লেখক নয় , লেখাই মূলধন

লোকজ উৎসব

মনোরঞ্জন উরাও

ওঁরাওদের কয়েকটি উৎসব

কথায় আছে ‘বারো মাসে তেরো পার্বণ’, ওঁরাওদের ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনই ঘটে থাকে। ওঁরাও সমাজের মানুষেরা সাধারণত উৎসব প্রিয় হয়। অন্যান্য উপজাতিদের মতো এরাও জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নানান সংস্কার ও বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে বিভিন্ন ধরনের আচার অনুষ্ঠান পালন করে। ওঁরাওদের কয়েকটি বিশেষ উৎসব হল— করম পূজা, আষাঢ়ী পূজা, বড়ভূত বা মান্‌খা পূজা, সহরাই বা গোয়াল পূজা, পুনামাণ্ডী, সারহুল, ভেলোয়া ফারী বা ডাণ্ডাকাট্টানা, খারিয়ানি ও ফাগুয়া পূজা প্রভৃতি। তবে ওঁরাও সমাজে সমস্ত পুজো পার্বণে ‘ভেলোয়া ফারী বা ডাণ্ডাকাট্টানা’ নামক অনুষ্ঠানটি পালন করে থাকে। পুজো পদ্ধতি এক এক জায়গায় এক এক রকম হয়ে থাকে। মূলত ওঁরাও সমাজের মানুষেরা প্রকৃতি পূজারি। প্রকৃতির মধ্যেই ঈশ্বরকে অনুভব করে। এই সমাজের নব্বই সতাংশই কৃষিজীবি। তাই তাদের বেশিরভাগ পুজো-পার্বণ হয় বৃক্ষ এবং ফসলকে কেন্দ্র করে।

করম বা কারাম উৎসব:

ওঁরাও সমাজে একটি অন্যতম জনপ্রিয় উৎসব হল ‘করম বা কারাম উৎসব’। ভাদ্রমাসের শুক্লাপক্ষের একাদশী তিথিতে এই উৎসব উদ্‌যাপিত হয়। এটি মূলত প্রকৃতির পূজা তথা গাছের পূজা। করম পুজোর সাতদিন আগে থেকে ওঁরাও সমাজের কুমারী মেয়েরা দাতন ‘কাঠিগেঙে’ নদী বা পুকুরে স্নান করে বাঁশ বোনা ছোটো টুপা বা ডালা বালি দিয়ে ভরতি করে। তারপর গ্রামের প্রান্তে এক জায়গায় ডালাগুলিকে রেখে ‘জাওয়া’ গান গাইতে

করম পূজা, ছবি: গুগল

গাইতে তিন পাক ঘোরে। এর পর তেল ও হলুদ দিয়ে মোটর, মুগ, ছোলা, কুর্তী ও ভুট্টা বীজ মাখানো হয়। এসব কাজ কুমারী মেয়েরা করে থাকে। একে ‘জাওয়া মা’ বলে।

গ্রামের বয়স্কদের নির্দিষ্ট করা একটি জায়গায় দু-টি করম ডাল এনে পুঁতে রাখা হয়। যা সন্ধ্যার পরে করম ঠাকুর বা ধরম ঠাকুর হিসাবে পূজিত হয়। করম পুজোর দিন করম গাছকে নতুন কাপড় পরিয়ে গাছকে আলিঙ্গন করে, ধূপ ও সিঁদুর দিয়ে পূজো করে ডাল কাটার অনুমতি প্রার্থনা করতে হয়। তারপর নতুন কপড় পরে উপবাসী তিনজন যুবক তিনটি ডাল কেটে নিয়ে আসে। একই ভাবে নববস্ত্র পরিহিত তিন জন কুমারী মেয়ে যুবকদের কাছ থেকে ঐ ডাল উপাসনা দেবীর কাছে নিয়ে আসে। ওঁরাও সমাজের পুরোহিত তথা মাহাত সেগুলো নিয়ে পূজা অর্চনা শুরু করে।

