লেখক নয় , লেখাই মূলধন

কল্যাণ সরকারের গুচ্ছকবিতা

শুধু এই কাঁটা এবং

এখনও বৃষ্টির মতো শব্দপতন
এখনও পদ্মকাঁটা কলারবোনে জেগে ওঠে।
অন্ধকারে জোনাকির আঁকিবুঁকি রেখা
সুনীল ভাস্কর্য আঁকে আকাশের প্লেটে।
কোথাও হড়পা বানে ভেসে যায় পাহাড়ের কুটো।
সময় কি কর্মনাশা নদীতে নেমেছে?
জপযন্ত্রে জেগে ওঠে, তুমি কোথায় এ’সময়?
আকাশে এত মেঘ কেন?
চমকে ওঠা বিজুরীতে যদি মশাল ধরানো যেত।
কী লাভ!
কারু কি সময় আছে,
বেতসের বনে জেগে ওঠা তীক্ষ্ণধার
—এটুকু দেখার?

যেখানে যা কিছু ছিল সেখানেই থাক।
যেটুকু যেতে চায় যেতে দেব—
শুধু যদি বলে দাও—
কান পেতে আছি।
কানামাছি ভালোবাসি।

এক্সোডাস

অনেকদিন অপেক্ষায় আছি মোজেস,
হাতে-পায়ে গোল দাগ গয়না পরে আছি।
অনাহার শয়তানের মতো পিছু ফেরে।
আকাশে শকুন
মাটিতে শেয়াল হৃদয়পিণ্ড খুঁজে ফেরে।

অস্ত্রের গায়ে শান শুধু নয়
পাঁজরে খেজুরকাঁটা খোঁজে কি লালকথা?
মোজেস তোমার কানে বসন্তবৌরী কী পাঠায়,
গান না কান্না?
খেজুরগাছ অনেকদিন বৃষ্টি দেখেনি,
অনেক অনেকদিন সবুজ।

মাঝে মাঝে স্বপ্নে দেখি প্যালেস্টাইন।
নদী, সোনাক্ষেত, ইস্কুলছুটি, সূর্য বাড়ি ফেরে,
মন্দিরে ঘন্টা বাজে, চেনামুখ নতজানু।

মোজেস, সারাদিন পর যখন
জেলখানা চোখ বোজে
তখন কেন টেলিপ্রিন্টারে বাজে
—এক্সোডাস এক্সোডাস এক্সোডাস?!

এখানে নয় তবে কোথাও

এত মেলি দৃষ্টিফরাস
উড়ে উড়ে প্রজাপতি আলপনা আঁকি
গুণ্ঠনে ঢাকো কেন মুখ হিরন্ময়?

চিন্ময় জগতের ঠিকানা পোষা পোশাকের সাথে
ভাঁটিতে চেপেছে তার উদ্দেশ্য জানি না।
ভেঙে দেখি, ভেঙে দেখি শঙ্খপেলব নেই,
পাতালে কোথাও স্যমন্তকমণি নেই।
আগে, তারও আগে পৃথিবী নামক গ্রামে
ছায়াপথে কম্পমান আলোর পাড়ায়
মিছে হেঁটে হেঁটে হেঁটে
সৃষ্টি মাড়িয়ে সৃষ্টিছাড়ার মতন।

তবু তুমি ঠিক আছ জানি
সবরিকলার গায়ে আলোর পাউডার।

গান হব

আমি গান লিখব, রোদ্দুর তুমি সুর দিও।
আমি গান বাঁধব, পাথর খসানো সম্প্রপাত
তুমি গাইতে শিখিয়ো।
শিখব কেমন করে সমুদ্রে যেতে হয়, সমুদ্র হতে হয়।

আমি পাঠশালা যাব, অক্ষর চিনব
কথা আর সুরের ডানা জুড়ে নেব শরীরে।
আমি গান হব, বাণ হব জেনো,
ভাঙব মানুষপুতুল ভাঙব,
তাকে অন্য আমির কাছে পৌঁছে দেব।
আমি ডাঙ্গায় বাঁশজল হব, রাস্তা ভাসাব রাস্তা খুঁজে নেব।

আমি গান শিখব, শেখাব আকাশের লাইটহাউসকে।
সে তার মারণআলো পৌঁছে দেবে মেরুদেশে—
দেবে সবুজমন্ত্র, বলিষ্ঠবিশ্বাস।

আমি গান পোষা সাপিনীর মতো ছেড়ে দেব
তারা খুঁজবে ডাঙায় আকাশে জলে লোহার বাসরঘর,
চিহ্নিতদের টেনে নামাবে গাঙ্গুরের জলে।

আমি গান শোনাব প্রচণ্ডকে সে অন্ধকার গিলে গিলে খাবে।
আমি গানে শান দেব লাঙল
দারুণ আঘাতে ভাঙবে নির্লজ্জ খিদে

আমি গান রেখে যাব সাগরের ধারে
তার দক্ষিণ হাওয়া খুঁজে নেবে ফাল্গুনদেশ।
আমি গান শিখব গানের কাছে সে দেবে নীলকণ্ঠপাখির খোঁজ
দেবে কুয়াশা পিছলে যাওয়া ঘাসফুল ভোর।
আমি গানের গাছে ফোটাব ইন্দ্রধনু ফুল
ফুলকে বাধ্য করব ফল দিতে মানুষের হাতে।

জীবনের পিছে আজীবন

বাজপাখি ঘুরে এসে বলেছে
সন্ধিনী হিমালয়ে কোত্থাও নেই।
ভিন্ন প্রত্যঙ্গের রাশ কদ্দিন চৌকি মিছিমিছি?
গাঙ্গুর কোথায় পা,
বেহুলারে তুই যদি একবার বৈজয়ন্তে, বেহুলা আমার!
সব পেয়েছির দেশ জানো ভূগোলে কোথায়?
সোনাবালুবেলায় কেন জেড্‌পাথরের মন্দির নেই?
তেপান্তর ধূ ধূ, স্বর্ণকেশিনী নেই।
অনেক আকাশ এখানে কোথায় ঝিকিয়ে?
—ডানা ছাঁটা পক্ষীরাজ, কাঁধে নির্লজ্জ লাঙল।
আমি রাজার ভিখিরি ছেলে ডাগর নজর।
পেঁপে ডাল তরোয়াল কি জানি কোথায় খসে গেছে!

শল্কপত্রে শুধু লেখা, ‘কুঁচবরণ কন্যা, মেঘবরণ চুল।’
আমি রামধনুফুল মেঘলা খোঁপায় গুঁজি
ধূমলবৃষ্টি কেড়ে নেবে শ্রাবণের, কে তুমি?

Facebook Comments

পছন্দের বই