লেখক নয় , লেখাই মূলধন

শুভ্রা মুখার্জীর গুচ্ছকবিতা

শিরোনামহীন

সমস্ত জমি জরিপের কাজ শেষ হয়ে গেলে
কোরা কাগজের মতো ভাঁজ খুলে দাঁড়িয়ে থাকে পুরনো পাথর
আমাদের ঘর আরও হাঁ করে এগিয়ে আসতে থাকে…
আরও দ্রুত সন্ধিকাল এসে ছোটো খুপরির মগজ ঘেঁটে দেয়
ঘুম আসে, কাঙাল আর্তির মতো ঘুরে ফিরে উঠোনে এসে বসে শব্দের নির্লিপ্ত বাঁক।

ক্রমশ নীল আরও নীল হয়ে ওঠা এসব জমিতে আমাদের চাষাবাদ শেষ হয়ে এলে
কৃষাঙ্গী যুবতী হেঁটে যায়, হাতে ধরা কালোকুলো গান্ধর্ব সন্তান।

এরপর ঘুম ভাঙে
মনে হয় কিছু বেঢপ মাপের জামা থাকা প্রয়োজন।

ধুলোখেলা

প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি সাপলুডো খেলার বয়স আর অছিলা আমারও ছিল। খেলতে খেলতে ঝোঁকের মাথায় পাক খেতাম গন্ধরাজ চারার মাথায়, উঠোনের গোবরজল ছেটানো তুলসীমঞ্চে। বেপাড়ার বালি আর পাথর মেশানো সরু সরু রাস্তায়। ফ্রকের ঝুল উঠে আসত কোমর থেকে আরও একটু আর ঠাকুমা মৃদু ধমকের ভঙ্গিতে জামবাটিতে দুধমুড়ি মাখতে মাখতে একটা আধপোষা বেড়ালের দিকে কতকটা দলা পাকানো আশ্রয় ছুঁড়ে দিত।

ভেন্টিলেটারের গোপন চিরকুটে কিছু অশালীন বরফচাপা মাছ… সাপের মুখ খুব পরিচিত হলে যেমন হয় আরকি; মা তেমনই স্বাভাবিক সুরে দার্জিলিং চায়ের লিকার নামিয়ে যেত বারান্দায়।
একটা মেরুন ফুলছাপ পাশবালিশ আর আমার ফ্রক কেটে বানানো দুটো আড়াআড়ি বালিশের কভারে আমি ছাড়া আর সবকিছুই পর্যাপ্ত। ওঁ বলো, বলো পাঁচালি কোনো জীবনকেন্দ্রিক
এসব সুযোগ্য সময়ে মেজো পিসির পিঠ ছন্দে দুলতে শুরু করলে আমি খানিকটা সোনপাপড়ি চুরির লাইসেন্স পেয়ে যাব মাত্র।

ভোরগুলো মহালয়া হয়, খানিকটা মহালয়া। পটুয়াপল্লীতে পড়ে থাকা ছেলেটা আমাকে মাটির গল্প শুনিয়ে যেত, ছেদ-যতিহীন মাটির গল্প শেষ করে উঠে যাওয়ার পর আমি রোজই তার বসার জায়গায় খানিকটা তাজা ছায়া পড়ে থাকতে দেখে শিখলাম সহজলভ্য ছায়ার বিশ্লেষণ। অথচ কখনও তাকে সাঁওতালডিহি ফেরত একটা তালপাতার পাখাও দিয়ে উঠতে পারিনি, বরং বলা ভালো দিতে চাইনি।যেমন ইচ্ছে করে সুলভে কয়েন দিতে ভুলে যাই, বাসের ভাড়ার পয়সা মেরে দিই ভুলে যাওয়ার অছিলায়।

সাওকুড়ির রাস্তায় মাটির গল্পগুজব শেষ হয়ে এলে, টবগুলো নির্দোষ বনসাই আর হারানো মাটির মাঝে একটানা দাঁড়িয়ে থেকে বেখাপ্পা রকমের লম্বা হয়ে ওঠে। অল্প ভাড়ার কোনও রুদালি গাঢ় নীল কান্না ছিটিয়ে দিলে সাবেক গৃহস্থ সাজে নিজস্ব লুডোর ছকে ফিরে আসে আঠানব্বইয় ঘরের পালিত সাপটি।

