লেখক নয় , লেখাই মূলধন

গল্প

মধুময় পাল

কলোনি ডায়েরি

[এই লেখা একটি ডায়েরির কয়েক পৃষ্ঠা৷ ডায়েরির লেখক অতুলকথা বাঙাল৷ কারো কৌতূহল হতে পারে এমন অদ্ভুত নাম কেন? পূর্ববঙ্গের কিশোরগঞ্জে তিনপুরুষের ভিটে থেকে উচ্ছেদ হবার পর নলিনীকুমার বসু ভারতে আশ্রয় নেন৷ বিখ্যাত কোনো নেতা বা গুরুর আশ্রয় নেওয়ার মতো নয় একেবারেই৷ প্রাণ হাতে নিয়ে পালিয়ে শেয়ালদা স্টেশনে লক্ষ দেশভিখারির ল্যাপটালেপটি ভিড়ে নিজেদের কোনোরকমে গুঁজে দেওয়া৷ ‘নিজেদের’ মানে নলিনীকুমার, তাঁর স্ত্রী, কন্যা ও নাতি৷ পালানোর সময় নাতির বয়স ছিল চারমাস৷ এই স্টেশনেই দীনভিখারি-অনুষ্ঠানে নামকরণ হয় তার৷ কোটালিপাড়ার ডাকসাইটে ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান অব্যয়ানন্দ শিশুর নাম রাখেন ‘অতুলকথা’৷ আর নলিনীকুমার নতুন পদবি দেন ‘বাঙাল’৷ ছিলেন ‘বসু’৷ যার দেশ যায়, তার সব যায়৷ পুরোনো পদবি থাকে কীভাবে? তাছাড়া, এরপর তো সবাই ‘বাঙাল’ ডাকবে, শোনার অভ্যাস হয়ে যাক শিশু থাকতেই৷ অব্যয়ানন্দও খেদা-খাওয়া৷ তিনি ১৯৫২ সালে নলিনীকুমারের কাছ থেকে দু-টাকার পুরোহিত-প্রণাম আদায় করেন এই নামকরণের জন্য৷ ডায়েরিতেই এ-কথা লিখিত আছে৷ অতুলকথার ডায়েরি তিরিশ পরিচ্ছেদের৷ এখানে তার একটি দেওয়া গেল৷ নামকরণ স্বয়ং অতুলকথার৷]

উত্তরের জানালা খোলা৷ আশ্বিনের আকাশে মেঘের জমায়েত আলো শুষে নিচ্ছে৷ বৃষ্টি নামবে কোনো সময়৷ শোবার আগে পর্দা আধাআধি টেনে দিয়েছে শিশির৷ বালিশে মাথা রেখে নাটকের বইটা পড়তে পড়তে চোখের পাতা ভারী হবে, হাই উঠবে, পাশ ফিরে আরামের কোল নেবে শরীর, ভাতঘুমে ডুবে যাবে— এরকম ভেবেছিল সে পর্দা টানতে টানতে৷ বিছানায় বসে বইয়ের সতেরো নম্বর পৃষ্ঠা খোঁজে৷ সতেরো পায়৷ কিন্তু সেই দৃশ্য ও সংলাপ নেই৷ তবে কি পনেরো, নাকি উনিশ? ডান দিকের পৃষ্ঠায় আছে ভুবনপ্রসাদের সংলাপ: তোমাকে আমি সম্মান দিয়েছি, মর্যাদা দিয়েছি, অধিকার দিয়েছি, ভাষা দিয়েছি৷ ভুলে যেয়ো না তুমি ভাষাহীন ছিলে৷ তোমাদের কখনো ভাষা ছিল না, থাকে না৷ আমি, এই ভুবন সিংহ দিয়েছি৷ কথা ফুটিয়েছি করতলে রেখে যত্নে আদরে৷

ডান দিক ধরে খুঁজতে খুঁজতে সংলাপটা পায় শিশির আরও ছ-পৃষ্ঠা পর৷ একবার ভুবনপ্রসাদ হওয়ার চেষ্টার মধ্যে দু-বার হাই ওঠে৷ ভুবনপ্রসাদের ভারী আওয়াজে হাইয়ের হাওয়া ঢুকে পড়ে৷ বই সরিয়ে রাখে সে৷ দূর থেকে ভেসে আসে আকাশের গুমগুম৷