কুমারী মেয়েরা করম পুজোর দিনে সারাদিন উপবাস করে সন্ধ্যার পর একটি থালায় ফুল ফল-সহ পুজোর নৈবেদ্য সাজিয়ে করম ডাল যেখানে আছে সেখানে গিয়ে পুজো দেন। ঐ সময় ওঁরাও রমণীরা গানের মাধ্যমে ধরিত্রী তথা বসুমাতা তথা ভূমিদেবীর কাছে প্রার্থনা জানায় যে, এ-বছর যেন ভালোভাবে বৃষ্টি হয়। ফসলে যেন পোকা না হয়। ফসল যেন ভালো হয়। এছাড়াও সকল পরিবারের সুখ সমৃদ্ধিও কমনা করে থাকে। পূজার মাহাত পূর্ব উল্লেখিত ধর্মা কর্মার গল্প সকলকে শুনিয়ে থাকে। সেইসঙ্গে সারারাত ধরে চলে নাচ গান।

পরের দিন সকালে মেয়েরা ‘জাওয়া’ থেকে অঙ্কুরিত বীজ গুলোকে তুলে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে বাড়িতে নিয়ে এসে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দেন। এরপর করম গাছটিকে জলে ভাসানো হয়ে থাকে। পুজোর পরে মেয়েরা পরস্পরকে করম ডোর বা রাখি পরিয়ে দেন।

আষাঢ়ী পুজো:

আষাঢ় মাসে জমিতে বীজ বপনের আগে এই উৎসব হয়। মূলত বৃষ্টির উদ্দেশে এই পূজা করা হয়। গ্রামের সকলে মিলে এই পুজো করে থাকে। আষাঢ় মাসে এই পুজো হয় বলে একে আষাঢ়ী পুজো বলে। ওঁরাও সমাজের বেশিরভাগ লোক কৃষিজীবি। তাই তারা জমিতে হালচাষের আগে ভূমিমাতাকে হিসাবে পুজো করে থাকে। ওঁরাও সমাজের কারো মতে মাটির নীচে থাকা অনেক ছোটো ছোটো জীব তাদের নাঙলের আঘাতে মারা যায়। তাই ধরিত্রী মাকে সন্তুষ্ট করার জন্য এই পূজা। এই পুজোর উপকরণ হিসাবে থাকে কলা, বাতসা, আম, কাঁঠাল, জবাফুল, দুব্বা ঘাস, আতপচাল। পায়রা, ছাগল, পাঠাও বলি হয়। এই দিনে ঘর বাড়ি গোবর-মাটি দিয়ে মোছার পর একটি পুরোনো কুলোর মধ্যে ঝাটা, গোবরের তৈরি ঘুটোতে আগুন ধরিয়ে তাতে কয়েকটি শুকনো লঙ্কা ছিটিয়ে বড়োরা বাচ্চাদের গায়ে হালকা ধোঁয়া দেয়। তাদের বিশ্বাস এতে অশুভ শক্তির আক্রমণ থেকে বাচ্চারা রক্ষা পাবে।

পাড়ার মহিলারা (মা অথবা দিদা) সেই পুরোনো কুলোয় ঝাটা-সহ গোবরের ঘুটো রাখা কুলোটি বাড়ি থেকে দূরে ফেলে আসে। তারপর সকলে পুকুরে স্নান করে বাড়ি ফেরে।

সোহরাই বা গোয়াল পূজা:

ওঁরাওদের আর একটি উৎসব হল ‘সোহরাই পরব’ বা ‘গোয়াল পূজা’। সোহরাই পরবটি কার্তিক মাসের কালি পুজোর পরের দিন পালন করা হয়। বিশেষ করে সেই দিনে বাড়ির গৃহপালিত পশু,
দিন পালন করা হয়। বিশেষ করে সেই দিনে বাড়ির

সোহরাই বা গোয়াল পূজোর ছবি, ছবি : গুগল

গৃহপালিত পশু, অর্থাৎ, গোরু ছাগলদের পূজা দেওয়ার রীতিই হল সহরাই পরব। এই দিন সকাল থেকে এই পুজো শুরু হয়। সেই দিন ঘরবাড়ি গোবর দিয়ে মুছে গোয়াল ঘর থেকে বাইরের আঙিনা পর্যন্ত চালের গুড়ো দিয়ে আলপনা দেওয়া হয়। আলপনার মাঝে সিঁদুরের ফোঁটা দেওয়া হয়। সেই দিন গোরু ছাগলদের পুকুরে স্নান করান হয়।

