Categories
amitava_oprokashito

অপ্রকাশিত গদ্য

শব্দকে তুলোর হাতুড়ি দিয়ে আঘাত

‘… a man can not successfully defend himself in the eyes of another, and when he is talking he is doing so only to drown the silence which spreads around him.’
(Love and garbage: Ivan Klima)

আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য যা কিছু আমরা বলি, তার মধ্যে থেকে যায় চারপাশের স্তব্ধতাকে নিমজ্জনের একটা চেষ্টা— উপরের এই উদ্ধৃতিটিকে বিস্ময়কর একসত্য বলে এ মুহূর্তে মনে হচ্ছে আমার। হতে পারে, কালই হয়তো সরে যাব এখান থেকে। নতুন কোন কথায় বিস্মিত হব। সারাজীবন ধরে এমন কয়েক হাজার বিস্ময়কর সত্য আসে এবং চলে যায়। এভাবেই আমরা নিঃস্ব আর সমৃদ্ধ হই একসাথে। আমার দুই তরুণ কবিবন্ধু— স্বপন এবং রঞ্জন আমার এই ব়্যান্ডাম পুলিশি লাঠিচার্জ কীভাবে সহ্য করবে জানি না। কিন্তু আমিও নিরুপায়। লাঠি ছাড়া আর কিছু নেই আমার।

খুব কুণ্ঠার সঙ্গে একটা কথা প্রথমেই স্বীকার করে নিই— কবিতা নিয়ে কথা বলার কোনো যোগ্যতা আমার থাকতে পারে না, কেননা সব থেকে কম আমি যা পড়ি তা কবিতা। এমন নয় যে আগে পড়তাম, এখন পড়ি না। এক অগ্নিময় তৃষ্ণা নিয়ে কবিতা পড়তাম একসময়, বলা ভালো শুষে নিতাম। সে-সময় কবিতার বই/পত্রিকা খুব বেশি আসত না কলকাতা থেকে অনেক দূরের এই মফস‍্সলে। প্রতি সপ্তাহে ৭৫ পয়সা দিয়ে ‘দেশ’ কেনা সম্ভব ছিল না— পয়সা নেই। প্রশান্ত মজুমদার আর আমি— দু-জনেরই বছর কুড়ির নীচে বয়স তখন— দু-জনের টাকা দিয়ে একটু-একটু করে কিনলাম ‘কবিতার পুরুষ’ (সং: অমিতাভ দাশগুপ্ত) ‘বাংলা কবিতা বার্ষিকী ১৩৭৫’ (সং: শক্তি চট্টোপাধ্যায়)। বহরমপুরের অগ্রজ কবিরা মাঝে মাঝে দুয়েকটা বই পড়তে দিতেন। একদিন মনে হল ফেরতযোগ্য এই সব বই আর না— কিনতে- পারা পত্রিকা থেকে প্রিয় লেখাগুলো যদি মুখস্থ করে নেওয়া যায়, একটা সুরাহা হয় তাহলে। দোকানে চা স্টলে দাঁড়িয়ে সার্জেনের মতো একাগ্রতায় কবিতা মুখস্থ করা শুরু করলাম। যে অংশগুলো মনে পড়ত না, পরের দিন দোকানে দাঁড়িয়ে আবার সেগুলো পড়তে যেতাম। নিজেকে মহাপ্রাণ হিসেবে দেখানোর জন্য এসব বলছি না কিন্তু। সেই সময় রেস্তহীন কবিতা পাগলদের অনেকেই এমনটা করতেন।

তো, এভাবেই চলছিল। কবিতা পড়া, কবিতা লেখা, কখনো-সখনো ঝামেলা মারপিটে জড়িয়ে পড়া, টিউশনি, আর দিনরাত আড্ডা। মদ খেতাম না। গাঁজা ভাং এসব চলত। মালদার পোস্ট অফিসের ব্যস্ততম মোড়ের ট্রাফিক আমি আর শিশির গোস্বামী (কবি নন) পুরো বন্ধ করে দিয়েছিলাম ভাংয়ের গুলি খেয়ে রাস্তায় বেঁহুশ পড়ে থেকে। সেই আনন্দময় মুহূর্তের কথা ভাবলে আজও রোমাঞ্চ হয়। এরপর গাঁ-গঞ্জে চাকরি জুটল একটা। বই-পত্রিকাহীন এক সাধকের জীবন শুরু হল। কবিতা নিয়ে তীব্রতা পরিস্থিতির চাপে স্তিমিত, প্রায় নিশ্চিহ্ন তখন। কয়েকবছর পরে অন্য চাকরিতে গেলাম। কবিতা আরও দূরের ব্যাপার হয়ে উঠল। এই—