আধোঘুমে সে শুনতে পায় নীলিমার সংলাপ: ভাষা যখন দিয়েছ, কথা যখন ফুটিয়েছ, শুনতে তো হবেই৷ শুনবে না কেন? আমি অন্য কাউকে শোনাব? তোমার ভাষা, তোমার কথা, মালিক তুমি৷ তোমারই হাতে তুলে দেব তোমার দান৷ যদি আর কাউকে শোনাই, যদি আর কারো সামনে বেজে উঠি, সইতে পারবে কি? পারবে না৷ গর্জন করে উঠবে৷ বলবে, তুমি আমার৷ শুধু আমার৷ তোমার দখলের কথা মনে করিয়ে দেবে৷ মনে করিয়ে দেবে আমি তোমার একার সম্পত্তি৷ হে প্রিয়, হে অন্তরতম, তুমি অধিকার দিয়েছ, ভাষা দিয়েছ, সে-সবই তোমার ভোগের জন্য৷

শিশির একটা ছবিতে দাঁড়ায়৷ সে নিলীমাকে দেখতে পায়৷ তার খুব কাছে৷ পরিপাটি শরীরের ওপর রচিত মুখশ্রী৷ চোখ তুলে বলে, আমার সবই তোমার জন্য৷

ঘুমটা সরে সরে যায়৷ নিলীমার রোল-টা লাভলি পেতে পারে৷ লাভলিকে পেতে পারে শিশির৷ ক্লাবে দু-বার এসেছে লাভলি৷ এক কর্মকর্তার পছন্দের নারী৷ পরিচয়ে বলে, অমুকের বোন, আমারও বোনের মতো৷ মধ্যবিত্ত বাঙালির ঢ্যামনামি৷ কর্মকর্তা লাভলিকে খাবে৷ জানা কথা৷ এরকম হয়ই৷ এরকমই হয়৷ শিশিরও খাবে৷ সে সিলেক্ট করেছে৷ ডিরেক্টররা পেয়ে থাকে৷ শিশির ডিরেক্টর৷ উচ্চারণ পরিষ্কার৷ রিফিউজি মেয়ে হলেও পূর্ববঙ্গের টান নেই৷ গলার জোর আছে৷ কলেজে পড়ার বয়স৷ পড়ে কিনা জানা নেই৷ পড়বার কথা নয়৷ গরিবের ঘরে বই বড়ো আপদ৷ মেয়েটি হয়তো শেখেনি অনেককিছুই, আড়ষ্টতা নেই চলাফেরায়৷ প্রথম দিনের রিহার্সালেই বুঝিয়ে দিয়েছে৷ হে প্রিয়, হে অন্তরতম, তুমি অধিকার দিয়েছ, ভাষা দিয়েছ, সে-সবই তোমার জন্য৷ পরিপাটি শরীরের ওপর রচিত মুখশ্রী৷ এরকম শরীর শিশিরের খুব লাগে৷ হাসি হতে পারেনি৷ রূপ থাকাটাই যথেষ্ট নয়, রূপকে দাঁড়াতে হয়৷

গুমগুম আরও ভারী হয়ে কাছাকাছি৷ উত্তরের জানালা দিয়ে অন্ধকার ঢুকছে ঘরে৷ ভর দুপুরে ঘনিয়ে এল সন্ধ্যে৷ আকাশ তোলপাড় করে মেঘ ডাকল৷ বৃষ্টি হবে৷ খুব বৃষ্টি হতে পারে যদি হাওয়ার টানে কেটে না যায়৷ ভোর থেকে আকাশ মেঘের হাট হয়ে ছিল৷ বেলায় বেলায় বেড়েছে ভিড়৷ ভাতঘুমের হাই মিলিয়ে গেছে৷ বেশ চনমনে লাগছে৷ বাদলদিনের একটা অন্যরকম এফেক্ট তো আছেই৷ হাসি আসতে পারে এখন৷ এখনও কি ঠাকুরঘরে? বয়স যত বাড়ছে, ঠাকুরবাতিকও বাড়ছে৷ হয়তো এখনও খাওয়া হয়নি৷ তারপর বাসন মাজতে বসবে৷ কাজের লোকের বাসনমাজা পছন্দ হয় না৷

মেঘের জমায়েত এ-মাথা ও-মাথা তখনই, সবেদুপুরে শিশির যখন মান্নার চায়ের দোকানে, অন্যদিনের মতো কাগজে ছোটো খবর খুঁজছিল৷ যেমন আইন-আদালত, মধুচক্র, অবৈধ সম্পর্ক৷ কুচো কুচো খবরে মুঠো মুঠো প্রাণ৷ চায়ের দোকান একটু হালকা হলে শিশির কুচোতে ঢুকে যায়৷