মোটর, ছোলা, মাসকলাই, এবং চাল-সহ সেদ্ধ করা হয়। যাকে ওঁরাওদের ভাষায় ‘দানাভাত’ বলে। পুজোর দিন সকালে গোরু ছাগলকে স্নান করিয়ে সর্ষের তেল মাথায় সিঁদুর দেওয়ার পর দানাভাতের সঙ্গে হাড়িয়ার জল পাত্রে নিয়ে প্রত্যেক গোরু ছাগলকে একটু একটু করে খাওয়ানো হয়। তারপর বাড়ির সকলে প্রসাদ হিসাবে দানাভাত মুখে দেয়।

একটি লাল মোরগ গোয়াল ঘরে বলি দেওয়া হয়। তারপর সেই মোরগের মাংস দিয়ে গোয়াল ঘরে খিচুড়ি রান্না করে খাওয়া হয়। ওঁরাও সমাজের প্রচলিত রীতি অনুযায়ী এই খিচুড়ি বাড়ির সকলের না-খাওয়া পর্যন্ত কাউকেই বিতরণ করা যাবে না। পুজোর শেষে চলে বাড়ির বয়স্কদের হাড়িয়া খাওয়া। এভাবেই পূজা সম্পন্ন হয়।

ডাণ্ডা কাট্টানা বা ভেলোয়া ফারি উৎসব:

ডাণ্ডা কাট্টানা একপ্রকার শুদ্ধিকরণ উৎসব। ওঁরাও সমাজের সবক্ষেত্রেই সকল বিষয়েই পবিত্রতা রক্ষা করে চলা আবশ্যক। তাই প্রতিটি শুভ কাজে তারা ডাণ্ডাকাট্টানা পূজা করে থাকে। নতুন বাড়ি তৈরি থেকে শুরু করে গৃহপ্রবেশ বা যে-কোনো শুভ কাজের সূচনাতে যেমন নারায়ণ পূজা বা সত্যনারায়ণ পূজা করা হয় তেমনই ওঁরাওরা ‘ডাণ্ডা কাট্টানা’ অনুষ্ঠান করে থাকে।

এই অনুষ্ঠান যে-কোনো দিন সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয়ের মধ্যে করা হয়। ওঁরাওরা তাদের যে-কোনো শুভ কাজের প্রারম্ভে, অর্থাৎ, বিবাহ অনুষ্ঠান, সদ্যজাত শিশুর আঁতুর, শ্রাদ্ধ, করম পার্বনের সমাপ্তিতে ভোর রাত্রে, শস্য ঝাড়াই-এর পর, বাঁধ নির্মান, পুকুর খনন, কুয়ো খনন, গৃহনির্মাণ, গৃহপ্রবেশ প্রভৃতি কাজের সূচনাতে এই শুদ্ধিকরণ অনুষ্ঠান করে থাকে। ডাণ্ডা কাট্টানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তারা ধার্মেস (ঈশ্বর), চালা আয়ো (ধরিত্রী মাতা), বিইড়ি বেলাস (সূর্যদেব), তাদের পূর্বপুরুষ ও অন্যান্য দেবদেবীর পুজো করে থাকে।

তাদের বিশ্বাস এই অনুষ্ঠান কেউ না করলে, সে অশুচি থেকে যায়। সমাজের কোনো মানুষের সঙ্গে মেলামেশা বা কোনো প্রকার শুভ কাজে কিংবা কোনো পুজো পার্বনে অংশ গ্রহণ করতে পারে না। সংসারের সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি প্রাপ্তির জন্য এবং গ্রহের প্রতিকূল প্রভাব থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য এই শুদ্ধিকরণ অনুষ্ঠান করা উচিত বলে তারা মনে করে।

জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ ও অন্যান্য শুভকর্ম অনুযায়ী ডাণ্ডা কাট্টানার পদ্ধতি যেমন ভিন্ন তেমনই পুজোর সামগ্রী বিসর্জন দেওয়ার নিয়মও আলাদাভাবে পালিত হয়ে থাকে। এই পুজোর প্রয়োজনীয় উপকরণগুলো হল— একটি নতুন কুলা, আতপচাল, উনুনের পোড়া মাটি, একটি দেশি মুরগির ডিম, একটি মাটির প্রদীপ, কাঠকয়লার গুঁড়ো, কাঁঠাল পাতার তিনটি ঠোঙা, আতপ চালের গুড়ি, দেশি মদ বা হাড়িয়া, এক ঘটি জল ও ভেলোয়া কাঠি বা চিরচিটি গাছ (লঙ্কা গাছের মতো ছোটো গুল্মজাতীয় গাছ) ইত্যাদি।

বয়স্ক ব্যক্তিরাই এই পুজোতে অংশগ্রহণ করে থাকে। গোবর দিয়ে নিকানো পরিষ্কার জায়গায় ওঁরাও পুরোহিত পূর্ব দিক মুখ করে আসন পেতে বসে। তার পেছনে দুই দিকে বসে বয়স্ক ব্যক্তিরা। পুরোহিত নিজের কোলে একটি কুলো বসিয়ে তার মধ্যে আতপচাল ও ডিম রাখে। তার আগে লাল, সাদা, কালো রং ব্যবহার করে নিম্নের নকশা অনুযায়ী ডাণ্ডা কাট্টানার চিত্র আঁকা হয়। এই রং গুলোর এক একটি অর্থ আছে। একটি রং আরাধ্য দেব-দেবীর আহ্বান বা বিতাড়ন হিসাবে ব্যবহৃত হয়। ডাণ্ডা কাট্টানা চিত্রের মাঝখানে পূর্ব পশ্চিম লম্বা করে ভেলোয়া দণ্ড রাখা হয়। এই ভেলোয়া দণ্ডের মাঝখানে আতপ চাল গুড়োর ঠোঙাটি রাখা হয়। এর পর ওঁরাও পুরোহিত আতপালের মাঝখানে ডিমটি রেখে মন্ত্রপাঠ করতে থাকে। পুজো শেষে আতপচাল গুড়ির সঙ্গে ডিম মিশিয়ে উনানের আঁচে সিদ্ধ করে প্রসাদ বানানো হয়। এই প্রসাদ সকলের মধ্যে বিতরণ করা হয় কিন্তু এই প্রসাদ মহিলাদের গ্রহণ করা নিষিদ্ধ।

ডাংরী উৎসব:

ডাংরী পরবটি ফাল্গুন মাসে কেঁচো মাটি থেকে বের হওয়ার আগে করা হয়। এই অনুষ্ঠানে বয়স্ক বুড়ি ছাগল বলি দেওয়া হয়। ওঁরাও সমাজে এই অনুষ্ঠানটি করে বাড়ির সকলে সুস্থ থাকার জন্য। ওঁরাওরা মনে করে ডাংরী পুজো করলে বাড়ির সকলে রোগ মুক্ত হয়। কালী মায়ের নামে ডাংরী পরবটি করা হয়। এই অনুষ্ঠানের দিন পুজোর সমস্ত উপকরণ একসঙ্গে একটি পাত্রে সাজিয়ে নিয়ে বাড়ির বাইরে খোলা মাঠে গিয়ে পূজা শুরু হয়। পুজোর পর বুড়ি ছাগলের মাংস খিঁচুড়ি বানানো হয়। তারপর খোলা মাঠে নিমন্ত্রিত সকলকে প্রসাদ হিসাবে খেতে দেওয়া হয়। সকলের খাওয়ার পর অবশিষ্ট খাওয়ার বাড়িতে নিয়ে যাওয়া নিষিদ্ধ ওঁরাও সমাজে। বয়স্ক পুরুষ ও মহিলারা খোলা মাঠে বসেই হাড়িয়া পান করে।

পুনামাণ্ডী পরব:

