হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে সময়ের মুণ্ডপাত করা যায়! যায় কি? আপনারাই বলতে পারেন। যদি যায়, প্রফুল্লই-বা ওর হাতের মুঠোয় এসে গেল কেমন করে! এমনটা হওয়ার তো কথা ছিল না। বরঞ্চ ছবিটার আদ্যোপান্ত যে-রকমটা হলে মনের কোণে দাগ লাগতে পারত, অনুত্তমা ফোঁস করে এসে লোকটার টুটি চেপে ধরবে, বংশ নির্বংশ হবে। লক্ষ্যটা কৌণিক বিন্দুতে এসে এমন করে নাচানাচি করল, লোকটা প্রফুল্লকেই গণশত্রু হিসেবে বেছে নিল। এই তো আজব কাণ্ড! প্রফুল্লর বাঁচা না-বাঁচার খতিয়ান মনের হিসেবের খাতা থেকে তো বাদই পড়ে গেছে কয়েক দশক আগে তাই না! এতটা অনমনীয় অনুত্তমা, এতটাই বিধ্বস্ত প্রফুল্ল। তাই কি স্বপন আরও বিধ্বংসী, রুখে দাঁড়িয়েছে প্রবল পরাক্রমশালী হয়ে। অম্বালিকার কিছুই নজর এড়ায়নি। সেনানীরা লেফট রাইট লেফট রাইট মার্চ করে এগোচ্ছে। কী জানি চুলের মুঠি ধরে দ্বিগুণ তেজে বনবন করে ঘোরানোর আকাঙ্ক্ষা নিয়ে। স্বপনের অঙ্গুলিহেলনের অপেক্ষায় সময় গুনছে। অম্বালিকার চোখে কি ছানি পড়েছে! এত কনকনে ঠাণ্ডায় এত খটখটে রোদ পুরো চাতালটাকে ঘিরে ফেলেছে কী করে! এমনটা হওয়ার সময় হয়েছে না কি হয়ে চলেছে অম্বালিকা টের পাচ্ছে না। এই প্রাচীর, প্রফুল্ল অনুত্তমারা সময়কে এমন করে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিল কেমন করে! অম্বালিকার চোখের পাতা পিটপিট করে, কোনো শাসনই এই দৃষ্টি মানে না।

চলো এবার নিজের দেশে যাই। একটু না হয় চিন দেবার বৃথা চেষ্টা করি না কেন? রজনী অরুণকে এমন একটা প্রস্তাব দিল যখন সূর্য অস্ত যাচ্ছে। গাছের ডালে পাতায় পাতায় আঁধারের প্রলেপ এসে জমছে একটু একটু করে। ওরা নিজেরাই ঠিক করেছে দরজায় এসে কড়া নেড়ে জানতে চাইবে ‘তোমরা কি ঘুমের দেশে চলে গেছ? এবার কি জেগে উঠবে?’ মিনমিনে একটা স্বর ভেসে এল বুঝি। এমন কণ্ঠস্বর এর আগে রজনী কখনও শোনেনি বুঝি। কারা এসে বাসা বেঁধেছে এই নির্জনে। কোনো বনলতা, আকন্দ, ঘেঁটু ভাট কলাবতীরা গোপনে আস্তানা গেড়েছে কি না কে জানে। ওদের মিলনমেলায় জন্ম নিয়েছে কথার পরে কথা। অরুণ ফাঁকফোকর দিয়ে দেখল, গাছেরা মানুষ হতে চাইছে। আর্ত চিৎকারে ভেসে আসছে গুল্মলতার গোঙানি। ওরা চলে-ফিরে বেড়ানোর যাবতীয় কৌশল রপ্ত করতে চাইছে। কাঠুরিয়ারা গাছ হবে বলে কত যে মন্ত্র আওড়াচ্ছে, রজনীর বোঝা দায়, তবুও কান পাতে। অরুণ মানুষকে জানোয়ার হতে এর আগে কখনও দেখেনি। এমন অভাবনীয় দৃশ্য যে প্রত্যক্ষ করবে, এমন সাধ্য ছিল না অরুণের। ও-পার থেকে এ-পারে আসার দূরত্বের মাঝখানেই ওরা শরীরটাকে বাঁকিয়ে কুকুর হতে চাইল। আবার কারও নিয়ন্ত্রণহীন ইচ্ছের দৌলতে বিড়াল হতে চাইল। মানুষটাকে বাস্তুসাপ হতে দেখল ওরা। হাঁটতে হাঁটতে ঢুকে গেল কচুবনে। তাই বলে এমন দশা ঘটবে পিসতুতো মামাতো ভাইবোনেরা গাছ হয়ে যাবে! এই উত্তাল সময়ে ওরা স্থির হতে চাইছে বলে। কৈশোরে ওদের স্থির সঙ্কল্প ছিল ওরা মানুষের চেয়ে বড়ো মানুষ হবে। সেই আশায় সার জল দিয়ে ওরা অনেক ধাপ পার হল। কেউ কেউ বলল, এটাই কি পথ! কথাগুলো মন্দ লাগল না। অরুণ রজনীরা যেদিন গাছের গোড়ায় জল দিতে লাগল, শাল শিমুল গরানরা তরতর করে বেড়ে গেল, তখন ওরা পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো মাঠটা কম সময়ে পার হয়ে গেল। তাতে কী এল গেল, দেখার সুখ হল না। কী আর করা! মনের সুখের আশায় রাস্তাটা পালটাতে পালটাতে কত পথ যে হাঁটল তার কি হিসেব-নিকেশ আছে। গাছেরা সমস্বরে বলল, ‘কোথায় যাও হে?’ ‘তোমরা কারা?’ ‘সে জেনে তোমাদের কাজ কী?’ ‘উপায়টা বাতলে দিতে পারি।’

গাছ হবে? আরে ঘাবড়াও কেন? মজবুত ঘরও হবে, সকল আশা পূর্ণ হবে। মুহূর্তে রজনী অরুণরা দেখল, লম্বা গাছগুলো কেমন ছোটো হয়ে যাচ্ছে। ওরা বলল, ‘আমরাও ছোটো হব।’

তরণী এসে তীরে ভিড়ল। অপেক্ষায় কারা কারা আছে কেউ আর গুনতি করেনি। যারা স্রোতের প্রতিকূলে যাবে তারাও আছে, যারা স্রোতের অনুকূলে যাবে তারাও আছে। বাজার সরকার, দোকানদার, কোয়াক ডাক্তার, কবিরাজ, শিক্ষক, ছাত্র, কারবারিদের ভিড়ে এককোনায় নীরবে দাঁড়িয়েছিল অরণি। কেন দাঁড়িয়েছিল বাকিদের কাছে অজানা, নিজেও জানে কি এই অপেক্ষা ওকে কোন গন্তব্যে পৌঁছে দেবে। কী যেন দেখতে চেয়েও দেখতে পেল না। উচ্ছল ঢেউ হঠাৎই টলমল করে উঠল। খুশিতে ডগমগ হয়ে পাড়ে এসে দোল খাবে এমন ইচ্ছায় ওরা লেজ দোলাল। পাড়ের কিনারে কেউ তো নেই। ওরা শুধু খলবলিয়ে চলেছে মাঝদরিয়ায়। কেউ যে হাত বাড়িয়ে গলুই থেকে হাত বুলিয়ে দেবে, এমন দৃশ্যও দেখা গেল না। বরঞ্চ তরণী যে-দিকে ছুটছে, হাওয়ার বেসামাল শব্দ কানে ভাসছে। অরণি যে-ছবিটা দেখতে পেল তরণীর দুলুনিতে পাড়ের গাছের ছায়ারা ভেঙে চুরমার হলে গাছেরা ভীত সন্ত্রস্ত হল, চিনতে চেষ্টা করল ওরা কারা! দু-চারটে বুড়ো উদবেড়াল চোখ পাকিয়ে আর কান খাড়া করে শুনল, গাছেরা কেমন করে কথা কয়। অরণির দিকে তাকিয়ে করুণ আর্তিতে জন্মের মুহূর্ত দেখার বাসনা জেগে উঠল, আবার পরখ করে যদি দেখতে পেত। ওরা গভীরে যেতে চায়। ওদের শরীরে মিশিয়ে দিতে চায় নিজেদের শরীর। ওরা জানে যে দর্পণে ওরা নিত্য মুখ দেখে ওদের ছবি নয়। অরণিও জানে ওদের বেদনা কেমন করে ছবি হয়ে ফুটে ওঠে। অরণি ওদের চাওয়া-পাওয়ার হিসেবও কষে রাখে। অরণিকে ডেকে ওরা কথা কয়। ‘শান্ত সলিলের দেখা যদি পেতাম, দেখ না, তোমার পায়ে পড়ি।’ আলোয় আলোময় হয়ে মানুষের চঞ্চলতা ঘুরে মরে। এই অশান্ত পথিকের লাফঝাঁপ নিরুপায় হয়ে অপেক্ষায় থাকে কখন সব থেমে যাবে, ওরা ওদেরকে দেখে জেনেবুঝে নেবে কতটা বাড়লে কতটা মেলে দিলে ছায়াবীথি হবে, কতটা গুণবতী আর রূপবতী হলে ওরা দু-দণ্ড দাঁড়িয়ে বলবে, ‘তোমরা আমাদের আত্মীয় হবে গো।’ পেছন ফিরে তাকায় না, তরঙ্গ তুললে শরীর আর শরীর থাকে না। রাতের আঁধারে নিথর হয় বটে, তাতে কেবলই সবকিছু অচেনা ঘুম ঘুম মনে হয়। অরণি ওদের কথার জালে জড়িয়ে বেবোল হয়। অরণি কী মনে করে বলেই ফেলে, ‘ও গাছ, তুমি শব্দের জন্ম দাও, প্রসববেদনায় জেগে ওঠো, তোমার কথা শুনে আমি একটুখানি কান্না করি, কথা কাটাকাটি করি, ঝগড়া করি। নদী না-হয় কান পেতে শুনুক। এসো না ত্রিনাথ হয়ে যাই।’