ইচ্ছে সংক্রান্ত অবাধ্যতা ৫

প্রেমের কথা বললে এখন হাইওয়ের বমির দৃশ্য মনে পড়ে।
দুটো ধাতব গ্লাসের ঠোকাঠুকি আর
পার্কিং লটে পড়ে থাকা প্রিন্টেড প্যান্টির কথা মনে পড়ে।

দু-চারটে দৃশ্যগত শিহরণ পায়ের বুড়ো আঙুল ছুঁয়ে তোমার কোল্ড কফিতে গিয়ে নামল
কলারে নামল চামড়া আর পশম।
তুমি সাবধানী সাবুদানার পাশে খুঁজে পেলে প্রেমিকার যৌনরোম
আর কয়েক ঘন্টা নীরবতার পর জেনে গেলে
প্রেমিকারা এভাবেই লিপস্টিক ফেলে যায় গ্লাসের কর্ণারে।

এখন নাইটি মোড়ানো এই গভীর শরীর নিয়ে কতদূর যেতে পারি?
তুমি ভাবো শালিখের বেঁধে রাখা পায়ের সাপেক্ষে কোনও প্রাপ্তবয়স্ক দূরত্ব নেই।
রাত্রি আরও মৎসগন্ধা হলে ক্রমাগত পাল্টে নেওয়া শরীরী মুদ্রায় আরও কিছু খুঁজে পাব বলে আমি আর প্রেমে নয়, শুধু পুরুষে বিশ্বাস রাখি।

হাইওয়েতে আরও নিগূঢ় বমনদৃশ্য ভাসে…

প্রেমের কথা বলতে আমার সামন্য কালো গোলাপ মনে পড়ে
আর গাড়ির কাচে পা উল্টে রাখা শালিখ দম্পতির স্লোমোশান সাউন্ড।

এরকম দৃশ্যরূপে বসে থেকে ভাবি
দেবোত্তম কোনো প্রেমিকের নাম ছিল নাকি?

সম্ভবত নিজের সপক্ষে বলছি


আমি শুধুমাত্র ঘরে ফিরতে চেয়েছিলাম ; আভাসে ভেসে আসা কথা লক্ষ্য করে যেসব ঘরের টান ছবির মতো মাথাতে ফুটে ওঠে তেমনই একটা ঘরের কোনাতে পৌঁছানোর ইচ্ছে আমার জামার ওপর লালার দাগ স্পষ্টতর করে দিয়ে চলে গেছে। চলে যাওয়ার রাস্তাটি ধূসর, নীল শামুক শাবকের চোরা কান্না দিয়ে চেরা। আপাত ঢালাইহীন উপত্যকার শেষে রাস্তাটি হারিয়ে গেলে আমি বুঝি আমার ফেরার পথ ক্রমশই মাকড়শার জালের ক্ষুদ্রতম সুতো হয়ে ঝুলে আছে। ঘুমিয়ে পড়ার আগে যাবতীয় তথ্য মাথাতে ঢুকিয়ে দিয়েছে আমার অপারগতা।

এখন মাথার ভিতরে জল, হৈ হৈ ফাঁকা। সেখানে আরামে প্রজাপতি ওড়ে বাকি অর্ধেক মাথার ভিতরে সবুজ মাছের চাষ। ডানাতে পলকহীন চোখ, চোখে কতগুলি সুস্বাদু বিকেল। আমি জলের দৃশ্যকে সহজ ভাবি, সহজকে জলের দৃশ্য। আর মৃত্যু একটি সমগ্র উপত্যকার মতো নেমে আসে, ছুঁয়ে চলে যায় জল। বরফের ঘরে প্রজাপতি নেমে আসে, তুলো তুলো আমাকে উড়িয়ে দিয়ে ফিরে আসে চাঁদ।

