Categories
অন্যান্য

ফা-হিয়েন

ফা-হিয়েনের ভ্রমণ

সপ্তদশ অধ্যায়

এখান থেকে ভ্রমণ করো দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্ত ধরে। অতিক্রম করো আঠারো ইউ ইয়েন পথ। এসে পড়বে প্রসিদ্ধ সংকশা নগরীতে। বুদ্ধ তিন মাসাধিক কাল ত্রিয়াশত্রিনশাস স্বর্গে কাটিয়েছিলেন। সেখানে তিনি তাঁর মায়ের মঙ্গলার্থে অনুশাসনগুলি প্রচার করেন। কথিত আছে স্বর্গ থেকে যখন তিনি পৃথিবীর পথে নেমে আসেন, প্রথম পা রাখেন এই সংকশা নগরীতে। ঐশ্বরিক ক্ষমতা বলে তিনি স্বর্গারোহণ করেন। আর শিষ্যগণের অগোচরেই রয়ে যায় সে-সব কাহিনি। স্বর্গবাসের মেয়াদ শেষ হবার সাতদিন আগে তিনি তাঁর অদৃশ্যমানতা ত্যাগ করেন।

বুদ্ধের আত্মীয় ভ্রাতা অনিরূদ্ধ ছিলেন প্রবুদ্ধ বা আলোকিত ব্যক্তি। তিনি জ্ঞানচক্ষু মেলে সুদূরে দেখতে পেলেন লোকমান, পরম পূজ্য তথাগতকে। প্রবীণ গুরু মৌদগল্যায়নকে অনিরূদ্ধ বললেন, ‘এবার তুমি যাও, তথাগতকে প্রণাম করো।’ মৌদগল্যায়ন এগিয়ে এসে বুদ্ধের চরণে নিজেকে প্রণত করলেন এবং একে-অপরকে অভিবাদন জানালেন। বুদ্ধ বললেন, ‘মৌদগল্যায়ন, আর সাতদিন পর পৃথিবীর পথে ফিরব আমি।’ এই কথা শুনে ফিরে গেলেন মৌদগল্যায়ন।

ইত্যবসরে আটটি সাম্রাজ্যের সম্রাট, তাদের মন্ত্রী, আমাত্য এবং প্রজাগণ, বুদ্ধের দীর্ঘ অদর্শনে হয়ে পড়ল ভারাক্রান্ত। এবার প্রিয় তথাগতের প্রত্যাবর্তনে সারা দেশজুড়ে সকলে মেঘরাশির মতো ঘনিয়ে এলেন। প্রত্যেকের বাসনা একটিই, পরম পূজ্যের দর্শন। একজন ভিক্ষুণী স্বগোতক্তির মতো হৃদয় নিংড়ে উচ্চারণ করলেন, ‘আজ রাজা, মন্ত্রী, সাধারণ মানুষজন সকলেই গৃহের বাইরে বেরিয়ে এসেছেন বুদ্ধের সন্দর্শনে। আমি একলা ভিক্ষুণী, কীভাবে দেখা পাই তাঁর?’ বুদ্ধ অন্তর্যামী। এই কাতর বাসনা জানতে পেরে তাঁর ঐশ্বরিক ক্ষমতা দিয়ে এক মুহূর্তে সেই মহিলাকে চক্রবর্তী রাজার রূপ দিলেন। এবং তিনিই প্রথম অভিবাদন জানালেন প্রিয় বুদ্ধকে।

স্বর্গ থেকে অবতরণের সময় বুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হল রত্নখচিত ধাপ-সহ তিনটি উড়ান। সপ্তরত্ন, সুবর্ণ, রৌপ্য, বৈদুর্য্য, স্ফটিক, মুক্তা, লোহিতক, মুসরগলভ দিয়ে তৈরি মধ্যবর্তী উড়ানে নেমে এলেন বুদ্ধ। ব্রহ্ম প্রস্তুত করলেন রূপার সিঁড়ি। চামরী গাইয়ের লেজ থেকে তৈরি শ্বেত মার্জনী হাতে তিনি এসে দাঁড়ালেন ডান দিকে। দৈব অধীশ্বর শিহ তৈরি করলেন রক্তবর্ণ সোনার সিঁড়ি। সপ্তরত্নে প্রস্তুত ছাতা হাতে এসে দাঁড়ালেন বাঁ-দিকে। অগণিত আমন্ত্রয়ী ঈশ্বরগণ বুদ্ধের অনুসারী হয়ে নেমে এলেন পৃথিবীতে। বুদ্ধ পৃথিবীর মাটিতে পা রাখতেই তিনটি উড়ানই ভূমিতে বিলীন হল। পড়ে রইল কেবল সপ্তসিঁড়ি।

পরবর্তীতে সম্রাট অশোক সেই সিঁড়ির অন্তঃসন্ধানে খননকার্য শুরু করলেন। খুঁড়তে খুঁড়তে নরকের দ্বার প্রান্তে এসে পৌঁছোলেও কোনো তল পাওয়া গেল না সেই সপ্তসিঁড়ির। আর এর পর থেকেই সম্রাট হয়ে পড়লেন গভীর ধর্মবিশ্বাসী। এই স্থানে নির্মাণ করলেন বৌদ্ধমঠ। মধ্য উড়ানে স্থাপিত হল ষোলো ফুট উচ্চতার বুদ্ধ মূর্তি। মূর্তির পিছনে নির্মিত হল ত্রিশ হাত উচ্চতার একখানি প্রস্তর স্তম্ভ। আর সেই স্তম্ভের শীর্ষে আসীন হল এক সিংহ মূর্তি। আর ভিতর দিকে স্তম্ভ গাত্রে চারপাশে উৎকীর্ণ বুদ্ধের মুখশ্রী। ভিতর-বাহিরে স্তম্ভটি কাচের মতো স্বচ্ছ।

কিছু বিরূদ্ধ মতের গুরু এই স্থান নিয়ে শ্রমণদের সঙ্গে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। বাদানুবাদ অন্তিম পর্যায়ে পৌঁছোয় শ্রমণগণের গুরুত্বপূর্ণ বিবৃতিতে, এ-স্থানে বসবাসের অধিকার যদি কেবল শ্রমণদের থাকে, তবে এখন তার প্রমাণসাপেক্ষে কিছু অলৌকিক ঘটনা ঘটবে। তাঁদের এ-কথা বলবার সঙ্গে সঙ্গে, স্তম্ভ শীর্ষে বসে থাকা সিংহ গর্জন করে উঠল, তাঁদের অধিকারের সমর্থনে। এতে গুরুগণ নিদারুণ ভীত হয়ে পড়েন।

তিন মাসাধিক স্বর্গের ঐশ্বরিক আহার সেবন করে বুদ্ধের গা থেকে স্বর্গীয় সুগন্ধি বেরতে লাগল। তাই তিনি তৎক্ষণাৎ স্নান করতে শুরু করলেন। যে-স্থানে এই ঘটনা ঘটে সেখানে পরবর্তীকালে একটি স্নানাগার তৈরি করা হয়। এই স্নানঘর আজও বর্তমান। যেখানে ভিক্ষুণী, সবার প্রথম বুদ্ধের অভিবাদন করেন, সেখানে একটি প্যাগোডা স্থাপিত হয়। বুদ্ধ যেখানে সর্বসমক্ষে চুল ও নখ কাটেন, সেখানেও তৈরি হয় প্যাগোডা। এ-সকল প্যাগোডা আজও বর্তমান। দৈব অধীশ্বর, শিহ আর ব্রহ্মার উপস্থিতিতে বুদ্ধ যে-স্থানে অবতীর্ণ হন, সেখানেও নির্মিত হয় একটি প্যাগোড। শ্রমণ এবং শ্রমণীগণ মিলে এই বিহারে সহস্রজনের বাস। কিছু জন আছেন মহাযান মতাবলম্বী আর কিছু হীনযান মতাবলম্বী। একটি সর্বজনীন তহবিল থেকে সকলেরই আহারের ব্যবস্থা হয়। এখানে রয়েছে একটি শ্বেত কর্ণ ড্রাগনের বাস। বিহারের শ্রমণগণের রক্ষক যেন সে-ড্রাগন। ভূমি আবাদ রাখে, নির্ধারিত ঋতুতে বৃষ্টি ঝরায়, সকল বিপর্যয় প্রতিহত করে। তাই তো শান্তির আবাস এই বিহার। শ্বেত ড্রাগনের এই সহৃদয়তার কৃতজ্ঞতাস্বরূপ, স্রমণগণ ড্রাগনের একটি বিগ্রহ স্থাপন করলেন, আর তার শয়নের জন্য স্থান প্রস্তুত করলেন। বিশেষ নৈবেদ্য দেওয়া হয় ড্রাগনের উদ্দেশে। প্রতিদিন শ্রমণদের মধ্যে থেকে তিনজনকে পাঠানো হত ড্রাগনের বিগ্রহের কাছে। সেখানে তাঁরা আহার সম্পন্ন করতেন। প্রতি বছর বর্ষাশেষে ড্রাগন নিজ রূপ বদলে হয়ে যেত সাদা কান বিশিষ্ট ক্ষুদ্রাকায় সাপ। সন্ন্যাসীরা যখন বিষয়টি জানতে পারলেন, ননীভরতি একটি তাম্র পাত্রে ড্রাগনটিকে রেখে দিলেন। প্রতি বছর একবার ঐ পাত্র থেকে বাইরে বেরিয়ে আসত ড্রাগনটি।

