Categories
কবিতা

সৌমিক মৈত্র

প্রার্থনা…

আমার বাড়ির উঠোনে দুটো গাছ—
জবা আর করবী।

মা রোজ সকালে স্নান সেরে, লাল জবা তোলে—
ঠাকুরের পায়ে দেয়।

আমি ঠাকুরের পায়ে মাথা রেখে প্রার্থনা করি।
মায়ের পায়ে যেন সাদা করবী দিতে না হয় কখনো।

মানতাসা

কাঁটাতার ঘিরে রাখে লালচে-ধূসর আলোককুণ্ডলী।
এই বিচ্ছিন্নতা অমূলক, তবু তুমি আঁচড়ে কামড়ে ভাঙো আমায়।
বিলুপ্ত হোক প্রতিষেধক, উপশম।
রহস্যময় উপনগরীর আহত সিংহদ্বারে ছড়িয়েছে মনুষ্য লোম।

এত রক্ত কেন মাখো—
প্রকৃতির চক্রাকার দিগন্তে আহত পাখির মতো।
তুমি প্রগতির বুক কেটে অন্তর্বাহিনীকে মুক্ত করে দাও এই প্রগলভ মরুবালিকণায়।
স্থিতু হও, মিঠে খেঁজুরের গন্ধমাখা বিকেলে।
যেখানে মৃত্যু যায়—
তার পিছে পিছে তুমি কোন লোভে গেলে?

নিশি কোলাহল নির্বিকার, গ্রহণ সকালে যেন মরক লেগেছে শঙ্কিল হৃদযন্ত্রে।
এ নৈর্ঋত মেঘ আহার্যবিহীন আপরাজিতা— দু-ফোঁটা কান্নার লোভে মাটি ছুঁয়ে হয়েছে ধোঁয়াশা।
অনারম্বর তুমি, মৃত কবজি থেকে ঝুলে থাকে—
প্রিয় মানতাসা।

যন্ত্রণা…

মৃতপ্রায় শরীরে—
ব্যথার রাক্ষস জেগে ওঠে।
আঘাতের নকশায় যন্ত্রণা ফুল হয়ে ফোটে।

মিনে করা কাটা দাগ,
রক্ত শুকনো, আলপনা—
দু-ঠোঁট বাক্যহীন, বেদনার সুতো দিনে বোনা।

এ-ক্ষত নির্বোধ, ছেড়ে যায় নিঃশ্বাস, প্রাণ।
নিঃস্ব কবর, একা—
পাশে তার বিষাদখাদান।

চামড়ায় শাদা ছোপ—
ফোস্কায় জ্বলে গেছে মুখ
যার দেহে ক্ষত নেই, তার শুধু মনের অসুখ।

রহস্য!

মশলার গন্ধ লেগে চঞ্চল, লাস্য বিকেলে।
যেন ক্যাওড়া জলে ভেজা মিঠে জায়ফল।

আফগানি কেশরের হলদে লালে,
ঢাকা পড়েছে মানস সরোবরের শাদা।

তুমি তেজপাতা ঠোঁটের—
হেমন্ত ঝাঁজ মিশিয়ে দাও গন্ধহীন রাতে।

দারুচিনি দেশ ঋতুমতী হল,
তুমি এলাচের স্বাদ বলে শুকনো ঝাল মাখিয়েছ গালে।

এ-জ্বালা তীব্র নয় জেনো—
এ শুধু রঙের আড়ম্বর, মিশে থাকা
সান্ধ্য বকুলে।

প্রলেতারিয়েত

অবসর বসে থাকে, শুকনো জানালায়।
মেঠো গন্ধের শোক—
লেগে আছে রক্তাভ পায়ে।

আহতের মতো দুই মৃত চোখে মাংসের লাল,
ধূসর জানালা থেকে ঝুঁকে আছে শূন্য কপাল।

বিষাদ মাখানো চোখে, উঁকি দিয়ে চলে গেল প্রেত—
প্রলেতারিয়েত।

 

Categories
কবিতা

উমা মণ্ডল

জহর বিষয়ক—

জহরের কাল মুছে গেছে সেই কবে। পুরাণের পৃষ্ঠা থেকে কখনো শুনতে পায়নি কেউই। জীবাশ্মের ছায়া তবু বেঁচে থাকে। লুকোচুরি খেলা। এই দেখা, এই ভ্রম… মরীচিকা পায়ে পায়ে ঘোরে বেখেয়ালে। কুণ্ডের ভাষায় যদি বলা যায় আগুনের আঁচ আছে। সেই যে ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি; তুলিরেখা মুখে অবন ঠাকুর। আসলে সে বিষ বিষয়ক শব্দবন্ধে ঘোরে ছিল বহুকাল। নতুন বৌঠান শুধু বলে গেল না কিছুই।

উড়ে উড়ে কথা বলে নিষিদ্ধ রাত্রির। গন্ধ পায় চিতাকাঠ ঘি চামড়া পোড়া আদিমের। বন্য আঁতুড়ের ঘরে জন্ম নেওয়া প্রতিমার চোখ জ্বলে গেছে আগেই; যোনির দ্বারে দারোয়ান বাঁধা। পথে কাঁটাখেত। তবু কালো প্যাঁচা মাংসাশী প্রাণী। তার প্রাণ চাই।
এই ঘণ্টা কি সতর্ক করে???? ঈশ্বরের দূত নর্দমায় বয়ে যায়। পাশে পড়ে থাকা অজন্মা ভ্রূণটি ধর্ষণের অবৈধ প্রমাণ। ওকে জহরের কালে নিয়ে যাও। আর শয়ে শয়ে অবলা বালারা ওদেরও ধরো একসাথে। বাঁধো। ঘাটে ঘাটে প্রদীপের আস্ফালন। এইভাবে পথ ব্যস্ত। রাঙা সূর্য ফুটে আছে পৃথিবীর গায়ে।