কবিতা এল না আর কোনোদিনই। এল জীবন-দেখা। সেই দেখার তীব্রতায় আমি ধ্বংস হয়ে গেলাম। চোখের পাতা ঝলসে গেল আমার। চাকরির শর্তে তখন আমাকে মৃত্যুকালীন জবানবন্দি নিতে হয়। সন্দেহজনক মৃত্যুর ইনকোয়েস্ট করতে হয় হাসপাতালে, মর্গে, মাঠে ঘাটে সবখানে। সবে হাঁটতে শেখা ছেলে উঁচু মাচা থেকে মাটিতে পুঁতে রাখা বেশ কয়েকটি লোহার রডে পড়ে গেছে। একটা রড তার চোখ দিয়ে ঢুকে মাথার পেছন ফুঁড়ে বেরিয়ে গেছে। Custodial death হয়েছে একজনের। ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে আমি মর্গে হাজির সুরতহালের জন্য। ছুরির একটানে পেট দু-ফাঁক করে হুড়মুড় করে বেরিয়ে আসা পচা নাড়িভুঁড়ি থেকে প্রয়োজনীয় নমুনা নেওয়ার পর খুলির চামড়া পুরো তুলে ফেলে চালের বস্তা নামানোর কাঁটার মতো জিনিস হাতুড়ি দিয়ে কপালে গেঁথে উঠে দাঁড়ায় ডোম। জোরে শ্বাস নিয়ে শক্তি সংগ্রহ করে। তারপর এক ঝটকায় শূন্যে তিনহাত লাফিয়ে উঠে ছিটকে পড়ে সেই মৃতদেহ এবং ডোম। তখন খুলির দরজা হাট হয়ে খুলে গেছে, তরল আলো গড়িয়ে নামছে মর্গের মেঝের ওপর।

হাসপাতালের বেডে শুয়েছিল বছর ত্রিশের একটি বিবাহিতা মেয়ে। আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। ঠোঁটে স্ফুরিত হাসির আভাস। মেয়েটির ত্রিসীমানায় মৃত্যু নেই, আর এর dying declaration নিতে হবে আমাকে! আমার প্রশ্ন শুনে ডাক্তার হাসলেন। মেয়েটির চোয়ালে অভ্যস্ত চাপ দিলেন, আর আমি দেখলাম সাদা আলোর বল উঠে আসছে মেয়েটির মুখ থেকে। তীব্র অ্যাসিডে তার জিভ তালু, গলা জড়িয়ে একটা খোসা ছড়ানো ফটফটে সাদা ডিমের মতো হয়ে উঠছে, টিভবের আলো ঠিকরে উঠছে সেই সাদা থেকে।

১৯৯৩ থেকে ২০০০ পর্যন্ত কয়েকশো বার এই কাজ করতে হয়েছে আমাকে। না করলেও পারতাম। তখন অনিচ্ছুক আর সব ম্যাজিস্ট্রেটদের কাজটা করতে হত। দেখতাম ৮০% ভিকটিমই মেয়ে। মেয়েদের পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে ওঠা পৃথিবীকে একটি ছোট্ট মেয়ের বাবা হিসেবে আমার সাধ্যমতো জঞ্জাল মুক্ত করা দরকার— মনে হয়েছিল এরকম। গলাপচা মৃতদেহে গন্ধ তাড়াতে কড়া আতর সারা গায়ে মেখে দিনে/গভীর রাতে কয়েকশো বার এই কাজ নিয়ে প্রেতের মতো ঘুরে বেড়িয়েছি আমি। শরীর ধ্বংস হয়ে গেছে ভিতরে ভিতরে এই অসহনীয় মানসিক চাপে। রাতে ঘুমোতে পারতাম না। চাপ কাটাতে আমি দান্তে (বিশেষ করে Inferno/Paradiso নয়) ওভিদ আর ভার্জিল পড়তে শুরু করি। সাথে ফ্রেজারের Golden Bough এবং জেসি ওয়েস্টনের From Ritual to Romance। সব থেকে মন দিয়ে পড়তাম ফ্রয়েড, ইয়ুং এবং অ্যাডলার। বছর দুয়েক এই বইগুলোয় বুঁদ হয়ে থাকলাম। স্বস্তি এল না, ঘুম এল না, কিন্তু চোখ খুলে গেল। ঠিক করলাম জীবনে কবিতা লিখব না আর, কিন্তু আমার ভয়ংকর দেখাগুলো টুকরো- টুকরো দৃশ্যে লিখে রাখব। কাল্পনিক একজন protagonist হিসেবে ম্যাডাম এম. নামের একজন এলেন। তাঁর জন্ম, তীব্র ভয়াবহতার মধ্যে বেঁচে থাকার মরিয়া চেষ্টা, ও আত্মহত্যা— সাথে প্রক্ষিপ্ত আরও কিছু টুকরো দৃশ্য— এই নিয়ে শুরু করলাম ‘টোটেম ভোজ’। টোটেম-এর সম্পূর্ণ পরিকল্পনা লেখা শুরুর আগে মনে মনে ছকে নিয়েছিলাম। একটি শব্দও প্রেরণাচালিত হয়ে আসেনি এবং প্রেরণায় আমি একবিন্দু বিশ্বাস করি না। আমি একটা pseudo-epic-এর আদলে বইটি ভেবেছি। Epic-এ invocation to the muse থাকে, টোটেমেও সেটা এল, কিন্তু অভিশাপ হিসেবে। এরপর ম্যাডাম এম আর আবির্ভাব, বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টের অনুসরণে এল সৃজনমূলক সাতটি দিনের কথা।