এই দেশ সুফলা। সাধারণ মানুষ সুখী-সমৃদ্ধ। তুলনারহিত এই দেশ। বিদেশ থেকে কেউ এলে তাঁরা অতিথি সেবায় মগ্ন থাকে অনিবার।

এই মঠ থেকে পঞ্চাশ ইউইয়েন দূরে আছে আর একখানি মঠ। হুও চিং সেই মঠের নাম। হুও চিং আসলে ছিল এক অশুভ আত্মা। বুদ্ধের সংস্পর্শে এসে এই আত্মার রূপান্তর ঘটে। এই স্থানে পরবর্তীতে একটি বিগ্রহ তৈরি করা হয়। বুদ্ধের শিষ্য অরহত হাত ধোওয়ার জন্য একটু জল নিলেন, আর হাতের ফাঁক গলে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল মাটিতে। জলের এই দাগ আজও দেখা যায় এখানে। সে-জলবিন্দু বয়ে যায়নি নিম্নে। এমনকী মুছেও ফেলা যায়নি। এই জায়গাতেই বুদ্ধের আর একটি প্যাগোডা আছে। এক শুভ আত্মা প্রত্যেকদিন জলসিঞ্চন করে পরিষ্কার রাখে এই প্যাগোডা। কোনো মনুষ্য সহায়তা দরকার নেই। গোটা জায়গাটাজুড়ে ‍রয়েছে শতেক ছোটো ছোটো প্যাগোডা। দিনভর ঘুরে গুনে শেষ হয় না এই প্যাগোডাগুলি। যদি গুনতেই চাও, তবে প্রতিটি প্যাগোডার পাশে দাঁড় করিয়ে দাও একজন করে মানুষ। তারপর গুনে নাও ঐ মানুষগুলিকে।

ছয় থেকে সাতশো জন শ্রমণ নিয়ে এখানেই রয়েছে আর একটি বৌদ্ধ বিহার। এই বিহারের একটি স্থানে বুদ্ধ কিছু আহার গ্রহণ করেন এবং সেখানেই তিনি নির্বাণ লাভ করেন। ঐ বিশেষ জায়গাটি গোরুর গাড়ির চাকার আকৃতির। বিহারের সর্বত্র রয়েছে সবুজ গাছপালা। কেবলমাত্র ঐ স্থানটিব্যতীত। বুদ্ধের পোশাক শুকাতে দেওয়া হত যেখানে সেই স্থানটিও সবুজহীন। সে-সব কাপড়ের দাগ এই স্থানে আজও অমলিন।

প্রথম পর্ব

দ্বিতীয় পর্ব

তৃতীয় পর্ব

চতুর্থ পর্ব

পঞ্চম পর্ব

Categories
অন্যান্য

শতদল মিত্র

মস্তানের বউ

১০

সেদিনও ছিল দুপুরই। তবে গ্রীষ্মের না, বসন্তের— যেহেতু, কাছে পিঠে কোথায় যেন কোকিল ডেকে উঠেছিল। কেন-না এ-এলাকাটা নতুন গড়ে উঠেছে। মুদিয়ালির কিশলয় গলির পেছন থেকে নিয়ে পার্টি অফিসের পেছনের কয়েক ঘর বিহারীবস্তি ছুঁয়ে ওদিকে ফতেপুর সেকেন্ড লেন পর্যন্ত বিস্তৃত বিরাট যে-হোগলার জলাজঙ্গলটা বিরাজিত ছিল জলের মাঝে মাঝে কয়েকখানি শিমুল আর কদমের গাছ নিয়ে, এই তো সেদিনই যেন-বা, বিশাল বিপুল এক থম মারা নির্জনতা বুকে জাগিয়ে— যে-নির্জনতা ভর দুপুর বেলাতেও মাঝ-নিশার অন্ধকার ডেকে আনত, যেখানে দিনমানে কখনো কখনো বেওয়ারিশ লাশ ভেসে উঠত এই সেদিনও, সেই জলাটা একদিন রাতারাতি ভানুমতীর জাদুতে বা ময়দানবের ছোঁয়ায় বর্তমানে মধ্যবিত্ত মানুষের একতলা বা দোতলার জমাট বসতি, পুরোনো জাগানো দুয়েকটি শিমুল বা কদম গাছ সমেত, যেগুলো আপাতত আজও বেঁচে মানুষের লোভী শানিত নখর এড়িয়ে। এখন ময়দানব কৃষ্ণ হলেও আসল ভানুমতী-জাদুকাঠিটা ছিল আসল ভগবান প্রদীপ রায়ের হাতেই! লোকে বলে আধাআধি হিস্‌সা ছিল নাকি কৃষ্ণের আর প্রদীপের। লাল পার্টির যাই বদনাম থাকুক তারা কিন্তু দলের ওপর থেকে নিচু সবাইকে দিয়ে-থুয়েই খায়। যেমন দেখতে দেখতে উবে যায় ঘেঁষকালের মাঠ, শান্তিনগরের বিপুল সেই হোগলার বন— না, সেখানে ইদানীং আর লাশ ভেসে ওঠে না, কেন-না লাল জমানার মধ্যগগনে শান্তি হি শান্তি! এবং টাকা মাটি, মাটি টাকা— এ ঈশ্বরীয় বাণীটিও বাস্তব আদল পায়! সে-সব টাকাও সমান বখরায় ভাগ হয়েছিল কৃষ্ণ আর প্রদীপের মধ্যে। যেমন উবে যায় লালার মাঠ, পাল বাগানও। শুধু আজও রয়ে যায় বাঁধা বটতলার বাবুলের গলির পেছন থেকে নিয়ে রামদাসহাটি পর্যন্ত বিস্তৃত হোগলার জলা-জঙ্গলটা, যেহেতু সেখানে মাঝে মাঝে জেগে থাকা দ্বীপে চোলাইয়ের চাষ হয়, এবং অবশ্যই পার্টি, পুলিশ, প্রশাসনের নজরের আড়ালেই, যেহেতু জলাটা কলকাতা কর্পোরেশন আর মহেশতলা গ্রামপঞ্চায়তের সীমানায়, ফলে দুই থানার মাঝখানে নিশ্চিন্তে বিরাজমান! হ্যাঁ, বর্তমানে মেটেবুরুজ যেমন উন্নয়নের প্রগাঢ় শরিক হয়ে মিউনিসিপালিটির ঊর্ধ্বে উঠে কলকাতা কর্পোরেশনের বর্ধিত এলাকা— ওয়ার্ড নং ১৩৩-১৪১, মহেশতলাও ক-বছর বাদে উন্নততর উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে পঞ্চায়েত থেকে মিউনিসিপালিটিতে উন্নীত হয়ে যাবে।

যে-কথা হচ্ছিল, সেদিনও ছিল দুপুরই। তবে গ্রীষ্মের না, বসন্তের— যেহেতু পুরোনো জাগানো শিমুল কিংবা কদম গাছে কোকিল ডেকেছিল, যা সেই দুপুরটাকে বিষণ্ণ ও ঘন করে তুলেছিল। আর সেই ঘন দুপুরখানি আরও ঘনান্ধ হয়ে উঠেছিল যখন কৃষ্ণ ঘরে এসেছিল, কেন-না তার শ্যাম মুখখানি ছিল কালো, থমথমে। ফলে সে-ক্ষণের ঘন আঁধার ভাঙতে সাহস হয়নি রূপার। বিস্মিত রূপা অপাঙ্গে তাকিয়েছিল কেবল, কেন-না কৃষ্ণের আজকের ফেরাটা সঠিক সময়ের ছিল। পরে স্নান করে, ভাত খেয়ে একটু ধাতস্থ হয়ে ফুকরে উঠেছিল কৃষ্ণ আপন মনে নিজেকে শোনাতেই যেন,— হেরে গেলাম। একটা বাচ্চা ছেলে হারিয়ে দিল! নাক-মুখ দিয়ে গলগলিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ে সে, মনের চাপা হাহাকারটাকেই উগড়ে দেয় যেন।