মান্না এটা জানে৷ সে পাখা বন্ধ করে দেয়, জোরে ঝাঁটা চালিয়ে ধুলো ওড়ায়, ঝুল ওড়ায়৷ উনুনে কাঁচা কয়লা গুঁজে দেয়৷ চোখ-জ্বালানো নাক-জ্বালানো ধোঁয়া ওঠে৷ তারই মধ্যে বসে শিশির রস খোঁজে৷ আজ মান্না বলেছে, শিশিরবাবু, আকাশ ভাইঙা পড়তে চায়৷ নামলে ছাড়া অনিশ্চিত৷ আমারে ঘরে যাইতে হবে হাইট্যা৷ পড়লেন তো আধাঘণ্টা৷ পাইছেন নিশ্চয় কিছু৷ ঘরে গিয়া ভাবেন৷ বউদির লগে গল্প করেন৷ শিশির মান্নার দিকে তাকিয়ে হেসে বলেছে৷ বলেছে, সাহস বাড়ছে তোমার৷ আজকের কাগজ সাদা৷ কোনাখামচিতেও কিছু নেই৷

নীল আলো ঝলসে উঠল জানালায়৷ চড়চড় শব্দে আছড়ে পড়ল বাজ কাছেপিঠে৷ শিশির কুঁকড়ে যায়৷ সন্ন্যাসীর মা ঝলসে দাঁড়িয়ে আছে নিমগাছে৷ প্রায় ছ-ফুট, চওড়া কাঠামোর শরীর বিদ্যুতের আলোয় আংশিক দেখে নাথুরামের কাঠের দোকানের পাল্লায় ছিটকে পড়েছিল শিশির৷ সেদিনও দুপুরে রাত্রি নেমেছিল৷ জানালাটা বন্ধ করা দরকার৷ বিছানা থেকে হাত বাড়িয়ে আপাতত পর্দা টেনে দেয়৷ আকাশে মেঘের কুরুক্ষেত্র৷ বালিশে মুখ গুঁজে পড়ে থাকে শিশির৷

‘খুট’ শব্দটা কানে এল৷ হাসি এল তবে৷ সদ্য বিয়ের পর এভাবেই শুতে আসত রাতে৷ শ্বশুর-শাশুড়ি কয়েকদিন ছিল তখন এখানে৷ ননদ ছিল৷ এখন তারা নেই৷ শ্বশুর-শাশুড়ি তো সপ্তাহখানেক বাদেই পাকিস্তানে৷ শেরপুরে বিরাট ব্যাবসা৷ বারোপাল্লার দোকান৷ অবিনাশের ওপর ছেড়ে দিয়ে আসা৷ খুবই বিশ্বস্ত অবিনাশ৷ তবু৷ দেশভাগের পর দেশটা আর আগের মতো নেই৷ ছেলের বিয়ে দিয়ে তারা চলে গেছে৷ ননদ চলে গেছে নিজের বাছাই-করা যুবকের সঙ্গে৷ শিশিরের এখন দুই মেয়ে৷ ওরা স্কুলে থাকলেও হাসি এমনভাবে ঘরে ঢোকে যেন এতটুকু শব্দ না হয়৷ সদ্য বিয়ের সহবাসের সেই লজ্জা আজও ডিঙোতে পারেনি৷ স্বামীর বিছানায় শব্দহীন এই আসার চেষ্টার একটা ‘খুট’ শব্দ কী ভীষণ রমণীয় ও কামনাতুর৷ হাসির স্তন দুই সন্তানের ধকলের পরও তেমনই সুডোল, পাণিগ্রাহী৷ শিশিরের বড়ো প্রিয় খেলার জিনিস৷ বড়ো প্রিয় হাসির ঠোঁট, সুগঠিত পা, কম্পনময় যৌনযাপনভঙ্গি৷ স্তনের ভাঁজে শিশিরের মাথা সে টেনে নেয়৷ ঝুঁকে পড়ে সবটুকু আদর নিয়ে৷ লাভলিরা কিছুক্ষণের৷ ঘরের বাইরের৷ সব সম্পর্ক ঘরের হয় না৷ শিশির মুখ গুঁজে চুপ করে পড়ে থাকে হাসি ছোঁবে বলে৷

