Categories
2023-sharodiyo-krorpatro amitava_smritikotha

বেবী সাউ

কবির অনস্তিত্ব ও কবিতার অস্তিত্ব

‘সময়টা ভালো নয় রে, সাবধানে থাকিস।’ সময়টা যে ভালো নয়, তা অমিতাভ মৈত্র-র চেয়ে আর কেই বা বেশি করে বুঝতেন, জানি না। কারণ খবরকাগজের পাতা থেকে বাস্তবতাকে যাঁরা জানেন, তাঁদের চেয়ে অনেক বেশি বাস্তবতার মুখোমুখি হতেন সরকারি প্রশাসনের উচ্চ দপ্তরে কর্মরত এই কবি। তার জন্য বিস্তর যে সব কাঁটাঝোপ অতিক্রম করতে হতো তাঁকে, রক্তাক্ত হন তাঁর মন। বাইরে থেকে হাসিখুশি এই অনুভূতিপ্রবণ কবির মনের ভিতরে যে অস্থিরতা চলত, তা সহজে বোঝা যেত না। হয়তো সেই আগুনের মতো অস্থিরতাকেই তিনি লিখতেন তাঁর কবিতায়। বাংলা কবিতার জগতে তথাকথিত আলোর জন্য মাথা খুঁড়ে মরেননি এই কবি। কারণ প্রকৃত কবির মতোই তাঁর ছিল দৃঢ় আত্মবিশ্বাস। নিজের ভাষার সাহিত্য, দেশের সাহিত্য, বিদেশের সাহিত্য, চলচ্চিত্র নিয়ে সর্বদা তিনি নিমগ্ন থাকতেন নিজের পড়াশুনোয়। হয়তো এ কারণেও কবি অমিতাভ মৈত্রর কবিতাকে অনেক বেশি আন্তর্জাতিক বলে মনে হয়। মনে হয়, তাঁর কবিতার ভিতর যেমন মেদিনীপুর পুরুলিয়ার এক প্রান্তিক মানুষ কথা বলে উঠছেন, তেমনই স্বর শোনা যাচ্ছে এই সময়েরই প্যালেস্তাইন থেকে, সিরিয়া থেকে, ভেনেজুয়েলা থেকে। যখনই কথা হতো, মনে হতো, মনে মনে অস্থির এক কবি, বিদীর্ণ হয়ে আছেন সাম্প্রতিক সময় নিয়ে। প্রশাসনিক কাজ তাঁকে আরও রুক্ষ বাস্তবতার সামনে ঠেলে দিয়েছে। কিন্তু তাতে তাঁর কবিতা শুধুই সংবাদের বৃত্তান্ত হয়ে পড়েনি। হয়ে পড়েনি বিবৃতি।

কবিতা আসলে একটা ভ্রমণ। একটা সফর। পাঠকের সঙ্গে কবির। কিংবা বলা যেতে পারে কবি এবং পাঠক পরস্পর কবিতাটির পেছন পেছন যান, তাকে ছোঁয়ার জন্য। অনুভবের জন্য। আর তাতেই রহস্যময়ী হয়ে ওঠে সেও। একটা নতুন কবিতা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মনে হয় পরিদর্শনে বেরিয়েছি। এক একটা দৃশ্য এসে বসছে। আবার এসে যাচ্ছে পরের দৃশ্যপট। চারপাশে অজস্র আলো-আঁধারের খেলা। এইসব রংকে কবি যেমন কিছু শব্দের মধ্যে বেঁধে রাখার সঙ্কল্প নেন, আবার পাঠক তাকে ছড়ায় বিস্তৃতির দিকে। হাঁটে। কবি আড়চোখে হাসেন। কবিও বেরিয়ে পড়াটুকু উপভোগ করেন। পাঠক রোমাঞ্চ বোধ করে। দেখে, শব্দ আর দৃশ্যের মতান্তর। সহযোগ। মুগ্ধ হয়। কখনও বিধ্বস্ত; বিভ্রান্ত। আবার বহুদিন পরে হঠাৎ কোনো দৃশ্যে নিজে খুঁজে পায় সেই কবিতাটির প্রকৃত আধার। তাই কবিতা যতটা না শব্দের ঠিক ততটাই স্বশব্দেরও। কবি অমিতাভ মৈত্রের কবিতা জীবন ঠিক এরকমই। দৃশ্যের জগত নেমে আসছে শব্দের কাছে। আবার শব্দের জগত মিশে যাচ্ছে দৃশ্যে। বাস্তব এসে গল্প করছে সাদা অ্যাপ্রোণ পরা নার্সদের সঙ্গে; একঘরে শব্দ চিৎকার করছে। আর বিরাট নার্সিংহোম থ মেরে আছে। ঠিক তখনই যেন হঠাৎ করে উড়ে এসে জুড়ে বসার মত কবি যেখানে হাজির। দেখছেন এবং স্তব্ধ হয়ে আছেন। বুঝতেই পারছেন না, এই মুহূর্তে তাঁর ভয় পাওয়া উচিত নাকি অর্ডার করা উচিত দায়িত্ব সূচি অনুযায়ী নাকি চিৎকার করে আউড়ে যাওয়া উচিত কোনও সংবিধানের সাজানো, সংযোজিত মুখস্থ করা লাইন!
“This long, this long dream, I’m awaking, no, I’m going to die, dawn is breaking” —Albert Camus এর এই লাইনগুলি কবিই ব্যবহার করেছেন তাঁর কাব্যগ্রন্থ “টোটেমভোজ”-এ। এইযে ভয়াবহতার প্রকৃত দৃশ্য কবি ব্যবহার করলেন সার্জিকল টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে— আর সাদা টকটকে একটা বলের সঙ্গে মেশালেন আসন্নমান মৃত্যুর দৃশ্যকে— আর এখানেই পালটে গেল এতদিনের নিয়ম কানুন। সাহিত্য রচনার ব্যাকরণ বিধি। কই বাংলা সাহিত্য তো কখনও এমনভাবে বাস্তবের সঙ্গে কথা বলেনি! শুধু ফল-ফুল-লতা-পাতা নিয়ে পড়ে থাকার মতো দিন যে আর নেই কবি অমিতাভ মৈত্রের কবিতা পাঠের মাধ্যমে সেই অনুভূতিকে খুঁজে পাওয়া যায়। কবিও বলতে পারেন ” প্রতিটি অপরাধের পাশে রক্তের হালকা ছোপ লেখে থাকা ট্রেন/একবার মাত্র আলো ফেলে ঘুরে যায়/আর ভয়ার্ত ঘাস আর ভয়ার্ত ভেড়াদের সামনে/আমরা বিচ্ছিন্ন এবং আত্মস্থ হতে চেষ্টা করি”( মনঃসমীক্ষকের স্বীকারক্তি)।

অমিতাভ মৈত্রর জন্ম ১৯৫২ সালে। যে সময়টাতে জন্মেছেন এখনকার আরও বিশিষ্ট কয়েকজন কবি। সমকালীন অবস্থানটিকে ধরলে দেখা যাচ্ছে, কবি অমিতাভ মৈত্রের রচনাকৌশল পুরোপুরি ভিন্ন। আঙ্গিক, বচন, কবিতার বিষয় বৈচিত্র্য— সবকিছুতেই কবির নিজস্ব ছাপ; ‘বিভীষিকার জগৎ রক্তের আঁশটে ব্লান্ট-গন্ধ’ মাখা এক বাস্তব দুনিয়া। কবির নিজস্ব কথায়।

প্রথম কাব্যগ্রন্থ “বিদ্ধ করো, তীর” প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ সালে। দীর্ঘ একটা সফরের কবিতা নিয়ে কবির এই কবিতার বই। বাংলা সাহিত্যের পাঠকের মতো করে, ছন্দ, রূপ রসের সৌন্দর্যে মণ্ডিত এই সব কবিতাগুলি। কিন্তু কবির সন্তুষ্ট নন। কবি চাইছেন অন্য কিছু; ধরতে চাইছেন সেই বিরাট বাস্তবকে। মনের ভেতর চলছে অস্থিরতা; দ্বিধা-দ্বন্দ। এঁকে ফেলতে চাইছেন প্রকৃত বাস্তবকে। তখনই ব্যর্থ কবির মনে হয়েছে— “‘বিদ্ধ করো, তীর’-এর এইসব কবিতা থেকে আমার আত্মা বিযুক্ত হয়ে গেল। নিজের কবিতা বিষয়ে স্ফীত আস্থা নেই এমন মানুষ যা করতে পারেন, আমি তাই করলাম। এরিয়া ছেড়ে সরে গেলাম।”