যদি ঘাড় ধরে থাকা হাতটাকে আগুনের উৎসবে তুলে দেওয়া যেত বেশ হত। কুণ্ডের কিন্তু পুরুষ বিষয়ক মাংসের চাহিদা আছে পুরাকাল থেকে। একবার জিভে নিয়েই দেখুক। অমৃত মন্থন

বিষবৃক্ষ—

এইসব উপন্যাসে দম্পতির বিছানায় চোরাকাঁটা
চকচক করে
অবকাশ যাপনের অছিলায় ডাক দেয়
খাদের ঈশানকোণে

অশনি এমনই মায়ামৃগ
কস্তুরী নেশায় পথ ডাকে
আরও কাছে, আরও কাছে
পথিকটি এখনও সরল ছকে কাটাচিহ্ন খেলে
বাঁক থেকে বাঁকে যে মৃত্যুর পরওনা নিয়ে
বাটখারা বসে আছে
সেই সংবাদপত্রের পাতা সে পড়ে ওঠেনি
আর্যভট্টের ভক্তটি শুধু সরলরেখায় বিন্দু গুনে চলে

ওগো খই এইভাবে ওড়া ঠিক নয়
পড়েছ যমের পাতা; অবসরে
ঘুম ছিল চোখে…

ফলারের সাদা খই সই পাতিয়েছে লেবু ও লঙ্কার সাথে। ওরা ভাগ্যচক্রে কালো বেড়া দেয়। বেড়ালের এঁটোমাছ নিয়ে ঝোল রাঁধে। তার সাথে রাঁধুনি মশলা। খই তাই উড়ে যায় শোকচিহ্ন নিয়ে

বার বার চিহ্ন আঁকো অবলা আমার
কবে যে খুঁটের ধার খেয়ে গেছে তোতাপাখি…
পাখি শুধু হরিনাম বোঝে; শতবার কর গুনে খাবি খায়
ওদিকে শিকড় হাত লম্বা করে ভিতে
ভূমিকম্প ডেকে আনে

দুর্গা সহায়—


আমি সেই সুর চিনি… বাঁশি থেকে উড়ে আসা পথের গানটি আমায় ভাসিয়ে নিয়ে চলে। ফেলে আসা কথা মাত্রা পেয়ে যায়

আশ্বিনের ঢেউ এসে গেল। প্রকৃতিতে শারদীয়া লেখা। কোথা থেকে জন্ম অসুখের আমাকে মনে পড়েছে। গায়ে জ্বর। সামনের খোলা জানলাটি এক পাঠাগার। শব্দগুলি উড়োচিঠি যেন। পড়ে ফেললেই হল। একলা ঘর বলে যে-বাতিস্তম্ভের নাম রাখা, বিদ্যুৎ সংকেত পেয়ে চমকে ওঠে। চোখ স্থির হয়

অন্য একটি চোখের ছায়া পড়ে। সেই ছায়াপথে অদৃশ্যের মায়াগন্ধ। এক অতলের ডাক। মেয়েটির জলে ভরা আয়নাটি কত কথা বলে। হে, নৈঃশব্দ্য…


দুর্গার গায়ে তাপের প্রকোপ বেড়েই চলে; তবু কাশে ভরা রেলপথ হাত তুলে ডাকে। পায়ে যাযাবর খুর বাঁধা। আর সেই চোখ, জলে ভরা সেই চোখ… নৌকা টানে ছলাৎ, ছলাৎ

জল শুধু জল… পোড়ামাটির ঈশ্বর তখন অস্থির। মাটি ধুয়ে যায়, কাঠামোও; কালাশৌচ পার করে পরিবার যাত্রা করে অন্য পথে। তখন ওরা তিনেতে বন্দি। ভিটেতে ‘কাল’ শিকড় পুঁতেছে; সর্পিল চলাফেরা। এইসব দৃশ্যপট, গোরুরগাড়ির ধুন; স্মৃতিময়…

কিন্তু সেই চোখ, জলে ভরা চোখ; দরজায় হাত রেখে ঠায়… মাটি ডাকে, ছড়া কাটা মাটি; এই ভিটে প্রদীপের সলতে তখনও নামিয়ে রাখেনি।


প্রকৃতি এখন আশ্বিনের দরজায়। কাঠামোয় মৃন্ময়ীর চোখ আঁকা হয়ে গেছে। মেঘগুলো চালচিত্র তৈরি করে একতারা সুরে। ওদের পালকে নক্ষত্রের সংসার। আমার গায়ে জ্বর। সামনের জানলায় ইতিহাস, বর্তমান… পাশে পড়ে ওষুধের ছেঁড়া নামগুলো; চোখ স্থির। হয়তো কাশের ভেলা দেখছে কিংবা রেলপথ, টানা রেলপথ…

