লেখক নয় , লেখাই মূলধন

অর্ঘ্যকমল পাত্রের কবিতা

বান্ধবীবৃত্তান্ত


“you are so unpredictable… ”— বলেছিল মেয়েটি। যে মেয়েটির গান আমার মনে ধরেছিল। অথচ, আমি জানি কৃপা বসুকে যে বড়ো লেখিকা মনে করে, আমাকে প্রেডিক্ট করা তার কম্ম নয়! কিন্তু সে বিভাজনরেখা বরাবর সরু কোমরের নিয়োগ আমাকে ভাল্লুকছানার গল্প বলে।
এখন একবাগান আমের ভিতর বসে পেয়ারা খেতে খেতে সত্যিই আমার বিষণ্ণ লাগে


“well said”— বলে চলে যাওয়ার সময় যে মেয়েটি একবারও পেছন ঘোরেনি (!) সে আর কীভাবে বুঝবে, আমারও একটা পূর্বদিক আছে। যেখানে আমি ছোটো ছোটো খরগোশ পুষেছি…


“Disgusting…” শব্দের সাথে সাথেই যে আমার কবিতা ছুঁড়ে ফেলেছিল; সে জানে না আজীবন বান্ধবীদের কাছে ঢ্যামনা হয়ে থাকাও কম কৃতিত্বের নয়!

শুধু তার নামে যে ফিঙেটাকে তখন চিহ্নিত করেছিলাম, তাকে এখন আর কিছুতেই অনেকের ভিড়ে আলাদা করতে পারি না…


“Please..” বলতে বলতে ক্রমাগত ঢলে পড়ত যে ছুঁড়ি, তাকে আমি উপহার দিই রণজিৎ দাশের বই। শুনতে শিখিয়েছি কবীর সুমনের গান

লোডশেডিং উঠে গেছে এসব তো কম দিন হল না! কেমন করে তাকে বোঝাই— ওই লোডশেডিং পর্যন্তই ওর শিকড়


“May be…”— বলে কথায় কথায় কথা শেষ না করার কথকতা অভ্যাস করে ফেলেছে মেয়েটি। তার ভিতর ঢুকে আমি এই গুচ্ছকবিতা পেলাম। এবং হঠাৎ নিজেকে আবিষ্কার করলাম— অরণ্য যেখানে ঘন…

এখন এই যে ও জিজ্ঞেস করল— “একা ফিরতে পারবে?” আমার কী ওকে দিদি বলা উচিত?

লকডাউন উঠবে আদৌ?


আমি ঠিক আমার মতোই থেকে গেলাম। মিছিলের পাশে রাখা পাশবালিশ দেখতে দেখতে ঝিমিয়ে এলো কান।ওহ্ শব্দ! ওই শব্দে হয়তো কিছু একটা ছিল। হয়তো স্বপ্ন… খানিকটা পেয়ারাপ্রবণ। এবং স্বপ্নের কথা হতেই আমার চোখ জুড়িয়ে আসে ঘুমে…


ঠিক এভাবেই এগিয়ে যাবো। হয়তো এভাবেই এগোনো উচিত। কিংবা আমি দেশলাই জ্বালাতে অক্ষম। নিভন্ত মানুষ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি ট্রামস্টপেজের সামনে। লকডাউন উঠবে কিনা সেসব না ভেবেই আমি হাসছি… লিখছি… বই পড়ছি রণজিৎ দাশের। যদিও এছাড়া অন্যকিছু আমি করতামও না আগে


একটা তিনলাইনের কবিতার মতো আমার নিজস্ব ভার আমি অন্যকাউকে বইতে দিতে পারি না! আপেলরঙা মেয়েটির মতো পারি না অন্যের ঝালমুড়ি ঠোঙা থেকে খানিকটা বিষণ্ণতা মুখে পুড়তে! সুতরাং একটা চারাগাছ পুঁতে এই ক’দিনের মধ্যেই নিজেকে ভাঁজ করে ঢুকিয়ে ফেলতে হবে ট্রাঙ্কের ভিতরে


