লেখক নয় , লেখাই মূলধন

মারুফ আহমেদ নয়নের গুচ্ছকবিতা

নিষেধাজ্ঞা

নিষেধাজ্ঞা জারী হলো, আমার মুখের দিকে তুমি তাকিয়ো না। এই যে উচুঁ- নিঁচু খানা-খন্দক, পাহাড়-পর্বত, আলোর তীব্র ঝলকানি, তুমি পা পিছলে পড়ে যেতে পারো। জানো তো, আমার চোয়ালে রাগী পিপঁড়েদের বাসা। চোখের ভেতর সমুদ্র। তুমি স্নানের বাসনা নিয়ে খুলে ফেললে বুকের কাঁচুলি, আমার ভীষণ ভয় করে। আমি কাউকে বলি না, তোমার প্রেমে পড়ার স্বভাবে মৃত্যু আসে। সমুদ্র শামুকের মতো নিজেকে গুটিয়ে নিই। তোমাকে ভালবাসি, বলি না। পাখিদের কাছে নাম না জানা ফুলেদের কাছে ফিরে যাই।
তাদের বলি, আমি কবি জীবন ঘৃণা করি। আমি মূলত তোমার সন্তানের পিতা হতে চেয়েছিলাম।

সুন্দরের ক্রীতদাস

আমি আজন্ম সুন্দরের ক্রীতদাস থেকে যাব। যদি তোমার জন্য একটি শব্দও আর না লিখি কমতি হবে না। তুমি অমরত্ব পাবে, যেভাবে গ্রীক ও রোমানদের সভ্যতার পাশে দাঁড়িয়ে আছে সুন্দর নারী-মূর্তি, মূলত তারা সুন্দর ও ধ্বংসের দেবী। যে সুন্দর সমুদ্রে পরিভ্রমণ করায়। নির্জন রাত্রে জাহাজের শেষতম কামরায় ডেকে নেয়, তারপর রুটির মতো ছিড়ে ফেলে দেয়, হাঙ্গরের ঠোঁটে। আমি ভাবি, তুমি কী এমন সুন্দর, আমাকে একা করে দিয়েছ। মাথায় চাপিয়ে দিয়েছ পৃথিবীর সমান ওজন। ফলশ্রুতিতে আমার পিতা-মাতা আমার উপর ভীষণ বিরক্ত। আমার সহোদর ঘৃণা করেন। কেন জানতো, আমি কবি হব!
অথচ মানব সভ্যতার ইতিহাস জুড়ে কেবল মেষ পালকের গল্প।

অভিযোজন প্রক্রিয়া

আমি তোমাকে ভালবাসি। ঐ যে শিমের লতা উঠে যাচ্ছে খড়ের চালে, তার মতো করে যদি তোমাকে ভালবাসতে পারতাম ! আমার চিরকাল আক্ষেপ থেকে যাবে। সমুদ্র জলে মাছ হয়ে সাঁতার কাটতে গিয়ে মনে পড়বে, পৃথিবী আবার বরফে ঢাকা পড়ে যাবে। আহা বরফ যুগ, আমার মাথা কোথায় জমে থাকবে। তোমাকে পড়বে মনে, বরফের জামা গায়ে ফায়ার প্লেসে ঢুকে যাবো আমরা। আহা মানুষ জীবন, তোমার কাছে কত ঋণ। সাদা ভাল্লুকদের সাথে পায়ে ছাপ মিলিয়ে হাঁটতে গিয়ে কমলালেবুর মতো গড়িয়ে যাব। আহা সবুজ সতেজ কমলালেবু, তোমাকে দেখে এত রুগ্ন মনে কেন! তুমি তো জানো, তাকে ভালবাসা ছাড়া আমার কোনো পথ ছিল না, সেই তো আমার অভিযোজন প্রক্রিয়া।

আমার মাবুদ জানেন

আমার মাবুদ জানেন, আমার ভালবাসা কতটা নিরাকার। তুমি তার সামনে দাঁড়ালে পুড়ে খাঁক হয়ে যেতে। যদি আমি তার পরিমাপ করতে পারতাম ! পারি না বলেই তোমার কাছে আমার যাবতীয় নিঃস্বতা। আমার এমন নিঃস্বতা নিয়ে যে এতো খেলা করো তবুও তোমার স্বস্তি মেলে না। আমি কাউকে বলি না, এমনকি আমার বন্ধুদের ভেতরে কেউ জানেন না, আমার ভীষণ অসুখ। তোমার চিঠি পায়ে বেঁধে উঠে আসা পায়রার ঝাঁক আটকা পড়েছে মাথার খুলিতে। বাক বাকুম শব্দে ভরিয়ে তুলেছে জীবন। এখন আমি যেখানেই যাই, এক ঝাঁক পায়রা মাথার উপর উড়তে থাকে। আমি তাদের বলি, আমি কি পাখি বিক্রেতা!
রোদ নেমে আসে ঘাড়ে, যেন দুপুর, মাথার খুলিতে কাল কেউটের ছানারা রোদ পোহায়, দংশন করে। আমি যন্ত্রণায় ছোটাছুটি করতে থাকি। চিৎকার করি, হে মাবুদ আপনি আমাকে রক্ষা করুন।