দীর্ঘ দশ বছরের বিরতি। দীর্ঘ একটা পরাজিত মন? নাকি নিজেকে ভাঙার জন্য নির্জন কোনও সাধনা? দীর্ঘ সময় অতিক্রম করে শব্দের কাছে কবি ফিরলেন। অসন্তুষ্টি; ক্রোধ; রাগ; অভিযোগ; অভিযোগ সবটুকু নিয়েই ফিরলেন। ততদিনে ভেঙে গেছে অনেক কিছু। ততদিনে তিনি খুঁজে পেয়েছেন তলস্তয়ের “The death of IvanGlych” গল্পে ইভানইলিচের অদ্ভুত অসুখ ও যন্ত্রণা থেকে ব্যথার কেন্দ্রবিন্দু। তাঁর কাছে কবিতা শুধু শরতের মেঘোজ্জ্বল আনন্দ নয়; বরং কবিতা ধরা দিয়েছে এক রক্ত মাংস হিংসা দ্বেষ কলহ বাস্তব জীবনের প্রকৃত সত্য হিসেবে। শুধু সৌন্দর্য মণ্ডিত হয়ে নয়; বরং মিলিত সত্ত্বার রূপ ধারণ করে। কবিও এটাই চাইছিলেন। কাফকার মতো তিনিও বলতে চান “সেই মানুষটির মতো লিখতে চাই আমি যে সেই হাতের আশ্রয়ে উন্মাদের মতো ছুঁড়ে দিতে পারে নিজেকে। ” তবে যে বিপন্নতা কাজ করছিল কাফকার ভেতরে সেটি কি কবির ভেতরেও আছে? একটা বিরাট অস্বস্তি কাজ করছে কবির মধ্যে। একটা অনিশ্চয়তায় মোড়া রাত্রি; ঘাতকের মতো চোখ আর দমবন্ধ একটা অবস্থান থেকে কবি বেরোতে চাইছেন যেন। আর ওইসব অজস্র হিংস্র চোখ কবির চোখে ফোকাস করে চলেছে অবিরত। ওখান থেকে যেন মুক্তির সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে। এতদিনের জমে থাকা মনের ভেতরে ক্রোধ মুক্তি চাইছে। কিন্তু এই পৃথিবী যে বড্ড নিস্পৃহ; নিঃসঙ্গ। কারোর কথা শোনার মতো অবসর নেই তার। কবি অসহায়। ফিরলেন শব্দের কাছে। বললেন, ” টোটেম’ এর ভাষা প্লাষ্টার করা হাতের মত শক্ত, আড়ষ্ট, কৃত্রিম। দাঁন্তের নরক ও পরিশুদ্ধিতে আমি মুক্তি খুঁজছিলাম তখন।সঙ্গে বাইবেল এবং কাফকা। “Inferno” –তে নরকের দরজায় লেখা ছিল –“Leave every hope, ye, who enter.” আমি সেটি ব্যবহার করেছিলাম বইয়ের শুরুতেই।” ম্যাডাম এম. এর সঙ্গে। ম্যাডাম এম. দেখালেন টোটেম ভোজ এর প্রাকমুহূর্ত। আত্মহত্যার আগে একজন সুস্থ সবল মানুষের কী কী করণীয়। আর প্রাসঙ্গিকভাবেই কবি তুলে আনছেন Andre Hardellet এর উক্তি “Such detachment! Such relief.” কীরকম মুক্তি? নিজেকে আবিষ্কার? নাকি নিজেকে ধ্বংস করে ফেলা? এই আত্মহত্যার ছবি আঁকতে গিয়ে কবি জোগাড় করে আনলেন চোখের সামনে এক প্রোটাগনিস্ট নারীর বর্ণনা। “এগিয়ে আসছে আপেল আর লাফিয়ে কামড়ে ধরছে ম্যাডাম এম এর গলা/ দাঁতের ডাক্তারের মতো শ্লথ গ্যাস সিলিণ্ডার দু-পায়ের মাংসে জায়গা খুঁজে নিচ্ছে”। চমকে উঠতে হয়। লাইনের পর লাইনে উঠে আসে সমাজের বাস্তবচিত্র। আর পাঠক ম্যাডাম এম এর মধ্যে দেখে সেই নারীটির যন্ত্রনাজর্জর দিনগুলির দৃশ্য চিত্র। আর এই ভারতীয় সমাজে হাঁটা ফেরা করে বেড়ায় কবি সৃষ্ট চরিত্রগুলি। কবিও তাঁর যাবতীয় চিন্তা ভাবনা; রাগ-অভিযোগ নিয়ে চরিত্রগুলির সঙ্গে সহবাস করেন।

২০১৫ সালে বেরোয় কবির ‘সি আর পি সি ভাষ্য’। ততদিনে কবি তাঁর কর্মজীবন থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন। সিভিল সার্ভিসে চাকরির সূত্রে আইনের মারপ্যাঁচ স্বাভাবিক ভাবেই এসেছে। কিন্তু এই কবিতার বইটিতে আছে কবির নিজস্ব অনুভূতি এবং উপলব্ধির প্রকাশ। ‘vision of evil’ থেকে তুলে আনা কবির বয়ান; স্বীকারোক্তি।

কবি অমিতাভ মৈত্রের কবিতাতে দেখা মেলে একজন তৃতীয় ব্যক্তির— কখনো তিনি ক্রিস্টোফার, কখনো ম্যাডাম এম, কোয়ারান্ট রিগ্রেসন অথবা আয়নাতে প্রতিবম্বিত ছায়া হেনরি। এবং তারা কেউ এদেশীয় নয়। তারা কেউ লেখক নন, কবি নন, এমনকি পাঠক নন। তৃতীয় জন। নিরপেক্ষ? যারা শুধু আসে এবং চলে যায়।

চোখের সামনেই ঘটে যাচ্ছে বিভিন্ন ধরণের বাস্তব চলচিত্র। অথচ দৃশ্যের সঙ্গে অনুবাদ হচ্ছে একটি শ্লথ-মন্থর যাতায়াতের। আবার সামনে বেজে উঠছে কোনও ফ্রেগর্যান্স অফ কালার-এর অতলান্ত স্পর্শে। মনে হচ্ছে এ যেন রসের ভিয়েন। এ যেমন সত্য, তেমনি এও সত্য সমস্ত বাস্তবতা একটা আশ্চর্য গ্লোবের ওপর ঘুরছে। আবার মুহূর্তে তৈরী হওয়া সেই কালারের ফোকাস ভেঙে পড়ছে। এখানে পাঠকই সর্বত্র। নিজস্বতা আছে বলেই নিত্যতার এই সূত্র, এই মহিমা। আমি আছি বলেই রূপ রঙ রস স্পর্শ। আমার জন্যেই সমস্ত নিয়ম কানুন, ব্যস্ততা, ভাঙা-গড়া। কবি অমিতাভ মৈত্রের কবিতা এসব কথাই বলে যাচ্ছে। তাই হেনরির মধ্যে পাঠক নিজেকে খোঁজে; বাউণ্ডুলে জীবনকে খোঁজে। আর হাঁটে। আর এখানেই কবির কবিতার সার্থকতা। এখানেই কবি অমিতাভ মৈত্র-র কাব্যব্যক্তিত্ব।

এমন এক কবি এই রণ-রক্ত-সফলতা-ব্যর্থতার পৃথিবী থেকে অনেক দূরে চলে গেলেন। রয়ে গেল তাঁর কলম, যার রক্তের দাগ এখনও শুকোয়নি।

Categories
2023-sharodiyo-krorpatro amitava_smritikotha

অমিতজ্যোতি সেনগুপ্ত

একজন দক্ষ প্রশাসক এবং একজন রুচিশীল সাহিত্যিক

গত ২২-শে ফেব্রুয়ারি চলে গেলেন অমিতাভ মৈত্র। সাহিত্য জগতের বিরাট ক্ষতি তো হলই, আমি হারালাম আমার এক বন্ধু ও প্রাক্তন সহকর্মীকে। একই সার্ভিসের সহকর্মী হওয়াতে, আমরা যে যেখানেই থাকি না কেন, আমাদের প্রায় ১৭০০ আধিকারিকের ডব্লিউ বি সি এস (এক্সিকিউটিভ) ক্যাডারের সবার মধ্যেই একটা অদৃশ্য যোগাযোগ সবসময়ই থাকে। তাই ওঁর সাথে ২০০৭ সালে রায়গঞ্জে সাক্ষাৎ হওয়ার আগেই ওঁর বিষয়ে অনেক সংবাদই আমার জানা ছিল। ওঁর জলপাইগুড়ি এবং পরে ঘাটাল মহকুমার মহকুমাশাসক হিসেবে প্রশাসনিক দক্ষতা আমাদের কাছে উদাহরণ হয়ে থাকবে। বিশেষ করে ঘাটাল মহকুমার প্রচণ্ড বন্যা পরিস্থিতি উনি যেভাবে ঠাণ্ডা মাথায় সামলেছেন তাতে উনি রাজ্য সরকার এবং সার্ভিসের সম্পদ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছেন।

অমিতাভদার সরকারি কর্মজীবন আরম্ভ হয় ভূমি-সংস্কার দপ্তরের আধিকারিক পদে। ১৯৮৩ সালে রাজ্য সরকার বিভিন্ন দপ্তরের কর্মরত আধিকারিকদের মধ্য থেকে ডব্লিউ বি সি এস (এক্সিকিউটিভ) অফিসার চয়ন করার জন্য একটি বিশেষ পরীক্ষা নেন এবং সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উনি সার্ভিসে যোগ দেন ১৯৮৬ সালে। প্রশাসনে ভূমি ও ভূমি-সংস্কার দপ্তরের খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা আছে কারণ প্রত্যেক দপ্তরেরই উন্নয়নের স্বার্থে ভূমির প্রয়োজন। চাকরির শুরুতেই সেই দপ্তরের অভিজ্ঞতা নিয়ে কাজে নামায় ওঁর কর্মদক্ষতা সবসময়ই প্রশ্নাতীত ছিল।

অমিতাভ মৈত্রর সাথে আমার প্রথম দেখা হয় ২০০৭ সালে, আমি যখন উত্তর দিনাজপুর জেলা গ্রাম উন্নয়ন সেলের প্রকল্প নির্দেশক পদে যোগ দি। উনি তখন জেলা ভূমি ও ভূমি-সংস্কার আধিকারিক পদে আসীন। খুবই গুরুত্বপূর্ণ পদ এবং ভূমি-সংক্রান্ত অনেক জটিল সমস্যার সমাধান অধস্তন পর্যায়ে সম্ভব না হওয়ায়, সেগুলো সমাধানের দায়িত্ব এই পদের ওপর বর্তায়। এছাড়াও ছিল অতি সংবেদনশীল ভূমি অধিগ্রহণের বিষয়। অমিতাভদাকে দেখেছি খুব নিপুণভাবে আইনের বিশ্লেষণ করে এবং একই সঙ্গে যথাসম্ভব মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সব সমস্যাকেই গ্রহণযোগ্য সমাধানের দিকে নিয়ে যেতে। এ-কথা সর্ববিদিত যে নিরপেক্ষ সরকারি সিদ্ধান্ত সবার পছন্দের না-ও হতে পারে। অনেক সময়ই বিভিন্ন ধরনের চাপ এসেছে সিদ্ধান্ত পাল্টাবার জন্য, কিন্তু ওঁর মতো একজন স্পষ্টবক্তা এবং ধীর স্থির আধিকারিকের পক্ষে ওইসব চাপকে নস্যাৎ করে দেওয়া একেবারেই কঠিন ছিল না। তা সত্ত্বেও ক্ষমতাশালীর আঘাত নেমে আসতে দেখেছি, দেখেছি ওদের নতজানু হয়ে ক্ষমা চাওয়া এবং ক্ষমাশীল অমিতাভ মৈত্রর সব ভুলে পরিতাপীকে ক্ষমা করে দেওয়া। ওঁর চরিত্রের এই দিক ওঁর শুভাকাঙ্ক্ষীর সংখ্যা ক্রমশই বর্ধমান রাখত।

