Categories
2023-Sharodiyo-Kobita

উমা মণ্ডল

পরশুরামের কুঠার


একটানা ডেকে যাওয়া একটা প্রবণতা। দুঃখ হয় এইসব ডাক শুনে। ইঁট খসে পড়ে বাড়িটার; ডাক তবু এক গাছ থেকে অন্য গাছে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে। বাড়তে থাকে তীব্রতা। ওদিকে ইঁটের পরে ইঁট… ধুলো ধুলো কবিতারা সব চোখ মেলে দেখে, অর্বাচীন …

অথচ কোকিল ডাকবেই। বসন্তের পাখি ভুলে গেছে আদ্যাস্তোত্র। যখন তখন কুহুতান, ভীষণ অসুখ যেমন। আর অশ্বত্থের তীব্র মায়া; তবু থাকেনা অতীত, নিবিড় ছায়ার সন্ধিক্ষণ। এই পাখি, গাছ বিষয়ের পার্শ্বচর। চরাচর। মিলেমিশে গেছে ব্যাকুল, ব্যাকুল…


মাতৃগর্ভ ঈশ্বরের গৃহ অন্ধকার, শ্যামা তপ্ত কাঞ্চনবর্ণের ঊষাকাল বেশ তীব্র রক্তরসে রাগালাপ দড়ি বাঁধে আগামীর সে বৃক্ষ হবে, সে মস্ত হবে

তবে সময়ের ছক বড়ো কুকথা বলে ঐহিক তাকে শুনতে চেওনা তাকে বুঝতে চেওনা নীরব নীরব থাক পক্ষকাল থেকে- অন্য পক্ষকাল
এই বেশ ভালো আছি, এই বেশ সুখে আছি ওদিকে শকুন হাসে


কাহিনি বলেছে হাতে লেগে থাকা রক্ত- তাঁর কিন্তু নাম আছে ডেকে দেখো সাড়া দেবে চামড়ার তলদেশে যে জীবন বয় অন্তঃসলীলার ব্যথা; ও অভিশাপ পেয়েছে

জিনগত ব্যাখা কিন্তু অঙ্ক কষে দেবে ক্ষেত্রফল মধ্যে তুমি একা উচ্চারণ করে পঞ্চভূত, স্তোত্র; হু হু হাওয়া অহম, অহম
মুছে যায় বলাকার স্রোতে………

তারপর তীব্র ঘৃণা থেকে রক্ত ঘেঁটেঘেঁটে এক মালা ছিল- বংশধর বিশেষ


ঘর থেকে যতটা দুরের পথ মায়াময় ততটা দুরেই সাতজন্ম এক ঝটকায় ধুলো, এক ঝটকায় মৃত্যু ইঁট খসে পড়ে বাড়িটার; ঘুমে জেগে হাত তুলে ডাকে কোকিলের গুণগুণ খোকা ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো………

শৈশবের ছোট চারাগাছ মুখে দেয় ডালভাত- ‘মা’…… বিশ্বাস হয়না জটার অগ্রিমে কান পেতে দেখো অশ্বত্থের ভাঙা ডাল থেকে উঠে বসা কুঠারের শব্দকোষ বলে হ্যাঁ ‘মা’……. ছিল


কবিতার ভাষা আজ ঠাণ্ডায় কাতর করোনার তীব্র মহামারী কপালের জ্বরে তেতো তেতো ভাব বিস্বাদের অমরাবতীতে হাহাকার দুধ সাবু মুখে ওঠেনা, ঠোঁটের ধারে বসে থাকে হাত ধরে পার করে দেয় লাল টিপ আগুন আগুন সন্ধিক্ষণে যে পদ্মের চোখ জাগে লহমায় সেই লাল টিপ থেকে রক্তনদী, দেবী ও মানবী হ্যাঁ ‘মা’…………ছিলো

ধুলো ধুলো কবিতারা সব চোখ বুজে থাকে


এক পরশুরামের হাত কুঠারের বেগ এনেছিলো পৃথিবীতে। সেই স্রোতে ভেসে গেছে ইহকাল, পরকাল। নদী নদী ব্যাথা, ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী; জাতক জাতক গন্ধ। কুঠারের হাতে থাকে লাল জবা। চোখ ছিলো। থেকে জল ঝরে ঝিরিঝিরি।

পদ্ম থেকে সাপ, ছকে গ্রহদোষ। এইসব বিশেষ্যের কথা থাক। আসলে পরশুরাম কোন এককালে কুঠারের বলে নাড়ি কেটেছিলো নিজের, লোকে বলে মায়ের

এই বাড়িও শাপিত। মাতৃহত্যা দোষে কাঁপে। আবার ইঁট খসে পড়েছে ……ভীষণ রকম এক ডাক, কোকিলের আলজিভ থেকে ভেসে আসে। কুঠার, কুঠার।

কুঠারের যন্ত্রণা কেউ বোঝেনা। শুধুই ঘাতক কিনা

Categories
2023-Sharodiyo-Kobita

ঋতুপর্ণা খাটুয়া

চা বাগানের কথা


সবুজ ধানক্ষেত, তারপরের বাঁশ জঙ্গল পেরোলেই সরুগাঁও টি এস্টেট।
একটি মজদুর ক্ষেত দিয়ে হেঁটে চা বাগানের দিকে যাচ্ছে, ভাবছি বন্ধু,
তোমায়ও আমি চা বাগানের মাঝে এভাবে হাঁটিয়ে নিয়ে যাব। চা ফুল
হয়, তা দেখোনি বোধহয়, দেখাব তোমায়। পৃথিবীর যা যা আশ্চর্যজনক
বলে আমার মনে হয়, সবই তোমায় দেখাব। একপ্রকার কুহক লুকিয়ে
আছে ওইখানে, দিনের বেলায়ও স্থির গাছগুলি। ওদের দাঁড়িয়ে থাকার
দৃঢ় সিদ্ধান্তের মাঝ বরাবর হেঁটে যাব। হাত তো ধরাই আছে, একটা চুমু
খেতে পারি না কি আমরা! আহ্ কী নির্লজ্জ সুন্দর আমার মন। ছাড়ো।
বাদ দাও। ওই হাঁকুপাঁকু করে উড়ে যাওয়া বকটিকে দেখো তো, কীসের
এত তাড়া কে জানে! কত কথাই বলছি, তুমি আমার দিকে এই থম
মেরে দাঁড়িয়ে থাকা ঠান্ডার মতো তাকিয়ে আছ! যা খুশি করো না কেন,
আমার ভেতরে থাকা ভয়কে আমি হাটের মুরগি করে সবার সামনে
আনব না। আহা চারিদিকে সবুজ মদিরার মতো ঘুম ছড়িয়ে আছে। তুমি
এভাবেই কি গিলিগিলি ছুমন্তর কিছু করো নাকি! হালকা সবুজ আর
গাঢ় সবুজ পাতা একটি গাছেই! উফফ জাদুর পর জাদু! একটু বাড়তি
জাদু এনে আমাকে এগিয়ে রাখো আলোর দিকে, আরেকটু ভাসিয়ে
রাখো, অযথাই বাবার চোখের আড়ালে,
আমার এটুকু মদ্যপ উৎপাত কি তুমি মেনে নেবে না!


