লেখক নয় , লেখাই মূলধন

ধারাবাহিক।পর্ব৩

ফা-হিয়েন

ফা-হিয়েনের ভ্রমণ

অষ্টম অধ্যায়
তীর্থযাত্রীদল নদী পার করে উং ছাং দেশে এসে পৌঁছোলেন। এই দেশটি ভারতের একেবারে উত্তর দিকে। মধ্যভারতীয় ভাষাই দেশজুড়ে সার্বিকভাবে ব্যবহৃত হয়। মধ্যভারত মূলত চীনের মতোই। এখানকার মানুষের পোশাক আর খাদ্যাভ্যাস চীনের মানুষের মতো। বুদ্ধের প্রচলিত ধর্ম এখানে বেশ ঋদ্ধ। সন্ন্যাসীগণ যেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন তার নাম সেংচিয়ালান। সর্বমোট পাঁচশত সন্ন্যাসী আছেন। সকলেই হীনযান মতাবলম্বী। ভবঘুরে বৌদ্ধ ভিক্ষুদল এসে পড়লে, তিন দিনের জন্য তাদের আপ্যায়নের সমস্ত দ্বায়িত্ব তখন সন্ন্যাসীদের উপর। তিন দিন পর তাদের স্থান বদলের আহ্বান জানানো হয়। কথিত আছে বুদ্ধ যখন উত্তর ভারতে আসেন তখন এই দেশেও তিনি এসেছিলেন। বুদ্ধ এখানে একটি পদচিহ্ন রেখে যান, যেটি ব্যক্তিবিশেষের ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী ছোটো আর বড়ো হয়ে প্রতিভাত হয়। এখনও এই পায়ের ছাপটি বর্তমান। যে-পাথরের উপর তথাগত তাঁর কাপড় শুকাতে দিতেন, যে-স্থানে তিনি দুষ্ট ড্রাগনকে রূপান্তরিত করেছিলেন। সবই এখন দর্শনীয় স্থান। পাথরটি চৌদ্দো ফুট লম্বা আর কুড়ি ফুটের বেশি চওড়া, একটি দিক মসৃণ। বুদ্ধের ছায়া অনুসরণ করে হুই চিং, তাও চেং, হুই তা নগরাহরা দেশের দিকে এগিয়ে চললেন। ফা-হিয়েন এবং অন্যান্যরা এই উ ছাং দেশেই বর্ষাকালটি অতিবাহিত করলেন। বর্ষা অন্তে আবার পথ চলা, আবার এগিয়ে যাওয়া অবিরাম দক্ষিণ প্রান্ত ধরে, যতদিন না সু হো তো দেশে এসে পৌঁছোনো যায়।

নবম অধ্যায়
বৌদ্ধধর্ম এ-দেশে জনপ্রিয়। পুরাকালে পবিত্র ইন্দ্র শক্র বোধিসত্ত্ব পাবার আশায় নিজেকে পারাবত আর শঙ্খচিলে রূপান্তরিত করেছিলেন। বোধিসত্ত্ব, পায়রাটির বন্দিমুক্তিপণ হিসাবে নিজের শরীর থেকে একখণ্ড মাংস কেটে দেন। এবং সেই স্থানেই তিনি বুদ্ধ হিসাবে জ্ঞানের সর্বশেষ স্তরটি সম্পূর্ণ করেন। পরে তিনি যখন তার শিষ্যদের সঙ্গে বিভিন্ন জায়গা পরিভ্রমণ করছিলেন, তখন এই স্থানটিকে চিহ্নিত করেন তার বুদ্ধত্ব লাভের স্থান হিসাবে। এভাবেই এখানকার সাধারণ মানুষ জায়গাটির বিশেষত্বের কথা জানতে পারে এবং স্বর্ণ, রৌপ্যে মোড়া একটি প্যাগোডা নির্মাণ করে।

দশম অধ্যায়
এই অঞ্চল থেকে যাত্রীদল পাঁচ দিন ধরে পূর্ব দিক বরাবর ক্রমাগত হেঁটে পৌঁছোলেন চিয়েন টো উই দেশে। এ-দেশের রাজা, সম্রাট অশোকের পুত্র ফা ই। বুদ্ধ যখন বোধিসত্ত্ব লাভ করেন, তাঁর প্রতিরূপ অন্য আর একটি জীবের উদ্দেশে নিজের চোখদুটো উৎসর্গ করেন। সেই স্থানেও সোনা, রূপা খচিত একটি প্যাগোডা নির্মিত হয়। এই দেশবাসীরা মূলত হীনযান সম্প্রদায়ের।