অঙ্গদ একদিন ঠিক করেছিল যুদ্ধে যাবে। সে কথা প্রদ্যুৎকে ঘটা করে বলেই ফেলেছিল। মাঠটা এতদিন খালিই পড়েছিল, কোনো ভ্রূক্ষেপই করেনি। দর্শকদের চিৎকারে ফিরে ফিরে দেখল, বল্লাল পাঁই পাঁই করে ছুটে বেড়াচ্ছে মাঠ জুড়ে। উরুটা সমান তালে চলছে। বিপক্ষের দলে এমন কেউ নেই ওর গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে। কোথায় যেন অঙ্গদের স্বপ্নটা লাফিয়ে উঠল। একটু আগেই নয় নম্বর রেজিমেন্টের দল নিজেদের কারিকুরি দেখিয়ে ব্যারাকে ফিরে গেছে। এই সুযোগে করবে বাজিমাত। একবার যাচাই করে দেখবে ও কোনো অংশে কম যায় কিনা। ওই তো পাঠশালা। ছেলেমেয়েদের হৈ হৈ রৈ রৈ কলরবে ক্লাসরুমটা শূন্য হয়ে যেন মাঠের মাঝখানে চলে এল। কে আর কার কথা শোনে। সকল প্রশ্নের উত্তর সবুজ ঘাসের বুকে লেখা হয়ে যায়। ওরা উচ্চকন্ঠে নিজের কথাগুলোই এমন করে বলতে চায় যেন এতকাল সুযোগের অপেক্ষায় দিন গুনছিল। অঙ্গদ আবারও চরকির মতো ঘুরপাক গেল। উল্টোপথ দিয়ে কত লোক তো গলাগলি করে ওদের সুখ-দুঃখের কথা বলতে বলতে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। অঙ্গদকে দেখল কি দেখল না, না দেখতে চাইল না – সে আর অঙ্গদ কেমন করে জানবে। অঙ্গদের বড়ো শখ ওই জলপাই রঙের পোশাক পরে শহরের বড়ো রাস্তা দিয়ে ছুটে চলে যাবে। মাঠটাকে যেভাবে দেখতে চাইছিল কিংবা দেখতে চাইবে তার কোনো আগাম সংকেত কেউ পৌঁছে দিতে চাইছে কিনা। মাঠটা ছিল তো বর্গাকার ধীরে ধীরে কেন ত্রিভুজ আকৃতির রূপ নিল। বল্লাল আর অঙ্গদ এই দৌড়ের খেলায় জিতবে কেমন করে? কারা ওদের স্বপ্নগুলো নিয়ে লারেলাপ্পা খেলছে। পাঠশালা আর মাঠটাও একই পংক্তিতে এসে বল্লাল আর অঙ্গদের জন্য ভিন্ন নিশানা নিরূপণ করে দিতে চাইছে। অঙ্গদ আর প্রদ্যুৎ এখন অন্য খেলায় মত্ত। পাগলা ষাঁড়টা ক্ষেপে উঠেছে। মাঠের অধিকারের নেশায় ও ঠিক করেছে এখন সকলকে গুঁতিয়ে লম্বা করে দেবে। অঙ্গদ আর বল্লালের দফারফা করে ছাড়বে। সকল যুক্তিকে ও ফুৎকারে ওড়াবে, কে আর কত নজর করবে, কানে যে ও তুলো গুঁজবেই গুঁজবে, হাসাহাসি কানাকানি চুলোয় যাক। তীব্র বেগে ও ছুটে আসছে। অঙ্গদও ছেড়ে দেবার পাত্র নয়। ষাঁড়ের দুটো শিং, অঙ্গদ আর বল্লালের শক্ত হাতের মুঠোয়। ষাঁড় ভেবেছিল দেয়ালে ঢুঁ মারবে, হবে চিৎপটাং, সে গুড়ে বালি। তার আগেই খেল খতম। বিনা সওয়ারিতেই শিং দু-টো ফটাস। মাঠটা ওদের বোঝার আগেই কেমন করে বর্গাকার হয়ে গেল। স্বপ্নগুলো নিয়ে ওরা বনবন করে ছোটে এই ফাঁকে, ষাঁড়টার চোখদুটো ঝাপসা হলে ভাবে, ‘বাপরে এ আবার কী আজব কাণ্ড কারখানা!’

সুবোধ সারি সারি মরার শরীর আগলে রেখে যে উপলব্ধিতে ভেসে যেতে চাইল তা জীবনও নয়, মৃত্যুও নয়, কোথায় কী এমন এক সময়ের সন্ধিক্ষণ তার শুরুই-বা কোথায়, শেষই-বা কোথায়, অদ্ভুত এক শূন্যতা যা পূরণ করার উপায়ান্তর নেই। এক-একটা মাপজোকহীন বিন্দুতে যারা আপন নিয়মে খেলে বেড়াচ্ছে যেমন করে ওরা খেলবে বলে ইচ্ছে প্রকাশ করেছিল। সৌমিত্রদাকে দেখে চমকেই গেল সুবোধ। মঞ্চের এক কোণে গুটিসুটি মেরে বসে সংলাপ আওড়াচ্ছে, নিস্তরঙ্গ নদীর উদ্বেলতা থেমে গেলে যেমন ধীর অচঞ্চল হয় তেমনি। উচ্চস্বরে মঞ্চ দাপিয়ে আওড়াতে গেলে কষ্টে বুকটা ফেটে যায়, চোখের পলকে দেখে নেয় দর্শকাসনে বসে থাকা মুখগুলো কতটা বুঁদ হয়ে আছে। ওদেরকে ধাক্বা মারবে বলেই না জোড়হাত করে মঞ্চটা প্রদক্ষিণ করে শব্দের তীক্ষ্ণতাকে বুঝতে চায়। হঠাৎই তর্জন-গর্জনে মঞ্চ কেঁপে ওঠে। দর্শকরা বিমূঢ় নির্বাক হলে সৌমিত্রদা বুঝে নেয় নিউটনের তৃতীয় সূত্র নিজের নিয়মে সংযোগ ঘটাচ্ছে, শব্দতরঙ্গ তরতরিয়ে সামনে পেছনে ডানে বাঁয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এবার সৌমিত্রদা মঞ্চের মাঝখানে দাঁড়িয়ে দৃষ্টি শূন্যে ভাসিয়ে এমন সংলাপ আওড়াচ্ছে যা কিনা মনে হচ্ছে মঞ্চস্থ নাটকের বিষয়বিভ্রম। এমন উচ্চারণের সময় যে আসন্ন প্রিয় দর্শকমণ্ডলী আঁচ করতে পেরেছে কি! দর্শকাসন থেকে হাততালি দেয় অবন্তী, অম্বালিকা, অরণি আর প্রফুল্ল। মাঝখানের তিনটে সিট বাদ দিয়ে রমেশ আর শান্তি বসে গুনেই চলছে কোন আসনটা ফাঁকা, ওখানে কি নির্বান্ধব জীবনানন্দ এসে বসবে একটু পরে। অঙ্গদ আর বল্লাল সামনের সারিতে বসার সুযোগ পেয়ে গেল! উদ্যোক্তাদের ম্যানেজ করে না ভিআইপি কোটায়! তবে কি ষাঁড়ের খাতায় নাম লিখিয়েছে! কত কী-ই না হয়। সুবোধ ঢোক গেলে। সুবোধের মনটা আনচান করে। প্রাণভরে মানুষটাকে এক পলক দেখবেই দেখবে। চারধারে কথা উড়ছে। ফিসফিসানিটা নিতে না পেরে রাগে ফুঁসল। সৌমিত্রদা চিৎকার করে, ‘এই তোমাদের হাততালি দেওয়ার সময় হল, এতদিনে বৃথাই আমি শত শত রজনী পার করে এলাম।’ একরাশ অসন্তোষ নিয়ে অস্থির হয়ে বলল, ‘ভাব-অভাবের পালা সাঙ্গ হয়েছে, এবার আমি নিজের ঘরে যাব।’ সুবোধ পেছনের সারি থেকে গ্রীনরুমে ঢুকেই দেখল সৌমিত্রদা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে বিড়বিড় করছে, ‘এদের জন্ম! বড্ড ভুল হয়ে গেছে। ডুব দিতেই শেখেনি, বলে কিনা পয়সা দিয়ে টিকিট কিনে রস কিনবে, আবার আগাম বুকিং!’ আরে এ তো মনোময়! পার্কের জলাশয়ের পাশের আসনটায় বসে আকাশের তারা গুনছিল। রজনী অরুণকে সাক্ষী রেখে নিজের বঞ্চনার হিসেব কষছিল, আকাঙ্ক্ষিত জীবন আর ফেলে আসা জীবনের পাঠশালায় কে কোথায় কেন? এ যেন কোথায় হাজির করছে, কতকাল ধরে অজানিত, তবু সুবোধের জগৎটা নাটকের শেষ অঙ্কের মতো ঘুরে ফিরে চলে আসে। সৌমিত্রদাও আসে কি! আসে হয়তো, আসবেই হয়তো কিন্তু এখন নিশ্চুপ অন্ধকারে সৌমিত্রদার কান্নার শব্দই শুধু শোনা যায়, বাকিরা শুধু কুশীলব।

