লেখক নয় , লেখাই মূলধন

তন্ময় মণ্ডলের কবিতা

সমুদ্রের গল্প

দিদির দেওয়া লাল মলাটের বইটা তখনও সঙ্গে। আমরা তিনজন মেরিন ড্রাইভে বসে আরব সাগরের বিকেল মাপছি।

বোম্বের দুপুরে নিজেকে বেশ করে সেঁকে নিয়েছি গত দু’দিন। শুকিয়ে নিয়েছি খানিকটা ব্যর্থতা, অনুশোচনা…

কল্যাণীদির হাসি, নবনীতাদির স্নেহ আর অর্ঘ্যদাদের অসমবয়সী বন্ধুতা যখন বোম্বের আলো চেনাচ্ছিল আমাদের, আমার ভেতর একটা রাঙতা মোড়া লাল রং বহুদিন পর সমুদ্র ছুঁতে গিয়েও থমকে গেল।

সূর্যের লাল, আমার ভেতরকার লাল আর লাল মলাটের বইটা কীভাবে গোটা মুম্বাইকে আমার সামনে সিঁদুর কৌটো বানিয়ে তুলছে।

সেই লাল আলোর বেষ্ঠনী আমার মগজ থেকে হৃদয়ের তন্ত্রীতে কিছু ঝলসানো স্মৃতি পাঠাচ্ছে তীব্রবেগে…

আমি দেখতে পাচ্ছি এক ধূসর গোধূলিতে জামাইবাবুর পা দিয়ে মুছিয়ে দেওয়া হচ্ছে দিদির সিঁথি।

দীঘায় বেড়াতে গিয়ে যেদিন জামাইবাবু হারিয়ে গেল মহাশূন্যে,
তারপর থেকে আমার দিদি আর কখনও সমুদ্র দেখেনি।

***

বিপন্ন সময়ের শব্দ

এক নিশ্ছিদ্র অসুখে ডুবে আছে আমাদের মহাবিশ্ব।
দরজা নেই, জানলা নেই, একটা ছোটো ঘুলঘুলিও চোখে পড়ছে না, এত গাঢ় এ অসুখ!

এই অসুখের দিনেও যারা ত্রাণের বস্তায় পার্টির সিম্বল কিংবা নেতানেত্রীর মুখ এঁকে দেয়,
আমার থুতু ফেলার বেসিনের সাথে তাদের ফারাক করতে, অ্যাশট্রেতে আরও খানিকটা ছাই জমাতে হয়।

আমি কি রেগে যাব?
নাকি চিৎকার করে গিলে ফেলব নিজের শরীরটাকেই?

আমি যে চোখ বন্ধ করতে পারছি না।
চোখ বুজলেই দেখতে পাচ্ছি ক্ষুধার্ত মায়ের পেটের ভেতর বাড়তে গিয়েও থমকে যাচ্ছে অসহায় শিশুর হাত!

আমার কি লিখতে বসা উচিত এখন?
কী লিখব, কিই বা লেখা সম্ভব!

অবশ্য এর মধ্যেই বিজ্ঞ কবিরা কেউ কেউ ফেসবুকে একে অপরকে আক্রমণ করে যাচ্ছে ছন্দ নিয়ে, ভাষা নিয়ে, কুম্ভীলকবৃত্তি নিয়ে। কবিতার নামে সাইত্রিশ পৃষ্ঠার তত্ত্ব আওড়াচ্ছে কেউ কেউ।
আমি তো সেসব স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি না আজ। আমার সারা শরীরে ঝিঝিপোকার মতো বেজে চলেছে আজন্মকালের খিদে। ফুটপাথের খিদে। ছাটাই হওয়া শ্রমিকের খিদে। রিক্সাচালকের খিদে। ভারী মোট বওয়া বলিষ্ট কুলির খিদে।

আমি কেন শুনতে পাচ্ছি এত মানুষের কান্না?
কেন এত অসহায় লাগছে নিজেকে!

এমন তো হওয়ার কথা নয়
আমি যে আলোর কথা বলা মানুষ,
কয়লার গভীরেও দ্যুতি খুঁজে পেয়েছি কতবার…

তবে আজ কেন এ পৃথিবীকে মনে হচ্ছে মহাশ্মশান!

