Categories
কবিতা

পঙ্কজকুমার বড়ালের কবিতা

নিঃঝুম শূন্যতা ওড়ে


রাতের ভেতর রাত৷ ক্রমশ গহীন বন, ছোটো ছোটো টিলা৷ মনোরম ঘাসের গালিচা পেতে শিশির ঘুমায়৷ গাছে গাছে জোনাকি আলপনা৷ একটি নদী, তার হাঁটু জলে হেঁটে যায় নুড়ি— কাঁকড়, ছোটো মাছের ঝাঁক৷ একসময় চকিতে উঁকিমারে বুনো চাঁদ, তারপর ডানা মেলে এগিয়ে আসতে থাকে৷ বাতাস ওড়ে, বাতাসের চুল থেকে খসে পড়ে অচেনা ফুলের সুবাস৷ সমীরণ টিলার বুকে মাথা রাখে, যেন তপস্যা ক্লিষ্ট কোনো ঋষি এইমাত্র ঘুমিয়ে পড়েছে৷ তার একটি হাত বুকের উপর পরম নিঃসঙ্গতায় লীন হয়ে আছে, অপরটি ঝরাপাতার মতো মাটির শরীর জুড়ে এলিয়ে রয়েছে— এখন চরাচর জুড়ে ঘুমের জগৎ৷ কোনো অপেক্ষা নেই, যন্ত্রণা বিবশ হয়ে আছে, ইচ্ছের দুয়ার এঁটে দিয়ে না পাওয়ারা গান হয়ে ভেসে গেছে অলীক আকাশে৷


জাগো হে, জাগো— চেতনা দোলা দিয়ে ওঠে৷ অজান্তেই হাত চলে যায় পাশে৷ কে ডাকে! পাশ বালিশের শরীর জুড়ে ছড়িয়ে থাকে কোমল অভিমান৷ ধীরে ধীরে চোখ মেলে সমীরণ৷ জানলা দিয়ে চুঁইয়ে নামছে আলো৷ তার নরম ছোঁয়ায় উঠে বসে সে৷ কী এক স্বপ্নের ঘোর, যেন মাথার ভিতর রাশি রাশি তুলো গোঁজা৷ এক অদ্ভূত অনুভবে সে যেন ডুবে যেতে থাকে৷ বাইরে উঠোন জুড়ে শালিকের ডাক৷ গাছের শিরা বেয়ে নেমে যাচ্ছে রৌদ্র শিহরণ৷ একসময় দরজায় টোকা পড়তে থাকে৷ সমীরণ বুঝতে পারে না কোন দরজার কড়া নড়ে যায়৷ কেবল টোকা পড়ে৷ দরজার শরীর জুড়ে শব্দ ওঠে ঠক্..ঠক্..ঠক্৷


যেন কোথাও কিছু নেই, অশেষ আকাশ৷ একটি ঘুড়ি সুতোহীন উড়ে যেতে থাকে৷ ঘুড়ির পিছে পিছে ডানা মেলে দিনের ছায়ারা৷ সমীরণ বসে থাকে দীঘির পাড়ে৷ সমস্ত দীঘি জুড়ে হাঁসের সফেদ৷ তাদের চঞ্চুর ধারে ক্ষয়ে যায় বাতাসের আয়ু৷ সমীরণ সে সব দেখে অথবা দেখে না৷ সে শুধু বসে থাকে৷ যেন একটি প্রকাণ্ড চাকার উপর বসে আছে সে৷ চাকাটি ঘুরতে ঘুরতে নেমে যাচ্ছে মহাতলের দিকে৷


প্রাণপনে মাটি আকড়ায় সমীরণ৷ সে যেন একটি গাছ৷ একমাথা ডালপালা, শেকড়ে পলির উষ্ণ ঘ্রাণ৷ আর একটি লতা, ফুলে ফুলে ফলের আকুতি নিয়ে সে যেন জড়িয়ে আছে সমস্ত ভূবন৷ সবুজ রক্ত চলকে উঠছে তার৷ অতঃপর স্বপ্ন আসে, কত স্বপ্নের কথাবিতান পৃষ্ঠা মেলে দেয়৷ অভিমানের নিঃশ্বাসে লতা গাছটি গুমড়ে ওঠে— কথা বলো, কথা বলো গাছ৷


মনের বাগান জুড়ে টুপটাপ পাতা খসে যায়৷ ময়ালের মতো নিঃশব্দে বয়ে চলে হাওয়া৷ সমীরণ বুঝতে পারে তার ভিতরে আর কোনো গান বেঁচে নেই, স্বপ্নের পাঠশালা ভেঙে গেছে কবে! ক্রমশ শুকিয়ে যাওয়া শিকড়ের ফাঁস ঢিলে হয়ে গেছে৷ এখন কেবল নিঃশেষের পালা৷ যে মনে ফোঁটেনি ফুল, সবুজের হাতছানি, যাবতীয় রঙের বাহার তার কাছে বোবা আয়োজন৷


তবুও এক স্পন্দন জেগে থাকে বুকে! কী আশ্চর্য, কী দারুণ যন্ত্রণাময়! জমে থাকা ঘন কালো মেঘে বিস্ফোরণ ঘটে গেলে যেমন হঠাৎ চলকে ওঠে আলো, তেমন এক স্পন্দন মাঝে মাঝে গুমড়ে ওঠে বুকে, নিঃশব্দে বজ্রপাত হয়৷ সমীরণ চোখ বন্ধ করে৷ তারপর দেখতে থাকে নিজের ভিতর৷ শত শত ছায়াপথ, ব্রহ্মাণ্ড ছাড়িয়ে আরও দূর, গহীন দূরত্বে, যেখানে কেউ নেই, কেবল শূন্যতা৷ অথবা শূন্যতাহীন অপার স্পন্দন৷

Categories
কবিতা

শাশ্বতী সান্যালের কবিতা

পারদ-হে প্রিয়


এখন জ্বরের দিন। তোমার দাঁতের স্বাদ ভালো নেই

ডাঁসা আপেলের মাংসে ভরে আছে ফ্রুটবাস্কেট
তাদের গোলাপি স্তনে পুরুষের দংশনের দাগ
খুঁজে পায়নি নারীরক্ষা সমিতির হুজুগে বাবুরা…

এখন জ্বরের দিন। ডুমোডুমো নীল মাছি
বসে আছে ফলের দোকানে।


সোরা ও গন্ধক মিলে তৈরী হয় কোনো কোনো পুরুষ শরীর
সামান্য জ্বরের আঁচে লোহাচুর দুমুঠো মিশিয়ে
বিক্রিয়াকঠিন তার মুখ দেখতে ভালোবাসে মেয়েমানুষেরা

ডোরাকাটা গামছা দিয়ে গা মুছেছ কতদিন পরে…
প্রথম ভাতের স্বাদ আর তন্দ্রা নিয়ে
ভেজা বারুদের টিন মেলে দিয়ে বসেছ রোদ্দুরে

গোলাপি মুখের আভা। সাঁঝের পোহাল শেষে
খুব মৃদু কুপি জ্বলে উঠেছে কোথাও

রক্তের ভিতরে যে লোহা পুষে রেখেছি, সে কথা
জ্বরের বিকেলে আজ, ভুলে গেছ?
ভুলে যেতে চাও?


দু-এক ঘর পারদ উঠে গেলে আবার তো জড়িয়ে ধরবে
আবার বিষের মতো ঘুলিয়ে উঠবে নীল জল
আদিবাসী মেয়েটির গোড়ালির ক্ষত থেকে, পুঁজ থেকে,
হাঁড়িয়া অমনিবাস থেকে
তোমাকে শক্ত করে তুলে আনব বিছানায়, সফেন চাদরে

ভয় নিয়ে, আশঙ্কা নিয়ে,
ওষুধের স্ট্রিপে সেই পুরোনো সোঁদর গন্ধ নিয়ে
পাহাড়ে নদীতে বনে পেতে দেব শতরঞ্চিগুলো
দু-ঘর একঘর ক’রে
পুরোনো জলের নীচে দেখা দেবে কবেকার বিষ

সময় ভীষণ কম,
আবার তো জল খসে গেলে

খাদের উপর থেকে নীচে পড়ে যাবে কোলবালিশ…

ঊষা

এই সেই বিতর্কিত সূর্যোদয়

সহজ ধুলোর দেশে
মেয়েদের পায়ে পায়ে
ফুটে ওঠা সৌরকুসুম

তরল সোনালি রোদ? হেমলক?