Categories
2023-Sharodiyo-Golpo

তীর্থঙ্কর নন্দী

বটবৃক্ষদের আত্মকথা

মিলনপুরের গ্রামের রাস্তাটি মোট সাতটি পুকুরের পাশ দিয়ে এঁকে বেঁকে সোজা থানার দিকে চলে যায়। মিলনপুর থানা খুব বিখ্যাত। থানা ছাড়িয়ে রাস্তাটি চলে গেছে সোজা বাজারের দিকে। বাজারের আগেই বিশাল এক মাঠ। মাঠের মাঝখানে বড়ো আকারের একটি বটবৃক্ষ। বৃক্ষটি স্বাভাবিকভাবেই বেশ ঝাঁকড়া। ঝুড়িও নেমে এসছে। ফলে সন্ধ্যা হতে না হতেই এলাকাটি বেশি অন্ধকার অন্ধকার লাগে। মানুষজনের এই অন্ধকারটি বেশ পছন্দের।

বৃত্ত এবং তৃণা মিলনপুরেই থাকে। দু-জনেরই বাড়ি বাজার লাগোয়া। তবে তৃণা থাকে সামান্য দূরে। রেশনের দোকানের কাছে। দু-জনেই শৈশব থেকে প্রচুর বটবৃক্ষ দেখে আসছে। বিভিন্ন জায়গায়। স্কুলে কলেজে যেতে আসতে। বন্ধু বান্ধবদের বাড়ির কাছাকাছি। বিভিন্ন ভ্রমণস্থলে ইত্যাদি। কিন্তু মিলনপুরের এই বৃহৎ বটবৃক্ষটি তাদের অনেক আপন। কাছের। এর নীচে বসে হাসি কান্না ভালোবাসা গল্পগাথা সব প্রাণখুলে করা যায়। কখনো এই বৃক্ষ চোখ রাঙায় না। বাড়িতে রিপোর্ট করে না। রাগ করে না। এই বটবৃক্ষ সন্ধ্যার পর ছড়িয়ে দেয় অন্ধকার। স্নেহভরা ভালোবাসা। গোপনীয়তা।

নিত্য সন্ধ্যায় বৃত্ত আর তৃণা এই বটবৃক্ষের কাছে আসে। খবরের কাগজ বিছিয়ে বসে। শুরু করে কথামালা। গল্পগাঁথা। প্রেমকাহিনি। পরস্পরের ছোঁয়াছুয়ি। আবদার আহ্লাদ ধৈর্য অধৈর্যর খেলা কখনো মন কষাকষি। চোখজোড়া থেকে নেমে আসে জলবিন্দু। দুঃখ। রাগ বিরাগের গালগল্প। আবার বহুদিন শরীরের খেলা। বৃত্তর হাত চলে যায় স্তন জোড়ায়। যোনিপথে। মাংসল স্তনজোড়া তৃণার যেন খুব সুগন্ধযুক্ত। আকৃতি নরম। বৃত্তর হাত স্তনজোড়ায় পড়লে তৃণার চোখজোড়া বুজে আসে। মাথা বৃত্তর কাঁধে এলিয়ে পড়ে। আবার যোনিপথে হাত গেলে তৃণার নরম শরীর কেঁপে ওঠে। সুখে যেন কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে। গোঙানি আসে। বটবৃক্ষটি তৃণাকে ঝুড়ি দিয়ে জড়িয়ে ধরে। আগলে রাখে। বেশি অশান্ত কামুক হতে দেয় না। তৃণাকে নির্দিষ্ট মাপে বেঁধে রাখে। একসময় রাত হলে দু-জনে উঠে পরে। বাড়ি চলে যায়।

এই শহরে নলবনের কাছে ঝাঁকড়া দু-টি বটবৃক্ষ। দু-টির মধ্যে দূরত্ব দু-শো হাত। একটি বাঁধানো। অন্যটি না-বাঁধানো। বাঁধানো বটবৃক্ষের নীচে নিত্য গল্পগুজব চলে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের। বৃদ্ধরা একটু আলাদা বসে। বৃদ্ধারা বসে একটু দূরে। নিজেদের মতন করে। এমনভাবে দুদল বসে যে কোনো দল তাদের গোপন কথা শুনতে পায় না। অথচ গল্পমালাসিঙ্গারা চলে। গল্পমালায় থাকে রস কষ বুলবুলি মস্তক।