যা কিছু আমি দিনরাত চিবোই সমস্তটাই হজম হয় না ঠিকই। অতএব বেশি খাওয়াদাওয়া করার ইচ্ছে আমাকে ছাড়তে হবে শীঘ্রই। এরচেয়ে গান শোনা ভালো।কিংবা তুমি পায়চারি করতে পারো ছাদে। তাহলেই বুঝবে—পাখিদের পাখনা নেই… পালক আছে। দেওয়ালেরও কোনো শব্দ নেই… কেবল নিঃসঙ্গ একটা একটানা নির্বাণ আছে…


যখনই খুচরো পয়সা পাই— মনে হয় ঝিমিয়ে পড়ার মতো স্বাভাবিক আর কোনোকিছুই নয়। রাত্রি নামার আগে গুনে নিই কতগুলো তারা আজ ঝিমোচ্ছে… কতগুলো সন্ধ্যে এভাবেই বান্ধবীহীন কেটেছে…

অতঃপর একবাজার লোকের ভিতর দাঁড়িয়ে আমি নিজের স্বর শুনতে পাই না!

স্ট্রিং


আমাকে লিখতেই হত এইসব। কীভাবে ঝিঙেফুল দেখে আমার যৌনচেতনা জন্মেছিল। কীভাবে অর্ঘ্যকমল পাত্র ডানা ছিঁড়ে হয়ে উঠেছিল অর্ঘ্য। তাকিয়ে দেখি— বিরাট একটা সন্ধ্যে হেলে আছে খামারের দিকে। ববিরাট একটা জানালা আজ ইঁদুরের মতো লুকিয়ে আছে। ঝুঁকিয়ে আছে শোক। এই যে আমি এখন একটা ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছি, আমি কী এখন রকমিউজিক শুনতে পারি না? অথবা একটা ফোন-ও তো করা যায় অনঙ্গদীপদাকে… আলোচনা করা যায় কবিতা নিয়ে


তারপর এই মেঘলা দিনে নিজের অস্তিত্ব আরো টের পেয়েছি ইঞ্চিখানেক। “You are not a unique person”— এ কথা ছোটোবেলায় যে মেয়েটির কাছ থেকে শুনেছিলাম, তাকে আজ অবধি হাসি ছাড়া আর কোনোকিছুই ফিরিয়ে দিইনি। এতদিন ছন্দ শিখিনি বলে আজ আর মনখারাপ হয় না! কবি অনিন্দ্য রায়ের কাছে শিখেছি পয়ার আর সরলদোলগতি পরস্পর অভিন্ন জিনিস। ওরই মিন পজিশনে জমা রেখে দিই আমার নিজস্ব সম্ভ্রম। বাকি সমস্ত প্রশ্নেই এখন মনে হয়— সময় নষ্ট….


সত্যি কী আর তেমন কঠিন কাজ? কেবল একটা হাসি নিয়ে চুপচাপ বসে থাকা। দিব্যি কথাবার্তা চালানো বউঠানের সঙ্গে। আমি জানি, জ্যোৎস্না এলে কারোর ফিজিক্স পড়তে ভালো লাগে না। আমি জানি, ঢেউ বারান্দায় উঠে এলে রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনা মোটেও কাজের কথা নয়। আমি জানি, বিপর্যস্ত কিছু শব্দ লিখে, আমি কোনোদিনই কোনো সুস্থ কবিও হতে পারব না। তাই নিস্তব্ধতায় আমি শেষ করে দিই আমার আলফাল লেখা। আমি জানি, আমি অংশুমান কর নয়, যে শেষ লাইনে চমকে দেব তোমায়…


কোথাও কিছু নেই। ছাদ থেকে বসে দেখছি পাশের লিচুগাছটাকে। একটা পাতা ধীরে ধীরে দুলতে দুলতে ভাসছে… মাটিতে পড়ার আগে ঝেড়ে নিচ্ছে শারীরিক জং… এবং আমার মনে হচ্ছে জীবনানন্দ কোনোদিন-ই পুরনো হতে পারে না!

Facebook Comments

পছন্দের বই