লেখক নয় , লেখাই মূলধন

সরদার ফারুকের কবিতা

সরদার ফারুকের কবিতা

মৃত এক রমণীকে

মৃত এক রমণীকে বললাম, ‘এই নাও ঈগলের ডানা
ওড়া শেষ হলে রেখে দিয়ো পাহাড়ের কাছে।’
এখানে ঘাসেরা আরও সবুজ হয়েছে, আকাশের রং আরও নীল
কেবল হাঁটুর নিচে মানুষের পায়ের ঠিকানা নেই
ঠোঁটে তালা, পিছমোড়া হাতে রজ্জুর বন্ধন

অভিশাপ বলে কিছু আছে? সিডন ও টায়ার নগরে
বোমার আঘাতে ভেঙে পড়া দালানের ফাঁকে
দেখেছ কখনো শিশুদের মুখ?
অবরুদ্ধ জনপদে সঙিন-উঁচানো সৈনিকের চোখে
ক্রোধ নাকি অবসাদ ছিল?

তারাও চেয়েছে ঘরে ফিরে যেতে
জয়তুন ফুল ফুটে কতবার ঝরে গেছে
বালিয়াড়ি জুড়ে কত সাইমুম এল
আলিফের মতো তবু সোজা হয়ে ছিল খেজুরবিথীকা
বুড়ো এক উটকে বলেছি, ‘চলো ঘুরে আসি,
আমাদের দিন শেষ হয়ে যায়।’

নীল শিরা

অ্যাপোলোর নগ্ন মূর্তি দেখে জেনে গেছি
অতিকায় শিশ্ন শুধু নীল ছবিতেই হয়
প্রস্তরপূজার দেশে কালো কালো পাহাড় দেখেছি
‘মরুর বালিকা কম বয়সেই ঋতুমতী?’ —এমন প্রশ্নের পরে
মুখ বেঁধে ধরে নিয়ে গেছে

ফাঁসির মঞ্চেই তোমার আসল পরিচয়
তুমি কেঁদে ওঠো, নাকি জল্লাদের দিকে সোজা হেঁটে যাও—
সে-ও এক বিচার্য বিষয়

খোজার চিৎকারে কেউ ফিরেও দেখে না
রূপসীর নীল শিরা ভেসে ওঠে আলোকসজ্জায়

প্রেম

শহরে তখন কোনো ব্যাচেলর অফিসার এলে
প্রতিবেশী খালাদের মাতৃমূর্তি বিকশিত হত
‘ভানুর হোটেলে খেয়ে ছেলেটা শুকিয়ে গেছে
যাও মিতু, এক বাটি মাংস দিয়ে এসো’

ঘন ঘন বেজে যেত হারমোনিয়াম
‘আমি যার নূপুরের ছন্দ…’
রাজপুত্র সেজেগুজে বিকেলবেলায়
ঘুরতে বেরোলে জানালায় কারো হাসির ইশারা

আমাদের চোখে ভুল করে
চোখ পড়লেই মুখটা ঘুরিয়ে নিত

গানের চূড়ায়

গানের চূড়ায় নৈঃশব্দ্যের মতো বসে আছে
কালো পাখি, নাকি সে ক্ষতের মাছি
বিলাপের ঘ্রাণ ভালোবাসে?

আমাদের লাল ঘোড়া ছিল, তাড়িয়ে দিয়েছি
অবিশ্বাসী বন্ধুতার মতো সে এখন
তিসিখেতে ঘোরে

গোরখোদকের সাথে মদপান করলেই তুমি
উত্তীর্ণ হবে না
ওরা তো কেবল মৃত্যুর গহ্বরে উঁকি দিতে পারে

নৈরাজ্যের খুব কাছে এক ভদ্র পাড়া
তাদের চিরুনি কেউ ছুঁতেও পারে না
মেয়েদের সাবানের মোহে ছুটে আসে
গন্ধবণিকের দল, সাজানো শিবিকা আছে,
পুষ্পমাল্য আছে, অনুতাপ নেই

হারানোর ভয়ে কারা কাঁদে?
পাগলের জাত নেই, ইতিহাস নেই
কে তাকে শোয়াবে মখমল বিছানায়?