দু-টি বটবৃক্ষই জানে নিত্য বিকাল সারে পাঁচটার পর কারা কারা আসতে পারে। বাঁধানোতে আসে সত্তরের বুড়ো নিলয় বাহাত্তরের বুড়ো অজয় পঁচাত্তরের বুড়ো জয়মাল্য আশির বুড়ো সুজয়। উলটো দিকে সত্তরের বুড়ি মাধুরী পঁচাত্তরের বুড়ি সরলাবালা আশির বুড়ি নয়নতারা পঁচাশির বুড়ি বৈজয়ন্তি। মোট আটজন বসে। বাঁধানো বটবৃক্ষ জানে এই আটজন কোনো হিসাব মিলিয়ে আসে না। চারজন চারজনের ভিতর কোনো আবেগ যুক্তি প্রেম বিরহ কিছুই নেই। আসে শরীর স্বাস্থ্যের দিকে তাকিয়ে। কেন-না এঁদের মোটামুটি সবারই ডাক প্রায় আসছে আসছে। ফলে সান্ধ্য হাঁটাচলা একটু নিজেদের ভিতর গল্প করা সবই আর-একটু বেঁচেবর্তে থাকার ওষুধ বাঁধানো বটবৃক্ষের নীচে বুড়োদের গল্প এখন সুগার প্রেসার প্রেস্টেট ইত্যাদি। এই বটবৃক্ষ জানে আগে অনেক তরুণদের সমাগম হত। সেই সমাগমে কি তখন নিলয় অজয় জয়মাল্য সুজয়রাই আসত! হয়তো তাই। বটবৃক্ষর স্মৃতি প্রখর। তার পাতাগুড়ি আজ থাকে কাল থাকে না। ঝড়াপাতার জন্য তার কম কষ্ট হয় না। যেমন আজ আর নিলয়ের স্ত্রী নেই। মৃগীতে মারা যায়। অজয়ের বড়োছেলে দুর্লভ আত্মহত্যা করে। বটবৃক্ষ সব জানে। বটবৃক্ষ যেন অনেকদিন আগে মাধুরীকে দেখে। শর্টকাট ফ্রক পরা। সবে ষোলোর যুবতী। ছিটকে যাচ্ছে যৌবন। ফ্রকটি ছিল সাদা কালোয়। সরলাবালা কি স্লিভলেস ব্লাউজে আসত! হতে পারে। পাতার ভিতরে এত যুবক যুবতী কাকদল যে বটবৃক্ষর খেয়ালও ক্ষীণ হয়ে যায়। শুধুই শব্দ সান্ধ্য কা কা। বটবৃক্ষ জানে নয়নতারা সরল মেয়ে। বিবাহ হয় চল্লিশ বছর আগে। ফর্সা গায়ের রং বৈজয়ন্তি খুব হেসে হেসে কথা বলত। এখনও এই বুড়ি বয়সেও বলে। ওর হাসিতে মাখানো থাকে এক মায়া প্রেম আদর।
দু-শো হাত দূরে যে-বটবৃক্ষটি সেখানে ইদানীং বসে ফ্রডেরা। মানে ঠগেরা। আগে আসত স্কুলের ছেলেমেয়েরা। কলেজের ছেলেমেয়েরা। গত কুড়ি বছর ধরে আসতে থাকে ফ্রডেরা। ঠগেরা। অর্থাৎ দেশ ডিজিটাল হওয়ার পর। হয়তো কথাটি ভুল। মানুষ তো আগেও ঠগ ছিল! বটবৃক্ষ ঠগের তারতম্য বোঝে। বটবৃক্ষ প্রেম অপ্রেমের ভাষা বোঝে। কান পেতে শোনে ঠগেদের বাক্যালাপ। ইদানীং রনো রুনি আসে। হাতে দামি অ্যানড্রয়েড। অনেক বাড়তি সুবিধাও আছে মনে হয় এই সেটে। বটবৃক্ষের একদম উত্তরের কোণে দু-জনে বসে। একটু ঘন হয়ে। মনে হয় যেন প্রেমিক প্রেমিকা। কিন্তু তা না। দু-জনেই বর্তমান সময়ের ফ্রড। ঠগ। খুব চাপা গলায় দু-জনে কথা বলে। এমন চাপা যে বাতাসের কানও জড় ভোঁতা হয়ে যায়। অথচ নরম বাতাস দু-জনের আসে পাশে ঘোরাঘুরি করে। বটবৃক্ষের কচি পাতা দোল খায়। রনো রুনিকে দেশের কোণে কোণে ফ্রডেদের গল্প বলে। দু-জন দু-জনের ফ্রড বন্ধুদের কনট্যাক্ট নম্বর সেভ করে। মেসেজ করে ইত্যাদি। কবে কোন ব্যক্তির ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট হ্যাক করতে হবে কীভাবে করতে হবে কোন কোন ব্যক্তির ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট কী পরিমাণ অর্থ আছে এদের সবই ঠোঁটস্থ। মুখস্থ। এরা সপ্তাহে দু-একটি করে অ্যাকাউন্ট পুরো সাফ করে দেয়। এই সাফের পিছনে এদের প্রচুর মাথা ঘামাতে হয়। খাটতে হয়।

নিত্য নতুন রহস্যময় গল্প ভাবতে হয়। আর সেইসব রহস্যময় গল্প একদমই গাঁজাখুরি নয়। গল্পগুলি ব্যাঙ্ক গ্রাহকদের কাছে বকুল ফুলের গন্ধের মতন নেশা ধরায়। নেশায় ঘোর লেগে নিজস্ব ব্যক্তিগত ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের সব গোপন তথ্য এক এক করে দিতে থাকে। অ্যাকাউন্ট খুব মসৃণভাবে জিরো ফিগারে নেমে আসে ইত্যাদি।

ব্যস্ত শহর থেকে একটু দূরে হৃদয়পুর। একটু দূরে বলতে বাসেও যাওয়া যায়। ট্রেনেও যাওয়া যায়। বাসে গেলে এক ঘণ্টা। ট্রেনে গেলে এক ঘণ্টা পাঁচ মিনিট। হৃদয়পুর স্টেশনে নেমে ডান দিকের ওভার ব্রিজের নীচে বিখ্যাত বিরিয়ানির দোকান। মাসি মেসোর। এই দোকানে মটন বিরিয়ানি দু-শো! মসৃণ আলু। নরম। মাংস যেন জিভে ঝোলানো। দাঁত কাঁপে না। দাঁতে জোরও লাগে না। হাড় থেকে নিঃশব্দে মাংস খুলে আসে। এই দোকানে বিরিয়ানি খেয়ে যদি একটু এগোনো যায় চোখে পড়ে সুড়কির রাস্তা। একটু লালচে। সেই লালচে রাস্তার পাশে মানে বিডিও অফিসের কাছাকাছি একটি বিখ্যাত বটবৃক্ষ আছে। রাস্তার পাশে বলে বটবৃক্ষের গুঁড়ির কাছে সাদা মার্কিং আছে। যারা গাড়ি নিয়ে আসে তাদের সেই সাদা মার্কিং-এ অনেক সুবিধা হয়। কেন-না রাস্তায় আলোগুলি দেখলে মনে হয় অনেক পুরোনো অথচ আলোয় রশ্মি এত নরম নিস্তেজ যে কোথায় গাছ কোথায় পুকুর কোথায় কচুবন কিছুই বোঝা যায় না।

আজ শনিবার জ্যৈষ্ঠের দশ। একটি কালো নেক্সান গাড়ি এসে থামে। গাড়িটি নতুন মডেলের। গাড়ির কাচও কালো। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই কে ভিতরে। বটগাছের কাছে এসে গতি ধীর হয়ে যায়। গাছ ছাড়িয়ে আরও কিছুটা এগিয়ে গিয়ে গাড়ি থামে। নামে দু-জন মধ্যবয়সি মানুষ। একজন পুরুষ। একজন মহিলা। বটবৃক্ষ বেশ ভালোই চেনে দু-জনকে। নাম প্রিয়ক। প্রিয়া। বটবৃক্ষ জানে প্রতি শনি রবি দু-জন আসবেই। ঘাসে রঙিন রুমাল বিছিয়ে ঘণ্টাখানেক ধরে নীচু স্বরে চলবে গল্প আড্ডা চুমাচুমি। বদান্যতা অসভ্যতা। বটবৃক্ষ গত তিন বছর ধরে দু-জনেরই চেনে। দু-জনেই পরকীয়াতে লিপ্ত। দু-জনেরই গোছানো সংসার আছে। নিজস্ব বাড়ি আছে। দু-জনেরই একটি করে সন্তান আছে। তবুও কেন কীসের টানে এই পরকীয়া! কেন সংসারকে ফাঁকি দিয়ে এতদূরে আসা। পরকীয়াতে গোপনীয়তা বেশি থাকে বলেই কি এত আনন্দ! মজা! অথচ পরকীয়াতে যে-রক্তমাংসের শরীর আছে সাজানো গোছানো সংসারেও তো সেই রক্তমাংসের শরীর থাকে! তবে কেন পরকীয়াতে এত আনন্দ!

হৃদয়পুরের বটবৃক্ষটি একটু পৃথক। সে সব বটবৃক্ষর সঙ্গে নিজেকে মেলায় না। এই বটবৃক্ষ অনেক বটবৃক্ষর কথা জানে। প্রিয়ক প্রিয়া নিজেদের ভিতর আলোচনা করতে করতে জানায় গত দু-বছর কোন কোন বটবৃক্ষের নীচে তারা গল্প করে। বদান্যতা করে। অসভ্যতা করে। প্রতিটি বটবৃক্ষ প্রিয়ক প্রিয়ার বদান্যতা চেনে। পরকীয়া চেনে। হৃদয়পুরের বটবৃক্ষর নীচ থেকে নেক্সান কালো গাড়ির কালো কাচে ঢাকায় বাড়ির ফেরার পথে মাসি মেসো বিরিয়ানির দোকানে একটু প্রিয়ক থামবে। থেমে প্রিয়ক নামে। প্রিয়া গাড়িতে বসে থাকে। জানি না কেন প্রতি শনিবার রবিববার প্রিয়া গাড়িতে বসে থাকে। বটবৃক্ষ দূর থেকে দু-জনকে দেখে। বটবৃক্ষর কি কোনো অন্তর্দৃষ্টি থাকে! তার ডালের ভিতর দিয়ে! কচি পাতার ভিতর দিয়ে! প্রিয়া একজন সংসারী মহিলা। সন্তান-সহ সুখে সংসার করে। তবুও কেন পরকীয়ার এত টান! প্রশ্নটি কিন্তু এই সমাজে কারোর কাছে নয়। একমাত্র বটবৃক্ষর কাছে। বটবৃক্ষই জানে সব উত্তর। বটবৃক্ষরাই জানে সবার উত্তর। ফলে এখানেই শেষ হল বটবৃক্ষদের আত্মকথা গল্পটি।