মাগুরমারি পৌঁছে গেছে নিজস্ব সৌন্দর্যের চূড়ান্ত সীমায়।
মাঝে কাজল টানা রাস্তা আর দুপাশে ঘন চা বাগান—
টোটো এখনই ঢুকে গেল নিভৃতে, তিনযাত্রী নিয়ে,
টিংটিঙে সবুজ পাখিটি উড়ে গেলে বনের ভেতরে
এইবার হয়েছে একটি কেলো। চা বাগানের গোপন মাদকতায়
রাস্তা শুয়ে আছে দু-পা ফাঁকা করে। ঠিক যোনিতে দাঁড়িয়ে
টোটো চালক বলল, আমি তো চিনি না মাগুরমারি স্কুল!
ঠিক যোনিতে এসেই এমন হতভম্ব হয়ে যায় অনেকেই
যোনির ভেতরে ঢুকে যাওয়ার রাস্তা নেই, নইলে
ঘুরে আসতাম টোটো নিয়ে বিশ্বের আদিস্থলে
এমতাবস্থায় আহ্বায়ককে ফোন করা হলে সে
ফোন ধরে বললে, টাওয়ার যেদিকে, ওদিকে যেতে—
আমরা এগিয়ে গেলাম রাস্তার বাঁ পা ধরে
চা বাগানের উঁচু স্তন দেখতে দেখতে—


আজ এসেছি কৈলাশপুর চা বাগানে, তোমার চেয়ে একটু দূরে
সবুজের গা ঘেঁষা জঙ্গলের মধ্যস্থলে। কী লিখি আর! যা দেখেছি,
কী করে বলি! ওই শিশুরা কটেজের মেঝেতে বসে আছে, দূরে
ফুটছে মাংস, তার আগে চলছে সংস্থার অনুষ্ঠান, সবশেষে খাবে
শিশুরা। ভাতের জন্য ছুটে আসা শিশু কখনও রাগ করে অনুষ্ঠানের
মাঝে ছুটে চলে যাবে না বাড়ি। এসব এড়িয়ে তাও এলাম লুকোতে
সরকারি গেস্ট হাউসের দিকে, কিন্তু ওদের ক্ষিদে এড়ানোর ক্ষমতা
আমার নেই, এসবই লিখছি তোমায়। তুমি কি প্রতিটি অক্ষরে ওদের
দেখলে! দ্যাখো, ওই যে মেয়েটি ছেঁড়া জামা পরে ঢুলছে ঘুমে! ওই
ঘুম একটি সজোরে লাথি হয়ে অনুষ্ঠানের ক্যাঁতায় পড়েছে। কিন্তু
আমরা সকলে দিব্য ঘুমিয়ে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সমাজসেবার অনুষ্ঠানটি মারকাটারি হলো,
ক্ষুধার অনুষ্ঠানে এবারে বক্তব্য রাখবেন মাননীয়…


একটু এপাশে শাল সেগুনবাড়ি। কিছুদূর গেলে শাপলাপুকুর।
এড়িয়ে এদিকে এসেও শান্তি নেই,
তোমায় নিয়ে লেখার ফুরসৎ পাচ্ছি না, এই
চা শ্রমিকদের শিশুরা আমায় দিয়ে লিখিয়ে নিচ্ছে কী একটি লেখা।
ওই লেখা আমায় মাঝ জঙ্গলে ফেলে চাবকাচ্ছে, চরকির মতো ঘোরাচ্ছে
নাকে দড়ি দিয়ে। আমার চারপাশে যে হলুদ পোকাটি বারংবার ঘুরছিল,
অস্থির করছিল, সে আর কেউ নয়, জঙ্গলের ক্ষিদে। ভুখা শিশুর ক্ষুধা।
ওদের মুখ, আর বাকি সবকিছুই সব অস্পষ্ট হয়ে আসছে আমার
কনজাঙ্কটিভাইটিসে লাল হয়ে যাওয়া তীব্র লাল চোখে


মা শেতলার দিব্যি, ওদের কথা আর একটি বারও লিখব না, শুধু
এইবারটি লিখে রাখতে দাও, গোপন বিষাদ। এ আঁচড় রয়ে যাবে।
প্রজন্মের পর প্রজন্ম চলে যাবে, চা বাগানের উঠতি কিশোরী কোমর
দুলাবে ছম্মোকছল্লো নেপালী গানে। ওই কোমরের খাঁজে লুকিয়ে
থাকবে তামাম দুনিয়াদারী। তুমিও জানো না, আমিও জানি না,
কীভাবে এ ভঙ্গিতে পরপর ওরা খুঁজে নেবে গোপন যৌনসঙ্গী এবং
ক’টা টাকা। ক’টা টাকা! কতটাকায় ক’টা টাকা হয়, কীভাবে জানা
যায় বলো! অমিমাংসিত এই বর্তুলে ঢুকে ঘুরে যাচ্ছে রাতের কালো
গাঢ় চা বাগান। আমি তার কতটুকুই বা জানি! চোখে ধুলো পড়লে
কাঁচ উঠিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি। চা বাগান ঘুমায়নি। ঘুমায় না। ওরা
ঘুমাতে পারে না! রাস্তায় নেমে চা খেয়ে ঘুম কাটিয়েছি, চা ওদেরও
ঘুম কেড়ে নিয়ে কোথাও যেন ছুমন্তর …

Categories
2023-Sharodiyo-Kobita

মহিউদ্দিন সাইফ

রিমিল-পিয়ং কথা


পিয়ং-এর মতো অস্ট্রিক কন্যা রিমিল কখনো দেখেনি।
ওড্রো দেবীর সাথে সুমার সে রূপ প্রাঞ্চ অভিঘাতে। খেরোয়াল ভাষার সিঁড়ি দিয়ে উঠতে নামতে মুখোমুখি, মুলাকাত হল
আর সেই খ্যান নিরুপাখ্য মধুর ধারা
করমডাল থেকে টিপিটিপি ঝরে পড়ছে ফুল…
সেই দৃশ্য, পাগল জারহি, ছুটে বেরোচ্ছে
জলের ছাওয়াল খুশবু-হরিণ…

এসব মর্ম একা যখন একলা রিমিল,
ডাগর দুটি চোখ দিয়ে নির্মলা জল, দরিয়া নাজুক,
দেশ পেরিয়ে খজকামান আর হারাতা পাহাড়,
আরও দূরে জারপি-চায়চাম্পা ফেলে বয়ে যাচ্ছে
নদী, আরও দূর কোনো দেশে…


চিলেছাদে ভাতঘুমের অবসর,
আর দিদিবুড়ি গেছে বেনাকুচির বনে
ঘরপিছে আড়বাঁশি, রোদেভরা দিন
বাজিয়ে বাজিয়ে একঠার, দুলছে রিমিল
দেখে লেবাস শুকানোর ছলে পিয়ং এসেছে,
আর ‘সুই উড়… সুই উড়…’ বলে খিলে উঠল
বিমুগ্ধা রাধিকা…

আমের বোলের রীত মগ্না আকাশ হতে
দিব্য সাদম মস্ত এক, নেমে এল
প্রাচীন হৃদয়বারি পান করতে
আর যাবার খ্যানে ফেলে গেল মুখের ফেনাটি

সরিয়ে নাকাব, মধুর হাওয়ার স্রোত
নিরাময় স্রোত আর হাওয়ায়
ভেসে বেড়াচ্ছে রিমিল-পিয়ং, ফেনাটি মান্দাস
দুটি আদিঅন্তহীন পাখি
তেলেশমাতি ভেসে যাও পাখি, লিটার উঠান থেকে
ওই দূরে
মানুষ জন্মেছিল জেনে যেদিকে উদয় হচ্ছে
নরম সঘন দাড়ি মিহির দেবতা…


সারা রাতের নাচের ক্লান্তি পুষিয়ে নিচ্ছে ঘুম। আলগা জুড়াটি থেকে ফিরাক নিয়ে পড়ে আছে
বিছানায় গুলাব, চাম্পা আর সাদা তোয়া-বাহা।
পুন্নিমার রাতটুকু ওরা হাত ছুঁয়ে বসেছিল,
তারপর বিরহী জীবন এল, রেখে গেল দুইফোঁটা
সিপির উপরে অশ্রুজল…
মনে হল এই সেই জল যা কেবল ছিল সর্বপ্রথমে,
আপন হৃদয় চিরে বের করে এনেছিল
জনক-জননী, সেই হাঁস ও হাঁসিল…