এক বছরের কিছু বেশি উত্তর দিনাজপুরে থাকার পর আমি বদলি হলাম নদিয়ার জেলা ভূমি ও ভূমি-সংস্কার আধিকারিকের পদে। তার কিছুদিন পরেই অমিতাভ মৈত্রও নদিয়া চলে এলেন জেলা পরিষদের অতিরিক্ত নির্বাহী আধিকারিক হয়ে। আবার কিছুদিন এক জেলায় কাজ করলাম আমরা। রাজ্যের ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থার সর্বোচ্চ স্তরের অতিরিক্ত নির্বাহী আধিকারিককে কার্যত নির্বাহী আধিকারিকের সম্পূর্ণ দায়িত্বই সামলাতে হয় কারণ নির্বাহী আধিকারিক অর্থাৎ জেলাশাসকের ব্যাপক ব্যস্ততার মধ্যে জেলা পরিষদে সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করা সম্ভব হয় না। একারণেই অতিরিক্ত নির্বাহী আধিকারিক পদের প্রণয়ন। এই ভূমিকায়ও সম্পূর্ণ সফল অমিতাভ মৈত্র। শাসক ও বিরোধী দলগুলোর নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সরকারি আইন বুঝিয়ে জেলাকে উন্নয়নের পথে নিয়ে যেতে ওঁর কোনো অসুবিধাই হয়নি। আইন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, স্পষ্টবক্তা এবং ধৈর্যশীল আধিকারিক হওয়াতে ওঁর কাজ উনি নিজেই খুব সহজ করে নিয়েছিলেন।

সময়ের প্রভাবে আমরা দু-জনেই জেলা থেকে বদলি হয়ে রাজ্য সরকারের মহাকরণের বিভিন্ন দপ্তরে যোগদান করলাম, প্রথমে উপসচিব এবং পরে যুগ্মসচিবের পদে। যুগ্মসচিব থাকাকালীনই অমিতাভ মৈত্র সরকারি চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণ করে সাহিত্যের প্রতি সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করলেন খুবই আনন্দের সাথে। উনি প্রায়ই বলতেন সরকারি আধিকারিকের সাহিত্যচর্চা হচ্ছে বিগ ব্রাদারের নজরদারিতে নিজেকে প্রকাশিত করা। লেখার সময় সতর্ক থাকতে হয় যা লিখছি তা ন্যায্য কথা হলেও কোনো সরকারি নিয়মকে আঘাত করছে না তো! আসল প্রতিভার প্রতিভাস হয় আধিকারিকের সঙ্গে বাধানিষেধরাও অবসর গ্রহণ করলে।

অমিতাভ মৈত্র সময়ের আগেই চলে গেলেন, কিন্তু ছাপ রেখে গেলেন একজন দক্ষ প্রশাসক এবং একজন রুচিশীল সাহিত্যিকের। ভালো থাকুন অমিতাভ মৈত্র।

Categories
2023-sharodiyo-krorpatro amitava_smritikotha

কমলকুমার দত্ত

একটি বিস্ময়চিহ্ন

‘সেই আমিই জাহাজ, যার পায়ে কোথাও ছোট্ট আঘাত আছে/ নোঙর করা বারণ, তবু মাটি মাঝে মাঝেই ধরে ফেলে আমাকে/ তখন কর্পূর ছড়িয়ে এড়িয়ে যাই, আকাশে মুখ তুলে এড়িয়ে যাই/ নোঙর করা বারণ, কারণ পায়ে কোথাও ছোট্ট আঘাত আছে’

লেখার নাম ‘ আঘাত’। কোথাও ছোট্ট আঘাত আছে। এই আহত মানুষটার সঙ্গে কম করেও বাইশ-তেইশ বছর আগে পরিচয় হয়েছিল। তখন মনে হয়েছিল মানুষটা আহত। বাইশ-তেইশ বছর পরেও তা-ই মনে হয়।

প্রথম পরিচয়ের পর মাঝে মাঝে রাতে ফোন করতেন। তখন তিনি জীবিকাসূত্রে ঘাটালের এস-ডি-ও। বলতেন সেইসব দিনগুলির কথা যখন তাঁকে মৃত্যুপথযাত্রীদের জবানবন্দি নিতে হতো, মৃতদেহের কাটাছেঁড়ার সাক্ষ্য লিখে রাখতে হতো। আর বলতেন ভিনদেশি কবি, চিত্রকরদের কথা। শুনতে শুনতে মনে হতো মগ্নস্বরে যেন নিজেকেই শোনাচ্ছেন সেসব। আজ তাঁর লেখাগুলি যখন পড়ি তখন একই অনুভূতি হয়।

সামনাসামনি যখনই দেখা হয়েছে, মনে হতো মানুষটা লুকিয়ে পড়তে চাইছে। কথা বলছে, কিছু বলতে হয় তাই। ভদ্রতাবশত।

হ্যাঁ, আমাদের কাগজে, তাঁর সঙ্গে পরিচয়ের পর থেকে, প্রায় প্রতি সংখ্যায় লেখা চাইলেই দিয়েছেন— কবিতা চাইলে কবিতা, গদ্য চাইলে গদ্য। দেওয়ার সময় প্রতিবার বলতেন, কিছু হয়নি, দেখুন ছাপবেন কি না। তাঁকে নিয়ে সংখ্যা করবো শুনে অবাক হয়ে বলেছিলেন— আমাকে নিয়ে! না না, ওসব করবেন না। অনেক বুঝিয়ে রাজি তো করালাম, তারপর দেখি সহযোগিতা করছেন না। অনেক কষ্টে সংখ্যাটা করা গিয়েছিল। সংখ্যাটি বেরনোর পর কিছুতেই পাঁচটা কপি দিতে সফল হইনি, জোর করে কিনে নিয়েছিলেন। ব্যস, ওই পর্যন্তই, তারপর সংখ্যাটা নিয়ে একটি কথাও বলেননি, কোনো আগ্রহ প্রকাশ করেননি। না, ভুল বললাম, দু-তিনবার অপরাধীস্বরে জানতে চেয়েছিলেন যে বিক্রি থেকে খরচাটা উঠে এসেছে কি না।

আমি ব্যক্তিগতভাবে কবিতার আলোচনা করি না বা পড়ি না। কবিতার কোনো আলোচনা সম্ভব বলেই বিশ্বাস করি (কবিতার কোনো আলোচনা সম্ভব বলেই বিশ্বাস করি) না। তবে অন্য কবির কবিতা নিয়ে অমিতাভ মৈত্রের লেখা আগ্রহ নিয়ে পড়ি। তিনি কখনো কবিতার ‘আলোচনা’ করেননি, আমি তাঁকে সেইসব কবিতার মধ্যে মগ্নচৈতন্যস্বরূপ দেখতে পাই। অন্য কবির একটা পাঁচ-সাত পংক্তির কবিতা কীভাবে তাঁর নিজের অস্তিত্বের অংশ হয়ে উঠছে তা দেখে বার বার শিহরিত, বিস্মিত হয়েছি। তিনি লিখেছেন, ‘কবিতায় প্রতিটি শব্দ দাঁত চেপে থমথম করে তার পাশের শব্দটির ছিটকে যাওযার চরম সময়টির জন্য। যিনি শব্দের এই বুনো আক্রমণাত্মক মুখ দেখেছেন তিনিই কবি, শব্দের মেডিসিনম্যান।… যখন কবি লিখছেন, ‘কিছু শব্দের এই দ্বিতীয় জীবন তখন তিনি টের পান। কবির নিজের দ্বিতীয় জীবন নেই’। আরেক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেছেন, ‘কবিতার শব্দকে হতে হবে আ্যলজাইমার রোগীর মতো আত্ম-অর্থ-বিস্মৃত’।

বাংলা কবিতার জগতে অমিতাভ মৈত্র এসে পড়েছেন মূর্তিমান উপদ্রবের মতো। তাঁকে অস্বীকার করা যায় না, তকে স্বীকার করলে বাংলা কবিতাক বড়ো একটা অংশকে ছেড়ে আসতে হয় ।

আমি মনে করি তকে গ্রহণ করতে হলে পাঠককে অনেক পাঠসংস্কার ত্যাগ করে এগিয়ে আসতে হবে, কেন না এই কবি আমাদের কাছে অনেকটা আগে এসে পড়েছেন। বাংলা কবিতার ইতিহাস বহুকাল পরে পরে এমন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়।

Categories
2023-sharodiyo-krorpatro amitava_smritikotha

প্রশান্ত গুহমজুমদার

কিছু কথা, কিছু অন্বেষণ

কিছু কথা ছিল। কিছু কাজও। কাজটার কথাই আগে বলি। তোর সদ্য প্রকাশিত প্রবন্ধের বইটা নিতে হত। আর আমার নতুন কবিতার বই শিখা আর তোকে। আর কিছু নতুন লেখা শোনার। শোনানোর। আর তোর করা স্কেচগুলো দেখার। শিখাকে একবার বলতে হত, আমাদের ঘরে আরও একবার আসার। আর নাতনির ছবি-সব দেখার। ও কি আমাদের সেই ছোট্ট জবার মতোই মিষ্টি হয়েছে? আর আমাদের নিজস্ব কথা? সে-ও তো বিস্তর। হবে কখনও? তুই তো আমাকে ব্লক করে দিলি! তা-ও বলছিস হবে! তাহলে হোক।

প্রদীপ। অমিতাভ মৈত্র। আমি প্রশান্ত। ৬৫ বছর আগে যোগাযোগ। দু-জনেরই ৬। আজ আমার ৭১+। তুই আচমকা চলে না গেলে তোরও তাই হত। হল না। সময় হতে দিল না। বেঁচে থাকতে থাকতে, কথা বলতে বলতে, মুখোশ পড়তে পড়তে, অভিনয় করতে করতে অভ্যাস হয়ে যায়। হোমো স্যাপিয়েন্স-এর এমন হয়। আমারও হয়, হয়েছিল, হয়েছে। এই পৃথিবীতে থাকলে এমনটা আমার হতেই থাকবে। কিন্তু তোর সঙ্গেও কি তেমন আমার কখনও ঘটেছে? তবে কি আমরা, দু-জন যখন একলা, ঠিকঠাক মনিষ্যিই ছিলাম না! কিন্তু এখন কীভাবে এই ৬৫ বছর, আবাল্য বন্ধু হিসেবে, তোকে ফিরে দেখব! লেন্সের কায়দাটাই তো জানা নেই! তোর বদলে আমি গেলে, তোকেও হয়তো এমন লিখতে হত। কিন্তু এখন তোর কথা বলতে বসে আমার কথাই যদি বলে বসি! সে কি উচিত হবে? কোনো কালক্রমও হয়তো থাকবে না। যেমন, তুই আমার বাড়িতে আসার কিংবা তোর বাড়িতে আমার যাওয়ার। গেলেই মেসোমশাই বাইরের লাল ধাপিটায় বসে বসেই বলতেন, যাও, প্রদীপ উপরে আছে। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে, তুই তো ছিলি আমারই একটা অংশ। অথবা আমি তোর। তাহলে! খুবই সঙ্কটের বিষয়। তাই বাধ্য হয়েই সিদ্ধান্ত নিলাম, তোর মেধার কথা, কলমের কথা, তুলির কথা, একজন মনস্ক অতুল মেধাসম্পন্ন পাঠকের কথা আমি বলবই না। এসব বিষয়ে বহু বিদগ্ধ প্রাবন্ধিক, যোগ্য কবি, প্রতিষ্ঠিত শিল্পী রয়েছেন, তাঁরা বলবেন। সেটাই যথোচিত হবে, কিছু উজ্জ্বল কাজ হবে। এইসব বাদ দিয়ে কতটা কী বলতে পারব, জানি না। তবু, প্রদীপ আয়, দু-জনে মিলে যতটা পারি, পুরোনো দিনগুলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখি।

