লেখক নয় , লেখাই মূলধন

প্রবন্ধ

মানস শেঠ

মিথ্রিডাটিয়ম: নীল রঙে মিশে গেছে ইতিহাস

“এ বিষের নাই রে শেষ!
শুরু শুধু আছে?—
কখনো থাকে এ বিষ দূরে
কখনো বা কাছে।”
— মাজু ইব্রাহিম

বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হয়েছে রাজার। খবরটা ছড়িয়ে পড়া মাত্রই রাজ্য জুড়ে শুরু হয়ে যায় চাপা গুঞ্জন— রানিই বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করেছেন রাজাকে। কারণ, অন্য কোথাও তো নয়, নিজের বিলাসবহুল ভোজনকক্ষেই মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে রাজাকে। রানি ছাড়া আর অন্য কারো পক্ষেই সেই ভোজনকক্ষে ঢোকা অসম্ভব। এমনই তর্ক বিতর্কতে উত্তাল রাজ্য। তবে রাজ্যের সবাই যে রানিকে খুনি ভাবছেন তা অবশ্য নয়। অনেকেই মনে করছেন, কোনো অজ্ঞাত আততায়ীর কাজও হতে পারে এটা।

কৃষ্ণ সাগরের দক্ষিণ তীর জুড়ে গড়ে উঠা পন্টাস রাজ্যের রাজা পঞ্চম মিথ্রিডাটিসের মৃত্যু রহস্যকে কেন্দ্র করে দেশ তখন সরগরম। কে হত্যা করলেন রাজাকে— সেই প্রশ্নে বিভক্ত রাজ্যবাসী। সেই রহস্য উদ্‌ঘাটন না হওয়ায়, তখন থেকেই আজও দ্বিধাবিভক্ত ইতিহাস।

খ্রিস্টপূর্ব ১২০ অব্দে বিষক্রিয়ায় যখন মৃত্যু ঘটে রাজা পঞ্চম মিথ্রিডাটিসের, তাঁর দুই পুত্র তখন নিতান্তই নাবালক ছিলেন। জ্যেষ্ঠ পুত্র মিথ্রিডাটিস্‌ ইউপাটরের বয়স তখন বারো। আর কনিষ্ঠ পুত্র মিথ্রিডাটিস্‌ ক্রেস্টাস্ তখন আরও ছোটো। রাজার মৃত্যুর পর, জ্যেষ্ঠ পুত্র মিথ্রিডাটিস্‌ ইউপাটরকে সামনে রেখে রানি লেয়ডাইসই হয়ে উঠলেন সাম্রাজ্যের সর্বময় কর্ত্রী। রানি লেয়ডাইস ছিলেন অত্যন্ত চতুর। রাজ্যের শাসন ভার হাতে পাওয়ার পর রানি বুঝতে পারেন, কয়েক বছর বাদে বড়োছেলে মিথ্রিডাটিস্‌ ইউপাটরই এই সিংহাসনের প্রকৃত দাবিদার হয়ে উঠে আসবে। রীতি মেনে, তাঁকে তখন ছাড়তে হবে এই গদি। প্রমাদ গুনলেন রানি। ক্ষমতায় টিঁকে থাকতে গেলে কত কিছুই না করতে হয় মানুষকে! জ্যেষ্ঠ পুত্র মিথ্রিডাটিস্‌ ইউপাটরকে হত্যার নকশা তৈরি করলেন রানি লেয়ডাইস। একদিন, কিশোর রাজকুমারের অজান্তে, পিছন থেকে বর্শা নিক্ষেপ করেন কেউ। বর্শা লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায় সে-যাত্রায় বেঁচে যান কুমার। কিছু দিন পর, একপ্রকার জোর করেই, একটা পাগলা ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে, যাতে ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে মৃত্যু হয় তাঁর। কিন্তু, সে-যাত্রায়ও বেঁচে যান তিনি। ঘোড়ার পিঠ থেকে তাঁকে পড়ে যেতে দেখেননি কেউই। তবে ঘোড়ার পিঠে চেপে সেই যে লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গেলেন কুমার, তারপর থেকে আর কোনো খোঁজই পাওয়া গেল না। এই সম্পর্কে দুটো মত পাওয়া যায়। প্রথম মতানুসারে, নিজের বিপদ বুঝে কুমার নিজেই রাজপ্রসাদ ত্যাগ করেন এবং আত্মগোপন করে থাকেন। দ্বিতীয় মত, জ্ঞাতি শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করতে, কুমারকে অজ্ঞাতবাসে পাঠান স্বয়ং রানি।