ক-দিন ধরেই শেরু নামটা শুনছে রূপা। ধানখেতি বস্তির বছর সতেরোর কিশোর সে। কিশোরই তো, তবুও তার করিশ্মায় আব্বাস-বাদশার একচেটিয়া খানদান ভেঙে চৌচির যেন। কাচ্চিসড়ক, আয়রন গেট রোড, শাহী আস্তাবল লেন, ধানখেতি, বাত্তিকল কাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে সে ইদানীং! অথচ কেউ তাকে দেখেনি নাকি! ডকের চোর, ট্রান্সপোর্টার, লেবার কনট্রাক্টর— সবার কাছ থেকে তোলা তুলত তার দল। যারা এতদিন আব্বাসকে দিয়ে এসেছে, তারা প্রথমে পাত্তা দেয়নি। ফলে দু-একটা লাশ পড়ে যায়, যে-খেলার যা নিয়ম তা মেনেই। ফলে টাকা আপনি পৌঁছে যেতে থাকে তার কাছে। সে-কিশোর, শেরু সব টাকা নাকি বিলিয়ে দেয় ধানখেতি-বাত্তিকলের গরিব সকল মানুষকে। পুলিশ অনেক বার রেড করেছে ধানখেতি বস্তি আচমকা, দিনে-রাতে। না, শেরুর টিকিটি খুঁজে পায়নি তারা। বোরখা পরা মহিলারা প্রত্যেকবারই পুলিশকে ঘিরে ধরে জানিয়েছে যে,— শেরু-এরু কিসিকো হমলোগ নাই জানিস। না, পুলিশরা বস্তির কোনো ছোকরাকেও ধরতে সক্ষম হয়নি। কেন-না সে মহিলাকুল সকল সময়েই তাদেরকে ঘিরে থেকেছে। পুলিশ জোরও করতে ভয় পেয়েছে— ডি॰সি॰ হত্যার কেসটা যে তখনও দগদগে। দ্বিতীয়ত এ-বস্তির গলির গলতা, তার ভুলভুলাইয়া! সরু সে-গলির দু-পাশে ঝুঁকে আছে বস্তির খাপরা-টালির চাল, মাথা ঠেকাঠেকি করে যেন, আবার হঠাৎ তুমি দেখলে সে-গলি শেষ হয়েছে কোনো বাড়ির উঠোনে, বেকুব তুমি জানো না যে, সে-বাড়ির লাগোয়া কাঁচা ড্রেনের পাশ দিয়ে আবার এক নতুন গলির শুরু। যদি-বা জেনে নিয়ে সে-পথ ধরে এঁকে বেঁকে এগোলে, আচমকা দেখলে তুমি সহসা হাজির একচিমটে এক খোলা প্রান্তরে, তাকে ঘিরে টালি-খাপরায় ছাওয়া দশ ঘর! ব্যস, ফেঁসে গেলে তুমি! যদি শত্রু হও, পিছন পানে ফিরতে চেয়ে দেখলে সে ড্রেন ঘেঁষা গলির আধা- অন্ধকারে জ্বল জ্বল করছে কয়েকটা শার্দূল চোখ সে-আঁধার চিরে! অগত্যা পুলিশকে ফিরে যেতে হয় বার বার মেন রাস্তায় খাড়া তাদের গাড়ির নিরাপদ ঘেরাটোপে। কিংবা এ এমনও চাল হতে পারে পুলিশ-প্রশাসনের আব্বাস-বাদশাকে সবক শেখানোর! হতে পারে বখরায় কম পড়ছে লালবাড়ির।

বাদশা নামটা ইদানীং শুনেছে রূপা। দেখেছেও একদিন এক ঝলক। হুডখোলা জিপে দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল সে— ছ-ফুটের ওপর লম্বা, টকটকে গায়ের রং, সাদা জামা, সাদা প্যান্ট, সাদা জুতো, এক কানে ঝিলিক দিচ্ছে সোনার হাত— পাঞ্জা। হ্যাঁ, বাদশার মতোই তার শান-সওকত। অল্প দিনেই আকাশ ছোঁয়া উত্থান। আব্বাসের হাত ওর মাথার ওপর, ও নাকি পরের ভোটে সবুজ দলের উমিদবার-প্রার্থী এবং জিতবেও, কেন-না আব্বাস ফ্যাক্টর। শোনা যায় সবুজ পার্টির শিয়ালদ-র ছোড়দার সঙ্গেও ওঠাবসা, বেরাদারি। তবে এটা সত্যি যে, কলকাতা-হলদিয়া ডকের অর্ধেক ট্রান্সপোর্ট, ট্রেলারের মালিক নাকি সে। আবার এদিকের জাহাজ কারখানা, রাজাবাজার ডক ইয়ার্ড, জি॰ই॰সি॰, ল্যাম্প ফ্যাক্টরি, সাবান কল— সবের লেবার কনট্র্যাক্টের অর্ধেক তার, বাকি অর্ধেক প্রদীপ রায়ের বকলমে কৃষ্ণের।

সহসা সে দুপুরের শব্দহীনতাকে চলকে দিয়ে, ফলত রূপার ভাবনাকেও, কৃষ্ণ বাঁহাতের তালুতে ডান হাতের ঘুসির আঘাত হেনে হিসহিসিয়ে উঠেছিল— গো হারান হেরে গেলাম! দাঁড় করিয়ে গোল দিয়ে চলে গেল বাচ্চা ছেলেটা! মুড়ি-মুড়কির মতো পেটো। সঙ্গে শূন্যে ফায়ার! আমরা পালটা দিলে পাড়ার সাধারণ মানুষের ক্ষতি হত। সেটা আমি থাকতে হার্গিস কোনোদিন হতে দেব না। অপেক্ষায় ছিলাম, যদি প্রদীপদার বাড়ি অ্যাটাক হত তখন তো…। আর প্রদীপদা বলে কিনা,— ‘আমরা কাপুরুষ! আমাদের নাকি ফালতু পুষছে!’ একটু থামে কৃষ্ণ, যেন-বা দম নেয় ক্ষণিক ভেতরের রাগটাকে পরিপূর্ণ ভাবে উগড়ে দেবে বলে।

— আমরা ফালতু! যে-যুদ্ধের যে-কৌশল— আমরা মোটে জনা দশেক আর ওরা পঞ্চাশ-ষাট জন। আগে কোনো খবর ছিল না, এমনই হঠাৎ চাল! তা তোর গোয়েন্দা-পুলিশ কি ঘাস ছিঁড়ছিল! শুধু আমরাই ফালতু! আমদের পোষে হারামিটা! কে কাকে পোষে! আমরা আছি বলেই তো তুই আছিস! শালা কালা নাগ!

ঘটনাটা সত্যিই চমকে দেওয়ার মতোই, যেহেতু তা চিন্তারও অতীত ছিল, কেন-না প্রদীপ রায়ের আস্তানা ফতেপুর সেকেন্ড লেনের নোনাপুকুরে, খাঁটি হিন্দু বাঙালি পাড়া, তাছাড়া কৃষ্ণের খাস তালুক— সবচেয়ে বড়ো কথা প্রদীপ রায় নামের প্রতাপ, মাটির দুর্গের আসল নবাব যে, যতই ভোটে হারুক সে, বা মানুষ যতই অপছন্দ করুক না কেন! এ হেন প্রদীপ রায়ের বাড়ি পর্যন্ত ধাওয়া করেছিল একটা নাদান বাচ্চা ছেলে, নালায়কই যে! যা আব্বাস-বাদশারও স্বপ্নে হার্গিস আসবে না। তাও দু-আড়াই মাইল দূরের ধানখেতি থেকে উজিয়ে রামনগর লেন হয়ে, মিঠাতলাও, ব্রাহ্মসমাজ রোড, করমঞ্জিল, মুদিয়ালি ফার্স্ট লেন, মুদিয়ালি হরিসভা পার করে, ফতেপুর সেকেন্ড লেনের মতো হিন্দু পাড়ায় রঙবাজি, প্রদীপ রায়ের প্রতাপকে পায়ে দলে! এক ফুঁয়ে নিবিয়ে! বৃষ্টির অঝোর ধারার মতো পেটো ফেটেছে। নাঃ, দম আছে ছেলেটার! সব্বাই একবাক্যে সেলাম ঠুকেছিল শেরুকে। এখন নেতার প্রতাপ পাংচার হলে নেতা তো সর্বহারা! সমান সত্য মস্তানের ক্ষেত্রেও। প্রতিটা মানুষ ঘরে লুকিয়ে ক্ষ্যা-ক্ষ্যা হেসেছিল, যদিও মনে মনে। ফলে গল্পের গোরু গাছ ছাড়িয়ে আকাশে ভেসেছিল।

— আবে, কালা নাগ, বাপকা আওলাদ হো বাহার নিকালিস!

