লেখক নয় , লেখাই মূলধন

লোকজ উৎসব

জয়দেব বাউরী

বাউরী জনগোষ্ঠীর পরব

ছোটনাগপুর মালভুমির পালামৌ-হাজারীবাগ অঞ্চল থেকে মুণ্ডাড়ী জনগোষ্ঠীর একটি অংশ পৃথক হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল দামোদর নদের দুই তীর বরাবর। ছড়িয়ে পড়েছিল কাঁসাই, শিলাই, দ্বারকেশ্বর— এদিকে দামোদর থেকে অজয়ের দুই তীরবর্তী অঞ্চলে। পশ্চিম রাঢ়ের একটা বিস্তীর্ণ অংশজুড়ে ছিল মুণ্ডারী থেকে পৃথক হয়ে যাওয়া এই জনগোষ্ঠীর পদচারণা। তখনও তারা ছিল পশুশিকারী, গাছের ফল ভক্ষণকারী। বকের মাছ শিকারকে অনুসরণ করে হয়ে উঠেছিল মৎস্যশিকারী। এই জনগোষ্ঠীই বাউড়ী জনগোষ্ঠী।

নৃতত্ত্বের এই সামান্য অনুষঙ্গের প্রয়োজন হল এ-জন্যই যে, মুণ্ডাড়ী জনগোষ্ঠীর আচার অনুষ্ঠানের সঙ্গে বাউড়ী জনগোষ্ঠীর আচার-অনুষ্ঠানের বেশ কিছু সাযুজ্য রয়েছে আজও। যেমন— বাঁধনা পরব, কাঠিনাচ, শালগাছের পুজো, মাদল বাজিয়ে নাচগানের অনুষ্ঠান, উলকি নেওয়া, শিকার যাত্রা প্রভৃতি। কিন্তু বাউরী জনগোষ্ঠী তার জীবনযাত্রার সুদীর্ঘকালের ধারায় এসেছে বৌদ্ধসংস্কৃতির সংস্পর্শে, আরও পরবর্তীকালে এসেছে হিন্দুসংস্কৃতির সংস্পর্শে। আক্ষরিক অর্থে তারা পরিণত হয়েছে নিম্নবর্ণের হিন্দুতে। ফলত, তার আদিসত্তা, আদি আচার-অনুষ্ঠান-উৎসব-সংস্কৃতিতে ঘটে গেছে নানান সংযোজন, সংমিশ্রণ ও বিয়োজন। তেমনি ঘটেছে প্রতি-সংযোজনও। কিন্তু, বিগত শতাব্দীর নব্বই পরবর্তী বিশ্বায়ন হাওয়ায় ধীরে ধীরে ক্ষয়ে গেছে তার সংস্কৃতির অবয়ব। তবে আদি উৎসবের একটি-দু-টি আজও কিন্তু টিকে আছে স্ব-মহিমায়। অন্যগুলি ক্রমে ক্রমে ম্রিয়মান কিছুটা।

আষাঢ়ী পরব

বাউরী জনজাতির মূল পরবগুলো কৃষি ও শস্যকেন্দ্রিক। আষাঢ় মাসের প্রথম সপ্তাহে বর্ষা আগমনের সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় ‘আষাঢ়ী পরব’। নতুন উদ্যোমে ধান রোপণের কাজ পুরোপুরি শুরু করার পূর্বে টানা দু-তিন দিন পরবে মাতে বাউরী জনগোষ্ঠীর মানুষ। হিন্দুধর্মে এই একই সময়ে পালিত হয় অম্বুবাচী। কিন্তু, বাউরী জনগোষ্ঠীর কাছে এ যেন আকাশ ও ভূমির বন্দনা। বর্ষা আগমনের আনন্দ উদযাপন। কেন-না, মাটি-সংলগ্ন বাউরী জনগোষ্ঠীর মানুষদের কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ততা সেই কৃষি-সভ্যতার সূচনা লগ্ন থেকেই। এখনও প্রায় নব্বই শতাংশ মানুষই কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু এখন প্রায় সকলেই ভূমিহীন খেতমজুর, কেউ কেউ ভাগচাষি। তাই ‘আষাঢ়ী-পরব’ নিয়ে উন্মাদনা এতটুকুও কমেনি।

