লেখক নয় , লেখাই মূলধন

টমাস ট্রান্সট্রোমারের কবিতা/ ভাষান্তর: রমিত দে

স্মৃতিরা আমায় দেখছে

জুনের সেই সকালটা
যখন এতটা দেরিও হয়নি ঘুম থেকে ওঠার
আবার ঘুমোতে যাওয়ার তাড়া নেই।

ঠিক এ সময়টাতেই কাল নির্জনতা পেরিয়ে আমার যাওয়া উচিত
সবুজের মধ্যে,
ধীর , নির্লিপ্ত…..সেই সবুজ, যারা স্মৃতিতে ঠাসা।
যারা আমার পিছু নিয়েছে
অথচ ওদের দেখা যাচ্ছে না পুরোপুরি
যেন সেই গিরগিটি,রঙের প্রপাত ধারায়
জেগে আছে রঙহীন…

ওরা এখন আমার এতটা কাছে যে ওদের শ্বাসের শব্দ শুনতে পাই
অথচ পাখির ডাক,
সামান্য পাখি ছাড়া আর কিছু নয়…

দম্পতি

তারা আলো নিভিয়ে দিল;
দপ করে জ্বলে উঠে আলোটা নিভেও গেল
ঠিক যেন একটা ট্যাবলেট
গলে গেল এক গ্লাস অন্ধকারে।

আর পুরো হোটেলটা, ওর দেওয়ালগুলো
আলোর মর্ম ছেড়ে ছুটে গেল
ছায়া থেকে দূরে।
সাদা পালক ভিজিয়ে নিল স্বর্গীয় আঁধারে।
আর ওদের হাঁটাচলা ধীর হয়ে এল,
কথাবার্তা ধীর হয়ে এল,
ওরা শুয়ে পড়ল।

ঠিক তখনই ওদের গোপন ভাবনাগুলো ঘুম থেকে উঠে
মুখোমুখি বসল…
নড়ল না, চড়ল না, শুধু মিশে গেল
যেমন সেই বাচ্চা ছেলেটার রংগুলো
মিশে যায় ভিজে কাগজে
দৌড়ে যায় দুটো রং দুটো রঙের দিকে।

এটা অন্ধকার আর নিশ্চুপ।
যদিও শহর আজ রাতে কিছুটা কাছে চলে এসেছে।
বাড়িগুলোও এসেছে,
নিজেদের জানলাগুলো সপাটে বন্ধ করে। আরও কাছে।
তারা পরস্পরের এত কাছে, প্রায় গা ঘেঁষাঘেঁষি করে অপেক্ষা করছে
আর সে দিকেই তাকিয়ে আছে একদল মানুষ
শূন্য মুখ
আশ্চর্য শূন্য মুখ যাদের…

শ্বাসের সফর জুলাই

গোটা একটা গাছকে খুঁজতে বেরিয়ে
গাছের নিচে শুয়ে লোকটা।
ঘুরে বেড়াচ্ছে পাতা আর ডগাগুলোয়
তার জরুরি অবতরনের জন্য
ধীরে ধীরে সে নেমে পড়ছে কল্পঅসীম ওই প্রসারতায়।

লোকটা আবার জেটির কাছে আসতেই
জলের দিকে চেয়ে আছে।
যেখানে পথ হারিয়ে ফেলেছে মানুষ
আর জেটিগুলো মানুষের চেয়ে তাড়াতাড়ি বুড়ো হয়ে গেছে
ওদের কাঠগুলো ধূসর রূপোলি,
ওদের পেটে পাথর
অন্ধ আলো সরাসরি বুকে ধাক্কা মারছে ওদের।

লোকটা সারাদিন ছোটো নৌকোয় ঘুরেছে
নির্জণ খাঁড়ির এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে
গল্প বের করেছে