“কতটা বিষ গিলেছ নিজে?
তারপর সব কিছু করলে বিষাক্ত।
কতটা বিষ ছড়িয়েছ সুখে?
তারপর করলে আমাকে এত ক্ষতবিক্ষত।।”
— দীপেশ সরকার

অগত্যাই ছোটোছেলে মিথ্রিডাটিস্‌ ক্রেস্টাস্‌কে সামনে রেখে রাজকার্য পরিচালনার যাবতীয় দায়ভার নিজ হাতে তুলে নেন রানি লেয়ডাইস। এদিকে সময়ের সাথে সাথে, অজ্ঞাত কোনো এক স্থানে বেড়ে উঠতে থাকেন কিশোর মিথ্রিডাটিস্‌ ইউপাটর। তিনি বুঝতে পারেন তিনিই দেশের রাজা। রাজসিংহাসনের প্রকৃত দাবিদার। সেই দাবির জন্য এবার নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকেন তিনি। তিনি নিজেই বিপদসংকুল ভবিষ্যতের কথা বিলক্ষণ বুঝতে পারছেন। তিনি জানেন, কে বা কারা খাদ্যে বিষ মিশিয়ে হত্যা করেছেন তাঁর বাবাকে। বিষক্রিয়ায় বাবার মৃত্যু ভাবিয়ে তোলে কুমারকে। অস্ত্র নিয়ে সামনাসামনি মোকাবিলায় ভীত নন তিনি। কারণ, এখন তিনি একজন বীর যোদ্ধা হিসেবেই পরিচিত। তিনি চিন্তিত গুপ্তহত্যায়। কিশোর ইউপাটরের মনে সবচেয়ে আতঙ্ক তৈরি করেছে— গুপ্তহত্যা তথা বিষক্রিয়ায় মৃত্যু। সম্ভাব্য বিষক্রিয়া থেকে মুক্তির উপায় নিয়ে সারাক্ষণই ভাবতে থাকেন তিনি। বিষ প্রতিরোধ করতে পারে এমন কিছুর খোঁজ করতে শুরু করলেন তিনি। এই অজ্ঞাতবাসের দিনগুলোতেই বিভিন্ন ভেষজবিদের সাহায্য নিয়ে বিষ প্রতিষেধক প্রস্তুত করতে সচেষ্ট হলেন ইউপাটর। বিভিন্ন গাছের ছাল, মূল, পাতা, ফল, ফুল প্রভৃতি সংগ্রহ করতে থাকেন তিনি। সেই সমস্ত ভেষজকে কখনো বেটে, কখনো শুকিয়ে, কখনো গরম জলে ফুটিয়ে নানান মিশ্রন প্রস্তুত করতে শুরু করলেন। এই ধরনের নানান পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে এক সময়ে প্রস্তুত করেই ফেললেন এক বিষ প্রতিষেধক। এবার নিয়মিত সেই বিষ প্রতিষেধক ব্যবহার করতে শুরু করলেন তিনি। এই সমস্ত বিষ গ্রহণের ফলে প্রথম প্রথম ভীষণ রকমের অসুস্থ হয়ে পড়তেন তিনি। কিন্তু স্বল্পমাত্রায় নিয়মিত বিষ প্রতিষেধক নিতে নিতে ক্রমেই বিষ প্রতিরোধী হয়ে উঠেতে থাকেন। তিনি জানতে পারেন, তাঁর রাজ্যে ‘পন্টিক ডাক’ নামে এক ধরনের হাঁস আছে, যারা বুনো ও বিষাক্ত গাছপালা খেয়ে বেঁচে থাকে। বিষ প্রতিরোধের আশায় বিষাক্ত গাছপালার সাথে পন্টিক ডাকের রক্ত মিশিয়ে নিয়মিত গ্রহণ করতে শুরু করেন মিথ্রিডাটিস্‌ ইউপাটর। এছাড়াও এক জাতের বিষাক্ত মৌমাছির মধুও সেবন করতেন তিনি। এই সমস্ত বিষ গ্রহণ করে সর্ব অর্থেই বিষ প্রতিরোধী হয়ে উঠলেন তিনি।