নতুন প্রজন্মের যে-সব ছেলেরা ‘পরিযায়ী শ্রমিক’ হয়ে বাইরে কাজ করতে যায়। তারাও ঘরে ফিরে আসে এই সময়। বাড়িতে আসে কুটুমজন, মেয়ে-জামাই। সাধ্যমতো নতুন জামা-কাপড় কেনার চেষ্টা করে সকলেই। কোথাও কোথাও কালকুদরা, বিসাঁই বা ভৈরবের থানে হয় শূকর বলি। ঘরে ঘরে ভাত পঁচিয়ে মদ রাখে মহিলারা। হাঁড়িয়া। বাখুলে বাখুলে সম্মিলিতভাবে কেনা হয় শূকর। নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা হয় তার মাংস। কৃষির সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত কাজ বন্ধ রাখে এ-সময়। কুটুমজন, প্রতিবেশীদের নিয়ে মাংস-মদ-গান-বাজনায় আষাঢ়ী-র আনন্দ উদ্‌যাপনে মেতে ওঠে বাউরী পাড়া। কোথাও কোথাও আষাঢ় মাসের সংক্রান্তির দিন পালিত হয় এই ‘আষাঢ়ী পরব’।

কিন্তু, বিগত দুই দশকে এই চিত্র বেশ কিছুটা বদলেছে। শতাংশের বিচারে অতি নগন্য হলেও শিক্ষার আলোয় আসতে পেরেছে নতুন প্রজন্মের একটা অংশ। অনেকেই সক্ষম হয়েছে মদের আকর্ষণ থেকে নিজেদের দূরে রাখতে। শূকরের মাংসও অনেকে ঘৃণা ভরে অপছন্দ করে। ফলত পরবের উন্মাদনা একই থাকলেও রুচি ও খাদ্যাভ্যাসে এসেছে বেশ কিছু পরিবর্তন। আবার পরবতী প্রজন্মের যারা মদপ্রেমী তারা হাঁড়িতে রাখা নিজেদের তৈরি মদের প্রতি উদাসীন। তাদের পছন্দ ‘বোতল’। তাই আষাঢ়ী পরবকে কেন্দ্র করে ঘরের মহিলাদের বেশ কয়েক দিন আগে থেকে যে একটা প্রস্তুতি চলত মদ রাখা ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে তা একেবারেই কমে এসেছে। চল্লিশের কম বয়সি মহিলারা এই শিল্পকর্মটিতে হয়ে পড়েছে একেবারেই অদক্ষ। অবশ্য প্রয়োজনও তো পড়ে না। নিকটবর্তী গঞ্জ থেকে ‘বোতল’ আসে। এখন বাখুলে বাখুলে মাদলও বাজে না আগেকার মতো। নিজেদের গান-বাজনার পরিবর্তে অনেক জায়গাতেই শব্দ-দূষণ ঘটিয়ে অ্যাম্পিলিফায়ারে বাজতে থাকে জনপ্রিয় বাংলা-হিন্দি সিনেমার গান। তবে পরব নিজে আছে পরবের মতো।

মনসাপুজো

ধান রোপণের কাজ সম্পূর্ণ হবার পর কোথাও শ্রাবণ মাসের সংক্রান্তি কোথাও আবার ভাদ্র মাসের সংক্রান্তিতে মনসাপুজো হয়। শুধু বাংলা নয়, সর্পদেবীর পুজো বা আরাধনা নানা আঙ্গিকে ছড়িয়ে রয়েছে সারা দেশজুড়েই। কিন্তু বাউরী জনগোষ্ঠীর মনসাপুজোয় বেশ কিছু স্বাতন্ত্র্য লক্ষ করা যায়। প্রতিটি গ্রামে রয়েছে মনসার থান। একমাত্র মনসারই মূর্তি পুজো করে বাউরী জনগোষ্ঠীর মানুষ। পাড়ায় পাড়ায় খড়মাটি অথবা কংক্রিটের ঠাকুর ঘর রয়েছে একমাত্র মনসারই। অন্য সব দেবতা বা ‘বুড়ি’-র অবস্থান গ্রামের আশেপাশে খোলা-আকশের নীচে, গাছের তলায় বা বনজঙ্গলের ধারে, ঝোপেঝাড়ে।