তোর মনে আছে স্কুল থেকে ফিরে আমাদের বাড়িতে লোহার জালের ওপারে দাঁড়িয়ে সেই হরিণ, চিনে মুরগী, রাজহাঁস দেখার কথা? মনে আছে, না! থাকবেই তো। স্মৃতিশক্তি তোর বরাবরই প্রখর।

আচ্ছা তোর মনে আছে দুপুরে তোদের ছাদে বসে তোর লেখা ইংরেজি কবিতা শোনানোর কথা আর ইতিউতি মেয়ে দেখা? দুটোই ছিল আমাদের কাছে প্রবল বিস্ময়কর। কৈশোর তো সবে পেরিয়েছি! সেই তখন একটা ইংরেজি প্যারাগ্রাফ ঠিকঠাক লিখতে পারি না, আর তুই কিনা সেই ভাষায় কবিতা লিখছিস! সেসব তো আর রাখিসনি, তাই না? কেন! পিছনের বিরাট পুকুরটার মতোই সে-লেখা সব কোথায় হারিয়ে গেল! যেমন হারিয়ে গিয়েছে ‘শীতের প্রতি’ কবিতাটা। আমার এই লেখাটার কথা তুই বারবার বলতিস। কেন, কে জানে!

মহালয়ার ভোরবেলা ভাগীরথীর পাড়ে সূর্য উঠছে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র থেমে গেছেন। মৃদু কুয়াশা ভেঙে ক্রমে ফর্সা হচ্ছে। আর আমরা দু-জন জল শুনছি, দেখছি। পিছনে কৃষ্ণনাথ কলেজ। আমাদের কলেজ। আমাদের সামান্য সামান্য দাড়ি-গোঁফ। কথা বলছি না কেউ। আমি বলছি না সেই চমৎকার নারীর কথা, তুইও সেই যুবতীর নয়। ঘোলা স্রোত দেখছিলাম কেবল। আরও কিছু কি?

আজ উল্টোপাল্টা কথা বলতে খুব ইচ্ছা করছে। ঐ রানিবাগানের মাঠ। ক্রিকেট। তোর ঐ লিকলিকে শরীর নিয়ে অনেকটা পাল্লা নিয়ে বাঁ-হাতে দুরন্ত ইন্সুইঙ্গার! কী করে করতিস রে! তবু করিমপুরে ঐ বল একবার মাঠের বাইরে পাঠিয়েছিলাম। পাওয়া যায়নি আর। ক্যাচ ধরতে গিয়ে দুই ফিল্ডারে ধাক্কা লেগে মাঠের বাইরে। আর আমাদের কী উদ্বেগ। ছেলেদুটো ভালো আছে তো!

ধোপঘাটির মাঠে সন্ধ্যা হচ্ছে। আমরা কয়েকজন। তুমুল মতান্তর। বাম-ডান-অতিবাম রাজনৈতিক কাজকম্ম নিয়ে। তুই কিন্তু চুপ। অনেক পরে একদিন বলেছিলি, এইসব পার্টির রাজনৈতিক কাজকম্ম তুই ঠিক বিশ্বাস করতে পারিস না। আমি হেসেছিলাম। খুব নির্বিবাদী মানুষ ছিলি তো। ঐসব খেয়োখেয়ি তোর অসহ্য মনে হত। একদিন রাত ফুরিয়ে আসছে। দেয়াললিখন শেষে ঘরে ফিরছি। তোর সঙ্গে দেখা। এত ভোরে তুই উঠতিস না। সেদিন তবু দেখা হল। বলেছিলি, বাড়ি যা। মাসিমা ভাবছেন হয়তো। আর কোনোদিন এমন যেন না দেখি। আমি ফিরে এসেছিলাম। আর কোনোদিন রাত জাগা হয়নি আমার। তোর মুখটা মনে পড়ে যেত।

সেদিন হঠাৎ সুশীলদার একটা চিঠি পেলাম। একজনের হাত দিয়ে। তারপর উনি কলকাতা না কোথায় যেন চলে গেছেন। বেশ কয়েক পাতার। ছোটো ছোটো হাতের লেখায় অনেক কথা। আমাকে খুব গালিয়েছেন। কয়েকটি কবিতা। কোনো পত্রিকায় প্রকাশ করতে হবে। পড়তে খুব অসুবিধে হচ্ছিল। হঠাৎ দেখলাম, সেই ক্ষুদে ক্ষুদে লেখা-সব ঝকঝকে প্রিন্ট করা একটা চিঠি হয়ে গ্যাছে। বিদেশী কিছু কবিদের কথা আছে। পড়তে পড়তেই আমরা হাঁটছিলাম। সুশীলদার বাড়ি। উনি যাননি কোথাও। ওখানেই রাত্রে আমাদের দাওয়াত। তুই বলছিলি, নিজের লেখা নিয়ে সুশীলদা নিজেই খুব কনফিউজড্‌। আমি মাথা নেড়েছিলাম। যেমন মাথার উপরে একটা ছাদ নিয়ে ওঁর। আজীবন।

ছাড়িয়ে চলে এলাম। কবিতা আর ছবি নিয়ে তুই বলছিলি। সুনীল দাশ বলছিলি। কিন্তু এত গাড়ির শব্দ, কথা প্রায় শোনাই যাচ্ছিল না। প্রস্তাব দিলি, চল উড়ে যাই। আমরা উড়তে থাকলাম। কবরখানা পেরিয়ে, পঞ্চাননতলা পেরিয়ে উড়ে যাচ্ছিলাম। তুই তখন দালি আর বিনয় মজুমদারের কাজ নিয়ে বলছিলি। আমি ধর্মনারায়ণ দাশগুপ্ত আর রমেন্দ্র কুমার আচার্য চৌধুরী। চাঁদ আকাশে ফেটে পড়ছিল। তোর উত্তেজিত চোখ আর তীক্ষ্ণ নাক স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। ম্যাডাম এম্‌-কে নিয়ে লেখা মুখে মুখে বলে যাচ্ছিলি তুই। তখনও সেসব প্রকাশিত নয়। কিন্তু অসাধারণ স্মৃতিশক্তি তোর। পাংচুয়েশন অবধি ঠিকঠাক। শরতের বাতাস আর অলৌকিক আলো তোকে ঘিরে আছে। আমরা কোথাও একটা সম্‌-এ নেমে আসছি। এবার তোর দালিকে নিয়ে মুগ্ধতা। শূন্যেই তুই একটা অভিজাত সিঁড়ি আর দালির বিশাল গোঁফজোড়া এঁকে ফেললি।

পাহাড়ে বেড়াতে গিয়েছি। তুই আর আমি। প্রায় এক শুঁড়িপথ দিয়ে হাঁটছি। মাথার উপরে টুপটাপ আর কী যেন, কী যেন! যেন এই পৃথিবীর কেউ নই আমরা আর। রবার্ট ফ্রস্টের কবিতা গুনগুন। কতটা পথ, জানা নেই। এক চন্দনকাঠের বোতামের অন্বেষণ কেবল। তবু সে-পথের মাঝে বিষণ্ণ একা বাইসন! আমাদের ঘোড়া নেই। কী ভীষণ ভাবাবরোহ! তুই পিছোচ্ছিস। আমিও। শেষ অবধি অন্ধকার। শেষ অবধি মৃত পাতার ভিতর থেকে তোকে। একরাশ বিরক্তি নিয়ে বাইসন অন্য পথে। আমরা আরও এক বনের ভিতর। অর্কিড গাছে গাছে, অপেক্ষায়। গাভীর মতো না, গুরুতর মেঘ নেমে আসছে। স্বভাবেই অন্ধকার। সেই বোধ করি আমাদের প্রথম লৌকিক যাপন থেকে সরে যাওয়া। সত্তর কি এসেছে তখন!

প্রায় ভাঙাচোরা এক বাড়ির দোতলা। চিলেকোঠায় বসন্ত পূর্ণিমা এসেছে। সে সত্তরের মাঝামাঝি সময়। কাশিমবাজারের ঘরে ঘরে তখনও খুব শীত। আমাদের কিন্তু না। এক অষ্টাদশী যে তার সমস্ত সম্ভার নিয়ে গাইছে, আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে…! পাথরের মতো বসে আছি আমরা। কে আসবে! তাকে পরিচ্ছন্ন হতে হবে, প্রস্তুত হতে হবে! সে কি তোর জন্য, নাকি আমার! প্রবল এক টানাপোড়েন আর ঘোর নিয়ে ফিরেছিলাম আমরা। চাঁদ হেসে হেসে গড়িয়ে গড়িয়ে আমাদের প্রায়-কিশোর মাথা-বুক-পিঠ।

আমরা একটা যৌথ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেছি। ‘প্রদীপের আলোয় প্রশান্ত’। পেপারব্যাক। ‘পান্ডুলিপি’ প্রকাশক। যেদিক দিয়ে খুশি, পড়া যায়। লেটার প্রেসে, তবু এতটুকু ভুল নেই! সে উত্তেজনা বোঝানো আমার কম্ম নয়।

বিসর্জনের রাত্রে বসে আছি ভাগীরথীর ধারে। বালি আর বাবলাবন। তখনও গঙ্গায় বালি। একটা, তারপর আরও একটা, ভেসে আসছে লাল-নীল প্রদীপ। কোন্‌ দক্ষিণ দুয়ার থেকে তারা আসছে! এরপর অজস্র। এরপর প্রতিমা। নৌকায়, নৌকায়। আমরা দেখছি লোকাচার, দেখছি প্রতিমার বিষণ্ণ মুখ, অশেষ বিশ্বাস, উৎসব আর ঢাকের বোল ‘আসছে বছর আবার হবে’।