— কিয়া বে শালা নাগ, চুহা বন গায়িস ক্যা!

একটা করে ডায়ালগ একটা করে পেটো।

— দেখলিস তো শেরুকা করিশ্মা!

— ইয়ে তো জাস্ট ট্রেলার থা বে নাগ কা আওলাদ। পিকচার অভি বাকি হ্যায়।

এমন বলেই নাকি ওরা ফিরে গিয়েছিল পেটোর বৃষ্টি ঝরাতে ঝরাতে, সঙ্গে শূন্যে ফায়ার। এমনকী এ-গানও নাকি ভেসে উঠেছিল পেটো-পিস্তলের সংগতে— টিপ টিপ বরষে পানি, পানিমে আগ লাগে তো…! যেমন ঝড়ের বেগে এসেছিল, তেমনই ঝড়ের বেগে ফিরেও গিয়েছিল ওরা, যে-ঝড়ে প্রদীপ রায়ের সাজানো বাগান একটু হলেও তছনছ হয়েছিল বৈকি!

— আরে ওই ফর্সা পানা লম্বা ছেলেটাই শেরু।

— ধুস! শেরু তো কালো।

— যাইহোক, দেখিয়ে দিল বটে ছেলেটা। সত্যি দম আছে। নইলে বাঘের গুহায় এসে এমন রংবাজি!

কথারা আড়ালে আবডালে গড়ে ওঠে, হাওয়া পায়, ভেসে যায় দূরে রং পালটে পালটে।

হ্যাঁ, মুসলিম মহল্লায় চিকন কালো প্রদীপ রায় কালা নাগ বলেই প্রখ্যাত।

তবে নাগ তো! শীতঘুমে গেলেও যখন গর্ত থেকে বের হয়ে আসে শীত-অবসানে, তখন বিষথলি তার কানায় কানায় ভরা, টনটনায় তা যতক্ষণ না এক ছোবলে সবটুকু বিষ উগড়োতে পারে সে। এর পরের সময়টা, যা শীততুল্যই যেন প্রদীপ রায়ের সাপেক্ষে, কেন-না এই সময়টা সে নির্বিকার থাকে। আর এ-শীতলতার ঘেরাটোপে সে প্রশাসনের সর্বোচ্চস্তরে প্রভাব চালায় নীরবে, যেহেতু এটা প্রবাদ যে, আগুনের ফুলকির পিছনে হাওয়া থাকেই! সে-হাওয়ার উত্স খুঁজতে জানতে হয়। এবং ওপর তলার একটু তল্লাশিতেই খোঁজ মেলে এ-আগুনের পিছনে সেই শিয়ালদার ছোড়দা যোগ! অতএব গোপন রফা হয় রাজায় রাজায়। তবে সে-রফা অমূল্য আপোশের, নাকি মূল্যযুক্ত পাবলিক তা জানতে পারে না। শুধু ভাসা ভাসা এটুকুই জানতে পারে যে, সবুজ পার্টির নেতা সে-কিশোরকে নাকি ডেকে পাঠিয়েছিল এক ধোঁয়ামাখা সাঁঝে তাদের বাঙালিবাজার-বিচালিঘাটের দোতলা পার্টি অফিসে— হ্যাঁ, অতি অবশ্যই ইমানের শপথ চোয়ানো গোপনে।

কাচ্চি সড়ক, বাঙ্গালিবাজার থেকে শাহী ইমামবারা, থানা, লাল মসজিদ, শ্লটারহাউস রোড তক খানদানি মেটেবুরুজ সকালে শুনশান, বেলা যত বাড়ে, দিন ঢলে, আঁধার ঘনায় ততই সে জেগে ওঠে জুলুশে-জৌলুসে। সে-সাঁঝও ছিল তেমনই জৌলুসময়। একটি দোহারা কিশোর চোখের নির্লিপ্ত ইশারায় তার সঙ্গি চারজন সদ্য যুবাকে কাছে-দূরে লোকের ভিড়ে দাঁড় করিয়ে রেখে তরতরিয়ে উঠে যায় পাঞ্জাছাপ পার্টি অফিসের দোতলায়। সঙ্গে সঙ্গে পানের গুমটিতে, সামনের ফুটপাথে ফলের দোকানে কয়েকজন ক্রেতার মধ্যে আলতো চোখাচোখি হলে কিছু বাদে লুঙ্গি-শার্ট পরা একজন উঠে যায় ওপরে নিঃশব্দে। কত লোকই তো এ-সময়ে পার্টি অফিসে যায় দরকারে-অদরকারে! ভেতরে লোক আছে দেখে যেন থমকায়, ইতস্তত করে, নাদান পাবলিক হেন। ততক্ষণে চোখে-চোখে যা কথা হওয়ার হয়ে গিয়েছে ঘরের ভেতর থেকে বাইরে। কেন-না ঘরের ভেতর থেকে নেতাসাবের খাস চেলা খিঁচিয়ে উঠেছিল,— থোড়া ঠাহর যাও বাহার। অব জরুরি মিটিন চল রহা হ্যায়।

পিঠ ফেরানো কিশোরটির ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কিছু সংকেত হানলেও হানতে পারে, যেহেতু সে চকিতে ঘাড় ঘুরিয়েছিল এবং একজন এলেবেলে মানুষকেই শ্লথ পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেতে দেখেছিল। কিন্তু ইমান শব্দটা, ও বাইরে তার অতি বিশ্বস্ত সঙ্গীদের উপস্থিতি তাকে নিশ্চিন্ততা দিয়েছিল। কিন্তু তার অজান্তেই লোকটি সিঁড়ির লান্ডিং-এ দাঁড়িয়েছিল দেওয়ালে পিঠ দিয়ে শিকারি শার্দূলহেন বিভঙ্গে। কিছু বাতচিত, কিছু চেতাবানি, কিছু লেনদেন ও উত্সাহব্যঞ্জক কথার শেষে কিশোরটি দরজা পার হয়ে সিঁড়ির মুখে ঘুরতেই শার্দূল হেন লোকটি চকিতে লুঙ্গির পেছন থেকে সাইলেনসার লাগানো পিস্তল বার করে নিঃশব্দে ছ-ছ-টা দানা গেঁথে দিয়েছিল কিশোর শেরুর শরীরে, নামে-কামে শেরই ছিল যে, সেহেতু ঘাতকজন পুলিশি শিষ্টাচারে দু-পা জোড়া লাগিয়ে স্যালুট ঠুকেছিল লুটিয়ে পড়া বীর শত্রুকে।

ততক্ষণে সিভিল ড্রেসের বাকি পুলিশরা পজিশন নিয়ে নিয়েছে পিস্তল উঁচিয়ে,— ভিড় হটাইয়ে সবলোক। জলদি। বিচালিঘাটের গলির ভেতর লুকিয়ে থাকা পুলিশ ভ্যান ত্বরিতে চলে আসে অকুস্থলে। পুলিশ দখল নিয়ে নেয় গোটা চত্বরের। ঝপাঝপ শাটার নামে দোকানে। ফুটপাথের হকারের মাল গড়াগড়ি যায়। যেমন সিনেমায় হয় তেমনই। শেরুর সঙ্গীরা বিপদের গন্ধ পেয়ে উদ্‌ভ্রান্ত মানুষের ভিড়ে বোধহয় নিঃশব্দে মিশে গিয়েছিল। ভ্যানে চেপে শেরু চলে যায় লালবাজারে। সবুজ নেতা চোখের আঁশু মুছে ধরা গলায় বলেছিল পরে সংবাদ মাধ্যমকে— কৌন থা হামকো কিয়া মালুম! উ তো উপর ভি নেহী উঠ সকা। হাম উসকা সুরত ভি নেহি দেখ সকা। সিঁড়িমেই তো পুলিশ উসকো মার দিয়া। পুলিশ কা ইয়ে গুণ্ডাগর্দিকো হমারা পার্টি অপোজ করতে হ্যাঁয়।

