Categories
কবিতা

বিজয় দে’র কবিতা

সান্ধ্য কবিতাগুচ্ছ

গেস্টাপো

যাকে নিয়ে এত কথা হচ্ছে সেই মিস্টার এক্সকে আমি কি চিনি? এই শতাব্দী থেকে আরেক শতাব্দীর দিকে একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলাম। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে শতাব্দীর ওপার থেকেই যেন উত্তর এল “হ্যাঁ হ্যাঁ, তুমি নিশ্চয় চেনো”
আমার তো প্রশ্নের শেষ নেই।
“মিস্টার এক্স কি এই দেশেতেই থাকেন? বসবাস করছেন? নাকি অন্য কোনও দেশ থেকে এখানে আসবেন?”
কাটা কাটা উত্তর এল “ তিনি ভূত ও ঈশ্বরের মতো সর্বত্র বিরাজমান। তিনি ছিলেন। তিনি আছেন। তিনি থাকবেন”

“আমি কি ধর্ম ধুয়ে জল খাব?” চায়ের দোকানে বসে যিনি টেবিল চাপড়ে এই কথাটা বললেন, তার উলটোদিকেই আরেকজন, তিনি কিন্তু কথাটা শুনলেন তারপর, খুব শান্ত স্বরেই বললেন “চুপ। চুপ্। মিস্টার এক্স এসব কথা শুনলে খুবই রাগ করবেন, দেয়ালেরও দু-কান আছে। তিনি নিশ্চয় কাছাকাছি কোথাও আছেন”

“একটা পিয়ানোর তার গলায় পেঁচিয়ে যদি সিলিং থেকে আপনাকে ঝুলিয়ে দেয়া হয়, তবে আপনার কীরকম লাগবে? খরচ একেবারে নেই, সময়ও মোটামুটি কম, ধড় থেকে মুন্ডুটা কেটে বেরিয়ে আসতে যেটুকু। বিচ্ছিন্ন হওয়ার, এই ফাঁকে আপনি একটু ছোটোখাটো স্বপ্নও দেখে নিতে পারেন”

তিনি অন্ধকারে আছেন। মুখ দ্যাখা যাচ্ছে না। আমিও আরেক অন্ধকার থেকে এই প্রথম তাকে জিজ্ঞেস করলাম “তাহলে আপনিই মিস্টার এক্স? নাকি অন্য কিছু?
যেন শতাব্দীর ওপারের অন্ধকার থেকে একটি উত্তর ভেসে এল “আমি গেস্টাপো”

সাদা জামা
“একদিন এই বাড়িগুলো সব ভূতের বাড়ি হয়ে যাবে”

ইদানীং এরকম একটা কথা হাওয়ায় হাওয়ায় উড়ে বেড়াচ্ছে। মাঝে মাঝে
ম্যুনিসিপ্যালিটির লোকজন এই দিকে আসে। তাদের গায়ে সাদা পোশাক। হাতে সাদা চক

কোনো বাড়ি ভূতগ্রস্ত হলেই তারা নাকি দরোজায় দাগ দিয়ে যাবে

কিন্তু ভূত হবে কী করে? এখানে কেউ ভূত-প্রস্তুত প্রণালী জানে বলে শুনিনি

সকাল-বিকাল ব্যালকনি থেকে সামনের সরু গলিটির দিকে তাকিয়ে থাকি…
ওই, ওই বুঝি ওরা এল

গা শিউরে ওঠে। হাত-পা কাঁপতে থাকে। সজোরে স্ত্রী আমার হাত চেপে রাখে

এতটাই আতঙ্ক যে, সে ঘরের ভেতরের সব সাদা জামা কাপড় কোথাও না
কোথাও লুকিয়ে রাখে

“একটাও সাদা জামা যেন চোখের সামনে না থাকে”

আর আমি মনে মনে আমার সব সাদা জামাকে মৃত বলে ঘোষণা করি

চোপা

আপনি নিজের কবিতার ভেতরে নিজেরই আগাপাশতলা বমি আপনি জমি দখলের লড়াইয়ে একজন চতুর ও সহজ পলাতক
আপনি গর্তে গর্তে যতদূর আপনি ইঁদূরের ভেতরে ইঁদুরও ততদূর আপনি নিজের মৃতদেহের চামড়ায় লেগে থাকা স্বদেশের মানচিত্র

তুমি পুস্তকের একশো চল্লিশ পৃষ্ঠায় লিপ্ত গোপন সংক্রমণ তুমি হাজার মেঘের ভিড়ে একমাত্র মাছের বাজার
তুমি অন্ধকার বটপাতার ওপরে একাকী মূহ্যমান শামুক তুমি সবুজ পূর্ণিমার স্রোতে ভাসমান ভুতুম প্যাঁচার নির্যাস