বিন্দুতে আরম্ভ, বিন্দুতে সমাপ্তি; সব একাকার… অনন্তের পথে, লন্ঠনের আলো, জ্বর রাত; বিশল্যকরণী… বাঁশি বেজে যায়। জলে ভরা চোখ থেকে গভীরের ডুব; মায়াপথ। তল থেকে চিন্ময়ী আলোককণা সংকেত পাঠায়। দুর্গারা এখনও ত্রিশুলের শব্দ ভুলে যায়নি পুরোটা। চোখ বন্ধ হয়ে আসে; ঘুম চিরঘুম। দরজাটা বন্ধ আছে।
হে, নৈঃশব্দ্য… দুর্গা সহায়

 

Categories
কবিতা

শিবু মণ্ডল

হর-কি-পৌরি


হর-কি-পৌরি এলে সবাই হাসিখুশি থাকে। মানুষ মানুষকে দেখে। দেখে অন্যভাবে। নিজের কথা ভাবে কি না বোঝা যায় না। আমি অনেকবার এসেছি। যখনই আসি আমিও মানুষ দেখি। গঙ্গার স্রোতের মতোই আসছে আর যাচ্ছে। এক অনিঃশেষ প্রবাহ। নারীপুরুষ বালক বালিকা সকলেই ঝাঁপিয়ে চান করে। নারীরা স্নানের পর ঘাটেই কাপড় বদলায়। কেউ কেউ আড়ালে কেউ আবার প্রকাশ্যেই। তবে আমি পুরুষদের দেখি অন্য সময় রাস্তাঘাটে মহিলাদের দিকে যে-রূপ লোলুপ দৃষ্টিতে তাকায় তেমনভাবে এখানে দেখে না। তারাও শুধু জাঙিয়া পরে স্নান করে। যে যার খুশিতে বরফগলা জলে ডুব দেয় আর আনন্দে কাঁপে।


ঘাটে একটু দূর দূর লম্বা শেকল বাঁধা থাকে। পুন্যার্থীরা সূর্যকে নমস্কার করে দু-চার ডুব দেয়। কেউ কেউ সাঁতার কাটে। সাঁতার কাটলেও গঙ্গার প্রবাহের সাথে তারা অনিশ্চিত ভেসে যেতে পারে। কিন্তু কেউই যায় না। সেই শেকলটি ধরে থাকে ভয়ে। আর এমনভাবে শরীর উলটেপালটে চান করে দেখে মনে হয় নিজের সাথেই নিজে দু-টি কুমীরের মতো খেলে যাচ্ছে।


সন্ধ্যা ছ-টা বাজলেই মাইকে বেজে ওঠে অনুরাধা পড়োয়ালের কণ্ঠে— ওঁ জয় গঙ্গে মাতা…! চোদ্দো বছর হয়ে গেল আমি হরিদ্বারে আছি। তখন থেকেই দেখছি সেই একই গান বেজে আসছে। এই গানটির চেয়ে অন্য কোনো গঙ্গাস্তুতি বা তাকে নিয়ে গান হতে পারে তা আমি কল্পনাও করতে পারি না। গঙ্গা আরতির সময় যখন এই গানটি বেজে ওঠে তখন আমার শরীর জুড়ে এক শিহরণ জাগে— এ এক ভালোলাগারও অধিক কিছু। এক অতিপ্রাকৃতিক ভাবও বলা যেতে পারে। তখন আমি যেন সামনে বয়ে যাওয়া নদীটির জল হয়ে যাই। অথবা নদীর তরঙ্গে কাঁপতে থাকা আলো!


গঙ্গা আরতি শেষ হয়ে যাবার পরও আমি গঙ্গার পাড়েই বসে থাকি। আমার চারপাশ পুরুষের অন্তর্বাস থেকে ঝরে পড়া গঙ্গাজলে, মহিলার পোশাক ও চুল থেকে ঝরে পড়া গঙ্গাজলে থৈ থৈ দশা। ছোট্ট একটি ছেলে কিংবা মেয়ে তিলক ও শৃঙ্গারের বাটি এনে সামনে দাঁড়াবে। আমার হাসিমুখ দেখে কী বুঝবে জানি না। সে আমার কপালে তিলক ও শৃঙ্গার কেটে দিয়ে পয়সা চাইবে। অন্য সময় কেউ এভাবে পয়সা চাইলে ধমকে দিই। কিন্তু এখন আমি দশ টাকাও স্মিত মুখে দিয়ে দিই। তারপরেই আসবে একটি পুরুষ কিংবা মহিলা প্রদীপের থালা হাতে। আমি তাকেও ফিরাই না খালি হাতে।


দু-টি কিশোরী এলোচুলে বসে আছে সিঁড়ির ধাপে। তাদের ধবধবে ফর্সা পা জোড়াদু-টি গঙ্গার নীল জলে ডুবে আছে। সেলফি তুলছে তারা। সামনে দিয়ে বয়ে গেল গোলাপের পাপড়ি বোঝাই একটি পলাশ পাতা দিয়ে বানানো ডোঙা। তাতে জ্বলে আছে কর্পূর দিয়ে বানানো ক্ষণায়ু প্রদীপখানি। একটি মাঝবয়সি লোক ভিডিয়ো কলিং করে দেখাচ্ছে তার দূরদেশি আত্মীয়াকে! বয়ে যাওয়া আলো, গন্ধ ও জল দেখিয়ে প্রলুব্ধ করছে সেই দূরদেশবাসিনীকে। আমন্ত্রণ করছে তাকে ঈশ্বরের এই আপন দেশে!