পাশের মোড়াটিতে বসে রিমিল
না-বোঝা চোখ দেখছে গয়েবী, ঘুমন্ত পিয়ং
কেমন ধীরে ধীরে হয়ে উঠছে শিরম-গাছের দিব্য শিকড়,
তার মোড়াটি এক বিশাল শিরমপাতা
নীচে অপরূপ অগাধ অথৈ জলরাশি…


বাস থেকে নামতেই টেনে ধরল হাত
অপেক্ষায় চুর দুই চোখ দেখল মর্ম
আর মর্মের ভেতরে মায়াবী পিয়ং

শ্বেতপদ্দের পারা দুবরাজি বাজু
কাঁকালের ঝালর চটুলা মদির,
গায়… হাসে…
কানের লতির খানে করঞ্জার ফুল
ষোড়শী বাতাসে বাসে বিস্ময় সুবাস

এই অপলক দেখাটুকু দেখতে দেখতে
আসমানে আবের চাকা মেঘ নিচে জানুমধুন
ছেয়ে গেল আদিগন্ত মাঠ-ঘাট-পথ
পাশে ঘোঙার মতন টাঁড়, লসুৎ বুরুই
ওরা চেপে দেখল –
কে একজন মাথায় গামছা বেঁধে, প্রত্যুষ বদনে
বুনে চলেছে সাগাঘাস, সার্জম, মহুল, পিয়াল, বান্দলতা, কাশি আর আবহমান সময়ের বীজ
বুনে চলেছে আশ্চর্য জাহানে…


ভোরবেলা ঘুম ভাঙার আগেই এল সাবিলা পিয়ং

ঘরের মাঝারে সেই আদিম লোবানের  ঘ্রাণ
সেই শিল্পীত উন্মাদ সুবাস, প্রথম আশনাই
আর আলমের আনাচেকানাচে জাগা সুষমা আলপনা
যেন পায়ের নেউর হতে ছড়িয়ে পড়া মোতি
সামের শোলোক

এই স্বপনটুকুন দেখে
চোখ খুলতেই দেখল রিমিল ঝুঁকে আসা মুখ,
সটান গেল সরে—
এতদূরে, যে আর ছোঁয়া গেল না এ জনমে
এ জাহানে একবারও

তিরিল ডালের থেকে ঝরে গেল চাঁদ
নিচে আতশগুঁড়োর পারা ছড়ানো লিয়র
যতনে বেছে রাখা হলুদ
অমলতাস, হরিদ্রা, চাম্পার থেকে,
সব কালো হয়ে মিশে গেল রাতে—
যে রাত প্রথম জাগা আম পাতার পারা
যে রাত শুকিয়ে যাওয়া আম পাতার পারা…

Categories
2023-Sharodiyo-Kobita

বর্ণালী কোলে

কাব্য বিবর্জিত কবিতা


কবিতা যে কোথায় আরম্ভ হয় আমরা কেউ কী জানি। গল্প কোথায় শুরু। একঘেঁয়ে
‘ভালো’ ও ‘খুব ভালো’ কমেন্ট লেখার থেকে মুক্তি পাওয়ার মুক্তাঞ্চল কোথায়। যেখানে
অন্তত বৃষ্টির মতো অনায়াস নিজেকে বলা যায়। আঘাত করতে ভয় পাও? সত্য
জানালে তোমার পায়ের নীচের ভূমি চোরাবালুকায় পরিণত হবে ও তার মধ্যে ক্রমশ
নিজে কবরস্থ হয়ে যাবে তার ভয় পাও? তোমার সেই দাপট কোথায়। তোমার সেই
শক্তি কোথায়, যেখানে এক হাতে, নিজস্ব হৃদয়ে ইমারত বানিয়ে অনায়াসে অট্টহাস্য
করা যায়!
তুমি মিথ্যাচারী, এটা মেনে নাও। তোমার বাঁচাও কোথাও অভিনয়, মেনে নাও।


এইটুকু স্বীকারোক্তির পর কবিতার দ্বিতীয়াংশ শুরু। সেদিন দুপুরে তোমার
ঘরে তুমি একা। আকাশ ঘিরে মেঘ। ঠিক যেন রবীন্দ্র-কবিতা, তরুছায়ামসীমাখা,
গ্রামখানি মেঘে ঢাকা। জানালার বাইরে সবুজ প্রান্তর। দূর-দিগন্তরেখায় বৃষ্টি। ঘন কুয়াশায়
নিবিড়তা। ধানক্ষেতে ঢেউ। ঢেউ বেয়ে বেয়ে সে আসছে। তোমার মৃত বন্ধু। ঠিক জানালার
কাছে এসে দাঁড়াল। তুমি জাল দেওয়া জানালার এপারে বসা নন্দিনী। উলটো রক্তকরবী।
জালের বাইরে রাজা। বহুদিন পর। বৃষ্টি এনেছে। হাওয়া।বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে তোমাকে
নিয়ে যাচ্ছে কোথায়। এত জল, এত জল। বাপ্তাইজ সম্পূর্ণ তোমার।
এরপর, এরপর থেকে প্রিয় হল ক্রুশ!


যখন জ্বর আসছিল, কেঁপে কেঁপে, বাইরে চল্লিশ ডিগ্রি তাপমাত্রা, আর তুমি তোমার
সর্বাঙ্গ চাদরে মুড়ে নিচ্ছিলে, তখন তুমি পুলকিত কোথাও, তুমি হেমন্তের
জাতক। বাড়িতে তুমি সম্পূর্ণ একা। মাথার পাশে, জল, থার্মোমিটার আর পাইরেজেসিক।
বেহুঁশ তুমি, অথচ রোমাঞ্চিত। কার্তিকের শেষে এনই হিমেল হাওয়া, এমনই শীত
শীত। দ্রুত সন্ধ্যা নামে। প্রদীপের আলোয় মায়াজন্ম, জাতিস্মর ও আলাদিন। কাঁপতে
কাঁপতে আরও চাদর টেনে নিচ্ছে তুমি। আরও গুটিয়ে যাচ্ছ তুমি। অথচ বুঝতে পারছ
কোজাগরী পার হয়ে নক্ষত্ররা স্থির হচ্ছে… জন্মমাস আসন্ন তোমার।


দামী প্রিন্টেড কটন। মাচিং ব্লাউজ।
তার সাজানো গোছানো বাড়ি, সাজানো অশ্বের মুখ সর্বদা পূর্ব দিকে ধাবমান।
কর্তা অফিসে। মেয়ে কলেজ। প্রতিবেশীরা কেউ পাহারায় নেই। দোকানের
খরিদ্দার চলে যেতেই মুষলধারে বৃষ্টি। দোকানের ঝাঁপ নামিয়ে তড়িৎ, তার
পূর্বতন, বলা যায় তার চিরন্তন প্রেমিক, ওপরে।
তারপর..
খোলা আাঁচল গড়িয়ে লাবণ্য নামে। ঘোড়ার ঈষৎ দিক পরিবর্তন।

আলনায় ভাঁজ করা মেয়ের টি-শার্টের ওপরে লেখা বাণীরা মৃদুমন্দ হাসে… লেস স্লিপ, মোর
ড্রিম।


আপনি বোধহয় নিজেকে ছাড়া অন্য কাউকে কখনও ভালোবাসেননি। অন্যকে ভালোবাসাটাও
তাই একপ্রকার নিজের মধ্যেই ঘোরাফেরা করা। নিজেকে নিয়ে এত থাকলে সুতোর মতো
নিজের মধ্যে জড়িয়ে যেতে হয়। অজস্র গিঁট। খুলতে গিয়ে নিজেকেই কেটে কেটে বাদ।

দেখি আপনাকে। সঙ্গে সঙ্গে দেখি দূরত্বটাও। দুটো আলাদা নদী। দুটো আলাদা নৌকো। পৃথক
গতিপথ। কখনো কখনো প্রতিবেশীর মতো পাশাপাশি, কয়েক মুহূর্ত। কুশল বিনিময়।
ক্ষণিকের। এইটুকু। দুই নদীর মাঝে পথ। রোদ্দুর ও ছায়া। ওইটুকুই মায়া।

দেখছেন তো, শাড়ি পরে পরে কেমন দীর্ঘাঙ্গী হচ্ছি দিন দিন।
নিজেকে কেবল-ই মনে হচ্ছে ‘সুচরিতা’।
ঠিক ধরেছেন। রবীন্দ্রনাথ। গোরার প্রেমিকা!