তুই একটা ভাঙা দোতারা থেকে ছিট্‌কে-পড়া গানের কঙ্কাল তুই একটা কাচের বোতলের ভেতরে নষ্ট চাঁদের কুলকুচি
তুই সমস্ত হর্ষধ্বনির ভেতরে উড়তে থাকা ছাই-সমগ্র তুই দিনান্তে পাখিটোলার ভেতরে ডাহুক-শালিখের ওলাওঠা

অ্যান্টার্কটিকা

এই সুগন্ধ শিশু, সাদা ও সমৃদ্ধ। শিশুটির হাত ছুঁয়ে ফেলতেই সুগন্ধ সাতকাহন
তেঁতুলতলার মাঠ পেরিয়ে খোলাবাজারের দিকে চলে যায়
শিশুটি বলল “চলো তোমাকে একটা ধবধবে সাদা ও শীতল দেশ দেখাই ওখানে
আমি কখনও কখনও স্বর্গের গন্ধ হয়ে বসবাস করি
তখন এক সুদূরের বালক এসে আমার দুই হাতে নতুন নতুন পালক লাগিয়ে দিয়ে
চলে গেল, যেন আমি একটা পাখি। সুগন্ধ আমার পথপ্রদর্শক

এমন যে একটি দেশ আছে, জানতাম না, যেখানে গোটা দেশটাকেই সমাধিক্ষেত্র
মনে হয়। আমি এখানে পৌঁছে দেখি আগেই সুগন্ধ বরফ হয়ে বসে আছে

এতদিন আমি কোনও কথা বলিনি। আজ বললাম “তুমি কি শুধুই শিশু নাকি শুধু
সুগন্ধ নাকি সমাধিক্ষেত্রের চাতালে নিছক এক পাতা বরফ

উত্তর এল “আমিই একমাত্র দেশ, আমি একমাত্র সুগন্ধ, আমি একমাত্র শিশু
এই দেশ থেকে তোমাদের দেশের বাড়ি যেতে আমার মাত্র দেড় মিনিট

গাছবন্দি

গাছ কখনো জামা-কাপড় পরে না। তার কোনো লজ্জাবোধ নেই। গাছকে একদিন পোশাক-আশাকের
দোকানে অবশ্যই নিয়ে যেতে হবে

গাছ কি কখনো ঘেউ ঘেউ করতে পারে? আমি অন্তত শুনিনি। কিন্তু কেউ কেউ নাকি শুনতে পায়। এবং
তাদের কেউ কেউ গভীর রাতে গাছের মুখে জাল গলায় শেকল পরিয়ে দিয়ে আসে

গাছের কিন্তু খুব খিদে আছে। তবে তারা যা খায় সব অনুবাদ করে খায়। প্রবল ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তারা
চাঁদ বা সূর্য গিলে খেতে পারে না

গাছে গাছে নাকি খুব প্রেম। যারা প্রেমের কবিতা লিখতে পারে না তাদের চিবুক ছুঁয়ে গাছ একটা ছোট্ট মন্ত্র
পড়ে “লেবুপাতা করম চা শরীর চায় গরম চা”। তারপর কবিতা আসে সপ্রেমে

তোমরা কি কেউ তুতুলগাছ চেন? এই একটি গাছ, যার সামনে দাঁড়ালে মন ভালো। না দাঁড়ালেও। মন
খারাপ হলে দু’মিনিট দাঁড়াই; কথা বলি। তুতুলগাছের সাথে মন বিনিময় সব গাছ জানে

আমাকে গাউচ্ছা বলতে পারো কিম্বা গাছুয়া। অসুবিধে নেই। কিন্তু গাছকে কেউ বৃক্ষ বললে গাছ খুব লজ্জা
পায়। আর কেন যে আমার চোখমুখ লাল হয়ে আসে জানি না

টাঙ্কি

— তুমি একটু কুসুমবনে মেঘের ঘনঘটা… এই গানটা গাইতে পারবে?
— আহা, তোর বুকটা এত ফাঁকা ফাঁকা কেন রে? তুই কি অসুখ?
— তোমার মুখটা যেন ঠিক লবণদানি, এবার একটু পানিয়াল হয়ে যাও
— এবার বসন্তে আমরা সব হসন্ত বিসর্জন দিয়ে দেব

ব্যালকনির হুকে একটি নীল তোয়ালে ঝুলছে। ঝুলছে মানে ভেজা তোয়ালেটি
হাওয়ায় শুকোচ্ছে। নীল তোয়ালের লোমে বা পশমে অনেকদিনের ঘুম ও জাগরণ
তাদের গায়েও লুকিয়ে লুকিয়ে অনেক হাওয়া

উলটোদিকের বারান্দায় একটি লাল রঙের তোয়ালে। তার গায়েও অনেক কথা লেখা। সে
কিন্তু একটু বেশিই বলতে চায়। সেইসব কথার অনেক চোখ আছে। সেইসব চোখের অনেক
মরিয়া দৃষ্টি আছে। সেইসব দৃষ্টি থেকে কুসুম কুসুম অনেক গল্প

