লেখক নয় , লেখাই মূলধন

শুভ্রদীপ রায়ের কবিতাগুচ্ছ

রোগনাশা শহরের দিনলিপি

(ক)
এই যে আমার উত্তুরে জিহ্বাগ্রে লেগে থাকছে দক্ষিণী ব্যঞ্জন, এই অম্লস্বাদ তাড়ানোর উপায় কী প্রভু? এক দু-দিন করে সহস্র রাত চলে গেল এরূপ সাধনে। নম্র ত্বক ঘিরে কি কঠিন বল্মীক আবরণ আমার! খোলস ছাড়তেই দেখতে পাই সমগ্র শরীরে নোনাজলের দাগ— হলদেটে কালচে। চিকিৎসা বিজ্ঞান ঘেঁটেও এর কোনো উপশম নেই।
যে-শরীরের সাথে আমার দিনমান ঘর সংসার তারও আর থির বিজুরী নেই।
সংলাপ মেলেনা আজকাল, দু-দণ্ড পাশে বসে থাকি শুধু।
ধীরে ধীরে প্রতিরোধ ভাঙছে।

(খ)
খেলাটা বরাবরই কাউন্টার ডিসকার্সিভ। তবু আমরা চোখ বুজে একটা হাসিখুশি মুখোস পড়ে নিই।
পুট অন আ হ্যাপি ফেস, মেট!
প্রলাপের আর কী-ই-বা লজিক আর কী-ই-বা ভাষা। গোটা পৃথিবী জুড়ে শুধু পাগলের বিড়বিড়ানি।
এই এখন যেরকম বলছি আরকী!
রোগনাশা এই শহরে শুধু আমিই এক ম্যালিগন্যান্ট ক্ষত নিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছি।
অপেক্ষায় আছি একটা যথেষ্ট ধারালো স্ক্যালপেলের— আ সিম্পল কাট! ব্যাস।
এভাবেই প্রতিরোধ ভেঙে যায় সর্বনাশী!

(গ)
যেভাবে ধর্ম থেকে নিস্কৃতি চাইছ, ভাবছ গাছের জীবন বেছে নেবে আমি তো সেভাবে চাইতে পারছি না বন্ধু। শতানীকের মায়ানদীতে নামলে একটু শান্তি পাওয়া যায়, দুধ গঙ্গাজলে স্নান সেরে মানুষ হয়ে ওঠা যায়। অথচ পরম আহ্বান সত্ত্বেও আমার আর নামা হয় না। আমার চারিদিকে শুধু অবিদ্যার পাঁকদহ। যে বিপন্ন অস্তিত্বের কথা লেখা আছে সমস্ত কৃতবিদ্য কবিদের বইতে আমি তাকে অনুবাদ করতে পারছি, মিশিয়ে নিতে পারছি নিজের এই পরভূমে বাসকালে। এখানে শোওয়ার ঘরে যীশু আর মাদার মেরি ঠায় তাকিয়ে আছেন। তাই আমার আর বাবা হিসেবে পূনর্জন্ম হবে না, রেজারেকশন হতে পারে।

কেমোফ্লেজ

এমন একটা বোতাম থাকলে পারত যা খুললে পৃথিবীর সমস্ত বুকে পৌঁছোতে পারতাম।
অনেক ছোটো থেকেই আমি জানি অনাঘ্রাতা বুকে কচি ঘাসফুলের গন্ধ— কাম জাগে না,
স্নেহে জর্জরিত হই। অথচ সেই দূর্বা ডলে ডলেই আমার কলম ভেজাই। আমার পুং অহমিকার
ফ্ল্যাগ বেয়ারার। স্পেকট্রাম বাদ দিয়েও হাজার রঙের কলমের এক ফ্যাসিনেটিং সংগ্রহ আমার।
এক এক-ধরনের বুকের বর্ণনায় এক এক-ধরনের কলম। এবং পাঠক এটা খেল, চেটেপুটেই খেল।

আমি একজন মাস্টার ক্রাফটসম্যান। তবু সন্ধ্যেবেলা কলমের নামে ছুরিতে শান দিই।

কবি

যেদিকে খেলা ঘুরবে তুমি সেদিকেই চোখ ফেরাও। তুমি ক্রান্তদর্শী। নট লেস দ্যান নস্ট্রাদামুস!
এইসব জনশ্রুতি শুনে শুনে তোমার দিকে দূরবীন তাক করি।
দুটো শৈল্পিক হাত, দু-খানা পুরুষালী পা, প্রশস্ত পিঠ আর সুচর্চিত বুক দেখতে পাই।
অথচ কী আশ্চর্য— তোমার চোখ সমেত মাথাটাই অদৃশ্য!

যুদ্ধজয়ী (?)

অল কোয়ায়েট ইন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট।
তোমার একটা নাদে থেমে গেল সমস্ত যুদ্ধ।
সকল বিবদমান পক্ষেরা একে-অপরকে চুমু খেল।
আপেল বাগিচায় গ্লাসে গ্লাসে ঠোকাঠুকি করে উল্লসিত হল।
বোমাগুলোয় ছাতা পড়ল, বন্দুকগুলোয় জং।
আর তরোয়ালেরা গলে গিয়ে কাঁটা-চামচ হল।
মৈত্রীর গান প্রান্তে প্রান্তে গুনগুনিত হল। জাঁহাবাজ সব যুদ্ধনেতারা
তোমার নামের জয়ধ্বনি দিতে দিতে নিজেদের বাঙ্কারে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল।
সব শেষে শুধু তোমার বাড়ি ফেরার মন নেই।
‘বাড়ি’— আ ব্যাটেলফিল্ড হোয়্যার ইউ ক্যান নেভার উইন!

Facebook Comments

পছন্দের বই