লেখক নয় , লেখাই মূলধন

মোহিত তন্ময়ের কবিতা

চৈত্র

চৈত্রের রাত্রে ঠান্ডা হওয়া দিলে, একটা বিমর্ষ আমবাগানে ঢুকে পরি, বন্ধ্যা বাগানকে ঘিরে কোথাও কোনো লোক দাঁড়িয়ে নেই, শুধুই মরে যাওয়া শীতল পাতাদের হলুদ ঠোঁট থেকে টপ টপ করে ঝরে পড়ছে দু-দণ্ড ব্যর্থ ষড়যন্ত্র। ঝরে যাওয়া মুকুলের শূন্য ডাল থেকে দূরের অস্তিত্ব বলয় পর্যন্ত মিশ কালো রাত। ঠিক এমনটাই চেয়েছিলাম এই দু-মিনিটের জীবন থেকে, ঠিক এতটাই চুপচাপ বিশ্বাসঘাতক এক চৈত্রকে, যে আমার সঙ্গে বহুরূপী সেজে সহজেই খুঁড়ে ফেলবে আমার কবর।


চৈত্রের জরায়ুর ভিতর ঘুমিয়ে থাকে একটা শিশুর মতো ল্যাংটো বছর, প্রতিটা রাতে আমি নাভির ভিতর লুকিয়ে বসে দেখি, দূরে কোথাও মায়ের আরতি হচ্ছে, মা খুলে রেখেছে তার তৃতীয় চোখ আজ আমাদের একাধিক পাপ ধুয়ে যাচ্ছে রক্তে, মায়ের চোখে শুধুই রক্ত আর টাটকা মাংসের গন্ধ, মা অন্ধ হয়ে যাচ্ছে কিন্তু মন্দিরের চাতালে ঢাক বেজেই চলেছে…. বেজেই চলেছে… যেন শহরজুড়ে দীর্ঘতর কোনো খুনের মহড়া শুরু হবে, এখন মা কাঁদছে, পুরোহিতের মুখ থেকে মোমের মতো গলে পড়ছে লোভ… মাংসের লোভ— আমি ভুলে যাই, তুমিও সেই খুনি চৈত্র মাস।


এখন সন্ধ্যা একটু পর গাজন শুরু হবে, সবাই হাত-পা ধুয়ে মন্দিরের দিকে হাঁটছে। বৃদ্ধ চৈত্রের রাত্রে পাকুড় পাতার দল একটা অলক্ষুণে বাতাস লুকিয়ে রেখেছে, অনেক দূরের কোনো রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকা একপাল ছাগল বাতাসের ষড়যন্ত্র দেখে থেমে গেছে বাড়ি ফেরা হয়নি। অন্যদিকে আলপথ দিয়ে একতারা বাজাতে… বাজাতে… জঙ্গলের দিকে হারিয়ে গেল এক বেসুরো বাউল। মুখভরতি গুটি বসন্তের দাগ, কোথাও কোনো বাড়ি ফেরা লেখা নেই বারবার তাকালে মনে হয়— এই শুরু হবে… এই শুরু হল বলে…


দেখতে দেখতে চৈত্রও চলে এলো, সেই পয়লা বৈশাখ থেকে আধখোলা জানলার ধারে এখনও বসেই আছি এক বছর হল উঠিনি, কোথাও যাইনি শুধু বসেই আছি মহুয়া ফুলের দিকে তাকিয়ে। কত ফেরিওয়ালাকে দরজার সামনে দুঃখ ফেলে দিয়ে যেতে দেখেছি, শুধু মুখ বুজে দেখেই গেছি, কিছুই বলতে পারিনি ওদের। আমিও এই চৈত্রের উষ্ণতায় বরফ হয়ে গেছি, জমা ঠোঁট নিয়ে কাউকেই আর কিছুই বলতে পারি না।


চৈত্রের বিকেলের বৃষ্টি থেমে গ্যাছে
একটা লাল জবা তখনও গাছে লেগে আছে
তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে জনা দশেক,
এই ঝিমঝিম বিকেলে কে নিয়ে যাবে সেই রক্তজবা? কাটা হাতের বিনিময়ে
সন্ধ্যাবেলায় মায়ের পুজো, দিতে হবে অঞ্জলি
এখন ঢাকের আওয়াজ যতই কাছে আসছে জবা ফুলটির মাথা নুইয়ে যাচ্ছে,

আমাদের আর জবা ফুল তোলা হয় না, রক্তের স্বপ্ন নিয়ে মন্দিরে যাওয়া শুধুই।


এক সময় বিকেলের দিকে খুব ঝড় হতো
বাঁধের ধরে আমরা সবাই মিলে লিখতে বসতাম
কোনো প্রেমের লেখা নয়, ধ্বংসের লেখা নিয়ে
কীভাবে গাছ ভেঙে গেলে পাখিরা হারিয়ে ফেলে নিজেদের চোখ?

প্রেম শেষ হয়ে গেলে কী করে কুয়োতলায় ঝাঁপ দেয় অন্ধ ফকির? কিংবা
কীভাবে সম্পর্ক শেষ হয়ে গেলে
আমরা সবাই সহজেই চারাগাছ হয়ে যায়?
এখন ওই বাঁধ জুড়ে শুধুই চারাগাছ পোঁতা রয়েছে
অনেক দিন পর ঝড় উঠবে— আবার ফিরবে সেই সময়
—যাকে আমরা চৈত্র বলে ডাকতাম ।

Facebook Comments

পছন্দের বই