Categories
2023-Sharodiyo-Golpo

পাপড়ি রহমান

পাতার পাহাড়, রক্তবর্ণ হিম আর উষ্ণবয়সি ব্ল্যাকবোর্ড

টিলার উপর থেকে রাবারবাগানটাকে একেবারে পাতার পাহাড়ের মতো দেখায়। রাবার প্ল্যান্টগুলোর পাতাই কেবল দৃশ্যমান হয় বলে প্রাথমিকভাবে আমাকে এই বিভ্রমের ভেতর পড়তে হয়েছিল। অবশ্য এই বিভ্রমের ভেতর নাস্তানাবুদ হওয়ার পূর্বে আমি ঝুক্কুর ঝুক্কুরের দুর্দান্ত স্বাদ পেয়েছিলাম। আদতে ওটাই ছিল আমার জীবনের প্রথম স্বাধীনতা। স্বাধীনতা মানে যেনতেন প্রকারের স্বাধীনতা নয়। দীর্ঘকাল ফাটকবাসের পর এক্কেবারে গ্যাস বেলুনের মতো উড্ডীন হতে পারা। উড়তে উড়তে ঘুরতে ঘুরতে আকাশ ছুঁয়ে ফেলার মতো ঘটনাই ছিল সেটা। আমার আতঙ্কবাদী বাবা ওই প্রথমবার আমাকে ঘরের বাইরে দুই পা ফেলতে দিলেন। আর আমার এইরকম গ্যাসবেলুন হয়ে ওড়ার সুযোগ ঘটল রাজাকাক্কার কল্যাণে। রাজাকাক্কা মানে বাবার ফুফাত ভাই। তদুপরি তিনি ফরেস্টার বা আরও ঊর্ধ্বতন কোনো পদে কর্মরত। বাবা তাকে মোটামুটি দেবতাজ্ঞান করেন। রাজাকাক্কার মেয়ে বিউটি আপা আমার চেয়ে পাঁচ ক্লাস উঁচু। ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিতে যে কিনা আমারই ইশকুলে ভর্তি হল। আর বিউটি আপার সাথে আমার খাতির জমল দুধে ভেজানো চিতইয়ের মতো। যাতে কেবল চিত হয়ে ভেসে থাকা। উপুড় হওয়ার মতো কোনো ঘটনাই ঘটল না কোনোদিন! রাজাকাক্কা আর বিউটি আপার ব্যাপক টানাহেঁচড়ায় আমার আতঙ্কবাদী বাবার দিল সামান্য নরম হল। কিন্তু বন্দুকটা রইল আমার দিকে তাক করা। এই এক আরেক বিভ্রম। ভয় আর ভালোবাসা। দোস্তি আর ঘৃণা। আমি জানি তাক করে রাখা বন্দুকের নলটি অন্যত্র সরিয়ে নিলে বাবা একেবারে অন্য মানুষ। সদ্য জন্মানো শিশুর গায়ের পেলবতা সেই মানুষের মনে সেঁটে থাকে। অচেনা রূপ-গন্ধ-আশ্রয়। অথচ অহেতুক এই বন্দুক তাক করে রাখা — বাবাকে একেবারে আতঙ্কবাদীতে পর্যবসিত করেছে।

একেবারে পরম পাওয়া এই ঝুক্কুর ঝুক্কুর। ট্রেন আমাকে নিয়ে ছুটল ম্যালা দূর! ম্যালা দূর কত দূর? এইটা একটা প্রশ্ন বটে! ম্যালা দূর যে কত দূর তা মেপে বের করা মুশকিলের বিষয়।

ঝুক্কুর ঝুক্কুর করে ট্রেন গতি নিয়ে ছুটে চলল। আর গাছেদের-পাতাদের গন্ধ আমার নাকে ঝাপটা মেরে যেতে লাগল। আহ! কী করে বোঝাই যে সবুজের কী অদ্ভুত গন্ধ আছে! গাছেদের-পাতাদের গন্ধ কি মাতৃজঠরের গন্ধের মতো? আমি জানি না। মাতৃজঠর মানে কী তাই তো আমি ভালো জানি না!

উথালপাথাল করা সবুজগন্ধে ভাসতে ভাসতে আমি ট্রেনের জানালায় মুখ রাখলাম। তখন দুই ধারে পাহাড়ের সারি, বনজ ঝোপ দেখা দিয়েই মিলিয়ে যেতে লাগল। যেন ওরা মেঘের বিদ্যুৎ। সামান্য ঝিলিক মেরেই অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। আমার দৃষ্টি পিছলে যায় লালমাটি আর দেবদারুর বনে। ভিনদেশি ত্বক নিয়ে ইউক্যালিপটাস। তেজপাতার ডাঁটো পাতার বৃক্ষরাজি। পাহাড় আর সমতলের আলোছায়ার ভেতর দুলতে দুলতে ট্রেন আমাকে সত্যি সত্যি যদুনাথপুরে পৌঁছে দিল।

নেমে দেখি ফরেস্টের জিপগাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। জিপে ওঠার পর চলন্ত জিপের পেছনের খোলা অংশে তাকিয়ে দেখি কোথায় সেই পাহাড়ের সারি? কোথায়ই-বা রেললাইন? সব হাওয়া হয়ে গেছে। আর বিস্তীর্ণ সবুজ আমাদের ঘিরে রেখেছে। গাছেদের-পাতাদের এতটাই মেশামেশি যে, কোনটা যে কী গাছ তা-ও আলাদা করা দুরূহ। সেই নিবিড় বনরাজি, গাঢ় সবুজ গাছপালা আর পাখিদের বিচিত্র ডাক শুনতে শুনতে দেখি সেগুনের প্রায় গোলাকার ঢাউস পাতারা আকাশচারী হয়ে আছে। ত্রিপল ঢাকা জিপের ভেতর সবুজ গন্ধ ভরে উঠলে আমি মনে মনে উৎফুল্ল হয়ে উঠি — একটা গাছ আমি অন্তত চিনতে পেরেছি — সেগুন!

যখন আমার অপু-দুর্গার মতো গ্রামময় এক ছেলেবেলা ছিল, তখন আমি সেগুনকে বেশ ভালোই দেখভাল করতাম। কেউ তো আর জানে না — বোশেখের ঝড়বৃষ্টির পর সেই গাছের নীচে পড়ে থাকা ছিন্নপত্র ও গোটা গোটা ফল দেখার লোভে কতদিন আমি ছুটে গেছি। সেগুনের পাতা ডলে দুই হাত রাঙিয়ে তুলেছি। ওইসব খবর কেই-বা রাখে? ওই অপু-দুর্গার জীবনে কেই-বা আমার গতিবিধির উপর কড়া নজরদারি করবে?

আমার আতঙ্কবাদী বাবার খপ্পরে পড়ার আগে গ্রামময়, বৃক্ষময়, বৃষ্টিময় — স্বাধীন এক ছোটোকাল আমাকে মারাত্মক সুখী করেছিল!

আমার সেই ছোটোকালেই সেগুন আমার সঙ্গী হয়েছিল। সেগুনের ফুল ছিল হালকা ঘিয়ে রঙের। আকাশের তারকার আকৃতির। সেই ফুল নাকের পাতায় বসালেই পড়ে যেত। আমি ফের বসাতাম। এভাবেই দিনমান ফুলের উত্থান-পতন খেলায় মেতে থাকতাম। সেগুনের অনতিদূরে বাতাবিলেবুর গাছ। তাতে যখন ফুল ঝেঁপে আসত — আহা কী যে তাদের রূপ আর সুগন্ধ! আমাদের ছুটন্ত জিপের কোনো ধারেই বাতাবিলেবুর একটা গাছও নজরে এল না। শুধু গাছের গন্ধভরা, পাতার গন্ধভরা সবুজ হাওয়া কেটে কেটে আমাদের জিপ এগিয়ে চলল।

জিপ থামল বেশ উঁচু একটা টিলার নীচে। নেমে দেখলাম সুদীর্ঘ সিঁড়ি টিলাটাকে দুই হাতে পেঁচিয়ে ম্যালা দূর উঠে গেছে। আমরাও আমাদের তল্পিতল্পাসহ উঠতে লাগলাম। যতই উপরে উঠতে লাগলাম চারপাশে সন্নিবিষ্ট সবুজ পাতা ছাড়া আর কোনো দৃশ্য নাই! ওই প্রত্যন্ত পাহাড়িয়া অঞ্চলে বৃক্ষ আর আকাশ ছাড়া আর যেন কিছুই নেই!