একাদশ অধ্যায়
এই স্থান থেকে পূর্ব প্রান্ত ধরে আবার এগিয়ে চলা। সাত দিন অবিরাম চলা শেষে এসে পৌঁছানো গেল চু চা শি লো (তক্ষশিলা) নামের একটি দেশে। চীনা ভাষায় এর অর্থ ছিন্ন মস্তক। বোধিসত্ত্ব লাভের সময় বুদ্ধ তার সহ-জীবের জন্য নিজের শির উৎসর্গ করেন। এই হল এ-দেশের নাম মাহাত্ম্য। তীর্থযাত্রীদলের পথ চলা শুরু হল আবার। আরও আরও পূর্বে এগিয়ে চলা কেবল। এবার দু-দিনের সফর শেষে তারা এক আশ্চর্য দেশে এসে থামলেন। এখানে বুদ্ধ একটি ক্ষুধার্ত বাঘকে খাদ্যের যোগান দিতে নিজের দেহ দান করেন। এই দু-টি জায়গাতেও মূল্যবান পাথর খচিত প্যাগোডা রয়েছে। সন্নিহিত প্রদেশ থেকে আসা রাজা, মন্ত্রী, সাধারণ মানুষের মধ্যে, পূজার অর্ঘ্য দান, পুষ্প দান, প্রদীপ জ্বালানোর জন্য যেন বিরামহীন এক প্রতিযোগিতা আরম্ভ হয়ে যেত। এই সবকয়টি প্যাগোডা, একসঙ্গে সাধারণ মানুষের মুখে মুখে প্যাগোডা চতুষ্টয় নামে পরিচিতি পায়।

দ্বাদশ অধ্যায়
চিয়েন তো উই প্রদেশ থেকে দক্ষিণ দিকে একটানা দুই দিন ভ্রমণ করে যাত্রীদল এসে থামল ফো লু শা (বৈশালী) প্রদেশে। পূর্বে বুদ্ধ তাঁর সকল অনুগামীদের সঙ্গে নিয়ে ভ্রমণ করেন এই দেশ। ভ্রমণকালে আনন নামক শিষ্যকে বলেন, “আমার নির্বাণলাভের পর এ-দেশের এক রাজা কণিষ্ক এই স্থানে একটি প্যাগোডা নির্মাণ করবেন।” পরবর্তীকালে কণিষ্ক তাঁর শাসনকালে রাজ্য পরিদর্শনে এলেন। পবিত্র ঈশ্বর ইন্দ্র শক্র কণিষ্কের মস্তিষ্কে একটি ভাবনার বীজ বুনে দিতে চেয়ে নিজেকে মেষপালক বালকে রূপান্তরিত করলেন। পথমধ্যে গড়ে তুললেন একখানি প্যাগোডা। রাজা বালকের কাছে জানতে চাইলেন, “কী করছ হে বালক?” বালক উত্তর দিল, “বুদ্ধের জন্য প্যাগোডা তৈরি করছি।” রাজা বালকের কাজের প্রশংসা করলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে সেখানেই চারশো ফুট উচ্চতার একখানি প্যাগোডা নির্মাণ করালেন। মূল্যবান পাথর খচিত তার সারা অঙ্গে। তীর্থযাত্রীরা এ-পর্যন্ত যত মন্দির, প্যাগোডা দর্শন করেছেন, দার্ঢ্য আর সৌন্দর্যে এর তুলনীয় কিছুই নেই। সুমেরু পর্বতের দক্ষিণে অবস্থিত বিস্তীর্ণ জম্বুদ্বীপজুড়ে এমন প্যাগোডা বোধ করি আর একটিও নেই। এটিই সর্বোচ্চ। রাজা এই প্যাগোডা নির্মাণ সম্পূর্ণ করলে দেখা গেল এর দক্ষিণ দিক দিয়ে তিন ফুট উচ্চতার কিছু ছোটো প্যাগোডা উদ্‌গত হয়েছে। বুদ্ধের ভিক্ষাপাত্রটি এ-দেশে রয়ে যায়। পূর্বে উয়ে শি (পুরুষপুর এর রাজা কণিষ্কের পূর্ব পুরুষ হুভিষ্কা)-এর রাজা এ-দেশ আক্রমণের জন্য এক বিশাল সৈন্যদল জড়ো করেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল বুদ্ধের সেই ভিক্ষাপাত্র অপহরণ করা। যুদ্ধে পদানত করলেন এই দেশের রাজাকে। এর পর বৌদ্ধধর্মের তীব্র পৃষ্ঠপোষক হওয়ার কারণে পাত্রটি নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন তিনি। তদনুযায়ী তিনটি সম্যক বোধের (বুদ্ধ, ধর্ম, সঙ্ঘ) প্রতি অর্ঘ্য নিবেদন করলেন সর্বপ্রথম। তারপর একটি বিরাটকায়, সুসজ্জিত হাতির পিঠে পাত্রটি রাখা হল। এরপর হল কী! সহসা হাতিটি লুটিয়ে পড়ল মাটিতে এবং আর উঠে দাঁড়াবার সাধ্য রইল না তার। এবার চারটি চাকা বিশিষ্ট একটি গাড়ি প্রস্তুত করা হল। পাত্রটি রাখা হল গাড়ির উপর। গাড়ি টানার জন্য আটটি হাতি জুতে দেওয়া হল। পুনরায় হাতিগুলি অগ্রসর হওয়ার ক্ষমতা হারালো। রাজা অনুধাবন করলেন, এই রাজ্যে পাত্রটির কালাতিক্রম সম্পূর্ণ হয়নি, তাই এই বিপত্তি। গ্লানি, অনুতাপের সীমা রইল না রাজার। ফলস্বরূপ এই স্থানে রাজা একটি প্যাগোডা নির্মাণ করালেন। আর সেইসঙ্গে একটি মঠ। পাত্রটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একটি সৈন্যদল নিযুক্ত করলেন, আর সমস্তরকম পূজার অর্ঘ্য নিবেদন করলেন।