এই-ই সব কিছু ছিল ষাট-সত্তরের আকাশে। সত্যিই ছিল! মাটিতে তো কেবল শোষণের, অপমানের নানান কায়দা ছলচাতুরি, চিরকুটে দুটো ভাতের সংস্থানের আশ্বাস, ঘৃণা, প্রতিবাদের মুখ আর দহনের গন্ধ, নির্বিশেষ রক্ত। আর লালদিঘি পেরিয়ে, স্কোয়ার ফিল্ড পাশে রেখে আমরা তখন চলে যেতে চাইছি সমান্তরাল দুটো রেলের দিকে, যেটা কোনো বাফারে গিয়ে শেষ হচ্ছে না। কোনো সীমান্ত চোখ পাকিয়ে থাকছে না। যেহেতু আমরাও ‘বাঁচতে চাই’।

মনে আছে তোর? কী করেই-বা থাকবে! এমন তো কিছু ঘটেইনি। কেবল এরকম ইচ্ছে করতাম আমরা। শহর, পারিপার্শ্বিক বেঁচে থাকা যখন আমাদের খুব ক্লান্ত করে দিত, আমাদের তখন এমন। পরে অবশ্য বিনয় মজুমদার নিয়ে চমৎকার কিছু শব্দ লিখেছিলি। আমি ভেবেছিলাম, ওরে ব্বাবা, এভাবেও তবে কবিতাকে ভাবা যায়।

তোকে এত বিশ্বাস করতাম কেন, বল তো! তোর মতামত আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। প্রায় গাইডের। তুইও এটা বুঝতিস। বল, বুঝতিস না? আমার কথাও তুই শুনতিস। অরূপের সঙ্গে দিগন্ত, মিনি পত্রিকা রক্তপত্র। তুই সঙ্গে ছিলি। ইতিমধ্যে উৎপলদা ‘সময়’-এর আড্ডায় ডাকলেন। সেখানে তখন বহরমপুরের নক্ষত্র সমাবেশ। দিব্যেশদা (তোদের কী-রকম আত্মীয় হতেন), সুশীতদা, অরুণ ব্যানার্জি, মনীষী মোহন রায়, সুশীলদা, গোকুলেশ্বর ঘোষ, আরও অনেকে। কবিতা পড়া হচ্ছে, আলোচনা, মতামত, সে এক হইচই ব্যাপার। কত বাহবা! আমরা তখন কলেজ পেরিয়েছি। কত হবে! ১৯-২০। তুই কিন্তু সে-সময়েই কবিতাটা চমৎকার পড়তিস। গম্ভীর গলায়, ডান-হাতে কবিতার পাতা ধরে, বাঁ-হাতটা উঠিয়ে নামিয়ে।

বি টি পড়তে ভর্তি হলাম। তুই না। তুই কি সে-সময়ে টিউশনি করেছিলি! আমি করতাম। কারণ সে-সময়ে অভ্যন্তরীণ কলহে এবং আরও বহু হেতুতে আমাদের সবকিছু হয়ে গ্যাছে এইটুকু। গত্যন্তর ছিল না। বলেছিলি, অমুক পত্রিকায় কবিতা পাঠা। পাঠিয়েছি। বলেছিলি, ওই মেয়েটার কাছে আর যাবি না। যাইনি। বলেছিলাম, চল পম্পুর সঙ্গে চৌপর করি। সামান্য দ্বিধা ছিল, তবু এসেছিলি। বলেছিলি, বাবা রিটায়ার করবে। একটা হিল্লে হওয়া দরকার। সুতরাং নানান জায়গায় দরখাস্ত। সে-সময়েই চাকরির জন্য প্রিপারেশনের কথা বলেছিলাম। তুই শুনেছিলি। একসঙ্গে অঙ্ক শেখা, জেনারেল নলেজ, সংবিধান– কত কিছু। একদিন চাকরির পরীক্ষার এডমিট কার্ড। পেয়ে একসঙ্গেই পরীক্ষা দিয়েছিলাম। তাই তো দু-জনেই একসঙ্গে চাকরিতে। বলেছিলি, ইতি খুব ভালো মেয়ে। ওকে কখনও ঠকাস না। তারপর ৪৯ বছর তো হয়ে গেল। ইতির জন্যেই তো এখনও। আমার কথাও তুই শুনেছিলি। নানান বাধাবিপত্তি, সামাজিক টানাপোড়েন, শিখা আমাদের ঘরে এসে দুঃখ করত। তুইও। বলেছিলাম, শিখা তোকে ভালবাসে। তুই খুশি হয়েছিলি। শেষ অবধি ‘দুইটি হৃদয়ে একটি আসন’ ইত্যাদি।

তারপর তুই ক্রমশঃ অমিতাভ মৈত্র। নানান জায়গায়, নানান ভাবে। এই যে সিঁড়ি-সব, নিশ্চয়ই তুই ভুলে যাসনি। তাই বোধহয়, একদিন বলেছিলি, ‘এই ধুলো পায়ে ঘুরে বেড়ানোর দাগ তেমন কাজে আসে না হয়তো। হাওয়ায় মিলিয়ে যায়, জলে মুছে যায়। তবু এই ঘুরে বেড়ানোর ভেতর দিয়েই কোথাও অনুভূতির এক গূঢ় পৃথিবী আস্তে আস্তে খুলে যেতে থাকে।’ তুই আত্মার আশ্রয় খুঁজেছিলি। তাই এক ‘নির্জনতম নিবিড়তম আনন্দ’-এর খোঁজ আমি পেয়ে যাই তোর থুড়ি অমিতাভ মৈত্র রচিত বহু কবিতা আর মুক্তগদ্যে। একইসাথে দেখি, ‘মানুষ সরে এসেছে আলো অন্ধকারময় সেই মায়া পৃথিবী থেকে’, ‘অনেক ভেতর পর্যন্ত ধ্বংস হয়ে যাওয়া মানুষ যোগাযোগের ভাষা হারিয়ে, অস্তিত্বের নিঃস্বতার ধারণাটুকু নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ছে।’

এই কথা, এই প্রায় অপার্থিব স্মৃতিকথন সম্ভবত অধিকাংশই বাহুল্য বিবেচিত হওয়ার যোগ্য। তথাপি স্পর্ধা করছি বলতে যে, তোর, আমার প্রদীপের, আমাদের অমিতাভ মৈত্রের অদ্যাবধি সৃষ্টিতে একদিন পাঠকের হৃদয় জেগে উঠবে; ভালোবাসায়, শ্লাঘায় একাত্ম হবেই।

আপাতত ভালো থাকিস। এখন তো আর শ্বাসকষ্টটা নেই? এখন আমার হচ্ছে। হবে, যতদিন না আবার…

Categories
2023-sharodiyo-krorpatro amitava_smritikotha

উমাপদ কর

নির্বাণের কাছাকাছি অমিতাভ

“জলকে অনুরোধ করেছে তাকে ভুলে যাওয়ার জন্য”— অমিতাভ মৈত্র

“পরস্পরকে হত্যা করে হেমন্তের মৌমাছিরা যা বলতে চায়
বরফের অভিশাপ সারাজীবন মাথায় নিয়ে
কোনও পাহাড় যা বলে
মুখভর্তি নকল দাঁত নিয়ে
চোখ নামিয়ে সেটাই আজ বলছে হেনরি—” (‘কৃত্রিম হেনরি’/ অংশ)

অমিতাভ মৈত্র (দ্বিতীয় এবং অদ্বিতীয়। যে-কেউ উপরোক্ত পংক্তিগুলি পড়ে বলে দেবেন। হ্যাঁ, এসব প্যারাডাইম শিফট করার পর উদ্ভাবন করা তাঁর এক নয়া ডিকশন, অমিতাভীয়। আলাদা করতে পারি না, হেনরি, অমিতাভ, বিস্মিত আমি আর এক্স-ওয়াই-জেডকে।

যন্ত্রণার চামড়া উঠিয়ে নিলে ত্বকের নীচে ঘুম ভেঙে যায়। ধূসর-সাদা। আরেকটু নীচে লোহিত কণিকার চলাচলের আভাস। বেদনাকে অপারেশন টেবিলে সার্জিক্যাল ছুরিতে চিরে দিলে খোলামুখ দু-ভাগ হয়ে সাদা ধবধবে। ভেতরের দেয়ালে বিন্দু বিন্দু ভেজা রক্তকণিকা। ভালোবাসায় ফোলানো ব্লাডারে কুঠার মারা হচ্ছে রোমশ হাতে। অথবা আঙুলডগা ব্লাডারটা ঘোরাচ্ছে ধীরে, পৃথিবী ঘোরানোর মতো। বার বার ব্যর্থ কুঠার একবার নিশ্চিত ব্লাডারটা দেবে ফাটিয়ে। আঙুলের নখ ঘূর্ণনে-ঘর্ষণে ফুটো করে দেবে। জেনে এসেছি, ভালোবাসা অপার, মৃত্যুহীন। কিন্তু এ-যে শেষবাতাস ছেড়ে নিঃসহায়। তাহলে ভালোবাসা কি…

এখান থেকেই এক বিপন্নতার শুরু আমার মধ্যে। মানে, আমি উমা, আমি অমিতাভ, আমি হেনরি বা আমি এক্স-ওয়াই-জেড। বিস্ময়ের সঙ্গে রহস্যকে নেড়েচেড়ে বিপন্ন বোধ করি। কোনোকিছুই গোটা নয়, ভাঙা-ভাঙা আর অগোছালো। আবার ক্যায়টিকও নয়। বিন্যাস আর অবিন্যাসের মধ্যে বিপন্নতা দুলতে দুলতে বিপন্নতর হয়ে ওঠে। বস্তুজগতের অভীপ্সাগুলোকে বাজিয়ে বিপন্ন বোধ করি। বিপরীতে এক কল্পপৃথিবী আছে আমাদের। হেনরি, অমিতাভ, এক্স-ওয়াই-জেডসহ আমার।

