লেখক নয় , লেখাই মূলধন

অনুবাদ

মিয়া কোউতো

আগুন

ভাষান্তর: শৌভ চট্টোপাধ্যায়

বুড়ি বসেছিল মাদুরের ওপর, নিশ্চল হয়ে অপেক্ষা করছিল কখন তার মরদ জঙ্গল থেকে ঘরে ফেরে। তার পা-দুটো দ্বিবিধ ক্লান্তিতে অসাড়— সময়ের ছোপলাগা গলিঘুঁজি ধরে হেঁটে আসার ক্লান্তি আর অতিক্রান্ত সময়েরও।

তার যা-কিছু পার্থিব সম্বল, ছড়ানো ছিল মাটির ওপরে: থালাবাটি, বেতের ঝুড়ি, একটা হামানদিস্তা। আর তার চারপাশে ছিল শূন্যতা, এমনকী হাওয়াও বইছিল সঙ্গীহীন, একা।

বুড়ো ধীর পায়ে ফিরে এল, যেমন তার অভ্যাস। রাখালের মতো, সে তার বিষণ্ণতাকে নিজের সামনে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে বহুকাল ধরেই, সেই যেদিন তার ছোট্ট ছেলেটাও না-ফেরার রাস্তা ধরে চলে গিয়েছিল, তাকে ছেড়ে।

‘মানুষটা কেমন কুঁকড়ে যাচ্ছে দিন-কে-দিন’, বুড়ি ভাবছিল। ‘যেন শুধু একটা ছায়া।’

হ্যাঁ, ছায়াই বটে। কিন্তু সে কেবল তার আত্মার ছায়া, কেন-না শরীর বলে আর বিশেষ কিছু অবশিষ্ট নেই তার। কাছে এগিয়ে এসে, পাশে পড়ে থাকা আর একটা মাদুরে বুড়ো নিজের শীর্ণতাটুকু জড়িয়ে নেয়। মাথা তুলে, বুড়ির দিকে সোজাসুজি না তাকিয়েই সে বলে:

‘আমি ভাবছিলাম।’

‘কী ভাবছিলে গো?’

‘যদি তুই মরে যাস, তাহলে এই অসুস্থ, অশক্ত শরীরে আমি কীভাবে তোকে গোর দেব?’

কাঠির মতো আঙুলগুলো মাদুরের ওপর বোলাতে বোলাতে সে বলে চলল:

‘আমরা গরিব। থাকার মধ্যে তো শুধু এই না-থাকাটুকুই। বল-ভরসা বলতেও তিন কুলে কেউ নেই আমাদের। আমার মনে হয়, আমরা বরং এই বেলা, নিজেদের কবর নিজেরাই খুঁড়ে রাখি।’

আবেগের বশে, বুড়ি অল্প হাসে:

‘বড়ো ভালো মানুষ গো তুমি! কপাল করে এমন মরদ পেয়েছিলাম, আমার আর ভাবনা কীসের!’

বুড়ো চুপ করে চিন্তায় ডুবে গেল ফের। বেশ কিছুক্ষণ পর, আবার মুখ খুলল সে:

‘যাই, দেখি যদি একটা কোদাল জোগাড় করতে পারি।’

‘কোথায় যাবে তুমি কোদাল খুঁজতে?’

‘দেখি ওদের দোকানে পাওয়া যায় কিনা।’

‘সেই দোকান অবধি ঠেঙিয়ে যাবে এখন? সে তো অনেক দূর।’

‘রাত্তির নামার আগেই ফিরে আসব।’

এমনকী নৈঃশব্দ্যও দমবন্ধ করে বসে রইল, যাতে তার মরদ ঘরে ফিরলে বুড়ি টের পায়। যখন সে ফিরল, ধুলোর ছেঁড়াফাটা কানাতে তখন সূর্যের শেষ আভাটুকু প্রতিফলিত হচ্ছে।

‘কী হল গো?’

‘অনেকগুলো টাকা খরচ হয়ে গেল’, আর সে তুলে ধরল তার হাতের কোদালখানা, যাতে বুড়ি ভালো করে দেখতে পায়। ‘কাল সকাল সকাল লেগে পড়ব তোর গোর খুঁড়তে।’

পাশাপাশি দুটো আলাদা মাদুরে শুয়ে পড়ল তারা। বুড়ির মৃদু গলা বুড়োকে বাধা দিল ঘুমে তলিয়ে যেতে:

‘কিন্তু, শোনো…’

‘কী?’

