লেখক নয় , লেখাই মূলধন

গল্প

কৌশিক মিত্র

ডাউনস্ট্রিম

ফরতাবাদের সুরমা অ্যাপার্টমেন্টের ১২ নং ফ্ল্যাটটা একটি আপাত কলহ অথবা কথা-কাটাকাটির পর স্তব্ধ হয়ে গেছে। এক চিলতে বারান্দা থেকে সিগারেটের ধোঁয়া চারিয়ে যাচ্ছে সামনের রাস্তায়, রাস্তাটা নাকবরাবর গিয়ে মিশে যাবে গড়িয়া স্টেশন রোডে। বাঁ-দিকে এগিয়ে একটু গেলেই হরিমতী গার্লস। ধোঁয়াটা ততদূর যাবে না, যাওয়া সম্ভব নয় বলেই। কিন্তু উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থাকল হরিমতী গার্লস স্কুল। সোনারপুর ব্লকের খাদ্য দপ্তরের পরিদর্শক অনিন্দ্য এখনও ঠিক করে উঠতে পারেনি মেয়ে সোনাইকে কোথায় ভর্তি করবে, কাছাকাছি হরিমতীর প্রাইমারি সেকশনে না কি আইসিএসই-র কোনো স্কুলে! চার বছর হয়ে গেল সোনাইয়ের। শিখার আপত্তি বোর্ড বা মিডিয়াম নিয়ে ততখানি নয়, যতটা অনিন্দ্যর গড়িমসি নিয়ে। অনিন্দ্য এই জায়গাটায় এসে বড়ো কনফিউজ্ড‌।ইংরেজি না বাংলা, আইসিএসই-তে না পড়লে কতখানি ক্ষতি হতে পারে সোনাইয়ের, সবাই কি হাসাহাসি করবে সোনাই বাংলা মিডিয়ামে পড়ছে বলে। মন বিদ্রোহ করে ওঠে মাঝে মাঝে! যদি পড়াতে নিজেকেই হয়, তাহলেও বছরে কম-সে-কম চল্লিশ থেকে ষাট হাজার টাকা স্কুলে দিতে হবে। কেন??? কেরোসিনের ডিলার হরি পালের মুখটা মনে পড়ে যায়, কী খুশিতেই না এসে মিষ্টি খাইয়েছিল নাতনিকে নামজাদা এক আইসিএসই বোর্ডের স্কুলে ঢুকিয়ে। এই সোশাল প্রেসার অনিন্দ্যকে গুটিয়ে রাখে। পাটুলির এক বিখ্যাত স্কুল থেকে ফর্মটা তুলে ফিল-আপ করে জমা দেবে কি দেবে না এটাই সে ভেবে যেতে থাকে। শিখার আপত্তি সংগত, এরপর দেরি করলে তো হরিমতীর শিশু শ্রেণিতে ঢোকাও মুশকিল হয়ে যাবে, ক্লাস ওয়ানে তো আবার লটারি।

অফিস থেকে অটোয় ফেরে অনিন্দ্য। অভ্যাসবশত, স্টেশন রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে সে পৌঁছে যায় বরদাপ্রসাদ হাই স্কুলের উলটো দিকের ইউনিক বুক স্টোর্স-এ। দোকানের মালিক নির্মলবাবুর ফেয়ার প্রাইস শপ আছে। দুই ছেলে এই দোকানটা দেখে, আবার ব্লকে খাতাপত্র সইয়ের জন্যও তারা প্রায়ই অনিন্দ্যর কাছে যায়। স্বভাবতই ছেলেদুটোর সঙ্গে অনিন্দ্যর সখ্যতা জমে যায়, নকাই তো অনিন্দ্যরই বয়সি ফিজিক্সে অনার্স, প্রচুর টিউশনও পড়ায়, মকাই একটু ছোটো। বেশিরভাগ সময়ে ইউনিকে মকাই-ই থাকে। খুব বেশিদিন অনিন্দ্য সোনারপুরে পোস্টিং পায়নি, সুতরাং আবাসনের বাইরে তার পরিচিতি কম, খুব একটা মিশুকে না হওয়ার কারণে সে এ-জায়গায় পিছিয়ে পড়ে, আবার ভেতরের আড্ডাবাজ মানুষটিকে সামলাতে না পারায় ইউনিক স্টোর্স তার গল্প করার একটা ঘাঁটি হয়ে দাঁড়ায়।