খ্রিস্টপূর্ব ১১৩ অব্দ। সাত বছরের অজ্ঞাতবাস কাটিয়ে অবশেষে প্রকাশ্যে আসেন মিথ্রিডাটিস্‌ ইউপাটর। সোজা হাজির হলেন রাজধানী সিনোপ শহরে। দখল করলেন সিংহাসন। সিংহাসনে বসলেন রাজা ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিস্‌ হিসেবে। সিংহাসনে বসেই প্রতিশোধ নেন মায়ের উপর। বন্দি করেন রাজমাতা লেয়ডাইস এবং ভাই মিথ্রিডাটিস্ ক্রেস্টাস্‌কে। দেওয়া হয় কারাদণ্ড। হত্যা করতে থাকেন সিংহাসনের সম্ভাব্য সমস্ত দাবিদারদের। ১১৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দেই কারাগারে মৃত্যু ঘটে মা ও ভাইয়ের। কথিত, রাজার নির্দেশেই হত্যা করা হয় তাঁর মা ও ভাইকে। নিজের বংশে সিংহাসনের আর কোনো দাবিদার না রাখার লক্ষ্যে, নিজের বোন লেয়ডাইসকে (মায়ের মতো একই নাম) বিবাহ করেন তিনি।

“উগ্র বিষ শরীরে প্রবেশ করিলে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই তাহার চরম ফল ফলিয়া শেষ হইতে পারে, কিন্তু বিষ মনে প্রবেশ করিলে মৃত্যুযন্ত্রণা আনে— মৃত্যু আনে না।”
— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

এত কাণ্ডের পরও কিন্তু বিষ প্রয়োগে গুপ্তহত্যার ভয় থেকে নিষ্কৃতি পাননি রাজা ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিস্‌। নিজের রান্নাঘরে কড়া প্রহরার ব্যবস্থা করেন তিনি। নিয়োগ করেন রয়্যাল টেস্টার। খাবার চেখে দেখার জন্য। তাছাড়া আগের মতোই এখনও নিয়মিত সেবন করে চলেছেন বিষ প্রতিষেধক। কিন্তু তাতেও যেন নিজেকে বিপন্মুক্ত ভাবতে পারছেন না তিনি। নিজের নিরাপত্তা নিয়ে অনেক চিন্তাভাবনা করার পর, অবশেষে এক সর্ববিষ প্রতিষেধক প্রস্তুত করার কথা ভাবলেন তিনি। এই সর্ববিষ প্রতিষেধক হবে এমন এক মিশ্র ভেষজ, যা সমস্ত ধরনের বিষক্রিয়াকে প্রশম করতে সক্ষম হবে। সেই সর্ববিষ প্রতিষেধক প্রস্তুত করার জন্য তলব করলেন রাজবৈদ্য ক্রেটুয়াসকে। ক্রেটুয়াসকে জানালেন, সর্ববিষ প্রতিষেধক তৈরি করতে চান তিনি, আর এই বিষ প্রতিষেধক প্রস্তুতির দায়িত্ব নিতে হবে তাঁকে। রাজার ইচ্ছায়, সর্ববিষ প্রতিষেধক তৈরিতে ব্রতী হলেন ক্রেটুয়াস। ক্রেটুয়াস নিমগ্ন হলেন সর্ববিষ হরার প্রস্তুতিতে। নিরবিচ্ছিন্ন গবেষণা চালিয়ে অবশেষে তিনি সক্ষমও হলেন এক সর্ববিষহরা প্রস্তুত করতে। অচিরেই সেই সর্ববিষ প্রতিষেধক তুলে দিলেন তিনি রাজার হাতে। ক্রেটুয়াসের প্রস্তুত করা সেই সর্ববিষ প্রতিষেধক বা ইউনিভার্সাল অ্যান্টিডোট্‌স নিয়মিত গ্রহণ করতে শুরু করলেন রাজা ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিস্।

