লেখক নয় , লেখাই মূলধন

শুভাশিস মণ্ডলের কবিতা

এইবার, একটু লাফিয়ে

এইবার, একটু লাফিয়ে, সে নামল, স্বয়ং, ললাটে ।
আর ঠিক সে-মুহূর্তেই
সোনার বাটিতে ছিটকে লাগল কিছু
দূরপনেয় কাদা।

পথ আজও রৌদ্রবিবর্জিত, চণ্ডালের
তৃষ্ণা দিয়ে ভেজা। দু-ধারে উপকথাগুলি
অঙ্কুর মেলেছে। আর নিরাশা নয়,
তুলে নিচ্ছি বাঁক, পৃথিবীতে কুড়ি কোটি বছর
বেঁচে থাকলেও কেউ অমর নয়, তুমিও
সম্ভ্রমমাত্র, কয়েকটা সুগন্ধি অক্ষর ও ধ্বনিগুলি
সুদূরে ছড়িয়ে গেছে, তবু আবার বেরোব
তোমার গায়ের মাপে একখানা জামা
তোমার পায়ের মাপে একজোড়া চক্ষুষ্মান জুতো এবং
একটা হাসিখুশি গামছার জন্য—
যা তোমার প্রয়োজন ছিল। জেনেছি।
শীতে উপেক্ষিত সাপেরা
তোমার আঙুল থেকে খসে আস্তে আস্তে
জলে রঙে মিশে যাচ্ছিল তখন।

দেখেছিলাম সিন্ধুলিপি, অপাঠ্য, কিন্তু বার্তা বোঝা যায় ।

এখন, এতদিন পর, যখন সে নামল, ললাটে
একটু লাফিয়ে, নরম কাদার মাঠে
ভেঙে গেল উচ্চতার ভার। অল্প ত্যারছা হয়ে
উঠে যাচ্ছে রাত্রির চাদর, আর
গম্বুজের পাশে সাদাকালোনীলছায়াদাগের ভিতর
জলকুমরী, কোথায় লুকিয়েছিল, জাগল ।

প্রপঞ্চ, এবার নতুন খেলা বানাও বেশুমার!
পাথরের ছুরি হাতে নলি কাটতে কাটতে এগোচ্ছি। গলায়
মৃতদের আর্তনাদ, জয়ীদের ব্রহ্মসংগীত

কবিতার কথা

ভুল অনুবাদ থেকে যাবতীয় দুঃখ উঠে আসে।
যদিও যথার্থ অনুবাদও অধিকারবিমুখ
বিরস ভঙ্গির দেশ, মানি।
প্রতিটি ধ্বনি, প্রত্যেক শব্দ-বাক্য-অন্বয় এবং
উপমার নির্জন বন
বিশ্বাসঘাতক হিংস্র দাঁত ও দৃষ্টি দিয়ে ভরা
এবং চিত্রকল্প
বার বার প্রকাশ্যকে নগ্ন ও অস্পষ্ট করে।
তুমিও দেখেছ।

কবিতার অনন্ত মায়া, দুর্ভোগ,
অবিভাজ্য প্রশান্তির কথা
কিছুতেই বলা যায় না।
যেমন, তোমাকে ভালোবাসি, আজও ঠিকঠাক
বলা হল না, তাই
ভালোবাসা শব্দটির মূলানুগ অনুবাদ আজও
উড়ে এসে বসল না আমার খাঁচার জানলায়।
শূন্য মাঠে চিরদিন ভায়োলিন,
বেজে গেল শান্ত প্রখর আপালেচিয়ান ওয়ালজ।

ভাবি, এই দুর্যোগের দিনে
মহৎ প্রয়াণ সম্ভব কি না— ভাবি জানা সম্ভব কি না
দুঃখের মৃত্যুর শান্তির বীভৎসার
প্রাঞ্জল কাঠামো কবে গ্রামের সোঁতার পাড়ে
জল ছুঁয়ে মলিন ফুলের গন্ধে
পড়ে থাকবে যুগযুগাতীত।
কেউ তো এগিয়ে গিয়ে অপ্রস্তুত বিহ্বলতায়
তাকে ছোঁবে!

