লেখক নয় , লেখাই মূলধন

লোকজ উৎসব

গৌতম সরকার

আইচুরা দে…

অন গোঁসাইকে বললাম, “গোঁসাই তোমরা তো আইচুরা জানেন? কেমন ছিল— কহ। কুনো ঠি নেখা নাই। কাহয় কহিবা পারেছে না”।

“দাউ”

“সব কি নেখা থাকে? মানুষের সাথে সাথে কিছু ইতিহাসও চলি যায়”।

এমন কথা শুনে মনে হয়, ইতিহাসও সব সত্য সবসময় সত্যি করে বলে না। আমাদের মতো যারা শুধুমাত্র ক্লাসের ইতিহাস বইয়ের পাঠক— তাদের কাছে এমনটা মনে হলেও অপরাধ নয়। একজন নিরক্ষর নিত্যানন্দ পন্থী বৈষ্ণবও এই সত্যকে অনুভব করেছেন। এমন কথা বলার পিছনে অনেকে কৌতূহল অনুভব করতে পারেন। অথবা মনে হতেই পারে— এটা একধরনের আত্মরক্ষার ঢাল। এ-প্রসঙ্গে আরও একটি বক্তব্য আয়োজন করে বলতে পারি যে, ক্ষেত্রসমীক্ষার পাঠক বলেই জানি, সব ক্ষেত্রকেই ক্ষেত্র করি না বরং নির্বাচন করি। এই নির্বাচন অনেকসময় সঠিক না-ও হতে পারে। এবং সিলেকশনও কিছু ভাঁড় তথ্য দিতে পারে। যে-প্রসঙ্গে এই কথা বলা— ইতিহাসে অনেক পরিব্রাজক ও গবেষকের খোঁজ পাই। তাঁরা নিরীক্ষণ করেছেন ভারতীয়দের নিবিড় যাপন— জাত, জাতি, ভাষা, পোশাক এমন আরও কত কী!! লিপিবদ্ধ করেছেন। এসবের এক একটা কঠিন কাজ। প্রায় অসম্ভব।

তাঁদের কৃতিত্বকে মেনে নিয়েও দেবেশ রায়ের একটি মতকে প্রতিষ্ঠা করতে ভীষণ লোভ হয়— “ভারতবর্ষের বিশালতার সঙ্গে কোন সম্বন্ধ তৈরির ব্যক্তিগত অক্ষমতা বা সমষ্টিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতার বিকল্প হিসেবে বেছে নিয়েছি ভারতবর্ষের কিছু টুকরো বা খণ্ড চেহেরা।… সংসদ, সুপ্রিম কোর্ট, সেনাবাহিনীর মত আমাদের সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠানও বস্তুত কতটা সর্বভারতীয় সে-সম্বন্ধে আমি নিঃসন্দেহ নই”। অন্তত আমারও মনে এই ধারণা দৃঢ় হয়েছে।

উপরের আলোচ্য অংশ পড়ে অনেকেই ভেবে থাকতে পারেন— আমি আমার আলোচনার মূল থেকে সরে পরেছি। না, তা একেবারেই নয়। মূল বক্তব্যে যেতে গিয়ে কয়েকটা বিষয় আপাত সমস্যা তৈরি করেছে। কারণ, কোনো কিছু বলতে গেলে প্রথমেই প্রমাণ চেয়ে বসেন— ‘কিছু জন’। এইসব তথ্য কোন বইয়ে লেখা আছে? আগে কেউ কিছু বলে গেছেন? ইত্যাদি। তাঁদের কাছেও এই বার্তা দিতে যে— এখানে সবার ভারতবর্ষ আছে। সবারটা সবার মতো নয়। বরং বিষয়ীর কাছে দ্বিমতের বিষয়। ফলে যা যা পূর্বে উল্লেখ করা হয়নি। অথবা কারো লেখায় পাওয়া যায়নি। তা সবসময় মিথ্যে— এখানে এমন ভাববার এবং বলবার যৌক্তিকতা থাকবে না।

দীর্ঘ সমীক্ষায় দেখা গেছে প্রাচীন গৌড়ের একটা ভৌগোলিক এলাকায় নিজেরা নিজেদের ‘গৌড়-দেশি’ অথবা ‘দেশি’ বলে সম্বোন্ধিত করে। আরও ভালো করে বললে ‘দেশিয়া’। দেশে টিকে থাকার আত্ম-গৌরবও আছে। অথচ অনুল্লিখিত।