আকন্ঠ পানের পর
জল আর পাথরে লুকোনো
অচেতন পুরুষের পাশে, এ ব্রাহ্মসময়ে
জেগে উঠছে একে একে
দৃশ্যপট, পাখিদের ঘুম…

দাহঘাট

যেকোনো মৃত্যুর গায়ে আপনার মুখ লেগে আছে।

ভাবি, কোনোদিন যদি ভোরে টেলিফোন বেজে ওঠে
প্রতিবেশীদের ঘরে
টেলিফোন বেজে ওঠে, আর… জেনে ফেলি যদি
ছাপাখানা থেকে দূরে, নিঝুম শ্মশানে
একে একে পুড়ে যাচ্ছে আপনার ধবল কবিতা

আমার প্রণাম নেই। পাপ নেই। দাবি নেই। ভাবি,

এত এত রং নিয়ে, সেই ভোরে, কার কাছে যাব?

বিশ্বাস

একমাত্র লেখা পারে উড়ে যাওয়া চাল বেঁধে নিতে

গেরস্থ ঘরের জল-থইথই মেঝে থেকে
খুদকুঁড়ো- খিদে শুদ্ধ, এনামেল থালা শুদ্ধ
তুলে এনে, শীতে
একমাত্র লেখা পারে গরম ভাতের হাঁড়ি
ফ্যান গেলে দিতে

বিশ্বাসে মিলায় বস্তু
বিশ্বাসে নদীর চরে ফুটে ওঠে কাশ

আজ না ফুটলে, কাল

একমাত্র লেখা পারে এতসব কুসুম বিন্যাস

লেখা পারে? পারে বুঝি? কবে পেরেছিল?

Categories
কবিতা

শৌভ চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা

ধ্বংসের দিকে ফেরানো একটি মুখ


এসো, আলো জ্বালি। আর দেখো, কাচের ঢাকনার ওপর একটি মথ কেমন চুপ করে বসে আছে। আবার কখনো, আলোটিকে ঘিরে, উড়ে বেড়াচ্ছে পাগলের মতো। যেন এই আলোটুকুই তার সমগ্র অস্তিত্বের কেন্দ্রবিন্দু। আসলে, একটা কেন্দ্র ছাড়া, অস্তিত্বের কল্পনাও অসম্ভব বলে মনে হয়। এমনকী অনুপস্থিতিও, ক্ষেত্রবিশেষে, একটা কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে। পারে না কি?

আডর্নো বলেছিলেন, “আউশভিৎসের পর কবিতা লেখা, বর্বরতার নামান্তর।” যদিও, তাঁর এই কথা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারি না। আমার বিশ্বাস, পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবার ঠিক আগের মুহূর্তেও, কেউ না কেউ, নিশ্চয়ই একটি কবিতা লিখবে। যে-কবিতার কোনো পাঠক থাকবে না। যার শরীর থেকে, আস্তে আস্তে মুছে যাবে সমস্ত দৃশ্য, শব্দ, আলো আর ভাষা। শুধু এক অস্ফূট দীর্ঘশ্বাসের পালক, শূন্যের ভেতর, ভেসে বেড়্রাবে—ঘুরে, ঘুরে, ঘুরে, ঘুরে…


ঘুরে-ঘুরে, কেবলই ভাষার কাছে ফিরে আসছি।
দেখছি, ভাষা দিয়ে, গোটা একটা পৃথিবী
বানানো সম্ভব কি না। যদিও আমি ছাড়া,
আপাতত, সেখানে আর কোনো জনপ্রাণী নেই,
শুধু কিছু নুড়ি-পাথর, একটা শুকিয়ে-আসা ঝর্ণা, আর
অচেনা উদ্ভিদ, গুল্ম, এটুকুই…

ভাষা আগে, না কি দৃশ্য ও বস্তুপুঞ্জের এই
প্রসিদ্ধ সমাবেশ? ভাবতে ভাবতেই দেখি, চারিদিক
কেমন অস্পষ্ট হয়ে এসেছে। পায়ের তলায়,
মনে হল, মাটি কাঁপছে। তবে কি এবার
এই আলোটুকুও আর থাকবে না, নিভে যাবে?

মাঝেমধ্যে ভাবি, অন্ধরা ঠিক কীভাবে কবিতা লেখেন!


ছায়া যখন রয়েছে, তখন, কোথাও না কোথাও—তা সে যত দূরেই হোক, বা যতই ক্ষীণ—খানিকটা আলো যে এখনও রয়ে গেছে, এ-বিষয়ে আমাদের মনে আর কোনো সংশয় রইল না।

আমরা ঘাড় উঁচু করে, ওপরের দিকে তাকাই। ধূসর আকাশের গায়ে, নাম-না-জানা গাছের আঁকাবাঁকা আঙুল। ও তাদের কালো, গ্রন্থিময়, কুব্জ শরীর। একটা পাখি, কোথায় যেন, হঠাৎ চীৎকার করে ডেকে উঠল। এই হাওয়া—সাপের মতো ঠান্ডা, আর পিচ্ছিল—যার স্পর্শে, শরীর বিষিয়ে ওঠে।

এমন দিন কি সত্যিই আসবে, যখন কোনোখানে, আলোর এই সামান্য ইশারাটুকুও আর থাকবে না?

অন্ধকার মানুষকে যথার্থই সঙ্গীহীন করে। ভাবো, কী অসম্ভব সেই একাকীত্ব, যখন, এমনকী আমাদের ছায়াগুলিও, একে একে, আমাদের ছেড়ে চলে যায়!


ভাবো, কী অসম্ভব সেই মনস্তাপ, যখন তুমি
নিজের প্রিয় কুকুরটির মাথায় হাত বোলাতে-বোলাতে
আচমকা ট্রিগারে চাপ দাও, আর তারপর
একটা কেঁপে-ওঠা লালচে পর্দার ওপাশ থেকে,
একজোড়া ভাষাহীন চোখ, অপলক দৃষ্টিতে
তোমার দিকে তাকিয়ে থাকে, আজীবন।

সমুদ্রের ধারে, দাউ-দাউ করে জ্বলছে
একটা দোতলা কাঠের বাড়ি। কিছুদূরে, এক রুগ্ন বালক
শুকিয়ে আসা গাছের গোড়ায় জল দিতে-দিতে
আপন মনে কথা বলে উঠল, কতদিন পর!

“In the beginning was the Word.
Why is that, Papa?”