ততক্ষণে বৈদ্যুতিন সংবাদ মাধ্যমে এই খবর ঝলসে ওঠে যে— মেটিয়াবুরুজের শেরু নামক কুখ্যাত গুন্ডা পুলিশের সঙ্গে এনকাউন্টারে নিহত আজ সন্ধ্যায়।

সে-সাঁঝে বাত্তিকল-ধানখেতিজুড়ে শকুন সান্নাটা নেমেছিল, যা থকথকে কালো।

হঠাৎ শাঁখের আওয়াজে বাস্তবে ফেরে রূপা। সন্ধ্যের ধূপ-জল দিতে দোকানের বাইরে আসে সে। পাশের হলটা অভ্যাসবশত নজর টানে তার। আবছা অন্ধকার পোড়ো প্রাসাদের কঙ্কাল যেন তা। কে এক শামবাবু কিনে নিয়েছে হলটা— শামবাবুর আসল নাম রূপা জানে না, এটুকুই শুনেছে যে, সে নাকি বটতলার খুব বড়ো দর্জি ওস্তাগর— কাঁঠাল বেরিয়া রোডে হাভেলি তার। হয়তো বকলমে আব্বাসেরই লোক! ফতেপুরের অত বড়ো গ্যারেজটাও নাকি কিনে নিয়েছে, হাসপাতাল বানাবে। তার দোকানটাও কিনতে চায় সে। না, ন্যায্য দামই দেবে বলেছে, বরং বেশিই তা। বিক্রিই করে দেবে সে। কী হবে আর রেখে? নেহাত স্মৃতির অভ্যাস, তাই আসা! লক্ষ্মী-গণেশের মূর্তিতে ধূপকাঠিটা গোঁজার আগে কৃষ্ণের ছবিতেও একবার ধূপ দেখায় সে।— বোকা, বড়ো বোকা ছিল লোকটা, শেরুর মতোই। রাজনীতির দাবার চালে সামান্য বোড়েই শুধু। সন্ধ্যার ছায়া ক্রমে জমাট বাঁধতে থাকে দোকানজুড়ে। সুইচ টিপে আলো জ্বালে রূপা।

প্রথম পর্ব

দ্বিতীয় পর্ব

তৃতীয় পর্ব

চতুর্থ পর্ব

পঞ্চম পর্ব

Categories
অন্যান্য

সোমা মুখোপাধ্যায়

তাঁতশিল্পী আলপনা ভড়

সংস্কৃত তন্তু থেকে তাঁত শব্দের উৎপত্তি। বাংলার তাঁত এক ঐতিহ্যবাহী শিল্প। একসময় মানুষ গাছের ছাল বাকল দিয়ে পোশাকের প্রয়োজন মেটাত। ধীরে ধীরে কৃষিভিত্তিক সভ্যতার উন্মেষের সঙ্গে সঙ্গে স্থায়ী বসতি ও গড়ে ওঠে। মানুষ নিজের ব্যবহারের জন্য বোনা শুরু করে। পৃথিবীর নানা দেশে নানা ধরনের বোনার এই পদ্ধতি রয়েছে। এভাবে বাংলার তাঁতশিল্পের এক সুপ্রাচীন ইতিহাস আছে।

পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সব জেলাতেই তাঁতের কাজ হয়। এর মধ্যে হুগলি জেলার ধনিয়াখালি, রাজবলহাট, বেগমপুর এইসব অঞ্চলে তাঁতের সুপ্রাচীন ইতিহাস আছে। এই লেখায় রাজবলহাটের এক তাঁতশিল্পী আলপনা ভড়ের সঙ্গে পরিচয় করাব।

বছর তিনেক আগে রাজবলহাটে গিয়ে পরিচয় হয়েছিল আলপনা ভড়ের সঙ্গে। রাজবলহাটের প্রসিদ্ধি দেবী রাজবল্লভীর জন্য। সকালে পৌঁছে মন্দিরে ঘুরে প্রসাদের জন্য অপেক্ষায় ছিলাম। এই সময় পরিচয় হয় আলপনা ভড়ের স্বামী রবিন ভড়ের সঙ্গে। আমার গবেষণা বিষয়ে শুনে তিনি ওঁর বাড়ি নিয়ে যান। মন্দির থেকে হাঁটাপথে মিনিট পাঁচেক। শুনেছিলাম রাজবল্লভীর মন্দির ঘিরে আছে তাঁতিপাড়া। ঠকঠকি তাঁতের শব্দে মুখরিত থাকে এ-অঞ্চল।

গ্ৰামের পাড়ার বিভিন্ন বাড়ির পাশ দিয়ে যেতে যেতে সেটাই নিজের কানে শুনছিলাম। আর ভাবছিলাম সেই প্রচলিত কথা ‘চরকার ঘর্ঘর পড়শির ঘর ঘর’। এখানে সব বাড়ির সামনে রয়েছে কাঠে জড়ানো রঙিন সুতো। রোদে শুকিয়ে নেবার জন্য। বোনার‌ নানা রঙে সুতোকে রং করে নেওয়া হয়। আগে এখানকার মাটির বাড়ির দেওয়ালগুলো কালো রং করা। যদিও এর ভেতর অনেক পাকা বাড়িও আছে। আর আছে অনেক টেরাকোটার বর্ষপ্রাচীন মন্দির।

রবিন ভড়ের বাড়িতে ঢুকেই সামনের ঘরে তাঁত বুনতে দেখা গেল আলপনা ভড়কে। নদিয়ার নবদ্বীপে মহিলাদের তাঁত চালানোয় নিষেধ আছে বলে শুনেছি। চাক্ষুস এভাবে তাঁতবোনা দেখার অভিজ্ঞতা এর আগে ছিল না। এখানে সকলের হাত চালানো তাঁতটাই বেশি। ওঁরা স্বামী স্ত্রী দু-জনে আমাকে পরিচিত করান তাঁত যন্ত্রটির সঙ্গে।

আমরা টানাপোড়েন শব্দটির সঙ্গে অনেকেই পরিচিত। এখানে এসে তার আসল অর্থটা জানলাম।

তাঁতের মধ্যে কুণ্ডলী আকারে সুতো টানটান করে ঢোকানো থাকে। এখানে দু-ভাবে সুতো থাকে। লম্বালম্বিভাবে থাকা সুতাগুলিকে টানা এবং আড়াআড়িভাবে থাকা সুতাগুলিকে পোড়েন বলা হয়। যখন তাঁত চালু করা হয় তখন নির্দিষ্ট সাজ অনুসারে সুতা টেনে বোনা হয়। তাঁত হচ্ছে কাঠের ফ্রেমের একটা যন্ত্র। তাঁতের আকার এবং এর ভেতরের কলা কৌশল বিভিন্ন রকমের হতে পারে।

“বাংলা তাঁতযন্ত্রে ঝোলানো হাতল টেনে সুতো জড়ানো মাকু (spindle) আড়াআড়ি ছোটানো হয়। মাকু ছাড়াও তাঁতযন্ত্রের অন্যান্য প্রধান অঙ্গগুলি হল— শানা, দক্তি ও নরাজ। শানার কাজ হল টানা সুতার খেইগুলিকে পরস্পর পাশাপাশি নিজ নিজ স্থানে রেখে টানাকে নির্দিষ্ট প্রস্থ বরাবর ছড়িয়ে রাখা। শানার সাহায্যেই কাপড় বোনার সময় প্রত্যেকটি পোড়েনকে ঘা দিয়ে পরপর বসানো হয়। শানাকে শক্ত করে রাখার কাঠামো হল দক্তি। একখানি ভারী ও সোজা চওড়া কাঠে নালী কেটে শানা বসানো হয় আর তার পাশ দিয়ে কাঠের উপর দিয়ে মাকু যাতায়াত করে। শানাটিকে ঠিক জায়গায় রাখার জন্য তার উপরে চাপা দেওয়ার জন্য যে নালা-কাটা কাঠ বসানো হয় তার নাম মুঠ-কাঠ। শানা ধরে রাখার এই দু-খানি কাঠ একটি কাঠামোতে আটকে ঝুলিয়ে রাখা হয়। এই সমগ্র ব্যবস্থাযুক্ত যন্ত্রটির নাম দক্তি।