বৃষ্টি নেমেছে৷ মেঘের যুদ্ধ কিছুটা স্তিমিত৷ পাশের বাড়িতে বিরুদের টিনের চালে ঝমঝম হচ্ছে৷ কুকুরের কুঁইকুঁই শোনা গেল৷ কারো বারান্দায় বা রান্নাঘরের দাওয়ায় উঠেছে ভেজা এড়াতে৷ তাড়ানো হচ্ছে তাকে৷ শিবরামদের বাড়ি থেকে কাঁসরের আওয়াজ এল৷ ধনাদের গোয়ালে গোরু ডাকল৷ নিমুখুড়ো কাশছে আর বউকে ডাকছে চেঁচিয়ে৷ দ্বিতীয় পক্ষ, বয়স কম, সাড়া দিতে চায় না৷ খুড়ো এরপর খিস্তি ছোটাবে৷ হাসি তবে কি আসেনি? ‘খুট’ শব্দটা মনের ভুল? শিশিরের চাওয়ার মধ্যে বেজে উঠেছিল? হয়তো এখনও ঠাকুরঘরে৷ কিংবা খেতে বসেছে৷ নিজের হাতে বেড়ে একা একা খাওয়া৷ কিংবা খাওয়ার পর বাসন মাজতে বসেছে৷ এমনও হতে পারে শুকনো কাপড় তুলে গুছিয়ে রাখছে আর ভেজাগুলো মেলে দিচ্ছে বারান্দায়৷ কোনো ভাড়াটে হয়তো বলল, বউদি, ঘরে জল পড়ছে৷ কোনো ভাড়াটে হয়তো বলল, বউদি, ভাঙা পাল্লা দিয়ে ঘরে জল ঢুকছে৷ কেউ বলল, দিদি, দেয়াল চুঁইয়ে জলে মেঝে ভাসছে৷ টালি ভেঙেছে কয়েকটা৷ জানালার পাল্লাও ভেঙেছে৷ সারাবে কীভাবে শিশির? ভাড়াটেরা বকেয়া ভাড়া “আজ দেব কাল দেব” করে৷ পাকিস্তান থেকে টাকা আর আগের মতো নিয়ম করে আসে না৷ পিচচট দিয়ে সাময়িক মেরামতের চেষ্টা হয়েছে৷ টেকেনি৷ দেওয়ালে জল চোঁয়ানো ঠেকাতে খানিকটা জায়গা প্লাস্টার করা হয়েছে৷ কাজে লাগেনি৷ জানালার নতুন পাল্লা বানাতে অনেক খরচ৷ টাকা আসবে কোথা থেকে? ছয় ভাড়া-ঘরের মালিক হলেও শিশির গরিব৷ যেটুকু আছে তা বাড়িওলার ঠাট রাখতে খরচ হয়ে যাচ্ছে৷ মেয়েদের স্কুলের খরচ যোগানো এরপর সমস্যা হয়ে পড়বে৷ এসব ভাবতে শিশিরের একদম ভালো লাগে না৷ একটা দুশ্চিন্তা তাকে অস্থির করে, একটা অসহায়তা তাকে স্থবির করে৷

মেঘের ডাক আর শোনা যাচ্ছে না৷ শিশির বালিশ থেকে মুখ তোলে৷ বৃষ্টির ছাঁটে জানালার পর্দা খানিক ভিজেছে৷ হাসি আসেনি৷ নাকি এসেছিল? শিশিরকে মুখ গুঁজে শুয়ে থাকতে দেখে হয়তো ভেবেছে ঘুমিয়ে আছে৷ ডাকেনি৷ না, সেরকম হতে পারে না৷ হাসির অত সাহস নেই৷ থাকলে অনেক কিছুই ঘটে যেতে পারত এতদিনে৷ যে-ঘর থেকে হাসিকে আনা হয়েছে, সেখানে সাহস থাকে না৷ ছোটোবেলা থেকে মেয়েদের বাধ্যতার শিক্ষা দেওয়া হয়, মুখ বুজে মেনে চলার শিক্ষা দেওয়া হয়, ভয়ের শিক্ষা দেওয়া হয়৷ গোড়ার দিকে কখনো কখনো অন্যরকম কথা বলতে চেয়েছে হাসি, প্রতিবাদ করতে চেয়েছে৷ শিশির শাসন জানে৷ সুশাসন৷ শেরপুরের ব্যাবসা থেকে তখন প্রয়োজনের অনেক বেশি টাকা আসে৷ শিশিরের জন্মদিনে উঠোনে মেহবুব ব্যান্ড বাজে৷ ঝুলন পূর্ণিমায় রাধা-কৃষ্ণের পুতুল সোনার গয়না পরে দোল খায়৷ কালীপুজোয় বসনতুবড়ি ভুস করে জ্বলে উঠে আলোয় ভরে দেয় মুহুর্মুহু৷ রানাঘাটের রিফিউজি ঘরের বাবা-হারা মেয়ে কোনোদিন ভেবেছিল তার গায়ে এত সোনা উঠবে? শিশির শাসন জানে৷ সুশাসন৷ এখন আর সেই জাঁক নেই৷ কিন্তু শাসন পোক্ত হয়ে আছে প্রতি ধাপে৷ তোমার যে-ভাষা, সে আমার দান৷ তোমার যে-অধিকার, সে আমারই দেওয়া৷ নাটক জমে যাবে৷ লক্ষ্মীবিলাস রিক্রিয়েশান ক্লাব শিশিরকে ডিরেক্টর হিসেবে চেয়েছে৷ লাভলিকে নিলীমার পার্টটা দিতেই হবে৷ হাসি তবে আসেনি৷ বৃষ্টিভেজা হাওয়া আসছে ঘরে৷ বিছানা থেকে আকাশ যতটুকু দেখা যায় এখনও মেঘলা৷