আমি চুপ করে থাকি। ধ্বংসের কিনারায়
একটা অদৃশ্য সুতোর মতো ঝুলে আছে
আমার নৈঃশব্দ্য।


নৈঃশব্দ্যেরও
নিজস্ব একটা ভাষা আছে।
ভাষাকে প্রত্যাখ্যানের মধ্যে
লুকিয়ে থাকে যে-উচ্চারণ,
তা আসলে আরেকটা ভাষাই।
তুমি বুঝতে পারনি।

তুমি বুঝতে পারনি, একদিন
কালো আর সূর্যহীন একটা সকাল
তোমাকে জড়িয়ে ধরবে।
আর তখন,
বেমালুম ভুলে যাবে তুমি—
কাকে বলে ঘুম,
কাকেই বা জেগে ওঠা বলে।

Categories
কবিতা

শতানীক রায়ের কবিতা

যুদ্ধহীন যদি কোনো দেশ থাকে…


দ্বীপ যখন শুরু হয়
উঁচুতে তাকিয়ে কেউ পাখিকে ডাকে
একটার পর একটা ক্রিয়া ঘটতে থাকে
মাটি আর মানুষের রসায়ন ছত্রভঙ্গ হলে
মাঝরাতে ডাকতে ভুল করে পাখি
কীরকম করে শরীর দেওয়া নেওয়া হয়
ভূগোলের কাছে গিয়ে প্রার্থনা আরোপ করে
ক্রিয়াগুলো আলাদা হয়
সবকিছু একত্রে ঘটে, কখনো আলো
কখনো অন্ধকারই সব কথা বলে
আলো যেদিক দিয়ে ফিরে আসে
ফিরিয়ে নেওয়ার নদী ফিরিয়ে দেওয়ার মাটি
এরকম করে একদিন আবার দ্বীপমুখী হই
মূলে যে-কয়েকটি কথা আছে সেটাও ঘরমুখী হয়।


এমন একটি জগৎ
যার দরজা জানলা নেই
আলো অন্ধকার নেই
শুধু ধানক্ষেত পড়ে আছে
পাখি উড়ে আসে।
চৌকো চৌকো চিহ্ন নিয়ে
চিত্রকর্ম ফুটে ওঠে
কোনো পাখিকে বসাতে পারো
উদোম দরজার দিকে
জগৎ আড়াআড়ি হতে পারে
রেখা ধরে হেঁটে যাওয়ার ভেতর
সবকিছু। সবই অনন্ত সবই অপেক্ষা
ধরা পড়ে মানুষের বিপরীত কিছু
চিত্রের ভেতর এমনও হতে পারে
অপেক্ষারত পরি— ডানার দিকে
কেউ দেখেনি আর হঠাৎ সে উড়ে যাবে।


সব কিছু নিয়ে
একটা উদাসীন পুকুর।
জলাশয়ের অধিকাংশই পড়ে থাকে
দেখার জন্য এই ত্রিকোণ না
চতুষ্কোণও কিছু না
তেমনভাবে শহরের পর শহরে
কেউ গান গাইলে
পাখি ওড়া দেখলে
ঘুম ভাঙা— ঘুমোনো দেখলে
কে— কোন মানুষ
কী বলে উঠবে
সরল হিসেব নেই
মাছরাঙার যে কথা ছিল
পৃথিবীর যে ভিন্নতা ছিল
এবং বহুদিন পর
মূল কথা
বলার মাত্রা নিয়ে
যে-সব মানুষদের
সব… সবই চলে গিয়েছে
জল হয়েছে এত বড়ো
বিস্তারিত হয়ে বকুল গাছে
স্বপ্নের স্থপতি।
যারা শব বহন করে এনেছে
সিঁড়ি হয়ে নেমেছে দৃশ্য
অন্ধ করোটি
কিংবা শরীর
শরীরের সেই
কবিতা জমা থাক
বা উজাগর হোক।
বা না-হোক।


বাগানে একদিন…

তন্দ্রাঘোরে সে বাড়ি ফিরছে। ফেরার পথে অনেক আমবাগান লিচুবাগান পেরিয়ে আসতে হবে ওকে। সুন্দর নিকোনো উঠোন পাচ্ছে না সে। তাকে পাথরের কাছে মাথা ঠেকাতে হবে। একটু বসে জিরোতে হবে তারপর আবার উঠে যেতে হবে গৌর রঙের আকাশের দিকে তাকিয়ে তারই কোনো কৈশোরের বিকেলে। অতৃপ্ত ঘোর বাসনা থেকে সে যখন মনে করেছিল আজকের গল্পটা পুরোপুরি বাদ দিয়ে নতুন করে একটা গল্প লিখবে। হয়ে ওঠেনি। এই আমবাগানেই সে এসে হাজির হয়েছিল। আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল আর হারিয়ে গেছিল। কেউ ডেকেছিল পাতার স্তূপের আড়াল থেকে কোনো পৃথিবীতে। জঙ্গল আর জলের সঙ্গমভূমিকে সে প্রথম বুঝেছিল। সে কীভাবে পুরুষ হতে গিয়ে নিজেকে দেখেছিল। গাছের ঝুলে থাকা ফল আবিষ্কারে। ঝড়ের ঝাপটায়। উপড়ে তোলার ক্রমশ সে তার ভেতর থেকে বেরিয়ে কোনো এক সমান্তরালে মধু রাখবে। ঘুমোতে যাবে এরকম তো কথা ছিল না। কেউ তো বলেনি এভাবে পাখির নতুন কথা তৈরি করো। তার জঙ্গল প্রাপ্তি হয়েছিল। ঘন সবুজ আর শুকনো পাতা মেশানো একটা জঙ্গল।


ঘুমের কথা শুধু বলে চলেছি। কেউ শোনে না। গাছটাকে বারবার সাবধান করলেও সেই-ই একই ফল হয়। পুরোনো ব্রাহ্মণ্যলোকের যত ছবি। কত কিছু একটা সময় ঘুরে ফিরে পাক খেয়ে ল্যাম্পপোস্টের নীচে পড়ে থাকে। এরপর সারাদিন সারারাত জোড়া দিয়ে বছরের পর বছর দিনের পর দিন মাঘের পরে মাঘ। একটা সময় সবই মাটির ঘোড়া হয়ে ওঠে। একটা সময় দীর্ঘ ঘুমোনোর পর দীর্ঘ কথা বলার পর যখন একটা খণ্ড তৈরি হয় পাক খাওয়া আরশি তৈরি হয় মাঘ মাসের ফুল তৈরি হয়। এইসব নিয়ে। আসলে এই সবই কোনো-না-কোনো কথার অংশ হিসেবের মধ্যে আরও হিসেব সংকেতের ভেতর আরও সংকেত মাংসবাহী দিন মাংসবাহী রাত। মাখনের সঙ্গে মানুষ শরীরের সঙ্গে… এ কি ঘটনা এ কি তার ভ্রম বা আর কিছু। ঘুমের পর আরও একবার ঘটে যাওয়া এই সবকিছু। পরা আর অপরার খেলা।

Categories
কবিতা

হাসনাত শোয়েবের কবিতা

সন্তান প্রসবকালীন গান-৪

চিত্ররথ, এই নাও তোমার মহাভারত। গানের পাশে ফেলে গেছ ঢাল-তলোয়ার। বধ করো সুর ও সংহিতা। দক্ষিণে অগস্ত্য গেছে, তারও দক্ষিণে মৃগ। তাদের ফিরিয়ে নাও এবার। তুমুল হর্ষধ্বনির পাশে লিখে রাখো বৃহস্পতিবার সকাল, যখন সকল নারীই যোজন-গন্ধ্যা। গান্ধর্ব তাদের রীতি, কৃষ্ণ তাদের বর। সন্তান প্রসবকালীন গানে তারা ভুলে গেছে লয়-সুর। ওই দেখ, একা একা কাঁদছে তোমার হস্তিনাপুর।

***
সকলেই একা, তোমাদের পুত্রসমান। তাদের জন্য লিখো গান, সুর দাও, দাও অসুর। বিমর্ষ কৌরব পুত্রদেরও আছে হৃদয়। আহত বাঘের দাঁত ব্যথার যন্ত্রণাও তারা বুঝতে পারে। তারাও লিখেছে গান সুমহান। এই পথ ধনুর্বিদদের, অস্ত্রচালকরা তাই অযৌন; শিকারীরা বৃহন্নলা। মৎসান্যায়ীরা তাদের ঈশ্বর ও আপেল শিকার একমাত্র ধর্ম। তারা জানে না গান, সুরও ভুলে গেছে। আছে কেবল হৃদয়, তার ওপর জন্মানো মহাভারত।