শানায় গাঁথা আবশ্যকমতো প্রস্থ অনুযায়ী টানাটিকে একটি গোলাকার কাঠের উপর জড়িয়ে রাখা হয়, একে বলে টানার নরাজ। আর তাঁতি যেখানে বসে তাঁত বোনে, সেখানে তার কোলেও একটি নরাজ থাকে— তার নাম কোল-নরাজ। টানার নরাজের কাজ হল টানার সুতাকে টেনে ধরে রাখা আর কোল-নরাজের কাজ হল কাপড় বোনার পর কাপড়কে গুটিয়ে রাখা।” (এই অংশটি উইকিপিডিয়া থেকে ব্যবহার করা হয়েছে)

এই সমগ্ৰ প্রক্রিয়াটি মূর্ত করে তুলেছিলেন আলপনা ভড়। আলপনা দেবীর বাবার বাড়ি রাজবলহাটেও। তাঁরাও তাঁতের কাজ করেন। কিন্তু আলপনা দেবী কখনো বিয়ের আগে তাঁত বুঝতেন না। বিয়ের পরেই এই কাজটা তিনি নিজের চেষ্টায় শেখেন। সাধারণত তাঁতি পরিবারের মেয়েরা চরকা দিয়ে সুতো কাটার কাজটাই করে থাকেন। তাঁত বোনার কাজ করেন খুব অল্প মেয়েরাই।

পাঠক ওপরে তাঁত বোনার বিষয়ে যে-লেখাটা রয়েছে তা পড়ে নিশ্চয় উপলব্ধি করবেন এই কাজটা অত্যন্ত জটিল। অনেকগুলো ধাপ আছে একটা শাড়ি বোনার। সেই কাজটিই নিজের আগ্ৰহে শিখেছেন আলপনা দেবী। আমরা নারী ক্ষমতায়ণ নিয়ে অনেক আলোচনা করি। কিন্তু একজন ক্ষমতাময়ী নারীকে নিজের সামনে দেখে সত্যি অন্যরকম অভিজ্ঞতা হয়। এই শিক্ষা তো আলপনা ভড়ের অর্জিত। কতটা আগ্ৰহ থাকলে একজন সংসারী মহিলা এটা রপ্ত করতে পারেন তা আর নতুন করে বলতে হয় না।

আলপনা দেবীদের দুই পুত্র। দু-জনেই অন্য পেশায় নিযুক্ত। এছাড়া পরিবারে আছেন রবিন ভড়ের মা ও বাবা। বাড়ির ভেতর আছে তাঁতের সুতো জড়ানোর ও সুতো কাটার যন্ত্র। আলপনা দেবীর বউমা এগুলোর কাজ কী করে করতে হয় তা দেখালেন। সঙ্গে ছিল চা জলখাবার-সহ উষ্ণ আপ্যায়ন।

রাজবলহাটের শাড়ি ও ধুতি ৮০/১০০ সুতোয় বোনা। একটু মোটা ধরনের হয় ফুলিয়া বা শান্তিপুরের তুলনায়। নকশার ক্ষেত্রেও সাবেকি নকশা অনুসরণ করা হয়। এই নকশা হল রঙ্গবতী, ডবিবুটি, দানিবুটি ইত্যাদি। সুতো মহাজনদের থেকে তাঁতিরা কেনেন। শাড়ি মোটামুটি ৪৫০ থেকে শুরু। নকশা অনুযায়ী দাম হয়। এই শাড়ি মহাজন বা হাটেই বেশি বিক্রি হয়। একটা শাড়ি দেড়দিন মতো লাগে বুনতে।

 

রাজবলহাটের তাঁতিদের আরাধ্যা রাজবল্লভী। এই দেবীর জন্য ১৪ হাত তাঁতের কাপড় লগে। যেটা এখানকার তাঁতিদের তৈরি। এই মন্দির চত্বরের দোকানে এই শাড়ি পাওয়া যায়। পুজোর জন্য এখানে সবাই শাড়ি কিনে পুজো দেয়।

Categories
অন্যান্য

কবিতা স্টুডিও উজান সম্মান

Categories
অন্যান্য

test1

Categories
অন্যান্য

ফা-হিয়েন

ফা-হিয়েনের ভ্রমণ

চতুর্থ অধ্যায়
পক্ষকাল শেষে শোভাযাত্রার অবসান হতেই শেং শাও নামক দলটি শি পিনের দিকে রওনা দিল। সঙ্গী হল ওইগার প্রদেশের এক বৌদ্ধ শিষ্য। পঁচিশ দিনের অবিরাম পথ চলা শেষে ফা-হিয়েন ও তাঁর অন্য সাথীরা এসে পৌঁছোলেন জু হো প্রদেশে। এ-দেশের রাজা বৌদ্ধধর্মের উপাসক। সহস্রাধিক সন্ন্যাসী আছেন এখানে আর সকলেই মহাযান ধর্মাবলম্বী। দিন পনেরো বিশ্রাম অন্তে আবার যাত্রা। দক্ষিণ দিক লক্ষ করে চার দিন পথ চলা শেষে দলটি এসে পড়ল পলান্ডু পরিসরে। এবার আবার এক নতুন দেশ ইউ হি। আবার দিন কয়েকের বিরতি। এবারের যাত্রা হবে দীর্ঘ, বিরামহীন। একটানা পঁচিশ দিন ভ্রমণ শেষে এবার এসে পৌঁছোনো গেল চি চাহ প্রদেশে। হুই চিং আর অন্য সাথীদের সঙ্গে এসে পুনরায় মিলিত হলেন তাঁরা।

পঞ্চম অধ্যায়
দেশের রাজা পঞ্চ শীল ধারণ করেছেন। এ হল পাঁচ বছরের মহাসমাবেশ। সব শ্রমণদের রাজা আমন্ত্রণ জানান এই সমাবেশে। আর বিপুল সংখ্যায় তাঁরা যোগও দেন। তাঁদের বসার আসনগুলি পূর্ব হতেই সুসজ্জিত করে রাখা হত, ছোটো ছোটো পতাকা আর স্বর্ণ রৌপ্যের সুতায় পদ্মফুলের নকশা করা শামিয়ানা দিয়ে। আসনের পিছন দিকে একেবারে নিদাগ, ঝলমলে ঝালর দিয়ে সাজানো হত। রাজা তার সব মন্ত্রী অমাত্যদের নিয়ে যাবতীয় আচার মেনে পূজার অর্ঘ্য দিতেন। এক, দুই কখনো-বা তিন মাস পর্যন্ত এই অনুষ্ঠান পর্ব চলত এবং সাধারণত বসন্তকালেই বসত আসর। রাজার সভা শেষ হলে তিনি অমাত্যদের আহ্বান জানাতেন। এবার তাঁদের পূজার অর্ঘ্যদানের পালা। এই পর্বটি চলত দু-তিন, কখনো পাঁচ দিন ধরে। সকল নৈবেদ্য সারা হলে, এইবার রাজার আদেশমতো তাঁর মন্ত্রী, অমাত্যদের নিজস্ব ঘোড়ার সমকক্ষ কিছু ঘোড়ায় লাগাম, জিন পরিয়ে সাজানো হল। আনা হল অতি শুভ্র বস্ত্র, সকল প্রকারের রত্ন সম্ভার, শ্রমণদের যেমনটি প্রয়োজন। রাজা তাঁর অমাত্যবর্গ-সহ শপথ নিয়ে এ-সব সামগ্রী শ্রমণদের দান করলেন। এভাবে সন্ন্যাসীদের থেকে ভিক্ষা সামগ্রীর মাধ্যমে মুক্ত হল শ্রমণগণ। দেশটি তো পর্বতসংকুল এবং যথারীতি শীতল। গম ছাড়া আর কোনো শষ্য জন্মায় না। শ্রমণগণ তাঁদের প্রাপ্ত সামগ্রী গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে আকাশ হয়ে এল মেঘলা, ফলস্বরূপ হিমশীতল হল সকাল। এই জন্যেই এ-দেশের রাজা প্রতিনিয়ত সন্ন্যাসীদের কাছে প্রার্থনা করে গেছেন যাতে তাঁদের প্রস্থানের পূর্বে খেতের গম পেকে ওঠে। বুদ্ধের ব্যবহৃত একটি পিকদানি আছে এ-দেশে। তাঁর ভিক্ষাপাত্রের মতো এটিও একই রঙের পাথরে তৈরি। আর আছে বুদ্ধের একখানি দাঁত। এবং এই দাঁতের সম্মানে এ-দেশের মানুষ তৈরি করেছে একটি প্যাগোডা। সহস্রাধিক সন্ন্যাসী আছেন এই স্থানে, তাঁরা প্রত্যেকেই হীনযান মতাবলম্বী। যত পুবে পর্বত ঘেরা স্থানে যাওয়া যায়, সেখানে মানুষ চীনাদের মতোই মোটা, খসখসে পোশাক পরে, যদিও তাদের পশম আর গরম বস্ত্রের ব্যবহার ভিন্ন। শ্রমণদের আচার অনুষ্ঠানও এখানে বিচিত্র আর অগণিত। এই দেশটি যেন পামীর, হিন্দুকুশের কোলে শিশুর ন্যায় রয়ে গেছে। আর এখান থেকে গাছপালা, ফুল, ফলের চরিত্রও যায় বদলে। চীনের সাথে মিল পাওয়া যায় কেবল বাঁশ, পেয়ারা আর আখ গাছের।