নাটক নিয়ে মজে থাকার মধ্যে হাসি এল কীভাবে? হাসির আসবার কথা নয়৷ শিশির ভাবে৷ নাটকের সংলাপ পড়ছিল সে৷ হাই উঠছিল৷ ঘুমোবে ভাবছিল৷ মেঘ জমছিল৷ জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকছিল অন্ধকার৷ ঘুমটা ছোঁয়া দিয়ে চলে গেল৷ মেঘ ডাকল৷ বিদ্যুৎ চমকাল৷ কাছেপিঠে বাজ পড়ল৷ ভেসে উঠল সন্ন্যাসীর মায়ের দীর্ঘকায় ঝলসানো মূর্তি৷ সে ভয় পেল৷ বালিশে মুখ চাপা দিল৷ একটু পরে দরজায় খুট শব্দ হল৷ হাসিকে চাইল শিশির৷

আবার বৃষ্টি ঝরছে৷ দাপট তুলনায় কম৷ আবহাওয়া দপ্তর বলেছে, দফায় দফায় মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টি হবে৷ বজ্রপাতের সম্ভাবনা৷ ঝোড়ো হাওয়া বইতে পারে৷ বিছানা থেকে উঠে শিশির জানালার পর্দা সরায়৷ আলো জ্বালে৷ চোখে পড়ে টেবিলের ওপর একটা খাম৷ চিঠি এল? শেরপুর থেকে? পোস্টাফিসের স্ট্যাম্প নেই৷ হাতে এল কি? খামের ওপর ইংরেজি হরফে শিশির চৌধুরীর নাম৷ খামের একপ্রান্ত সন্তর্পণে ছেঁড়ে৷

বউদি, মেঝে ভেসে গেল৷ এসো দেখে যাও কী অবস্থা ঘরের৷ সারারাত জেগে বসে থাকতে হবে৷

দিদি, আমাদের ঘরটাও দেখে যাও৷ ভাঙা জানালা দিয়ে জলের ছাঁট এসে তক্তপোষ ভিজিয়ে দিয়েছে৷ সরাব কোথায়? শাশুড়িকে রাখি কোথায়? দিদি, আমরা মাসের ভাড়া মাসে মাসে দিই তো! তবু এত ছিদ্দৎ কেন কপালে৷

শিশিরবাবু কই? একমাস ভাড়া দিতে দেরি হইলে কী চোটপাটই না করেন৷ এখন কই তিনি? দরজার সামনে দিয়া বাথরুমের জল যায়৷ আসেন, শুইঙ্গা যান কেমন গন্ধ ছাড়তাছে৷ কী কমু আপনেগো, বড়োলোক মানুষ, পাকিস্তান থেইকা আপনেগো ট্রাংকভরতি টাকা আসে, সোনাগয়না আসে৷ আমরা খেদাখাওয়া পোড়াকপাল, ইচামাছ টুকাইয়া খাই আর বিছার লগে শয়ন যাই, মানুষ ছিলাম পার্টিশনের আগে, পরে আর নাই৷ নেহরু-জিন্নার লালসা আমাগো সব খাইছে৷ ওই শয়তানগুলা না জন্মাইলে দেশের মানুষ দেশেই থাকতে পারতাম৷ এই নরকে উঠতে হইত না৷ শিশিরবাবু, আপনেরা বড়োমানুষ নিজেগো জায়গা কী সুন্দর গুছাইয়া নিছেন৷ আপনেগো ঘরে জল পড়ে? পড়ে না৷ আপনেগো দরজায় গু ভাসে? ভাসে না৷

বাবা থামো৷ কাশি উঠবে৷ ও-সব বলে লাভ কী?