এই লেখাগুলির মধ্যে ‘Protagonist’ ম্যাডাম এম.— এক ঋতুহারা নারীসত্তা। তাঁর ভয়ার্ত চিৎকার সারা বইটিতে ছড়িয়ে। এডোয়ার্ড মুংখ-এর The Cry ছবিটির মুখ যেমন সারা ক্যানভাসে ছড়িয়ে যায়। এই ম্যাডাম এম হয়তো আমারই অ্যানিমাস।

টোটেমের ভাষা কৃত্রিম, আড়ষ্ট শীতল বিশ্লেষণমুখী। খুব বোকার মতোই আমি চেয়েছি ভাষাকে তার আদিলক্ষণে অর্থাৎ স্রেফ চিহ্নমূল্যে (Sign value) ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। কোথাও suggestiveness নেই, symbol নেই। চেয়েছি শব্দ প্রাথমিকভাবে যা বোঝায় সেটুকুই সে বোঝাক। শব্দের নিরেট বাস্তব দিয়ে বাস্তবতার প্রতীকী গঠনকে আঘাত করতে চেয়েছিলাম। যদি সেটা হয়ে ওঠে তুলোর হাতুড়ি দিয়ে হত্যার চেষ্টার মতো হাস্যকর— আমার যায় আসে না কিছু। বাংলা অনুবাদে বাইবেলের ভাষার আড়ষ্টতা আমি টোটেমে ব্যবহার করেছি। পড়লেই মনে হবে ইংরেজি বাক্য গঠনের নিয়মে অন্ধের মতো অনুসরণ করা হয়েছে।

আর একটা কথা, টোটেম-এ মাঝে মাঝেই কথোপকথন এসেছে। আড়ষ্ট কৃত্রিম কথাবার্তা। কেউ কাউকে শুনছে না, উত্তর দিচ্ছে না। দুয়েকটি নমুনা দিই—
১. ‘আমি কিন্তু এইমাত্র আপনাকে রাতের খাবারে আমন্ত্রণের কথা ভাবছিলাম।’
২. ‘আপনার পাঁজর থেকে বেরোনো রক্তের ওই তিনটে মোমবাতি কি পেতে পারি আমি?
৩. ‘হ্যাঁ। কিন্তু খাবারগুলো দেখুন। মনে হয় না আপনি ক্ষুধার্ত?’
— বাংলায় এভাবে কথা বলা হয় না। ইংরেজি ভাষায় এক স্বাভাবিক ফর্মাল দূরত্ব আছে, যা পারস্পরিক যোগাযোগহীনতা বোঝাতে কাজে লাগানো হয়েছে টোটেমে। ভাষাকে মন্থর করতে ব্যবহৃত হয়েছে প্রচুর ক্রিয়াপদ। এসবই করেছিলাম নিজেকে আরো নিঃসম্বল করে তোলার জন্য। সব কিছুই শেষপর্যন্ত হয়তো হয়ে দাঁড়িয়েছে একজন সার্কাস-ক্লাউনের দেকার্ত বিষয়ে গুরুগম্ভীর বক্তৃতার চেষ্টার মতো হাস্যকর। কিন্তু আমার সত্যি তো আমাকে বলতেই হয়।