প্রায় মনসা থানের পাশেই থাকে ভৈরবের থান। মনসার পুজোয় বসার আগে ভৈরবের পুজো করা হয়। পুজোর আগের দিন হয় ‘বার’। হাঁড়ি-বাসন মেজে ‘বেরো’-র জন্য বারের ভাত রান্না করে মহিলারা। দুপুরে নখ, চুল-দাড়ি কেটে, স্নান করে বারের ভাত খায় ‘বেরো’। তারপর উপবাস। ভোরের বেলা সূর্য ওঠার আগে কেউ গুড়-চিড়া খায়। পুজোর দিন সারা বেলা উপবাস করার পর সন্ধ্যায় ঘট নিয়ে পুকুরে যায় ‘বারি’ আনতে। ঘাটপুজো করে জল নেয় ঘটে। সারিবদ্ধ ফিরে আসার সময়ই ভর আসে কোনো-না-কোনো ‘বেরো’-র। পথে না আসলেও থানে গিয়ে আসবেই। কারো উপর ‘ভর’ করে ভৈরবরাজ। কারো উপর ‘ভর’ করে স্বয়ং মনসা! তখন সবল পুরুষরা জড়িয়ে ধরে তাদের উন্মত্ততাকে সামাল দেবার চেষ্টা করে। অথবা থানজুড়ে আছাড়-পিছাড়ি দিয়ে উন্মত্ততা প্রকাশ করতে থাকে। দাঁত কিড়মিড় করে ঢাকিকে বলতে থাকে ‘বাজা’। ঢাকের বাজনা আর ‘ভরণমত্ত বেরো’-র উন্মাদনা! পাশে দাঁড়ানো লোকজন, অন্যান্য বেরোরা বলে ওঠে ‘খেলুক’। উন্মত্ততা থামিয়ে ভরমত্ত বেরো একসময় নিজেই বলতে থাকে নানা ক্ষোভের কথা। পুজো নিয়ে সন্তুষ্টি অথবা অসন্তুষ্টির কথা, পাড়ার মঙ্গল অমঙ্গলের কথা। রাতভর তিনবার পুজো হয়। শেষ পুজো হয় ভোরের দিকে। অর্থাৎ, রাতজুড়ে জাগরণ। এই জাগরণের ঐতিহ্য রয়েছে বাউরী জনগোষ্ঠীর টুসু-ভাদু-মকর পরবেও।

বাউরী জনগোষ্ঠীর আদি ঐতিহ্যের ধারায় গানবাজনা সব পরবেরই অঙ্গ। মনসাপুজোতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। পুজোর বেশ কিছুদিন আগে থেকে শুরু হত ‘জাত’ গাওয়া। এখন কেবল বার, পুজো আর পান্নার দিন গাওয়া হয়। মনসা-কাহিনির বিভিন্ন অনুষঙ্গ নিয়ে এই গান গাওয়া হলেও নিজেদের অভাব-দারিদ্র্যের কথাও উঠে আসে এবং তা আলাদাভাবে গীত হয় কখনো কখনো। পান্নার দিন ছাগবলি দিয়ে পুজো সম্পন্ন হয়। তারপর প্রসাদ গ্রহণ করে উপবাস ভাঙে সম্পূর্ণরূপে।

গোয়ালপুজো

ভাদ্র মাসে মনসাপুজোর পরদিনই হয় গোয়াল পুজো। পাঁকুড় গাছের ডাল কেটে খানিকটা কাঠের পুরোনো পুতুলের আঙ্গিকে বানানো হয় ঠাকুর। গোয়ালঘরে টাঙানো হয় শালুক ফুল। খই-মুড়কি-সিঁদুর-কাজল-হলুদ-তেল আর শালুকের উপচারে পুজো করে বাখুলেরই কোনো পুরুষ। ক-দশক আগেও মাদল বা ধামসা বাজিয়ে গাওয়া হত গান। এখন বিলুপ্ত সেইসব গান ও গানের মানুষেরা।