একটু আগেই ইউনিকে ঢুকেছে অনিন্দ্য। সন্ধ্যা নামছে। মেট্রোর গতিবিধিতে এই চত্বর এখন সর্বদাই সরগরম। কেন-না ঠিক পেছনেই কবি নজরুল। নির্মলবাবু মাঝে মাঝে দোকানে এসে বসেন। আগে কী ছিল, এখন কী হয়েছে এসব গল্প নির্মলবাবুর কাছ থেকে শুনতে ভালোবাসে অনিন্দ্য। আপাতত দোকানের সামনে ভিড় দেখে তার থমকে যাওয়া— হঠাৎ মকাই তাঁকে দেখতে পেয়ে যায়— ‘স্যার, এদিক দিয়ে আসুন।’ দোকানে ঢুকে একটা টুলে জমাট হয়ে যায় অনিন্দ্য।

এক সুবেশা চড়া মেক আপ নেওয়া ভদ্র মহিলার সঙ্গে মকাইয়ের তর্ক চলতে থাকে—

— ‘ম্যাডাম, আমি তো আগেই বলেছি অক্সফোর্ডের হার্ড বাইন্ড খাতা, একদিকে ছবি, রং পেনসিলের কাজ, অন্য দিকে টাইপড প্রিন্ট আউট নিয়ে সাঁটানো— পাঁচশোর এক পয়সা কমে দিতে পারব না।’

— ‘কিন্তু গাঙ্গুলীবাগানের মডার্ন সাড়ে তিনশো করে নিচ্ছে কী করে?’

— ‘ছবিটা তাহলে বাড়িতে এঁকে নিতে হবে ম্যাডাম।’

ভদ্রমহিলা ব্যাজার। ‘কত অ্যাডভান্স দিতে হবে?’

— ‘তিনশো।’— ভদ্রমহিলা তিনটে কড়কড়ে একশো টাকার নোট বার করেন।

বিলে লেখা শুর হয়।— দান্তে, মাইকেলঅ্যাঞ্জেলো, মোৎজার্ট, নেপোলিয়ন, আমুন্ডসেন… মকাইয়ের বিড়বিড় অথচ নির্লিপ্ত উচ্চারণ চমকে দেবার পক্ষে যথেষ্ঠ।

‘অন্বেষা সেনগুপ্তের নামে বিলটা করুন। ক্লাস ফোর। হ্যাঁ, মোবাইল নাম্বার… না না, স্কুলের নাম লেখার দরকার নেই কিন্তু কবে দেবেন?’ হ্যাঁ, একটা কথা মনে রাখবেন, দু-শোর ওপর ওয়ার্ড যেন না হয়! ম্যাক্স দু-শো দশ। আমি কিন্তু দেখে নেব।

— ‘বেশ। আজ বুধবার! শনিবার বিকেলে পাবেন।’

ভদ্রমহিলা চলে গেছেন। মকাইয়ের সঙ্গে অনিন্দ্যর টুকটাক কথা শুরু হয়।

— ‘কী ব্যাপার মকাই? ফোরের একটা মেয়েকে দান্তের উপর দু-শো শব্দে রচনা লিখতে হবে?’ আহা! রবীন্দ্র সদনে লিট্ল‌ ম্যাগাজিন মেলা থেকে কেনা কমল মুখোপাধ্যায়ের শিলীন্ধ্র-র দান্তে সংখ্যাখানা অনিন্দ্যর মগজে ঝিলিক দিল। এখনও পুরোটা পড়ে ওঠা গেল না।

— ‘না, স্যার রচনা-টচনা নয়। সিম্পল প্রোজেক্ট!’

— ‘প্রোজেক্ট ব্যাপারটা আগেও শুনেছি। তা একটা ক্লাস ফোরের বাচ্চা দান্তের উপর প্রোজেক্ট করবে?’

— ‘স্যার, ওভাবে ভাবছেন কেন? এখন স্কুল, পেরেন্টস, টিচার সবাই চাচ্ছে ছেলে-মেয়ে অল স্কোয়ার হোক। দান্তে থেকে প্রোগামিং সবকিছুই মগজে লোড করে নিতে হবে’—

— ‘বুঝলুম। তা তোমার ভূমিকাটা কি এখানে, বাচ্চাদের বকলমে তুমি এসব তৈরি করো নাকি?’