দৃশ্য, আদ্যন্ত বানানো— এই জায়গা থেকেই প্রাথমিক ধাক্কাটা পাই— যখন লিখি কিছু। বিপন্ন, ত্রাস-তাড়িত মানুষ (কখনো তার নাম ক্রিস্টোফার, কখনো হেনরি— এরকম) সেই দৃশ্যের মধ্যে (আবার কখনো দৃশ্যের বাইরে) পরিত্রাণ খুঁজছে, পরিস্থিতি বুঝতে চাইছে। চাপে সে বিপর্যস্ত, তার চিন্তা শৃঙ্খলাহীন, arbitrary, কিন্তু তবু সে চেষ্টা করছে। যেন দৃশ্য, রং, ধ্বনি, আর যুক্তি শৃঙ্খলাহীন এক ধারাবিবরণী মিলেমিশে এক chaos সৃষ্টি করছে। কিন্তু এই chaos-এর অতলে একটা কিছু বলে দেওয়াও আছে। সেটা যদি পাঠককে না পৌঁছে দিতে পারি, তাহলে সেই লেখা সম্পূর্ণ ব্যর্থ। নিজের লেখার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সংশয় থাকে অনেকের। আমিও তার বাইরে নই। চার লাইনের কবিতার দু-লাইন পড়েই যদি কেউ লম্বা লম্বা করে ধু-উ-স বলে অন্য পাতায় চলে যান! এই ভয় থেকেই আমি চাই এমন এক নিজস্ব সিনট্যাক্স থাকুক আমার লেখায়, যাতে পাঠককে ধাক্কা না খেতে হয় পড়ার সময়। (যাঁরা কবিতা লেখেন তাঁরা সবাই এটা করেন, বলাই বাহুল্য।) মোটে তো দু-তিনজন আমার লেখা একটু পড়েন, তাঁদের কেও যদি ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিই এবং তাঁরা চলে যান, আমি কী করব তখন? ধুধু সাদা বরফের ওপর একটা লাল পায়রার মতো নখের আঁচর কাটব?
আমার নিজের সীমাবদ্ধতা আমি জানি খুব ভালোভাবেই। শক্তি থাকলে একদিন আমিও হয়তো গুটি কেটে বাইরে বেরিয়ে আসতে পারতাম। আজ আমি শুধু নিজের কথাই বলে গেলাম। কোন ভাবনা থেকে আমি কী কী করতে চেয়েছি— এসবে কেন আগ্রহী হবে কেউ? কিন্তু আমাকে অপ্রস্তুত করে বমির মতো উঠে এল যা কিছু বলিনি আগে, যা দরকারও হয়নি বলার। এবং স্বপন! রঞ্জন!…

‘… These are the fragments I have shored against my ruins.’ বিশ্বাস কর।

Categories
amitava_oprokashito

অপ্রকাশিত কবিতা

চৈতন্যোদয়

সাদা মাংস চলতে পারে
কিন্তু লাল আমার জন্য নিষিদ্ধ।
এটা না জেনেই আমি মানুষের মাংস খেয়ে আসছি
দীর্ঘদিন
তৃপ্তি ও অনুতাপের সঙ্গে।
ভয় করছে, এতদিন আমি কি ক্ষতিই করেছি আমার?

ইয়ে, মানুষের মাংস লাল না সাদা?

ডিভোর্স পেপার

রবার স্ট্যাম্পের ছাপগুলো খুঁটিয়ে দেখছে হেনরি
এবং রবার ঘষে অনিচ্ছা প্রকাশ করছে।
সম্ভবত বিকেল থেকেই সংক্রমণ ছড়াবে
রবার স্ট্যাম্পের ছাপগুলো খুঁটিয়ে দেখছে হেনরি।
বেড়ার ওপর একটা পুরোনো মাছি
পুরোনো রোদকে ঠিক তখন থেকেই আর চিনতে পারছে না
রাস্তা থেকে শান্তভাবে একটা বাড়ি সরে যাচ্ছে
ক্ষমা করে দিচ্ছে।

সিঁড়িতে বসে রবার স্ট্যাম্পের ছাপগুলো
শেষবারের মতো দেখে নিচ্ছে হেনরি।