প্রাচীন কিছু দলিল কিংবা ভোটার তালিকা দেখলে পাওয়া যায়— এদের পদবি ছিল দেশি। এদের ভৌগোলিক সীমানা নিয়ে আমারই লেখা একটি প্রবন্ধে চিহ্নিত করেছি— “পূর্ণভবা নদীর পশ্চিম পাড় থেকে নাগর নদীর পূর্ব পাড় এবং মহানন্দা নদীর পূর্ব পাড় এই ভূখণ্ডটি ঐতিহাসিক ভূমি”২। খুব সম্প্রতিকাল থেকে এরা রাজবংশী হিসেবে পরিচিত হচ্ছে। সাব-কাস্ট হিসেবে রাজবংশী লিখছে। অথচ আত্ম-পরিচয়ের সময় দেশি অথবা দেশিয়া বলে পরিচিত হচ্ছে। এদের নিজস্ব সংস্কৃতি আছে। ভাষা আছে। নিজস্ব আচার-আচরণে এখনও সমৃদ্ধ। তারই মাঝে কিছু লুপ্ত। কিছু হারিয়ে যাবার পথে…। আজকে আমাদের ‘আইচুরা’ নিয়েই মূল বক্তব্য। দেশিদের নিজস্ব উৎসব। নিজস্ব রীতিনীতিতে…

অন গোঁসাই বললেন— “আইচুরা হইল্‌ মহা উৎসব। যেইমত দুর্গাপূজা। ওইটা হইল হামারলার আত্মমর্যাদা”।

উৎসবটা কেমন?

উত্তরটা অন গোঁসাইয়ের বয়ানে লিখবার ইচ্ছে ছিল। লিখলে লিখাই যেত। তবে পাঠক ফাঁপরে পড়ত। কারণ, ঐ যে, প্রত্যেকেরই গল্প বলার নিজস্ব আচরণ আছে। গল্প বলতে বলতেই অন গোঁসাই জানতে চাইতেন— “কেনে দাউ, জানি করিবু?”। আবার কিছু বাদে বিড়ি ফুঁকতেন। শুরু করতেন অন্য প্রসঙ্গ। দীর্ঘ সাংসারিক জীবন ও তার ক্লান্তি নিয়ে কিছু কথা বলতেন। ফলে এইসব বক্তব্যকে গ্রিনরুমে রেখে সরাসরি মূল বিষয় আলোচনা করাই শ্রেয়। আর সেলিম দেবোত্তমরাও অধিকারবশত আমার মুখের শব্দকে কাটছাঁট করতে বলে দিয়েছে। বলেছে ঐ উৎসব সম্পর্কে অল্প কয়েকটি শব্দে লিখো। এবং আমার কঠিন সময়েও এই লেখাটি লিখিয়ে নিয়েছে— দুইরকম কৃতিত্বই ওদের প্রাপ্য। তবে মাঝে মাঝে অন গোঁসাইকে নিয়ে আসব আমার পরিশ্রম লুঘু করবার জন্যই।

‘দুর্গাপূজা’ এবং ‘আত্মমর্যাদা’ দুটোই মেদবহুল বিষয়। আছে জমজমাট আর স্বচ্ছলতা। আইচুরা তেমনি এক রমরমা পরব। সম্পদের প্রাচুর্য না থাকলে এই পরব করা সম্ভব নয়। তার কারণ, প্রতি বছরের একটা বিশেষ সময়ে মেয়ে-জামাই শ্বশুরবাড়ির সকলেরই সবকিছুরই (খাবার, পোশাক এবং ভ্রমণ) দায়িত্ব নেয় মাসাধিকের জন্য। অনুষ্ঠানের শেষে শ্বশুরবাড়ি যা দেয় সেও কম কী সে? গোরু ছাগল সোনা গহনা ভরতি। ফলে অন গোঁসাই দুর্গাপূজা ও আত্মমর্যাদা – বেশ চতুর ও সতর্কতার সঙ্গে ব্যবহার করেছেন বোঝা গেছে।

অন গোঁসাই— “খাবার দাবার বইল্‌তে কিন্তু ডাইল আর ভাত নাহায়। পত্যেক দিন মেলায় খাবার। নাহিরিও ভালো ভালো। মানে ঐ আর— খাবার-দাবারের বিহা বাড়ি”।

সে-কারণেই অন গোঁসাই প্রথম উপমা টেনেছেন দুর্গাপূজার সঙ্গে। অনেক আত্মীয় স্বজন কাকা কাকি ভাই বোন দিয়ে জনা তিরিশ থেকে পঞ্চাশেক। স্বভাবতই দুর্গাপূজার বিষয় আশয় চলে আসে। এই এতজন!! এতদিন!! আমাদের কাছে বিস্ময় বটেই। সম্প্রতি একটি গান লেখা হয়েছে। লিখেছেন অনিল কুমার সিংহ মহাশয়। সূর করেছেন নিমাই সরকার। খন ধর্মী গান।

“আইস কুটুম বইস আসনে
হামরা আছিক বেতালে
নবানি আষাঢ়ি মাইলা হামার
গেল যে কুনা
হাত মুখলা ধুবার টানে
জল দেও আনিয়া”

হাল আমলের লেখা এই গান হাল আমলকেই ধরেছে। বেতাল এখন হয়েছে। বেতালের সরল অর্থ ব্যস্ততা। আগে আত্মীয় আসা অর্থ রাজকীয় ব্যাপার স্যাপার। এই দেশিরা সেই নিয়ে আত্মমর্যাদায় অনুভূতিশীল ছিল।

জানতে চাইলাম “আর গোঁসাই কহিলেন যে— আত্মমর্যাদা অইখান কেমন?”