পুনামাণ্ডী পরবটি অগ্রহায়ণ মাসে ধান কাটার আগে করা হয়। বয়স্ক পুরুষরা সকলে মিলে এই পরবের দিন ঠিক করে। পুজোর দিনে ঘরবাড়ি গোবর এবং মাটি দিয়ে মোছার পর আঙিনায় লালমাটি এবং চালের গুড়ো দিয়ে আলপনা দেওয়া হয়। এই পুজোতে মাটির তৈরি হাঁড়ি, কলসি, ছোটো হাঁড়ি, বাঁশের তৈরি কুলা এবং ঝাটার প্রয়োজন হয়। এই উপকরণগুলো আলপনা দেওয়া স্থানটিতে সাজিয়ে রাখা হয়। তারপর বাড়ির বড়োরা একটি থালায় কলা, বাতাসা, ধূপ, সিঁদুর এবং একটি ধান কাঁটা যন্ত্র নিয়ে নিজের জমিতে পুজো দিয়ে একগোছা ধান মাথায় করে নিয়ে পাট্টায় মারা হয়।

খারিয়ানি উৎসব:

একটি পারিবারিক উৎসব হল ‘খারিয়ানি উৎসব’। খারিয়ানি উৎসবটি মাঘ ফাল্গুন অথবা বৈশাখ মাসে পালন করা হয়। এই পরবে প্রধান উপকরণ হিসাবে একটি সাদা মোরগ এবং একটি কালো মোরগ প্রয়োজন। পুজোর দিন বাড়ির বড়োরা উপবাস করে। এটি পরিবারের নিজস্ব পুজো। ঘরের এককোণে মোরগদুটোকে পুজো করে বলি দেওয়া হয়। তারপর সেই বলি দেওয়া দুটো মোরগ দিয়ে আলাদা আলাদাভাবে দুই জায়গায় খিঁচুড়ি বানানো হয়। কালো মোরগের মাংস দিয়ে বানানো খিঁচুড়ি পরিবারের সকলে খান এবং সাদা মোরগের মাংস দিয়ে বানানো খিঁচুড়ি পাড়ার সকলকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানো হয়।

দাসাই কারাম:

দাসাই কারাম উৎসবটি দুর্গাপূজার দশমীর দিনে করা হয়। চালের গুঁড়োর তৈরি তেলের পিঠে, হাড়িয়া, ধূপ, সিঁদুর ও তিনটি কলাপাতা ইত্যাদি সামগ্রী প্রয়োজন হয়। দাসাই কারাম পরবটি অনুষ্ঠিত হওয়ার এক মাস আগে থেকে গ্রামের নাচের আসরে ছোটো বড়ো সকলে সন্ধ্যায় খাওয়ার পর ঢোল মাদল নিয়ে নাচ গান করে। এইভাবে একমাস ধরে চলতে থাকে নাচ গান। পুজোর দিন সন্ধ্যা বেলা চালের গুঁড়োর তৈরি তেলের পিঠে প্রসাদ রূপে তিনটি কলাপাতায় করে পুজোর স্থানে রেখে ধূপ, সিদুর, ও হাড়িয়া দিয়ে বাড়ির বয়স্ক ব্যক্তিরা পূর্বপুরুষের নাম উচ্চারণ করে পুজো দেন। গ্রামের সকলে পুজো সেরে তেলপিঠে এবং বড়োরা হাড়িয়া খেয়ে নাচের আখড়ায় সমবেত হয়ে মাদল ও ঢোল বাজিয়ে নাচ গান করেন।

কাড়াভূত পূজা বা মানখা পূজা:

ওঁরাও সমাজের একটি শরীক বা বংশকেন্দ্রিক উৎসব হল ‘কাড়াভূত’ পূজা বা ‘মানখা পূজা’। এই পূজায় প্যারা বা মহিষ বলি দেওয়া হয়। ‘ওঁরাও’ ভাষায় মানখা শব্দের অর্থ মহিষ। এই পূজা সাধারণত এক যুগ, অর্থাৎ, বারো বছর পর একবার করা হয়। এই পূজা কোনো পরিবারে একবার করলে তিনপুরুষ করতে হয় না। এটি একটি শরীক বা বংশের পূজা। বংশ পরম্পরায় এই পুজো ওঁরাও সমাজে চলে আসছে। যে-কোনো মাসের অমাবস্যা রাতে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। সকলের সুখ, শান্তি, অসুখ এড়ানো, অভাব অনটন থেকে মুক্তি আশায় এই পূজা করা হয়। ওঁরাও মাহান এই পূজা করে থাকে। মাহান মহিষটিকে বস্ করে। ওঁরাও মাহান মহিষটিকে মন্ত্র করে মাঠে ছেড়ে দেয়। তারপর মহিষটি একাই পূজা স্থানে চলে যায়। এভাবেই এই উৎসবটি সম্পূর্ণ হয়। একে খুঁটি পূজাও বলে।