সিঁড়ি আর শেষ হয় না। উঠতে উঠতে হাঁপ ধরে যায়। জলতেষ্টায় কণ্ঠ কাঠ-কাঠ হয়ে উঠলে — রাজাকাক্কার সুবিশাল বাংলো।

টিলার উপরের ওই বাংলো থেকে চারপাশে তাকালে দুই-চারটা ছড়া দেখতে পাওয়া যায়। ওইসব পাহাড়ি ছড়া বা ঝরনার জলে রোদ্দুর পড়ে রুপালি রঙের নহর বইয়ে দিচ্ছে।

এই যে একেবারে ছবির মতো সাজানো পাহাড়ের অপরূপ দৃশ্যাবলি — যা দেখে মনে হয় স্বর্গ কোনোভাবেই এর চেয়ে উত্তম হতে পারে না। তবে সবচাইতে আনন্দের বিষয় এইখানে আমার আতঙ্কবাদী বাবা নাই। তার কড়া শাসন আর প্রচণ্ড মারধরের উপদ্রব নাই।

আহা! স্বাধীনতা! স্বাধীনতা সব সময়ই জীবনকে আনন্দময় করে তোলে। আমাকে যদি আর ফিরতে না হত ওই মারধরের সংসারে! যেখানে এক নিষ্প্রভ বুদ্ধির মা তার তৈজসপত্রের মতো নিজের মেয়েটিকেও এককোণে ফেলে রাখে — অযত্নে-অবহেলায়।

পরদিন ঘুম ভাঙতেই দেখি রোদ্দুর বাংলোটিকে স্পর্শ করে হেসে আছে। যেদিকে তাকাই সবুজের নানা রূপে একেবারে ব্যারাছ্যারা অবস্থায় পৌঁছে যাই। আদতে এসব হল সিদ্ধান্তহীনতার ঘোর। কোন্ সবুজ যে আমার নয়ন জুড়িয়ে দেবে আর আমি সেদিকেই নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকব!

বাংলো থেকে নীচে তাকালে পা শিরশির করে। বিস্তর সবুজের ভেতর আমার ঘূর্ণায়মান আঁখি হঠাৎ করে খুব কাছে এক রুপার নহরের সন্ধান পেয়ে যায়। সবুজ বনানীর মাঝখানটা চিরে যেন গলিত রুপার ধারা বইছে। আর ওই রুপালি স্রোত বহু নিম্নে সমতলভূমির ওপর সর্পিল গতিতে বয়ে চলেছে।

বাংলোতে দাঁড়িয়ে আমি ওই ঝরনার কল্লোল শুনছি। আহা! কে জানে মরণের পর স্বর্গ কেমন? কেউ তো ফিরে এসে বলে নাই স্বর্গের রূপ আসলেই কেমন?

কিন্তু আমি জানি এই বন-বনানীর সবুজ আর নমিত ঝরনাধারার চেয়ে স্বর্গ কিছুতেই উত্তম হতে পারে না।

রক্তবর্ণহিম

লোকালয় পেরিয়ে বহুদূরে বরমচালের রাবারবাগানটিতে যে-সবুজ রাজ্য গড়ে উঠেছে, তাতে হিমও যেন নামে একেবারে আপসহীনভাবে। কারণ সূর্যের আলো ওই অরণ্যে বা বনানীতে ছিটকি পাতার মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে প্রবেশ করে। রাতভর ওঁশ পড়ে পাতার উপর আর ওই ওঁশ বৃষ্টির ফোঁটার মতো টপটপিয়ে ঝরতেই থাকে। ভোরে ঘুম ভাঙলেই দেখি অপরূপ দৃশ্যাবলি। দূর্বাঘাসের ওপর অজস্র ছোটো ছোটো হীরে যেন জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকে।

ঘুম ভাঙার পর ঝরনা থেকে তোলা জলে মুখ-হাত ধুয়ে নাস্তা খেতে হয়। প্রতিদিনের নাস্তার মেনু ঘরে তৈরি কাঁচা ছানা, হাতে বেলা রুটি, ছোলার ডালের হালুয়া। কোনো কোনো দিন গরম ভাত, ভর্তা, বাসি তরকারি। বাংলোতে কোনো পানি সাপ্লাইয়ের বন্দোবস্ত নাই। পানি আনতে হয় অনেক নীচুতে গিয়ে, ঝরনা থেকে। সেই পানি রোদের বুকে ফেলে গরম করা হয় এবং ওতেই চলে স্নান।
প্রায় বিকেলেই আমি আর বিউটি আপা হাঁটতে বেরোই। হাঁটবার জন্য আমাদের সুদীর্ঘ সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামতে হয়। আমরা হাঁটি রাবারবাগানের ডানা ঘেঁষে — কখনো-বা রাবারবাগানের ভেতর। গাছেদের আর পাতাদের ঝাঁঝালো সবুজ গন্ধে আমাদের বুক ভরে ওঠে। তখনও হয়তো সূর্যাস্তের ঢের দেরি। কিন্তু চারপাশে কী রকম সবুজাভ অন্ধকার। বিউটি আপা বেশ ভারী ধরনের কার্ডিগান গায়ে চাপিয়ে হাঁটে। আমার সেরকম উষ্ণ কোনো শীতের কাপড় নাই। আমাকে পরতে হয় আমার আতঙ্কবাদী বাবার খামখেয়ালিতে বানানো কোট স্টাইলের একটা জামা। সামান্য ভারী কাপড়টা — কিন্তু ভেতরে কোনো লাইলিঙের বালাই নাই। ফলে যত শীত সবটাই ওতে হুড়হুড়িয়ে ঢুকে পড়তে পারে এবং ঢুকে পড়েও। আমি শীতের বিষাক্ত কামড়ে মরণাপন্ন হয়ে উঠলেও কাউকে কিছু বলি না। আমার কোনো দীনতাই অন্যকে বলতে লজ্জা লাগে।

হাঁটতে হাঁটতে বিউটি আপা বাঁ-হাতের বুড়া আঙুল মুখে পুরে চুষতে থাকে। এটা তার প্রিয়তর অভ্যাস। যখন আশপাশে কেউ না থাকে বিউটি আপা তার এই অভ্যাস বজায় রাখে।

এদিকে আমি বয়সে ছোটো ও বিউটি আপার প্রিয় বলে এই কাজটি সে আমার সামনে হরহামেশাই করে। ওইরকম সবুজাভ অন্ধকারের ভেতর হাঁটতে হাঁটতে বিউটি আপা একদিন বলে ওঠে — গন্ডারের গন্ধ পাচ্ছি।
— কী! মানে কী?
— গন্ডার নেমেছে পাহাড় থেকে। রয়েছে আমাদের কাছ থেকে সামান্য দূরেই।
— কী?
— হ্যাঁ, আমি গন্ডারের গন্ধ চিনি।
শুনে ভয়ে আমার গায়ের লোম জারিয়ে যায়।

বন্য জীবজন্তুও তাহলে রয়েছে এই অরণ্যে? ঘন জঙ্গল কেটে রাবার চাষ করা হয়েছে — মানুষদের কিছু ঘরবাড়িও রয়েছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। কিন্তু তা প্রায় না-থাকার মতোই। তবুও একেবারে জনমনুষ্যি নাই এমন তো নয়! এর মাঝে গন্ডার কীভাবে আসে?

চিন্তা যত দ্রুতই করি না কেন — ওই সূর্যের আলোহীন সবুজাভ বিকেলে কোনো কিছুকেই প্রতিরোধ হিসেবে দাঁড় করাতে পারি না। হয়তো আমার মতো বিউটি আপাও পারে না। আমরা জানি, জঙ্গলের আড়ালে সূর্য হারিয়ে গেলে চারপাশ কত দ্রুত ঘন অন্ধকারে পূর্ণ হয়ে ওঠে। তখন সিঁড়ি বেয়ে ওঠা কতটাই-না ঝুঁকির। ভাবতে ভাবতেই শীত যেন হঠাৎ আমাদের আরো আচ্ছন্ন করে ফেলে! আমরা জানি না — শীতের তীব্রতায় না গন্ডারের ভয়ে আমাদের দাঁতে দাঁত লেগে ঠকঠক শব্দ তুলতে থাকে। যদিও খুব মৃদু সে-ধ্বনি। কিন্তু বিউটি আপা বা আমি দুজনেই সে-ধ্বনি থামাতে পারি না। প্রায় দৌড়ে বাগান থেকে বেরিয়ে আসি। বিউটি আপা সাধ্যমতো চেষ্টা করে আমার সঙ্গ ধরতে। কিন্তু আমি এত জোরে দৌড়াই যে মুহূর্তে রাবারবাগানের দীর্ঘকায় গাছগুলো দূর ছবির মতো অস্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিউটি আপা হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে দৌড়ের গতি বাড়ায়। আমরা যখন টিলার উপরে উঠি তখন ওই সবুজাভ অন্ধকার ঘন কালোতে রূপ নিয়েছে।