***
যে হৃদয়, কালিকাপ্রাসাদে হারিয়ে ফেলেছিল সুর। তার পথ থেমে গেছে সেই প্রাসাদেই। ফেলে আসা ধুলো উড়ে গেছে দক্ষিণে, অগস্ত্যের খোঁজে, হারিয়ে ফেলেছিল বেণী। তার সন্ধানে গিয়েছিল শিখণ্ডীও। পড়ে আছি, যারা দুপুরের সিয়েস্তা। এখানে ফোরাত, এখানেই কুরু। তোমরা লিখেছ গান, দুপুরে হারানো সুরে। তার পিছু ছুটে গেছি মৃত ধনুর্বিদ। কুড়িয়ে নিয়েছি অসুখের ফল। নাম লেখা ছিল তোমার, মুছে দিয়েছি। ফল নিয়ে ফিরে আসি ঘরে।

***
সেই সব ফল, তাদের অসুখ। ক্রমশ ছুটে গেছে হাসপাতালের দিকে। সারি সারি মৃত লাশ শেষে পড়ে থাকে। অসুখের ফল তার বিমর্ষতা নিয়ে, ফিরে আসে তোমার ঘরে, যুদ্ধের ময়দানে। ঘোড়ার আস্তাবলে অসংখ্য সংসপ্তকের ভিড়ে পড়ি শুয়ে যাবতীয় ঈর্ষা নিয়ে। কালও যাবে সে রোগীর পথ্য হয়ে। গাণ্ডীব ছুঁড়ে পেড়ে নেবে আরো ফল। অট্টহাসি ছুঁড়ে দেবে তোমাদের ক্রুতার দিকে।

***
ক্রুতাকে বলো ফিরে যাও, তীব্র অসুখের পাশে গোল হয়ে বসো। মনে আছে সেইসব আলখাল্লাধারীদের, যারা তোমাদের কানে তুলে দিয়েছিল নকল গান, গ্রামোফোন ও মেঘমল্লার। ভাঙা রেকর্ডের পাশে গোল হয়ে বসো, তোমার মনে পড়বে তামুরা কাফকা, জ্যাজ ও বৃষ্টির পূর্বাভাস। এসবের ভেতর কেটে কেটে সাজানো শরীর, তার কাছেই হাত পেতেছে গান। নকল মিউজিয়াম, ঘুরে ঘুরে দেখি। গ্রামোফোন, গান শোনাও আবার। নকল গানে বৃষ্টি নামাবে মিঁয়া তানসেন।

***
নকল গান, কতকাল বাজাবে বিভৎস রেকর্ডার? যেটুকু দূরত্ব, ভিড় করে আছে বিপন্ন ড্রামার।, থ্রোনজুড়ে কেবল কাঁটা আর কাঁটা। তার সুর ও লয়ে তামাম দুনিয়া। আটকে আছে এই ভোর, ভোরের আজান। কোথাও ফুটছে ফের ক্রিসেনথেমাম। আহত দিন, গড়িয়ে যাবে আরও কিছুদূর? সাক্ষী দিচ্ছে দুপুর, তোমার আহার।

***
সাক্ষী দুপুরের বিষণ্ণ রং। যার নিচেই ফুটছে ফুল, পৃথিবীর ফুল। আসো, তোমায় এবার ফুল দেখাব। তীব্র সুগন্ধের আড়ালে তুমি ফেলে যাবে যৌনজীবন। তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাব বসন্তের দিকে, একটি পথকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাব বসন্তের দিকে। ছোটো ছোটো ফুল, ভুলবশত ফুটে আছে। তাদের বকে দাও, দাও নিশানা। তাক করে রাখ বন্দুক, এক দুই তিন- দ্রিম। ফুটো হয়ে গেল ফুলের জীবন, তোমার যৌনতাও। না, এইখানে কোন গান নেই, সুর নেই, শব্দও নেই। নৈঃশব্দ্য পেরুনোর আগেই প্রাণত্যাগ করেছিল সমস্ত বান্দিশ। তুমিও তাই শোনোনি কোন গান, অমরত্বের সুসংবাদও।

***
অমরত্বই তোমাদের গন্তব্য। সুসংবাদ ছাড়াই পৌঁছে যাবে কোন এক বিকেলে। সব বিকেলই গেছে নিঃসন্তান দম্পতির দিকে, তারা জানে না কোন গান । তুমি পৌঁছে যাও গানের মাস্টার। তাদের শেখাও সন্তান প্রসবকালীন গান, কেড়ে নাও অমরত্ব। দুপরের পরই যেটুকু ঘুম, সেটুকুই গান। খরগোশ দেখার ছলে তারা হারিয়ে ফেলেছিল সমস্ত যন্ত্রসংগীত, এমনকি পুরুষত্বও। তবুও অমরত্ব তোমাদের গন্তব্য, পেয়ারা বাগান দেখতে দেখতে সে পথ পাড়ি দেবে একদিন।

Categories
কবিতা

দেবোত্তম গায়েনের কবিতা

কমলালেবুর ভিতরটা নড়ছে…


শরীরী অস্তিত্বের জাগ্রত রূপ এই প্রাপ্তি। কিছুটা চেখে দেখে অনাড়ম্বর গাছের নাচ ও মুদ্রা কৌশল রপ্ত হলো। ঘুমের মধ্যে যে তুমি স্বপ্ন দেখবে তাকে বিচার করে অনাদর করা হয় নিজেকেই। সবটা সকাল সবটা মানুষরূপী! তোমাকে সেই ফিরে আসতেই হবে। হে ঋষি বীজের ধারনা আমার নেই। চাইলেও আমার মুক্তি পাথেয় নয়। জপের আড়ালে পাপ-প্রেম-শরীর সবটাই যে কর্পূরের মতো উবে যায়। নশ্বর নশ্বর!


অনেকটা দূর। জেগে আছি এটুকুই এযাবৎ আপেলের মধ্যে ধরা থাকবে। মানুষের জন্মের বহু আগেই তো ঠিক ছিল সে মানুষের থেকেই সরে যাবে। সরে যাবে পাখিরব সুরসমুদ্র থেকে। মেটালিক গাঢ় হচ্ছে ইতি টানছে বাঘের প্রিয় স্বাদ। খাদের কাছে খাদক এই দূরত্ব মিটিয়ে নিচ্ছে নির্বাচনের আদলে। খাদ্যের আগে সু জুড়ে দিলেই তা মানুষের অধিকারে; বাকি রাষ্ট্র যা ঠিক করবে।


প্রজাপতি। অলীক সে-রঙের প্রতি ছুটে যায়। রং চেতনার উলটোদিক। মানুষের বিভাজন হত্যা দিয়ে হলে ফুলের মরশুম পালটে যেত। প্রিয় শব্দের আড়ালে কত সত্য যে মারা যায়। জ্বলে দাউ দাউ করে মেঘ করে আসে এমন দাবানল। পাখিদের ছুটে যাওয়া মানে তানসেন দুঃখ পেয়েছেন। আপনি…


নিজের পাশে ঘুমিয়ে আছে সে। ভয়। রক্ত মিশে গেলে আয়না ঢেকে দিন। আপনি নিজে যে ভয়টা পেতেন না সেটা পাবেন এবার। প্রস্তুত হয়ে দাঁড়ান। স্নানের ধর্ম শুধু ধুয়ে দেওয়া নয় এক জায়গার পাপ আরেক জায়গায় প্রবাহিতও হওয়া! চোখের আগে অসংখ্য মুদ্রা এভাবেই মানুষকে বুঝিয়ে দিয়ে যায় জল বড়ো বিপদসংকুল।


এই এমন এক স্বধর্মদ্বেষী আমি খুঁজে বেড়াই লড়াই করার অস্ত্র। সামনে অগণিত গুহা। গুহা থেকে কখনওই কিছু আবিষ্কার না হলে, আমিও এভাবে অস্ত্র খুঁজে খুঁজে— আমাকে কেউ একজন বিশ্বাস করুক চাইতাম না! আমি তো জানতাম পরে কখনও এই গল্প বোবা হয়ে করব। সংকেত যা আদিম এবং পবিত্র!