‘আমার শরীর এখনও ঠিকই আছে। খারাপ হয়নি তো!’

‘নিশ্চয় হয়েছে। বয়স কি কম হল?’

‘তাই হবে’, সে মেনে নিল। আর তারপর ঘুমিয়ে পড়ল দু-জনেই।

পরদিন সকালবেলা, বুড়ো খুব খর-চোখে নজর করছিল বুড়িকে।

‘তোকে মেপে দেখছি। যতটা ভেবেছিলাম, তুই দেখি তার চেয়ে আরও বড়ো।’

‘দুর, কী যে বলো! আমি তো এইটুকুন মোটে।’

কাঠের পাঁজার কাছে গিয়ে বুড়ি ক-টা লকড়ি টেনে বের করে।

‘কাঠ প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। আমি যাই, জঙ্গল থেকে কিছু কাঠকুটো কুড়িয়ে আনিগে।’

‘তুই যা বউ। আমি এখানেই থাকি, তোর জন্যে গোর খুঁড়ি।’

বুড়ি বেরিয়েই যাচ্ছিল, হঠাৎ যেন একটা অদৃশ্য হাত তার কাপুলানা১ ধরে টানল। আর, থমকে দাঁড়িয়ে, বুড়োর দিকে পেছন ফিরেই সে বলল:

‘শোনো। একটা কথা জিজ্ঞেস করি…’

‘কী চাই আবার?’

‘খুব যেন গভীর করে খুঁড়ো না গর্তটা। আমি ওপরের দিকেই থাকতে চাই, ঠিক ভুঁইয়ের নীচটায়, যাতে মনে হয়, হাত বাড়ালেই জীবনকে ছুঁতে পারব আবার।’

‘ঠিক আছে। তোর কবরে না হয় মাটি একটু কম দেব।’

দু-সপ্তাহ ধরে বুড়ো উদয়াস্ত ব্যস্ত রইল কবর খোঁড়ার কাজে। কাজ যত শেষের দিকে এগোয়, তত তার কাজের গতি কমে আসে। তারপর, হঠাৎ বৃষ্টি এল একদিন। গর্ত জলে ভরে উঠল। দেখে মনে হল একটা নির্লজ্জ কাদাজলের ডোবা। বুড়ো মেঘগুলোকে শাপশাপান্ত করতে লাগল, আর আকাশকেও, যে তাদের এখানে এনে জড়ো করেছে।

‘বোকার মতো কোরো না, পাপ লাগবে তোমার’, বুড়ি তাকে সাবধান করল। বৃষ্টি পড়েই চলল, শেষে কবরের দেয়াল ধসে পড়ার উপক্রম। বুড়ো গর্তের চারিদিকে ঘুরে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণটা আন্দাজ করার চেষ্টা করে। শেষে, ওইখানে দাঁড়িয়েই, সে সিদ্ধান্ত নেয় কাজ চালিয়ে যাবার। বৃষ্টির অবিশ্রান্ত ধারায় ভিজে একশা হয়ে, বুড়ো গর্তের মধ্যে নামে আর ওঠে, ক্রমশ বাড়ে তার গোঙানির আওয়াজ, আর খুঁড়ে তোলা মাটির পরিমাণ পাল্লা দিয়ে কমে আসতে থাকে।

‘বৃষ্টির মধ্যে থেকো না আর, চলে এসো। এভাবে পারবে না তুমি।’

‘বাজে বকিস না মাগি’, বুড়ো হুকুম করে। কিছুক্ষণ অন্তর, সে কাজ থামিয়ে দেখে নেয় আকাশের অবস্থা। আসলে সে দেখতে চায়, কার কাজ বাকি আছে বেশি, তার, না বৃষ্টির।

পরদিন, বুড়োর ঘুম ভাঙল তীব্র বেদনায়, যেন হাড়গুলো তার যন্ত্রণাক্লিষ্ট শরীরের আরও ভেতরে টেনে নিতে চাইছে তাকে।

‘বড়ো যন্তন্না রে গায়ে। উঠতে পারি না।’

বউ তার দিকে ফিরে মুখ থেকে ঘামের ফোঁটাগুলো মুছিয়ে দেয়।

‘তোমার সারা গা যে জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে একেবারে। কাল অত ভিজলে, ওই জন্যে।’

‘না রে বউ, তা নয়। আসলে আগুনের ঠিক পাশ ঘেঁষে শুয়েছিলাম কি না, তাই।’

‘কীসের আগুন?’