কল্পের সঙ্গে চলমানকে মেলাতে গিয়ে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হলে বিষণ্ণতা গ্রাস করত। আবার সবটা একদম মিলে গেলে উল্লসিত-জয়ী-তৃপ্ত আমরা হারিয়ে ফেলতাম বাহ্যজ্ঞান। তা হয় না। আশ্চর্যভাবে কিছুটা মেলে, আধো, আংশিক। স্পষ্ট, কাছে, ছোঁয়া যায়। আবার কোথায় উধাও। ধরা-অধরার মধ্যে পেন্ডুলাম আমরা। অভিসারী রশ্মিগুচ্ছ একবিন্দুতে মিলিত হওয়ার আগেই বিপন্নতার চূড়ান্তে নিয়ে অপসারী হয়ে যায়। হেনরি অমিতাভকে বলে— ‘দেখলে, দেখলে কাণ্ডখানা’? অমিতাভ এক্স-ওয়াই-জেডকে হেনরি বানায়। আমি, হেনরি ও অমিতাভ একই বিভবপ্রভেদের বৃত্তের মধ্যে বিপন্ন উজ্জ্বলতায় জ্বলতে থাকি।

আমার অস্তিত্বর ওপর আমারই চেতনার আলো ফেলে দেখি তার প্রতিফলিত ক্যারিশমা। অনস্তিত্ব সে কখনোই প্রতিষ্ঠা করেনি। কিন্তু আমি কি আছি? মানে আমি, অমিতাভ, হেনরি, এক্স-ওয়াই-জেড। পূর্ণতার বাসনায় অপূর্ণতা ঘুম হয়ে নামে। আমাদের কামনা রাগবি খেলতে নেমে, খেলে সাদামাঠা ফুটবল। আমাদের রাগ-দ্রোহ-দ্বেষ-অভিমান ঝংকার তুলতে গিয়েও বাজিয়ে ফেলে আলাপ।

দৃশ্যাতিদৃশ্যের সঙ্গে সবসময় কোনো সম্পৃক্ততা অনুভব করি না। সমমেলে বেজেও উঠি কোনো ফ্রেগ্র্যান্স অফ কালার-এ। অতলান্ত স্পর্শে। মজে যাই রসের ভিয়েনে। আবার হাসতে হাসতে আমারই সামনে গড়ে ওঠা কোনো মঞ্জিল ভেঙে পড়তে দিই। এ শুধুই আমি। আমি আছি বলেই নিত্যতার এই সূত্র, এই মহিমা। কিন্তু আমি না-থাকলেও এসবই থাকবে। এই গড়া-ভাঙা, এই হাসি হাসি মুখ অন্য কোনো আমি, সদ্গুণসমৃদ্ধ হেনরি, সাদাহাসি অন্য অমিতাভ, অজস্র এক্স-ওয়াই-জেড। আমি না থাকলেই সব অনিত্য নয় তাহলে? বিপন্নতা এ-সময়েই এক কাপ চা নিয়ে আমার মধ্যে বসে। হেনরি হাসে।

আমার মধ্যে সবসময়ই একটা ভয় কাজ করে। কীসের জন্য ভয়, নির্দিষ্ট নয়। কেন ভয়, নেই তার হদিশ। বিপন্নতার মধ্যে সারভাইভ্যালের একটা কৌশল আবিষ্কারে মগ্ন হই। সহ্যের সীমাভাঙা অন্ধকার! অলস মন্থর অন্ধকারকে আমি ভয়ই পাই। খুঁজি, আলো, অনেক আলো, যা আমার ভয়কে আশ্বস্ত করবে। আমি হেনরি হয়ে যাই, বা হেনরি ঢুকে পড়ে আমার মধ্যে।

অনন্তের মধ্যে খণ্ড হয়ে বাঁচি। ভালো-মন্দ সার-অসার তত্ত্বজ্ঞান সব বুঝি না। সাধারণ দ্যাখা। স্পষ্ট গতিশীল কোনো উচ্চারণ নেই। তবু চোখে ভেসে ওঠে সেই পাহাড় যে ‘সারাজীবন মাথায় বরফ নিয়ে’ অনন্তের মধ্যে ঠায় দাঁড়িয়ে। অভিশাপ না নিয়তি? দেখি, বিশালের বিপরীতে ক্ষুদ্র এক দেয়ালে অনন্তকাল তাকিয়ে থাকা ততোধিক ক্ষুদ্র এক টিকটিকি। সে কি ফসিল হয়ে যাবে? নষ্ট হয়ে যাবে? আমাকে বলতে হয়, অভিশাপ অভিশাপ। বলতেই হয়, নষ্ট হয়ে যায়, নষ্ট নষ্ট। কিন্তু স্বাভাবিক প্রকৃত আমি পারি না। বলার আগে নকল দাঁত লাগিয়ে নিই মুখভর্তি। নিজের বিপন্নতা অপনোদনের জন্যই কি এই ছলনায় মেতে উঠি? জানি না, হেনরি জানে না, আমি নিশ্চিত অমিতাভও জানে না।
এসবই অতীতের বর্তমানের এবং ভবিষ্যতেরও। ছিলাম আছি থাকব। হেনরি ছিল আছে থাকবে। অমিতাভরাও। আমার চারপাশের অস্তিত্ব, ঘটার সম্ভাবনায় থাকা বহুবিধ ওয়েটিং লিস্ট, খোঁজা-দ্যাখা-অনুভব করা আর মিথস্ক্রিয়ায় ভরিয়ে তোলা চলতেই থাকবে। আমি, হেনরি বা অমিতাভরা ভাষ্য দিতে থাকব এসবের। তবে তা আনুপূর্বিক নয়। টানা নয়। মৌহূর্তিক। খণ্ড খণ্ড। কোলাজ কোলাজ। মহাকাব্যের অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের কাছে সঞ্জয় উবাচ রণক্ষেত্রের ভাষ্য নয়। ওল্ড কিংবা নিউ টেস্টামেন্টের Complete Commentary নয়। এ জাগতিক পরিসরের কাব্যভাষ্য। ভাঙা, অনুবাদ-অযোগ্য, অপূর্ণ, আর জ্ঞান-তত্ত্বহীন। অমিতাভদের চেষ্টা এ-কারণে, যেন এতে বিপন্নতাবোধ লাঘব হয়। হেনরিকে আমি দেখেছি একই অধ্যবসায়ে। অমিতাভ হেনরির প্রতিচ্ছবি। এক্স-ওয়াই-জেডসম আমি, হেনরি, অমিতাভ কখন যেন একাত্ম ও এক আত্মা হয়ে যাই। আমেন, আমেন।

সমান্তরাল অমিতাভ

দ্বিতীয় অমিতাভর জীবনপ্রণালী প্রাগুক্ত অবস্থানের সমান্তরালে হাঁটে আমার দ্যাখা-শোনা-বোঝা ও অনুভবে—
ক) ভিড়ভাট্টায়, গতিময় যানবাহনে, কানে তালা লেগে যাওয়া শব্দে, অমিতাভদা রাস্তা পেরোতে ভয় পেত। হেজিটেট করত। অনেকসময় তাঁকে হাত ধরে রাস্তা পার করে দিয়েছি।
খ) যে-কোনো মঞ্চে উঠতে ইতস্তত করত। একটা সংকোচ। একটা ভয়জড়ানো অস্বস্তি। কাটিয়ে উঠলেই মাইকের সামনে ছোট্ট করে হলেও বলত ভালো। অন্তত চার-পাঁচবার আমার এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে। একই মঞ্চে হলে, অমিতাভদার নাম আগে উচ্চারিত হলেও বলে বসত— ‘এই উমাপদ, তুমি আগে চলো না!’
গ) আড্ডা থেকে একটা পালাই-পালাই ভাব তৈরি হয়েছিল। ফোনাফুনি করে একত্রিত হওয়ার চেষ্টায়, হয়তো এল, কিন্তু অনেক দেরিতে, সামান্য কিছু কথাবার্তার পরই, কিছু একটা দোহাই দিয়ে, পালিয়ে যেত। আমরা বুঝতে পারতাম। একমাত্র ব্যতিক্রম দেখেছি, ২০১৬-র অক্টোবরে আমার বাড়িতে অ্যারেঞ্জ করা দু-দিনের আড্ডায়। ফুরোতেই চায় না। অকপট অমিতাভ।
ঘ) বাড়িতে গিয়ে কথাবার্তার সময় খুব ছটফট করত, আর পরে হয়তো নিয়ে বেরিয়েই পড়ত সেটেলমেন্ট অফিসের সামনের চায়ের দোকানে।
ঙ) চোখের ছানিকাটা অপারেশনের কিছুদিন পরে কথায় কথায় বলেছিল— ‘আমার মনে হয়, সবারই একবার চোখের অপারেশন করানো ভালো। কী আলো, কত উজ্জ্বল, কী উদ্ভাস। প্রাণভরে একবার পৃথিবীটা দেখে নেওয়া যেতে পারে’।
চ) রাগতে দেখিনি সচরাচর। বরং গাম্ভীর্য চিরে বের করা হাসি, কিঞ্চিৎ শব্দসহ। সেই অমিতাভদাই একদিন রাতে ফোনে (আমি কলকাতায়) বেজায় ক্ষিপ্ত। ‘ভেবেছেটা কী? আমি নপুংসক! চিল্লাতে পারি না! আমার চুপচাপ থাকাকে দুর্বলতা ভাবলে ভুল করবে। জিন্দেগিতে আর এই ইতরটার ফোন ধরব না’। ইত্যাদি। কথায় কথায় জেনে নিলাম ব্যাপারটা। বহরমপুরের তথাকথিত এক তরুণ কবি, ফোনে নানারকম গালিগালাজ করেছে। বলেছে ‘ন্যাকা’।
ছ) পত্র-পত্রিকায় কোথাও কিছু (গদ্য বা কবিতা) পড়লে ফোন করে প্রশংসা করত। প্রশংসা করতে জানত মানুষটা। কিন্তু একটা ব্যাপার খেয়াল করে দেখেছি, ফেসবুকে যেন কিছু-মিছু সাধারণ লেখাকেও একটু বেশিই প্রশংসা করে ফেলত। কারণ জিজ্ঞাসা করা হয়নি কখনও।
জ) একটা ইচ্ছা মনে মনে পোষণ করত। রেজারেকশন অফ অমিতাভ মৈত্র-র পরেও। তাঁরই মুখে— ‘এখনও যা লিখছি, সেটাও আমি জানি। যেটা লিখতে চাই, সেটা ঠিকঠাক হচ্ছে না। কিন্তু এখান থেকে এখনও আমি বেরোতে পারব না। চাইছিও না। আমার আরও বছর চারেক লাগবে। তারপর আমি শেষবারের মতো একটা চেষ্টা করব। যদি কিছু করা যায়… যদি না-ই হয়, তবে সেটাও হবে গিয়ে আরেকবার Story of failure।’ (আড্ডা— ২০১৬)। জানি না এই প্রয়াস অমিতাভদা নিয়েছিল কিনা! প্রকাশিত কবিতায় আমি সেই ডিপার্চার দেখিনি। সবকিছু এত সময় মেপে হয় না যে, ডাক চলে এলে তো আরওই না।