যার যত অলঙ্কার ছিল, সিন্দুকে রেখেছে
ডাকাতের সাধ্য নেই গুপ্তস্থান চেনে
ফাঁসির দড়ির মতো রাত ঝুলে আছে
সন্ধিক্ষণ এখনো আসে না, আর ওই রাতজাগা কুবো
হুপহুপ করে ডাকে

ঘর চেনাবার কথা বলে তুমি
ডেকে নিয়েছিলে এক জলার নিকটে
সেখানে মাটির দুধে বেড়ে ওঠে
অগণন ঘাসশিশু, ঘুমের ভেতরে

কয়েদি

যখন ফুলের নাম শেখার সময়, তখন কিনেছি
গন্ধক-কয়লা-সোরা, জালে ব্যবহৃত লোহার টুকরো
যখন পেত্নীকে দেখে পরী বলে ভুল হতো, সেসময়ে
আমরা জেনেছি রিভলভারের এক ঘর খালি রাখা ভালো

আমরা কাউকে খতম করেছি?
আমরা কাদের কেশগুচ্ছ ছিঁড়ে উল্লাসের মঞ্চ বানিয়েছি?
নাকি নিজেরই রক্তে ভেসে যেতে যেতে ডুকরে উঠেছি—
বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক!

নেতাদের মন্ত্রী হতে দেখে স্বমেহনে থামিয়েছি
দাহকাল, জলের তাণ্ডব
আমাকে কি ডাইনোসরের মতো লাগে, কমরেড?

হাতুড়ি কাস্তের গান ক্রমশ হারিয়ে ফেলে সুর
প্রিজন ভ্যানের আশেপাশে ফুল হাতে কেউ নেই
যেন কয়েদির পরিচয় ছাড়া কোনোদিন কিছুই ছিল না!

প্রেমিকা

মুখোমুখি বসে আছে ভাড়াটে প্রেমিকা
নাটোরের রাণী নয়, সে এসেছে সখীপুর থেকে
পাটের আঁশের মতো চুল, ঘোটকীর ম্লানমুখ
চলে যাবে বলে পা দুখানি বাড়িয়ে রেখেছে

কোথায় শান্তির দিশা, দাশবাবু!
এখানে কেবল নগদ টাকার লেনদেন
ফিসফিসে স্বর শোনা যায়, অন্ধকারে—
‘আরো কিছু বাড়িয়ে দেবেন।’

অভাব

আমাকে শেখাতে আসে অভাবের কথা!
তুই তো জানিস, ভবতোষ
দুইবেলা ছাতু খেয়ে কতদিন পার হয়ে গেছে
ছেঁড়া হাফপ্যান্ট ফুঁড়ে দেখা যেত অবাধ্য মিনার

আমাকে বোঝাবে এরা সমাজ-সভ্যতা!
রাত দশটার দিকে হরিতকী গাছের আড়ালে
রুশী আপা দাঁড়িয়ে থাকত
বাড়িতে বা পথে দেখা হলে থুতনিটা নেড়ে
হেসে দিত— ‘ভালো আছ, খোকা?’
অজগর সবখানে চোয়াল খুলেছে

সুস্বাদু সালাদ দূরে থাক, কখনো দেখিনি
সাদা কাপড়ে মোড়ানো অলীক টেবিলে
চিতল মাছের পেটি আমাদের অপেক্ষায় আছে

শিল্প আর কবিতার কথা শুনে কাজ নেই
মাগিবাজ সম্পাদক শুধু অন্তর্বাস খুলতেই জানে
আর কিছু কামবেয়ে রমণীও আছে
ছয়মাস ধরে লুতুপুতু, ফাজিল আলাপ
তারপর অণ্ডকোষে সুড়সুড়ি দিয়ে বলে—
প্রার্থনার সময় হয়েছে

Facebook Comments

পছন্দের বই