 

Categories
কবিতা

বর্ণালী কোলে

প্রতারণা বিষধর সাপ


তোমারা প্রতীক্ষা করেছিলে, অবসান
আমি প্রতীক্ষা করেছিলাম, সূচনা
তোমরা আমাকে বেঁধে ফেলতে শুরু করেছিলে
আমার পায়ে বেড়ি দিয়ে
এইটুকুই আকাশ তোমার
এইটুকুই জগৎ

পৃথিবী তোমাদের দেওয়া ঈর্ষা-উপহার


একজন নারী কতটা কষ্ট পেলে
তোমার অহং শান্ত হবে, ভাবি
এত নির্লিপ্তি
এ তো খুনিদের থাকে
তুমিও তাই?
কেবলই হত্যা করো, হৃদয়
দীর্ঘ তলোয়ার, হৃৎপিণ্ডের তাজা রক্ত

ভুলে গেছি
মুখ মনে নেই
তবুও মাঝেমধ্যে মনখারাপ
কপালে, শিরায় আড়ষ্ট ব্যথা
চাবুকের দাগ


স্নেহ নেই, প্রীতি নেই
প্রেম নয়, দরদ নয়

ভয় লাগে, এখনও তার ভয় লাগে
আকাশি রঙের শাড়ি
নতুন বধূ

সিঁদুরচিহ্ন বিবাহের পরদিন মুছে নিয়েছে
মহাকাশে এখনও চাবুক
তারই শব্দ শোনে সে

তার সব বোধ
ঠিক যেন মানসিক রোগীদের চিকিৎসালয়


“শিকার” তোমার প্রতিবেশী নয়
খবরের কাগজের নারী নয়
তুমি নিজেই “শিকার”

আতঙ্কের মধ্যে থাকতে থাকতে
প্রত্যাশা হারিয়ে গেছে
জীবনের অংশগ্রহণের ইচ্ছে শেষ

মাঝেমাঝে ঈশ্বরের দিকে তাকাই
এরপর? এরপর?


এই মানুষগুলোরও মৃত্যু হতে পারে, অবাক দেখছি
চিত হয়ে শুয়ে বিশালদেহী লাশ
পচা দুর্গন্ধ বেরোয়নি এখনও
এখনও ছিটকে বেরোচ্ছে তেজ, দর্প, হুঙ্কার, ত্রাস
শাসন

একটু পর চিতায়
ছাই

স্মৃতি মৃত্যুর থেকেও বেশি বিভীষিকাময়


নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে
পিঁপড়ের মতো তোমার ওপর উঠে আসছে ওরা
তোমার বাঁচার ইচ্ছেকে ছেঁটে ফেলা
শোষণ নয়?

স্বপ্নে দেখ, রাজপথ
হাজার হাজার তুমি
মুষ্টিবদ্ধ ঘোষণা— “বাঁচতে চাই।”


প্রতারণা বিষধর সাপ। আজও
ছোবল দিয়েছে বহু বার। বিষদাঁত তার
নিষ্ক্রিয় হতে শুরু করেছে টানা ছয় মাস
দংশনের পর।
ভেঙে পড়ার বিষাদ একটি ব্যর্থ সংগম।

উঠে দাঁড়াচ্ছে। চলছে সে আবার।
নীলক্ষত কিছুটা মলিন।

রোদ্দুর, পুরুষ হও, তুমি।
ওর হাত ধরো একবার।
ও প্রত্যয় ফিরে পাক।

 

Categories
কবিতা

সেখ সাদ্দাম হোসেন

সদরঘাট

জল সরে গেছে। ঠাকুরের খড়ের কাঠামো
অসাড় পড়ে আছে বালির চরে

তোমাকে মনে পড়ে
বলো, এখন কি আর প্রণাম করা চলে?
পূজার সমস্ত মাটি ধুয়ে গেছে জলে

শুভ্র বসন, নাকের নোলক— দূর কোনো বন্দরে
আমাদের সমস্ত অনুরাগ ছেড়ে যাচ্ছে ভূমি
বিসর্জন সুরে

তোমাকে মনে পড়ে
এই যে অলস বিকেল, ঠাকুরের ভেসে যাওয়া চুল
এমন ফুটে আছে— যেন বিষাদও এক ফুল

নার্স

ওই দূরে

শুকিয়ে যাওয়া বৃক্ষের ডালে
কয়েকটা পাখি এসে বসেছে
কেউ শিস দিচ্ছে

কেউ ঠুকরে ঠুকরে খেয়ে নিচ্ছে পোকা

কুকুর


ব্যস্ততা এক কুকুর
ক্ষ্যাপাটে কুকুর
এর থেকে পালিয়ে বাঁচুন


একাকিত্ব
কুকুরের থেকেও ভয়ংকর

স্যালভেশন ৩

অসময়ে, ফুলও বড়ো ভারী লাগে
তবুও সম্ভাবনাময়, ধরো,
গাছের কালো ছায়ার উপর ছড়িয়ে দাও
ফুটে থাক—

এখন এ-সময় বড়ো প্রতারক।
শান্ত হও, একবার বোঝাও তাকে

দুঃখকে যে মেরে ফেলে, আসলে সেও ঘাতক

ইউরেকা

সমস্ত

সমস্ত দুঃখ বলার পরেও
কিছু দুঃখ থেকে যায় গোপনে

বুকের
অনেক
নীচে

পচতে শুরু করে। পচতে পচতে একদিন হঠাৎ
কেউ এসে বলে: এ তো জৈব সার। খুব উর্বর

Categories
কবিতা

সরসিজ বসু

ছান্দোগ্য বিনিয়োগ


যে কং সে-ই খং, যা খং তা-ই কং
যে রাহু সে-ই শির
        রাগরাজ, অমর মস্তক!