Categories
2023-Sharodiyo-Kobita

সুতপা চক্রবর্তী

মাতার আদেশ হয়, পিতা যান ভিক্ষাপাত্র নিয়ে
পৃথিবী ভ্রমিয়া আসি তুলি দেন অন্নপূর্ণা মা’য়ে

রোগের নগর, শোকপল্লী একে একে কালবেলা
মাতার চরণে ঢালি দেন পিতা ব্রহ্মাণ্ডের মেলা

সন্তান সন্ততি সব প্রাচীরের কোণে পড়ে রয়
আকাশ ফাটিয়া অন্ন পড়ে, মানবের ক্ষয় হয়

মাতার আদেশে পিতা মম জগতের আয়ু পান
ভিক্ষার পাত্রটি ঢলে পড়ে শিঙ্গা ভেঙ্গে খানখান

নগর নগরী নট নটী চন্দ্র সূর্য লতাফুল
পিতার বসন উড়ে যায় মানুষের উপকূল

চরণে ভ্রমর আসে, ফুলে আসে মধুরূপী জল
মাতার আদেশ হয়, পৃথিবীর চক্ষু টলোমল

অন্নের সমান ধন নাই, পৃথিবীর পানে চাই
সকলি অলীক! মোহমায়া,মায়া কাটি— কেটে যাই

বৃষ্টিতে আগুন জ্বালি শরীরের বাড়ি বহুদূর
সুরের আবেশে মেতে ওঠে রজনীরা, আহা সুর

বাজিয়া উঠিল জলেস্থলে গাঢ় নিশীথের বুকে
হাজার জোনাকি পাক খেয়ে যায় তীব্র রতিসুখে

ভৈরব নগরী নীলকণ্ঠ পলাশের থোকা ফুল
রজনী সাপিনী ফোঁস করে খুলে তার এলো চুল

রজনী আঁধার চকমকি নুড়ি,কড়ি খেলে যাই
বৃষ্টির আগুন সর্বনাশা জলবাড়ি পুড়ে ছাই

উঠান জুড়িয়া চাঁদ বসে, জলে পড়ে তার ছায়া
জন্মের ভিতরে জন্ম ঘুরে;দেখি সব শূন্য, মায়া…

বৃক্ষের আড়ালে তারা দেখি, জমিনের আঁকা বাড়ি
মাটিতে আঙুল পড়ে জাগে লক্ষ জোনাকির শাড়ি

সুরের ভিতরে কান পাতি, জোনাকির আলো পাই
খাঁচার ভিতরে চেনা পাখি খাঁচাটিকে ভেঙ্গে খাই

নয়ন পথের পরে,চক্ষুগামী হয় স্বর্ণ দেহ
আঁচলে মাসিক ঋতু মুখ ঢাকে, দেখে নাই কেহ

লাজের বরণ খুলি, একে একে গত হয় দিন
মাসিক ফুলের চক্রবাঁকে প্রজাপতি হয় লীন

হাজার রকম ডানা মেলি, চক্ষু খুলি, চক্ষু মুদি
বুকের ভিতর অশ্রু ঝরে পড়ে, অশ্রু দিয়ে বাঁধি

প্রতিটি মাসের শেষে ঘরে পলাশের ফুল ফোটে
আগুন রঙের ফুল দেয় বৃক্ষ, তীব্র বেগে ছোটে

নয়ন পথের দিকে; ধানজমি আস্ত জলাশয়
শূন্যের ভিতরে শূন্য আঁকি, আঁকি অনন্ত হৃদয়

বৃক্ষের গোড়ায় জল দাও, মাসিকের দাও পানি
আঁচলে সুপুরি বাঁধি,চক্ষু খুলে কড়ি দিয়ে কিনি

সোনার শরীরে লালফুল ফোটে, মুখ রই ঢেকে
নয়ন পথের স্বর্ণ দেহ ছাইচাপা পড়ে থাকে

থামতে চাইনি আকাশের মাঝে; একদল পাখী
ঘুরিয়া ঘুরিয়া দেখে গেলো আমাদের আঁকিবুঁকি

বনের ভিতরে বৃক্ষ পুঁতি, লুকলুকি তুলে খাই
পাখীরা আমার সই হয়, আঁচলের তলে ছাই

শেফালি ফুলের লক্ষ তারা ভোররাতে ফুটে রয়
বাঁশের সাজির সারা গায়ে মৃদুমন্দ বায়ু বয়

উঠানে বালক উঠে আসে, বালিকারা আঁকে ছক
মাটির উপরে পাথরের টান, তেঁতুলের টক

কর্মের পুরুষ পূজা পেয়ে যান লক্ষ্মী বারে বারে
মাটিতে চালের গুঁড়ি দিই, জন্ম যায় দূরে সরে

রাতের আঁধারে বনশিশু, নরশিশু সাথে খেলে
রজনী সাপিনী ফোঁস ফোঁস করে এঁকে বেঁকে চলে

গহীন বনের গাঢ় ঘরে পৃথিবীর ঘুম পায়
জন্মের সমান মৃত্যুসখা মম জন্ম খেয়ে যায়

আলোর প্রদীপ নিয়ে বসে আছে মহাকাল পিতা
চরণে ডমরু তাঁর বেজে ওঠে রুনুঝুনু; মাতা

আসিলে বৈঠক বসে, মেনকার পুত্রী ভাত খায়
মাটির গেলাসে ব্রহ্মান্ডের ছায়া পড়ে, থালা যায়

সরিয়া; মেনকা পুত্রী তিনি আলোফুল শিবজায়া
চৌদিকে রন্ধন বাটী কৈলাসের বঁধূ মহামায়া

গরাসে গরাসে ভাত তুলে মুখে দেন; গালভরা
পানের ডাবর; পৃথিবীর চোখ ছলোছলো, হারা

মণির ভেতরে বসে আছে পিতা, মহাকাল ঘোর
আলোর প্রদীপ তার নিভে আসে তপ্ত বালুচর

মাটির থালায় ভাত ওঠে, পেটে ওঠে নাড়ি ধন
মেনকা পুত্রীর চোখে জল আসে, আসে শুভক্ষণ

আলোর প্রদীপ নিয়ে, ব্রহ্মাণ্ডের ছায়া পড়ে, হায়!
চরণে ডমরু তাঁর রুনুঝুনু বাজে— বেজে যায়

 

