লেখক নয় , লেখাই মূলধন

অনুবাদ

মার্সেল প্রুস্ত

স্মৃতি
[Memory]

ভাষান্তর: সঞ্চয়িতা পাল চক্রবর্তী

খয়েরি উর্দি ও সোনালি বোতামে সজ্জিত একজন চাকর বেশ শীঘ্রই দরজাটি খুলে দিল এবং আমাকে একটি ছোটো বসার ঘরের দিকে এগিয়ে দিল— যে-ঘরে ছিল পাইন কাঠের প্যানেলের কাজ, দেওয়ালে ঝোলানো ছিল ছাপা সুতির কাপড় এবং যে-ঘর থেকে সমুদ্র দেখা যেত। আমি সেই ঘরে ঢুকতেই এক বেশ সুপুরুষ তরুণ উঠে দাঁড়ালেন, আমাকে শীতলভাবে অভ্যর্থনা জানালেন এবং আবার নিজের আরামকেদারায় বসে, ধূমপান করতে করতে খবরের কাগজ পড়তে লাগলেন। আমি একটু অস্বস্তির মধ্যে দাঁড়িয়েই রইলাম, বলা যায় আমি এখানে কী অভ্যর্থনা পেতে চলেছি সেটাই ভাবতে লাগলাম। এতগুলো বছর পরে, এই বাড়িতে এসে আমি কি ঠিক কাজ করলাম, যেখানে তাঁরা হয়তো অনেক আগেই আমাকে ভুলে গেছেন? এই আতিথ্যময় বাড়িটি যেখানে আমি আমার জীবনের সবচেয়ে সুখের, গভীর, কোমল মুহূর্তগুলি কাটিয়েছি?

বাড়ির চারপাশের যে-বাগানটি এবং একদিকে তৈরি হওয়া সেই অলিন্দটি, চিত্র-বিচিত্র চিনামাটির পাত্রে সজ্জিত ও খোদাই করা লাল ইটের দুই মুরুজ, লম্বা আয়তাকার জানালাগুলো যেখানে আমাদের বর্ষার দিনগুলি কাটিয়েছিলাম এবং এমনকী এই ছোট্ট বসার ঘরের সাজসজ্জাও— যেখানে আমাকে এখুনি নিয়ে আসা হল— কিছুই পালটায়নি। কতক্ষণ পরে এক সাদা দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ লোক অবিন্যস্তভাবে ঢুকলেন। তিনি বেঁটে এবং কুঁজো। তাঁর অনিবিষ্ট দৃষ্টি তার মধ্যে এক নির্মোহ অভিব্যক্তি এনেছিল, আমি তখনই মসিয়ে দে এন-কে চিনতে পেরেছিলাম। কিন্তু তিনি আমাকে চিনতে পারলেন না। আমি অনেকবার আমার নাম বললাম: কিন্তু তাঁর কোনো স্মৃতি উঠে এল না। আমার আরও বেশি অস্বস্তি হতে শুরু করল। আমাদের দৃষ্টি যেন আটকে গেল, আমরা কী বলব কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আমি বৃথাই তাঁকে কিছু সূত্র দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম: তিনি আমাকে সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়েছেন। আমি তাঁর কাছে একজন অচেনা মানুষ।যেই আমি চলে যাচ্ছিলাম, দরজাটি খুলে গেল: “আমার বোন ওডেট”, একটি দশ-বারো বছরের মিষ্টি মেয়ে তার নরম সুরেলা ভাষায় বলে উঠল, “আমার বোনের এক্ষুণি মনে পড়ল যে, আপনি এখানে ছিলেন। আপনি কি এখানে এসে ওঁর সঙ্গে দেখা করতে চান? তাতে তিনি খুব খুশি হবেন!” আমি ছোট্ট মেয়েটিকে অনুসরণ করলাম এবং আমরা বাগানের দিকে এগিয়ে গেলাম। সেখানে আমি সত্যি ওডেটকে পেলাম। একটি বড়ো মোটা কম্বল ঢাকা দিয়ে একটি অনাচ্ছাদিত সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছেন। তাঁর এতই পরিবর্তন হয়েছে যে, আমি তাঁকে চেনা দুষ্কর হয়ে পড়ত! তাঁর মুখাবয়ব প্রলম্বিত হয়েছে এবং তাঁর অন্ধকার চোখ যেন তাঁর নিস্তেজ মুখকে বিদ্ধ করেছে। একসময় সে বেশ সুন্দরী ছিলেন এখন আর তা নয়। একটু যেন দ্বিধাগ্রস্তভাবেই তিনি আমাকে পাশে বসতে বললেন। আমরা একাই ছিলাম। “আমাকে এই অবস্থায় দেখে তুমি নিশ্চয়ই বেশ অবাক হয়েছ”, অনেকক্ষণ পরে তিনি বললেন। “আসলে আমার ভয়ংকর অসুস্থতার পর থেকে, এই যেমন তুমি দেখছ, এরকমভাবে কোনো ছটফট না করে শুয়ে থাকতে হয়। আমি অনুভূতি আর দুঃখ নিয়েই বেঁচে আছি। আমি গভীরভাবে ওই নীল সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকি, যে-সমুদ্রের এই অসীম শৌর্য আমার কাছে মনোমুগ্ধকর। এই ঢেউগুলো যেন আমার মনে আসা কত মন খারাপের চিন্তা, কত আশা যা আমাকে ছেড়ে দিতে হয়েছে। আমি পড়ি, আসলে আমি অনেক পড়ি। কবিতার সুর আমার মধুর স্মৃতি জাগিয়ে তোলে, আমার সম্পূর্ণ অস্তিত্ব সজীব হয়ে ওঠে। সত্যি তুমি কত ভালো যে, এত বছর পরেও আমাকে ভোলোনি এবং আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছ! আমার সত্যি খুব ভালো লাগছে! আমি আগের থেকে অনেক ভালো অনুভব করছি। আমি এটা বলতেই পারি— পারি না কি?— যখন আমরা এত ভালো বন্ধু ছিলাম, তোমার কি মনে পড়ে এই জায়গাতেই আমরা টেনিস খেলতাম? আমি তখন বেশ সমর্থ ছিলাম; আমি সুখী ছিলাম। আজ আমার সেই সামর্থ্যও নেই; আমি আর সুখীও হতে পারব না। আমি যখন দেখি ভাঁটার টানে সমুদ্র সরে সরে যায়, অনেক দূরে, আমার তখন ভাঁটার স্রোতে আমাদের একা হাঁটার কথা মনে পড়ে। আমি যদি খুব দুষ্ট, খুব স্বার্থপর না হতাম, তবে আমার সেই মুগ্ধ মুহূর্তগুলির স্মৃতি আমাকে সুখী রাখার জন্য যথেষ্ট হত। কিন্তু, তুমি জানো, আমি যেন নিজেকে ছাড়তেই পারি না, এবং কোনো কোনো সময় আমার নিজের চেষ্টা সত্ত্বেও, আমার ভাগ্যের বিরুদ্ধে গর্জে উঠি। এই একাকিত্ব আমাকে উদাস করে তোলে, কারণ, সেই মা মারা যাওয়ার পর থেকেই আমি একা। আর বাবা, আমার কথা ভাবার জন্য বাবা বড়োই বৃদ্ধ ও অসুস্থ। আমার ভাই এক নারীর কাছে ভয়ংকরভাবে প্রতারিত হয়ে চরম আঘাত পেয়েছিল। সেই থেকে সে একাই থাকে। কোনো কিছুই তাকে ভোলাতে ও সান্ত্বনা দিতে পারে না। আমার ছোটো বোনটি এতটাই তরুণ, তাছাড়া আমাদের তাকে নিজের মতো সুখে বাঁচতে দিতে হবে।”

আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে তাঁর চোখ উজ্বল হয়ে উঠল। তাঁর বিশীর্ণ পাণ্ডুবর্ণ অদৃশ্য হয়ে গেল। তাঁর সেই বহুকাল পুরোনো মিষ্টি অভিব্যক্তি তিনি আবার ফিরে পেলেন। আবার তিনি সুন্দরী হয়ে উঠলেন। তিনি কী সুন্দরী ছিলেন! আমি তাঁকে জড়িয়ে ধরতে চাইতাম: তাঁকে বলতে চাইতাম, আমি তাঁকে কতটা ভালোবাসি… আমরা অনেকক্ষণ একসঙ্গে ছিলাম। সন্ধ্যার ঠান্ডা বাড়ছিল, তাই তাঁকে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হল। এবার তাঁকে বিদায় জানাতেই হবে, চোখের জলে আমার গলা রুদ্ধ হয়ে এল। সেই লম্বা অলিন্দ দিয়ে আমি হেঁটে গেলাম। সেই সুন্দর বাগানের নুড়িপথ আর আমি পেরোব না। আমি সমুদ্রতীরে নেমে পড়লাম; সেখানে কেউ ছিল না। শান্ত, নির্মোহ ভাঁটার জলের ধারে বিষণ্ণ আমি বেড়াতে লাগলাম। সূর্য অদৃশ্য হয়েছে; কিন্তু তার বেগুনি আকাশে ছড়িয়ে পড়েছে।

 

 

 

 

Facebook Comments

অনুবাদক: সঞ্চয়িতা পাল চক্রবর্তী 

মালদা নিবাসী সঞ্চয়িতা পাল চক্রবর্তী বর্তমানে উত্তর দিনাজপুর জেলার ইটাহারের ড. মেঘনাদ সাহা কলেজের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপিকা। ১৯৮৬ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর তাঁর জন্ম। তাঁর গবেষণার বিষয় নারীবাদ। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি বাঁকুড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের গবেষিকা। তাঁর বিভিন্ন রচনা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পত্রিকায় প্রকাশিত। বাংলা ও ইংরেজিতে অনুবাদও বিভিন্ন বইয়ে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর সাম্প্রতিক বই— ‘অনন্যাদের আখ্যান: ভাবনা কর্মে বাঙালি নারী’।

পছন্দের বই