দূর পাহাড়ের নেকড়েরা

আমার আশ্চর্য সহ্য ক্ষমতা। পুরনো আঘাতে তরবারীর মতো ঝন ঝন শব্দে বেজে উঠি। রক্তের স্বাদ গ্রহণ শেষে ঘুমিয়ে পড়ি। যেন এ ঘুম কখনো না ভাঙ্গে, আত্নহত্যার সাদৃশ্য নিয়ে যে আতা গাছ বেড়ে উঠেছে তার কাছে আমাকে ঋণী করো না। দেখো, তোমার স্বপ্নের ভেতরে খেলা করছে অজস্র সাপ ও ব্যাঙ। মর্গ থেকে প্রজাপতির ডানায় ভর করে আমি উড়ে আসছি আমি। আমাকে কবুল করো। এই যে দূর্ভিক্ষের দিন, তোমার বাথ টবে লেজ নাড়াচ্ছে অজস্র কুমির। অজস্র মাছ ড্রয়িং রুমকে নদী ভেবে সাঁতার কাটছে।
আমাকে ভুলে গেলে এমনই ক্ষতিগ্রস্ত হবে তুমি, অভিশাপ দিচ্ছি না। তবুও তোমার ব্যাক্তিগত হরিণগুলোকে টেনে নিয়ে যাবে দূর পাহাড়ের নেকড়েরা।

দূর দেশের আগন্তুক

তোমাকে যদি একদিন ভালো না বাসি। বুকের ভেতর বজ্রপাতের শব্দ শুনি। হৃদ-স্পন্দন থেমে যায়। ভয়ে জুবু-থুবু হয়ে পড়ে থাকি। নিজেকে ভাঙতে ভাঙ্গতে এই ক্লান্তি। প্রিয় আগুনের ফুল, আমার এই খেলায় একমাত্র প্রতিপক্ষ তুমি, আমার প্রেম ও কামনা সম্পর্কিত ধারণা, মিশে গেছ অবচেতন মনে। যখন মাটির ছাঁচে ঢালি এই মদ, অপূর্ব এক বাসনা। টাল-মাটাল হবার সম্ভাবনা থাকে প্রবল, তবুও খনির অন্ধকারে তলিয়ে যাই। জানি, কোনো মানুষ শোক করবে না মাছের পুত্র-হত্যার পাপের জন্যে। পৃথিবী এক লীলাময় প্রান্তর। কেউ চেনে না আমাকে, সবাই ভাবে, হয়ত দূর দেশ থেকে আসা কোনো আগন্তুক। ঘোড়া বেঁধে রেখেছে গাছের ছায়ায়।

আমি ঘুমিয়ে পড়লে সকাল হবে না

জেগে আছি। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে তোমার কন্ঠস্বর। আমি চারদিকে তাকাই। কোথাও তুমি নেই, স্থির হয়ে বসি। জানালায় দু-চোখ রেখে বসে থাকি। জানি, আমি ঘুমিয়ে পড়লে সকাল হবে না। তুমি সূর্য দেখতে না পেলে চিৎকার করবে। অথচ আমি তোমাকে সবুজ প্রান্তরের গল্প বলতে পারি। যেখানে জ্যোৎস্নার সৌন্দর্য লুটোপুটি খায় সবুজ ঘাসে। যদি তুমি জিজ্ঞাসা করো, সৌন্দর্যের সংজ্ঞা কী। আমি তোমাকে দেখিয়ে দেব, ঐ যে বজ্র ও কাঠের ঘোড়াগুলো জোৎস্না পান করে আরও উজ্জল হচ্ছে। পরষ্পর ভাব বিনিময় বলছে, ঐ ভাষাটিই মূলত কবিতা, যা আমি লিখতে চেয়েছিলাম।

তুমি

তোমার কাছে আমার অনেক ঋণ। অনেক শীত কুয়াশার রাত্রি উপেক্ষা করে তোমার কাছে এসেছি। উত্তরের মৃদু হাওয়ায় তেল শূন্য মাটির প্রদীপে যেভাবে বেজে ওঠে মৃত্যুর ঘন্টাধ্বনি। সেভাবে তোমার কাছে যেতে পারিনি। নিজের পাতানো ফাঁদে মাথা কেটে ফেলি। মাথা শূন্য দেহকে বলি এখন মধ্যরাত, তার দিকে এভাবে হেঁটে যেয়ো না, তোমার ভয়ংকর চেহারা দেখে সে ভয় পেতে পারে। তার করুণা জাগতে পারে।

Facebook Comments

পছন্দের বই