উত্তরে বুড়োর মুখ থেকে শুধু গোঙানির আওয়াজ বেরোয়। বুড়ি সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে: কোন আগুন দেখল তার মরদ, তারা তো কোনো আগুন জ্বালায়নি!

সে উঠল বুড়োকে একবাটি সেদ্ধ জাউ খেতে দেবে বলে। কিন্তু ঘুরে দেখে, বুড়ো ততক্ষণে উঠে পড়ে কোদাল খুঁজতে লেগেছে। সেখানা বাগিয়ে ধরে, পা ঘষটে বাইরে বেরোনোর তোড়জোড় করে। এক পা এগোয়, আর থমকে দাঁড়ায় শ্বাস নেবার জন্যে।

‘ওগো, যেয়ো না এভাবে। আগে মুখে কিছু দাও।’

বুড়ো শুধু হাত নাড়ল মাতালের মতো। বুড়ি তবু ছাড়ে না:

‘তোমার শরীরের এই হাল, ডান-বাঁয়ের হুঁশ নেই। বিশ্রাম নাও শুয়ে।’

বুড়ো ততক্ষণে গর্তের মধ্যে নেমে পড়েছে, আর কাজ শুরু করবে বলে তৈরি হচ্ছে। কিন্তু অসুখ তাকে তার জেদের শাস্তি দিতে ছাড়ে না, আচমকা মাথাটা ঘুরে যেতে তার মনে হল সারা দুনিয়া যেন চোখের সামনে নাচতে লেগেছে। হঠাৎ, সে চিৎকার করে উঠল হতাশায়:

‘বউ, বাঁচা আমাকে!’

গাছের কাটা ডালের মতো মাটিতে আছড়ে পড়ল বুড়ো, মেঘ ডাকল এমন যেন আকাশখানা দু-ফাঁক হয়ে ফেটে যাবে এইবার। বুড়ি দৌড়ে গেল বুড়োকে সাহায্য করবে বলে।

‘শরীর তো বেজায় খারাপ তোমার।’

হাত ধরে টানতে টানতে বুড়োকে এনে সে মাদুরে শোয়ায়। শুয়ে শুয়ে বুড়ো বড়ো বড়ো শ্বাস টানতে থাকে। সমস্ত প্রাণশক্তি যেন জড়ো হয়েছে ওইখানে, হাপরের মতো ওঠা-নামা করা পাঁজরগুলোর মধ্যে। জীবন যেখানে ঔজ্জ্বল্যে ঝলমল করছে, মৃত্যু সেখানে আসে আচমকা বজ্রপাতের মতো, কিন্তু এখানে, এই নিঃসঙ্গ মরুভূমিতে, মানুষ খুব চুপিসাড়ে ঢলে পড়ে মৃত্যুর ভেতর, যেভাবে পাখি তার ডানা ভাঁজ করে।

‘বউ’, কোথাও কোনো চিহ্ন রাখে না, এমন আবছা গলায় বুড়ো বলল, ‘আমি তোকে এভাবে ফেলে রেখে যেতে পারব না।’

‘কী করার কথা ভাবছ তুমি এখন?’

‘কবরটা তো ফাঁকা ফেলে রাখতে পারি না। তোকে মেরে ফেলা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই আমার।’

‘ঠিকই বলেছ। এত কষ্ট করে খোঁড়া গর্ত, যদি শুধুমুদু খালি পড়ে থাকে, তবে সে ভারি দুঃখের কথা।’

‘হ্যাঁ, তোকে মেরেই ফেলব আমি; কিন্তু আজ নয়, গতরে আজ জোর পাচ্ছিনে মোটে।’

বুড়ি তখন তাকে ধরে সোজা করে বসায়, আর এককাপ চা করে আনে।

‘আস্তে আস্তে খেয়ে নাও দিকি। খেলে ভালো লাগবে। কাল কত কাজ পড়ে আছে, তাকত না পেলে চলবে?’