এক পরাক্রমশালী রাজা হিসেবেই ইতিহাসে বিধৃত হয়েছেন ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিস্‌। যুদ্ধক্ষেত্রে ও রণকৌশলে রাজা ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিস্ ভয়ংকর ছিলেন। রাজ্যভার গ্রহণ করার পরই রাজ্য বিস্তারে বিশেষ মনোযোগী হন ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিস্‌। প্রথমে আক্রমণ শানাতে থাকেন পার্শ্ববর্তী রাজ্য সমূহে। একে একে ছোটো বড়ো বিভিন্ন রাজ্য দখল করতে শুরু করেন তিনি। আনাতোলিয়া (তুরস্ক) অঞ্চলের রোমান মিত্র রাজ্যগুলো জয় করে ইজিয়ান সাগর তীরে রোমান রাজ্যের সীমানায় উপস্থিত হন ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিস্। এই সময়ে গোটা আনাতোলিয়া অঞ্চল নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করে ফেলেন তিনি। ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিসের হাতে রোমান মিত্রদের পরাজয় এবং পন্টাস রাজ্যের বিস্তারে চিন্তিত হয়ে পড়েন রোমানরা। ফলস্বরূপ খ্রিস্টপূর্ব ৮৯-৬৩ অব্দের মধ্যে তিনবার মিথ্রিডাটিসের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন রোমান সেনাদল, ইতিহাসে যা ‘মিথ্রিডাটীয় যুদ্ধ’ নামে খ্যাত। রোম সাম্রাজ্যের সীমা থেকে মিথ্রিডাটিসকে হঠাতে রোমান সেনাধ্যক্ষ লুসাস কর্নিলিয়স সুলার নেতৃত্বে বিশাল এক বাহিনী হাজির হয় পন্টাস রাজ্যের পশ্চিম সীমান্তে। শুরু হয় ‘প্রথম মিথ্রিডাটীয় যুদ্ধ’ (খ্রিস্টপূর্ব ৮৯-৮৫ অব্দ)। প্রাথমিকভাবে কিছুটা পিছু হঠেন মিথ্রিডাটিস্‌। পরে পালটা আঘাতও হানেন তিনি। ফলে, দীর্ঘস্থায়ী হল যুদ্ধ। বছর চারেক পর, খ্রিস্টপূর্ব ৮৫ অব্দ নাগাদ রোমান রাজ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে সেনাধ্যক্ষ সুলার রোম অভিমুখে যাত্রা করেন। একই সময়ে মিথ্রিডাটিসের বিজিত রাজ্যেও শুরু হয় বিদ্রোহ। ফলে উভয়পক্ষই যুদ্ধ বিরতিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। পরিণতিতে সমাপ্তি ঘটে প্রথম মিথ্রিডাটীয় যুদ্ধের। ঘরোয়া অবস্থা কিছুটা সামলানোর অনতিকাল পরেই আবার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন দু-পক্ষ। শুরু হয় ‘দ্বিতীয় মিথ্রিডাটীয় যুদ্ধ’ (খ্রিস্টপূর্ব ৮৩-৮২ অব্দ)। এই যুদ্ধে রোমানরা পিছু হঠতে থাকে এবং শেষপর্যন্ত পরাজিত হয় ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিসের কাছে। এরপর বেশ কিছুটা সময় শান্তই ছিল উভয়পক্ষ। খ্রিস্টপূর্ব ৭৩ অব্দে, পার্শ্ববর্তী বেথিনিয়া রাজ্যে নিজেদের পছন্দের উত্তরাধিকারকে মসনদে বসাতে গিয়ে ফের যুদ্ধে জড়িয়ে পরেন এই দুই রাজ্য। শুরু হয় ‘তৃতীয় মিথ্রিডাটীয় যুদ্ধ’ (খ্রিস্টপূর্ব ৭৩-৬৩ অব্দ)। দশ বছর ধরে চলল এই