সাত শতাধিক সন্ন্যাসী সমবেত হলেন। মধ্যাহ্নে তারা পাত্রটি বাইরে বের করলেন। এবার সকলে মিলে নানা উপচারে অর্ঘ্য সাজিয়ে নিবেদন করলেন। পূজা অন্তে মধ্যাহ্নভোজন সারলেন সকলে মিলে। এর পর আসন্ন সন্ধ্যাকালে যখন ধূপ ইত্যাদি জ্বালাবার কাল উপস্থিত হল, তারা আবার পাত্রটি বাইরে নিয়ে এলেন। দুই গ্যালনের অধিক তরল এই পাত্রে রাখা যায়। বিচিত্র রঙের সমাহার আছে এতে, যদিও মূল রং হল কালো। আদতে বুদ্ধের নির্দেশে চারটি পাত্রজুড়ে এই বৃহৎ পাত্রটি তৈরি হয়। আর এই চারটি জোড় সহজেই পৃথক করা যায়। এক ইঞ্চির এক পঞ্চমাংশের সমান পুরু এই পাত্রটি স্বচ্ছ আর উজ্জ্বল।

ধনীর দেওয়া বিপুল ফুলের ঐশ্বর্য, শত, সহস্র, দশ সহস্র শস্যের নৈবেদ্যেও অপূর্ণ রইল যা, দীনহীনের ছুড়ে দেওয়া একটি দু-টি পূজার ফুলে পূর্ণ হয়ে উঠল তথাগতর সেই ভিক্ষাপাত্র। পাও উন আর শেং চিন শুধুমাত্র পূজা দিয়ে ফিরে গেলেন। হুই চিং, হুই তা আর তাও চেং পূর্বেই না শিয়ে প্রদেশে পাড়ি দিয়েছেন। সেখানে বুদ্ধের দন্ত, করোটি আর ছায়ার উপাসনা করলেন তাঁরা। সহসা অসুস্থ হয়ে পড়লেন হুই চিং আর তাঁর শুশ্রূষা করার জন্যে তাও শেং রয়ে গেলেন সেখানে। হুই তা একাকী ফিরে এলেন ফো লু শা প্রদেশে। সেখানে বাকিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হল তাঁর। এখান থেকেই হুই তা, পাও উন আর শেং চিং চীনে ফিরে গেলেন। ভিক্ষাপাত্রের মন্দিরে এসে হুই চিং-এর ভ্রমণ শেষ হল। মৃত্যু হল তার। আর এভাবেই ফা-হিয়েন এবার একাকী অগ্রসর হলেন পরবর্তী গন্তব্যে।

প্রথম পর্ব

দ্বিতীয় পর্ব

Facebook Comments

অনুবাদক: সঙ্গীতা দাস

শৈশব ও বেড়ে ওঠা উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার চাঁদপাড়া। অত এক দশকের বেশি সময় ধরে গ্রামের স্কুলে ইংরেজি ভাষার শিক্ষকতার পেশায় নিযুক্ত। অন্তর্মুখী জীবন নিয়ে একা একা লোফালুফি খেলেন। অনুবাদ, লেখালেখি, পাঠ এ সবই নীরব কুয়াশায় আচ্ছন্ন। এই অনুবাদ, এ তাঁরই জীবনের অংশ, তাই বাঙ্ময় হয়ে ওঠে।

পছন্দের বই