Categories
2023-Sharodiyo-Kobita

সুমন সাধু

গুপ্ত পাখিবিদ্যা আর বেড়াল যাবতীয়

জীবনের যত গুপ্ত পাখিবিদ্যা আর বেড়াল যাবতীয়
ঠিকানা মজবুত সর্বস্ব পথে ক্লান্তির কুহক
যেন পাতার আড়ালে মুচকি হাসা আকন্দ ফুল
ঝরে পড়ে স্বজনহারানো এ বরষা মরশুমে
আর যত আকুল দীর্ঘশ্বাসের কাছে এসে বসে পড়ছে
না ফোটা ডিম্বপ্রণালী
এই রূপে হতশ্রী হই
যত পাপতাপ বিদ্ধ হোক কামিনী নাভিকুণ্ডে
জ্বালাটি জুড়োবার নয়, তবু রোজ আপনার
সঙ্গে কথা ফুরোয় না
কথার পিঠের ধুলো ঝেড়ে এ বরষায়
আপনি ঘুমাতে পারেন না
শরীরের সমস্ত জলে সুউচ্চ মেঘ জমে
বাষ্পলোকে যেন প্রসূতির কুয়াশাকঙ্কাল

একা এক ব্রহ্মাণ্ড

হাজার হাজার সূর্যের পাশে প্রকাণ্ড সব আলো
ভিড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছায়া
কী হিমশীতল সেইসব শরীর, কী নিদারুণ লোভ
একা হয়ে আসা ঘর ক্রমশ বৃহৎ হয়
স্বভাবের জলতেষ্টা পায় হঠাৎ

এই বোকা ব্রহ্মাণ্ডের মাঝে চিৎ হয়ে শুয়ে আছি
চারপাশে উড়ন্ত সব ছাড়পোকা

ঘরের কথা

একটা বেডরুম
শতবর্ষ পুরনো খাটে লাল চাদর পেতে রাখা হয়েছে
দুটো চেয়ার ঘরের দৈর্ঘ্য প্রস্থকে দুইভাগ করেছে
হাওয়ায় উড়ছে সদ্য ভেজা তোয়ালে
ঘরের তিনদিকে পেরেক বিদ্ধ ফটোফ্রেম
মেঝেতে লুটানো তোমার টুপি, চায়ের কাপ
একটা ঘরে যা যা থাকার সব আছে
এমনকি তোমার ছায়া
শুধু এই ঘরে অত্যাচারিত হওয়ার প্রতিটি দাগ
আমার শরীর থেকে উধাও
তারপর থেকে আমি অলৌকিকে বিশ্বাস করি

অনন্ত

জুন মাসের দেওয়াল বেয়ে নামছে নীল ফুলের ক্যালেন্ডার
সিনেমার আবহে তখন গর্ভবতী বেড়ালের কান্না
এমন বরষার দুপুরে অনন্ত গতিতে ধেয়ে আসছে
শুদ্ধচারী মন্ত্রগুচ্ছ
তোমায় সেলাম ঠুকি
আর ওস্তাদের শেষ রাতে হুবহু পড়ে ফেলি ময়মনসিংহ-গীতিকা
তোমাকে তোমার নামে ডাকার মিথ শেষ হয়
আমার নধর শরীরের সেবা লাগে না আর
শুধু চোখের নীলমণি দিয়ে ঢেউ খেলে যায়
এ রোগের মেয়াদ বারোমাস
কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এলেই মেপে নিই নাগরের শিশ্ন
শরীরের যুদ্ধ থামে

স্বাধীনতা

সমূহ সন্ধের মাঝে ভাবি আমাদের চিল-চিৎকার
রঙের হলদে থেকে গলে পড়ে ভিতরের কমলা
চারপাশে ভিড় করে মহীরুহরা
আমাদের কদমছাঁট চুলে আজ দৃশ্যমান কাঁচি
মরমে পরিপাটি ছোঁয়া
যেন কাঁটার আড়ালে আমাদের মা

কাল দেশ স্বাধীন হবে
মায়ের মধ্য গগনে ঘুরবে রেডিওর চাকা
তরঙ্গ পাড়ে ধাক্কা খাবে, ফিরে আসবে
একা এ দেশের প্রান্তরে এলোচুল, বিনুনি, সোমত্ত সিঁথি
চিল চিৎকারে ফেটে যাবে দেশপ্রেমের গান

Categories
2023-Sharodiyo-Kobita

বাপি গাইন

গুচ্ছকবিতা


কিছু একটা হয়েছে এই পশ্চিম আকাশের
দেখো – তোমার মাথার ছায়া ছিটকে পড়ছে বালির ভেতর
এই কাঁধ তবে বিশ্রামের উপযোগী না।
এই ভিজে ওঠা আকাশও তবে আর নক্ষত্রের না।

দূরে পাথরের শহরে জ্বলে উঠছে নর্তকীর পা
হিসেবের খাতার ভেতর হাঁটতে গিয়ে শব্দ হচ্ছে খুব
এই শব্দ আমি চাইনি, যদিও
জীবনের দিকে হেঁটে যেতে
এতো অন্ধ মানুষ আমি চাইনি কখনো।


যেমন বীজের ভেতর ধ্যানস্হ থাকে গাছ
তোমার ভেতর তেমনই প্রোথিত আছি আমি।

যতক্ষণ না তোমার খিদে আমাকে ছিঁড়ে ফেলছে
যতক্ষণ না আমি তোমার প্রার্থনায় সাড়া দিচ্ছি।


একার ভেতর কী এক পাগল কথা বলছে
এই মৃতদেহ বিষণ্ণ সেতু ভেবে তুমি ভেঙে ফেলতে পারো।

খুব সকালে একটা প্রজাপতি তোমার ক্ষত চাটতে আসে
আজ ওকে না করে দাও। আজ ওকে শিক্ষা নিতে বলো।

ফেলে দেওয়া মাংসের আলোয় সাদা হয়ে উঠছে এলোপাথারি কুকুর
আর কুকুরের গানে ফিরে আসছে আবার হত্যার প্রকরণগুলি।


যে খিদে মাংসের ঘুম ভাঙাতে পারে না তা কোনো খিদেই না।
যে জাগরণ কেবলমাত্র ঘুমের দিকে ঝুঁকে— তাকে প্রশ্ন করা উচিত।
প্রলাপ কি তবে বিপদসীমার উপর এক উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শুধু?
সম্ভাবনা নয় কোনো গুপ্ত জন্মের?

অথচ খাদ্যের সংস্পর্শে এসে সব প্রানী আঘাতের তাৎপর্য ভুলে যায়
সব আঘাত খাদ্যকেই আবার গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে।
এভাবেই সমাজ রচিত হয়, বোঝাপড়া রচিত হয়ে থাকে।


ফুলের ঘ্রাণ দিয়ে ফুলকে শনাক্ত করা যায়।
অথচ হাওয়া ব্যতীত ঘ্রাণের কোনো অস্তিত্বই থাকে না।
ফলে ফুল আর ততোধিক ফুলও থাকে না।
এরকম পরিস্থিতিতে তোমাকে অনুভব করি
শ্বাসে ও বিশ্বাসে হাওয়াকেও সমর্থন করি তাই।
হাওয়ার ভূমিকা পালন করি
সর্বহারার ভূমিকা পালন করে যাই।

Categories
2023-Sharodiyo-Kobita

তন্ময় ভট্টাচার্য

তোতাপাখি

ঘুরিয়ে কিন্তু লেখাই যেত—
‘অনন্ত সৌন্দর্য ফুঁড়ে উঠেছ, কাঁকই,
পালকে জলের দাগ, হাত মোছো আঁচলে যেমন’

অথচ জল খেতে গিয়ে এইমাত্র নদী হল
গলা-বুক, হাত কাঁপছে থরথর করে

কবিতা নয়
সহজ কিছু পথ্যের প্রয়োজন আজ

জ্বরের পর জ্বর আসছে
গান বাজছে নির্মলা মিশ্রের

গাইডবুক

একটা বাসরুটের শুরু ও শেষ জুড়ে দিত আমাদের
অথচ বাসে চেপে কোনোদিন যাইনি তোমার কাছে
নিঃসঙ্গ কবর থেকে, ভিখারির প্রত্যাখ্যান থেকে
বেছে-বেছে জেনে নিতাম নামকরণের অপূর্ব স্টপেজ

বাসেরা অপেক্ষা করত, ফিরে আসতে চাইনি যেহেতু
সাবধান করেছিল, একদিন জলে পড়তে হবে

ওদের

এ-বাড়িতে কোনো বিড়াল বাঁচে না
এমন এক সত্যের বিপরীতে
দাঁড় করিয়ে দিলাম এই কবিতা

বহুদূর কোনো ধাপার মাঠে
ওরা বেঁচে উঠছে
একে একে অস্থি-চর্ম-প্রাণ

ফিরে এসে যদি জিজ্ঞেস করে
ফেলে এসেছিলাম কেন
আমাকেও ওভাবে বিদায় জানাতে চায়

তরুণ সেই কবিদের কী পরামর্শ দেব!