ভাদুপুজো

ভাদ্র মাসের সংক্রন্তির দিন হয় ভাদুপুজো। বাউরী সংস্কৃতির ধারায় অনেক পরের দিকে সংযোজন ঘটেছে ভাদুর। তার একটি জনশ্রুতিও প্রচলিত রয়েছে। দেবী নয় বরং বাড়ির কন্যারূপেই পূজিতা হয় ভাদু। ভাদ্র মাসের প্রথম দিন থেকে কলঙ্গার মধ্যে গোবরের উপর ধান ছড়িয়ে, কোথাও কোথাও আবার একটি পাত্রের উপর ফুল রেখে এক মাস ধরে চলে ভাদুর আরাধনা। এটি ভাদুর বিমূর্ত এবং আদি রূপ। ভাদ্র-সংক্রান্তির এক সপ্তাহ আগে ভাদুর মূর্তি নিয়ে আসা হয় ঘরে। এই মূর্তি পূজার প্রচলন হয়েছে অনেক পরে। বাউরী জনগোষ্ঠীর পঞ্চকোটী, মানা এবং মূলা বাউরীদের মধ্যে ভাদুপুজো নিয়ে উন্মাদনা সবচেয়ে বেশি। কুমারী ও বিবাহিত মহিলারা সংক্রান্তির রাতে ভাদুর জাগরণ করে। ভাদু গীত গায়। পরদিন সকালে দলবদ্ধভাবে গান গাইতে গাইতে বিসর্জন দেয় পুকুরে বা নদীতে। এ-সময় এক ভাদুদল আর এক ভাদুদলের উদ্দেশে করে গান গায়। গানে গানে পাল্লা দেওয়া চলে।

ভাত বাড়ানো ও বাঁদনাপরব

এটি বাউরী জনগোষ্ঠীর একটি আচার। কিন্তু বাউরী জনগোষ্ঠীর বেশ কিছু আচারের সঙ্গে সঙ্গেই জড়িয়ে আছে অনুষ্ঠান, উৎসব। এই ‘ভাত বাড়ানো’ হয় কার্ত্তিক মাসের অমাবস্যায়। শক্তিদেবী কালিকার পুজোর দিন সকালের দিকে। মেয়েরা রান্নার হাঁড়িবাসন পুকুরে নিয়ে গিয়ে মাজে। স্নানটান করে এসে রান্না বসায়। বাড়ির বয়সে বড়ো কোনো পুরুষ স্নান সেরে এসে সেই রান্নার নানা পদ এক একটি পেনেটি পাতায় সাজায়। পূর্বপুরুষদের উদ্দেশে নিবেদন করে সেইসব আহার্য্য। এই আচারটিই ‘ভাত বাড়ানো’। এ-দিনই সন্ধ্যাবেলায় হয় ‘ইঁজোপিঁজো’। অল্পবয়সি ছেলেমেয়েরা পাটকাঠি জ্বালিয়ে, কুলো বাজিয়ে মশা তাড়ায়। পুড়ে যাওয়া পাটকাঠির অবশিষ্ট অংশ পুকুর বা ডোবার কাদায় পুঁতে দেয়।

কিন্তু এই আচারটিই অন্য এক মাত্রা পেয়ে যায় যখন পরদিনই জাঁকিয়ে বসে বাঁদনা পরব। অন্যান্য আদি জনগোষ্ঠীর থেকে বাউরী জনগোষ্ঠীর বাঁদনা বেশ কিছুটা অন্যরকম। হয়তো-বা বৌদ্ধ-সংস্পর্শ পেরিয়ে নিম্নবর্ণের হিন্দুতে পরিণত হওয়ার জন্যই। গোয়ালের সবচেয়ে বয়স্ক গোরুটির শিঙে হলুদ-তেল মাখানো হয় প্রথমে। তারপর গোয়ালের অন্য গরুদের। সব গোরুগুলির সারা পিঠেই আলতার ছাপ মারা হয় বাটিতে কাপড় জড়িয়ে। দুয়ারে কাঁঠাল পাতা রেখে জ্বালানো হয় প্রদীপ। বাউরী জনগোষ্ঠীর কাছে এটি গোরুর বিবাহ।

পুরুষরা মাদল বাজিয়ে কাঠি-নৃত্য করে। গান গায়। সেই গানে থাকে কৃষির অনুষঙ্গ এবং অন্য নানা প্রসঙ্গও। পাড়ার মনসাথানে নৃত্য-বন্দনা করে যায় গ্রামের ‘গোলাঘর’ তথা অন্যান্য উচ্চবর্গের বাড়িতে নাচ দেখাতে ও ‘আদায়’ করতে। সেই ‘আদায়’ সংগ্রহ করে পাড়ারই কারো উঠোনে পান-ভোজনে বসে আর প্রায় রাতব্যাপী গাইতে থাকে গান। কখনো ঝুমুর, কখনো ‘ডাঙাল্যা’।