এছাড়াও ওঁরাও সমাজে জন্ম, বিবাহ এবং মৃত্যু সংস্কারকে কেন্দ্র করে কিছু উৎসব পালন করা হয়। শ্রাদ্ধকর্মের সময় বাড়ির সকল পুরুষ, শিশুর মস্তক-মুণ্ডন করে টিকি রাখা ওঁরাও সমাজের রীতিতে আছে। কিন্তু বর্তমান কালে বয়স্ক পুরুষরাই ছোটো মাপের ঠিকি রাখে। মহিলাদের প্রসবের ষষ্ঠ দিনে বাচ্চাদর মাথার চুল নেড়া করে প্রসূতিকে স্নান করিয়ে সুদ্ধ করা হয়। কাটা চুল কলার ভেলায় রেখে গঙ্গা দেবীর নামে নদীতে, পুকুরে বা ডোবায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়। তারপর নামকরণের বিচিত্র অনুষ্ঠান পালন করা হয। কলার ভেলায় রেখে জলে ভাসিয়ে মাতৃবংশ ও পিতৃবংশের নামে আতপচাল ফেলে ‘জোড়ালাগান’ খেলে শিশুর নাম রাখা হয়। ওঁরাও সমাজে শুভ ক্রিয়া-কর্মে ধাতুর পাত্র ব্যবহার নিষিদ্ধ। অশুভ শক্তির নজর এড়াবার জন্য শিশুর কোমরে কালো সুতোর সঙ্গে চামড়া, লোহার পাত বা গাছের শেকড় বেঁধে দেওয়ার রীতি রয়েছে। একবছর বয়স হলে কন্যা সন্তানের কান ফুটো করা সামাজিক রীতি। পুত্র সন্তান বিবাহের উপযোগী হলে আগুয়া (ঘটক) মারফত ছেলের পিতা কন্যা বাড়িতে সংবাদ পাঠায়। কন্যার পিতা স্থান-দিন নির্ণয় করে আগুয়ার (ঘটক) মধ্য দিয়ে বিয়ের কথা চলতে থাকে। বিবাহের কথা চলাকালীন কন্যার গোত্র ও ছেলের গোত্র দু-পক্ষেরই জেনে নেওয়া খুব প্রয়োজন। একই গোত্রের বিবাহ নিষিদ্ধ। গোত্র এক হলে ধরে নেওয়া হয় যে, পূর্বে কোনো কালে তাদের পিতৃবংশ ও মাতৃবংশ একই পরিবারের একই মায়ের গর্ভজাত সন্তান ছিল। কোনো এক কালে তাদের পূর্ব পিতৃবংশ ভাই-দাদা ছিল। গোত্র এক হলে ওঁরাও সমাজের বিশ্বাস নতুন যুবক-যুবতী একই মাতৃ গর্ভজাত সন্তান, অর্থাৎ, ভাই-বোন সম্পর্ক।

সাক্ষাৎকার

১. রবি এক্কা, বয়স ৫০, গ্রাম কাজীভাগ, তপন দঃ দিনাজপুর।

২. ঝারিয়া কুজুর, বয়স ৫৮, গ্রাম ফুলবাড়ি, গঙ্গারামপুর দঃ দিনাজপুর।

৩. অজিত লাকড়া, বয়স ৪৫, গ্রাম কাজীভাগ, তপন দঃ দিনাজপুর।

৪. বন্ধন লিণ্ডা, বয়স ৬২, বালুরঘাট, দঃ দিনাজপুর।

৫. মুংলী কুজুর, বয়স ৪৬, গ্রাম বুধইচ, তপন দঃ দিনাজপুর।

 

Facebook Comments

পছন্দের বই