— ‘না স্যার, আমার সময় কখন? সব লোক আছে। খাতা-পেনসিল তো পাইকেরি রেটে কেনা। একটা ছেলে আছে, ইরেজিতে এমএ করেছে বিদ্যাসাগর থেকে ডিসট্যান্সে, দু-চারটে সাইট ঘেঁটে এসব তৈরি করে একেবারে স্পেসিফিকেশন মতো টাইপ করে প্রিন্ট-আউট দিয়ে চলে যায়। এক দিদি আছেন, বাচ্চাদের পড়ান, ভালো ছবি আঁকেন তার কাজ খাতায় ছবি, লেখাগুলো পেস্ট করে, ছবির পাশে অলঙ্করণের কাজটা করা— ব্যস প্রোজেক্ট রেডি।’

অনিন্দ্য ফিরে গেল ছোটোবেলায়। সেটা সম্ভবত ১৯৮৮। সে ওয়ানে। মা তখনই বিএড করতে গিয়েছিল, শ্রীমন্ত কাকু মা বিএড-এর প্র্যাকটিস টিচিঙের প্র্যাকটিকাল খাতা অলঙ্করণ করছে। তখন বিএড-কে বিটি বলা হত। যতদূর মনে পড়ছে রুল টানা অংশে প্রথমে লেখা ছিল শিক্ষক ক্লাসে যে-পিসটি পড়াতে চলেছেন সেটি কীভাবে উপস্থাপনা করবেন তারই বিবরণ-নমুনা হিসেবে সম্ভবত: ‘ভোরাই’ কবিতাটা ছিল। হায়, সে-খাতাগুলো যে কোথায় হারিয়ে গেল!

— ‘রেট’ কীরকম দাও?

— ‘কম্পাইলেশন আর প্রিন্ট আঊট একশো পঁচিশ, ছবি আঁকা-সাঁটানো পঁচাত্তর।’

— ‘খাতা, মলাট স্টিকার নিয়ে তাহলে আড়াইশো। বাবা! তোমার তো হান্ড্রেড পার্সেন্ট প্রফিট।’

— ‘খাতা পেন বই বেচে লাভ নেই স্যার। বই/খাতা এখন স্কুল থেকে নেওয়া মাস্ট। দোকান টিকিয়ে রেখেছে প্রোজেক্ট আর ইশকুল।’

— ‘বাঃ, এ তো দেখছি একেবারে ইন্ডাস্ট্রি!’

— ‘ঠিকই স্যার! কোর নয়, তবে ডাউনস্ট্রিম!’

ফিলড আপ ফর্ম নিয়ে আপাতত, সেই বিখ্যাত স্কুলের সামনে অপেক্ষমান অনিন্দ্য। গেটের অদূরে ভুট্টাওয়ালা, পাশে সুদৃশ্য চশমার দোকান। সে জানে, ফর্ম জমা দিলে সোনাইকে অ্যাডমিশন টেস্টে বসতে হবে। সিলেবাস দেওয়া আছে— ‘এ’ থেকে ‘জেড’ বড়ো ও ছোটো হরফে লেখা, ‘অ’ থেকে ‘ন’ পর্যন্ত লেখা এবং ‘ওয়ান’ থেকে ‘ফিফটি’ পর্যন্ত সনাক্ত করতে পারা— মোটের উপর এই হল সিলেবাস। এতে উতরোলে বাবা মা ক্যান্ডিডেট-সহ তিনজনকে ইন্টারভিউ বোর্ডের সামনে হাজির হতে হবে। তাতে কর্তৃপক্ষ খুশি হলে তবে অ্যাডমিশনের পরোয়ানা।

অনিন্দ্য টাইম মেশিনে করে ফিরে যাচ্ছিল ব্লকের স্থায়ী সমিতির মিটিঙে। নারী, শিশু ও সমাজকল্যাণ স্থায়ী সমিতির তরফ থেকে বক্তব্য রাখছিলেন সিডিপিও শুভাশিস গোস্বামী— শুভাশিস অনিন্দ্যদেরই সমসাময়িক— ৩-৬ বছর বয়সের বাচ্চাদের জন্য প্রথাগত শিক্ষা-প্রণালীকে এড়িয়ে ব্যবহারিক এবং বিনোদনমূলক শিক্ষাদান যে কত প্রয়োজনীয় সে-কথাটাই বোঝচ্ছিল শুভাশিস, ব্লকের (প্রোজেক্টের) ২০ খানা শিশুয়ালয়ে (মডেল আইসিডিএস সেন্টার) পূর্ণোদ্যমে কাজ শুরু হয়ে গেছে, দ্বিতীয় ধাপে ২৫টির কাজ শেষের মুখে, ওয়ার্কারদের সিনিতে (চাইল্ড ইন নিড ইনস্টিটিউট) অ্যাডভান্সড ট্রেনিং নেওয়ার পর্ব সমাধা। শুভাশিসের সঙ্গেই নিছক আগ্রহের বশেই হরিনাভীর কাছে একটা শিশুয়ালয়ে তার যাওয়া, বাচ্চাগুলোর জন্যে ট্রফি নিয়ে গিয়েছিল সে। সে এক আজব দেশ। সেই ফ্ল্যাশব্যাক এখন তাকে ছিঁড়েখুঁড়ে দিচ্ছিল।

