লেখক নয় , লেখাই মূলধন

শৌভ চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা

ধ্বংসের দিকে ফেরানো একটি মুখ


এসো, আলো জ্বালি। আর দেখো, কাচের ঢাকনার ওপর একটি মথ কেমন চুপ করে বসে আছে। আবার কখনো, আলোটিকে ঘিরে, উড়ে বেড়াচ্ছে পাগলের মতো। যেন এই আলোটুকুই তার সমগ্র অস্তিত্বের কেন্দ্রবিন্দু। আসলে, একটা কেন্দ্র ছাড়া, অস্তিত্বের কল্পনাও অসম্ভব বলে মনে হয়। এমনকী অনুপস্থিতিও, ক্ষেত্রবিশেষে, একটা কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে। পারে না কি?

আডর্নো বলেছিলেন, “আউশভিৎসের পর কবিতা লেখা, বর্বরতার নামান্তর।” যদিও, তাঁর এই কথা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারি না। আমার বিশ্বাস, পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবার ঠিক আগের মুহূর্তেও, কেউ না কেউ, নিশ্চয়ই একটি কবিতা লিখবে। যে-কবিতার কোনো পাঠক থাকবে না। যার শরীর থেকে, আস্তে আস্তে মুছে যাবে সমস্ত দৃশ্য, শব্দ, আলো আর ভাষা। শুধু এক অস্ফূট দীর্ঘশ্বাসের পালক, শূন্যের ভেতর, ভেসে বেড়্রাবে—ঘুরে, ঘুরে, ঘুরে, ঘুরে…


ঘুরে-ঘুরে, কেবলই ভাষার কাছে ফিরে আসছি।
দেখছি, ভাষা দিয়ে, গোটা একটা পৃথিবী
বানানো সম্ভব কি না। যদিও আমি ছাড়া,
আপাতত, সেখানে আর কোনো জনপ্রাণী নেই,
শুধু কিছু নুড়ি-পাথর, একটা শুকিয়ে-আসা ঝর্ণা, আর
অচেনা উদ্ভিদ, গুল্ম, এটুকুই…

ভাষা আগে, না কি দৃশ্য ও বস্তুপুঞ্জের এই
প্রসিদ্ধ সমাবেশ? ভাবতে ভাবতেই দেখি, চারিদিক
কেমন অস্পষ্ট হয়ে এসেছে। পায়ের তলায়,
মনে হল, মাটি কাঁপছে। তবে কি এবার
এই আলোটুকুও আর থাকবে না, নিভে যাবে?

মাঝেমধ্যে ভাবি, অন্ধরা ঠিক কীভাবে কবিতা লেখেন!


ছায়া যখন রয়েছে, তখন, কোথাও না কোথাও—তা সে যত দূরেই হোক, বা যতই ক্ষীণ—খানিকটা আলো যে এখনও রয়ে গেছে, এ-বিষয়ে আমাদের মনে আর কোনো সংশয় রইল না।

আমরা ঘাড় উঁচু করে, ওপরের দিকে তাকাই। ধূসর আকাশের গায়ে, নাম-না-জানা গাছের আঁকাবাঁকা আঙুল। ও তাদের কালো, গ্রন্থিময়, কুব্জ শরীর। একটা পাখি, কোথায় যেন, হঠাৎ চীৎকার করে ডেকে উঠল। এই হাওয়া—সাপের মতো ঠান্ডা, আর পিচ্ছিল—যার স্পর্শে, শরীর বিষিয়ে ওঠে।

এমন দিন কি সত্যিই আসবে, যখন কোনোখানে, আলোর এই সামান্য ইশারাটুকুও আর থাকবে না?

অন্ধকার মানুষকে যথার্থই সঙ্গীহীন করে। ভাবো, কী অসম্ভব সেই একাকীত্ব, যখন, এমনকী আমাদের ছায়াগুলিও, একে একে, আমাদের ছেড়ে চলে যায়!


ভাবো, কী অসম্ভব সেই মনস্তাপ, যখন তুমি
নিজের প্রিয় কুকুরটির মাথায় হাত বোলাতে-বোলাতে
আচমকা ট্রিগারে চাপ দাও, আর তারপর
একটা কেঁপে-ওঠা লালচে পর্দার ওপাশ থেকে,
একজোড়া ভাষাহীন চোখ, অপলক দৃষ্টিতে
তোমার দিকে তাকিয়ে থাকে, আজীবন।

সমুদ্রের ধারে, দাউ-দাউ করে জ্বলছে
একটা দোতলা কাঠের বাড়ি। কিছুদূরে, এক রুগ্ন বালক
শুকিয়ে আসা গাছের গোড়ায় জল দিতে-দিতে
আপন মনে কথা বলে উঠল, কতদিন পর!

“In the beginning was the Word.
Why is that, Papa?”

আমি চুপ করে থাকি। ধ্বংসের কিনারায়
একটা অদৃশ্য সুতোর মতো ঝুলে আছে
আমার নৈঃশব্দ্য।


নৈঃশব্দ্যেরও
নিজস্ব একটা ভাষা আছে।
ভাষাকে প্রত্যাখ্যানের মধ্যে
লুকিয়ে থাকে যে-উচ্চারণ,
তা আসলে আরেকটা ভাষাই।
তুমি বুঝতে পারনি।

তুমি বুঝতে পারনি, একদিন
কালো আর সূর্যহীন একটা সকাল
তোমাকে জড়িয়ে ধরবে।
আর তখন,
বেমালুম ভুলে যাবে তুমি—
কাকে বলে ঘুম,
কাকেই বা জেগে ওঠা বলে।

Facebook Comments

পছন্দের বই