আছড়ে পরার আগে অস্তিত্বই যদি না থাকত টিকে থাকার সম্ভাবনা বীজের মধ্যে করে ঘুরে বেড়াতাম। যেভাবে এই সম্পর্কগুলো গুটিকয় খোলস এর মধ্যে। যারা বেরুতে চাইলেও দু-হাত দিয়ে দরজা খোলার কেউ নেই। স্বর প্রকাশ্যে আসার আগেই গাছ তার আধার ছেড়ে দেয় পালঙ্ক বিক্রেতার কাছে। আপনি জানতেন সবটা।


আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে ক্রিয়া বলতে সবটাই মুক্তির জন্য। মানুষ এর আভাষটুকু পেয়েছিল বলেই একটা দিকে ভাগ হয়ে গেল। কিছুটা এইরকম; ফলের বীজের ধরন যা দেখে মানুষ কখনও চিন্তা করেনি শুধু অভ্যাস করেছে খাদ্য। দানা ও শস্য। তফাতটা বুঝতে পারছেন তো…


সেভাবে গতকালের মতো আর তাকে বলতে শুনলাম না, “বুকের মধ্যে দুঃখ জমিয়ে মানুষ পায় কেউ”— এই অভিব্যক্তি তে আমার কোনো হাত ছিল না। জলের গভীরতা মাপতে গিয়ে মানুষ রত্ন পায়, রত্নের গভীরতা খুঁজতে গিয়ে মানুষ ঋণী হয়ে পড়ে।


সময় পেরিয়ে যায়। মানুষের সঙ্গে কারুর যুদ্ধ হয়ে উঠল না। কী অবিরাম দুঃখ এই টলটল করে ধাক্কা খায় পাড়ে। নিকষকৃষ্ণ ধারা, ঝুপ করে কেউ পড়েছে চোখের মধ্যে। বিরহ জানাব জানাব নিশ্চুপে সে ঝিম নিয়ে আসে। মায়া পড়ে যায়! মনে হয়। মনে হয় মানুষের প্রেমের মধ্যে ভ্রমরের নজর পড়েছে। ক্রমশ সে চোখ থেকে বাসা বাঁধা শুরু করে, অন্ধ! অস্তিত্বটুকু মাটি বইকি!

১০
আজব, দেখছ কী আমাদের হাতে কোনো অবসর নেই এখন। ঘুরছি, ঘুরেই চলেছি। পরিক্রমার একটা শেষ থাকে মাঝে কতোগুলো হত্যা। সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে থাকলেই তা সেতু যেমন হয়ে যায় না, তলায় তলায় একটা শূন্যতা লাগে, ঠিক সেইভাবেই কমলালেবুর ভিতরটা নড়ছে। ঢক্ পক্। জলের আধার ভাঙলে মানুষ তার স্বর-স্বপ্ন-শয্যা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে। ভেবে ভেবে সে-ও বেরিয়ে পড়ে এই আবাদে। আগে আগে পিঁপড়ের দল পিছনে সে…

Categories
অনুবাদ কবিতা

কাশ্মীরের কবিতা

ভাষান্তর: সোহেল ইসলাম

এখানে পাঁচজন কাশ্মীরির দুটো করে মোট দশটা জবানবন্দি থাকল। গত সাত-আট মাস কাশ্মীর নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে কবিতাগুলোকে আমার জবানবন্দিই মনে হয়েছে। তাই তার উল্লেখ। কাশ্মীরে আমরা যা দেখি, তারচেয়ে বেশি কিছুই ঘটে প্রতিনিয়ত। গোটা কাশ্মীর জুড়ে মানুষের অভিজ্ঞতা একই। স্কুল বন্ধ, বাজারঘাট বন্ধ, ফোন বন্ধ, গণপরিবহন বন্ধ, রাস্তায় বেরোনো বন্ধ, এমনকী সবচেয়ে দরকারেও এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটানো যায় না। এ তো গেল দিনের আলোর কথা। রাত তো আরও ঝুঁকি দিয়ে ভরা। ওষুধ কেনা এমনকী হাসপাতাল যাওয়ার মতো দরকারেও রাতের কাশ্মীর নিরাপদ নয় খোদ কাশ্মীরিদের কাছেও। কেন-না রাতের দখল থাকে সেনাবাহিনী আর পুলিশের হাতে। কাশ্মীরের অন্ধকার মানুষের অসহায়তার কথা বলে। ছাদের বুক থেকে চাঙর ভেঙে পড়লে যেমন ছাদ চুপচাপ থাকে, স্বাভাবিক হতে চায়, কিছুই হয়নি এমন ভাব নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। ঠিক একইরকমভাবে কাশ্মীরও শরীরে স্যালাইনের নিডিল নিয়ে ব্যথা, যন্ত্রণা, দুঃখ, না-পাওয়া একনিঃশ্বাসে ভুলিয়ে দিয়ে আবার বেঁচে উঠতে চায়। এই বেঁচে ওঠায় কোনো মিথ্যে নেই, কোনো নাটক নেই। থাকার মধ্যে আছে শুধু অপেক্ষা। সেই একই অপেক্ষা এখানকার ঘরবাড়ি, দরজা-জানলার এবং এখানকার মানুষের মতোই। একটু মন দিয়ে তাকালে দেখতে পাবেন, দেওয়ালগুলো বোমা আর বুলেটের অত্যাচার সহ্য করতে করতে নিথর হয়ে গেছে। আর দরজা-জানালাগুলো সেনাবাহিনীর নিষেধাজ্ঞা মেনে নিতে নিতে বুড়ো হয়ে গেল। বাড়ির আলো ছুটে যে রাস্তায় বেরিয়ে আসবে তার কোনো উপায় নেই। এখানে মুক্তির একমাত্র পথ হল মরে যাওয়া। তবে মজার ব্যাপার যে মরে গেল, মুক্তি কেবল তার। কিন্তু তারপর বাড়ির লোক পড়বে যাঁতাকলে। তল্লাশি, প্রশ্ন, রাতবিরেতে গলা ধাক্কা, সুরক্ষার অভাব, হয়রানি এসবই যেন তখন ওই বাড়ির রোজকার জীবন হয়ে ওঠে। আবার নতুন করে তারা তখন মৃত্যুর অপেক্ষায়, মুক্তির অপেক্ষায় দিন গুনতে থাকে।

লকডাউন, মারধোর, হেফাজত, কাগজপত্র কেড়ে নেওয়া, পুরোনো FIR দেখিয়ে এনকাউন্টার, হাত-পা ভেঙে দেওয়া, চেকিংয়ের নামে অসভ্যতা কাশ্মীরে নতুন কিছু নয়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এর সাক্ষী। আপনি যদি ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখতে গিয়ে লাল কাশ্মীর দেখে ফেলেন, অবাক হওয়ার কিছু নেই। সত্যিই কাশ্মীর এখন দুঃখে, কাঁদতে কাঁদতে, ক্ষতবিক্ষত শিশুর মৃতদেহের মতোই লাল। ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর তথ্য আর সরকারি আমলার বক্তব্যের উপর নির্ভর করে যে-কাশ্মীরের কথা আমরা মনে মনে কল্পনা করি তার সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল নেই। দেশের জনগণের কাছে কাশ্মীর মানেই ভিড়, উশৃঙ্খল, হাতে পাথর নিয়ে তেড়ে আসা জনতার ভিড়। কিন্তু উলটো দিকে দাঁড়িয়ে থাকাদেরও যে একটা ভিড়, তারাও যে রাইফেল, প্যালেট গান, গ্রেনেড হাতে ভিড় তৈরি করেছে তা আর দেখানো হয় না। এই যে বারবার কয়েনের একপিঠ দেখিয়ে বিচারপতি বসিয়ে বিচার করে নেওয়ার মানসিকতার বিরুদ্ধেই কাশ্মীরের কলম জ্বলে উঠেছে, জ্বলে উঠছে। আর তাই কাশ্মীরের কবিরা সরাসরি মানবাধিকারের কথা বলছেন, মানবজাতির পক্ষে কথা বলছেন। ফলে কাশ্মীরের কবিতায় আপনি যত এগোতে থাকবেন, দেখবেন― মা, কারফিউ, রক্ত, হ্যান্ড গ্রেনেড, কাঁটাতার, নিষ্ঠুরতা, গণকবরের মতো শব্দ উঠে আসছে বারবার। আসাটাই স্বাভাবিক। কাশ্মীর তার কবিতায় জীবন লেখে, বেঁচে থাকা, ঘুরে দাঁড়ানো, কাঁধে কাঁধ রেখে উঠে দাঁড়ানোর কথা লেখে। যা তাকে শিখতে হয়নি। জীবনচর্চার মধ্য দিয়েই তার কলম একে ধারণ করেছে।