শিশিরের কানে আসে৷ চেয়ারে বসে সে খাম থেকে চিঠি বের করে৷ মায়ের হাতের লেখা৷

মা লিখেছে: আদরের খোকা, প্রথমে তোমরা আমাদের প্রীতি ও শুভকামনা জানিবে৷ আশা করি তোমরা সকলে সর্বকুশলে আছ৷ এইখানকার পরিস্থিতি বিশেষ সুবিধার নহে৷ দিনে দিনে খারাপ হইতেছে৷ পরিস্থিতি অবগত করাইবার জন্য তোমার পিতাঠাকুরের নির্দেশে চিঠি লিখিতেছি৷ কিছুদিন পূর্বে আমাদের দোকানের সম্মুখে বড়োরকমের গোলমাল হয়৷ রাজিবুল মণ্ডলের বড়োছেলে দোকানে আসিয়া বলে যে, তাহার ভাইয়ের জামা ও প্যান্টের অধিক মূল্য লওয়া হইয়াছে৷ তাহারা দল বাঁধিয়া আসে৷ অবিনাশ তাহাদের বুঝানোর চেষ্টা করে৷ তাহারা অবিনাশকে চড়চাপড় মারে৷ ইতিপূর্বে এইরূপ ঘটনা কখনো ঘটে নাই৷ রাজিবুল মণ্ডল আমাদের পুরানা খরিদ্দার৷ তাহার নিকট বহু টাকা পাওনা আছে৷ তোমার পিতাঠাকুর রাজিবুল মণ্ডলকে দেখা করিতে বলিয়াছে৷ সে আসে নাই৷ মাসুদুর রহমান বলিয়াছে, এইরূপ আরও ঘটিবে৷ লোকঠকানো ব্যাবসা আর চলিবে না৷ দরকার হইলে দোকান উঠাইয়া দিবে৷ মারধরও হইতে পারে৷ মাসুদুর প্রকাশ্যে এইসব বলিতেছে৷ তোমার পিতাঠাকুর থানায় গিয়াছিলেন৷ বড়োবাবু ভরসা দিতে পারেন নাই৷ বলিয়াছেন, সাধারণ মানুষ আপনাদের উপর ভীষণ চটিয়া আছে৷ আমাদের দোকান হইতে একমাইল উত্তরে করিমসাহেবের মোকাম৷ শুনা যায়, করিমসাহেব এই গণ্ডগোলের পিছনে৷ তিনি অবশ্য স্বীকার যান নাই৷

খোকা, দেশটা আর আমাদের নাই৷ খাতায় কলমে আমরা নাগরিক৷ কিন্তু এই দেশের মানুষ আমাদের স্বীকার করে না৷ বহুকালের চেনাজানা মানুষদের মুখের ভাষা পালটাইয়া গিয়াছে৷ উহারা চায় আমরা যেন এখনই চলিয়া যাই৷ কেন যাইব সে-উত্তর নাই৷

বেশি দূরে নয় বাজ পড়ল৷ শিশির দেখতে পেল সন্ন্যাসীর মায়ের ঝলসানো দীর্ঘ দেহ নিমগাছের হেলানে খাড়া৷

মা লিখেছে: মহাজনের ঘর হইতে আমাদের দোকানে মাল আনিতে বাধা দেওয়া হইতেছে৷ পথে মালের গাড়ি আটকানো হইতেছে৷ পুরাতন খরিদ্দারদের ভয় দেখানো হইতেছে৷ ধারের টাকা আদায়ের আশা আর নাই৷ ধারের টাকা মিটাইতে নিষেধ করিতেছে পাড়ার গউণ্ডাপ্রকৃতির ছেলেরা৷ বারোপাল্লার দোকানের চারিপাল্লা পূর্বেই বন্ধ হইয়াছে৷ এরপর কী হয় ঈশ্বরই জানেন৷ অবিনাশ ভারতে চলিয়া যাইবে বলিয়া মনস্থ করিয়াছে৷ তাহার মেয়ে বড়ো হইয়াছে৷ সেদিনের ঘটনায় সে মর্মাহত৷ সন্তানের মতো ছেলেপুলেদের হাতে চড়চাপড় খাইতে হইবে ইহা সে কোনোকালে ভাবে নাই৷ সেলিম ভাইরা ভরসা দিতে পারিতেছেন না৷ প্রতিবেশীদের মতিগতি ভালো নহে৷ বিভিন্ন জায়গা হইতে খবর পাই হিন্দুরা দেশত্যাগ করিতেছে৷ কোনো কোনো পাড়া হিন্দুশূন্য হইয়াছে৷ আমাদের দেশ আর আমাদের জন্য নিরাপদ নহে৷