প্রতীকের নীচেই অন্ধকার

কথকতা অতিগ্রহ, তুশ্চু বারো আনা
সকলে একত্র হয়েও ভগবান হন না
অথচ একটু পুঁজিপাটা হলে কেউ তাঁকে ছাড়িয়ে ওঠেন


হাসিনামা লেখা হচ্ছে, লেজুড় হয়েছে হাস্যজন
এতটা জামিনযোগ্য থাকবে না এই হাস্যরস

মৃত্যুভয় ভেঙে গেছে বলে
যে-ঔদাসীন্য শেষে আসে
সুরুতেও যদি তা থাকত!

প্রশ্ন করবার বেলা সবাই মেধাবী, মহালোচ্চাগুলো
তদন্তে বাধা হয় এমন গজলও গাওয়া অনুচিত


সফরের পদে পদে আমি কত শূন্য দেখলাম
যে-দেশে যেমন শূন্য, যার কাছে যত আক্ষরিক
রক্তশূন্যতার সঙ্গে ভারসাম্য রেখে
যদি কোনো অছিলায় শূন্যের শরিক হওয়া যায়,
গুজব পাগল দেশে পালাবার তাড়াহুড়ো থাকে

অবিদ্যা ও অপরের বিপরীত রতি
কত নোংরা ভোগমূল্য বাজারে ছেড়েছে!


বারে বারে আর আসা যাবে না: এই মেঠো গানে
প্রণব পুটিত করে নিলে
সেটাই দিনের বড় আপডেট হয়

হৃদয় মৌচাক নয়, গানের ছেপ্‌কায়
প্রসাদী জনমত ঘুরছে শহরে
       নির্দোষ জীবন তুমি ধুয়ে খাবে?

লজ্জাকে ললিতকলা ভাবতেই পারো


তুমি কিন্তু অনেক দূরের কোনো পায়ের আওয়াজে
পা মিলিয়ে হাঁটো,
স্বচ্ছন্দে গিলতে পারো অনেকের গলার আওয়াজ

একখানা সর্ষেপুরাণ যদি লেখা হত!

যে-কথা বলার নয় সে-কথা কোথায় পাওয়া যায়
নিজের কোলেই শুয়ে কত-না ভেবেছ!

তুমি পঙ্‌ক্তিদূষক, তোমাদের দেবতা আলাদা

Categories
2021-JUNE-KOBITA কবিতা

অর্ঘ্যকমল পাত্র

ধ্রুপদী

আমার বন্ধুরা কত কথাই বলে, তোমাকে দেখলে
তোমার বন্ধুরা কত কথাই বলে, আমাকে দেখলে

অথচ,
আমি তোমাকে দেখলে চুপ
তুমি আমাকে দেখলে চুপ

আমাদের বন্ধুরা কত কথাই না বলে
আমাদের দেখলে…

অপেক্ষা

সে আসতে পারে শেষ মুহূর্তে—
এই কথা ভেবে
আমি মুহূর্তকে আর-ও দীর্ঘ করে রাখি

যে-কোনো মুহূর্তে সে আসবেই—
এই কথা ভেবে
আমি মুহূর্তকে বড়ো বেশি ছোটো করে ফেলি

এবং এর ফলে
মুহূর্তেরা ভেঙে যায়
টুকরো করে আমাকে!

অসুখ

যে-বৃষ্টি তুমি চেয়েছিলে
যে-বৃষ্টিতে তুমি ভিজেছিলে সারারাত

সে-বৃষ্টিকে চোখেও দেখিনি আমি।
আমি কেবল চেয়েছিলাম
তার গন্ধ…
এই
এবং বৃষ্টির গন্ধে
ঘুমিয়ে পড়েছি সারারাত…

তৃতীয় বিশ্ব

পাহাড়ের গল্প মাঝেমধ্যেই শুরু হয়
পাহাড়ের গল্প কোনোদিনই শেষ হয় না

এবং যাদের কোনোদিন-ই
কোনো পাহাড় দেখা হয়নি
পাহাড়ের গল্প শুনে
তাদের ভিতরে ভিতরেও

একটা বিশাল পাহাড় জেগে ওঠে

যে-সব আর কিনে দেওয়া হল না

চুড়ি
শুধুমাত্র শৌখিন সৌন্দর্য
বেশিদিন থাকে না

ভেঙে যায়। চুরমার…

টিপ
সংস্কারে বিশ্বাস নেই। জানি।
অসতর্কতার মতো পুনরাধুনিক তুমি

অগত্যা তোমার কপালে
পরিয়ে দিতে চাই না— আমার চিহ্ন

কাজল
এ যেন তোমার
উতলা চোখের বালি।

কোনো কোনো ঢেউ আসে
ঘেঁটে দেয়…

লিপস্টিক
সে তো
ঠোঁট শুকিয়ে যাওয়া মেজোবোন

শুধু গান ধরলেই
উজ্জ্বল লাগে সব কিছু!