আর একটা কথা আতহার জিয়া এবং হুজাইফা পণ্ডিতের সাহায্য না পেলে কাশ্মীরকে আমার জানাই হত না সেভাবে। শাম্মি কাপুরের ‘ইয়া হু’ বলে বরফে ঝাঁপিয়ে পড়া কাশ্মীর নিয়েই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতাম। কিন্তু তা যে হওয়ার নয়, বেশ বুঝতে পারছি এখন।

আসিয়া জহুরের কবিতা

[পরিচিতি: আসিয়া জহুর বর্তমানে কাশ্মীরের বারামুল্লার একটি কলেজে মনোবিজ্ঞান পড়ানোয় কর্মরত। কাশ্মীরি সাহিত্য, কবিতা, মনোবিজ্ঞান বিষয়ক বই এবং নিবন্ধ লিখেছেন।]

মিলিটারাইজড জোন

জিভ কেটে কাঁটাতারে ঝুলিয়ে দেওয়ার আগে
কিছু বলা যাক

মাথায় হাতুড়ির আঘাত নেমে আসার আগে
কিছু চিন্তার ফসল ফলানো যাক

ঘুমের দেওয়াল
বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়ার আগে
কিছু স্বপ্ন বোনা যাক

অন্ধ হয়ে যাওয়ার আগেই
চলো, অন্ধকারকেই আয়না বানিয়ে ফেলি

শব্দ মুছে দেওয়ার আগে
হাতের তালুতেই
লিপিবদ্ধ করি কাশ্মীরি ইতিহাস

নদী

একদিন নদী রাস্তা ভুল করে
ঢুকে পড়ল পাড়ায়
বাড়িতে
স্কুলে
দরজায় কড়া নাড়তে আরম্ভ করল
যত রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি
তত বাড়তে থাকে রাগ
সে কী একগুঁয়ে জেদ নদীর
দরজা-জানালার ফাঁকফোঁকর দিয়ে
ফাটা দেওয়াল দিয়ে ঢুকতে লাগল ভেতরে
প্রথমে বইগুলো তাকে তুললাম
তারপর আসবাবপত্র
শেষে নিজেরাও
কিন্তু নদীর জেদ…
বই থেকে শব্দগুলোকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল
পাড়া থেকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল প্রতিবেশী

আমরা এখন
হাসি-কান্না ভাগ করে নিতে নিতে
এক দেওয়ালহীন বিশ্বের বসবাসকারী

আমজাদ মজিদের কবিতা

[পরিচিতি: আমজাদ মজিদ ইনভার্স জার্নালের সম্পাদক ও প্রতিষ্ঠাতা। বর্তমানে দক্ষিণ কাশ্মীরে থাকেন। সেখানে বসে চীন, ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার সমালোচনা বইয়ের উপর কাজ করছেন।]

কাশ্মীরে কারফিউ

কারফিউ রাস্তায়
স্কুলে
ঘরবাড়িতে
রেডিয়ো, সংবাদপত্রে
ইন্টারনেটে
টিভি চ্যানেলে
আমাদের বক্তব্যে
আন্দোলনে
প্রতিবাদে
শোকে
এমনকী যে-স্বাধীনতার কথা আপনারা বলেন
কাশ্মীরে তাতেও কারফিউ
তবুও আমরা আশা ছাড়িনি
জীবনকে বাজি রেখে
মৃত্যুকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে
উন্মাদনা ভাগ করে
লড়াই জারি রেখেছি—
ঠিক একদিন কারফিউ মুক্ত কাশ্মীর গড়ব আমরা

পরিচয় পত্র

দরখাস্তের ভিড় থেকে আলাদা হয়ে
সেও প্রিন্ট হল অন্যদের মতো
নোটারিযুক্ত হয়ে
দেশের স্ট্যাম্প নিয়ে
ল্যামিনেশনে মুড়ে
এক সরকারি দপ্তর থেকে
আরেক সরকারি দপ্তরের টেবিলে চক্কর কাটতে লাগল
তারপর সত্যি সত্যিই একদিন
দাগী আমলাদের হাত থেকে মুক্তি ঘটল তার

আজও স্পষ্ট মনে আছে
সেই দিনটির কথা
কাগজের ভিড়ে মাথা তুলে তাকানো দরখাস্ত
লম্বা কিউয়ে উলঙ্গ মজিদ
আর তার রক্ত-মাংস দেশীয় হওয়ার প্রমাণ দিচ্ছে

তখন আমি বাড়ি থেকে অনেক দূরে
কাচের জানলা দিয়ে দেখছি দেশ

শাবির আহমেদ মীরের কবিতা

[পরিচিতি: শাবির আহমেদ মীর কাশ্মীরের পুলওয়ামায় থাকেন। একজন গদ্যকার, কবি ও ছোটোগল্প লেখক। বর্তমানে সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত।]

যেদিন যুদ্ধ শেষ হবে

যুদ্ধ শেষ হলে
একবার আসুন আমাদের এখানে
বুলেট কিংবা প্যালেট গানে ফুটো হয়ে যাওয়া জায়গায়
আঙুল ঢুকিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখে নেবেন
কতটা আহত
কতটা আঘাত সহ্য করেছি আমরা

যুদ্ধ থেমে গেলে
আপনাকে এনে দেব গন্ধ
ভয়ের গন্ধ
ধ্বংসস্তূপের গন্ধ
দেখে নেবেন কী জমকালো সেইসব অন্ধকারের গন্ধ

যুদ্ধ থেমে গেলে
বুটের দৌড়ঝাঁপের আবহ শোনাতে নিয়ে যাব আপনাদের
উপত্যকা ভাগ করা
কাঁটাতারের গর্জন শোনাতে নিয়ে যাব

যুদ্ধ থেমে গেলে
আপনাকে নিয়ে যাব ভেরিনাগ
সেখান থেকে পায়ে হেঁটে সুখনাগ
তারপর আমরা যাব ডাল লেকে
একটি দিন কাটাব বন্দুকের পাহারা ছাড়া
দেখবেন কী শান্তিপূর্ণ সেই ভ্রমণ

যুদ্ধ শেষ হলে
গণকবর খনন বন্ধ হলে
আপনাকে যোগদান করতে বলব
কাশ্মীরি সংগীতের ঐতিহ্যের সঙ্গে
আপনি অনুভব করবেন
আমরা ঠিক কতটা খুশিতে থাকি
নিজেদের নিয়ে

সত্যি সত্যিই যেদিন যুদ্ধ থেমে যাবে চিরতরে
আপনাকে চায়ের আমন্ত্রণ জানাব
নোনতা, গোলাপি চা
আশা করি সেদিন বুঝবেন
আমরা কোনোদিনই
একে-অপরের শত্রু ছিলাম না

