কবিতা
দেবজ্যোতি রায়
শারীরিক
কুন্তল, পাহাড়ি নদী। মেঘে সোহাগসিদুঁর।
সিল্কের খসখস। মোম গলে যায়।
স্টেশন, অলস ট্রেন। নির্জন কামরায়
অন্ধগায়ক।
আড়মোড়া ভাঙছে রাত্রি
খোঁপা থেকে খসে বেলকুঁড়ি।
সুগন্ধ জড়িয়ে ধরে বিছানা, চাদর
সুগন্ধছায়ায় আমি রিটার্ন টিকিট হারিয়ে ফেলেছি
জঙ্গলের ত্রস্তপথ। পাতা ঢেকে রাখে শ্বাপদের থাবা
অস্ত্র, শাণিত পাপড়ি। রন্ধ্রে রন্ধ্রে রূপকথা জাগে
মখমল বিছিয়ে রাখে নিভৃত শরীর
তুমি বায়ুভূত, তুমি জ্বলন্ত সাকার
মুঠোয় লাগাম টাঙাওয়ালির
স্নান করো আদিম হ্রেষায়।
অলৌকিক কক্ষপথে আপেলবাগান।
তুমি আকাশযানের মতো উড়ে যাও
তোমার আশ্চর্য পিঠে নক্ষত্রভ্রমণ করছে
রোমাঞ্চিত হরিদাস পাল।
শিলাপুষ্প
বনস্পতির ডালে, ওষধিলতায়
তুমি আছ,
জ্ঞানযোগে, অবিদ্যামাদকে।
উপনিষদের পাশে ফ্রয়েড, ইয়ুং
তোমার জিভেই সায়ানাইড, আগুনের শিখা।
তুমি কি পর্বতশৃঙ্গে পোশাক বদলাও?
অবতলে নেমে আস, বরফকিন্নরী
ডানা ও বাতাসে গূঢ় বোঝাপড়া!
তুমি সহজযানের সূত্র
সমুদ্রতরঙ্গ থেকে তুলে আনো ফুসফুস
মৃত নাবিকের।
কল্পবিজ্ঞানের মতো তোমার বিস্তার
শক্ থেরাপির স্রোত
আমার প্রত্যঙ্গ কাঁপে বিদ্যুৎছোবলে
ভেসে আছি জল কেটে কেটে
আশ্চর্য সন্ধানে
কোথায় শস্যের গোলা, টিলা, খাদ,
মধু, পাপ, শিলাপুষ্প, হলুদ পরাগ?
মহামহিমান্বিতকে
ঘড়ির কাঁটা অ্যান্টিক্লকওয়াইজ ঘুরছে
কেশব নাগকে বিহ্বল করে বদলে যাচ্ছে অঙ্কের
সূত্র-সমাধান
থালা থেকে উড়ে যাচ্ছে রুটি অভিকর্ষের বাইরে
ভয়ে ভয়ে জড়ো হলাম লঙ্গরখানায়,
বুড়ো বটগাছের নীচে
মরা মোষের দীর্ঘশ্বাস হাওয়ায় হাওয়ায়
স্তম্ভিত আকাশে ঝুলছে মুণ্ডমালা
আমরা শনাক্ত করতে পারছি না
ধড়বিচ্ছিন্ন মাথাগুলি।
থ্রি-নট-থ্রি বুলেটের মতো চাঁদ পাক খাচ্ছে
অন্ত্রে, পায়ুপথে।
বন্ধ কারখানা-শ্রমিকের খিদে
সুখলালের পাথর বসানো চোখ
নিহত জঙ্গির চিঠির বয়ান—
মাংসাশী ফুলের শিল্পে ফুটে আছে রক্তের গভীরে।
আমাদের আর একবার দেখা হবে
শাণিত চপারের নীচে
শ্রেণিচেতনার পাঠ ছড়িয়ে পড়বে
হাজারিবাগ জঙ্গল থেকে ছিন্নমস্তার মিথে,
সাংখ্যযোগে শোনা যাবে বলির বাজনা
ভীমসেন যোশীর মালকোশে পথশিশুর কান্না।
পথ
পথের দূরত্ব নিয়ে কথা হল, তর্কও হল
প্রতিযুক্তি উড়ছে বাতাসে
আসা ও যাওয়ার মধ্যে চিরকালই
একটি নদী থাকে।
মহাপ্রস্থানের পথে অদৃশ্য কুকুর থাকে, অনুষঙ্গময়
নৌকো থাকবে কিনা, দোলনাবাহক
কোহলপ্রত্যাশী বন্ধু, ফুলমালা স্মৃতি, ন্যায়, বেদান্তদর্শন?
এ-সব প্রশ্নের মধ্যে ড্রপসিন আবার নামুক
নীরবতা, পজ্
পথই তদন্তসূত্র, ঢেউ, চোরাবালি
নিয়তি হাতের ছাপ রেখে গেল জানালার কাচে
ওপারে কুয়াশাঘেরা ধূসর পাহাড়
মুসাফির হেঁটে যান
শিকারির খাদ্যনালি ছিঁড়ে
অরণ্যসংহিতা লেখে নির্মম শিকার
এও এক পথের মাহাত্ম্য!
জানালার এপাশে, মুক্তিপদ মাস্টারের ঘুম পায়
নাইট ল্যাম্পের আলো
তার মনে হয়—
পথের রহস্য আছে, হিংসা ও পক্ষপাত আছে
জ্ঞান ও মূর্খতা-সহ আবর্ত, তুলোর গদি, ছারপোকা
কী নেই পথের?
উজ্জ্বল নিশান ওড়ে,
ভাড়া ফাঁকি দিয়ে তীরে পৌঁছোনোর কূটাভাস
তবু পথ ঢলে পড়ে নিমিত্তের দিকে
তার ভবিতব্য লেখে পথযাত্রী, যুগান্তের
রাতজাগা পাখি।
শ্রমণ
এই ঋতু কাব্যধর্মী
উপমা, রূপকে বহমান।
পার হল রূপনগরের গহন পরিখা
শ্রমণের কাঁধে বোঝা
সময়ের, কার্যকারণের
ক্রমশ পায়ের শব্দ গুম্ফার দিকে
শরীরে পতঙ্গ ওড়ে, পাখি বসে, মাছ ঘাই মারে
যেন সাক্ষাৎ প্রকৃতি।
শোনা যায় প্রার্থনাসংগীত
চলেছে শ্রমণ
তার ছায়া ধীরে ধীরে মোহহীন, শান্ত, নিরাকার।

দেবজ্যোতি রায়
একজন বিশিষ্ট কবি। নিবিড়ে কবিতাচর্চা করতে ভালোবাসেন। জন্ম ১৯৬৬। নদিয়ার চাকদহে থাকেন। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: ‘অসম্পূর্ণ জলরেখা'(১৯৯২), ‘কুশপুত্তলিকা’ (২০১৪), ও ‘সমীরের চটি’ (২০১৯)।