লেখক নয় , লেখাই মূলধন

রাহুল গাঙ্গুলীর শব্দরূপ

দৃশ্যকল্পনের নি|রাকার কাঠামো ~ কিছু উপলব্ধি

ভাষাবিদদের গবেষণা ও মতামত অনুযায়ী: ভাষার কেন্দ্রচরিত্রে থাকা শব্দের কাঠামোগত বৈশিষ্ট্য মূলত দুটি। প্রথমটি হল ধ্বনি এবং দ্বিতীয়টি হল দৃশ্য। ধ্বনি হল, যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রাথমিক এবং আদিমতম রূপ। যাকে বিশ্লেষণ করে, সম্ভাব্য দ্বিমাত্রিকতায় রূপ দেওয়ার প্রচেষ্টা থেকে অক্ষর এবং যাকে আবার জোড়া লাগিয়ে শব্দ তৈরি করার প্রচেষ্টা থেকে দৃশ্য। খুব বেশি ভাষাতত্ত্বের জটিলতায় না গিয়ে, যতটা পারা যায় সহজ করে লিখলাম। আর এই ধ্বনি এবং দৃশ্যের যৌথ রূপ হলো শব্দার্থ, যা আবার ওই নির্দিষ্ট ভাষার অন্তর্গত কিছু নির্দিষ্ট অর্থকে বহন করে। আর, এই নির্দিষ্টতাকে নিয়ন্ত্রণ করে ব্যাকরণ বা grammar. এ ছাড়াও, যখন শব্দার্থগুলোদের বিভিন্ন আনুষঙ্গিকতায়, বিভিন্ন আবহে দৃশ্যের পূর্ণতাকে স্পষ্ট করতে থাকে, প্রয়োজন পড়ে ব্যাকরণগত শব্দার্থ বহির্ভূত কিছু চিহ্ন। সহজ ভাষায়, চিহ্নের কাজ হল শব্দার্থ থেকে দৃশ্যের অসম্পূর্ণতাগুলিকে মুছে, তাকে সম্পূর্ণতা প্রদান। ঠিক যেমন, একটি শূন্য ক্যানভাসে ~ প্রাথমিক স্কেচ, তারপর বিভিন্ন অর্থে বিভিন্ন রং ইত্যাদি প্রয়োগ করে দৃশ্যের সাকারত্ব প্রদান। আবার, প্রয়োজনানুসারে শব্দার্থের গাণিতিক রূপ হিসেবে সংখ্যা এবং বিভিন্ন গাণিতিক চিহ্ন। যেহেতু, শূন্য মানে শুধুই ‘কিছু নেই নয়’ বরং যা আছে, তা অদৃশ্য। অর্থাৎ যেরকম শূন্য ক্যানভাসটি হল চরিত্রগতভাবে নিরাকার। যেহেতু, ভাষার্থ একটি দৃশ্যের সম্ভাব্য সহজতম প্রতিরূপ। অতএব, দৃশ্যের অন্তর্গত কাঠামো ভেঙে ফেললে, যা পাওয়া যায় ~ তাও স্বতন্ত্র দৃশ্য। সুতরাং একটি সহজ সমীকরণ যদি করা যায়, তা অনেকটা এরকম হতে পারে:

ভাষা = বাক্য + চেতনা
= ( শব্দ + চিহ্ন) + (চোখ + চেতনা)
= (অক্ষর + চিহ্ন) + (চোখ + মস্তিষ্ক)
= (ধ্বনি + দৃশ্য) + ( দেখা + উপলব্ধি)