চাঁদ কেন

আমার পাহাড়ি জীবন থেকে সমস্ত পাগল ফুল
উত্তরকুরুর অগোচরে
বস্তা বেঁধে চাঁদে রেখে এসেছেন রাজা হারিক।
লম্বা ঝাঁকড়া চুল, ভিনদেশি ইস্পাত-শরীর দেখে
মনে পড়ে গেছে রাগনারকের অন্তিম গোধূলি—
তুফানি রক্তের ঝড়, ঘিলুতে আছড়ে পড়া
হাতুড়ি, তলোয়ার আর ঢালের ঝনক।
জ-হার্পের সুরের সুতোয় বাঁধা গোলাপ
রক্ত মুছতে মুছতে পৃথিবী ঘুরছিল।
আমি কিছু বলতে পারিনি।

সেই দিন থেকে আমি চাঁদ
আর আমারই গুহায় থাকা বেহুদা মাতাল এক
চাঁদের ঝরনা হয়ে গেছে ।

পৃথিবীতে সর্বত্র সেই আলোর গুনগুন।
পাথরে চাটানে শততন্ত্রী ঝোরার গান শোনা যায়।

কার মাতৃভাষা জ্যোৎস্না?
কতদিন শৃঙ্গগুলি আলোকিত?
সমতলে নিরাধার অন্ধকার কেবল জটলা করে।
চাঁদের স্বপ্ন নিয়ে খেলে পক্ষীরাজ ।

দরমার বেড়াঘেরা ভাঙাফুটো
ছাদের শহরে চাঁদের গুরুত্ব যেন
জল ও মাটির চেয়ে বেশি ।

শুরুর দিন

একটা পাথরের চাঁই, দু-রতি শূন্যতা এবং আমি
কেবলমাত্র এই দিয়ে একটা কবিতা লিখে ফেলা
খুব কঠিন কাজ নয়। কোথাও
ফাঁকা একটা মাঠে অনেকদিন সূর্য উঠছে না ।
বহুদিনের বট গাছ, তার লালা ঝরে ঝরে
আজ শক্ত সপ্রাণ স্ট্যালাকটাইট ঝুরি,
তাকে আঁকড়ে বাড়ছে স্বর্ণলতার সবুজ পাগলামি ।
এসব আঁকার জন্য আমাকে কি যাজক হতে হবে?

ঘুম ভেঙে উঠে দরজা খুলেই
কারো মনে হতে পারে
পাশের বাড়ির রঘুদাই মহাভারতের কর্ণ।
কবে থেকে একটা চাকা মাটিতে অর্ধেক গাঁথা।
কবে থেকে অমর কবন্ধ ঘুরে ঘুরে বাজার করছে।
এসব সোজা কাজ ।

যাচ্ছেতাই শক্ত আর অসম্ভব হল
নিজের জন্য এক সাভ্র পার্বত্য শহর বসানো।
সেখানে উল্লম্ব গুহার সামনে
গভীর জল, তাকে ঘিরে থাকা মাটি, দুটো রাধাচূড়া
বকুল, কদম, কামিনী—
একটা প্রবীণ ডিঙি, কর্মহীন, সারাদিন
দুলে দুলে দাঁড়িয়েই আছে। এমন সহজ পরিসর।
মাঝে মাঝে অ‍্যান্ড্রোমিডা থেকে হাঁসেরা আসবে।
হাঁসেদের ডাক জলে নামতে গিয়ে
হঠাৎ সমস্ত ভুলে
শুরুর দিনের নীরবতা।

মেঘদূত

সেগুন গাছের পাতা ঢলঢল ভরাট বদন।
ভিতর শেষ অব্দি সবুজ আর ঠোঁটে তিল।
নাকে অভিমানী ধূসর সারস বসে আছে।

আষাঢ়ক্রান্তির মেঘে লীন হয়নি ছবি।
কী করে সে জেগে আছে
একঢাল কালো পরাক্রমী চুল নিয়ে?—
শূন্য অনন্ত স্মৃতি নিয়ে সে তাকিয়ে রয়েছে।
তার ক্ষান্তি-রহস্য-চপলতা, সমূহ জীবন নিয়ে
যেন আমার উড়ন্ত খুশবুদার প্রতিপক্ষ!

আমি ওকে গ্রহণ করেছি।
ফাঁপা তর্জনী মৃদু চালে স্পর্শ করছে
কুচযুগ, চিবুক, সুরভি।
কপালে জমাট নীল রক্ত। নীচে
পরমার্থ ঘূর্ণিস্রোত, নাভি
গরম নিশ্বাসে জেগে উঠল।

মন্ত্র পড়ছি, এসো, এসো
দেখো আমরা একই জাতি, মাটিতে প্রোথিত,
মূল আকাশে।
মজ্জা হয়ে হাড়ে ঢোকো, প্রবাহিত হও, পূর্ণ করো।

তবু বাঁ-হাতে ট্রিগার। সাবধানী কখনো মরে না।

মেঘ ঝরে পড়ছে দৌত্যহীন, ছদ্মবেশী
তরল আগুনের মতো ।
দেবী, প্রসীদ !

Facebook Comments

পছন্দের বই