শিশিরবাবু, ব্যবস্থা কিছু তো করবেন৷ নাকি এই অবস্থা চলবে৷ শোবার জায়গায় জল, রান্নার জায়গায় জল৷ থাকি কীভাবে? তুলে দিতে চান? আমাদের তুলে দিয়ে বেশি ভাড়ার ভাড়াটে বসাবেন? ঘর মেরামত না হলে আমি আর ভাড়া দেব না, স্পষ্ট বলে দিলাম৷ ক্লাবের কিছু ছেলে আমাকেও চেনে৷

মা লিখেছে: পাড়ায় একটা দমবন্ধ ভাব৷ আমরা প্রায় নিঃসঙ্গ৷ হিন্দুঘর যাহারা আছে তাহারা আমাদের এড়াইয়া চলে৷ বুঝিতে পারি, তাহারা বাঁচিতে চায়৷ কিন্তু বাঁচিতে পারিবে কি? তোমার পিতাঠাকুর উমেশবাবুদের সঙ্গে কথা বলিয়াছিলেন৷ তাঁহারা হুঁ হাঁ করিয়া কাটিয়া পড়েন৷ বুঝা যাইতেছে আমাদের কোনো অপ্রীতিকর অবস্থায় পড়িতে হইলে কেহ আসিবে না৷ মোহনবাবু পরিষ্কার বলিয়া দিলেন, আমাদের ঘরের মেয়েরা বড়ো হইয়াছে৷ তাহাদের বিপদে ফেলিতে পারি না৷ আপনি তো আপনার পুত্রকন্যাকে ইন্ডিয়ায় আগেভাগে সুব্যবস্থা করিয়া রাখিয়াছেন৷ তখন তো আমাদের ঘরের কথা ভাবেন নাই৷ এইপ্রকার ভয়প্রদ অবস্থার মধ্যে আছি৷ তোমার পিতাঠাকুরের মতো শক্ত মনের মানুষও ভাঙিয়া পড়িতেছেন৷ তাঁরই নির্দেশে এই পত্র লিখিলাম৷ তোমাদের দুশ্চিন্তা বাড়িবে, জানি৷ তোমার পিতাঠাকুর কহিলেন, দেশ ছাড়িলে উপার্জন বন্ধ হইবে৷ ঘরবাড়ি বেচিয়া ন্যায্য দাম পাইবার সম্ভাবনা নাই৷ বারোপাল্লার দোকানও জলের দরে বেচিতে হইবে৷ নানারকম পাকেচক্রে ফেলিয়া উহারা ন্যায়সংগত দাম দিবে না৷ এইরকম অবস্থায় পড়িতে হইবে কখনো ভাবি নাই৷ জীবনের শেষভাগে আসিয়া এইরূপ হইল৷ ঠাকুর কপালে আরো কী লিখিয়াছেন কে জানে! আমরা ইন্ডিয়ায় গেলে কী অবস্থায় পড়িতে হইবে তাহাও তোমার পিতাঠাকুর ভাবিয়াছেন৷

শিশিরবাবু কি ঘরে আছেন? থাকলে একটু বাইরে আসেন৷ নিজের চোখে দেখে যান৷ বউদিমণিকে বলে কী লাভ! উনি তো আমাদের সুরাহা দিতে পারবেন না৷ দেখে যান জল পড়ে উনুনের মাটি গলে গেছে৷ দুটো ভাত-ডাল ফুটিয়ে নেবার উপায় নেই৷ কিছু মনে করবেন না আপনি নাটক ভালো করেন৷ আমরা নাটক করি না৷ ভাড়া দিই থাকি৷ আমাদের নাটকে নামালেন কেন? ভাড়া কম দিই এই অপরাধে? কত নাটক করেন৷ হাততালি পান৷ দশ-বিশটা টালি বদলে দিতে পারেন না৷

সন্ন্যাসীর মায়ের ঝলসানো দেহটা ভেসে ওঠে৷ শিশির ভাবে, ভাড়াটেরা যদি একসঙ্গে তার ঘরের দরজায় জড়ো হয়, সে কী করবে?