রি-শাফল

মায়ের এমন বয়সেই আমার জন্ম হয়েছিল
সেই বয়সে পৌঁছে, আজকাল ভাবার চেষ্টা করি
মায়ের সম্বন্ধ নিয়ে কেউ হাজির হলে
আমি কি রাজি হতাম বিয়েতে

পুরনো ছবির দিকে একেকটা দুপুর বয়ে যায়
জানলা দিয়ে উঁকি মারে বাম জমানার অবকাশ
মা হওয়ার আগে মা যে-তরুণী
তাকে কি আদৌ ভালোবাসতাম

বাবা হওয়ার আগে বাবা যে-যুবক
থই মেলে না
পুরনো ছবির মধ্যে হেসে ওঠে আমারই আদল

বহুদিন

একটি হাত যতদূর থেকে ডাকতে পারে, ততদূরই আলো
যত কাছে এসে নির্জীব হয়, ততটুকু আয়ু—

এইসব তত্ত্বে আমার বিশ্বাস ছিল না
হাতকে হাতের বাইরে চলে যেতে দেখেছি বহুবার

চাদরের বাইরে, এমনকী, চিতার বাইরেও

এত দূর—অথচ একটুও রাগ নেই
এসব ক্ষেত্রে আমার আঙুলগুলো নালিশ হয়ে ওঠে

বহুদিন সেই হাতে আঙুল বসেনি

Categories
2023-Sharodiyo-Kobita

রাজীব দত্ত

পোড়া মাটির গজল


দেখলাম, ছাদে; গাছের ছায়া, তার ভিতর একটা বিড়াল রোদ পোহাচ্ছে। এই যে গাছ, আমি তার বাঁকা হয়ে নামা ডালে একটা সাপ ভাবলাম। উড়কাপোড়া সাপ। সাপের হিস হিস শব্দের অনেক দূরে, গাছের গোড়ায় একটা মেয়ে। বোবা

সাপ, বিড়াল, মেয়ে কেউ কাউকে চিনে না


আলো চেটে চেটে খেল একটা সাপ

সাপটা অন্ধ


ফুলের ছায়ায় যারা দাঁড়িয়ে আছে
তাদের চিনি না

ফলের পাশে যারা তাদেরও না

না চেনার অহমে দাঁড়িয়ে একটা ছবি ভাবছি
যার শিল্পী ছবিটাকে এখনো দেখেননি
অন্ধ বলে, বিকেলে

আমাকে ও শিল্পীকে পাহারা দিচ্ছে ফুল ও ফল
বাগানের বাইরে নিয়ে যাবে বলে


খোলা চিতার ছাই ছড়িয়ে পড়ছে হাওয়ায়

বৃষ্টি আসুক


সংঘবব্ধ আলো তোমাকে ঘিরে রেখেছে
তুমি বাড়ি ফিরবে কীভাবে?


একজন ছাতিম গাছের নিচে
অত্যন্ত একটা মানুষ

ভাষা শিখছে

যাতে সহজ হতে পারে


পায়রা নামল ধানে;

একটা গাওয়া গান ঈশ্বর খুঁজতে বেরুলো,

রোদের ভিতর—

Categories
2023-Sharodiyo-Kobita

ধ্রুবন সরকার

ব্রেইল-এ লেখা আমলকি গাছ


এই যে সব ফেলে আসি বারবার, তোমার কাছে… রাত্রির জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে দেখি, শ্লোগান, শেষমেষ ধোঁয়া আর পুরোনো আগুনে… ঘরে রাখা মাটির কলসি, ঘট, উল্টে গেছে । ডানায় বীজ-শব্দ, ভাগ হওয়া ক্ষুধা। দু-তিন বার ডুবে গেলেও অবৈধ লুকোচুরি, খেলার ঝোঁক। আমি সব পাণ্ডুলিপি লুকিয়ে ফেলছি তোমার থেকে, সব আতরের দাগ, আদরের ক্ষত, চাঁদের নদী-মোহনা, আমার আশ্রয়। সূর্য পুড়ে পুড়ে কালো হচ্ছে, আমার কনুই। ডালের গায়ে গেঞ্জিটা মেলে দিলাম, গলার কাছে ছেঁড়া। কমলকুমার ছবির খাতা থেকে রং ঢেলে দিয়েছেন। আমার দু’হাতে ভোরের অন্ধকার, পেনসিলের শিষ। সিঁড়ি-ধোয়া জল গড়াচ্ছে উঠোন, সদর দরজায়। আমি পুরোনো তারা খুঁজছি, আলো। দোর-খোলা নদীর জল পূর্ণকুম্ভে, একা। বটতলার মোড়ে দাঁড়িয়ে ব্রিজের দিকে মুখ করে ঝগড়া করছি তোমার সঙ্গে। বন-জঙ্গল, ঘাস-লতার নীচ দিয়ে চাঁদের ছোটো ছোটো কালো দাগ হেঁটে বেড়াচ্ছে। সারা দুপুর ভেবেছি বৃষ্টি আসবে, তোমার মতো তারাও আজ কতটা বাগানের গাছ আর কতটা মাটি ভিজবে, তার হিসেব মেলাতে মেলাতে চলাঘর এঁকেছে, টিনের তোরং। মাঝরাতে যখন তোমায় এসব লিখছি, দু’চোখের পাতার শিশির অজানা পাথরে, চুপিসাড়ে নিয়মের ভাগ চিহ্ন আর বিয়োগের যত কাল দেশ, একক অনুমানে, শরীরের ডালপালায়। রাতচরা পাখিটা এইমাত্র দৌড়ে গেল, তোমার এদিক-ওদিক। নতুন যে এল তোমার জীবনে, বলেছ তাকে আমার কথা? কেমন ভালোবাসতে আমায়? কেমন ধোয়া হাতে তৃষ্ণার জল, রঙচটা মিনার বেয়ে ফেনাভাত। দুপুরের আঠালো রোদ আর বাটি-পোস্তর সুঘ্রাণ এখনও প্লাস্টিকের টেবিলে, বড্ড টানটান। মধ্যমার কুয়াশা সরিয়ে পাখির পা পড়েছে, তৃতীয় মনে। শূন্য চোখে সব হারানো গান শোনা যায়। আজও তুমি আমার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলে না, কোথাও। আজও আমি বৃষ্টির কথা ভেবে, খেয়াঘাট, নৌকোর সম্পর্কে। আর ঘেয়ো মনের ওপর দাঁড় এঁকে চলা ডিঙিটা… ভেসে যাচ্ছে, তুমুল প্রশ্রয়ে।


