সামনে সময় ভয়ংকর
আমি ভালো নেই। মাথার মধ্যে সব-সময় দুশ্চিন্তা, রাতে ভালো ঘুম হয় না। চোখ বুজলেই ধেয়ে আসে নানান দুঃস্বপ্ন। প্রেশার সুগার খুব বেড়ে গেছে। আমি জানি কোভিদ-১৯-এর আক্রমনে কেউ আর ভালো থাকার কথা নয়।
অভিজ্ঞতা হল সেই জিনিস, যা আমাকে শেখায় আত্মোপলব্ধির পাঠ। ভুল ভেঙে মনে করিয়ে দেয় আমার অদক্ষতার কথা, অপারগতার কথা, অজ্ঞানতার কথা। মানুষের জীবন কোনোদিনই বেঁচে থাকার অনুকূল কিছু ছিল না। বলা ভালো, তার বেঁচে থাকাটাই এই মহাজগতের এক ব্যতিক্রম, ম্যাজিক। হয়তো অতিরিক্তও। তবু অতিমারির প্রকোপ যখন তার উপরে প্রত্যক্ষ প্রশ্নচিহ্ন তুলে দিল,
আমি একজন শান্তশিষ্ট নির্ঝঞ্ঝাট মানুষ। আইন-কানুন মেনে চলি, বিশেষ করে, তাতে যদি পুলিশের বা প্রাণের ভয় থাকে। তাই লকডাউনের সময় নিজে নিজেই কোয়ারেন্টাইনের আইন মেনে ঘরবন্দী হয়ে আছি। মোটের ওপর, ভালোই আছি। বার-তারিখ গুলিয়ে যায়, তাই একটা হিসেব রেখেছি। সোমবার নিম-বেগুন খাওয়া হয়, তাই সকালে নিমপাতা আনতে নীচের বাগানে যাই। বুধবার কারিপাতা আনা হয়, আর যদি কুমড়োফুল জোটে।
অতিমারির এই দিনগুলোতে সবকিছুই কেমন ধীরে অথচ নিঃশব্দে বদলে যেতে শুরু করল। ধুপছায়া মেঘের একটা বিশাল চাঙারি উড়ে এসে যেন আচানক আড়াল করে দিল প্রত্যহের দেখা নীল আসমান। এখন ব্যালকনিতে দাঁড়ালে নীলের সামান্য চূর্ণও আর নজরে পড়ে না, আসমান দূরে থাকুক। দৃষ্টির সীমানায় শুধু সারি সারি দালানের ম্লান-মূক দাঁড়িয়ে থাকা। সম্প্রতি অঢেল ক্লান্তি এসে তাদেরও যেন একেবারে গ্রাস করে ফেলেছে!
একটি মুহূর্তের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে অনেকগুলো মুহূর্ত, তার ভেতর ঢুকে যাচ্ছে আরও অনেকগুলো মুহূর্ত। প্রতিটি মুহূর্ত আসে দৃশ্যের ওপর ভর দিয়ে। একটানা সিনেমা দেখার ব্যাপারগুলো অনেকটা এরকমই। অসংখ্য মুহূর্ত একের পর এক জমা হতে থাকে স্মৃতির করিডোরে। যা ক্রমশ অনুভূতির দেয়ালে আঘাত করতে থাকে। হঠাৎ কোনো একদিন অস্তিত্বহীনতার অনুভব যখন প্রকট হয়ে উঠে,
রাস্তার কোনো বিকল্প নেই। কারণ, একমাত্র রাস্তাই বিকল্প। অতএব এই পথ ধরতেই হল। বিচ্ছিন্ন হতেই হল। সবার হাত ছেড়ে দিয়ে এমন একটা আকাশের তলা দিয়ে হেঁটে চলার সংকল্প করতে হল, যেখানে চন্দ্র সূর্য নেই তারাদের নিশ্চিত ইশারা নেই। মানুষের কোলাহল ছাড়া মানুষের পায়ের শব্দ ছাড়া পেরোতে হচ্ছে মাইলের পর মাইল। বাঁচার জন্য তবে একলা হতে হচ্ছে। একলা গান গাইতে হচ্ছে।
আপাতভাবে মনে হতে পারে, মানুষ গৃহবন্দি। সে একটা জেলখানায় ছোট্ট খুপরিতে আটকে আছে। কিছু মানুষের জন্য তা তো বটেই। যারা ছোট্ট একটা ঘরে নিজের বিছানা আর সামান্য কিছু আসবাবে নিজেকে স্বেচ্ছাবন্দি করেছে। সামান্য আকাশও দেখা যায় না, সেই ঘর থেকে। একতলার ঘর, তাই জানালা খোলাও সমীচীন নয়। বে-আব্রু হয়ে পড়ার আশঙ্কা, একটা মানসিক ব্যাধি জন্মানোর আদর্শ চৌখুপি।