আসলে, এই স্বল্প পরিসরে এই আলোচনা করাটাও প্রায় অসম্ভব।তবে, চেষ্টা করলাম প্রারম্ভিক কথাগুলো যতটা পারি সহজ করে বলতে। আরও সহজ করে বলাই যায়, তবে সেক্ষেত্রে দরকার আরও বেশি পরিমাণ বা এলাকা বা পরিসর। ইন্টারনেট খুলে যদি কেউ ইতিহাস একটু দেখে নেন, দেখবেন ~ কথোপকথনের লিখিত রূপের প্রারম্ভিক ইতিহাস কিন্তু দৃশ্য থেকে। আর এইখানে দৃশ্যের সাকারত্ব বা নিরাকারত্ব নিয়ে আমার কবিতার কাজ। আর সেটার জন্য যে-প্রসেসটা আমার মতো করে নিয়েছি, তা হল ~ এনকোডিং & ডিকোডিং। এছাড়াও, চিহ্ন নিয়ে কাজ করার আরেকটি বিশেষ উদ্দেশ্য হল ~ এমন একটা সর্বজনীন ভাষা তৈরি করা, যা যে-কোনো ভাষার সীমান্ত বা কাঁটাতার ভেঙে ফেলতে সক্ষম। এবার আসি, ‘সাকার থেকে নিরাকার’ বিষয়টিকে নিয়ে একটু সহজ আলোচনায়।ধরা যাক ~ ছয়টি তল দিয়ে আবদ্ধ কোনো জায়গা, যেখানে কিছু ঘটছে। আমরা ধরে নিতে পারি এই পুরো মাধ্যমটি একটি নির্দিষ্ট ফ্রেম। এখন, যা ঘটছে তা হল একটি দৃশ্য এবং তার সময় সাপেক্ষটির গতিবেগ এতোটাই যে, দৃশ্যটি কখনো স্থায়ী নয়।দৃশ্য ভেঙে দৃশ্য, আবার সেই ভাঙা দৃশ্য ভেঙে গিয়ে আরও ভিন্ন দৃশ্য, কখনো কিছু ভাঙা দৃশ্য জুড়ে গিয়ে অন্য দৃশ্য, আবার সেই জোড়া লাগা দৃশ্যটি ভেঙে আবার কিছু নতুন দৃশ্য। এভাবে পুরো ঘটনাটি এতটাই অনির্দিষ্ট যে, প্রতিনিয়ত আরও বেশি অস্থায়ী। ঠিক যেমনটা ব্রহ্মাণ্ডে ঘটে চলেছে অনবরত ~ এক অদৃশ্য আবহের অনাদৃশ্য, যার প্রতিটি রূপ একেকটি স্বতন্ত্রতা সাক্ষ্য বহন করে চলে।আমরা যেমনভাবে দেখি ফিশন্-ফিউশন্ (শব্দদ্বয়ের সাথে অপরিচিত হলে, গুগুল সার্চ করে নিতে পারেন)। তাই, || (মড্ চিহ্ন) একাধারে সংযোগ বা লিঙ্ক। আবার, তার গাণিতিক ব্যাখ্যাটি হল ‘পরমমান’, অর্থাৎ দুটি দাঁড়ির মাঝে যা আছে, তার ধনাত্মক বা ঋণাত্মক, উভয়েই সমান এবং শূন্য থেকে উভয়ের রৈখিক দুরত্ব বা তল দুরত্ব। যেহেতু, আমার কবিতায় পরমমান হল শূন্য ~ অতএব, শূন্যের ভিতরেই অসীম এবং অসীমের অন্তরেই শূন্য, একে অপরের পরিপূরক। এখানে শূন্য একটি স্পেস বিশেষক মুহূর্ত। আবার, যখোন |০| নির্দিষ্ট ~ আড়ালের অবকাশে শূন্য (যেমন, মহা|০|তা: অর্থাৎ মহাশূন্যতা এবং ‘মহা’-র আড়াল অবকাশে শূন্য, যে ‘তা’-ভিত্তিক তলে গিয়ে মিশে যেতে চাইছে)। এরকমই যেখানে স্পেস বা বর্ণশূন্য বা ফাঁকা ~ তা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মাধ্যম বা স্থান। আবার, ⓟ শব্দটি একাধারে যেমন ‘পি’ ধ্বনিমূলক, অপরদিকে ‘কপিকল’ বিশেষ্যটি ⓟ জাতীয় দৃশ্যার্থ-ও বটে (খেয়াল করে দেখুন, অক্ষরটি বৃত্তে আবদ্ধ)। তেমনই ⓣ (টি) ~ যেন কেউ টুপি পরে বসে আছে, সামনে প্রসারিত পাদুটি। আবার, ↺ চিহ্নটি (টর্ক) একটি ঘূর্ণন ~ যার অভিমুখ ঘড়ির কাঁটার দিকে বা বিপরীতে। আবার, এই দ্বিমুখী ঘূর্ণন মুখোমুখি হলে সৃষ্টি হচ্ছে দ্বন্দ্ব। এরকম আরও, কত কিছু পরিশেষ করতে গিয়ে একথাই বলা যায়, যে আমার এখনও অবধি ব্যবহৃত অধিকাংশ চিহ্ন-ই আমরা জানি, যা সেকেন্ডারি পর্যায়ভুক্ত (যেমন বর্গমূল বা নিদেনপক্ষে ‘০’)। কিন্তু, এ-সব নিয়ে কবিতা লিখতে গেলেই বা দেখলেই মনে করি, শব্দ ছাড়া কি কবিতা আদৌ হয়। আসলে, এগুলো মনে হয় অভিজাত বদ্ধতা ~ যা খোঁজ করার বা সন্ধানের প্রধান প্রতিবন্ধকতা। আসলে, কবিতা শুধুই আবৃত্তিযোগ্য হবে, তা তো নয়, এখানে দৃশ্য ও পাঠ ~ সমান্তরালভাবে উভয় উভয়ের পরিপূরক। তা যদি না হয়, তবে চর্চা বন্ধ কেন (প্রশ্নচিহ্ন অহেতুক মনে করে, ইচ্ছাকৃতভাবেই প্রয়োগ করলাম না)।

Facebook Comments

পছন্দের বই