লেখক নয় , লেখাই মূলধন

অনিকেশ দাশগুপ্ত’র কবিতা

রাতের ভোজবাজি

তারা পরস্পর এভাবে মুখোমুখি বসে থাকবে যেকোনো
অতিমাত্রিক তঞ্চন সরিয়ে উঠে আসা রাতের রেস্তোরাঁয়।
ত্রিপলের নীচে সারি সারি মানুষ ওদের পরিত্রাতা ভেবেছিল
পাথরের লিপিগুলি এক মহাজাগতিক সুতোয় পড়িয়ে
কাঁধে অসংখ্য শিশু নিয়ে ফিরেছিল ওই কারখানার প্রশস্ত
ধার বরাবর, গীর্জার প্রশান্তি ছড়িয়ে এক সাংকেতিক আলোয়
জনে জনে অনন্ত প্রদীপ জ্বালিয়ে সেই যে হাঁটুজলে নেমে দাঁড়াল
নাগরিকরা সেসব সমবেত স্তোত্র মনে রেখেছে …
সন্ধ্যার প্রারম্ভিক আলো, আলতা মাখা পায়ে নৌকোর দিকে ছুটেছে
একাধিক জিজীবিষু কী আড়ষ্ট শরীরে জল ডিঙোয়
আর অংশত এই খেলাগুলি দেয়ালে প্রথম শুদ্ধ দেবতা
অথবা তাঁর ঘনিষ্ঠ লাল ফুল রেস্তোরাঁর সতর্ক মাংসাহারে অতিবিস্তৃত হয়।
আকাশে আকাশে নির্বোধ কুকুরগুলিকে মধ্যরাতের মুখ থেকে
উগরে তোলে সেসব ভয়ার্ত পরিচিতি…

বিষফুল

এখন প্রত্যেক উপত্যকার সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে রাখি…
পাহাড়ী মুক্তিফলগুলির মাথা কেটে কী দীর্ঘ পবিত্র মালা গাঁথা হয়েছে
পায়ে আবশ্যক সমতল মৃত্যুর দুরন্ত বাঁক থেকে মুখ ফেরাতে বলে
আর ত্বকের অন্যান্য স্তরে ঢাকা থাকে সহস্র শৌখিন ক্রুশ।
এই ঊষর প্রান্তে মায়াময় প্রতিধ্বনি, খসে পড়া আপেলফুল
শেষবার চোখ রেখেছে মাংসের সারাৎসার জুড়ে…
এবং সারিবদ্ধ সাদাকালো ছকের ভেতর দিয়ে ছুটে গেছে
একের পর এক লাগামহীন ভেড়া কিংবা তাদের মাংসল অহঙ্কার,
দরজার এপারে সেসব বড়ো স্বাভাবিক প্রয়াস
মন্থর ট্রাকের চাকায় জড়িয়ে যাওয়া জমাট আপেলের চর্বি
আর খুব আলগোছে নামিয়ে রাখা দুই পা, প্রারম্ভিক সকালের মতো
তাজা নিমন্ত্রণে এঁটো ও ভারী হয়ে থাকে …

শীতল খেলা

প্রশস্ত পাঁজরগুলি বয়ে বেড়াবার মতো সাদাকালো খোপে
প্রারম্ভিক ভাঙা ভাঙা অক্ষরগুলি বসিয়ে রেখেছিল সে
আর একের পর এক এভাবেই তার আত্মহননসমূহ অনাবিল
এবং নিভৃত প্রার্থনার আকার পেল…
ঘরময় ফিকে চৌকাঠ আর দেয়ালের আদিম চিত্রকল্পে
সে দেখে দানবের মৃত্যুক্ষয়, মাংসের দার্শনিক ঔজ্জ্বল্য
আর গির্জার সম্মুখে, বিস্তর আলোছায়া
সেসব ভঙ্গিমাকে
কীভাবে চিরায়ত করে…
প্রশস্ত পাঁজরের ফাঁক দিয়ে ধ্রুপদ আলোর অস্বাভাবিক
মাত্রাহীনতার মতো সেসব তীব্র খোপ…

অধিষ্ঠান

বালির ভেতর সেঁধিয়ে আছে শীতরক্তের ছানা
যজ্ঞাগ্নি থেকে উড়ে আসা ঝুরো লিপির মুখ যেন
নিথর মাথা ফেটে নামে দেবতার লাল শিখর
অপাপবিদ্ধ তুলে রাখি ব্রক্ষ্মকণা…
আজ মূর্ছা যায় তার অবাধ ঘাই
সূর্যের সহস্রতম শক্তিচক্র, নিঃশ্বাসে ধ’রে ওই ভিখারিণী
অসম্ভব বীজ বিলোয় কাঁটাবনে,
আঙুলে ঝরে আইনানুগ পরাগ… হায়!
আমি আর দেবী আছড়ে পড়ি কিশোরীবিলে…পদ্মকোণে…
শস্য পোড়ে, চর্বি-তেল ছাইমাখা মহাদেব
পূজিত হন
শবগন্ধে আবাহন
ব্রত ফলে যায়, কুঁড়িশূন্য ছায়ালেখ—
যা ছিল নরম কলস, মাটির কোষে, বীজশুক্রে
আরেকের ভেতর লীন হয় ধাতু, সঞ্চয়, ষড়চক্রে…

বাড়ি ফেরা

দেখতে পেলেই একটা আঁটোসাঁটো বাড়ি
শেষ রাতে হারিয়ে ফেলি পায়ের থই
কালের নামতায় কাকে খুঁজি
সিঁদুরপোকাগুলি হানা দেয় নিঃশ্বাসে ঝাঁকে ঝাঁকে
ঠিক নীচু হলে ভাসিয়ে দেয় নামহীন উলটোস্রাব
আঁকশি দিয়ে কোন বিকেল থেকে টানি বেড়ালের তোবড়ানো নখ
সারিবদ্ধ খুপরি ঘর
অন্ত্যজ হতে লোভ হয় কোন একান্ত টিলার
ছিদ্রের ভেতর দিনপঞ্জিগুলি তুলে তুলে রাখি…

সহসা হামা দিলে খুলে যায় রাস্তা
আগুনের নিয়ন্ত্রণ আর লাফ মেরে তারসমুদ্র থেকে উঠে আসে
বাড়ি ফেরার মরুমুদ্রা…

Facebook Comments

পছন্দের বই