তৃতীয় মিথ্রিডাটীয় যুদ্ধ। এই যুদ্ধে রোমান সেনাদের নেতৃত্ব দেন সেনাধ্যক্ষ নিয়াস পম্পিয়স ম্যাগনাস, যিনি ‘পম্পি’ নামে অধিক পরিচিত। দীর্ঘ দশ বছর ধরে যুদ্ধ করার পর, মিথ্রিডাটিসের রণক্লান্ত সেনাবাহিনীর একাংশ বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। রাজ্যলাভের আশায়, পন্টাস রাজ্যের এই সেনা বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন মিথ্রিডাটিসেরই দুই পুত্র। মিথ্রিডাটিসের সেনারা আর যুদ্ধ করতে নারাজ। বরং এই যুদ্ধবাজ রাজার বিরুদ্ধে রোমানদের সাহায্য করতেই বেশি আগ্রহী তাঁরা। পরিণতিতে তৃতীয় মিথ্রিডাটীয় যুদ্ধে পরাজিত হন মিথ্রিডাটিস্‌। নিজের স্ত্রী-কন্যা ও নিকটজনদের নিয়ে রাজধানী সিনোপ ত্যাগ করে কৃষ্ণসাগরের উত্তর দিকে ক্রিমিয়া উপদ্বীপের প্যান্টিকাপিয়ম শহরের দুর্গে আত্মগোপন করেন তিনি। এদিকে মিথ্রিডাটিসের পালানোর সংবাদ পেয়ে তাঁর সন্ধানে নেমে পড়েন রোমান বাহিনী। তাঁকে বন্দি করতে প্যান্টিকাপিয়মে সেনা পাঠান পম্পি। প্যান্টিকাপিয়ম অভিমুখে রোমান সেনা অভিযানের খবর জানতে পারেন মিথ্রিডাটিস্‌। কিন্তু না, রোমানদের হাতে কিছুতেই ধরা দেবেন না তিনি। রোমানদের গ্রেপ্তারি এড়াতে সপরিবারে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেন মিথ্রিডাটিস্‌। নিজের সঙ্গে সবসময়েই কিছু পরিমাণে বিষ বহন করতেন মিথ্রিডাটিস্‌। সেই বিষ তিনি তুলে দিলেন তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের হাতে। রাজা ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিসের দুই মেয়ে— মিথ্রিডাটিস্‌ (পিতার মতো একই নাম) ও নাইসা, বিষ পান করে মৃত্যু বরণ করেন। তাঁর স্ত্রীও বিষপান করা মাত্রই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। অবশিষ্ট বিষের সবটাই পান করেন মিথ্রিডাটিস্‌ নিজে। সেই মারাত্মক বিষপান করেও মৃত্যু হল না তাঁর, দিব্যি বেঁচে রইলেন তিনি। নিয়মিত বিষ প্রতিষেধক গ্রহণ করে, এখন তিনি নীলকণ্ঠ। কোনো বিষই আজ আর বিষ বলে প্রতীয়মান হয় না তাঁর কাছে। সকল প্রকার বিষের প্রতিরোধী হয়ে গেছেন তখন তিনি। তাই মারাত্মক এই বিষ সেবন করার পরও দিব্যি বেঁচে রইলেন মিথ্রিডাটিস্‌। তবে বিষক্রিয়ার ফলে তাঁর শরীর তখন অবসন্ন, ক্লান্ত। দেহে আর শক্তি যেন নেই তাঁর। নির্জীব হয়ে নিজ শয়নকক্ষে পড়ে আছেন তিনি। কিন্তু বেঁচে আছেন। এদিকে রোমান সেনারাও শহরে ঢুকে পড়ল বলে। কিন্তু না, জীবন থাকতে রোমান সেনাদের হাতে ধরা দেবেন না তিনি। অগত্যাই তাঁর বিশ্বস্ত এক সেনাকে ডেকে মিথ্রিডাটিস্ নিজেকে হত্যা করার আদেশ দিলেন। অনুরোধেই হোক বা নির্দেশে, তাঁর অনুগত সেনার হাতেই শেষপর্যন্ত মৃত্যু বরণ করলেন রাজা ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিস্।

ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিসের মৃত্যুর পরই রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করেন রোমান সেনারা। রাজার ঘরে ঢুকে, মৃত রাজাকে উদ্ধার করেন তাঁরা। রাজার পাশে একটা পুঁথি উদ্ধার করেন রোমান সেনাদল, তাতে বেশ কয়েকটা বিষ প্রতিষেধক প্রস্তুতির উপায় লিপিবদ্ধ করা ছিল। সেনাধ্যক্ষ পম্পির হাতে সেই পুঁথি তুলে দেন রোমান সেনারা। পুঁথির গুরুত্ব বুঝে তা সযত্নে রক্ষা করেন সেনাধ্যক্ষ পম্পি। কিছুকাল পরে, তাঁর উদ্যোগেই এই পুঁথির রোমান অনুবাদ প্রকাশিত হয়।

“আমার ফণার মণি করিলাম উল্কাপিণ্ড তুলি
মহাকাল-করে জ্বালাময় বিষ-কেতন উঠিনু দুলি।
সেদিন আমারে প্রণতি জানাতে এলো কত নর-নারী,
বন্দিয়াছিল আমারে ভাবিয়া সাগ্নিক নভোচারি।”
— কাজী নজরুল ইসলাম

মিথ্রিডাটিসের মৃত্যুর পর, সাময়িকভাবে ইতিহাসের অন্তরালে চলে যায় এই সর্ববিষ প্রতিষেধকের ঘটনাটা। মিথ্রিডাটিসের মৃত্যুর প্রায় ১০০ বছর পর রোমান মেডিক্যাল এনসাইক্লোপেডিয়ার রচয়িতা অলাস কর্নিলিয়স সেলসাস (খ্রিস্টপূর্ব ২৬-৫০ খ্রিস্টাব্দ) তাঁর বিখ্যাত ‘দি মেডিসিনা’ গ্রন্থে ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিস্‌ ব্যবহৃত এই সর্ববিষহরার প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। এই গ্রন্থে এই সর্ববিষহরার উপকরণের বিশদ বিবরণও পেশ করেন তিনি। সেই সময়ে, মিথ্রিডাটিস্‌ ব্যবহৃত সর্ববিষহরার নাম হয়তো অনেকেই শুনেছিলেন, কিন্তু সেই বিষহরার উপাদান সম্পর্কে একেবারেই অন্ধকারে ছিলেন সবাই। সেলসাসের বই প্রকাশের পর থেকেই দ্রুত জনপ্রিয়তা তথা পরিচিতি লাভ করতে থাকে এই সর্ববিষহরা। অচিরেই, মিথ্রিডাটিসের নাম থেকেই এই সর্ববিষহরা ‘মিথ্রিডাটিয়ম’ নামে পরিচিতি লাভ করে। কোনো কোনো গ্রন্থকার আবার এই সর্ববিষহরাকে মিথ্রিডাটাম নামেও উল্লেখ করেছেন। মিথ্রিডাটিয়মে মোট ৩৬টা উপাদান আছে বলে উল্লেখ করেছেন সেলসাস। এই ৩৬টা উপাদানই ভেষজ তথা উদ্ভিজ। এর উপাদান হিসেবে এমন কিছু ভেষজের ব্যবহার দেখা যাচ্ছে, যা কেবলমাত্র মধ্যপ্রাচ্য বা ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলেই পাওয়া যায়। সেলসাসের বই প্রকাশের পর থেকেই মিথ্রিডাটিয়ম নিয়ে আগ্রহ বাড়তে থাকে আমজনতার। খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে রোমান সাম্রাজ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে মিথ্রিডাটিয়ম। অনেকেই ভাবতে থাকেন এই প্রতিষেধক সেবন করলে বুঝি সমস্তরকমের অসুখ থেকেও নিস্তার পাওয়া যাবে। দীর্ঘ ও সুস্থ জীবনের আশায় রাজা প্রজা নির্বিশেষে এই মহৌষধ সেবনের আগ্রহ প্রকাশ করতে থাকেন। কিন্তু কে বানাবে সেই মিথ্রিডাটিয়ম? ক্রেটুয়াসের মতো সেই কুশলী ওষুধ নির্মাতা কোথায়? তবু হাল ছাড়তে নারাজ অনেকেই। ফলে নতুন করে প্রস্তুত হতে লাগল মিথ্রিডাটিয়ম। অনেকেই সেই প্রস্তুত প্রণালিতে বড়োসড়ো পরিবর্তন আনলেন। বিষের তীব্রতা বাড়াতে অনেকেই আরও নতুন নতুন উপাদান যুক্ত করলেন। খ্রিস্টীয় প্রথম শতকেই মিথ্রিডাটিয়মের ৫৪ খানা উপাদানের কথা উল্লেখ করেছেন প্রখ্যাত রোমান ইতিহাসবিদ প্লিনি (২৩-৭৯ খ্রিঃ)। এই তথ্য থেকে এটা স্পষ্ট, ইতিহাসের একটা পর্যায়ে মিথ্রিডাটিয়ম প্রস্তুতিতে অত্যন্ত সক্রিয় ছিলেন বেশ কিছু মানুষ। তবে মিথ্রিডাটিয়ম প্রস্তুতিতে কেউ সফল হয়েছেন বলে শোনা যায়নি। কারণ, শুধু উপাদানের বর্ণনা থেকে তো আর কোনো ওষুধ বা রাসায়নিক পদার্থ তৈরি করা সম্ভব নয়। সেইসমস্ত ওষুধ বানাতে গেলে নির্দিষ্ট তাপ, চাপ, কতক্ষণ ধরে তা ফোটাতে হবে, কোনটা গুঁড়ো করে ব্যবহার করতে হবে, কোনটা গোটা ব্যবহার করতে হবে, সেইসমস্ত তথ্যও তো জানা প্রয়োজন। সব দিক বিবেচনা করে, আধুনিক মিথ্রিডাটিয়ম বিশেষজ্ঞরা তাই স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, মিথ্রিডাটিয়ম বানানো সম্ভব নয়। তাছাড়া মিথ্রিডাটিয়মের উপাদানগুলোর পরিমাপ লক্ষ করলে দেখা যাবে, কোনোটা ২৯ গ্রাম নেওয়া হয়েছে, তো কোনোটা ২৬.৬৬ গ্রাম, আবার কোনোটা ১.৬৬ গ্রাম নেওয়া হয়েছে। আজ থেকে অত হাজার বছর আগে, এত সূক্ষ্ম পরিমাপ করা যে, কীভাবে সম্ভব হল, তা অনুমান করা কিন্তু বেশ কষ্টকর।

চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক প্রাচীন এবং চিত্তাকর্ষক বিষয় বিষবিদ্যা বা টক্সিকোলজি। সাপের বিষ, মাকড়সার রস, আর্সেনিকাদি খনিজ বিষ, হেমলক জাতীয় ভেষজের সাথে দীর্ঘদিনের পরিচয় মানুষের। ইতিহাস বলছে, মিথ্রিডাটিসের সমসময়ে রোম, গ্রিস, এশিয়া মাইনর অঞ্চলে বিষপ্রয়োগে গুপ্তহত্যা ছিল বহু রাজপরিবারের ইতিহাসের অঙ্গ। কোনো সন্দেহ নেই যে, সেইসমস্ত রোমহর্ষক মৃত্যুগুলোর সাথে একসঙ্গে ঠাঁই পাবে ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিসের মৃত্যুও। ইতিহাসের গর্ভে থেকে যায় কত বিষাক্ত ইতিহাস।

গ্রন্থঋণ:
1. ‘The Poison King: The Life and Legend of Mithradates, Rome’s Deadliest Enemy’, Adrienne Mayor, Princeton University Press, 27 March 2011.
2. ‘Mithridates the Great: Rome’s Indomitable Enemy’, Philip Matyszak, Pen & Sword Military, Reprint Edition, 1st March, 2016.

মানস শেঠ

মানস শেঠের জন্ম হুগলি শহরের ১৩ ই ফাল্গুন ১৩৯৩ বঙ্গাব্দের বৃহস্পতিবার। প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষা হুগলি শহরে হলেও, বাংলা সাহিত্যে স্নাতক(২০০৮) এবং স্নাতকোত্তর (২০১০) বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দির থেকে। পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন শিক্ষকতা। প্রবন্ধ লেখার সলতে পাকানোর ক্ষেত্র ছিল বিদ্যামন্দির পত্রিকায়। এরপর বেশ কিছু প্রবন্ধ প্রকাশ পায় ‘সাপ্তাহিক বর্তমান’ পত্রিকা সহ কিছু বাণিজ্যিক পত্রিকায়। বিভিন্ন বিষয় নিবন্ধাবলী প্রকাশ পায় ‘দিগন্ত’, ‘বার্ণিক’, ‘তবু একলব্য’, ‘নির্মুখোশ’, ‘চতুষ্কোণ’, ‘শিল্পনীড়’ প্রভৃতি ম্যাগাজিনে। প্রথম প্রকাশিত প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘ধুলোর চাদর’ (২০১৭) এর জন্য পেয়েছেন ‘বার্ণিক সাহিত্য সম্মান’ (২০১৮)। আরেকটি গ্রন্থ ‘বাংলার চড়ক ও গাজন উৎসব এবং অন্যান্য’ (২০১৯) প্রকাশ পেয়েছে ‘পরম্পরা’ প্রকাশন থেকে।

পছন্দের বই