অমিতাভর নির্বাণ-খোঁজ

দ্বিতীয় অমিতাভ যখন বলেছি, তাহলে প্রথম অমিতাভ একজন ছিল নিশ্চয়ই। ছিল তো বটেই। তাঁর সঙ্গেই আমার প্রথম আলাপ-পরিচয়-আড্ডা-ভালোবাসা-হৃদ্যতা। ১৯৭২। কলেজপড়ুয়া আমি ও জমিল সৈয়দ কবিতাপত্রিকা ‘শ্রাবস্তী’-তে মাতলাম। আমি স্রেফ হুজুগে। জমিলই সব, আমি সঙ্গে থাকি। কবিতাসংগ্রহের কাজে অমিতাভদার রানিবাগানের বাড়ি (তখন বেশ ছোটো বাড়ি, হলুদ রং)। ছোটোখাটো পাতলা-সাতলা হাসিমুখ অমিতাভদা। তারপর বাড়ির সেই ঘরে মাঝেমধ্যেই নানারকম কবিতালোচনা আর আড্ডা, এমনকি প্রেমিকার চিঠিপাঠও, অনেক দিন, চাকরি নিয়ে বহরমপুর ছাড়া পর্যন্ত। একটা হৃদ্যতা বুঝতে পারতাম। পরে হঠাৎই বহরমপুরে কখনও-সখনও দ্যাখা হওয়া, কিছু কথাবার্তা। ৭৯-তে আমিও বাড়ির বাইরে। যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন।

এই অমিতাভও কবিতা লিখত। প্রকাশ করত। প্রশান্তদা (গুহমজুমদার) আর সে ছিল হরিহর আত্মা। বলতাম— ‘মানিকজোড়’। ৮৪-৮৫ নাগাদ একটা কবিতার পত্রিকা ‘পাণ্ডুলিপি’ যৌথভাবে শুরু করেছিল। মাত্র তিনটে সংখ্যা। আমার কবিতা চেয়ে নিয়েছিল, অমিতাভদাই। “তারপর চাকরির দৌলতে সব ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যাওয়া। ও পর্ব শেষ। লেখাটেখাও প্রায় বন্ধ। একদম Out of touch যাকে বলে। আমি তো ছিয়াশির পর থেকে লিখিইনি প্রায়। টুকটাক, সামান্য… বলার মতো কিছু নয়।” (আড্ডা— ২০১৬)

৮৬-র আগে কবিতা লেখালিখির একটা নমুনা—
“পানপাত্র ভেঙে যায়, সাথে ভাঙে সমূহ আড়াল
জল কি গড়িয়ে যায় তার মৃদু উষ্ণতা নিয়ে
সমর্পিত হতে কারো কাছে? যে রয়েছে দূরে কুয়াশায়
আজ তার মুখে আমি গোধূলির রহস্যকে লগ্ন হতে দেখি
যেন সে পাথর কোন, জল যার শ্বেত পরিত্রাণ—
পানপাত্র ভেঙে যায়, সাথে ভাঙে রাত্রির আড়াল
জল কি গড়িয়ে যায় তার মায়া বিষণ্ণতা নিয়ে
সমর্পিত হতে কারো কাছে?” (ভেঙে যায়/ ‘রৌরব’-এ প্রকাশিত)

প্যারাডাইম শিফটের কথা বলেছিলাম। একবার মিলিয়ে নিতে পারেন হে উৎসুক!

সমান্তরাল অমিতাভ

এই পর্বে (পরিচয় থেকে আটের দশকের প্রায় শেষ পর্যন্ত) আমার দ্যাখাশোনা অমিতাভদা—
ক) চায়ের দোকানে, রবীন্দ্রসদনে, বাড়িতে আড্ডা মারত, পরনিন্দা-পরচর্চা ছাড়া।
খ) আমার মতো নবীন কবিতাকারের কবিতা মুখস্থ বলে দিতে পারত।
গ) গল্পের মধ্যে মজা ও উইট ছড়িয়ে দিয়ে, নিজেও হেসে উঠত। প্রাণবন্ত।
ঘ) যত্রতত্র লেখা প্রকাশে দ্বিধা ছিল, নিজেকে নিয়ে সবসময়ই একটা সংশয় পোষণ করত।
ঙ) চাকরিতে মনোনিবেশ আর সেখান থেকেও লেখার রসদ আত্মস্থ করা।

ট্রানজিশন

যে-কোনো অপরিমেয় বাঁকে একটা ট্রানজিশন থাকে। অমিতাভদারও ছিল।
“শাক্যসিংহ বিষয়ক আমাদের গল্পের ভিতরে
ভেসে ওঠে ফাঁপা, গোল চাঁদ— আর
আমাদের ছোট বোন গলা মোচড়ানো শাদা হাঁস
কাপড়ে আড়াল করে প্রধান ফটক ধরে
ভোরবেলা বাড়ী ফিরে আসে।
ক্ষুধাকে সে বোধিজ্ঞান করে না এখন” (ক্ষুধা/ ‘রৌরব’ বারোবছর, জানুয়ারি-৮৮)

এর পরপরই ‘টোটেমভোজ’ সিরিজ। দ্বিতীয় এবং অদ্বিতীয় অমিতাভ। তাঁর মুখ থেকে— “আমি আবার যখন শুরু করব বলে ঠিক করলাম, তখন নিজেই ঠিক করলাম, এবার নিজের কবিতাটা লিখব।… এতদিন তো নিজের কবিতা লিখিনি। লিখেছি প্রেজেন্টেবল কবিতা, লোকে পড়েই ভালো বলবে, বেশ বেশ করবে। এটা ভুল ছিল, ভাবনায় মারাত্মক ভুল।… এবার ভেতরে ঢোকার কবিতা লিখব, আত্মস্থ করার কবিতা। ধ্যানের মতো জায়গা থেকে লেখা। মনে একটা ক্ষোভ… একটা যাকে বলে বিবমিষাও তৈরি হল। বুঝলাম, নিজের লেখা ভাঙা দরকার। তো সেখান থেকে নিজের কবিতার একদম পুরোনো ছাঁচ ভেঙে বেরিয়ে আসতে ইচ্ছে হল। দেখাও হল এরই মধ্যে নানারকম, সামাজিক টানাপোড়েন, মানুষজন, চাকরির সুবাদে মরতে যাওয়া মানুষের, পোড়া মানুষের জবানবন্দী নিতে হত, ভয়ংকর, সব মিলিয়ে একটা নিজেকে মোটিভেট করা।… ভাবলাম, কিছুই তো পারি না, তাহলে নিজেকে একটু ভ্যাঙাই, নিজেকে নিয়ে একটু মজা করি। ‘টোটেমভোজ’, ‘ষাঁড় ও সূর্যাস্ত’ এসব থেকেই…” (আড্ডা ২০১৬)।

অফুরান স্মৃতি

বহরমপুর গেলে ভোরের দিকে হাঁটতে ভালো লাগে আমার। ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে এক ভোরে এমনই হাঁটতে হাঁটতে, রানিবাগানের এক গলিতে। বাকিটা ফেসবুকে পোস্ট করা লেখা থেকে (২১/১১/২০২০) টুকরো টুকরো তুলে ধরি।

“তখনই চোখে ভেসে উঠল একটা রঙিন দো-তলা বাড়ির কোলাপসিবল গেটের পেছনে কাঠের বড়ো দরজার গায়ে যেন স্বর্ণাক্ষরে লেখা, ‘অমিতাভ মৈত্র’, নীচে, ‘শিখা মৈত্র’। পেয়ে গেছি। ভুলিনি। ঠিক চলে এসেছি। এই বাড়িতে সবমিলিয়ে কতবার-যে এসেছি, আজ তা আর গুণে বার করতে পারব না। কিন্তু আমার প্রথম দ্যাখা বাড়িটা এখন আমূল বদলে গেছে, স্বাভাবিক নিয়মেই। বছর কয়েক আগেও যখন এসেছিলাম, তখনও এতটা বদল দেখিনি।…“

১৯৯৬-এ বহরমপুর ফিরে যখন আবার নয়া উদ্যোগে ‘রৌরব’ করার প্ল্যান হচ্ছে, তখন একদিন অমিতাভদাকে ধরলাম রবীন্দ্রসদনে, রৌরবে কবিতা-বিষয়ক গদ্য লিখতে। প্রথমে না-না করলেও, আমার আর সমীরণের (ঘোষ) পীড়াপীড়িতে লিখল। পরপর কয়েকটা সংখ্যায় গদ্য। কবিতা ও মিউজিক, কবিতা ও স্বপ্ন আরও দু-একটা! এই অমিতাভদা একদম আলাদা অমিতাভদা। অসাধারণ গদ্য। সেসময়ও অমিতাভদার বাড়ি বেশ কয়েকবার গেছি।… “সুশীলদার স্মরণসভায় না থাকতে পারলেও, ‘স্মরণ’-এ লেখাতে পেরেছিলাম। সুশীলদার মৃত্যুর পর একবার দ্যাখা হলো সুশীলদার বাড়িতে। গিয়েছিলাম, অতনুদের (বন্দ্যোপাধ্যায়) এখন বাংলা কবিতা কাগজের ক্রোড়পত্র বৌদির হাতে তুলে দিতে। সেদিন স্ক্যয়ারফিল্ডে বসে জমাটি আড্ডা হয়েছিল।”… “বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ভাবলাম, ডেকে উঠি, ‘অমিতাভদা’! চকিতেই। না, ডাকিনি। ডাকিনি, যদি এই সকালে ঘুমজড়ানো অথচ তেজিগলায় ভেতর থেকে অমিতাভদা চিৎকার করে ওঠে, ‘কে রে অর্বাচীন! এই সকালে আমার নাতনির ঘুম ভাঙাস?’ বা বলে ওঠে— “দ্যাখ তো হেনরি! এই সক্কালে ‘চল্লিশ পা দূরে একজন গরম মানুষ’ মনে হচ্ছে!” আমি তো জানি অমিতাভদার ‘হেনরি’ আছে। যদি ‘হেনরি’ অমিতাভদার কথায়, ‘ভয় পেয়েই সে আরও জোরে জোরে কাচ মুছতে শুরু করে দেয়’ আর ‘চামচটাকে ছুঁড়ে দেয়’ (চুল্লির মধ্যে) আমার মাথায়! কোথায় দাঁড়াব তখন। না, ডাকিনি। অমিতাভদার অনেক বিকল্প, ‘ম্যাডাম’, ‘ক্রিস্টোফার’, ‘হেনরি’। অমিতাভদা চিনলেও এরা আমায় চিনবে না। ঢুকতে দেবে কেন বাড়িতে? উল্টে জিজ্ঞাসা করে বসবে, ‘পতন কথা’ থেকে একটা লাইন বলো দেখি! ঠিক আছে, ‘টোটেম ভোজ’ থেকে হাফ-লাইন, বেশ বেশ তাহলে ‘ষাঁড় ও সূর্যাস্ত’ থেকে কোয়ার্টার লাইন! ওরা হয়তো, ‘অমিতাভ মৈত্রর কবিতা সংগ্রহ’ পর্যন্ত দৌড় করাবে আমায়। ওঁরা জানে না আমায়! পাসওয়ার্ড তো চাইবেই। নিজে নিজেই হাসলাম। ঘুমোক দাদা, পরে হবেখন, কখনো।”

