কবিতা
হিন্দোল ভট্টাচার্য
মৃৎফলকে লেখা
১
বড়ো অন্ধকার, তবু দুঃখ থেকে একদেওয়াল দূরে
সুন্দর যেখানে ম্লান মুখ
নির্জন ঘরের মতো, জানলা খুলে রাখে শীতকালে।
তোমার হাসির শব্দে ভেঙে পড়ে
বরফের নদী।
২
তোমার শহর থেকে দূরে থাকি,— তোমার ভাষায়
কবেকার মরচে ধরা লোহার পেরেক বিঁধে আছে।
মানুষ দেবতা হলে, দেবতা শয়তান হয়ে যায়
ঘন ঘন রক্তবমি করে;
এত বিষ তুমি কেন ধারণ করেছ মহাদেব?
তাহলে সমুদ্র তোল, ধিকিধিকি প্রতিহিংসা
ভালো কথা নয়।
তোমার শহর থেকে দূরে থাকি,— সুন্দরের গায়ে
কবেকার পোড়া দাগ লেগে আছে জড়ুলের মতো
৩
সেও তো আসলে মূর্তি,— যে কখনো নিজেকে ভাঙে না
খোলা চোখে পলক পড়ে না
তার চেয়ে মূর্তিকর হওয়া ভালো,— বার বার গড়ে
বার বার ভেঙে দেওয়া যায়
ব্যর্থ হলে মানে, তুমি বেঁচে আছ,—
রক্ত চলাচল হয়
দু-চোখে এখনও জল আসে…
৪
ভালো, উদাসীন থাকা। এঁটো বাসনের স্তূপে
যেভাবে আহার লেগে থাকে
ইশকুলবাড়ির গায়ে বিকেলের আলো,—
তোমাকে ঈশ্বর ভাবি।
মাছি ও পিঁপড়ের সারি প্রাণকণা খুঁটে নিতে আসে…
ভালো, উদাসীন থাকা। আকাশ এবং শস্যখেত
মুখোমুখি শোয় যেরকম…
খেলা অসমাপ্ত রেখে পড়ুয়ারা ঘরে ফিরে যায়
পড়ে থাকে মাঠ যার সবুজের ফাঁকে ফাঁকে
জীবনের দুঃখ লেগে আছে
৫
ঝরে যেতে পারি আমি, ঝরে যেতে পারো তো তুমিও
এ-পৃথিবী ঝরে যাচ্ছে প্রতিদিন, প্রতিরাতে—
আমাদের সকলের আয়ু আর মায়া ঝরে যায়।
যাওয়াটাই বড়ো কথা, থাকা তো কেবল
সমাধির কাজ। তুমি সমাধি হবে কি?
শিলালিপি থেকে তবু শুনেছ কি চোরা আর্তনাদ?
যুবতী যক্ষিনী জানে, তার স্তন বড়ো বেশি মৃত।
কামের আগুন নিভে গেছে তাই তাহাদের দেবী মনে হয়;
কোথাও সংগীত যেন শুধু প্রতিধ্বনি হয়ে আছে।
সংগীত ফুরিয়ে গেলে, তার পর শূন্যতাই জন্ম দেয় সুর…
৬
আমাকে গোপনে রেখে ঈশ্বর বিদেশ চলে যান
হাওয়াবদলের রক্ত বেসামাল করে।
দেখি গুহামানবের চোখ দিয়ে, ভাবি জগন্নাথ
কীভাবে অন্ধের চোখে দেখা দেন এ-ঘন বরফে?
এখন আঁধারশীত। ঘনঘন ছোবল মেরেছে
পিশাচেরা যেরকম পাকে পাকে খায়।
আমি তো গোপনে দেখি ঈশ্বরের ছদ্মবেশে রন্ধ্রপথ দিয়ে
এসেছে কালাচ-বিষ। রয়েছে খোলস।
আমরা দু-জনে বসে আছি কবে ঈশ্বর ফিরবেন—
৭
এই তো এলে, এর মধ্যে যাই যাই ভাব কেন, শোনো ওদিকে
কীর্তনের গান শুরু হল। রাতটা থেকেই যাও। না-হলে শ্বাসকষ্ট হবে,
ফিরে যাওয়ার পথ এত সহজ নয়।
কত চড়াই, ধ্বস, নালা, চোরাবালি, পাথর,— কোথাও কোথাও রাস্তাই নেই।
কোষবদ্ধ কিছু হাত বুনো লতাপাতা জড়িয়ে এ-পথে ধুলোয় মিশে আছে
ফিরে যাওয়ার পথ এত সহজ নয়।
৮
যখন ঈশ্বর নেই, আমি খুব নিরাপদে থাকি!
এলোমেলো করে দেওয়া তার কাজ, আমি তো গুছোই
সে বলে, সঞ্চয়ী মন বড়ো;
বই গোছাই, ভালো করে পরিষ্কার করি ঘর, ফুল তুলে আনি…
মন্ত্রের বদলে কিছু অভিমান পড়ি।
তিনি পাথরের মতো তাকিয়ে থাকেন
ঈশ্বর এলেই শুধু
আচমকা হাওয়ায়, ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় খেত
ঘরের ভিতরে জমে ধুলো, মাটি, জল।
দেখি মৃত গাছের ডালেও
একটি আশ্চর্য সাদা ফুল ফুটে আছে।
৯
কারা যেন আমাদের নিয়ে
অসমাপ্ত উপন্যাস লেখে।
এক-একটি অনুচ্ছেদে
এক-একটি চরিত্রে কথা বলি।
ক্রমশ লিখিত হই
তাঁর ইচ্ছেমতো।
তোমাকে হত্যার কথা ভাবি প্রতিদিন।
তোমাকে লেখার কথা ভাবি।

হিন্দোল ভট্টাচার্য
নয়ের দশকের যে-সব কবি বিশ বছরের অধিককাল ধরে বিস্তার করে রেখেছেন নিজেদের, হিন্দোল ভট্টাচার্য তাঁদের অন্যতম। বীরেন্দ্র পুরস্কারপ্রাপ্ত এই কবি স্বচ্ছন্দ গদ্যতেও। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা দশের বেশি।