আর এখন সে ঘুমোবে
একটা নীল আলোর ভেতর।

সত্যিই এখন সে ঘুমোবে।
যখন এই খাঁড়ি
হামাগুড়ি দেবে বিরাট মথের মত
কাঁচের ওপরে…

স্টেশন

গড়িয়ে গড়িয়ে একটা ট্রেন এসে থামল।
থামল একটার পর একটা বগি,
কিন্তু কোনো দরজা খুলল না।
কেউ উঠল না,
নামলোও না।
তবে কি কোনো দরজাই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা?
ভেতরে
গাদাগাদি ভীড়।
তাদের স্থির চোখ স্থির জানলার দিকে স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
বাইরে একজন মানুষ
ভারী হাতুড়ি নিয়ে ট্রেন বরাবর হেঁটে আসছে।
সে প্রথমে চাকাতে আঘাত করল
মৃদু একটা কম্পন। রিনরিনে ঠান্ডা।
কিন্তু এখানে, ঠিক এখানে সে শব্দ অকল্পনীয় গভীর।
যেন শ্লথ নিস্তব্ধতাকে নির্বিষ করে বিদ্যুৎ খেলে গেল
যেন চার্চের ঘন্টা কেউ দুলিয়ে দিল চাবিহীন আকাশের দিকে।
গোটা পৃথিবী ঘুরে আসা একটা শব্দ
সেই এখন থেমে যাওয়া ট্রেনটাকে টেনে নিয়ে যাবে
তুলে নিয়ে যাবে প্রতিবেশীর ছেড়ে যাওয়া ভিজে পাথর

মনে রেখো
সব কিছু গাইছে
বিশ্বমাদলের বিস্ময় ছন্দে
সব কিছু
আর এটাও মনে রেখে
এবার চলা যাক!

নীল বাড়িটা

সেটা ছিল রাতের অন্ধকার। ঠিক রাতও নয়, আলস্যের ভেতর দিয়ে আধো খোলা চোখ নিয়ে অল্প জেগে আছে আলো। গভীর জঙ্গলে দাঁড়িয়ে আছি আমি। আমার বাড়ি আর তার ধুসর নীল দেওয়ালগুলোর দিকে চেয়ে। যেন এ মুহূর্তে আমি মরে গেছি আর বাড়িটাকে একেবারে নতুন দেখায় দেখছি।

আশিটার বেশি গ্রীষ্ম বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে বাড়িটা। চার গুন আনন্দ আর তিন গুন দুঃখ নিয়ে সম্পৃক্ত হয়ে আছে। এ বাড়ির কেউ মরে গেলে বাড়িটাকে নতুন করে রং করানো হত। এটাই নিয়ম। মৃত মানুষটা নিজেই রং করত, তুলি ছাড়া, ভেতর থেকে।

বাড়ির বাইরে একটা ফাঁকা জায়গা। কখনও সেখানে বাগান ছিল, এখন নেই। এখন সেটা আগাছার রাজত্ব। কি নেই! ভাঙা বাসনকোসন, ভাঙা প্যাগোডা, ভাঙা শব্দ, ভাঙা আলো, ভাঙা বাগান আর গোটা একটা আগাছা, সবকিছু খেয়ে বসে আছে সে।

মাঝখানে বিরতির মতো জেগে থাকা আগাছার ওপর একটা বুমেরাং-এর ছায়া আসছে, যাচ্ছে। ঢলাঢলি করছে। অকস্মাৎ শূন্যের পথে তার এই আসা যাওয়া আসলে একজন মানুষের উদ্দেশ্যে। সে আমার সময়ের অনেক আগে এ বাড়িতেই ছিল। প্রায় একটা শিশু। কিছুটা দৌড়ে গিয়ে আবার ফিরে আসছে বহুযুগ আগে তার ছেড়ে যাওয়া চৈতন্য। শুকনো পাতার মত বলছে-…” তৈরী করো…আঁকো….”। এ প্রস্তুতি তার পৌঁছোনোর প্রস্তুতি, ভাঙাচোরা মাঠ পেরিয়ে ভাগ্যের কাছে।

বাড়িটা ঠিক যেন বাচ্চাদের আঁকা ছবির মতো। এখনো একটা ছেলেমানুষী মেখে আছে; আসলে কেউ যেন তার পুরোপুরি শিশু হওয়ার প্রকল্পনা মাঝ পথে ছেড়ে হারিয়ে গেছে কখন। দরজা খুলে বেরিয়ে গেছে। আর সেই দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলাম আমি! ছাদ জুড়ে অস্থিরতা। দেওয়াল ভর্তি শান্তি। বিছানার মাথার কাছ টায় একটা জাহাজের ছবি , সতেরোখানা পালওয়ালা, লম্বা লম্বা ঢেউ, ঢেউয়ের চূড়া, আর একটা ঝোড়ো হাওয়া, যা কোনোদিনই ওই ছবির কাচ ধরে রাখতে পারেনি।