ষষ্ঠ অধ্যায়
এই স্থান থেকে পশ্চিমে এগোও, মিলবে ভারতবর্ষের উত্তর খণ্ড। পথ মধ্যে হিন্দুকুশ, পামীরের বিস্তার। বুনো পেঁয়াজের ভারী ফলন এ-অঞ্চলে। এক মাস যাবৎ যাত্রা শেষে সফল হলেন তীর্থযাত্রী দল। পার করলেন এই ‘পেঁয়াজ পরিসর’। বরফের এই দেশে শীত গ্রীষ্মে ভেদ নাই কোনো। আর আছে বিষধর ড্রাগন। সামান্য প্ররোচনায় ঢেলে দেয় বিষময় বাতাস, বৃষ্টি, তুষার, বালি ঝড় বা পাথর। এমন বিপদের মুখে দশ হাজারে একজন পালাতে পারে না, এমনই ভয়ংকর। এ-দেশের মানুষকে ‘তুষার শৃঙ্গের মানব’ নাম দেওয়া চলে অবলীলায়। এ-সকল পর্বত পেরিয়ে তারা এসে পৌঁছোলেন উত্তর ভারত। একেবারে সীমান্তে তো লি জাতির মানুষের বসতি। এঁদের মধ্যে শ্রমণেরা আছেন। প্রত্যেকেই হীনযান মতাবলম্বী।

বুদ্ধের ছিল আঠারো জন ব্যক্তিগত শিষ্য। আর জানা যায় যে, তাঁদেরই একজন নিষ্ক্রমণ শক্তি দ্বারা এক কুশলী শিল্পীকে স্বর্গরাজ্যে নিয়ে যান, সেখানে মৈত্রেয় বোধিসত্ত্ব মূর্তির (চীনের মন্দিরে হাস্যরত ঈশ্বরের বিগ্রহ) দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, বর্ণ ও বৈশিষ্ট্য পর্যবেক্ষণের জন্য। উদ্দেশ্য ছিল, যাতে ফিরে এসে তাঁকে দিয়ে কাঠের উপর নিজের একখানি মূর্তি উৎকীর্ণ করানো যায়। এই পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্যে সর্বমোট তিনবার স্বর্গলোক যাত্রা করেন। অবশেষে সম্পূর্ণ করলেন আশি ফুট উচ্চতার বিশালাকায় একটি কাঠের মূর্তি, যার চরণ দু-খানিই ছিল আট ফুট লম্বা। ব্রত, উপবাসের দিনগুলোতে উজ্জ্বল দীপ্তিতে ঝলমল করে উঠত এই মূর্তি। এইখানে পূজার অর্ঘ্য দেবার জন্য এ-প্রদেশের রাজাদের মধ্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যেত।

সপ্তম অধ্যায়
পর্বতের ইশারায় এগিয়ে যাও দক্ষিণ পশ্চিম প্রান্ত ধরে,পাবে কঠোর, দুর্গম, অতি ভয়ংকর এক পথ। পনেরো দিন এই পথে একটানা চললেন যাত্রীদল। পাথর প্রাচীরের মতো নিস্তব্ধ দাঁড়িয়ে এক-একটি পর্বত। মোটামুটি একহাজার জেন তাদের উচ্চতা। দৈবাৎ প্রান্তে এসে পড়লে চোখের দৃষ্টি হয় বিহ্বল। দুর্মর সাধ জাগে এগিয়ে যাই সামনে, আর সত্যিই যদি সাড়া দাও সে-ইশারায়, হারিয়ে ফেলবে মাটি, হারিয়ে ফেলবে শূন্য। নীচে স্রোতস্বিনী সিন-তন। প্রাচীন সময়ের মানুষেরা পাথর কেটে পথ তৈরি করেছিল। পর্বতপ্রান্ত ধরে সাতশো ধাপের একটি সোপান। সে-সিঁড়ি বেয়ে যদি নীচে নামা যায়, দেখা যাবে নদীর উপরে ঝুলে আছে দড়ির সেতু। নদীর দু-টি তীরের মাঝের দৈর্ঘ্য আশি কদমের কম। চিঙ-ই-র মতে হুন সাম্রাজ্য থেকে আসা ছাং চিন বা কান ইং এই স্থানে পৌঁছোতে পারেনি। সন্ন্যাসীগণ ফা-হিয়েনের কাছে জানতে চাইলেন, পুবের দেশগুলিতে বৌদ্ধধর্মের প্রসার কোন সময় থেকে শুরু হয়। ফা-হিয়েন বললেন, “যার কাছেই আমি জানতে চেয়েছি সকলেই বলেছে যে, ভারতবর্ষের শ্রমণেরা প্রাচীন রীতি মেনে, মৈত্রেয় বোধিসত্ত্বের মূর্তি স্থাপনের দিন, নদী অতিক্রম করে বৌদ্ধ সূত্রাবলী এবং শৃঙ্খলাগুলি এখানে নিয়ে আসেন”। বুদ্ধের নির্বাণের তিনশ বছর পর এই মূর্তি স্থাপনা হয়। তখন চৌ সাম্রাজ্যের পিং ওয়াং রাজার শাসনকাল। এই সময় থেকেই বুদ্ধের উপদেশাবলি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। মহান মৈত্রেয় ছাড়া আর কেউ বুদ্ধের ত্রিকায়া এবং তার উপদেশাবলির এমন সম্যক প্রচার করতে পারেননি। বিদেশিদের কাছে এই ধর্মবিশ্বাস এভাবেই পরিচিতি পায়।

হুন সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় রাজা মিং টি বৌদ্ধধর্ম প্রচারের স্বপ্ন লালন করেছিলেন। আর ফলস্বরূপ পবিত্র গ্রন্থগুলি ফিরিয়ে আনার জন্য অভিযান শুরু হয়। বুদ্ধের প্রচলিত অনুশাসনগুলির উৎস যে কী, তা মিং টির স্বপ্নের মতো একরকম অমীমাংসিত রহস্যই হয়ে রইল।

প্রথম পর্ব

Categories
অন্যান্য

সেলিম মন্ডল

অদৃষ্ট

হাওয়ায় পুড়ে গেল ঈশ্বরের ছায়া, এখন নীল রঙের রোদ হাতে নিয়ে
ঈশ্বর ঘুরে বেড়ান মাঠে ঘাটে, ধুলোর আলপনা জমে তাঁর গায়ে,
নব্য প্রেমিক প্রেমিকারা তাঁকে পাথর মনে করে নিজেদের নাম
যত্ন করে লিখে রাখে— ঈশ্বর সব দেখেন আর মুচকি হাসেন,
নতুন অলংকার পেয়ে, আহ্লাদে, আবার পুড়ে যান ঈশ্বর…

বধূবরণ

সেদিন চৌকাঠ ডিঙিয়ে রোদ্দুর এলো, এলো আলো বাতাস জল—
একটা আস্ত সমুদ্র এসে ভাসিয়ে দিল খাট, আলমারি, ঘরের সমস্ত আসবাব…
এখন খোলা জানলার পাশে ভ্যান গখের হলুদ গম ক্ষেত,
আর রাতের বেলায় ছাদ জুড়ে মুনলাইট সোনাটা…
তোমার অর্ধেক আকাশ ‘এই শুনছ…’ বলে আলতো টোকা দিল আমার অর্ধেককে,
দু-চারটে তারা খসে পড়ার পর—

সেদিন তোমার সঙ্গে চৌকাঠ ডিঙিয়ে গোটা পৃথিবী এলো আমার ঘরে
আর আস্ত একটা সূর্য এসে আটকে রইল আমাদের বাড়ির আশমানে