সিরিয়ায়

সোমবার,
আশার দিন
অপেক্ষা শেষ হওয়ার দিন
জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানে
চকচকে রুপোর বাটিতে খাবার পরিবেশনের দিন
যেন একটা বিশেষ মুহূর্ত
যার জন্য আমরা
একে অন্যের মুখ চাওয়াচায়ি করে থাকি
ওই তো রূপকথা থেকে
আল্লাহ আর তাঁর দূত
আমাদের বাঁচাতে আসছেন
                           অবশেষে

মঙ্গলবার,
সতর্ক থাকার খবর আসছে
জরুরী সামান হাতের কাছে গুছিয়ে রাখার সতর্কবার্তা
যে-কোনো সময়
সবকিছু ছেড়ে পালিয়ে যেতে হতে পারে

রেহানার কপাল
তাই তো পালিয়ে যেতে পেরেছে
চোখের মণি, আইলানকে মানুষ করার সুযোগ পেয়েছে
যে কি না এখন রেহানার একমাত্র ভরসা

বুধবার,
প্রথম মা হওয়া গাভীর মতো ছটফট করছি
স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছি না
গুজব ছড়িয়ে পড়ছে
বন্দুকের আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ছে
বোমায় টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে ঘরবাড়ি
বাইরে কারফিউ
এখন ধৈর্য্যই একমাত্র পথ
আমাদের অপেক্ষা করতে হবে
জুতসই পালানোর মুহূর্ত না আসা পর্যন্ত

বৃহস্পতিবার,
আমাদের দুঃখের দিন
ধোঁয়া আর ধ্বংসস্তূপের মাঝখান থেকে
জিভের টুকরো
গোল গোল চোখ
ছোটো সরু হাড় কুড়িয়ে
বাড়ি ফেরার দিন

শুক্রবার,
আমাদের শোক এতটাই দগদগে যে
আমরা শিষ্টাচার ভুলে যাই
আপনি চান
আমরা দেওয়ালে মাথা ঠুকি
হাত দিয়ে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে থেমে যাই
জিভ অসাড় হয়ে আসুক
জল শুকিয়ে যাক চোখেই
কিন্তু আমাদের হাহাকার এতটাই নাছোড় যে
থামতে জানে না

শনিবার,
ক্ষোভ প্রকাশের দিন
এও এক নেশার মতো
আকাশের দিকে দু-হাত তুলে চিৎকার

দর্শকরা প্রথম প্রথম
সমবেদনা জানান
মাথা নীচু করে বিড়বিড় করেন
তারপর একটা সময় বিরক্ত হয়ে মুখ ফিরিয়ে নেন
কাজে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন
আমরা দিন শেষে
ঝাঁকে ঝাঁকে যে যার বাড়ি ফিরে আসি

রবিবার,
আমাদের নীরবতার দিন
নতুন সপ্তাহের প্রস্তুতির দিন

কায়সার বশিরের কবিতা
[পরিচিতি: কায়সার বশির কাশ্মীরের অনুবাদক, লেখক এবং কবি। কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর।]

মৃতদেহ

ওই দেখুন একটা মৃতদেহ
কোথায়?
ওই তো স্রোতে ভেসে আসছে
আমি তো দেখতে পাচ্ছি না
ওটা কী?
ওই দেখুন লাশ! আখরোট গাছের নীচে
ওটা দুর্ঘটনা না খুন, আপনি কী মনে করেন?
ওই দেখুন একটা বুলেট
কোথায় বুলেট?
এটা তো একটা মাথা
পাকা তুঁতের মতো ছেঁতরে গেছে
আমি বুঝতে পারছি না… একটু গুছিয়ে বলুন
শুনতে পাচ্ছেন?
কী?
মায়েরা উঠোনে বসে কাঁদছে
মৃতদেহের জন্য?
হতে পারে
চলুন, সান্ত্বনা দিয়ে আসি
কী করে, ওটা তো রেড জোন
আমি বিশ্বাস করি না
বিশ্বাস করতে হবে আপনাকে
শুনুন
কী?
কণ্ঠস্বর
হ্যাঁ, একটা আওয়াজ
কণ্ঠস্বর না, ওটা চিৎকার
কীসের?
মিছিলের
ওরা কি লাশ তুলতে আসছে?
আমি জানি না
তবে, এদিকেই আসছে― যেন একটা হিংস্র নদী
চলুন, দৌড়ান
তা না হলে আমরা খুন হয়ে যাব
কেন? এটা ঠিক না
জানি, আপনি চলুন
লাশের কী হবে?
ভুলে যান, চলুন…
কোথায়?
যেখানে নিরাপদ মনে হবে
আমি দৌড়তে পারি না
আমার পা সেই কবে থেকে ঘুমিয়ে আছে
কেমন স্বপ্ন পছন্দের আপনার?
কার?
লাশের…
ভুলে যান, চলুন
ওরা এদিকেই আসছে
কোথায়?
আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না
এত কুয়াশা কেন?
কোথায় কুয়াশা, এগুলো ধোঁয়া
আগুন ধরিয়ে দিয়েছে
কারা?
আমি জানি না
চলুন, পালাই
আপনি যান, আমি থাকব
কেন?
ওরা যে আমার ভাইয়ের মৃতদেহ নিয়ে আসছে
ভাইকে একা ফেলে কোথায় যাব?

আমি

বৃষ্টির পরে
আগস্টের আকাশে রামধনু উঠল
আমি তার কাছ থেকে
কিছুটা লাল রং ধার করলাম
আমাদের দুঃখ লিখব বলে

সিদরা নাজিরের কবিতা

[পরিচিতি: সিদরা নাজির কাশ্মীরের কবি। কাশ্মীরের আন্তিপোড়ার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেছেন। সিদরার কাছে কবিতা একটা প্রার্থনা, যা তাকে সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করায়।]

কাশ্মীর

দাসের মতো বাঁচা কাকে বলে― আপনি কি জানেন?
বাইরে বেরোলেই কাঁটাতারের ঘেরা
হায়নার চোখের মতো বন্দুকের নল
আপনার দিকে তাক করা
তখন কেমন অনুভব হয়
আপনি কি জানেন?

যখন কোনো কাশ্মীরি যুবক নিখোঁজ হয়ে যায়
সেই বাড়ির মুকুট থেকে নিশ্চিত
একটা পালক খুলে পড়ে
মায়ের চোখ থেকে ঝরে পড়ে নোনা জল
জল নয় অভিশাপ
আপনি কি জানেন― কেমন সেই অনুভূতি
প্রতিটি কাশ্মীরি বোনের মনে ক্রোধের বাস
বাবাদের হাতে কবরের মাটি
আপনি কোনোদিনই জানতে পারবেন না
এই শাসন দেখতে দেখতে
কাশ্মীর আস্ত একটা কবরে পরিণত হচ্ছে

কবরের রাস্তায়

সাদা কাফন এল
আতরের গন্ধ এল নাকে
হাসি নিমেষে বদলে গেল কান্নায়
সেই বীরের সম্মানে
ইনকিলাবের নাড়া দিতে দিতে চলে গেল একদল যুবক
শুধু,
একজন বাবা কেঁদে উঠলেন
একজন মা কেঁদে উঠলেন
আর চারজনের কাঁধে করে
একটা কাঠের ফ্রেম চলল―
                       শীতের দেশে

Categories
কবিতা

কল্যাণ মিত্রের কবিতা

নখর দিনের কবিতা

স্নানঘর থেকে উড়ে যাচ্ছে বৃষ্টি
বোঝার ভুলে
          বয়স বাড়ছে আমার

এত ভুল আসছে কোথ্থেকে
ভুলের কি কোনো পূর্বপুরুষ আছে !
পশ্চিমপুরুষ?

স্নানঘর থেকে উড়ে যাচ্ছে বৃষ্টি
ছোট হয়ে আসছে চোখ
বিন্দুজলে বৃত্ত ভাসছে…

সে – ২

সন্তুর বাজিয়ে আসে
শিকারা ভাসিয়ে চলে যায়

রমণের ছদ্মবেশে যে জ্যা-টানি শব্দের চেতনা জাগ্রত করে
মুদিখানা দোকানের মাসকাবারি খাতার মতো
তার জের কি কখনও মেটে?