আমি কি আমার শত্রুদের সঙ্গে একবার ফোনে কথা বলব?
তাদেরও বড়ো আপনজন মনে হচ্ছে আজ।

আমি যে হিন্দু-মুসলিম, তৃণমূল-বিজেপি কিছুই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি না।
শুধু ঝাপসা আলোয় কিছু অসহায় হাত আমাকে ডাকছে।

আমি কি তাদের পাশে দাঁড়াব না!

***

উৎসর্গ

রাত্রের গভীরতা তোমার চোখকেও ছাপিয়ে যাচ্ছে।
শহরের কোনোপ্রান্তে এক চেন স্মোকার
সিগারেটে শেষ টান দেবে দেবে ভাবছে।
তুমি তোমার বরের সদ্যপরিচিত বুকে কৃষ্ণসার হরিণ খুঁজছ।

আমি আজও শহরের আলজিভে শুয়ে থাকা এক বেহিসেবি মানুষ।
বোতলের মদ তলানিতে ঠেকলে
রাতের অন্ধকারকে তোমার এলোকেশ বলে মনে হয়।
আমি অন্ধকারকে ছুঁই,
খুঁজি,
খুঁজতে থাকি তোমার
একান্ত আবেগঘন দৃষ্টি।

ওদিকে তুমি হয়তো ততক্ষণে,
চুমু খাচ্ছো কৃষ্ণসার হরিণের ঠোঁটে…

***

চিয়ার্স

তীব্র আনন্দ না প্রকাশের ভেতর
এক নিরন্তর অসহায়তা থাকে।

এক একটা উদযাপনও
খানিকটা বিষণ্ণতা দিয়ে যায়।

মদের ফায়ার প্যাকের মতো
কিছু বজ্রগর্ভ মেঘ আমার সুখের দিনেও
দুঃখের চিবুক ছুঁয়ে থাকে।

জীবনের অ্যাক্সেলেটরে হাত আমারই,
শুধু নিয়ন্ত্রণ করে অন্য কেউ

আমি জানি,
রাস্তা বাঁক নেবেই।

তাই যখন ক্ষণিকের স্তব্ধতায়
কোনও পরিযায়ী আলো এসে বলে—
‘এসো উদযাপন করি।’

আমি চিয়ার্স করতে পিছুপা হই না কখনও।

***

সাইত্রিশ ঘণ্টা

টানা সাইত্রিশ ঘণ্টা
আমি কারোর মুখ দেখিনি। নিজেরও না।

এ জীবন যেদিন থেকে বুঝিয়েছে, তুমি বড়ো হয়েছ।
সেদিন থেকেই আলো জড়ো করো আলো…
সেদিন থেকেই এমন ঘুম কখনও ঘুমোতে পারিনি
যার মাঝে ঘনঘন ইন্টারভ্যাল ছিল না।

গত সাইত্রিশ ঘণ্টায় আমি কারোর কথা ভাবিনি।
ফ্ল্যাটের ইএমআই-এর কথা ভাবিনি।
অফিসের চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলা লোকগুলোর কথা ভাবিনি।
প্রেমিকার বাবা যে এমাসেই বিয়ের পাকা কথা বলতে আসছেন,
সেকথাও খেয়াল হয়নি একবারও।

জীবন যেদিন থেকে বুঝিয়েছে আমার ইচ্ছেয় সব হবে না।
কত ইচ্ছেকে সিগারেটের সাথে
অ্যাশটেতে চেপে মেরেছি দিনের পর দিন।

তবে বিগত সাইত্রিশ ঘণ্টা। আহ! এমনও অপূর্ব ঘোর।
এমন ভেসে ভেসে থাকা। অন্ধকারের ভেতরও কত আলো…

সাইত্রিশ ঘণ্টা আটান্নো মিনিট। ডাক্তার জানালো বাড়ি যেতে পারি।
বুঝলাম অন্তিম গন্তব্যে পৌঁছনোও আমার ইছেয় হবে না। তাই আবার একটা সিগারেটই ধরালাম।

Facebook Comments

পছন্দের বই