মা লিখেছে: তুমি রোজগারের ব্যবস্থা করিতে পারো নাই৷ চাকরির বয়স আর নাই৷ ব্যাবসা করিয়াছিলে৷ লোকসানে ডুবিয়াছ৷ তোমার স্ত্রী ও দুই কন্যা আছে৷ তাহাদের খরচ ভাড়ার টাকায় কোনোক্রমে এখন চলিয়া যায়৷ কন্যাদের লেখাপড়ার খরচ বাড়িলে চালাইবে কোন উপায়ে? তোমার স্বভাবের দরুন খুকুর ভালো বিবাহ হইতে পারে নাই৷ সে নিজে পাত্র বাছিয়া পালাইয়াছে৷ জামাইয়ের এখন চাকরি নাই৷ তাহাদের কীভাবে চলিতেছে ভগবানই জানেন৷ দোকানের অনেক টাকা তোমাকে দেওয়া হইয়াছে৷ সে-সবই কি নষ্ট করিয়াছ? তোমার পিতাঠাকুর আবার কিছু টাকা পাঠাইবেন৷ আশরফ সাহেবের হাতে৷ একমাত্র তিনিই আমাদের শুভানুধ্যায়ী৷ তিনি কথা দিয়াছেন দোকানের ভালো দাম মিলিবে৷ সম্ভবত তিনিই কিনিবেন৷ এই পত্রও তাঁহার হাতেই পাঠানো হইল৷ তুমি শীঘ্র একটা উপার্জনের ব্যবস্থা করো৷ মনে রাখিবে, গহনায় হাত দিবে না৷ কোনো কারণেই না৷

হাসিকে ও দুই নাতনিকে আমাদের শুভাশিস জানাইবে৷ পত্র দীর্ঘ হইল৷ তোমার পিতাঠাকুরের নির্দেশমত লিখিলাম৷
ইতি— আশীর্বাদিকা মা৷

তার মানে, হাসি ঘরে এসেছিল৷ চিঠি রেখে গেছে৷ শিশিরকে ডাকেনি৷ সাহস বেড়েছে৷ এরকম চিঠি আগেও এসেছে৷ তার কোনো একটি বা দু-টি কি পড়েছে হাসি? শিশিরই হাসিকে পড়তে শিখিয়েছিল। সে তখন বালিকা বধূ৷ সাহসটা তবে শিশিরই দিয়েছে?

আমি অতুলকথা বলছি:
বাজবাদলের দুপুরে শিশির চৌধুরীর ঘরের ভেতরকার ঘটনা শুনেছি কানুদার মুখে৷ গোলামালিকের ছেলে কানু দাশের সঙ্গে বিশেষ সখ্য ছিল শিশির চৌধুরীর৷ দু-জনে অস্থানে কুস্থানে যেত৷ টাকা জোগাত কানুদা৷ বাজবাদলের দুপুরের ঘটনার বিবরণে কিছু প্রক্ষেপ থাকতে পারে৷ যেমন, কানুদা নিজের মতো করে কিছু অংশ ঢুকিয়ে দিয়েছে৷ আমিও হয়তো কিছু মিশিয়েছি৷ শিশির চৌধুরীর স্ত্রী হাসিকে আমি বহুবার দেখেছি৷ খুবই সুন্দরী৷ মুখে সবসময় হাসি৷ কথা বলতে শুনেছি কমই৷ আর পাঁচজনের থেকে আলাদা৷ সন্ন্যাসীর মা-র দীর্ঘ ঝলসানো শরীর আমি দেখেছি৷ ভয়ংকর৷ চিঠিটাও হয়তো দেখেছি৷ কারণ, একটা প্রশ্ন আমার মাথার ভেতর মাঝে মাঝেই গুঁতো মারে, হিন্দু আর মুসলমানদের সম্পর্কটা হঠাৎই এতটা বিষিয়ে গেল? এতদিনের মানুষ পরিচয়টা মুছে গেল? এরকমটা হতে পারল কেন? শুধুই রাজনীতির প্রতিক্রিয়া? নাকি এতদিনের সম্প্রীতির ন্যারেটিভটা নিছক মনভোলানো?

Facebook Comments

পছন্দের বই