Categories
2021-JUNE-KOBITA কবিতা

রাজর্ষি দে

ওবিচুয়ারি

আমি শুধু মুছে গেছি জলে
অমেয় বালি দানা ঝরে গেছে ঘড়ি থেকে
বালি পড়ে কিচকিচ দৃষ্টি ঝাপসা হল কার
তার হদিস তত্ত্বতালাশ আপাতত থাক
অযথা বোঝা ভারী করে কাঁধ

সমাহিত বিকেলের দিন ঢলে গেল কবে
কবে?
সে-হিসেব রাখিনি তো
হঠাৎ জানালায় চোখ গেলে
বুক খাঁ-খাঁ করে ওঠে
ফেরিওয়ালা ডেকে গেলে মনে পড়ে
কার কার ডাক ফাঁকি পড়ে গেল

বন্ধুরা ভালো আছে
আত্মীয়পরিজনও
নিশ্চয়ই
অবশ্য ডিসেম্বর হতে হতে কত স্বজন ঝরে গেছে
সে-হিসেব রাখেনি দশ-পাঁচের খাতা
আজ বটতলা একা
টর্চ ফেলে দেখি
শেষ পত্র যাই যাই করে

তবু
টেবিলে পেনটা পড়ে আছে
আলমারি ঝাড়লে
এখনো দু-তিনটে শখের জামা পাবে
সূদুর কাপ্তানির অবশেষ—
দু-সাইজ ছোটো জিন্স
এইভাবে জঞ্জাল পোষে কেউ?
ফেলে দাও, ফেলে দাও
সব দিক শান্তিকল্যাণ হোক

মারিজাতক পঙক্তিগুচ্ছ

এ অদ্ভুত অন্ধকারে একলা আলো দিচ্ছে চিতা
*
জলে যার লাশ ভেসে গেল তার ছিল সাঁতারে অনীহা
*
শ্বাসের মূল্য মিটিয়ে দিতে ভাতের ভাঁড়ারে চাবি
*
মুখোশ পরা নিষ্কলঙ্ক হল্
*
যে-কোনো স্পর্শ স্যানিটাইজ করে নাও
*
সন্তান মরে গেলেও বিড়ম্বনা বাড়ে

লিপ টু লিপ

শ্বাস না পেলে নীল লাগে
দৃষ্টি বিন্দু হয় নক্ষত্রের মতন
ধ্রুবতারা ফিশফিশ করেছে শ্বাপদের কানে
এইবারে সভ্যতা ঝরে যাবে প্লাস্টার হয়ে
স্যান্ড-পেপার ঘষা হাপরের ডাকে
ক্ষুৎপিপাসাও দূরে যায় (দারাপুত্র এ-ক্ষেত্রে অলীক)

একটু হাওয়া ছাড়ো প্লিস
অন্তত এই অজুহাতে, হয়ে যাক লিপ-টু-লিপ

দু-হাত রেখেছি মাটিতে

বিষ শুষে নিই কানা চোখে
বিশ-আঙুল শিকড় বুনি
চতুষ্পদ কুকুরের ধারা
জ্বর পেটে চাঁদ খেয়ে নিই

চব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয়

হাড়মাস খেয়েছিস শালী
আমিও ছিঁড়েছি নাভিডোর
কে কাকে খেয়েছি আগে পিছে
মাংসের গুণ মাপা হোক

পোয়াতী ঘাসের দুধ

পোয়াতী ঘাসের বুক বেয়ে
শিশিরের দুধ ঝরে পড়ে
শুষে নিলে মা-হারা যুবক
প্রেমিকার নাভিমূল পড়ে

Categories
2021-JUNE-KOBITA কবিতা

সায়ন

নাকছাবি ভাঙা দেশ!


জানালা খোলো, আলোপাহাড়ের দেশ
প্রিয়ার কাজল, জেলের মধ্যে নাতাশার হাত মুঠো
বিদুৎ লিখি অন্ধগলির ভাষায়

নিষ্ঠুর চাঁদ, পাখিনীর ঈর্ষা বিলাপ
আয়না দেখে গণতন্ত্রের হাড়-মাস

মেঘ আসে, চন্দনকাঠের আগুন
দেওয়ালে কি আছে জানো? বিরাট ছোবল—

যত রাত গেছে কেটে
কাচের ছায়া
মনের উপর ছেয়ে গেল
নাকছাবি ভাঙা দেশ


কে যাও ওই পথে, আশ্রয়
পাথর এঁকে দেয় তোমার রক্তাক্ত নূপুর
কত ঢেউ ঝাপিয়ে পড়ে ছাদের মাটি
গাছের হাতে বাঁধা মধুবনী আঁচল

হরিণের জেগে থাকা চোখে নামে বৃষ্টিভরা মেঘ
ওই দেখো— কী বিরাট চুলে ফাঁস লেগেছে সন্ধ্যামালতি চাঁদ,
পীতাভ নদীঘর, জলের নীচে জল
এই গর্ভ বৃন্দাবন, আমাদের ভারতবর্ষ প্রাণ
বাধ ভাঙনের আলিঙ্গন

সমুদ্রের ওপারে সুন্দরী গাছের ঘর
নগরের আকাশ গলা চাঁদ নিয়ে পুঁথিপাঠ
পাথরে বসে স্পর্শ করে অক্সিজেনহীন দেশ


মাজারের ভিতর লুকিয়ে আছে মানুষ,
ইট পাথরের দেহ। সাঁইজি তার সাধনানীলের গান ধরতেই, উঁচুতে লাফ দিল পিতার কলজের আগুন।

তমালতলা আর বেনুবনছায়ার জলে— লালনের কোলজে রঙের ছায়া। জ্যোৎস্নার আলোয় ডুবে যাচ্ছে অলীক মানুষের সংসার!