জানিনা কেন, প্রতিদিনকার চেনা গলি কিংবা কোনো অস্থির চারমাথার মোড়ে আসার একটু আগেই আমি এখানে এসে পৌঁছাই। এ জীবনকে ধন্যবাদ জানাই! অন্বেষণ করি বিকল্পের। সেই রেখা, সেই হারিয়ে যাওয়া রেখা, জীবন খুঁজতে গিয়ে হারিয়ে যাওয়া সেই জলরং, খুঁজি অনেকদিনের ডাক অনেকদিনের রং, ভাবি এই না হওয়ার দেশে কোথাও তো আছে সে প্রত্যক্ষ, আছে দেখা, দেখার মতো হয়ে!

একটা জাহাজ, ভেসে আসে নিরাসক্ত। ওর ভেঁপুর তীক্ষ্ণ আওয়াজে রৌদ্রভূমিকে নিরুদ্দেশের দিকে বাড়িয়ে দেয় আরও কিছুটা। আর দুঃখ আর আনন্দ- দুজনেই শিশিরে ভিজে ফুলে ওঠে। সত্যিই কিছু জানিনা আমরা, আর কিছু না জেনেই যাত্রা শুরু করি। যেমন জানিনা আমাদের জীবনে একটা করে জাহাজ আছে, অলক্ষ্যে জাগ্রত, সে সমান্তরালে ভাসছে, পুর্নযাত্রাকে ঈশ্বরের মত অস্পষ্ট করে… যখন সূর্য আরও লাল আরও স্পষ্ট করে তুলছে পেছনের তটভূমিকে।

কোকিল

কোকিলটা ডেকেই চলেছে একনাগাড়ে,উত্তরের বার্চ গাছে।এত তীক্ষ্ণ সে ডাক, প্রথমে শুনলে মনে হবে কোনো অপেরা শিল্পী কোকিলের নকল করছেন। কোকিলটার দিকে কিছু সময় অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলুম। প্রতিবারই ডাকের সাথে সাথে ওর লেজের পালকগুলো ঠিক যেন কলের হাতলের মত উঠছে নামছে। তারপর দুপায়ে লাফিয়ে উঠল পাখিটা, চিৎকার ছড়িয়ে দিল চিনতে না পেরে আর উড়বে উড়বে করল, এবং কি যেন বিড়বিড় করতে করতে কাউকে না বলে উড়ে গেল পশ্চিমে…গ্রীষ্মের এবার বয়স বাড়ছে আর শূণ্যতা গ্রাস করছে সবকিছুকে। কুকিউলাস ক্যানোরাস এবার ফিরে যাবে ক্রান্তীয় প্রদেশে, সুইডেনে ওর দিন শেষ, ওর ডাক পড়েছে, জানলা আবার খুলছে, ও তো জাইরের, সেখানেই তার শেকড়সম্পৃক্ত যাত্রা। তবে ভ্রমণের কথা আসতেই মনে হল আমি এতটা সাবলীল নই এসব ভ্রমণ-ট্রমনে, বরং যেকোনো ভ্রমণ নিজেই নিজেকে মেলে ধরে আমার সামনে, নিরুদ্দেশ অন্বেষণ করে আমাকে। এখন, যখন আমি আরও আরও কোনঠাসা হয়ে পড়ছি, চোখে উঠেছে গোল কাচের চশমা আর বিস্ময়ের সিঁড়ি ভেঙ্গে ক্রমশ বিজনতার দিকে বড়ো হচ্ছি তখনও কিছু না কিছু ঘটবে, এটা স্বাভাবিক। এর মধ্যে অবাক হওয়ার কিছু নেই। অচিন্তনীয় কিছু একটা, যা আমাদের নির্বাচনকে ডাক দেবে নিয়মের ব্যতিক্রমে। এই ভাবনাটাই আমাকে বয়ে নিয়ে চলেছে, ঠিক যেমন আফ্রিকার মধ্যে দিয়ে সুসি আর চুমা মমি করে নিয়ে চলে এল লিভিংস্টোনের মৃতদেহটাকে…

Facebook Comments

পছন্দের বই