প্রারম্ভিক প্রতিটি দৃশ্যকালে পটুয়ার ছায়া আর ছায়াবাজি সংশ্লিষ্ট হয়। জলকে মোহময় মনে হয়, মোহকে জলের মরচে পড়া আবরণ। আমি গুলিয়ে ফেলেছি সমস্ত রাস্তাঘাট। নিজেকে ঘড়িতে রেখেছি। আমি লম্বাটে ঘন্টার কাঁটা— প্রতিটি ঘড়িতেই আমি লাভজনক সময় থেকে দু-মিনিট দূরে দাঁড়িয়ে থেমে গেছি। এই অভিশাপের মতো চন্দ্রমাস শেষ হলে পটুয়ার আঙুলে আঙুল ফেরত দিয়ে আমি সম্ভবত শুধু ঘরেই ফিরতে চেয়েছিলাম।

এখন আমার পায়ের দৃশ্যে অবাক রঙিন মাছ, মাথাতে কালো-নীল… অসম্ভব প্রজাপতি।


তারপর আমাদের আর কিছুই থাকে না। চোখের নরম পাতা পড়ে থাকে ফিকে লাল রাস্তায়। কু্ঁয়োর গভীর থেকে জল তোলা শেষ হলে আমাদের আর কি থাকে বলো? শুধু দু-চারটি সংলাপ আর উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা শূন্যতা ছাড়া। এর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে যেসব শব্দ তাতে বিচ্ছুরণের গল্প কম। হালকা উত্তাপে সেঁকে নেওয়া মাংসের চপের মতো মুড়মুড়ে হয়ে ছড়িয়ে যাওয়ার মতো কিছু একটা থেকে পাশ ফিরে বসি। বুঝি আমাদের সত্যিকার চেহারায় আশ্চর্য রকমের রং আর মদের প্রভাব ফুটে বেরিয়ে এসেছে।

আজ আবার সে নরম হবে, একটি সুলভ খাবার। আমি হাড় কিপটের মতো স্বাদু খাবারের দোকানগুলিকে পেরিয়ে যাচ্ছি, রংচঙে আগ্রহী লালায়িত জিভ থেকে পিঠের মাংস বাঁচিয়ে পালাতে পালাতে ছুঁড়ে দিচ্ছি মুঠোভর্তি একটাকার কয়েন। আজ নরম হওয়ার দিন… তুলতুলে কিছু পেলে তার গলা টিপে ধরে জোরসে ধাক্কা মারতে ইচ্ছে করে। কোনো খাদ সংলগ্ন মৃত্যুর গল্পে জোরে জোরে হাততালি দিয়ে হাসার ইচ্ছেই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, টের পাই।

কেউ সেই বাদামী দৈত্যটার নাম জানে না। অথচ সে আমার মাথার মধ্যে ক্রমাগত শুড় নেড়ে চলে, শ্বাসের গন্ধ স্থবির হয়ে সবুজ থালার মধ্যে লাট খেতে থাকে। আমার সমস্ত ক্ষমতা এবং অক্ষমতা সবকিছু সস্তার কাগজে মুড়ে হাতবদল হচ্ছে। যেন কেউ দলাপাকিয়ে ছুঁড়ে দিল ডাস্টবিন লক্ষ্য করে। দৃষ্টি স্থির রাখি, একটি কাব্যিক মিথ সহজে কর্কটরাশির কাছাকাছি আসতে চায় না, তবু কোনও ভুল পদক্ষেপে চাঁদের উল্টোপিঠে স্পষ্ট হয় আনুবিস এবং মৃতদের ডাকনাম।

এরপর আমাদের বলার আর কিছুই থাকে না। কয়েকটিমাত্র এরকম বিকেলের পর চিত্রকর হাঁটু মুড়ে বসে দেখেন কাচের জানলার ওপর আমাদের সবুজ খুলির ছায়া এক্কাদোক্কা খেলতে খেলতে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে কোনও নির্বিকার সাদা দেওয়ালে।

Facebook Comments

পছন্দের বই