লেখক নয় , লেখাই মূলধন

কবিতা

উমা মণ্ডল

সৃষ্টিরহস্য

উদাসীন দুপুরের গাছে বসে থাকা কোকিলের চোখে জল পড়ে। হয়তো শীত; ধূসরের শব্দগুচ্ছ পড়ে নিয়েছে সে। এখন কাঙাল হাতে দেনা, পাওনা। আরও নিঃস্ব হয়ে যাওয়া। লাল ধুলা ভেসে যায় দেহ জুড়ে… নদী একটু থাক। এই প্রয়াগের জল মূর্তিমান যমদূত; স্মৃতিচিহ্ন বলে কিছু রেখে দেয় না… বকুল ফুল

ভ্রমরের আদিনৃত্য দেখেছ? যেভাবে জেগে ওঠে শক্তি শবের মধ্যমা থেকে। দারুণ আগুনে ধোঁয়া ওঠে আকাশের দিকে। শেষ থেকে প্রারম্ভের ধারাপাত রিং হয়ে ছুটে যায় পৃথিবীর কোলে; মা ডাকে সন্তান… বুক থেকে খসে পড়ে সুধারস, তার যাপনের ইতিকথা; সেই শূন্য থেকে গড়া চিন্ময়ীর চোখ। জল আসে…

কেঁদো না কোকিল; এই উদাসীন চোখে তানালাপ একতারা নিয়ে বসে আছে একান্তের বোধে…

নিরাময়

পেয়েছি জন্মদিনের চিঠি…
পার হয়ে গেছে কয়েকটা সূর্যওঠা নাম আর ঘন রাত। আমার অসুখে ঢাকা রোদ জলজ গম্ভীর। আঙুলের ফাঁকে যতটুকু আশা, ততটুকু দিন দেখা যায় জানালার শেষে। সেই ঠোঁটে রাখা আহির ভৈরব দেখি পাখিদলে, আকাশের খুব কাছে। একতারা বুকে ভাসে
চিঠি এসে গেছে অবশেষে…
সাদা খামে ভরা এই পাতাগুলি একটি সিন্দুক। আধো বোল, খানিক রহস্য; গাছেদের ডালে ডালে ইচ্ছে বাঁধা সুতোর ঢিলেতে। তাপ দেওয়া অক্ষরের গা-গরম, ছুঁলে পুড়ে যায় চোখ। শিরা বেয়ে বেয়ে জলের আকুতি। বাড়ন্ত জীবন। হয়তো চণ্ডালিকার বংশধর। হাঁটি ডোমপাড়া দিয়ে; সন্ধানে, সন্ধানে।
অক্ষরের গর্ভ বেশ প্রাচীন; আবিষ্কারের দেশে এই অতীতের রেখা সমুদ্রের খুব কাছে। অতল দেখি শুধু অতল; স্রোতে স্রোতে ডাক দিয়ে যায় গাঙচিল। তোমার চিঠি এসে গেছে

হ্যাঁ, আমার চিঠি এসে গেছে। জন্মদিন শেষে অবশেষে; অসুখ সারাতে…

সীমারেখা

মেঝেতে গুটিয়ে থাকা বড়ো অসহায়
পাশ দিয়ে চলে যায় সময়ের চাকা
অথচ কেমন নির্বিকার
এতকাল পার হয়ে গেল, ভয় নেই
তবু এই গণ্ডি এই সীমা…
বেড়া বাঁধা উঠানের ধারে বকুল ফুলের গাছ
গন্ধে সেই নেশা যাযাবর ডাক;
পৃথিবীর তলপেটে যে-মাধ্যাকর্ষণ আছে
জানে গুটিকয় জাতি
ওদের পোশাকে শীত গন্ধ, বরফ আতর
এইসব অভিধানে নেই

ডুব দিলে উঠে আসে লুপ্তপ্রায় ডাকঘর
চিঠিতে প্রাচীন শব্দ হরপ্পার; এইসব
গল্পকথা, উত্তরের পথ
ধূমায়িত গরমের চা ‘ঠিক বুঝবে না’
তবু কথা যুধিষ্ঠির… পাক খেয়ে খেয়ে ঠিক
পায়ে ধরে; মেরুদণ্ড বেয়ে গলা

এরপর ডাক এলে উঠে যাব বাঁকে
রহস্যের কাঁচাঘরে
আলতামিরার গুহাপথ ছেড়ে হয়তো বা
নতুন পথের গন্ধ পাব…

খরা

কতদিন এ-পাড়ায় বৃষ্টি নেই। সেই কবে আকাশের ঘর কালো করে দু-একফোঁটার স্বাদ… চাতকের কান্না শুনে প্রাচীন বটের ঝুরি বলে অভিশপ্ত কাল। সেই থেকে সদ্য জন্ম নেওয়া পাতা হলুদের কোপে ঝরে যায়। গোটা একটা গাছ পোকাদের হাতে চলে গেছে। ছায়ারা হারিয়ে গেছে। তার সাথে পাখিদের বৈঠকী আড্ডাও

ও-দিকে কাঙাল ধানখেত… জ্বলে গেছে হলুদের বেশ। কালো গুঁড়ো ঝুরঝুরে হাওয়া হাতে লেগে; পেটে জ্বালা ধরে। মাতৃদুগ্ধের আস্বাদ অধরা মাধুরী। হাঁড়ি পেতে বিষন্নতা। তার ব্যক্তিগত খাতা থেকে কেউ জল নামক শব্দটি তুলে নিয়ে গেছে। এ-দিক-ও-দিক মুড়ে নৌকা তৈরি করে না খেয়ালি মন। গতি নেই, নেই চলাচল। বড়ো বিষণ্ণতা মাগো। সামনে অন্নপূর্ণার বেদী শূন্য। নীচে ডুবে যাচ্ছে দিনকাল

সেইসব শব্দ

গভীরতা থেকে সৃষ্টি হওয়া শব্দ আসলে ডুবুরি
আতসকাচের চোখে কথা বলে আকারে ইঙ্গিত
দূরদূরান্তর থেকে আগত ইথার
একহাতে লুফে নেয়। তেজ শুধু তেজ
আলো থেকে উদ্ভাসিত পথে বিশ্রামের ছায়া
সকালে ভৈরব
রাতে ছায়ানট…

তীব্র এক আকর্ষের টানে ওঠে ঢেউ
মধুলোভে ছুটে আসে কামুক পৃথিবী
নেশা শুধু নেশা…
সীমান্তের কাঁটাতার ডাকে বেহালার ছড় টেনে
ক্ষত বাঁধা খাদ ভুলে যায় রক্তের প্রচ্ছদ
আসলে ডুবুরি ঐ শব্দ; এক একটি মায়ারোগ
আতসকাচের চোখে কথা বলে আকারে ইঙ্গিতে

খেয়ে নিতে পারে গোটা কৃষ্ণগহ্বরকে

Facebook Comments

পছন্দের বই