সমস্যা হচ্ছে সোনাই পারছে না ঙ, ঞ লিখতে, এ-র মাত্রা কেন সে দেবে না এটা তার কাছে খুব দুর্বোধ্য, ওয়ান থেকে ফিফটি সিরিজে চিনলেও র‍্যান্ডম সিলেকশনে অসুবিধেয় পড়ে যাচ্ছে। মেয়েটা কুঁচকে যাচ্ছে দিনদিন! কয়েকদিন আগেও অফিস থেকে ফিরে বাপ মেয়ের সঙ্গে টিনটিন নিয়ে বসত। রোজ তিন পাতা। টানটান হয়ে থাকত মেয়েটা! বাবা থার্কেটা দুষ্টু, কেন ও ক্যাপ্টেন আর টিনটিনকে ছেড়ে দিয়ে চলে এল। ‘তিব্বতে টিনটিন’— শেষের পাতা। চ্যাংকে নিয়ে ফেরার পথে টিনটিন, ক্যাপ্টেন আর কুট্টুস। সোনাইয়ের চোখে জল টলটল— ‘এ কী রে কাঁদছিস কেন’— মেয়ে ছুটে পাশের ঘরে চলে যায়। আবার ফেরে— ‘বাবা, ইয়েতিটা কী করবে এবার? ও যে একা হয়ে গেল!’

ইনস্পেকটর সাহেব অনিন্দ্য বসুরায়, এখন বড়ো একা, তার চোখের সামনে একের পর এক বিভীষিকা। হাতের ফাইলটা খুলে সে ফর্মটা একবার দেখে। সামনের পাতায় সোনাইয়ের পাসপোর্ট ছবিখানা বড়ো করুণ ঠেকে। অস্ফুটে তার মুখ থেকে বেরিয়ে গেল— ‘লা ভিতা নুওভা’— সে নিজেকে এখন দান্তে আলিগিয়েরির সঙ্গে তুলনা করল। আপাতত ইনফার্নোর সামনে। একজন ভার্জিলের বড়ো দরকার ছিল এ-মুহূর্তে। পথ প্রদর্শক! পাশের দোকান থেকে একটা ছোটো ফিল্টার উইলস নিয়ে ধরায় সে, হঠাৎই চমক— ‘স্যার কী ভাবছেন এত? মেয়েকে এখানে ভর্তি করবেন নাকি?’

কেরোসিনের এজেন্ট অমিত চক্রবর্তীর ছেলে বাপি।— ‘চলুন স্যার অফিসে দিয়ে আসি।’

— ‘আপনি এখানে?’

— ‘একটু ব্যাঙ্কের কাজে এসেছিলুম আর কী। আমার মেয়েও এখানেই পড়ে স্যার! এখন ক্লাস ফোর, নিশ্চিন্তে ভর্তি করে দিন— খুব ভালো জায়গা। খরচাপাতিও কম। আর কিছু না হোক মেয়ে অন্তত ইংরেজিটা ফড়ফড় করে বলতে শিখবে। ব্যস আর কী চাই?’

— ‘কীরকম খরচাপাতি?’

— ‘বছর দুই আগে একজনকে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলুম, তখন ঐ অ্যাডমিশন চার্জ, টার্মিনাল ফীজ, টিউশন ফিজ, অ্যানুয়াল চার্জ, বইখাতা এসব নিয়ে হাজার বাহান্ন পড়েছিল, এখন আর কত হবে ষাট-পঁয়ষট্টি হবে বড়োজোর! ওসব নিয়ে টেনশন নেবেন না স্যার—ডিসকাউন্ট করিয়ে দোব।’

— ‘না মানে, কি জানেন তার আগে অ্যাডমিশন টেস্ট, ইন্টারভিউ এসব আছে তো, তাতে পাশ করা চাই।’

বাপি হো হো করে হাসতে শুরু করে— ‘স্যার টেনশন লেনে কা নেহি দেনে কা! আপনি আমাদের সাহেব— আর এই স্কুলের সামনে এসে আপনি টেনশন নেবেন, আর আমাকে দেখতে হবে! ম্যায় হুঁ না! ওসব টেনশন পাবলিকের জন্য। ছাড়ুন স্যার! আগে বলুন কী খাবেন লস্যি না স্প্রাইট!’

স্কুলের গেটের মধ্যে দিয়ে একঝলক তাকাল অনিন্দ্য! আলাদা করে একটা টেন্ট খাঁটানো হয়েছে, সামনে বড়ো করে সাইনবোর্ড টাঙানো আছে ‘অ্যাডমিশন কাউন্টার’।

অনিন্দ্য ধীরপায়ে গিলোটিনের দিকে এগিয়ে গেল।

Facebook Comments

পছন্দের বই