আমি ওদের মাঝখানে যেতেই দু-টি তোয়ালে
আকাশের দু-রকম মুখ হয়ে গেল

নীল তোয়ালের বুক থেকে লজ্জ্বা আর
লজ্জ্বার বুক থেকে ব-ফলা খসে গিয়ে উড়ে গেল
লাল তোয়ালের বুকের দিকে

তোয়ালেও মানুষ; আর তোয়ালেকে মানুষ ভেবে
আমার জীবনে যে কত ভুল

কবি যখন

কবি যখন ছবি আঁকে তখন সেটা ট্রামলাইন না হয়ে আর উপায় থাকে না

আমার চোখের সামনে একটি ছবি; কাচ দিয়ে বাঁধানো ট্রামলাইন। চোখের সামনে থেকে
দৃশ্য শুরু হয় তারপর ট্রামলাইন ক্রমশ মিশে যায় দিগন্তের দিকে

ট্রামলাইন দেখতে দেখতে আমার ঘুমে অনেক চাঁদের উদয়, আবার দেখতে দেখতে
অনেক চাঁদের অস্ত। একটা ঘণ্টাধ্বনি টিংটিংটিং চলতে থাকে আমার ঘুমের সঙ্গে

আমাদের জলপাইগুড়িতে শেষে ট্রামলাইন পাতা হয়ে গেল? খবরটা শুনেই আমি রাস্তায়। ট্রামলাইন খুঁজতে আমি
এপথে-সেপথে। একটা দুর্ঘটনার আশঙ্কা আমার পিছে পিছে আসছে

কবি যখন ছবি আঁকে তখন ট্রামলাইন মুছে দেয়া ছাড়া তার আর কোনো উপায় থাকে না

Categories
কবিতা

শান্তমের কবিতা

ইস্কুল

কেউই আসে না

না ফেরা মানুষ; ভালোবাসাগুলি
ঠিকানা বদলে নেয় বার বার

Categories
কবিতা

বঙ্কিমকুমার বর্মনের কবিতা

নমুনা

আমাদের বিবাহের পচাগলা সুর কেউ শুনছে না, না-একটা ফুল গাছ, না-একটি প্রজাপতি। সবাই কেটে পড়ছে দূর থেকে ভ্রূ কুঁচকে। অযথা আমরা বিবাহের খরচ বাড়িয়ে চলেছি দিনকে দিন।

Categories
কবিতা

মামনি সরকারের কবিতা

মায়া ফলক


প্রেমের কবিতা লিখতে বললে
মা-বাবাকে মেলাতে বসি।
কিছু কিছু রাতের বাতাস

Categories
কবিতা

কাজী ওয়ালী উল্লাহর কবিতা

জীবনভঙ্গি

আশ্চর্য জীবনভঙ্গি আমি রপ্ত করেছি
ঘুমাব না, ঘুমালে জাগবই না
কেবল রোদের পরাগায়নে ঝিমিয়ে দুপুর কাটিয়ে দিই,

Categories
কবিতা

বিক্রম ঘোষের কবিতা

ঠাকুমা ও মা


মা বলতো শেষের কয়েকটা দিন ঠাকুমা নাকি শৈশবে ফিরে যেতে চেয়েছিল,
বিকেল হলেই আয়নার সামনে বসে লাল ফিতে দিয়ে সাদা একমুঠো পটের চুলে বিনুনি বাঁধত,

Categories
কবিতা

অর্ঘ্যকমল পাত্রের কবিতা

প্রিয় অসুখ


প্রিয় অসুখের কাছে এসে আরও উদ্বেলিত হয় রাত। প্রিয় তালগাছের দিকে তাকাই। তালগাছটিও আমার দিকে…

Categories
কবিতা

অনিকেশ দাশগুপ্ত’র কবিতা

রাতের ভোজবাজি

তারা পরস্পর এভাবে মুখোমুখি বসে থাকবে যেকোনো
অতিমাত্রিক তঞ্চন সরিয়ে উঠে আসা রাতের রেস্তোরাঁয়।
ত্রিপলের নীচে সারি সারি মানুষ ওদের পরিত্রাতা ভেবেছিল

Categories
কবিতা

ওয়াহিদা খন্দকারের কবিতা

ম্লান আলোর সারাংশ

নির্বাক উচ্চারণে গড়িয়ে যায় সশব্দ পায়চারি
উঠে যাচ্ছে উপনিবেশ,
পাহাড়সহ ধসে যাচ্ছে কাঠের বাংলো

Categories
কবিতা

সুমন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা

নির্বীজ প্রস্তাবনার দিকে

রাত্রির পাঠক্রম তোমাকে জটিল ভেবে সিঁদ কেটে ঢুকে পড়ছে অস্থিচাতুরী। ফসলের দিকে যেতে যেতে দেখা হবে বলেছিল বিষণ্ণ রক্তপাত। ঋতুভার খুলে খুলে আশ্চর্য হেঁটে আসে শান্ত মৃগপথ।