চাঁওড়ি-বাঁওড়ি-মকর-এখ্যান-টুসু পরব

শস্য খামারে উঠে যাবার পর শুরু হয় বাউরী জনগোষ্ঠীর অন্যতম বড়ো পরব ‘চাঁওড়ি-বাঁউড়ী-মকর-এখ্যান-টুসু পরব’। বাংলা তো বটেই দেশের বিভিন্ন প্রদেশে হয় মকর সংক্রান্তি উদ্‌যাপন। বাউরী জনগোষ্ঠীর পরব শুরু হয় ‘চাঁওড়ি’-র দিন থেকেই। এই দিন থেকে পরবের প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করে স্থানীয় হাট-বাজার থেকে। মহিলারা স্নান সেরে পিঠেপুলির জন্য ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে গুঁড়ো কোটে। অল্পবয়সি মেয়েরা এই দিন বা তার আগের কোনো হাটবারের দিন টুসুর চৌডল কিনে আনে। ছেলেরা অনেক আগে থেকেই ‘মকরকুঁড়ে’-র জন্য খেঁজুরপাতা কেটে মাঠে শুকোতে দিয়ে রাখে। পরব উদ্‌যাপনের চূড়ান্ত প্রস্তুতির দিন হল এই ‘চাঁওড়ি’।

পরদিন ‘বাঁওড়ি’ থেকে শুরু আসল পরব। এদিন মহিলারা স্নান সেরে পিঠে তৈরি করে। পুরুষরা ‘বাঁওড়ি’ জাগানোর প্রস্তুতি নেয়। পাড়ার আশেপাশে ফাঁকা মাঠে শালাপাতা, শালডালে কুঁড়ে বানায় গানবাজনা আমোদ-স্ফূর্তির জন্য। সন্ধ্যা হতে না হতেই ঢোল-ধামসা-মাদল নিয়ে পাড়ার ‘মরদ’-রা হাজির হয় সেখানে। চালা হয় বাড়িতে রাখা হাঁড়ির মদ। উনোন বানিয়ে বান্না হয় ‘চাট’। শুরু হয় ঝুমুর গান। একজনের একটা গান শেষ হয় তো অন্যজন আরেকটা শুরু করে। ধামসা-মাদলে মাতোয়ারা হয়ে এভাবেই রাতব্যাপী বাঁওড়ি জাগায় বাউরী-পুরুষরা। কিন্তু সংস্কৃতির বিশ্বায়নের হাওয়ায় ‘বাঁওড়ি’ জাগানোর এই চিত্রটিও অনেকটাই কমে এসেছে এখন।

টুসু ভাসান: গুগ্‌ল ইমেজ

বাঁওড়ির বিকেলে আশপাশের ফাঁকা মাঠে বা পুকুর পাড়ে শুকনো খেঁজুরপাতি-পোয়াল দিয়ে ‘মকরকুঁড়ে’ বানায় ছেলেরা; সংক্রান্তির সকালে স্নান সেরে আগুন পোহাবে বলে। এদিন কৃষিকাজের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি এমনকী অন্যান্য জিনিস কারো বাড়িতে ফেলে রাখে না। অন্য কারো বাড়িতে থাকলে তা ঘরে নিয়ে আসে। সন্ধ্যায় ‘দেনি তোলা’ ধান আঁটি থেকে খড় নিয়ে ধান-চালের পুঁড়ো, মরাই, কৃষিযন্ত্রপাতি ও অন্যান্য জিনিসের উপর চাপিয়ে রেখে ‘বাঁওড়ি বাঁধে’। বাড়িতে রাতের খাওয়া-দাওয়ার আগেই এই বাঁওড়ি বাঁধার কাজটি সম্পন্ন করে নিতে হয়। সকালে মকর স্নানের সময় সেইসব বাঁওড়ি বাঁধা খড় ঘটির ভেতর ঢুকিয়ে পুকুরে জলে ভাসিয়ে আসে। স্নানের পর মকরকুঁড়ে জ্বালিয়ে আগুন পোহায়।