সব সৌভাগ্যের মধুকোষে একজন নারী
সব উত্থানপতনের নেপথ্যে একজন নারী

‘নারীর কোনো উদাহরণ হয় না’

ভাষা

ভাষা আমার মাতৃদুগ্ধ                         ভাষা ত্রিসন্ধ্যা আহ্নিক
ভাষা আমার ভোরের স্বপ্ন                     ভাষা বুড়ো আঙুলের টিপছাপ
ভিড়ের মধ্যে যে-হাত ধরব বলে চলন্ত বাসের পিছনে
ছুটছি – সেই হাত সাপের ল্যাজের মতো
ক্রমশ সরু হয়ে আসছে…

আমার আর্তনাদ-ই আমার ভাষা।

Categories
কবিতা

পল্লব ভট্টাচার্যের কবিতা

শাস্ত্র অনুযায়ী, সমস্ত ক্রিয়া কর্মের আগে ও পরে
হাত ধুয়ে নিতে হয়; যাতে
কৃতকর্মের কোনো দাগ না লেগে থাকে।

আমি হাত ধুয়ে নিয়েছি।

হাতের মাধ্যমে কিছু ত্রাণ মাত্র পৌঁছে যায় দাতা থেকে গ্রহীতার কাছে।
হাত যে কিছুই নয়, দাতা বা গ্রহীতা, একথা না জানা হলে,
আত্মপ্রচারের মূর্খ অহংকারে ভাঁড় হয়— বাঁচা।

তুলসীদাসজী থেকে একথা শেখার পর, লজ্জ্বায় নুয়ে আসে মাথা।

‘আমি নই, হত্যাকারী এ হাত ইন্দ্রের’— বলে পুরাণকথার সেই ব্রাহ্মণও
আমার মতোই স্বস্তি পেতে চেয়েছিল। অথচ, ‘এ পুষ্পিত উদ্যান
কার যে নির্মান!’ —বলে দাঁড়াতেই, সে যখন বলেছে, — ‘আমার’—

তখন ইন্দ্র মানে, আমিত্ব, অহং; তাকে নিতে হয় সৃষ্টি ও ধ্বংসের ভার।

‘পবিত্র বা অপবিত্র যে অবস্থাতেই হোক, তাঁকে যে স্মরণ করে,
সে-ই শুচি, অন্তরে বাহিরে।’ —এই উচ্চারণ শেষে, বিশাল বিস্তারে
এসে দাঁড়িয়েছে শুচি-শুদ্ধ পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ ।

তবু অবিশ্বাস টিপে ধরে আমাদেরই গলা ।

শ্রীমদ্ভাগবতে লেখা, ক্ষুধা ও প্রয়োজন অনুসারে
খাদ্য পাওয়ার অধিকার দেহীমাত্রেরই রয়েছে।
এর বেশি যে অধিকার করে, সে দন্ডযোগ্য।

দন্ডদাতার মূর্তি আমারা বানিয়ে নিয়েছি অপাণিপাদ।

Categories
কবিতা

বিপ্লব চৌধুরীর কবিতা

শকুন্তলা

একটা কৃষ্ণসার হরিণের দিকে যখন তাক করেছি আমার জার্মান মাউজার, ঠিক তখনই একটা গাছের আড়াল থেকে আমি দেখতে পাই তোমাকে। প্রথমে আমার নয়নে আসে তোমার বক্ষসৌন্দর্য, এবং অতঃপর মুখচন্দ্রিমায় মুগ্ধ হয়ে যাই। তখন অবাক হয়ে দেখি, যে হরিণটিকে হত্যা করব বলে আমি ভাবছিলাম, তুমি তাকে ধরে আদর করছো। সে তোমার সঙ্গে যেন কথা বলছে কোনো এক বনজ ভাষায়। আমি কিছু বুঝতে পারি না। তুমি সেই ভাষা বোঝো, ভালোবাসা দিয়ে।

বন্দুক মাটিতে ফেলে, তীর ও ধনুক পরিত্যাগ করে, আমি গিয়ে দাঁড়াই তোমার মুখোমুখি। দেহ থেকে চন্দনের, চুলের খোঁপা থেকে ফুলের সুবাস সুবাতাসে ভাসে। তোমার আশ্চর্য চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, আজ থেকে আর শিকার আমার কাজ নয়। শুধু চাই, তোমার নরম বুকে আমার কঠিন হাড় ক্রমে মিশে যাক। আমাদের ঘিরে ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামে। তুমি আমার, আমি তোমার হাত ছুঁয়ে থাকি।

রাত ভোর হয়ে যায়। প্রেমের প্রেরণায়।

সেই আমি

গাছের ভিতরে গাছ হয়ে যাই যদি! তুমি কি তখনও চিনতে পারবে? মাছের ভিতরে যদি মাছ হয়ে যাই, কাঁটা বেছে বেছে খেয়ে ফেলবে নাতো! নদীর ঢেউ অথবা ভূপৃষ্ঠের মাটি, কোথায় আশ্রয় নেব ভাবছি এখন। আর তাই সমগ্র সত্তা-জুড়ে বারবার কেঁপে কেঁপে উঠছে সাড়া-জাগানো সব সংশয়। মনে হয়, একটা রূপান্তরের পথ বেয়ে হেঁটে চলেছি কোনো তেপান্তরের দিকে। সেখানে গিয়ে আমি পাব একটা সবুজ ফুসফুস। ডানা পাব দুটো। পাখি হব গভীর বনের। উড়ে এসে যখন বসব বাগানের গাছে, তুমি কি তখন চিনতে পারবে! শুনতে চাইবে বহুবার চেনা-শোনা কোনো প্রিয়তম গান?

নির্বিষ

তুমি বাজাবে বীণ। আমি সেই তালে তালে নাচাব আমার ফণা। গোবর-লেপা বাঁশের ঝাঁপিতে চেপে, তোমার কাঁধে কাঁধে ঘুরে বেড়াব মেলার পর মেলা— হাটের পরে হাট— কত কত শহর আর শত শত গ্রাম। আমার দৈনিক খেলা তোমার মুখে তুলে দেবে প্রতিদিনের ভাত-রুটি-মদ। বউয়ের জন্য শাড়ি, ছোটো ছেলেটির জন্য পিতলের ঘুনসি কিনে আনবে তুমি। আমৃত্যু আমি থেকে যাব তোমার সহায়।
সেই কবে বটের কোটর থেকে তুমি বন্দি করেছো আমাকে। এতদিন পরে তোমার সংশয়ী মন বলছে আমাকে, সেই প্রতিশোধ-স্পৃহা থেকে যদি কখনো তোমাকে ছোঁবল মারি আমি! ও জীবন-সাপুড়ে, কেন এসব অর্থহীন কথা আজ উঠছে বলো তো? প্রথম দিনেই তো তুমি ভেঙে দিয়েছো আমার বিষ-দাঁত।

চোখ

আছে, তাই দেখি। ওই তো শিমুলগাছ রঙে রঙে লাল। মাটিতে ফুল-সহ পড়ে আছে পলাশের ডাল। তোমার সুন্দর বিরাট দিঘি। ফুটে উঠলো গোলাপি শালুক। বিকশিত হতে দেখি ভোর থেকে রাত। ছেলেরা ক্রিকেট খেলছে। বড়ন্তীর ড্যামে বাবার সঙ্গে ঘুরতে আসা সেই ছোট্ট মেয়েটির ফুটফুটে মুখ। জঙ্গলের অন্দরমহলে জীর্ণ এক টেরাকোটার মন্দির। মাটি ফুঁড়ে, সরলবর্গীয় গতি নিয়ে জেগেছে পর্বত। তার শৃঙ্গের ওপর নীল নীল নীলাকাশ। নাম-না-জানা পাখিরা সব উড়ে যায় অজানার দিকে।