আমাদের ঘেমে নেয়ে ওঠা শরীর গরম কাপড়ের আড়ালেই থাকে। ঝরনার তোলা জলে মুখ-হাত ধুয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে প্রবল কাশির চোটে আমি একেবারে কাস্তের মতো বেঁকেচুরে যাই। আমার মনে হয় প্রচণ্ড এক হিমখণ্ড আমার বুকের ভেতর ঢুকে পড়েছে। ফলে বেদম কাশিতে আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। বিউটি আপার আম্মা রসুন থেঁতো সরষের তেলে গরম করে আমার বুকে-পিঠে জোরে মালিশ করে দেন। কিন্তু আমার কাশির উপশম হয় না।

বিউটি আপা তার ঢাউস টেনজিস্টারের নব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গান বাজায়। একেবারে লো ভল্যুমে। আমি বলি —
আরেকটু জোরে বাজান
— না, না আর জোরে না।
— কেন?
— মানুষ শুনলে মন্দ বলবে।
গান বাজালে মানুষ মন্দ বলবে? আমি এই রহস্যের কোনো কূল-কিনারা পাই না। বিউটি আপাকে দেখি টেনজিস্টারের সাথে কান লাগিয়ে গান শোনে। ফলে আমাকেও কান লাগিয়ে গান শুনতে হয়। আমার কান ব্যথা করতে থাকে আর কাশিও বাড়তে থাকে।
এদিকে চাচিমা আমাকে প্রতিদিনই গোসল করতে বলেন। বলেন,
— গোসল করো, গোসল করো নইলে কফ বুকে শুকাইয়া যাইব।

আমি সূর্যের নীচে ফেলে রাখা কুসুম-গরম পানিতে হররোজ গোসল করি। বিকাল হলেই রাবারবাগানের ধারে বা ভেতরে বা ঘাসময় দীর্ঘ জমির উপর হাঁটতে থাকি। সঙ্গে বিউটি আপা। আমার পরনে আমার আতঙ্কবাদী বাবার খামখেয়ালিতে বানানো সেই কোট। ভেতরে লাইলিঙ ছাড়া। ফলে পাহাড়-টিলা-অরণ্য-ঝরনার যত হিম সব আমার শরীরের ভেতর ঢুকে পড়ে। আমার কাশির বেগ বাড়ে। আর ঘুঁতঘুঁতে জ্বরে আমি অবসন্ন হয়ে পড়তে থাকি।

ওই পাহাড়-অরণ্য-ঝরনা আর বিশুদ্ধ বাতাস, তাজা ছানা — হালুয়া — রুটি কিছুই আমার জ্বর কমাতে পারে না! এমনকি আমার কাশিও না। জ্বর-কাশি নিয়েই আমি রাবার বানানোর প্রক্রিয়া দেখি। কীভাবে রাবারের বৃক্ষ কাটা হয়, কীভাবে তাতে টিনের পাত্র পেতে দেওয়া হয়, কীভাবে আগুন জ্বালিয়ে ধোঁয়া দিয়ে সেই রাবারের মণ্ড তৈরি করা হয়।

এদিকে চাচিমার গরম সরষের তেল আর রসুনের মালিশে আমি বিব্রত হতে থাকি। কারণ আমি দেখি আমার সমতল বুকে পক্ষীশাবকের নরম রোঁয়া উঠেছে। ডিমের কুসুমের মতো কুঁড়িস্তন আমাকে সংকুচিত করে তুলছে।

ধুর! চাচিমা খামোখাই এত কষ্ট করছে। আমার কাশি তো কিছুতেই কমছে না!

এদিকে অরণ্য বা পাহাড়ের কোনো পরিবর্তন নাই। এমনকি ঝরনাধারাও। বাংলোর উপর থেকে জলপতনের শব্দ আমি শুনতে পাই। চাচিমার আরদালি-বেয়ারারা ওই জল টিনের পাত্রে ভরে উপরে উঠিয়ে নিয়ে আসে।

আহ! একেবারে বিশুদ্ধ জল!

এই পাহাড়ের হাওয়া বিশুদ্ধ। গাছতলা-বৃক্ষরাজি, তাদেরও উদ্ভাসিত তারুণ্য। আর আছে বান্দরের মেলা। প্রায়ই গাছ থেকে নেমে এসে ওরা চাচিমার নানান কিছু নিয়ে পালিয়ে যায়! ওদের ধরার সাধ্য কারও নাই। আর আছে পাখিদের বিচরণ। কত বর্ণ-গোত্রের পাখি! কত বিচিত্র তাদের কথাবার্তা! বিশাল বিশাল রক্তচোষা! ভয়ে আমি একা কোথাও যাই না।

রক্তচোষা যদি আমার সব রক্ত চুষে নেয় এই ভয়েই কিনা কে জানে আমার শরীরের রক্ত জোট বাঁধে। অবশ্য আমি তা আদৌ বুঝতে পারি না।

আমি পুনরায় ত্রিপল ঢাকা জিপগাড়িতে চেপে বসি। বিউটি আপা সজল চোখে তাকিয়ে থাকে। চাচিমা বলেন — ‘ফের আইসো বাপ। ইশকুল ছুটি হইলেই আইসো।’

আমার আতঙ্কবাদী বাবা আমাকে নিতে এসেছেন। ফের সেই ভয়াবহ কারাগার। ফের বন্দীজীবন। ফের বৃক্ষহীন নগর। বিষাক্ত হাওয়া। ট্রেন আমাকে হাওয়ার টানে উড়িয়ে নিতে থাকে। বরমচালের অরণ্যে আমি কত যে কাঠবিড়ালি দেখেছি! কত পাখি আর তাদের গান!
কেন যে আমি মানুষ!

কাঠবেড়াল হলেও তো লুকিয়ে থাকতে পারতাম গাছের কোটরে।

দুই পাশের লালমাটির পাহাড় ফেলে ট্রেন কী ভীষণ জোরে ছুটে চলেছে! পাতাদের সবুজ ঘ্রাণ হাওয়া থেকে ক্রমে হারিয়ে যেতে থাকে। আমি কি তাকালেই দেখতে পাব ওই নিবিড় স্নেহছায়াময় সবুজ বনভূমি?
জানি — পাব না।
ফেলে আসা কোনোকিছুই মানুষ কোনোদিন অক্ষত ফেরত পায় না!

উষ্ণ বয়সি ব্ল্যাকবোর্ড

আমাদের বাগানের ঘাসগুলা কি অতটাই সবুজ?

বিউটি আপার সাথে যে-ঘাসে আমি হেঁটেছিলাম তাদের মতো?

আমি তাকিয়ে তাকিয়ে ঘাসেদের সবুজ হওয়া দেখি, কিন্তু কিছুতেই ওই সবুজের সাথে মেলাতে পারি না। আমাদের বাসার ভেতরে অরণ্যের ঘ্রাণ নেই — কেরোসিন তেলের ঘ্রাণ থইথই করে। মা ওই তেলে স্টোভ জ্বালিয়ে রান্নাবান্না করে। এদিকে তরল কাশির দমকে আমার শরীর আরও অনেক বেশি বেঁকেকুকে যায় — আমি কাশতে কাশতে দম নিতে পারি না।

আমাদের সাদা গোলাপ গাছে বিস্তর কুঁড়ি এসেছে। কয়দিন পরই ফুল ফুটিয়ে গাছটিকে এরা ঢেকে দেবে। নানা রঙের জিনিয়া আর গোলাপি সাদা দোপাটি ফুলের সারি দেখতে দেখতে আমার পাহাড়ের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। গন্ডারের গন্ধভরা বিকেল। আমাদের ত্রাস আর দৌড়ানো শুরু করা। ওই গভীর নির্জন অরণ্যে — ওই সবুজাভ সন্ধ্যাবেলায় আমাদের ত্রাণকর্তারূপী কেউ ছিল না। ফলে আমাদের দৌড়াতে হয়েছে। বেদম দৌড় যাকে বলে।

আমি আমাদের বাগানের ঘাসেদের রকম-সকম দেখতে দেখতে প্রচণ্ড কাশিতে ফের বাঁকাকুকা হয়ে যাই। তরল লবণাক্ত কফ ফেলতে ফেলতে হঠাৎ চমকে উঠি। দেখি রক্তের মতো কী যেন ঘাসের ভেতর গড়িয়ে যাচ্ছে।
রক্ত!
সত্যিই রক্ত নাকি?
ফের কাশি ওঠে। ফেলতে ফেলতে ফের চমকাই।
রক্ত!