বাঁওড়ির রাত্রেই থাকে মেয়েদের টুসু বা তুষুর জাগরণ। পৌষ মাসের প্রথম দিনই টুসুপাতে অল্পবয়সি মেয়েরা। মাটির সরার উপর সারি দিয়ে বসানো প্রদীপ। মেয়েরা কুমোর ঘর থেকে কিনে আসে এই টুসু। এর পর এক মাসব্যাপী প্রতি সন্ধ্যায় টুসুর গান গেয়ে আরতি করে। অল্পবয়সিদের সঙ্গে যোগ দেয় বাড়ির ও বাখুলের বড়োরাও। বাঁওড়ির সন্ধ্যায় লুচি-সুজি-মিষ্টি-গুড়-চিড়া দিয়ে টুসুর ভোগ প্রস্তুত করে। সারারাত সমবেতভাবে গান গেয়ে টুসুর জাগরণ করে। ‘পহরে পহরে’ পুজো দেয়। কুয়াশা ছড়ছড় ভোর হতে না হতে টুসুকে মাথায় নিয়ে গান গাইতে গাইতে বাধ বা নদীর দিকে যায় ভাসাতে। এ-সময় একদল আর এক দলকে খানিকটা টিজিং করেই গান গায়। গানে গানে পাল্লা দেয় পরস্পর।

মকরের পরের দিনই এখ্যান। এই এখ্যান দিনেই বনবাদাড়, ঝোপঝাড়ে যে-সব দেবতা আছে তাদের সকলেরই পুজো হয়। মায়ুন্দাবুড়ি, বিসাঁই, কুদরা, বড়াম— এইসব দেবদেবীর থানে ষাঁড়া বলি হয়। মাটি খুঁড়ে পাথর দিয়ে উনোন বানিয়ে মাটির হাঁড়ি-সরায় রান্না হয় ভোগ। মোনোই খিঁচুড়ি। মুনিস-কামিন-মানদ্যার-ভাগীচাষিরা ‘গোলাঘর’ পরিবর্তন করে অন্য ‘গোলাঘরে’ কাজে যোগ দিতে পারে। পুরোনো গোলাঘরে মুজরি-টজুরি বাড়ানো নিয়েও কথা হতে পারে। বাউরী জনগোষ্ঠীর কাছে এই ‘চাঁওড়ি-বাঁওড়ি-টুসু-মকর-এখ্যান’ পরব আসলে এক কৃষিবর্ষ বিদায় এবং আরেক কৃষিবর্ষকে বরণের উৎসব।

ছাতুবাড়ানো ও গাজন

চৈত্র মাসের সংক্রান্তির দিন পূর্বপুরুষদের উদ্দেশে ছাতু বাড়ানো হয়। বাড়ির বয়সে বড়ো পুরুষরা-মহিলারা সকাল থেকে উপবাস করে। ঘর থেকে শাল বা পলাশ পাতায় ছাতু-গুড়-কাঁচা আম নিয়ে পুকুরে যায়। ডুব দেবার পর পেনেটি বা পদ্ম পাতায় সেই ছাতু-গুঁড়-কাঁচাআমের অংশ রেখে জলে ভাসিয়ে দেয়।

চৈত্র সংক্রান্তির শিবের গাজনে বাউরী জনগোষ্ঠীর পুরুষরা ভক্তা হয়। চড়কে ওঠে। বাণ ফোঁড়ানোর মতো নানা কৃচ্ছ্রসাধনের মধ্য দিয়ে দেবতাকে তুষ্ট করার চেষ্টা করে।

বাউরী জনগোষ্ঠীর পরব বা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের দু-টি প্রধান অক্ষ হল— ‘আষাঢ়ী’ ও ‘বাঁওড়ি’। প্রথমটি, সমস্ত সৃজনের উৎস, রাঢ়ের কৃষির সম্ভাবনার প্রধানতম আকর বর্ষাকে বরণ ও তার আগমনে আনন্দ উদ্‌যাপন। দ্বিতীয়টি হল শস্যের পূর্ণতা প্রাপ্তির পর খামারে ওঠা ও শস্যদেবী টুসু ঘিরে আনন্দ উদ্‌যাপন। অর্থাৎ, একটি কৃষি পর্যায়ের সূচনা এবং তার পরিসমাপ্তি এই দু-টি প্রধান বিন্দুতে স্থিত যেন বাউরী জনগোষ্ঠীর উৎসব। অন্যান্য পরবগুলি যেন আনুষঙ্গিক। নানাভাবে তা বাউরী জনগোষ্ঠীর জীবন ও চিত্তকে নান্দনিক উৎকর্ষতা দান করেছে।

ঋণ

১। রাঢ় সভ্যতা— সুনীল কুমার দাস।
২। রাঢ়ের জনজাতি ও লোকসংস্কৃতি— ড. মিহির চৌধুরী কামিল্যা।
৩। ভারতের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়— ড.অতুল সুর।

Facebook Comments

পছন্দের বই