আমরা ফিরে এলাম বধ্যভূমির আখরায়
স্বচ্ছন্দ মৃত্যুছাপ, প্রাচীন ভূমিতাপ গন্ধ।
পাঁজরের ইতিহাস লিখতে লিখতে আঁকড়ে ধরি ভগবানের কবজি… বরাহমিহিরের খাতা
মেঘের কাছে দেখি— বৃষ্টির ভেজা চুলের আকাশ

এখন সকাল হয় শিশির আর সায়ানাইড বিন্দুর মাঝে।


ঝড়ে পোড়া হাজার চাষির চিৎকার, থালায় কান্নার গ্রাস
বন্ধ দরজায় ওলট-পালট হয়ে যায়
যাকে তুমি কোনো একদিন
ছায়ামানুষের দেহ ভেবে চেয়েছিলে ভোট।

লোকটা দৌড়ে এল বহু দেশ, নগর, গ্রাম, খাপ পঞ্চায়েত— তবুও ওর কোনো দেশ নেই

এখন শুধু হাত ভরা করোটির বোঝা,
ডান হাতে স্ট্র্যাপ ছেঁড়া চটি।

 

Categories
2021-JUNE-KOBITA কবিতা

তমোঘ্ন মুখোপাধ্যায়

স্বজনকথা


গাছবৃত্তে লেখা পদ্য। গাছশীর্ষে ন্যুব্জ মাতা-পিতা
উঠে দেখছে কামপ্রবাহ; কালো আকাশ উন্মুক্ত স্তন।
“আয়” ডাকছে, “আয়” ডাকছে, আমি সে-স্তন মুঠোয় রাখি যেই
ঝরে পড়ল ন্যুব্জ মাতা, ন্যুব্জ পিতা— হলুদ বিদ্যুৎ।
শ্মশানবঁধূ কাঠ সাজাল, কাঠ জ্বালাল, গাছবৃত্তে লেখা
পারিবারিক হাড় জ্বলছে; চিতাকাষ্ঠে ন্যুব্জ মাতা-পিতা
কুঁকড়ে গেল; অন্ধকার; আলো ফুটলে ন্যাড়ামুণ্ডি হই।
মুঠো শক্ত, স্তনমাংস আদরে নয় ব্যথায় কাতরায়।

ন্যুব্জ মাতা, ন্যুব্জ পিতা একসঙ্গে বৈতরণী পার।
আমি দেখছি প্রতি পর্বে পাতাবর্ণ বাদামি হয়ে যায়।
“আয়” ডাকছে, “আয়” ডাকছে গাছবৃত্তে জন্ম নেওয়া জরা।
তর্পণের সময়কাল। মায়াকুণ্ডে চংক্রমণ করি।
গাছবৃত্তে লেখা পদ্য শিকড় ভেঙে আছড়ে পড়ে মাঠে।
ন্যুব্জ মাতাপিতার মুখ আকাশস্তন চুষছে সারারাত…


অন্ধকারে নেমে আসছি। স্বপ্নে কার খুকির চিৎকার
খুনদৃশ্য দেখার মতো তীক্ষ্ণ ভয়ে হঠাৎ জ্বলে ওঠে?
হত্যা এত কঠিন, তবু কোথাও কোনো প্রশিক্ষণ নেই।
অন্ধকারে নেমে আসছি। গঙ্গাজল, আমায় ত্রাণ দাও।
এখন যাকে অনাত্মীয় ভেবেছি, তার আত্মীয়-শরীর
গলা বাড়ায়। ছাগের গলা। খাঁড়ার মতো আমার স্পৃহা নামে।
অন্ধকারে মাথা গড়ায়। স্বপ্নে কার খুকির চিৎকার
খুনশব্দ শোনার মতো মুগ্ধ শোকে হঠাৎ জ্বলে ওঠে?

এখন শোক অনপনেয়। অথচ খুকি বোধের মতো চুপ।
কার যে মেয়ে! আমার? তবে স্বপ্নে কেন মুখোশ-পরিহিতা?
দেখেছে তার বিশাল সখা হত্যা শেষে শিশুর মতো কাঁদে।
অন্ধকারে নেমে আসছি। স্বপ্নে তার মাটির মতো হাত
আমার হাত স্পর্শ করে; রক্ত ছুঁয়ে মোমের মতো জ্বলে।
অনেক হল! গঙ্গাজল, বাপ-বেটিকে এবার ত্রাণ দাও।


এই আমার ঘর-দুয়ার। হিংস্র থেকে হিংস্রতর রোজ।
পশুর মতো দু-তিনজন। ক্ষুব্ধ খুব। হাঁড়ির জল ফোটে।
ফুটতে থাকি সপরিবার। ধোঁয়ার মতো অলীক, নিরাকার
এই আমার ঘর-দুয়ার শূন্যে উঠে শূন্য পেড়ে আনে।
বৃত্তে বসি। শূন্য খাই। চিন্তামণি বঁটিতে আঁশ ঘষে।
হিংস্র থেকে হিংস্রতর। ভাতের থালা বিষের চোটে নীল।
সে-বিষ শেষে কথামৃত। শরীর থেকে মায়া-প্রপঞ্চর
আদিম বীজ বেরিয়ে যায়; ঘর-দুয়ার মৃতের মতো চুপ…

