লেখক নয় , লেখাই মূলধন

কবিতা

হাসান রোবায়েত

হিস্ট্রি অব ম্যাডনেস

এক-একজন পাগলের থাকে এক-একরকম চরিত্র, যেমন পৃথিবীতে রাজাদের ইতিহাস আছে, আছে যুদ্ধের ইতিহাস তেমন পাগলদের জন্য কি কোনো ইতিহাস আছে? নিদেনপক্ষে পাগলকোষ? এই যেমন আমার মায়ের আপন চাচা ঝরু মণ্ডল, একদিন ডিগ্রি পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে কামারজানির উপর পাগল হয়ে যান তিনি—

একদিন, সূর্যাস্তের পাশে দেখা গেল ঝরু মণ্ডল চুপচাপ বসে আছেন— হাতে পায়ে শেকল— তখন কী ভাবছিলেন তিনি? তার আত্মার চারপাশে ম ম করে প্রজাপতি উড়ছিল হয়তো— বৃষ্টির ফোঁটার দিকে তাকিয়ে ঝরু মণ্ডল বলছিলেন, ‘প্রজাপতিরা পাখা নাড়ালেই ঝমঝম করে বৃষ্টি আসে পৃথিবীতে আর একজন সালেহা বেগম পায়ে নূপুর পরে হেঁটে যায় ঠান্ডা বাতাসের দিকে—’

আমার মা আমাকে সাবধান করতেন— ‘প্রত্যেক কবিই আসলে ঝরু মণ্ডল যারা বৃষ্টির শব্দকেও মনে করে সালেহা বেগম—’

আরজু পাগলি

পাগলামি সম্বন্ধে পাগলদের চেয়েও বেশি জানে পুবালি বাতাস— সেদিনও হাওয়ায় কাঁপছিল আর্ত দুপুরের ছায়া— একটা প্রাইমারি স্কুলের রুমে ক্লাস নাইনের ব্যাচ পড়াতাম আমি— দরজা থেকে সোজা রাস্তা দেখা যায়, ছোটো টঙ দোকানে কাঁচা ভিড়— বোর্ডে লেখার এক ফাঁকে আমাদের রুমে ঢুকে পড়ে আরজু পাগলি— সোজা আমার হাত থেকে চক নিয়ে কালো বোর্ডের উপর লিখে ফেলে ‘সাইফুল’— আমি জিজ্ঞাসা করি— কে উনি?— আরজু পাগলি হাতের ভঙ্গিমায় প্লেনের উড়ে যাওয়া দেখায়—

আমার ছাত্রদের মধ্যে একজন যা বলল তার সারমর্ম এই— সাইফুল দুবাই থাকে, বিয়ের পরপরই সে দুবাই ফিরে গেলে বউকে না করত মোবাইল না নিত কোনো খোঁজ! গ্রামের কয়েকজন যৌনবিষাদগ্রস্ত যুবক রাত বিরাতে জ্বালাতন করত তাকে— সাইফুলের জন্য সবুর করতে করতে একদিন পাগল হয়ে যায় আরজু— এরপর থেকেই গাছে মাটিতে শূন্যতা পেলেই লিখে দিত ‘সাইফুল’— যেন তার সমস্ত শূন্যতা থমথম করছে কেবল সাইফুল নামের পাশে—

এরপর গ্রামের ছেলেরা তাকে দেখলেই ক্ষ্যাপাত, ‘স্বামী বিদেশ’ আর আরজু পাগলি চিৎকার করে বলত— ‘সমস্ত গাছে গাছে ফুটে আছে আমার বিবাহ—’

সিদ্দিক পাগল

আমাদের গ্রামের সিদ্দিক পাগলের কথাই বলি না কেন—! একবার চূড়ান্ত রকমের পাগলামির পর তাকে ধরে-বেঁধে পাবনায় নিয়ে যাওয়া হল— সিদ্দিক পাগলকে দেখে ডাক্তার একটা চারদিক ফুটা বালতি দিয়ে বলল ‘এইটা ভরে আনো দেখি—’ সিদ্দিক তো মহাক্ষ্যাপা সে ডাক্তারকে বলল আপনাকে পাঁচটা জীবন দিলাম, পাঁচ জীবনেও বালতিটা ভরাতে পারেন কিনা দেখি—!

এখন আমার জীবন সিদ্দিক পাগলের সেই চারদিক ফুটা বালতিটার মতো, যতই জীবনকে আলো ও হাওয়া দিই না কেন জীবন ঝরে যায় দশদিক ফুটে থাকা অন্ধ ফুলের মতো—

রাবেয়া পারভীন

প্রতিটা পাড়াতেই নির্ঘাত একজন না একজন পাগল থাকে— তাদের প্রত্যেকেরই থাকে পাগলামির ভিন্ন ভিন্ন আর্ট— কেউ হয়তো কেবল দুই টাকা পেলেই শান্ত আবার কেউ হয়তো এক কাপ চা পেলেই খুশি— আমি একজন পাগলকে চিনতাম যে সারা রাস্তাভরে বড়ো বড়ো অক্ষরে লিখে রাখত ‘রাবেয়া পারভীন’— তার মায়ের নাম— একদিন যে তাকে রেখেই পালিয়ে গেছে তার বড়োচাচার সাথে—

কামনা

বদ্ধ উন্মাদেরা কীভাবে নারীকে কামনা করে আমি জানি না— শুধু বিষণ্ন দুপুরে চানখারপুলে দেখেছিলাম একজন অর্ধনগ্ন পাগল এক নারীর নাম ধরে শীৎকার করতে করতে মাস্টারবেট করছে রাস্তায়—তার চারপাশের রিকশা, গাছ, হাওয়া সবাই যেন তার কামনার নারী হয়ে তখন উড়ে বেড়াচ্ছে কল্পনায়—

Facebook Comments

পছন্দের বই