আমাদের কাছে একা হয়ে যাওয়াটা আসলে কিছু নয়। আমরা তো একাই, ঘুরতে ঘুরতে প্রবাহ, প্রবাহের ক্ষয়ে লম্বা ছায়া… ফুল, সুগন্ধি… সূর্য যেদিকে অস্ত যায়, সেদিকেই হেঁটে গেছে। এসব আসলে তেমন কিছু হয়ে ওঠে না কখনও। আমরা সবাই ঐদিকেই হাঁটি… ঘুম না এলে স্লিপিং পিল… পিল ভাবলে আরও কিছু মনে হয়। টুপটুপও পিল নিত… আমরা দুজন একসঙ্গে অনেকক্ষণ জেগে থাকার পর। না ঘুমোনো রং বলতে আলোধোয়া খয়েরি। আচ্ছা, খয়েরি আর বাদামি খুব কাছাকাছি, তাই না? না হলেও কিছু যায়-আসে না। তবে, বিস্কুটের রঙে ভেজা একটা দিন… নিজে অদৃশ্য হয়ে ভাবি… চারকোলে আঁকা কালো-সাদা ঘুম, কানের লতি বেয়ে নেমে আসছে আলো, আশ্চর্য ত্রিপলের কোণ, ভেজা ছাদ, জলঢোড়া। পাশে মুখচোরা মস্ত গর্ত, ভেতর থেকে লাজুক বাঁশ মুখ বার করে রেখেছে। শুধু কালো গর্তটাই ছবিতে রয়েছে, আর পিল না খাওয়া পাখির পালক। এটাও তেমন কিছু নয়, আসলে পালকের পাশে মরা পাখিটার শরীর পড়েছিল।

দীর্ঘশ্বাস ছড়িয়ে যায়, কুড়িয়ে নেওয়া যায় না। রবীণদা যেদিন চলে যান, সেদিনও আলো জ্বেলে দিয়েছিলেন। আগের রাতগুলো পোড়া মনসাপাতা যেন। আকন্দ গাছে থোলো থোলো অন্ধকার। অন্ধকার মানে কতগুলো কাকের গায়ে-গা দিয়ে বসা। বর্ষার দিনে ছাতা উপুড় করে তাতে জল ধরেছি, কাগজের নৌকো ভাসিয়ে যন্ত্রণার স্বাদ, তাড়না, আঙুল ডুবিয়ে প্রতিসরণের দূরতর দেশে ইউটোপীয় উপাদান খুঁজে চলা। জীবনের অন্তর্গত নৌকোয় যেতে যেতে ভেবে নেওয়া, যে আমার পাশেও একজন শুয়ে আছে, জলের ওপর, যার বুক বলতে ঢেউয়ের ওঠানামা। যদি মনে করি এসবও কবিতা, তবে অবশ অংশেরা দু-চারটে গাছ, শখের ছবি, শব্দের ছবি। সেসবের অনুলিপি করবে বলে, চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে রয়েছে একজন।

এসব তেমন কিছুই নয়, হারিয়ে যাওয়া বিন্দুর স্বর, আবীর। সম্পূর্ণ ভুলে গেছি, কিভাবে কান্না থামাতে হয়। ছায়াপথ অন্ধ মানুষদের হাতে পর্বতের ভাষা, কালো সামুদ্রিক রং, বৈভবে শিস দেওয়া দেওয়াল গেঁথে দিয়েছে।


এখন রাতে ঠিকমতো ঘুম আসে না, আজ থেকে তাই একটা খেলা খেলব ঠিক করেছি। লেবুপাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে পেছনের বাগানের পাশে সব ভুল শুধরে নেব। জুতোর ফিতের কাছে পাঁজরের কত হাড় পড়ে থাকে। রেলে-কাটা মানুষের পা খসে যায়। চিতা থেকে গড়িয়ে গেলে, আবার ধরাধরি করে তাকে কাঠের বিছানায় শুইয়ে অর্ধেক ব্যথার কথা মনে করিয়ে দিই। ভ্রূজোড়া ঠোঁটের নীচে রেখে চুমু খায় টুপটুপ। আমাদের পেট-বুক জুড়ে আজ ঐকিক নিয়ম। লেবুপাতার রসলাগা মধ্যমা চুষে চুষে আরও বেশি তেতো স্বাদ।

আজ নিঁখুত একটা গন্ধ উড়ে আসছে কোথা থেকে… নিয়মের সূত্র… সূত্রের ঘাম… ঘামের ফোঁটা…


ছায়া আমার চেয়ে অনেক দূরের স্বর স্পর্শ করে। ঝোপের শব্দ আর বুনো রং শুঁকতে শুঁকতে ভাবে, বুকের ভেতর ঝাঁপ দিয়ে সাঁতরে যাওয়া মাছরাঙার গন্ধ হাতের তালুতে ঘষে নি-ই। লন্ঠন ভেবে কত কিছুই তো জমিয়ে রাখলাম… করুণ আলোছায়া, তেলরং। টুপটুপের ভালো নাম ছিল আলো। গর্তে ফিরে যাওয়ার আগে সে প্রতিবার শাড়ি ও আকাশের মুদ্রা আঁকত, খেজুরপাতার ছায়া।

রং ও রেখা বেড়ে চলেছে, পাতার ঘুমও। এখন রোদের চোখের দিকে চাইলেই বুঝি কালো শেকলের নীচের জবা গাছটা কেন চোখ বন্ধ করে। জামগাছের হাওয়া কবরের আলগা মাটি অক্লেষে ছুঁয়ে যায়। ঐ তো, তোমার পায়ে আটকানো কুয়োতলার ছায়া, ছিঁড়ে ছিঁড়ে, স্নান সেরে ভেসে যায়। কপালে জপমন্ত্র ঠেকিয়ে মা অন্নত্যাগ করে, গঙ্গার দিকে মুখ ক’রে… দু-মুঠো আতপ চাল। বাবা চলে যাওয়ার আগে থেকেই মা সাদা কাপড় পড়ছে, সমরকাকু মারা যাওয়ার পর। পাশ দিয়ে জিওল মাছ লাফিয়ে যায়, মাছওলার সাইকেলের হাঁড়ি থেকে। চোয়াল শক্ত হয়ে কুড়িয়ে আনা কাঠ… উল্টোরথের ঘোড়ার জিন টান দিয়ে ফিরে যায়, ডাকে না। রোদের তেজ বাড়লে লাল্টুদের পেয়ারা গাছে দুটো শালিক এসে বসে, আর মা-এর দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে, রোমকূপে জোড়া আঁশের মতো। আমি দুলে দুলে পড়া মুখস্থ করি। যেসব দিনে পেট নরম হয়, ওই গাছের কচি পাতা সেদ্ধ করে জল… বাঘছালের রং। বাসি মুখে অর্ধেক জল , দেওয়ালে ঝোলানো চৈত্র-রাত। ঘুমের ওষুধ প্রিয় আঙুলের মতো, ঘুম পাড়িয়ে দেয়। সাইকেলের রডে জড়িয়ে থাকা রোদ হয়ে, কালস্রোত আর হাতের আঙুলের ধূসর ঝোলায়।

সেদিনও ছিল একলা বৈশাখ, সকালে ফোন করেছিলাম। টুপটুপ বলেছিল, আজ যখন প্রথম তোমার ফোন এল, সারাদিন না-জানি কতকিছু…। আর ঐ দিনই বাবা চলে গিয়েছিলেন। একটা ছোটো ছবি আমায় দিয়ে বলেছিল, সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বাঁধিয়ে দিও। পারিনি। যতবার ছবিটা বড়ো করেছি ততবার সূর্যমুখীর প্রতিটা পাপড়ি কুঁকড়ে গেছে। আমরা আবার কি হারাব, বলো? চুলের দশদিক ধুয়ে গেছে চালধোয়া জলে। শ্বাস নিচ্ছি… জপের চেয়েও নিঁখুত পরম্পরায়, আয়নার বিন্যাসে। শ্বাস ছাড়ছি, নিয়মিত ভেদহীন এক কুঁড়ে ঘরে। আলো সেখানে বেড়ার ফাঁকে, মাটি স্পর্শ না করেও… ধুলোর কাছে, পর্দা ও পুরুষে।