এই আমার দুয়ার-ঘর। মন্দিরের সাপের মতো রোজ
দৈব কোনো লিঙ্গ ভেবে আমার আয়ু জড়িয়ে জেগে থাকে।
চিন্তামণি বঁটি জাগায়। আমার আঁশ সিঁটিয়ে যায় ভয়ে।
মাছের মতো দু-তিনজন। বেকুব খুব। কড়ায় তেল ফোটে।
আঁশের মায়া তলিয়ে গেছে। সবার দেহ নুন-হলুদে মাখা।
এই আমার ঘর-দুয়ার। চিন্তামণি, জমিয়ে রাঁধো। খাই…


রোগ বিদ্যা। রোগ বন্ধু। উড়ে মরছে আরোগ্যের ছাই।
ঘোর চিনছি। জড় চিনছি। বাস্তবিক জড় কিচ্ছু নেই।
প্রাণবাষ্প ঘিরে ধরছে। দূরে মৃত্যু একা। অপেক্ষায়…
ঘোর কিন্তু যুবতী আয়া। রাত বাড়লে পথ্য কাছে রাখে।
খাদ্য গেল ভিতরে আর তখন থেকে প্রবল বমিভাব।
রোগবন্ধু শিয়রে বসে; কানের পাশে ঠান্ডা মুড়ো নামে—
“এখন থেকে লেখার হাত দাসানুদাস, বশংবদ নয়।”
রোগ বিদ্যা। রোগ বন্ধু। উড়ে যাচ্ছে পঙ্গু স্থিতিকাল।

স্বজন ছিল লিখনকাম। এখন হাত আমার আওতায়
থাকে না আর; পৃষ্ঠা বোঝে রমণগতি বদলে গেছে খুব।
সে স্বৈরিণী, তবুও তার শরীর কাঁপে। গর্ভপথ জড়।
কিন্তু, দ্যাখো, জড় চিনেছি। বাস্তবিক জড় কিচ্ছু নেই।
প্রাণবাষ্প ফিকে হচ্ছে। মরণ কাছে। রভস উবে যায়…
রোগ বিদ্যা। রোগ বন্ধু। ক্রমান্বয়ে আমার মাথা চাটে।


ক্ষণজন্মা আমি একটি সুলক্ষণা মেয়ে পয়দা করে
স্ত্রী-র গর্ভ খুশি করেছি। আঁতুর ম-ম করেছে তার ওমে।
আমার ঘাড়ে তিন-চারটে ফুটোর মতো জন্মদাগ দেখে
গুরু আমায় বলেছিলেন, “গতজন্মে সদ্যোজাত মৃগ
ছিলিস, তোর ঘাড় কামড়ে এক বাঘিনী আরামে খেয়েছিল…”
আমার স্ত্রী বা মেয়ের জ্ঞানে এ-সব কিছু রাখিনি। তবু রাতে
খেলাচ্ছলে মেয়ে আমার ঘাড়ে নরম থাবা বোলায়, বলে—
“এগুলো ছুঁলে ব্যথা লাগছে? এ-দাগগুলো কোথায় পেলে, বাবা?”

স্বপ্নে দেখি মেয়ে আমার সেই বাঘিনী; চক্ষু জ্বেলে ঘোরে।
এই আমায় দেখল। ছুট। ছিটকে যায় অরণ্যের মাটি।
আর্তনাদ। দু-একবার। ঘাড়ের পেশী কামড় মেখে স্থির।
আদরমুখো তিন শাবক কিছুটা খেল… বাকিটা মেয়ে খায়…
“এ-দাগগুলো কোথায় পেলে? এ-গুলো ছুঁলে ব্যথা লাগছে, বাবা?”
ঘুমপুতুল মেয়ের গায়ে খুঁজে মরছি কালো ডোরার শোক…


মন্ত্রখাকী ঘর আমার। চিবিয়ে খায় মারণ-উচাটন।
বশবর্তী রাখতে চাই। কিন্তু ঘর এমন চঞ্চলা,
মধ্যরাতে উলটে দেয় লক্ষ্মীভাঁড়। পয়সা ছড়াছড়ি।
পয়সা যে-ই গড়িয়ে পড়ে, সারা উঠোন প্রবল বেঁকে যায়।
মন্ত্রখাকী ঘর আমার। যাগ-যজ্ঞে নরমুণ্ড ছোঁড়ে।
নরকরোটি অগ্নি ছোঁয়। সত্ত্বগুণ সিঁটিয়ে যায় ভয়ে।
ভয়? না মোহ? চিলেকোঠায় চুল বিছিয়ে দুর্বিপাক বসে।
যজ্ঞাহুতি কিচ্ছু নেই। সমিধ ডোবে মারণী বন্যায়…

শুধুমাত্র একতারার পরাৎপর ধুন জাগালে কেউ,
ঘর-দুয়ার ঘুমায়। সুখ। খোকার মুখে চাঁদের দুধ নামে।
বাপ-পিতেমো যে-শাপ পেয়ে অন্ধপ্রাণ, দৃশ্য থেকে দূর,
সে-শাপ নেভে; দৃশ্যাতীত স্বপ্নঘোরে দৃশ্য হয়ে যায়।
অলপ্পেয়ে ঘর আমার অলখ্ সাঁই দেখার লোভে-লোভে
আমায় ফের বাউল করে ভাসিয়ে দিল ত্রিনদী সঙ্গমে।