বুড়ো ঘুমিয়ে পড়ে, আর বুড়ি বসে থাকে ঘরের দোরগোড়ায়। তার বিশ্রামের ছায়ায়, সে দেখে, আলোর রাজাধিরাজ সূর্যের শরীরও কেমন আস্তে আস্তে বিবর্ণ হয়ে আসছে। সারাদিনের ঘটনাগুলো সে মনে-মনে নাড়াচাড়া করে, আর তাদের বৈপরীত্যের কথা ভেবে তার হাসি পায়: সে, যার জন্মের কোনো নথিপত্রই নেই, কী নির্ভুল নিশ্চয়তায় আজ জেনে ফেলেছে নিজের মৃত্যুর তারিখ। যখন চাঁদ উঠল, আর তার আলোয় জঙ্গলের গাছগুলো স্পষ্ট দেখা যেতে লাগল, বুড়ি তখন সেখানেই গা এলিয়ে দিল, আর তলিয়ে গেল ঘুমের ভেতর। সে স্বপ্ন দেখল এখান থেকে অনেক দূরের কোনো সময়ের: যেখানে তার ছেলেমেয়েরা রয়েছে, যারা মরে গেছে আর যারা বেঁচে আছে তারাও, মাচাম্বা২ ভরে উঠেছে ফসলে, সেই শ্যামলিমার গায়ে তার দৃষ্টি পিছলে যাচ্ছিল। বুড়োও রয়েছে সকলের মাঝখানটিতে, গলায় টাই বাঁধা, গল্প বলছে বিছানায় শুয়ে। সবাই রয়েছে সেখানে, তার ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনি। জীবন রয়েছে, ধীরে ধীরে প্রস্ফুটিত হচ্ছে সে, কত অজস্র প্রতিশ্রুতির জন্ম হচ্ছে তার গর্ভে। সেই হাসিখুশির মেলায়, সবাই সত্যি বলে মেনে নেয় বড়োদের সমস্ত কথা, কারণ, ভুল তারা করতেই পারে না, আর কোনো মা-ই মৃত্যুর সামনে মেলে ধরে না নিজের রক্ত-মাংস। সকালের হরেক শোরগোল একসময়ে তাকে তার নিজের ভেতর থেকে ডেকে তুলতে চাইল, কিন্তু ঘুমের শেষ রেশটুকু ছেড়ে আসতে কী ভীষণ অনীহা তার। রাত্রিকে সে অনুনয় করে আরও কিছুক্ষণ থাকার জন্য, যাতে তার স্বপ্নগুলো আর একটু দীর্ঘস্থায়ী হয়। ঠিক ততখানি আকুতি ঝরে পড়ে তার গলায়, যতটা আকুতি নিয়ে সে একদিন জীবনের কাছে মিনতি করেছিল, তার সন্তানদের যেন সে তার কাছ থেকে কেড়ে না নেয়।

আলো-আঁধারির ভেতর, বুড়ি তার স্বামীর হাতখানা ধরতে চাইছিল, যদি এই তীব্র কষ্টের কিছুটা সুরাহা হয়। যখন তার হাত ঠেকল বুড়োর গায়ে, তখন দেখল তার শরীর একেবারে ঠান্ডা, এতটাই ঠান্ডা যে মনে হচ্ছিল বুড়ো বুঝি সেই আগুনের থেকে বহু দূরে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে, যে-আগুন কখনো জ্বালেইনি কেউ, কোনোখানে।


কাপুলানা: মেয়েদের লম্বাঝুলের পোষাক, কতকটা সারং-এর মতো
মাচাম্বা: ছোট একফালি চাষের জমি

Facebook Comments

অনুবাদক: শৌভ চট্টোপাধ্যায়

শৌভ চট্টোপাধ্যায়ের (১৯৮৩-) জন্ম ও বেড়ে ওঠা হাওড়ার শিবপুরে। পড়াশোনার সুবাদে কিছুদিন লাখনৌ-তে বসবাস। এবং, বর্তমানে, কর্মসূত্রে দিল্লির বাসিন্দা। প্রায় দেড়-দশক যাবৎ কবিতা লিখছেন। কবিতা প্রকাশিত হয়েছে অনুবর্তন, কৃত্তিবাস, কৌরব, দাহপত্র, নতুন কবিতা, শুধু বিঘে দুই, যাপনচিত্র ইত্যাদি নানান পত্রপত্রিকায়। এ-যাবৎ প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা পাঁচ— ‘অনন্ত-র ঘরবাড়ি, হাতিঘোড়া ও অন্যান্য’ (২০০৯, ডি কোং), ‘মুনিয়া ও অন্যান্য ব্যূহ’ (২০১৩, নতুন কবিতা), ‘মায়াকানন’ (২০১৬, সৃষ্টিসুখ), ‘নিঃশব্দে অতিক্রম করি’ (২০১৯, শুধু বিঘে দুই) এবং ‘পবিত্র নববিধান’ (২০২১, সৃষ্টিসুখ)। যুক্ত ছিলেন ‘অবসরডাঙা’ ও ‘ব্রজী’-নামক দু-টি পত্রিকার সঙ্গেও।

পছন্দের বই