যে যতদিন শ্বশুরবাড়ি খাওয়াতে পারবে তার তত বেশি ধন-দৌলত আছে এই পরিচয় দেয়। অবশ্য তখন এমন কেউই ছিল না, যার কোনো সম্পত্তি ছিল না। টাকাপয়সা ছিল না। সবাই আইচুরা পালন করত। এবং যে পারত না সেও চেষ্টা করত। কারণ, এতেই তার পরিচিত। এতেই তার গৌরব। বংশমর্যাদা।

অর্থশাস্ত্রের লোকেরা, একে, তাদের পরিভাষায় হয়তো অপচয় জাতীয় বিশেষণ দেবে। ইতিহাস পড়ার যতটুকু সৌভাগ্য হয়েছে প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থার কারণে অর্থশাস্ত্রে তাও হয়নি। ফলে অপচয় বিষয়কে একরকম না-পাত্তা দিয়েই সামাজিক পরিকাঠামো নিয়ে কথা বলা যেতে পারে। এই যারা, এই আইচুরা পালন করত তারা এই এলাকায় ধনসম্পদের অধিকারী ছিল। জমিজমা সবই তাদের ছিল। নইলে বছরান্তে এমন পরব পালন করে, তেমন সাধ্য কার? ক্ষেত্রসমীক্ষাও তাই বলছে। এখানে অন গোঁসাই একক ব্যক্তি হলেও এক নয়। দেশিদের প্রতিনিধি। ক্ষেত্রসমীক্ষায় সাহায্যকারী সকল তথ্যদাতার সমাহার। উল্লেখিত ভৌগোলিক সীমানায় বসবাসকারী অন্য গোষ্ঠীরা হাল আমলের। আদিবাসী বাদে। সকলের বসবাসের ধরন দেখলেও বোঝা যায়। গুচ্ছাকারে সজ্জিত দেশিদের পাড়া-গাঁ। এক বাড়িতে ঢুকলে অন্য সমস্ত বাড়িতে যাওয়া যায়। যেন সুড়ঙ্গপথ। সমস্ত খবর সবাইকে পৌঁছে দেবার জন্য…। বাইরের শত্রু যাতে সহজে একক কোনো পরিবারকে আক্রমণ করতে না পারে। যেন গেরিলা শিবির। এমন গ্রামের দেখা এখনও মেলে।

“গোঁসাই এই অনুষ্ঠানগ্যালা কেনে হয়?”

গোঁসাই— প্রীতির বন্ধন। ভাই-বোনের বন্ধন। যেমন ভাইফোঁটা। সেখানে ভাইয়ের মঙ্গলকামনা করে। তেমনি এই অনুষ্ঠান। তবে একটু ফারাক আছে। আই মানে দিদি বা বোন। “মুই আইয়ের বাড়িত যাম”। এটা বোন বা দিদি ফোঁটা। বোন ও দিদির মঙ্গলকামনার অনুষ্ঠান। আজকালকার দিনে অবশ্য এমন কয়েকটা দৃশ্য দেখা গেছে বোনেরা বোনদের ফোঁটা দিচ্ছে। তবে দেশিদের এই অনুষ্ঠান যে একটি সামাজিক দলিল তা বোঝা যায়। স্বতন্ত্রতা বোঝা যায়। যে-কারণে এদের আত্ম-গৌরব।

“গোঁসাই!! এমন কাথা কহিলেন কেহয় বিশ্বাসে করিবা চাহিবেনায়!!!”

“সেইটা ওমার ব্যাপার— ঐ যে একখান কাথা আহি— বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর-তে বো এই হচ্ছে হামার অনুষ্ঠান। এই হছে হামারাল গৌরব”।

তথ্যসূত্র:
১। রায়, দেবেশ (সম্পা.)। ২০১৫। দলিত। দিল্লী; সাহিত্য অকাদেমি। পৃ. ১।

২। সরকার, গৌতম। ২০১৯। অত্মানুসন্ধানে দেশি-র সমীক্ষা ও পর্যালোচনা। হোসেন, জাহাঙ্গীর (সম্পা.)।বাংলার জনসংস্কৃতি ও সংস্কৃতি। রাজশাহী; বাংলাদেশ ফোকলোর গবেষণা কেন্দ্র। পৃ. ১৭।

Facebook Comments

পছন্দের বই