পরদিন ফেসবুকে পড়ে আমায় ফোন— “উমা তুমি লজ্জায় ফেলে দিলে আমাকে! তুমি ডাকলে না! এতক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলে! আশ্চর্য। বলো তো, তুমি কি আমাকে একটু পর করে দিলে না? আমি বিস্মিত হই তোমাদের ভালোবাসায়। তবে তুমি অন্যায় করেছ, না-ডেকে” ইত্যাদি।

ফেসবুকে লেখাটা শেষ করেছিলাম এইভাবে— “আমাদের সময়ের বড়ো (মেজর) কবি ও গদ্যকার অমিতাভ মৈত্র। প্রথার বাইরে, স্বতন্ত্র চিন্তা-চেতনা, বাকরীতি, ভাষা, আর পরিবেশনা। এগিয়ে থাকা এক শিল্পীমানুষ। আমার মতো ক্ষুদ্রের সঙ্গে তাঁর ৫১ বছরের পরিচয়, হৃদ্যতা, কথাবার্তা-আড্ডা হয়, আমার লেখালিখি নিয়ে অন্তত দু-বার কলম ধরে, এর চেয়ে শ্লাঘার বিষয় আর কিছু হতে পারে না! মাথা নুইয়ে প্রণাম জানিয়ে ঘরের পথ ধরলাম। আজ ঘরটা যেন অনেকটা দূর মনে হচ্ছে। বস্তুত বহুদূর কোথাও যেন একটা পৌঁছে গিয়েছিলাম। ঠিক স্ববশে নেই।”…

না, মৃত্যুদিন, দুপুরে অমিতাভদার বাড়ি থেকে বাবুয়া (অনুপম ভট্টাচার্য) ফোন করলেও অমিতাভদার মৃতমুখ আমি ফোটো কিংবা ভিডিওতে দেখতে চাইনি, যেমন চেয়েছিলাম নাসের-এর সময়। জানি না, কেন যে!

Categories
2023-sharodiyo-krorpatro amitava_smritikotha

অর্যমা সিংহ মৈত্র

বন্ধুর মতো সম্পর্ক ছিলো বাবার সঙ্গে

অমিতাভ মৈত্র, আমার বাবা, বন্ধুর মতো সম্পর্ক ছিলো বাবার সঙ্গে, আমাকে ডাকতেন ‘মা জননী’ বলে। কোনোদিন কিছু চাইতে হয়নি বাবার কাছে। না চাইতেই আমার সব প্রয়োজন বুঝে আমার কাছে সেগুলি এনে হাজির করতেন। সারাজীবন চাকরিসূত্রে বাইরে বাইরে কাটিয়েছেন। প্রত্যেক শনি, রবিবার বাড়িতে আসতেন। সপ্তাহের ঐ দুটো দিন ছিল আমার কাছে সবচেয়ে আনদের দিন। বাবা খুব ভালো ছবি আঁকতেন। আমার ছোটোবেলার আঁকার হাতেখড়ি বাবার কাছেই। বাবা ভীষন ভালো গান গাইতেন। তখন আমার বয়স ছয়/ সাত হবে। রাত্রিবেলা খাওয়া সেরে জ্যোৎস্না রাতে আমাকে আর মাকে নিয়ে ছাদে বসতেন চেয়ারে। আমরা বাবার কাছে গান শুনতে চাইলে ‘আজ জোৎস্নারাতে সবাই গেছে চলে’, ‘বড়ো আশা করে’, ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু’— এসব গানগুলো গাইতেন। আর আমিও ববার কাছে শুনে শুনে ঐ বয়সে গানগুলো মুখস্থ করে ফেলেছিলাম। এত ব্যস্ততার মাঝেও পরিবারকে প্রচুর সময় দিতেন। আমার পড়াশোনার শিক্ষকও ছিলেন বাবা। একটু যখন বড়ো হলাম, ইংরেজিতে যেকোনো চিঠি, অনুচ্ছেদ যেগুলো ভালো বুঝতে পারতাম না, বাবা লিখিয়ে দিতেন। এমনকী ফোন করে অনেকক্ষণ ধরে বিষয়গুলো বুঝিয়ে দিতেন। ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে যখন পড়া শুরু করলাম, বাবা নাটকের এক একটা সিন মুখস্থ বলে যেতেন আমাকে বোঝানোর সময়। খুব অবাক হতাম এতদিন পরেও ম্যাকবেথের লাইনগুলো বাবার কীভাবে মুখস্থ আছে। ভাবতে খুব অবাক লাগে একজন মানুষ, যিনি উচ্চপদস্থ অফিসার হওয়ার সুবাদে সঙ্গে সিকিওরিটি নিয়ে গাড়িতে লাল আলো জ্বেলে ঘুরে বেড়াছেন, বিভিন্ন জায়গায় রেড করে বেড়াচ্ছেন, সেই মানুষটাই আবার বাড়ির লক্ষ্মীপুজো, সরস্বতী পুজো করছেন সব নিয়মনিষ্ঠা মেনে। সংস্কৃত মন্ত্রোচ্চারণ ছিল বাবার অসম্ভব সুন্দর। এবছরও নিজেই বাড়ির সরস্বতী পুজো করেছেন। ICU তে ভর্তি থাকাকালীন একদিন দেখা করতে গিয়েছি, বললেন পরের দিন একটা সাদা কাগজ আর পেন নিয়ে আসতে। কিছু লেখা মাথায় এসেছে, লিখে ফেলতে হবে ঝটপট। যেদিন রিলিজ পেলেন নার্সিংহোম থেকে, অর্থাৎ মঙ্গলবার, ২১.০২.২০২৩ বিকেলবেলা, বাড়িতে ঢোকামাত্র আমাকে বলেন “পড়ার ঘর থেকে আমার কিছু বই কাগজ আর টেন নিয়ে আয়। আমার প্রচুর কাজ বাকি আছে”। ভীষণ যেন একটা তাড়া কাজ শেষ করার। হাতে পেন নিয়ে চেষ্টা করলেন কিছু লেখার, তখন অক্সিজেন চলছে, শরীরে প্রচুর ক্লান্তি। পারলেন না লিখতে শত চেষ্টা করেও, আর লেখা হলো না। পরের দিন নিঃশব্দে চলে গেলেন আমাদের থেকে অনেক দূরে। তুমি যেখানেই থেকো খুব ভালো থেকো বাবা।

Categories
2023-sharodiyo-krorpatro amitava_smritikotha

শিখা মৈত্র

আমার জীবনসঙ্গীর শেষ দিনগুলি

অমিতাভ মৈত্র, এই মানুষটিকে আমি আমার জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলাম, খুব নম্র, বিনয়ী মানুষ ছিলেন। এত বড়ো পদে চাকরি করতেন, কিন্তু সব মানুষের সঙ্গে সমানভাবে মিশতেন, সবাইকে সম্মান করতেন। কখনো কোনোরকম অহংকার ছিল না ওনার মধ্যে। চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর উনি লেখার প্রতি আরও বেশি সময় দিতেন। প্রতিদিন সকাল এবং সন্ধ্যেবেলায় ওনাকে দেখেছি নিয়ম করে বই, খাতা, কলম নিয়ে বসতেন, পড়াশোনা ও লেখালেখি করতেন। এমনকি যখন সবার খেতে বসতেন তখনও অন্য হাতে বই খুলে উনি কিছু পড়ছেন। কোনো লেখা শেষ হলে আমাকে সেটা পড়ে শোনাতেন, আর প্রথম বইটি উনি আমার হাতেই তুলে দিতেন। চাকরি সূত্রে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। সব জায়গায় মানুষের কাছে প্রচুর ভালোবাসা ও সম্মান পেয়েছেন। উনি সি.ও.পি.ডির পেশেন্ট ছিলেন। কখনও কাউকে ওনার অসুখের কথা প্রকাশ করতেন না। আমরা জিজ্ঞাসা করলে সবসময় বলতেন, আমি ভালো আছি। উনি চলে যাওয়ার দশদিন আগে থেকে হঠাৎ একটু বেশিই শ্বাসকষ্টে ভুগতে থাকেন। ভাক্তার দেখানো হলে তিনি বলেন অ্যান্টিবায়োটিক নিতে হবে চ্যানেল করে। বাঁহাতে চ্যানেল করে দিনে দুবার অ্যান্টিবায়োটিক চলছে, উনি সেই অবস্থায় রিলকে নিয়ে লেখাটা লিখছেন। জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কষ্ট হচ্ছে না তোমার? তৎক্ষণাৎ বললেন না, কোনো কষ্ট হচ্ছে না। শেষ লেখার প্রিন্ট করনোর জন্য উনি যেতে পারেননি, তাই ছেলেটি বাড়িতে এসে লেখা নিয়ে যায়। সেই প্রুফ দেখার জন্য নার্সিং হোম থেকে ২১ তারিখে ফিরেই আমাকে বললেন, তাড়াতাড়ি ফোন চার্জ দাও, আমার কিছু জরুরি মেসেজ করতে হবে। রাত্রি ৭:৩০ টা, কিছুক্ষণ মেসেজ দেখার পর উনি ঘুমিয়ে পড়লেন। পরদিন অর্থাৎ ২২ তারিখ সকাল থেকে আর কোনোভাবেই ভেকে ডেকে ওনার সাড়া পেলাম না, আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। সবসময় বলতেন দুজনে একসাথে আরও অনেকদিন বাঁচবো আমরা, সেই কথা আর রাখতে পারলেন না।