তার চেয়ে আমার ঘুমের অসুখ-ই ভালো। প্রতি ঘোষ-অঘোষ বর্ণ জলের মতো ভেসে যাবে, চিহ্ন বদলাবে ঘোড়ার পিঠের। টুপটুপের কালো শাড়ির আঁচলে পীতরক্ত, গিঁট বেঁধে রাখা। নিজের চেয়ে আপন কোনো ভষ্মাধার খুঁজে পাইনি কখনও, যা অনন্ত আশ্রয় হতে পারে। তুমি অনেক নদীর কথা শুনিয়েছ, অনেক বয়ে চলা… তাদেরও খুঁজে পাইনি। আমি পৌঁছনোর আগেই পথটা শেষ হয়ে গেছে।

প্রতিদিন একটা বুনো পাথরে দাঁড়িয়ে আমার ফিরে চলা দেখি। দূর থেকে মনে হবে রিলিফ স্কাল্পচার, ধানের শিষ। অজস্র আশ্রয় মিশে আছে দূরশব্দে। আগাছার আঙুলগুলো এবার ছড়িয়ে পড়ুক ঘরময়। কত বছর বাদে আজ তুমি চেয়ার টেনে বসলে, ভারী বোতলের চওড়া বুকে কলমির দাগ। তোমার যন্ত্রণা টানটান সেলোফেনে মুড়ে চোখের স্নায়ু, হাতের পাতা আলাদা করে রাখছি। কে তবে প্রিয় বলো, ভেজা হাওয়ার শব্দ? অর্ধেক নদীকথার ফুসফুস? সেই কালো শাড়িটার মতো যে রঙমুক্ত একফালি পাল্লা ফাঁক করে রেখেছে? ফিতে বাঁধা ব্লাউজটা, ওর সাথেই তো পড়বে ভেবেছিলে? আর তাই বিকেলবেলা বেড়িয়ে স্টেশনধার… সারা রাস্তা আমরা জেগেছিলাম। সেদিন সবুজ রং কিনেছিলে বোধহয়। আর দড়ি বাঁধা পিঠ। কালো শাড়িটার সাথে মিলল না বলে পড়াও হয়নি।

আমার পা পিছিয়ে যাচ্ছে, তোমার ধুলোয়। শরীরের জয় পরাজয় ভেবে তুমিও বর্ণহীন। শ্রেয় রেণুশ্লোকে মেলে ধরেছ আঁচল, আমি ডুব দিইনি।

আজ উৎসর্গের পাতায় সব ঘুম ডিঙিয়ে বলো… সিন্ধুজল, আর মৃত পাখির পালক। চোখ আটকে যায় তোমার পুনর্যাপী ঘরে। সেখানে আজও নিভিয়ে দেওয়া আলো, তাসের দেশ আর তোমার কালো শাড়িটার রং পড়ে আছে।


আমাদের হাতের অমলতাস আর সঙ্কীর্তনের যাদব ফকির এক মানুষ নন। পঞ্চভুবনের আচার সংস্কারে আমি অনেকবার তার মুখের দিকে চেয়েছি। নাট-মন্দিরের সব নকশায় সে কাঁচা-পাকা ধানের ভেতর ঘাসপোকার আলপনা খুঁজে পেয়েছিল। চৌপথি থেকে ডানহাতের রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে দূরের মন্দির-ঘরে ঘন্টার আওয়াজ। রোজা রাখার দিনেও কাছে গিয়ে শুধু ত্রৈরাশিক গুণ, চিহ্ন, ভাগের অবশেষ আর সিঁড়িভাঙা অভাবি সর্বনাম… নিজেকে খুঁজে খুঁজেই দিন শেষে অন্তরীণ দাহ নিয়ে ফিরে যায়। জোড়া পাঁকালমাছ বৈশাখের জ্বরে ঘোলা চোখে চেয়ে দেখে, আমার কুশের আংটি দে-ঘাটের ধাপ বেয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে নামছে… কলাপাতার ছেঁড়া ডোঙায় আতপ, কলা, কালো তিলের চটকানো মণ্ড নিয়ে। যারা শেষমেষ শ্মশানগাছে পায়রার দল খুঁজে পায়, মাজারের পাশের জমিতে কিরিচ ও তন্তুজ অভ্যাসে পাঁচিল গেঁথে রাখে, তারাই হাতের রঙিন কাচ টুকরো টুকরো করে কবরের চারপাশ সাজিয়ে দেয়। আমপাতায় আলতারং, পাটি বিছিয়ে তার ওপর খোলা পিঠ, দাঁতের দাগ, জরির শব্দ… কম পাওয়ারের আলো জ্বেলে। মরা সাপের দেহের মতো লম্বা হয় রাত।

নিরন্তর অন্ধদিনে ক্ষুরের আড়াল ধরে ধরে আমার বড়ো হওয়া। জানলা খুলে বসেছি, নিঃশঙ্ক ভয় আর সংকটে গা পুড়ে যাচ্ছে। উত্তরের পাহাড়ের গায়ে একটা শালগাছ জন্মেছে। অবৈধ। গোপনে বলে এসেছি তছনছ হয়ে যাওয়া ক্যালেন্ডারে এবছর কোনো জন্মদিন থাকবে না, কোনো ভুলের চিহ্ন। অন্ধকার ঢুকে পড়েছে খোপকাটা ঘরগুলোয়। আজ আওয়াজের চেয়েও তীব্র টান অনুভব করছি কমলকুমারের ছবির খাতায়।

বাঁকা সূর্যের আলোয় ভেসে যাচ্ছে কামিনীর ঝোপ। গাছের শেকড় গা থেকে নীচের দিকে ঝুঁকে তারপর মাটির ওপর দিয়ে সহজিয়া ভঙ্গিতে…। ফিঙেটা নাচতে নাচতে আড়াল থেকে বেরিয়ে কী যেন খুঁটে নিচ্ছে… পাতা ও আমার নির্লিপ্তি। বিউগল ফেলে ছিঁড়ে যাওয়া ঝিল্লির স্রোত সরল আত্মরতি ভেঙে ভেঙে ছাইয়ের গাদায় নাভিকুণ্ড খোঁজে। তুমি যা চেয়েছ টুপটুপ, আমিও কি তা চাইনি? মাটির অন্ধকার, কনকনে রক্তজাল, পৌরুষে বিষয়ী হয়ে ওঠা মেঘ, অলৌকিক মায়াধ্বনি, দীর্ঘ অভ্যাসে অনিদ্রা ছুঁড়ে দেওয়া নির্জন গলি, ধোঁয়ার গাদ, সেঁকোবিষ। ছায়া বেয়ে ওঠা জলের নীচে আমাদের সংসার, নহবত বাজিয়ে। জলে ডুবে নেই ভেবে নারী ও নক্ষত্রের ঘট ভেঙে যায়। পূর্ণগ্রাস আছড়ে পড়ে একরোখা শালুর আঁচলে।

এমন বিকেলে তোমার বুকে হাত রেখে কেঁপে উঠেছিল আকন্দের ডাল, যেন যত্ন করে বাঁধিয়ে দিয়েছি আমাদের ফুলের দিন, মেঘে আসা জল। তুমি আমার চেয়ে আরও আগে থেকে কষ্ট পাও, করবী আঠায়। আজ যদি সত্যিই বৃষ্টি হয়, সেই জলে ধুয়ে যাবে গোয়ালঘর। মাঠ খুঁজে নেওয়া মেথি ফুল স্নান করবে। তোমার শরীরে ফসল ফলবে আজ, যা আমি খেয়াল করিনি, মুখ বুজে আসা বর্ষার দিনে।