Categories
অন্যান্য

উৎসব সংখ্যা ২০২০

প্রচ্ছদ ছবি: ইনামুল কবীর

সম্পাদকীয়

আমরা কেউ ভালো নেই। ভালো থাকার চেষ্টা করেও ভালো থাকতে পারছি না। আসলে সময়টাই এমন। একদিকে করোনা অতিমারি আরেকদিকে রাষ্ট্রের শোষণ। এত মানুষ কর্মহীন! আজ মানুষ ঠিক আছে তো কাল কী হবে জানে না। নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য যে যার মতো লড়ে যাচ্ছে। এবছর ‘উৎসব সংখ্যা’ প্রকাশ করতে পারব ভাবিনি। ‘টিম তবুও প্রয়াস’ তিনমাস ধরে দীর্ঘ পরিশ্রম করেছে, যাতে  ‘উৎসব সংখ্যা ২০২০’ প্রকাশ করা যায়। সমস্ত  অন্ধকার বা বিপর্যয়ের মধ্যে আমাদের এটুকুই আলো। এবারের উৎসব সংখ্যায় আমরা কিছু বিষয়কে আলাদাভাবে গুরুত্ব দিয়েছি। চেষ্টা করেছি— অনেকগুলো নতুন মুখকে পত্রিকার পাতায় রাখতে। সেইসঙ্গে পাঠকদের সঙ্গে বিশ্বসাহিত্যের সংযোগ ঘটাতে। উৎপলকুমার বসুর অগ্রন্থিত লেখা ও অরুণেশ ঘোষের অপ্রকাশিত চিঠি এই সংখ্যাকে পাঠকের কাছে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলবে বলে আশা করা যায়। অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখককে এ সংখ্যায় রাখতে পারিনি। আগামীতে তাঁদের নিয়ে পরিকল্পনা আছে।

মুদ্রিত সংখ্যার মতো এই সংখ্যার পিছনে ‘টিম তবুও প্রয়াস’ একই শ্রম দিয়েছে। কোনোভাবেই যাতে গুণগতমান নষ্ট না হয় সেদিকে রাখা হয়েছে খেয়াল। পাঠকদের কাছে অনুরোধ করছি লেখার নীচে মন্তব্য জানাবেন। আপনাদের মতামত আগামীদিনে আমাদের কাজ করতে আরও উৎসাহ দেবে। লেখকদেরও অনুরোধ করছি আপনার ও পছন্দের লেখা শেয়ার করতে— যাতে বহু সংখ্যক পাঠকের কাছে পৌঁছায়।

সূচিপত্র দেওয়ার পর আমাদের কাছে অনেক অনুরোধ এসেছিল— সংখ্যাটি যেন প্রিন্ট করা হয়। সত্যি বলতে এত বড়ো কলেবরে সংখ্যা এই মুহূর্তে ছাপা সম্ভব নয়। অনলাইনে যে-কেউ ফ্রি পড়তে পারবেন সংখ্যাটি। তবে কারো যদি ইচ্ছে হয় পত্রিকার উন্নতিকল্পে আর্থিক সহায়তা করতে পারেন। প্রচ্ছদ, প্রুফ, ওয়েবজিন পরিবেশকদের আমরা যথাযথ মূল্য দিতে পারব। এমনকী লেখকদেরও।

মোনালিসা ও রাজদীপ পুরীকে বিশেষ ধন্যবাদ। তাঁদের কারিগরী সহায়তা সংখ্যাটিকে আরও প্রাণ দিয়েছে।

সকলে ভালো থাকুন। সুস্থ থাকুন।

♦ প্রবন্ধ

পুজোর গানের গৌরবময় অতীত
গোপাল দাস

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের আশ্চর্য সমন্বয় মাইহার ব্যান্ড
অলক রায়চৌধুরী

কলকাতা একটি শ্রমতালুক
প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়

এই রহস্যকে সহ্য করতে হচ্ছে
জয়ন্ত ঘোষাল

মুর্শিদাবাদের বোলান গান
সুজিৎ দে

মিথ ও ট্যাবুতে সাত সংখ্যা: আফ্রিকান মিথোলজি
রবিউল ইসলাম

গল্প

লক্ষ্মী দিঘা পক্ষী দিঘা কুলদা রায়

সেইসব বাড়িয়ে বলা গল্পগুলো যশোধরা রায়চৌধুরী

জলময়ূরীর সংসার পাপড়ি রহমান

ভয় হিন্দোল ভট্টাচার্য

শীতঘুম শুভদীপ ঘোষ

দংশন বিশ্বদীপ চক্রবর্তী

হাতটি সেলিম মণ্ডল

 গদ্য

একটি রক্তিম মরীচিকা পঙ্কজ চক্রবর্তী

কে জন্মায় হে বিপ্লব? তমাল রায়

বাল্যকাল কিংবা এক কাল্পনিক অতিভুজ রণজিৎ অধিকারী

অতিমারির উৎসব ও এক ছদ্মকবি শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী

সাদা রোগ ঈশিতা দেসরকার

অগ্রন্থিত গদ্য

শিশুসাহিত্য প্রসঙ্গে উৎপলকুমার বসু

কবিতা

বিজয় দে  •  বিপ্লব চৌধুরী  •  পল্লব ভট্টাচার্য   কমলকুমার দত্ত  •  কল্যাণ মিত্র  •   অনিন্দ্য রায় • সুদীপ্ত মাজি  অগ্নি রায়কুন্তল মুখোপাধ্যায়  নির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়  •  শৌভ চট্টোপাধ্যায় •  হাসনাত শোয়েব  • ইন্দ্রনীল ঘোষ  • শাশ্বতী সান্যাল  • প্রীতম বসাক  • পঙ্কজকুমার বড়াল •  তথাগত  • দেবোত্তম গায়েন  • শতানীক রায়  • শুভম চক্রবর্তী  • শাশ্বতী সরকার • প্রবীর মজুমদারগৌরাঙ্গ মণ্ডল  • সঞ্চিতা দাস  তমোঘ্ন মুখোপাধ্যায়

অনুবাদ গল্প

আসল-নকল
ভাষান্তর: গৌরব বিশ্বাস

অনুবাদ গদ্য

পাওলো কোয়েলহোর গদ্য
ভাষান্তর: অমিতাভ মৈত্র

লেভ তলস্তয়ের একটি আত্মজ্ঞানের খসড়া
ভাষান্তর: রূপক বর্ধন রায়

অনুবাদ কবিতা

জেন কবিতা
ভাষান্তর: রাজীব দত্ত

কাশ্মীরের কবিতা
ভাষান্তর: সোহেল ইসলাম

লোকগল্প

আরও কিছু আছে বাকি
সুব্রত ঘোষ

সাক্ষাৎকার

হারুকি মুরাকামির সাক্ষাৎকার
ভাষান্তর: রিপন হালদার

অপ্রকাশিত চিঠি

অরুণেশ ঘোষের লেখা গৌতম চট্টোপাধ্যায়কে চিঠি

চিত্রকলা

তন্ময় মুখার্জীর চিত্রকলা

——————————————————————————————————————–

সকলের সুবিধার্থে সংখ্যাটি উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। কোনো সাবক্রিপশন মূল্য রাখা হয়নি। যদি কেউ মনে করেন সংখ্যাটি মূল্য দিয়ে পড়বেন সেক্ষেত্রে আপনার খুশিমতো ৮৬৮১৯৩৭৩৫৬ নম্বরে phonePay বা gPay করতে পারেন। অথবা অ্যাকাউন্টেও পে করতে পারেন। 

ব্যাঙ্ক  অ্যাকাউন্ট
TOBUO PROYAS PROKASHONI
Bank Of India
Chapra Branch
IFSC- BKID0004123
CHAPRA BRANCH
Account No- 412320110000151

Categories
অন্যান্য

একটি পুনরাধুনিক সন্ধ্যা

অনুপম মুখোপাধ্যায়ের ‘স্বনির্বাচিত কবিতা’ প্রকাশ

অংশগ্রহণে কবি ও কথাসাহিত্যিক মলয় রায়চৌধুরী, কবি ও কথাসাহিত্যিক অনুপম মুখোপাধ্যায়, কবি ও প্রচ্ছদ শিল্পী রাজীব দত্ত এবং কবি ও প্রকাশক সেলিম মণ্ডল

Categories
অন্যান্য

করোনার দিনগুলিতে: অংশুমান কর

কবি ঠিক কতখানি নিষ্ঠুর?

আমার ব্লগে একটি লেখা লিখতে গিয়ে আমি লিখে ফেললাম যে একজন কবি, একজন শিল্পীও একজন নিষ্ঠুর মানুষ। শুনলে খানিকটা ধাঁধার মতো লাগতে পারে। মনে হতে পারে তা কী করে হয়?