আহা! সেই যে হিমের বিকেল — পাহাড়ের সেই প্রচণ্ড হিম কি রক্তবর্ণ ধারণ করে আমার ফুসফুসের ভেতর বাসা বেঁধেছে!

তৃতীয়বারের কাশিতে ঘন রক্ত উঠে আসে।
আর বাগানের ঘাসে সেই রক্ত লাল ফড়িঙের মতো ঝুলে থাকে। আমি আমার আতঙ্কবাদী বাবাকে ডাকি।
— বাবা কাশির সাথে রক্ত যাচ্ছে!
— কী বলো? কই দেখি?
— বাগানের ঘাসে।

বাবাকে বলা হয় না ঘাসের ওপর বসে থাকা লাল ফড়িংদের পিছু পিছু আমি কত সাবধানে পা ফেলেছি। দুই হাতে ডানা দুটো যে-ই ধরতে যাব — হঠাৎ সে উড়ে গেছে! আর আমি সে-দুঃখে প্রায়ই কেঁদে ফেলেছি। আজ সেই লাল ফড়িঙের দল আমাদের বাগানের ঘাসের ওপর স্থির বসে আছে। ভারি অদ্ভুত কাণ্ড তো!

বাগানের ঘাসে রক্তচিহ্ন দেখে বাবা ভয়ানক গম্ভীর হয়ে যান। আমাকে আর কিছুই বলে না।
এরপর থেকে আমার ইশকুল কামাই হতে লাগল। বিকেলবেলার সাথীরা আমাদের বাসায় আসা ছেড়ে দিল। আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে ক্রমাগত কাশতে লাগলাম। রক্ত ঝরে ঝরে আমার ফুসফুস প্রায় শূন্য হয়ে গেল। অবস্থা দেখে বাবা প্রায় উন্মাদগ্রস্ত হয়ে উঠলেন। এ-ডাক্তার, সে-ডাক্তার — ছোটো-বড়ো সব ডাক্তার জড়ো করে ফেললেন। ওষুধ-পথ্য-এক্সরে-জ্বর-চাদর এইসবের মাঝে আমার জীবন কী অদ্ভুতভাবে জড়িয়ে গেল!

আমি রাতভর কাশতাম। আমার বিছানার পাশে ছাইভর্তি বাসন দিয়েছে মা। যাতে বাতাসে জীবাণু না ছড়ায়। ভোর হতে হতে রক্তে ভিজে সব ছাই দলা পাকিয়ে যেত। আমিও অবাক হতাম — আমার এতটুকুন শরীরে কী করে এত রক্ত এল?

এই যে অবিশ্রাম কাশছি — কাশির সাথে টকটকে তাজা রক্ত উঠে আসছে, তবুও কেন রক্ত নিঃশেষিত হয়ে যাচ্ছে না আমার শরীর থেকে?

সকালে ঘুম ভাঙতেই আমার মনে পড়ে যেত ইশকুলের কথা। ক্লাস টিচার রাবেয়া খাতুন ব্ল্যাকবোর্ডে চকখড়ি দিয়ে তারিখ লিখছেন। তার দুধসাদা আঙুলে চকখড়ি ধরে রাখা। সরু সরু চমৎকার আঙুলগুলো চকের গুঁড়োতে মাখামাখি! রাবেয়া খাতুন, আমার খাতায় প্রায়ই লিখে দেন ‘ভালো রাখা’।
‘ভালো রাখা’ মানে কী?
একদিন লিখলেন ‘রাখা’।

আমি বুঝলাম ‘ভালো রাখা’ মানে গুড ধরনের কিছু হবে। আপার নাম আসলে রাখা — রাবেয়া খাতুন। রক্তের সমুদ্দুরে ভাসতে ভাসতে আমার শুধু ইশকুলের কথাই মনে পড়ে। খরস্রোতা নদী পেরিয়ে আমার ইশকুল — আমার ক্লাসরুম আর সহপাঠীরা। এদিকে মাকে দেখি আমার খাবারের গ্লাস-প্লেট সব আলাদা করে দিয়েছে। আমার প্লেটে সে কাউকে খেতে দেয় না। অন্যদের প্লেট-গ্লাসে খেতে দেয় না আমাকেও। এটা সে এতটাই চাতুরীর সাথে করছে যে আমার আতঙ্কবাদী বাবা টেরও পান না।

আমার কি ভয়ংকর কোনো অসুখ করেছে?
নইলে মায়ের এত সাবধানতা কেন?
আমি একদিন খেতে বসে কেঁদে ফেলি!
বাবা চোখ লাল করে জানতে চান,
— কী হইছে? কান্দস কেন?
আমি বলি,
— আমার খাওয়ার প্লেট-গ্লাস মা আলাদা করে দিয়েছে।
— কোনটা তোর?

আমি আঙুল তুলে একটা লাল বর্ডারের প্লেট দেখিয়ে দিলে বাবা ওতে খেতে বসে যান।
বাবার মুখ দেখি থমথম করে। দেখি বাবাও কাঁদছে।

আমার উপলব্ধি হয় — আমার শরীরটা পাখির মতো হালকা হয়ে গেছে। এখন আমি যেন ইচ্ছে করলেই উড়ে যেতে পারি। উড়ে উড়ে বরমচালের রাবারবাগানে পৌঁছে যেতে পারি। ওইখানে যে-ঝরনা বইছে, সে জলপান করে ফিরে আসতে পারি; অথবা ওই সবুজ বনভূমির প্রতিটি বৃক্ষের পাতায় পাতায় দোল খেতে পারি। ঠোঁট দিয়ে খুঁটে দিতে পারি পাতাদের শিরা-উপশিরা। অথবা উড়তে উড়তে ওই অরণ্যে পথ হারিয়ে ফেলতে পারি। হয়তো তখন অন্ধকার ঘনায়মান। বানরের দল গাছের ডালে চুপটি করে বসে বসে অপেক্ষা করছে রাত্তিরের। অন্ধকারের ভয়ে আমার পাখি-শরীরটা নিমেষে লুকিয়ে ফেলতে পারি পাতাদের আড়ালে, যাতে কেউ আমাকে আর খুঁজে না পায়। আমি অরণ্যের গন্ধের ভেতর, বিশুদ্ধ হাওয়ার ভেতর, ঝরনার জলের ভেতর একাকার হতে হতে ভুলে যেতে পারি সংসার-কারাগার। যেখানে বাড়াবাড়ি শাসন, কড়া পড়ার চাপ, প্রচণ্ড মারধরে আমার ছোট্ট শরীরটা প্রায়ই নীলাভ হয়ে থাকে। সেই জখমচিহ্নের দিকে তাকিয়ে আমি সারারাত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদি। একটা জখম না-সারতেই আরেকটা জখমের চিহ্ন তীব্রভাবে শরীরে বসে যায়।
অবিরাম কাশি, রক্তপাত, ওষুধ, পথ্য, চাদর, বালিশ, বিছানার সঙ্গে আমার আতঙ্কবাদী বাবা সেঁটে থাকেন। আমার ভয়ানক অসুস্থ শরীরটাকে সারিয়ে তোলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে থাকেন। কিন্তু আমি তো সেরে উঠতে চাই না। সেরে উঠলেই আমার শরীরটা আর পাখি থাকবে না। ভারী শরীর নিয়ে আমি কি আর উড়তে পারব? কিন্তু আমাকে যে উড়তেই হবে।

উড়ে উড়ে যেতে হবে ওই পাহাড়ে, ওই অরণ্যে। ওই অরণ্যে আমি ফের যেতে চাই — যে-অরণ্যের হিম আমার ফুসফুস ঝাঁঝরা করে দিয়েছে। আমার এই অসুস্থতা, প্রবল রক্তপাতময় শরীরটাকে আমি ওই অরণ্য ছাড়া আর কোথায়ই-বা রাখতে পারব?

ওই অরণ্যের দিনগুলোতেই তো আমার সমতল বুকে ডিমের কুসুমের মতো কুঁড়িস্তন জেগে উঠেছে। ওই অরণ্যই আমাকে প্রথম স্বাধীনতার স্বাদ দিয়েছে।

এখন এই ভাঙাচোরা, মৃতবৎ, ক্ষয়িষ্ণু শরীরটাকে নিয়ে আমি আর কোথায় আশ্রয় পাব?
আমি জানি মানুষ ফিরিয়ে দিলেও অরণ্য কিছুতেই ফেরাবে না। ফেরাতে পারবে না। অরণ্যের ঠাঁই মানুষের জন্য চিরকালের।